শিশিরসিক্ত সুখকাব্য উইলিয়াম ট্রেভর

অনুবাদ : মেহবুব আহমেদ

 

ক   খন ঘুম ভাঙল মেরি বেলার মনে নেই, জেগে দেখেছে, ও আসেনি। স্টেশন থেকে উড্স টেলিফোনে জানিয়েছিল, ট্রেন আসতে দেরি হবে। ততক্ষণে প্রায় দশটা বেজে গেছে, সোফায় বসে অপেক্ষা করতে করতে ও নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছিল, বিছানায় যাওয়ার কথা মনে নেই।

আলো দেখে বুঝতে পারছিল ভোর হতে দেরি আছে। ঠান্ডা বাতাস আসছিল আধখোলা জানালা দিয়ে, কম্বলটা ও গায়ে টেনে নিল। এলে এ-ঘরেই আসত, ওরা দুজনের জন্যে গুছিয়েছিল এ-ঘর। ড্রেসিং টেবিলের ওপর ফুলদানিতে প্রিমরোজ। এসেছিল নাকি ও!

আবার ঘুমিয়ে পড়ে মেরি বেলা, স্বপ্ন দেখে ও আসেনি। ট্রেনের দেরির কথা ঠিক নয়, উড্স একা ফিরে বলেছে ট্রেন থেকে অপরিচিত কাউকে নামতে দেখেনি, তাও ঠিক নয়। কিন্তু সকালে নিচে খাবার ঘরে যেতে দরজায় এক অচেনা গলা শুনতে পেল, মেরি বেলার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘তোমাকে দেখেই চিনেছি কীভাবে বলত।’ পরে স্কুলঘরে বসে বলেছিল সারাটা গ্রীষ্ম তাদের সামনে আছে, অনেক কিছু করবে ওরা।

প্রথম দিন পড়ার পরই মেরি বেলা নার্সারির নাম দিয়েছিল পাঠশালা। বস্ন্যাকবোর্ডের কাজ চালাবার জন্যে উড্স সেস্নট জোগাড় করে এনেছিল; কিন্তু দরকার ছিল না, কত রকমের খাতা, লেখার কাজ খাতায়ই চলত। সে-গ্রীষ্মে মেরি বেলার বয়স বারো, সেপ্টেম্বরে তেরো হলো।

নীল জার্সি আর নীল শার্ট পরত ও, সঙ্গে টুইডের টাই আর হুইপকর্ড ট্রাউজারস। মেরি বেলার মা বলতেন, ওকে তাঁর Gone with the Wind-এর লেসলি হাওয়ার্ডের মতো লাগে। বাবার বিশ্বাস ছিল, ছেলেটি তাঁর মেয়েকে ইভ্লিনসকোর্টের যোগ্য করে দিতে পারবে, ওই জন্যই তো ওর আসা। প্রতিদিন বারোটা বাজতে ছেলেটি উঠে পড়ত, বলত, সকালের জন্য যথেষ্ট। তারপর ওরা খামার ঘুরে ঘুরে কোথায় কী হচ্ছে দেখে বেড়াত। পরে বিকেলে ঘোড়ায় চরে ওরলি এজে যেত, কখনো-বা যেত স্টিল ফেলে বা হেঁটে চলে যেত গ্রাটান সমাধিতে।

একবার দেখেছিল বেশ কজন অশ্বারোহী এ-অঞ্চলের বিশাল প্রান্তরে পালস্না দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছে, ওর তখন হিদক্লিফের কথা মনে পড়ছিল, কথাটা মেরি বেলা বুঝতে পারেনি। ওরা হাঁটাপথে একে অন্যকে পড়ে শোনাত, যার যেটা পড়ার সেভাবেই বেছে নিত।

এ-গ্রীষ্ম যে একদিন শেষ হবে – চিন্তাটা ব্যথিত করত মেয়েটিকে; ছেলে বলত, কখনো শেষ হবে না, কারণ স্মৃতি তাকে বাঁচিয়ে রাখবে।

 

অ্যান্টনির বয়স তখন বাইশ বছর, ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়েছে, তেমন বিশিষ্ট কোনো ফল করেনি এবং কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না; তারপর একটি বিজ্ঞাপন দেখে মনে হলো কিছু না করার চেয়ে মাসকয়েক গ্রামাঞ্চলের একটি বাচ্চাকে পড়ানো বরং ভালো। ও চিঠি লিখল। উত্তরে যে-চিঠিটি পেল সে এক শিক্ষিত মানুষের লেখা। কাজটা নিলে ওর কী কী অসুবিধে হতে পারে তা পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে। আমরা মুরল্যান্ডের কাছেই থাকি এবং বলা চলে আরো প্রত্যন্ত অঞ্চলে, এখানকার নিঃসঙ্গতাবোধ শ্বাসরুদ্ধকর মনে হতে পারে।

জায়গাটা কিন্তু অত ভয়াবহ মনে হলো না অ্যান্টনির। ওদের ওল্ড গ্রানজ নামের বাড়িটা এতটা জাঁকাল হবে, ওর ধারণায় ছিল না এবং সমৃদ্ধ ছিল খামার। জায়গাটার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর ওর খুব ভালো লাগছিল। আর মেরি বেলাকেও ওর ভালো লেগেছিল, মেয়েটি তীক্ষন বুদ্ধিসম্পন্ন এবং প্রাণবন্ত, বয়সের তুলনায় ছোট। স্মিত হাসি যেমন হাসত, তেমন সরব হাসিও। ওর চেহারায় সৌন্দর্য ফুটে উঠতে শুরু করেছে; কিন্তু ব্যবহারে শিশুসুলভ ছাপ নষ্ট হয়নি। পড়তে বসে ভূগোলে ও আনন্দ পেত না, আর জ্যামিতির সরল রেখা ও অসম বাহুবিশিষ্ট চতুর্ভুজ তাকে আকর্ষণ করত না। ওর কল্পনা পাখা মেলত ইতিহাসে; কবিতা ও সহজেই বুঝত; শব্দ ও বানানের ক্ষেত্রে ওর একটা পদ্ধতি ছিল। আর সেবারের বৃষ্টিবিহীন উষ্ণ গ্রীষ্মে ওর এমন একটা অনুরাগ তৈরি হলো অ্যান্টনির জন্যে, যা সে না বোঝার ভান করতে পারল না বা ঝেড়েও ফেলে দিতে পারল না। তাই সেপ্টেম্বরের শুরু থেকেই তার এতটাই অস্বসিত্ম হচ্ছিল যে, নিজের কাছে অস্বীকার করতে চাইলেও পারল না। মেরি বেলার তেরো বছর পূর্তির পরদিন অ্যান্টনি ওল্ড গ্রানজ ছাড়ল। কতবার ওরা মুর অঞ্চলে বেড়াতে গেছে, মেরি বেলা কত পাখি চিনিয়েছে ওকে, কত অন্তরঙ্গ আলোচনা ওরা করেছে, কিন্তু এ সবকিছুর চেয়েও অনেক অনেক বেশি পেছনে ফেলে চলে গেল অ্যান্টনি। খামারকর্মীদের সঙ্গে কত সময় কত কাজ ও করেছে, পরিবারের সঙ্গে কত ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছে, এসবের চেয়ে আরো অনেক বেশি পড়ে রইল পেছনে। অ্যান্টনি কি ভুলে যাবে কত ব্যথিত ছিল মেরি বেলা ও চলে যাবে ভেবে, ওর যাওয়ার দিনে আর যখন ওরা বিদায় নিল একে অপরের কাছ থেকে কী যে হতাশা ছিল ওর চোখে, সবই ফেলে গেল তবে, ও বুঝেছিল এসব ভুলে যাওয়া অসম্ভব। কিন্তু অ্যান্টনি ভুলে গেল। ও ভুলে যেতেই চাইল। মনে হলো, ভুলে যাওয়াই ওর জন্যে ভালো হবে।

