শুদ্ধতার কবিতা উত্তরায়ণের কবিতা

‘যারা ভারি পণ্ডিত তারা সুন্দরকে প্রদীপ ধরে দেখতে দেখতে চলে আর যারা কবি ও রূপদক্ষ তারা সুন্দরের নিজেরই প্রভায় সুন্দরকে দেখে নেয়, অন্ধকারের মধ্যেও অভিসার করে তাদের মন।’

শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সুন্দর’ নিবন্ধে এই যে স্মরণীয় বাচন উপহার দিয়েছেন, এ-কথা মনে পড়ল কি এজন্যে যে, গহনভাবনার ডুবুরি কবি সুন্দরের আবাহনে জগৎ-সংসারের যাবতীয় অসুন্দর ও আবর্জনাকে প্রত্যাখ্যান করতে করতে বোধের উত্তুঙ্গ মহিমার দিকে এগিয়ে যান? বিশেষত যে-কবি সর্বব্যাপ্ত আঁধি ও স্খলনের মধ্যেও ঐতিহ্যের চিরায়তনে আস্থা রাখেন, মৃতসঞ্জীবনীর খোঁজ থেকে সরে আসেন না কখনো – তাঁকে তো প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখতেই হয়। যা জীর্ণও হয় না, ক্ষয়ও হয় না সেই সুন্দরের একান্ত নিজস্ব প্রভা আবিষ্কার করে কবি ওই আলোর বিচ্ছুরণেই সুন্দরকে দেখতে ও বুঝতে জানেন। বাইরে থেকে কোনো প্রদীপ তাঁর চাই না, যা সুন্দরের সামনে ধরে সৃষ্টির পথে চলতে হবে তাঁকে। সে হয়তো প-িতের কাজ, কিন্তু কবির তো নয়। বরং মনে আসছে ডাকঘর নাটকে অমলের সেই বিখ্যাত উচ্চারণ : ‘আমি পণ্ডিত হব না, পিসেমশাই, আমি পণ্ডিত হব না।’

কিন্তু কবি যখন অনস্বীকার্যভাবে পণ্ডিত সে-সময় সুন্দরকে দেখার ধরন কি একই রকম থাকে? প্রশ্নটি অনিবার্য হয়ে উঠল, কারণ কবি মোহাম্মদ সাদিকের শফাত শাহের লাঠি (জুন ২০১৭) পড়ে অনুভব করলাম, সংকলিত কবিতাগুলো ফকিরি ধারায় নিষ্ণাত বিদ্বান ভাবুকের জীবন-উপাসনার অভিব্যক্তি। কিন্তু এ-কথা লিখতে গিয়ে টের পাই, পাঠকৃতি থেকে উঠে আসছে অমলের স্বর : না না আমি পণ্ডিত নই : আমি কবি, শুধুই কবি, কবি ছাড়া অন্য কিছু নই। যে-মানুষটি সরকারি দফতরে উচ্চতম পর্যায়ে কাজ করে সে কবি না অন্য কেউ। যে-মানুষটি সিলেটি নাগরী-লিপি নিয়ে গবেষণা করেছে সে হয়তো কবির কাছাকাছি, তবু সে পুরোপুরি কবি নয়। সাদিক মানে কবি মোহাম্মদ সাদিক (বাংলাদেশ) যাঁকে পড়–য়ারা জেনেছেন আগুনে রেখেছি হাত (১৯৮৫), ত্রিকালের স্বরলিপি (১৯৮৭), বিনিদ্র বল্লম হাতে সমুদ্রের শব্দ শুনি (১৯৯১), কে লইব খবর (২০১০) প্রভৃতি সংকলনের মধ্য দিয়ে।