ইভলিন্সকোর্টের প্রবেশ পরীক্ষায় সহজেই পাশ করে গেল মেরি বেলা। ওর মা তার সময়ে এখানে ভালো কাটিয়েছিলেন; কিন্তু ওর ভালো লাগল না। পাঠশালার গ্রীষ্মের কথা প্রায় সবসময় মনে পড়ত, ওরকম কিছুই ও ইভলিন্সকোর্টে পেল না। সেই গ্রীষ্মের কথা ও কাউকে বলতে চাইত না এবং বলত না। অ্যান্টনির সঙ্গে ও ঘোড়ায় চড়ে কিছু জায়গায় যেত, ছুটিতে বাড়ি এসে ও একাই ঘোড়া নিয়ে যেত সেসব জায়গায়; কিন্তু ফিরে এসে মনের কথা গোপন করত। ছুটির কাজের নাম করে কালির দাগ লাগা টেবিলে ছড়ানো বই পড়ে থাকত, ওদিকে খেয়ালই করত না; অ্যান্টনির সঙ্গে যে আর কখনো দেখা হবে না – এ-কথা ও মেনে নিয়েছিল; কিন্তু ওর গলার স্বর তো ছিল ওখানে আর তা যেন সবসময়ই থাকবে – অ্যান্টনি বলছে জোয়ান অব আর্কের কথা, এলিজাবেথ টিউডরের কথা, তাকে সে বলত নিঃসঙ্গ রানী, আরো বলত পার্লামেনের কথা, মারি আঁতোয়ানেতের কথা আর ও চলে যেত মার্শালসিতে, ডার কোট মিলে এবং ওয়াইল্ড ফেল হলে অথবা হাওয়ার্থ গ্রামের ছোট গির্জাটি জীবন্ত রূপ নিয়ে ধরা দিত চোখে।

 

অ্যান্টনি মানচিত্রকর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলো এবং এ-পেশায় আগেই কেন আসেনি ভেবে আশ্চর্য হতো; কাজটা ওকে এতটাই আকর্ষণ করত যে, ও মনপ্রাণ ঢেলে দিতে পারত এবং আরো দেখল যে, এ-কাজে ওর দক্ষতা যেমন আছে, তেমন সহজাত গুণও আছে। ওল্ড গ্রানজে অ্যান্টনি কয়েক মাস মাত্র ছিল। এর কয়েক বছর পর একটা পার্টিতে এক মেয়ের সঙ্গে ওর দেখা হলো। লম্বা, পাতলা, সাদা চুলের মেয়েটির নাম নিকোলা। ওদের পরিচয় ঘনিষ্ঠ হওয়ার পর অ্যান্টনি দূরে কাজ পেলে নিকোলা সঙ্গে যেত। আব্রম্নৎসি অঞ্চল এবং আফ্রিকার নতুন কিছু শহরে ওরা গেছে, জায়গাগুলো আগে মানচিত্রে চিহ্নিতই ছিল না, ওরা নবনির্মিত জার্মানিতে গেছে এবং নিকোলা ছবি তুলে ওকে সাহায্য করেছে। ইংল্যান্ডের পুরনো রাস্তা বদলে গিয়ে যখন গাড়ির রাস্তা তৈরি হলো, তখনো নতুন মানচিত্রের কাজে ওরা গেছে। সময়মতো ওরা বিয়ে করল, দুটো মেয়ে হলো এবং লন্ডনের গাছগাছালিভরা বারনেস নামের এক শহরতলিতে বাড়ি নিল। মাতৃত্বের সন্তুষ্টি এবং অ্যান্টনির একাগ্র ভালোবাসায় নিকোলার সৌন্দর্য স্নিগ্ধ আত্মবিশ্বাসে সমৃদ্ধ হলো। অ্যান্টনি একাই কাজে যায় তবে যাওয়ার চেয়ে ফিরে আসতেই বেশি পছন্দ করে। প্রতিবার ফিরে মনে হতো বাচ্চারা একটু বদলে গেছে এবং ওই ছোট পরিবারেরই একটা দিক যেন বেড়ে গেছে। ওর অনুপস্থিতিগুলো ভালোবাসা জিইয়ে রাখত আর নতুন নতুন কাজে সম্পৃক্ত বাচ্চাদের দেখার আকর্ষণ কখনো কমে যেত না। সারা সপ্তাহ বাচ্চারা লক্ষ্মী হয়ে চললে শনিবারে ওদের নিয়ে রিচমন্ড পার্কে যাওয়া হতো, পরে মেইডস অব অনারে থাকত চা-পর্বের আনন্দ। রোববারে নিকোলার মা সারাদিনের জন্য মেয়েদের নিয়ে যেতেন তবে ওরা যেন স্নেহের আধিক্যে নষ্ট না হয় সেদিকে তার সতর্ক দৃষ্টি ছিল, তিনি সন্ধের দিকে ফিরিয়ে আনতেন ওদের। ওরা চারজনই যে কত ভাগ্যবান, এ-কথা অ্যান্টনি প্রায়ই বলত আর নিকোলাও বলত। অন্য কাউকে বিয়ে করলে বিবাহিত জীবন কেমন হতো বা বাচ্চারা কতটা অন্যরকম হতো এ-কথা কেউ কখনো ভাবেনি। ওরা যে একে অন্যকে বিয়ে করেছে এ-ই যথেষ্ট ছিল এবং আর কিছু চাইবারও ছিল না। ‘ওদের ওল্ড গ্রানজের কথা বলো’, প্রায়ই নিকোলা অনুরোধ করত আর অ্যান্টনি তখন স্মৃতি থেকে মনে করে মেয়েদের শোনাত।

ওরা প্রতিবারই শুনত, আর নিকোলাও শুনত, বলত কী যে ভালো লাগে শুনতে, মেয়েরা সায় দিত ওর কথায়।

 

মেরি বেলার মায়ের যেদিন ষাট বছর পূর্তি হলো সেদিন সকালে তিনি হঠাৎ করেই মারা গেলেন, মৃত্যুর ইঙ্গিতবহ কোনো অসুস্থতা তাঁর ছিল না। তখন মেরি বেলার বয়স চবিবশ, ইভলিন্সকোর্ট শেষ করে ওল্ড গ্রানজেই আছে এবং ওখানে ভালোই আছে। সহজেই ও মায়ের স্থান গ্রহণ করল, আগের মতোই ওর বাবা আরাম আর সুবিধা পেলেন ঠিকই কিন্তু হঠাৎ ঘটে যাওয়া নিদারুণ দুঃখটা মেনে নিতে পারলেন না। তাঁর স্বভাবজাত রসিকতাবোধটাও আর ফিরে পেলেন না, বাড়ি ও খামারের প্রতি যে-স্নেহ ছিল তাও হারিয়ে ফেললেন। গভীর বিষণ্ণতা থেকে মদ্যপান ধরলেন আর যেন হারানো সুখের সন্ধানে বেপরোয়া ঘোড়দৌড় করে ফিরতেন। একদিন তিনি ফিরলেন না; পরে ঘোড়া একা ফিরে এলে তাঁর খোঁজ পাওয়া গেল। বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিলেন, আর চেতনা ফিরে পেলেন না, সম্ভবত এরকমই কিছু চেয়েছিলেন।

মেরি বেলা ওল্ড গ্রানজ বিক্রি করে দিতে পারত, নতুন মালিকের হাতে দিয়ে দিতে পারত তার ছোটখাটো কর্মীবাহিনীসহ মাংস ও পশমের জন্য পালিত দুই জাতের কয়েক সহস্র মেষ এবং ঘোড়া। কিন্তু ও আগের মতোই চলতে লাগল এবং বাবার মৃত্যু-পরবর্তী নিঃসঙ্গ কিছু মাস এক বয়সী অন্ধ কুকুরকে সঙ্গী করে পাঠশালায় বসে সময় কাটিয়ে দিত। ও জানত যে, ও অতীতে বাস করছে এবং আরো জানত যে, ওই অতীত ওখানে সবসময়ই ওকে ঘিরে থাকবে আর ও নিজে অতীতেরই অংশ।

ইয়র্কশায়ারের মুরে যে অ্যান্টনি আবার গেল সে কোনো আবেগবশত ঘটনা নয়। হঠাৎই ওর কাজ পড়ে গেল ওখানে, আর একদিন সকালে যখন দেখল যে ওরলি এজের কাছেই ও আছে তখন কেমন কৌতূহল-মেশানো উত্তেজনায় গাড়িটা ওল্ড গ্রানজের মাইলখানেকের মধ্যে রেখে পাঁচিলঘেরা বাগান আর খামারবাড়িগুলোর পাশ কাটিয়ে হাঁটতে লাগল। নিস্তব্ধ ছিল সমস্ত এলাকাটা অথচ ওর মনে আছে উঠোনের ক্রমাগত শব্দ, হইচই, ব্যস্ততা – বেমানান লাগছিল এই প্রশান্ত ভাব। কেন যেন নিজের অজামেত্মই সবার চলার যে-পথটা ওর মনে ছিল সে-পথেই হাঁটতে লাগল।

এপ্রিলের প্রথম দিকের সুন্দর সকাল। সেই বিশাল প্রান্তরে মেষপাল ছাড়া কিছু ছিল না। ঘোড়দৌড় নেই, একটা জনমানব গ্রাটান সমাধিতে উঠছে না, তবু দূরে যেন চলমান একটা শব্দ আছে – অ্যান্টনি বুঝতে পারল এবং এসব ও দেখবে আশা করেছিল। হাঁটতে হাঁটতে যেসব জায়গায় ওরা বসত, যেখানে ও মেরি বেলাকে উদারিং হাইটস থেকে পড়ে শুনিয়েছে অথবা দি চাইমস থেকে মেরি বেলার পড়া শুনেছে, যেখানে বলেছিল কেবল ফরাসিতে কথা হবে, সেসব ওর মনে পড়ল।

স্টিল ফেল-এ পৌঁছাবার আগেই ও ফিরে এলো। কিছু বিশেষ ঘটনা মনে ছিল বলে স্মৃতিবিভ্রম হচ্ছিল, একবার মাত্র ঘোড়দৌড় দেখেছিল এই বিশাল প্রান্তরে, এই সময় তো ওরকম কিছু আশা করা যায় না আর বহুদিন আগে যে বালিকাটিকে ও পড়িয়েছিল সে তো নিশ্চয়ই এই প্রত্যন্ত গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। ও ঘুরে দাঁড়িয়ে যে-পথে এসেছিল সে-পথেই ফিরে যেতে যেতে মুহূর্তের জন্য ইতস্তত করল, তারপর দুপাশের গাছগাছালির ভেতরের দুটো ছাইরঙা পিলার পার হয়ে ঢুকে পড়ল।

সেই বড়, চওড়া সামনের দরজা ঠিক আগের মতোই রোদে-জ্বলা বিবর্ণ হয়ে আছে। ও পাশের দরজাটায় গেল – এতে কড়া বা ঘণ্টি কিছুই নেই, তবে দরজাটা কেবল রাতে বন্ধ থাকে। ঠেলে ঢুকেই চোখে পড়ল করিডোরের এক দেয়াল জুড়ে সার্কাস রিংয়ের ওপর ট্র্যাপিজ খেলার আগের সেই ছবি; দীর্ঘ, শীতল করিডোর গিয়ে শেষ হয়েছে রান্নাঘর আর বাসন ধোয়ার ঘরে। কয়েকটি গলার স্বর ভেসে আসছিল, মাঝে মাঝে ছুরি-কাঁটা নামিয়ে রাখার শব্দ হচ্ছিল। অ্যান্টনি হ্যালো বলতেই সব শব্দ থেমে গেল। কালচে চুলের নীল পোশাক পরা একটি মেয়ে পেছন ফিরে তাকাল ওর দিকে।

ও আবার হ্যালো বলতেই মেয়েটি উঠে দাঁড়াল আর সঙ্গে সঙ্গে ওর মনে হলো এইতো মেরি বেলা।

‘এ কি আশ্চর্য’, বলে ওকে সম্ভাষণ জানাল মেরি বেলা। অন্যদের মধ্যে দুজন বয়স্ক লোক উঠে দাঁড়িয়ে মাথা ঝোঁকাতে অ্যান্টনি হাত মেলাল ওদের সঙ্গে।

মেরি বেলা আনন্দের সুরে বলে, ‘তুমি লাঞ্চে এসেছ, তাহলে’, ওর এই ভঙ্গিটা অ্যান্টনি ভোলেনি। কানায় কানায় উপচেপড়া হাসি মেরি বেলার সমস্ত চেহারায় প্রাণসঞ্চার করল। আগে ওর চুল লম্বা ছিল, মাঝে মাঝে বেনি করত, এখন গুছিয়ে পেছনে টেনে আঁচড়ানো।

দাঁড়িয়ে-পড়া একজন অ্যান্টনির জন্য চেয়ার টেনে দিয়ে বলল, ‘সব ভালো তো স্যার?’

‘এটা ভেড়ার হাঁটুর নিচের অংশ’, চামচ দিয়ে পেস্নটে তুলতে তুলতে বলল মেরি বেলা।

সবার খাওয়া শেষ। বয়স্ক দুজন অ্যান্টনি যখন ছিল সে-সময়ের কথা কিছু বলল। তারপর সবাই হাতে হাত মিলিয়ে একসঙ্গে বেরিয়ে গেল।

বিস্ময় কাটছে না মেরি বেলার, অ্যান্টনিকে, দেখতে দেখতে গুনগুন করে বলে, ‘ঈশ্বর’, ওর দেখার এই ভঙ্গিটাও ভোলেনি অ্যান্টনি।

 

বেশ কিছুদিন ওখানে থেকে গেল অ্যান্টনি কিন্তু লন্ডনে ফিরে গিয়ে তাতে ও বিস্ময়বোধ করল না। মেরি বেলা যখন মিনতির সুরে বলেছে, ‘চলো আমরা হেঁটে আসি’, তখন অ্যান্টনির মনে হয়েছে ওরা একসঙ্গে হাঁটবে এ তো স্বাভাবিক, আগের চেনা পথে ওর হাঁটতে যাওয়া উচিত আর মেরি বেলা ওকে পাঠশালায় নিয়ে যাবে তাও তো স্বাভাবিক। যেখানেই যাক ঘণ্টার পর ঘণ্টা যে কেটে যাবে এ তো জানা ছিল না।

ওর মায়ের মৃত্যুর কথা শুনল অ্যান্টনি আর তার পরপরই বাবার। মেরি বেলা বলেছিল, একমাত্র সন্তানের ভাগ্যই এরকম, উত্তরাধিকারের প্রাপ্ত সম্পত্তি প্রত্যাখ্যান করা যায় না, গ্রহণ করতেই হয়। অভিযোগ করছিল না ও, গলার স্বরে ওরকম কিছু ছিল না, বরং হাসিমুখেই বলছিল, যেন একা বলেই সবই ওর দেখতে হচ্ছে। স্মিত হাসি তো প্রায় আছেই মুখে আর কখনো জোরেও হাসছে।

বলেছিল, ‘ভাবতাম আর কি আসবে তুমি?’

সেই ফুলতোলা চায়না কাপে চা বানাল মেরি বেলা, আর ওর মা সব সময় করতেন যে-কেকটা সেটাই। অ্যান্টনি জানাল, ও মানচিত্রকর হয়েছে।

আগে একজন খেতে আসতে পারেনি, সে এলে রোগা, ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া চেহারার এই লোকটাকে অ্যান্টনি চিনতে পারল – এই লোকই অ্যান্টনির অপেক্ষায় প্রায়ান্ধকার স্টেশনের পস্ন্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ছিল, ট্রেন সেদিন খুব দেরিতে পৌঁছাল।

‘গাড়িটা দেখে ভাবলাম কে হতে পারে?’ ওর অস্থির গলার স্বর একটুও বদলায়নি।

পথক্লান্ত অ্যান্টনি মেলটন মোব্রের কাছের একটা গ্রামে থামল। তারপর এক হোটেল বারে একটা ড্রিঙ্ক নিল এবং আরেকটা নেওয়ার পর আর গাড়ি চালাতে চাইল না, রাতটা হোটেলেই থাকল। স্বপ্নে দেখল, পাঠশালাটা আগের মতোই আছে, শব্দ বন্ধ করার জন্য কীলক দিয়ে আঁটা জানালা, আগুন জ্বালাবার চুলিস্নতে রাখা কাঠের টুকরোয় বিন্দু বিন্দু ময়লা। মেরি বেলা একবার আবৃত্তি করেছিল, ‘সাদাটে উইলো, কাঁপছে পপলার, গোধূলিতে শিরশিরে হালকা হাওয়া।’ একবার মেরি বেলার বাবা ওকে ঘুম থেকে উঠিয়েছিলেন; একটা গরুর বাচ্চা হবে, একা পারছিলেন না। কাজ শেষে একসঙ্গে বসে ড্রিঙ্ক করতে করতে ভোর হয়ে গিয়েছিল। আধখোলা চিঠিপত্র হলঘরের টেবিলে ছড়ানো থাকত। যত্রতত্র ঘড়ি, কোনোটারই সময় ঠিক নেই।