প্রচ্ছদ-লিপিতে প্রসিদ্ধ সাহিত্য-সমালোচক সৈয়দ আকরম হোসেন লিখেছেন : ‘সাংস্কৃতিক-নৈসর্গিক অতীতকাতরতা, বর্তমানের স্বদেশ ও কর্পোরেট বিশ্বসভ্যতার রক্তক্ষরণ, আর্তচিৎকার এবং ভবিষ্যতের শীতল সন্দিগ্ধস্বপ্নকে – বিন্দুবদ্ধ করেছেন কবি মোহাম্মদ সাদিক, তাঁর কবিতায়। ওই ত্রিকালে তিনি চলাচল করেন কবিতা থেকে কবিতায়। তিনি সুর-ছন্দকে মানেন, ভাঙেন; কিন্তু রস-অলংকারের মিথস্ক্রিয়ায় থাকেন সুস্থির। শব্দরহস্যের আপাত সরলতা তাঁর কবিতার ভিন্নতর বৈশিষ্ট্য। তাঁর কবিতার ধমনিতে প্রবাহিত হয় চর্যাপদ থেকে একালের কাব্য-ঐতিহ্য। শব্দতরঙ্গে স্পন্দিত ত্রিকালের কথকতা। মোহাম্মদ সাদিকের কবিতা যেমনই হোক, তা নির্মাণ নয়, সৃষ্টি। একুশ শতকের স্বদেশ ও বিশ্বের উদ্যত বর্শাফলকের সামনে কবি উচ্চারণ করেন ধাড়ারগাঁয়ের মাতৃমন্ত্র। কবিতাশরীরে মোজেকখচিত হয়ে ওঠে প্রকৃতির বৈভব-বৈচিত্র্য, ধাড়ারগাঁয়ের জোনাক-কথা, নদী, হাওর, মানুষ, প্রেম ও মরমি সাধনার শব্দকুহক। মোহাম্মদ সাদিক অগোচরের কবি, তিনি কবিতা লেখেন জীবনানন্দে, উপাসনার মতো।’

বিদ্বান পাঠকের এই বয়ান যথার্থই মর্মগ্রাহী। সত্যিই সাদিক অগোচরের কবি, যাঁর কবিতা উপাসনার মতো। ফকিরি পরম্পরায় উদ্ভাসিত জীবনবোধের তিনি শরিক। বহিরঙ্গ পরিচয়ে তিনি বাস্তবের যে-বৃত্তেই সঞ্চরণ করুন না কেন, তাঁর মন সর্বদা ছিপ ফেলে রাখে চেতনার গহনে। শফাত শাহের লাঠি প্রমাণ দেয় কতখানি সার্থক হয়েছে সাদিকের ছিপ ফেলে বসে থাকা : জীবনের কাছে, নিসর্গের কাছে, লোকায়ত ঐতিহ্যের কাছে। সন্দেহ কী, বানানো কথার নিরবচ্ছিন্ন কর্ষণ দেখতে দেখতে ক্লান্ত ও অবসন্ন পাঠক এমন আনকোরা টাটকা নবীন সুবাতাসের প্রতীক্ষাতেই ছিলেন। নইলে কি আর ‘চৈতন্যে’র বই ২০১৭-এর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হওয়ার চার মাস পরেই (জুন) পরিবর্ধিত সংস্করণও বেরোল? প্রকাশক প্রত্যাশা জানিয়েছেন, ‘এই সংকলনে পাঠক মোহাম্মদ সাদিকের মরমী ঘরানার প্রতিনিধি স্থানীয় কবিতাগুলি খুঁজে পাবেন।’ শুধু এজন্যেই নয়, সাদিকের প্রকৃত কবিসত্তাকে যাঁরা খুঁজে নিতে চান, তাঁদের জন্যে এই সংকলন অবশ্যপাঠ্য। ফেব্রুয়ারি এবং জুনে প্রকাশিত দুটি সংকলনই যেহেতু পড়েছি, এ-কথা লিখতে পারি, জুন-সংস্করণটির প্রকাশনা অনিবার্যই ছিল। সাধারণত কোনো কবিতা সংকলনে কয়েকটি কবিতা স্মরণীয় হলেই মনে করি কবি সার্থক। কিন্তু ১১৮টি কবিতা দিয়ে তৈরি যে-সংকলন, তার শতাধিক বয়ান যদি স্মরণীয় হয়ে ওঠে এবং সম্মোহিত জনের মতো বারবার তাদের কাছে ফিরে আসতে ইচ্ছা করে, তাহলে এই সিদ্ধান্ত নিতেই হয় যে, সাম্প্রতিককালে এমন অনবদ্য কবিতা সংকলন পড়িনি।

 