সকালে অ্যান্টনি বুঝতে পারল ওর যাওয়া উচিত হয়নি। ওর হাতে লেখা খামে একটা চিঠি এলো। একা হলে পড়বে বলে চিঠিটা মেরি বেলা আয়নার টেবিলে রেখে দিলো। অ্যান্টনি আসার পর ও বলেছিল, ‘তোমার এত ধৈর্য আমি আগে ভাবিনি, কিন্তু তোমার নিশ্চয়ই ধৈর্য আছে।’

ওর মনে আছে, অ্যান্টনি একবার বলেছিল, ধৈর্য প্রয়োজনীয় গুণ এবং চিঠিটা একই জায়গায় রেখে ও যখন সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করেই রইল ওর মনে হলো কথাটা হয়তো সত্যি। শেষে চিঠিটা পড়ল ও। ‘তোমাকে আবার দেখলাম, কী যে আশ্চর্য লাগল। বাড়িটা ছাড়িয়ে আসতে আসতে ভাবছিলাম, সময় যেখানে থমকে আছে সে থাক সেখানেই; কিন্তু একথা ভেবে ফিরে গেলে নিজেকে মাফ করতে পারতাম না।’

লিখেছে, ‘কত মায়া তোমার, তোমার বাবা-মার সেই      আতিথেয়তাই মনে হলো।’ ও ভাবছিল অ্যান্টনি ওকে বলেনি কোথায় থাকে, চিঠিতে ঠিকানার জায়গায় শুধু লন্ডন লেখা। বিয়ের কথা কিছু না বললেও মেরি বেলা বুঝতে পেরেছে ও বিবাহিত। ভাবছিল, ছেলেমেয়ে, আছে কিনা।

মূল্যবান চিঠি, চিঠিটা ও ভাঁজে ভাঁজে ভাঁজ করে রেখে দিলো। নাই পারল উত্তর দিতে, ও তো ফিরে এসেছে।

 

ব্যাপারটা অ্যান্টনি ঘটায়নি। আগে যা অসম্ভব ছিল এবং এখন আর নেই তারই যোগসূত্রতায় ঘটনাটা ঘটেছে, এ-কথাই ভেবেছিল অ্যান্টনি; কিন্তু তাতে অন্য কোনো ফল তো হওয়ার নয়। সব ও ঠেলে সরিয়ে দিতে চেয়েছে, পাশ কাটিয়ে গিয়ে। সে-সময়টাকে অস্বীকার করতে চেয়েছে; তাছাড়া সহজেই এবং স্বাভাবিকভাবেই প্রতিবাদী হতে পারত; কিন্তু দেখল যে কোনোটাই পারছে না। ইতোমধ্যে বহু কিছু জমা ছিল ওখানে। ওরা দুজন আবার যখন সেই বিশাল প্রান্তরে হেঁটেছ, সবাই চলে যাওয়ার পর যখন চা বানিয়েছে মেরি বেলা, পাঠশালায় ও যখন মেরি বেলাকে চেয়েছে তখন কতশত মুহূর্ত কত না বিচিত্র বর্ণে রঞ্জিত হয়ে উঠল।

মনে মনে অ্যান্টনি ভাবে, সেই বিশাল প্রান্তরে ফিরে গিয়ে ও একা হাঁটতে পারত, দূর থেকে বাড়িটা দেখতে পারত, খামার দেখতে পারত, ঘোড়ায় চড়ে একাই ঘুরে বেড়াতে পারত। এসবই হতে পারত। কিন্তু অ্যান্টনি গিয়ে সোজা বাড়িতে উঠল আর তারপর থেকেই তো যাচ্ছে।

 

বিভ্রান্তির মধ্যে দিন কাটতে লাগল নিকোলার, তবু মনে হতো ব্যাপারটা তেমন কিছু নয়। তারপরও সকালবেলা ঘুম ভাঙার পর অস্বসিত্ম বোধ করত; কিন্তু ভাবতে চাইত না। দিনের বেলা আপনমনে ঘরদোর পরিষ্কার, রান্নাবান্না এবং বাজার করতে করতে ওর চিরদিনের প্রশান্তির খোঁজ করে ব্যর্থ হতো। ও বিশ্বাস করতে চাইত যে, অজানা ভাবনাটাকেই ও ভয় পাচ্ছে, কিন্তু পারত না। অশান্তি কমে না, ভয় থেকে মুক্তি নেই।

 

একখ- লম্বা, চ্যাপ্টা পাথর গ্রাটান সমাধিকে চিহ্নিত করেছে আর সমাধিটা ছিল একটা ছোট পাহাড়ের ওপর, এখন চারপাশের ঘাসের জমি থেকে তেমন বিশেষ উঁচু নেই সে-পাহাড়, পাথরটার অনেকটাই পড়ে গিয়ে কাত হয়ে রয়েছে তার ওপর। পাথরটায় খোদাই করে কিছু লেখা নেই। কথা থেকে জানা যায়, সমাধিটা এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির – সে নাকি এক নিঃসঙ্গ, উন্মত্ত এবং ভয়াবহ চেহারার মানুষ – হয়তো প্রাচীনকালের কোনো গোষ্ঠীপ্রধান ছিল।

‘দেখো, অতীত কিভাবে ধরে রাখে!’ অ্যান্টনির এবক্তব্য যে অলিখিত পাথরখ- থেকে প্রণোদিত নয় মেরি বেলা তা বুঝতে পারে; অ্যান্টনি বলছে ওদের দুজনের অতীতের কথা। শব্দে প্রকাশ পাওয়ার আগেই দেখা গেছে, ওরা দুজন একই চিন্তা করছে। মেরি বেলা ভাবে ওদের মাঝখানের বিচ্ছেদের কথাটা অ্যান্টনিরও নিশ্চয়ই মনে হয়। যেন অ্যান্টনি নয়, অন্য কেউ ওর অন্য জীবনটা যাপন করেছে, এই বিলাসী কল্পনা ওদের দুজনের মনেই ছিল।

আগস্টের মেঘমুক্ত আকাশ। মেরি বেলার জানা সুন্দর দিনগুলোর মতো এই আরেকটা দিন। সহজেই বাড়তে পারে সেভাবেই কাটা হয়েছে সমাধির চারপাশের ঘাস, মেষপালের মুখ থেকে বেঁচে যাওয়া একঝাড় ক্রেনস্বিল বেড়ে উঠেছে। মেরি বেলা গুনগুন করে বলে, ‘এ-গ্রীষ্মটাও কত সুন্দর, কি যে ভালো লাগছে – আজ তুমি আবার এলে।’

একবার অ্যান্টনি ওর জন্য একটি সুখকাব্য রচনা করেছিল, শব্দটা ওর ভালো লেগেছিল তখন, আর এখন শব্দটা আরো বেশি ভালো লাগছিল। সুখ নামেও একটি কবিতা ও লিখেছিল। অ্যান্টনি ফিরে আসার পর, এ নিয়ে কোনো কথা আগে পরে না হলেও ওরা জানত ওরা একত্রিত হবে, কারণ দুজন একত্রিতভাবেই ওই বাড়ি এবং ওই নিঃসীম প্রান্তরের।

 

এক রোববারের শান্ত বিকেলে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলল অ্যান্টনি। যে-স্ত্রীকে একসময় ও ভালোবেসেছিল এবং যে এখনো ওকে ভালোবাসে তাকে বলল, ওদের বিয়েটা ভুল হয়ে গেছে। বাগানে বসে ধীরস্বরে কথাটা বলল, কারণ এ-সময় বাচ্চারা নানির সঙ্গে বাইরে ছিল এবং ঘণ্টাখানেকের আগে ফিরবে না। বাগানে বাঁধানো জায়গা কম, কাছাকাছি রাখা ছিল বাগানচেয়ার দুটো।

একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে অ্যান্টনি বলল, ‘আমি জানি তুমি খুব কষ্ট পেলে।’ তেমন না বুঝেই যেন ওর বাড়ানো হাতটা ধরল নিকোলা।

শরৎ এসেছে, নিরাশ করা গ্রীষ্মের পর শরতের রোদ যেন ক্ষতি পুষিয়ে দিচ্ছে – ঝোপঝাড়ের পাতা এখনো শুকোয়নি, কেবল রোগাটে হয়েছে, কমে গেছে তার সবুজাভা। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার অন্ধকার নামবে, সেদিনই একটু আগে কথাটা বলেছিল নিকোলা।

ওর দু-হাঁটুর ওপর খোলা বই, বুকমার্কটা পড়ে গিয়েছিল, খুঁজে নিয়ে জায়গামতো রেখে দিলো। অ্যান্টনির ব্যক্ত রহস্যের উত্তরে তখনো কিছু বলেনি এবং এখনো বলল না। অ্যান্টনি তাকিয়ে দেখতে লাগল ছোট ছোট ফুলের জমির ভেতর দিয়ে হাঁটছে নিকোলা, এখান-ওখান থেকে একটা-দুটো আগাছা তুলে ফেলছে, ফুটন্ত মিকায়েলমাস ডেইজিগুলো দেখছে, গতকালও ফোটেনি ফুলগুলো। চেয়ারে ফিরে এসে বলল, ও জানতে পেরেছিল; আশা করছিল ওর ভুল হচ্ছে কিন্তু সে তো কেবল ভান, ও জানত ওর আশা করা উচিত নয়।

মিনতির ভঙ্গিতে বলল, ‘আর কিছু বলো না এখন, এখনই না।’

একটা ধারাল ঘাস ও টেনে তুলেছিল, সেটাই আঙুলে পেঁচাতে লাগল। অ্যান্টনির মনে হলো আগেই যদি বলত তবে ব্যাপারটা এত খারাপের দিকে যেত না, ও বলতে দেরি করেছে।

বেখেয়ালে নিকোলার আঙুল কেটে গেল ঘাসে, ঘাসটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে আঙুলটা ও ঠোঁটে ছোঁয়াল। অ্যান্টনি কিছু এনে দিতে চাইলে ও মাথা নেড়ে বারণ করল।

অ্যান্টনি বলল, ‘আমি দুঃখিত।’

পড়তে চেষ্টা করছিল নিকোলা। অ্যান্টনি ভেবেছিল ও অনুনয় করে বলবে, ‘যেও না’, কিন্তু ও তা বলল না। কোনোভাবেই কোনোরকম অনুনয় ও করল না এবং চোখের জল ও চেপে রাখল। অ্যান্টনি আবার বলল, ‘আমি খুবই দুঃখিত নিকোলা।’

বইয়ের সেই একই পাতা থেকে চোখ না তুলে মাথা নাড়ল নিকোলা কিন্তু যে-নীরবতা ও চাইছিল তা আর রইল না। একটা গাড়ির দরজা লাগার শব্দ হতেই বাচ্চারা ডাকতে ডাকতে বাগানে এসে পড়ল। ন-বছরের অ্যামেলিয়া, সুসির পাঁচ।

 

শরৎ এলো কনকনে ঠান্ডা বাতাস নিয়ে, প্রতি শরতেই সে-বাতাস বিশাল প্রান্তরের ওপর দিয়ে বয়ে যায়। মেষগুলো গায়ে গায়ে লেগে থাকে; স্রোতস্বিনী এবং কাছাটে খালবিল জমে যায়। তুষারপাত হতে থাকে।

কিন্তু তাতে সেই রৌদ্রময় দিনের সুখকাব্যে যতি পড়ে না, ধীরগতি দিন ছোট হয়ে এলেও একই রকম সুখের। আগে অ্যান্টনি গাড়ি নিয়ে ওল্ড গ্রানজ ছেড়ে দূরে দূরে যেত; কিন্তু ওইসব পরিচিত জায়গা আর আকর্ষণ করে না, যায়ও না। বইয়ের বাক্সগুলো আধাআধি খালি করেছে, ওর রঙিন কালি কলম নিজের পছন্দমতো সাজিয়ে রেখেছে পাঠশালায়। ওর প্রথম কাজ ছিল পুরনো শহর কিশিনেভের ওপর, সেই মানচিত্রটা ফ্রেমে বাঁধিয়ে দেয়ালে ঝোলান আছে, মেরি বেলার ওয়াড্রোবটা এখন ওরা দুজন ব্যবহার করছে, পাশাপাশি ঝুলছে ওদের কাপড়।

অ্যান্টনির জীবনে যতটা পরিবর্তন এসেছে মেরি বেলার ততটা নয়।  এখনো ওকে প্রতি সপ্তাহে কর্মীদের মজুরি দিতে হয় এবং ওদের দুপুরের খাবারটা রান্না করতে হয়; ওর মা রোস্ট ও স্টু করাই সহজ মনে করতেন, ও সেগুলোই করে। হিসাবপত্র দেখার কাজও আগের মতোই করে যাচ্ছে। ওর ওপর খামারের সমস্ত দায়িত্ব ও ব্যবস্থাপনার ভার ছিল; কখন কীভাবে কোনটা করা উচিত সবই ও দেখত, দুপুরের খাবার পর প্রচুর বাসনপত্র জমা হয়, সেজন্যে ডিশ ওয়াশার দরকার ছিল। যথাযথ বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা নিয়ে বাড়ি প্রয়োজনমতো উষ্ণ থাকছে, আগে এরকম ছিল না। মেরি বেলার নিঃসঙ্গতার সঙ্গী কুকুরটা আরেকজনের উপস্থিতিতে সন্দিহান হয়ে উঠেছে; কিন্তু সে তেমন কিছু নয়। কোনো অসুবিধেই ছিল না আর তাই দিনগুলো সহজেই সপ্তাহে গড়াত, সপ্তাহ মাসে, সময় যে এমন মসৃণতায় চলে যেতে পারে সে-অভিজ্ঞতা অ্যান্টনি বা মেরি বেলা কারো ছিল না এবং ওরা দুজনেই মনে করত ওদের একত্রে থাকার এই সন্তুষ্টি কিছুতেই নষ্ট হবে না। কিন্তু নভেম্বরের শেষে সকালে নাশতার টেবিলে একটি চিঠি মেরি বেলার হাতে এলো, পরিষ্কার হাতে নীল কালিতে ঠিকানা লেখা। এ-হাতের লেখা ও আগে কখনো দেখেনি, তবু সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারল লেখাটা অ্যান্টনির স্ত্রীর। গুছিয়ে লেখা এক পৃষ্ঠার চিঠিটা অ্যান্টনি যখন পড়ছে তখন মেরি বেলা ওকে লক্ষ করছিল। চিঠিটা ওর হাতে দেওয়ার আগে দুবার পড়ল অ্যান্টনি। ‘এ-ব্যাপারে কিছুই করা যাবে না’ – এই একটিমাত্র মন্তব্য ও করল।

ওর বড় মেয়েটি খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে, কী কারণে বলা হয়নি কিন্তু মেরি বেলা ধারণা করতে পারছিল এবং বুঝেছিল অ্যান্টনিও পারছে।

সেদিন সকালে বা সারাদিনেও চিঠির বিষয়ে তারা কেউ কোনো কথা বলেনি। চিঠিটা অ্যান্টনি নিয়ে গিয়েছিল এবং মেরি বেলার মনে হয়েছে বসার ঘরে আগুন জ্বালানোর সময় অ্যান্টনি ওটা পুড়িয়ে ফেলেছে। চিঠিটা আর কখনো ও দেখেনি।

কিন্তু চিঠির বিষয়টাকে অত সহজে এড়িয়ে যাওয়া গেল না। ওরা দুজনেই তা জানত এবং পরদিন সকালে আবার সেই নীল কালিতে লেখা চিঠি এলো।

অ্যান্টনি পড়তে পড়তে বলল, ‘ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে’; বলেছে, ‘পরীক্ষা করে দেখার জন্য।’

ওর হাত থেকে চিঠিটা নিল মেরি বেলা। অ্যান্টনি যা বলেছে তার চেয়ে বেশি ছিল চিঠিটাতে; কিন্তু খুব বেশিও না। নাশতার বাসন- কোসন জড়ো করল ও। অ্যান্টনি আরো কফি ঢালল। বলল, ‘পরীক্ষা করার কিছু নেই, কোনো রহস্য আবিষ্কার হবে না। অজানা কিছু নয়।’

শিশুর কাছে তার পিতার অনুপস্থিতি অসহনীয় হয়ে উঠেছে, প্রথমে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, পরে বেশ কিছুদিন অবিশ্রান্তভাবে কেঁদে কাটিয়েছে, তারপর শুরু করেছে অনাহারে থাকা। পরিষ্কার গোল গোল হাতের লেখায় বলা হয়েছে, ‘ওরা অবিলম্বে তোমাকে জানাতে বলেছে।’