দুই

আধুনিকতাবাদ যখন অবক্ষয়ী প্রবণতাকে সর্বাত্মক করে তুলেছে এবং উৎকেন্দ্রিক আধুনিকোত্তরবাদের মরীচিকায় আত্মসমর্পিতজনেরা অগভীর ও অসুন্দর স্থূলতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক অভ্যাসের চক্রব্যূহকে মান্যতা দিয়ে চলেছে, মোহাম্মদ সাদিকের এই কবিতা-সংকলন যথার্থই তৃষ্ণার্ত মনের ওপর নীলাঞ্জন ছায়া ছড়িয়ে দেয়। বুদ্ধি দিয়ে নিশ্চয় কবিতা লেখা হয় এবং পৃথিবীর সমস্ত ভাষার সাহিত্যেই ইদানীং বুদ্ধির দাপট অনেক বেশি। সেজন্যে হৃদয়ের কথা, অনুভবের কথা, ঐতিহ্যের কথা, চেতনার স্বোত্তরণের কথা যখন লেখেন সাদিকের মতো কোনো কবি, পাঠকের মুগ্ধতার আর শেষ থাকে না। এই যে কথাগুলো কলম স্বতশ্চলভাবে লিখে নিয়েছে, তাদের সমর্থন করার মতো কবিতা এই সংকলনে অনেক রয়েছে। পাঠক ইচ্ছামতো সংকলনের যে-কোনো পৃষ্ঠা খুলে পড়–ন, বুঝতে পারবেন, গভীর এবং সহজ-সারল্যই কবির অভিজ্ঞান। তাঁর উচ্চারণ সাধারণভাবে খ-কালের নয়, চিরবর্তমানের। এই পঙ্ক্তিগুলো লক্ষ করা যাক :

জলের প্রবাহ মানে কোনো নদী নয়

শব্দ ছন্দ মাত্রা মানেই কবিতা নয়

শুধু মানুষের অবয়বে পুরুষ অথবা নারী – কখনো মানুষ নয়।

তবে কাকে খুঁজে খুঁজে এবেলায় এই হাহাকার

কার জন্যে হা-করা কপাট খুলে অনন্ত প্রতীক্ষা?

 

নদী নাই তুমি নাই

পাঁজরে পুষ্পের ঘ্রাণ, পুষ্প নাই, ছায়া নাই

শূন্য আছে শূন্য নাই

(‘আব আতশ খাক বাদ’)

মনে হয় না-কি কবি আসলে স্বগত দ্বিরালাপে মগ্ন? আপন সত্তাকে সম্বোধন ও সম্বোধিতের মধ্যে দ্বিধাবিভাজিত করে নিয়েছেন তিনি। সহজ সুরে সহজ কথাই বলে গেছেন অথচ তাদের মধ্যে আভাস পাচ্ছি অতলান্ত গভীরতার। যে-শূন্যের কথা লিখছেন কবি তা আসলে শূন্য নয়। মরমি ফকিরি ধারার নিবিড় সংকেত – গূঢ় বাচনে এর উৎস। নদী বা পুষ্প বা প্রতীক্ষা : সমস্তই বহুস্বরিক। আর সবার ওপরে রয়েছে খাঁটি মানুষ খোঁজার আর্তি। সাদিকের মতো কবি জ্ঞানমার্গের পথে জানাতে চান না কিছুই; তিনি আসলে অনুভবের গহনলোকের প্রতি ইশারা করে প্রাণিত করতে চান। এই সংকলনজুড়ে ফিরে ফিরে এসেছে যে ‘আমি’ ও ‘তুমি’ সর্বনাম দুটি – এদের মধ্যে ইশারা পাই চিরকালীন দাতা ও গ্রহীতার মধ্যে বিরাজমান আত্মিক দেওয়া-নেওয়ার, চিরনবায়মান সম্পর্কের গ্রন্থনার।

কবিসত্তা মূলত ক্লান্তিহীন সূত্রধার। এই কবি এমন, যে নিজেরই সৃজনী সত্তার দিকে তাকিয়ে যুগপৎ বিভোর ও বিষাদমগ্ন। এই পঙ্ক্তিগুলো যেন সেদিকেই ইঙ্গিত করছে :