পরিবার ছেড়ে ও যেদিন চলে আসে সুসি ওর সঙ্গে থেকে গাড়িতে বই এনে রেখেছে। সারাটা সময় বাবার কাছে কাছে ছিল, হলঘরের বইয়ের সত্মূপ থেকে একটা একটা করে বই এনে দিয়েছে। অ্যামেলিয়া কোনো কথা বলেনি, নিজের ঘর থেকে বেরিয়েও আসেনি। অ্যান্টনি ভেবে নিয়েছিল, কেটে যাবে এ-সময়।

 

হাসপাতালে ওরা বলল, বাচ্চাটার ব্যবহারে পরিবর্তন যা ঘটেছে তা চরম মনোকষ্টের প্রতিক্রিয়া হিসেবে তেমন অস্বাভাবিক কিছু নয়। ওরা আশাবাদী ছিল, আশ্বস্তও করল এবং অ্যান্টনির উপস্থিতিতে ও সেরেও উঠল যা অন্যান্য অসুস্থতায় হয় না। পরে অ্যান্টনিই অ্যামেলিয়াকে বাড়ি নিয়ে গেল এবং যতদিন থাকবে বলে ভেবেছিল তার চেয়ে বেশি থাকল। রাতে নিচতলার একটা সোফায় ও ঘুমোত এবং প্রায়ই কাছে গিয়ে নিদ্রিতপ্রায়, স্নেহপ্রবণ মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে
থাকত। ওর ক্লান্ত চেহারাটা মনে হতো যেন কোনো বয়স্ক মেয়ের; কিন্তু অ্যান্টনি ওর কপালে ঠোঁট ছোয়ালে ও চোখ খুলে তাকাত, মাঝে মাঝে হাসতও। অ্যামেলিয়ার জন্মের সময় কষ্ট হয়েছিল; কিন্তু তারপর এ- পর্যন্ত কখনো কষ্ট দেয়নি। এক সপ্তাহের বেশি থাকল অ্যান্টনি আর এর মধ্যেই অ্যামেলিয়াকে নিয়ে যে-ঝামেলা হয়েছে তা ও সংশোধন করে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। ও মানচিত্রকর হতে চায় শুনে অ্যান্টনি খুশি হয়েছে। মেয়েকে ও বুঝতে পারছিল এবং ক্ষমাশীলও ছিল, মেয়ের সঙ্গে থাকার সময়টায় ওর ওপর রাগ করেনি।

কিন্তু ওল্ড গ্রানজের উঠোনে অ্যান্টনির গাড়িটা পৌঁছানোর তিনদিন পরেই ও খবর পেল যে-অ্যামেলিয়া আবার খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে।

 

এসব ব্যাপারে চিন্তা না করে থাকার চেষ্টা করেছে মেরি বেলা। ওর অবস্থান থেকে ও কোনো পরামর্শও দিতে পারে না এবং কিছু ভাবতেও পারছিল না। ঘটনার ভেতরে ও আছে অথচ ওর অবস্থান বাইরে, ওর অস্বসিত্ম হচ্ছিল, বুঝতে পারছিল না কী করবে। যে-পরিবার অ্যান্টনি পরিত্যাগ করে এসেছে, তার কথা প্রায় বলেই না, বললেও অত্যন্ত নৈর্ব্যক্তিক স্বরে বলে, যেন এখনকার অবস্থায় তাই হওয়ার কথা। যে-স্ত্রীর সঙ্গে ওর বিচ্ছেদ ঘটেনি মেরি বেলা তার নামটা জানে আর সে বলপয়েন্টে নয়, নীল কালিতে ঝরনা কলমে চিঠি লেখে, এছাড়া আর কিছুই জানে না। ওল্ড গ্রানজে তার কোনো ছবি নেই এবং বাচ্চাদের কোনো ছবিও ও দেখেনি। একটা বাড়ির কথা কয়েকবার বলেছে অ্যান্টনি তাও বাড়িটা কোথায় এইমাত্র।

তবু ওইটুকু থেকেও মনে ছবি আসে, কথা কানে আসে পাঠশালায় বসে যেমনভাবে দেখেছে যুদ্ধমান জোয়ান অব আর্ককে, দেখেছে এলিজাবেথ টিউডরের উঁচু কলারে মহামূল্যবান ঝকঝকে পাথর, তেমনই এখন ছায়া আর কেবল ছায়া থাকে না। যে-ছোরা নিষ্ঠুরভাবে বারবার আঘাত হেনেছে, যেসব মাথা রক্তের নদীতে গড়িয়ে পড়েছে আর কৌশলে বিশ্বাসঘাতকতা, এসবই তাদের নিজেদের নাটকের মধ্য দিয়ে বাস্তবে পরিণত হয়েছে।

অসহনীয় ক্ষতি শান্ত স্ত্রীর জন্য বেদনাদায়ক হয়েছে। শূন্য পড়ে আছে অ্যান্টনির ঘর, খালি হয়ে গেছে সমস্ত তাক, ড্রয়ার হালকা হয়ে গেছে, চেয়ারটা কোনায় পড়ে আছে, খালি হয়ে গেছে সংসার; কিন্তু তবু দেয়ালে ছবিগুলো আছে, আগের মতো একই সব কার্পেট, একই নকশা, আগের মতোই সব জিনিস আছে টেবিলগুলোতে। ওরা আবার বাচ্চাটাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল।

 

বাতাসে কান্নার সুর শিসের ধ্বনি; দমকা বাতাসের উন্মত্ততা। নিঃসীম প্রান্তরে ওদের কথা হারিয়ে যেতে লাগল, ওরা আবার শুরু করে, আবার হারায়। উষ্ণতার আশায় মেরি বেলা শক্ত খসখসে কাপড় পরেছে। অ্যান্টনির মনে হলো মোটা টুইড আর বহুব্যবহৃত কর্ডুরয় ওর চেহারায় সেই শৈশবে দেখা পেলবতা দিয়েছে। মেরি বেলাকে ও দুবার দেখছে – ওর মন, ওর স্বভাব, ওর হাসি, ওর দুঃখবোধ, সব মিলিয়ে দুবারই ওকে তার অনন্য মনে হয়েছে – দ্বিতীয়বার ও দেখছে প্রেমিকের মতো করে।

কিন্তু যা কিছুই হোক অ্যান্টনির সহজাত ধারণা যেমন ছিল তেমনি আছে, যে-যন্ত্রণা মেরি বেলাকে বারবার তাড়িত করে ও তা কখনো হতে দেয় না। ও চেপে রাখতে পারে, গোপন করতে পারে এবং নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে জানে। মানচিত্রকরের পৃথিবী যুক্তিসংগত এবং সহজবোধ্য। এতে কল্পনার কোনো স্থান নেই। এর যথাযথতা এবং স্বচ্ছতা ওকে আনন্দ দেয়। তাই অপ্রয়োজনীয় অংশ ছেঁটে ফেলে ও নিখুঁতভাবে কাজ করতে পারে।

কনকনে বাতাস গায়ে ফুটছে, অ্যান্টনি বলল, ‘আমরা এখানে এবং একসঙ্গে আছি, এর প্রতিক্রিয়া নিয়েই আমরা আছি, আমাদের থাকতে হবে এবং আমরা পারব।’

 

মেরি বেলা ভাবছিল পারবে কি ওরা। অনির্বচনীয় ওই ঘটনার শুরু হয়েছে যখন অ্যান্টনি ফিরে এসে ডাক দিলো, ও তো আগের অবস্থানেই ছিল; আর সব ভালোবাসা প্রত্যাখ্যান করেছিল অ্যান্টনি। কিন্তু তবু সেই স্মৃতি অস্থির করে তোলে আর এখন তা ভয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রথমে বড় বড় ফোঁটায় তুষারপাত হচ্ছিল প্রান্তরজুড়ে, পরে ঘন হয়ে পড়তে লাগল। দূরে ওরলি এজ অস্পষ্ট হয়ে এলো এবং ওরা আর এগোল না।

মেরি বেলা আসেত্ম বলে, ‘তুমিই আমাকে কল্পনা করতে শিখিয়েছিলে’ – কোমল স্বর ওর মন্তব্যের পরিহাস বহন করল না। কিন্তু বাতাসে উড়ে গেল সে-কথা এবং ও পুনরাবৃত্তি করল না। ওর জানা কথাটার ঘোষণা নয়, অন্তরে তার নিঃশব্দ প্রতিধ্বনি বহন করে ফিরে যাওয়ার দীর্ঘ পথ চলবে এটুকুই করণীয় ছিল ওর।

ওরা পৌঁছে দেখল শান্ত হয়ে গেছে উঠোন, কর্মীরা বাড়ি ফিরে গেছে। উষ্ণতায় ভরা নির্জন গৃহ, অপেক্ষমাণ অন্ধ কুকুর।

 

দিনকয়েক তুষারপাত শুধু নয়, তুষারপ্রবাহ হতে লাগল, বরফ জমতে লাগল ছাদের খাঁজে খাঁজে, জানালার ধারিতে, কাঁচের শার্সিতে এবং আকার বদলে গেল জলাধার আর তাতে ওঠার পাথরখ-গুলোর।

পাঠশালার টেবিলে অ্যান্টনি ডিজনের পরিবর্তিত রাস্তার অসমাপ্ত মানচিত্র বিছিয়ে চারদিকে চারটে পেপার ওয়েট চেপে দিয়েছে। পাশে ক্রমানুসারে সাজিয়ে রেখেছে ওর কালি কলম। এ-টেবিলটা ওরা দুজনেই অতীতে ব্যবহার করেছে। তারপর থেকে আরো অনেকভাবে ব্যবহার হয়েছে এ-টেবিল – এর ওপর আলুবীজের চারা গজিয়েছে, আপেল রাখা হয়েছে একটা থেকে আরেকটার স্পর্শ বাঁচিয়ে, তামা-রুপোর জিনিসপত্র মেজে পরিষ্কার করা হয়েছে, চায়না ও পরসেলিনের জিনিসের ওপর রেখেই জোড়া দেওয়া হয়েছে। এই সকালবেলায় আবার ওরা দুজনে টেবিলটা ব্যবহার করছে, এর আর একপ্রামেত্ম বসে মেরি বেলা খামারের হিসাবপত্র দেখছিল।

এইমাত্র ও ঠিক করেছে পর্দাবিহীন জানালায় পর্দা দেবে, ডেইজি আঁকা, রোদে জ্বলা, বিবর্ণ ওয়াল পেপারটায় কত যে দাগ – ওটাও বদলে দেবে, দেয়ালের নিচের অংশের তক্তা, ছবির রেল সাদা রং করা দরকার, দরজা ও জানালার ফ্রেমও রং করা দরকার। এ-ঘরকে ওরা ওদের ঘর বলে সবসময়ই বলবে।

‘সব ঠিক তো?’ অ্যান্টনির কথাটা ওর কানে আসে। তারপর অ্যান্টনি চোখ তুলে ওর দিকে তাকিয়ে হেসে আবার নিজের কাজে ফিরে যায়।

একটা বাড়ির ছবি স্বপ্নের মতো প্রায়ই ওর মনে আসে, এ-কল্পনা ও কিছুতেই সরিয়ে দিতে পারে না। আর প্রায়ই যখন শুয়ে ঘুম আসে না ও ভাবে, অ্যান্টনি ঠিকই বলে, মানুষের জীবনে যা ঘটে তা নিয়েই তাকে বাঁচতে হয়। বলে, বিয়ে ভেঙে যায়, এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়; আরো বলে, ওর বাচ্চার যথেষ্ট বুদ্ধি আছে ও সামলে উঠবে। একদিন ওরা খুশি হবে ভেবে যে, ওরা যথার্থভাবে চলতে পেরেছিল।

অ্যান্টনি ঘুমিয়ে পড়লে সেই রাতের অন্ধকারে মনটা অশান্ত হয়, বিভ্রান্তি থেকে ক্লান্তি আসে, মেরি বেলা নিজেই ফিসফিস করে একটা ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর কথা বলে আর তা সে নিজের কানেই শোনে, এ-শিশু ক্ষত নিয়েই বড় হবে। ওর মনে আছে, সেই কবে এক কর্মীর হাত কেটে পড়ে গিয়েছিল আর তখন খুব কষ্ট পেয়েছিল ও; ওর মায়ের যখন ব্যথা উঠত তখনো ও কষ্ট পেত, ইভলিন্সকোর্টের সেই মেয়েটাকে সবাই যে অবজ্ঞা করত তার জন্যও কত মায়া হতো ওর, এই যে অন্ধ কুকুরটা সঙ্গে সঙ্গে থাকে, মায়া হয় বলেই তো। কিন্তু ওর করুণা এখন ভালোবাসার ওপর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল, ভালোবাসার জন্যই চুপ করে থাকে। তাই রাতের অন্ধকারে মনে হয় এ-করুণা যেন ধৃষ্টতা। করুণার মন নিয়ে আগে যা করেছে এখন আর তা করতে পারছে না। তারপরও ওর করুণা হয়।

‘হ্যাঁ, আমি ঠিক আছি,’ বলে নিজেও একটু হাসে। আরেকটা স্বপ্ন ও প্রায়ই দেখে – বাচ্চাটা মারা গেছে, ফুল বিছানো সমাধির পাশে একা দাঁড়িয়ে আছে অ্যান্টনি আর ও গাছের আড়ালে লুকিয়ে তা দেখছে, ছেড়ে যেতে চায় না অ্যান্টনিকে।

 

রান্নাঘরে ওদের রাতের খাওয়া শেষ হয়েছে মাত্র, অ্যান্টনি বলে, ‘তুমি মন খারাপ করে আছো।’

থালা-বাসন নিয়ে সিঙ্কে যাচ্ছিল মেরি বেলা, মাথা নাড়ল কিন্তু উত্তর দিলো না, ঘুরেও দাঁড়াল না, পানিতে ভেজানো সসপ্যানটা ঘষে ঘষে মাজতে লাগল।

অ্যান্টনি অপেক্ষা করে রইল, তারপর গরম পানিতে ধোয়া গরম বাসনগুলো একটি একটি করে হাতে আসতে ও মুছে রাখতে লাগল। বুড়ো কুকুরটা ওর কোণটাতে গিয়ে শান্তিতে ঘুমাচ্ছিল।

‘অ্যামেলিয়া এখন ঠিক আছে, জানো তো সে-কথা’, অ্যান্টনি বলে।

‘হ্যাঁ, তা জানি।’

‘তবে কী হয়েছে তোমার মেরি বেলা?’

‘বোকামি আর কি।’

ও জানত এরকম একটা সময় আসবে, আবার ভেবেছে যে, নাও আসতে পারে, যতই অনড় হোক ওর যন্ত্রণাক্ত। চিন্তাটা আসেত্ম আসেত্ম সরে যাবে, প্রতিটা দিনে, প্রতিটা রাতে একটু একটু করে কষ্ট কমতে থাকবে।

অ্যান্টনি বলে, ‘সে ভয়ংকর সময়টা আর নেই, শেষ।’… শেষ হয়নি, স্মৃতি শেষ হতে দেয় না, কখনো হবে না। ক্ষতিগ্রস্ত কখনো নম্রভাবে সরে যায় না বরং ভেতরের পৈশাচিক শক্তিগুলোকে বার করে দিতে থাকে। এটা হবেই, মেরি বেলা অন্যরকম কিছু ভাবতে পারে না।

শান্তভাবে, ধৈর্য নিয়ে কথা বলে অ্যান্টনি, মুখে স্নেহপ্রবণ হাসি। ওর হালকা নীল চোখ, ওর হাত, ওর ঠোঁট, ওর দাঁড়ানোর ভঙ্গি, ওর চলাফেরা, ওর শান্ত হাসি সবই মেরি বেলা ভালোবাসে। কিন্তু তারপরও অর্থহীন ওর কথা। ও বোঝে না।

ছোট একটু সন্দেহ বাড়তে বাড়তে অশনিসংকেতে পরিণত হয়েছে, এ-কথাটাই ও বলতে চেষ্টা করে; কিন্তু চিন্তাটা ওকে এমন বিভ্রান্ত করে, চিন্তা ও কথার যোগসূত্রতা তৈরি হয় না এবং কিছুই আর বলতে পারে না। ওরা তো নিজেদের বদলাতে পারবে না, কেবল যা নয় তাই ভান করতে পারে।

এই নির্মল মানসিকতায় ওর ভেতরে নিঃসঙ্গতাবোধ তৈরি হতে থাকে, আগে যখন সত্যিই নিঃসঙ্গ ছিল তখনো এতটা বোধ করেনি। ওর বহুপরিচিত একাকিত্ব এর কাছে কিছুই না, এ-বোধটা আশ্চর্যরকমের, ওর সবচেয়ে আকাঙিক্ষত সঙ্গী ওর কাছে থাকলেও নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে হয়। অ্যান্টনি বলে, ‘এটা বোকামি, এসব কিছু।’

কথাটা ও রেগে বলে না, বিরক্তি নিয়েও বলে না কিন্তু ধৈর্য হারিয়ে গেলে সবই আসবে; আসবে উদাসীনতা, অবজ্ঞা ও ঘৃণা। ও কীভাবে জানে? অ্যান্টনি কেন জানে না? ও না শিক্ষক ছিল একসময়!

 

রাত ধীরে বয়। রাতের ধীরতাই ওদের ভরসা। দিনে যে ওলট-পালট হয় তা ঠিক করে নেওয়ার সুযোগ করে দেয় জানালার ধারিতে বসানো ঘড়ির ঢিমে তালে চলা কাঁটা-দুটো। অ্যান্টনি বলেছিল, সময় তাদের পথের দিশারি, শূন্যহাতে ওদের ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে নিয়ে চলেছে এবং তাকে গভীর প্রেমে পরিণত করেছে।

‘আমরা তো সত্যিই ভালো আছি, তাই না, আমাদের তো একটু বুদ্ধি করেই চলতে হবে’, একটু গায়ে পড়েই কথাটা বলে অ্যান্টনি।

কিন্তু মনের অশান্তি তো কিছুতেই যায় না। ভোরের সতেজ গলায় কর্মীরা সব উঠোনে দাঁড়িয়ে একে অন্যকে ডাকাডাকি করছে। মাঠ থেকে পশুপাল তাড়িয়ে আনা হয়েছে দুধ দুইয়ে নেওয়ার জন্য। ঠনঠন শব্দ হচ্ছে বালতির। একটা ট্রানজিস্টর আসেত্ম বেজে চলেছে। রান্নাঘরে ক্লান্তিতে অমসৃণ গলায় কথা যেন হোঁচট খাচ্ছে।

নীরবতা ভেঙে মেরি বেলা বলে, ‘কিছু না ঘটলে আমরা নিজেদের তেমন জানতেই পারিনে; আমরা কতটা পারি আর শেষ পর্যন্ত কতটা পারিনে সে-সীমারেখা একেবারেই অস্পষ্ট; কোনটা আমাদের ক্রমাগত কষ্ট দেবে আর কোনটা যে দেবে না।’

অ্যান্টনি ওকে কাছে টেনে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, আজীবন এভাবেই ওকে কাছে রাখতে চায় সে। বলে, ‘অসাধারণ তোমার সাহস।’

 

সকালের দুধ আর ডিম নিয়ে এলো একজন কর্মী। ওর হাত থেকে দুধের পাত্রটা নিয়ে অ্যান্টনি রান্নাঘরের নীল ও সাদা দুটো জগে রেখে বাকিটুকু কফির জন্য সসপ্যানে ঢেলে দেয়। বলে, ‘আজ দিনটা ভালো, তাই না?’ লোকটি বলে, ‘গত কয়েকদিনের তুলনায় আজ বেশ ঝকঝকে।’ রুটি কাটছিল মেরি বেলা, টোস্ট করবে।

বসন্ত সেবার আসি আসি করেও এলো না, সেই এক সকালে দেখা গেল অ্যান্টনি নেই। ভোরে ঘুম ভাঙতে গাড়ির শব্দ পেয়েছিল মেরি বেলা।

ভোরের কর্মীরা আরো জানত। অ্যান্টনিকে ওরা ঘর থেকে তার জিনিসপত্র বার করে আনতে দেখেছিল। ওদের কাছে বিদায় নিয়েছে অ্যান্টনি, ওদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়েছে। অ্যান্টনির যাওয়ার সময় ওরা হাত নেড়েছে তারপর যতক্ষণ গাড়িটা দেখা গেছে ততক্ষণই ওরা তাকিয়ে ছিল।

ওর কাপড়চোপড়, কালি-কলম, অসমাপ্ত ডিজন, বইপত্র সবই ও নিয়ে গেছে। কেবল পুরনো শহর কিশিনেভ পড়ে রয়েছে, তাই ও চেয়েছিল, ওর একটি অংশ এখানেই রইল।

 

মেরি বেলা ওর যাত্রাপথ জানে, কোথায় ও বিরতি নেবে জানে, একবার রাতে ও এক জায়গায় ছিল; কিন্তু পরে কখনো থাকেনি এবং এবারো থাকবে না। ওর পৌঁছতে প্রায় সন্ধে হবে।

শূকরের জারিত একটা জঙ্ঘা কাটে ও, প্রত্যেক পেস্নটের জন্য দু-টুকরো করে – কর্মীরা একে একে খেতে আসবে। রোদ এসে পড়েছে রান্নাঘরে, বসন্ত আর গ্রীষ্মের দিনগুলোতে তাই হয়। পাঠশালায় মাঝে মাঝে পর্দা টেনে দিত অ্যান্টনি, ওর পৌঁছতে সন্ধে হবে।

নিজের পেস্নট হাতে নিয়ে টেবিলে গিয়ে বসেই থাকে মেরি বেলা। ওর স্বভাবজাত স্নেহপ্রবণ স্বরে ও সত্যকে এড়িয়ে যাবে, প্রতারণাও করতে হবে। স্ত্রীর কাছে ফিরে গিয়ে তার করুণার জন্যে মিথ্যের আশ্রয় তো নিতেই হবে। ভালোবাসাকে বলবে উন্মত্ত মোহ আর মোহ তো কখনো স্থায়ী হওয়ার নয় এবং তা শেষও হয়ে গেছে।

টেবিলে রোজ যেমন কথা হয় তেমনি হলো, সকালবেলার কাজের কথা তো হলোই যার কিছু শেষ হয়েছে আর কিছু হয়নি। আজকের আর আগামীকালের আবহাওয়া নিয়েও কথা হলো। এ-আলোচনায় অভ্যাসমতো মেরি বেলাও যোগ দেয়। ও ক্লান্ত হয়ে পড়বে কিন্তু তবু নিজেকে সামলে রাখতে পারবে – ওটাই ওর স্বভাব। কৃতজ্ঞ স্ত্রী ওকে প্রত্যাখ্যান করবে না, চূর্ণ-বিচূর্ণ টুকরোগুলো আবার জোড়া লাগবে। একটা মাঠের পাঁচিল বদলে নতুন করে তৈরি হচ্ছিল, মেরি বেলাকে ওরা জানালো কাজটা শেষ হয়েছে, আগে পাঁচিলে ওঠার সিঁড়ি ছিল না, এবার করা হয়েছে আর নতুন দরজাও বসানো হয়ে গেছে। ও আর ফিরে আসবে না, একবারের জন্যও না, কখনো না। আবার সম্পর্ক তৈরি করার মতো রুচিহীন প্রচেষ্টা কখনো হবে না, কিছু তো অন্তত শূন্যের চেয়ে ভালো মনে করে মিথ্যে হাতড়ে খোঁজা – কখনো নয়।

ওরা সবাই চেয়ার পেছনে ঠেলে উঠে পড়ল, ওদের বুটের মসমস শব্দ হলো লাল টালির মেঝেতে। মেরি বেলার মনে হলো ওরা যেন উদ্বিগ্ন হয়েছে, হয়তো সমবেদনা বোধ করছে। কোনোটাই ও হেসে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল না, ও কেবল চাইল ওরা যেন বুঝতে পারে যে, ভালোবাসা অপরিবর্তিত, যেমন ছিল, তেমনি থাকবে। অ্যান্টনির কাছে থাকবে ওর ছায়ায়, ছায়ায় আর ওর কাছে থাকবে ওদের দুজনের চেনা ঘরদোর আর পরিচিত জায়গাগুলোতে। মেরি বেলা চাইছে ওরা জানুক এ-ভালোবাসা শুকিয়ে যাবে না, অতি ধীর মৃত্যুও এর হবে না, অথবা কখনো সাধারণে নেমে যাবে না।

 

[উইলিয়াম ট্রেভর একজন আইরিশ ছোটগল্প লেখক ও ঔপন্যাসিক। ১৯৫০ সালের পর থেকে তিনি ইংল্যান্ডে বাস করছেন। তিনি বেশ কয়েকটি পুরস্কার পেয়েছেন।

উদারিং হাইটস – ইয়র্কশায়ারের অ্যান ব্রন্টের লেখা বিখ্যাত উপন্যাস। হিদক্লিফ এ-উপন্যাসের নায়ক।] r