হরিণের দেশে, অরণ্যের ঘাসে ঘাসে কেবল আমার রক্ত

পাখির পালকে-ঢাকা আমার শোকের চিহ্ন, জোনাকিরা জানে

আমার পকেটে কিছু কবিতার কান্না আছে

… … …

শ্মশ্রুমুখ বাউল আমাকে চেনে, তার একতারায় একান্তে থাকে

আমার আঙুল

জিকির আমাকে চেনে

সারারাত দরবেশের রওজায় আমি এক মরমি প্রদীপ

বাতাস আমাকে চেনে, তোমাকে চেনে না।

(‘অপরিচিতের কবিতা’)

কত সাবলীলভাবে কবিতায় উঠে আসে নৈসর্গিক অনুপুঙ্খগুলো : হরিণ, অরণ্যের ঘাস, পাখির পালক, জোনাকি, বাতাস এবং তাদের সঙ্গে একই সূত্রে গ্রথিত দরবেশের রওজা, মরমি প্রদীপ, বাউলের একতারায় একান্তে সম্পৃক্ত কবির আঙুল। সমস্তই চিহ্নায়িত বাচনের গ্রন্থনা। পড়তে পড়তে বুঝে নিই, সর্বব্যাপ্ত ক্ষয়িষ্ণুতার অন্ধকারকে প্রতিস্পর্ধা জানায় এসব আলোকিত উচ্চারণ। বিশ শতকের প্রথমার্ধে প্রসিদ্ধ দার্শনিক কৃষ্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য যে ‘মননে স্বরাজ’ প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছিলেন, চিত্তবৃত্তির নিরুপনিবেশীকরণ অর্জনের মাধ্যমেই তা সম্ভবপর। আর তখনই অবক্ষয়বাদের সার্থক বিকল্প হিসেবে উত্তরায়ণপন্থী চেতনায় আধারিত সৃজনী শিল্পকৃতির উন্মেষ হয়। এই নিরিখে সাদিকের শফাত শাহের লাঠি সংকলনের কবিতাগুলোও যেন সত্তার নিয়ামক সংবিদের নিবিড় আনন্দময় উন্মোচন। লিখতে ইচ্ছা করে, কবিতার বয়ানও যে হতে পারে ফুলের কোরকের মতো কোমল লাবণ্যময়, আবার ধ্যানের মতো তদ্গত নিবিড় : এই সংকলনে মগ্ন না হলে কি জানতে পারতাম? এমন কিছু নিটোল কবিতা রয়েছে যাদের অংশবিশেষ উদ্ধৃত করা যায় না, সম্পূর্ণ বয়ানের প্রতি মনস্ক হতে হয়। যেমন পূর্ণতা রয়েছে উচ্চাঙ্গসংগীতের অনুভব-উদ্দীপক সুরের ইন্দ্রজালে কিংবা পারাপারহীন সাগরের উদার রমণীয় বিস্তারে।

বিনয়ী কবি যদিও লিখেছেন শিরোনামহীন প্রাগ্ভাষে : ‘কবিতা লিখতে লিখতে বুঝেছি, আমি কবিতা না লিখলেও সভ্যতার কোনো ক্ষতি হত না। নির্দ্বিধায় জানাতে পারি, মন্ত্রের মতো নিটোল কবিতা পড়ার অভিজ্ঞতা যদি না হত, অপূরণীয় ক্ষতি হত পাঠকেরই। আমাদের ভাষায় যে প্রচ্ছন্ন রয়েছে এতখানি অমেয় সম্ভাবনা, সহজ লাবণ্য উপাসনার, স্বভাবের পথে অভিব্যক্ত আশ্চর্যের বন্দনায় : তা কি জানা যেত?’ সাদিক দেখিয়েছেন, পরম্পরাঋদ্ধ জীবনের যে-কোনো অনুষঙ্গই কবিতায় রূপান্তরিত হতে পারে যদি তাতে গভীরের বার্তা অনুরণিত হয়। আর, যদি শব্দাতিগ অনুভূতি মুছে দেয় সব রৈখিকতা :

ওই তো শীতের হিমেল হাওয়া আসছে ছুটে

ঝরিয়ে দিতে স্বপ্ন-সুখের শোভন পাতা

ছোটো’পা তুই বুনলি কেবল তরতাজা সব ফুলের ছবি, ধানের ছড়া

বিহান বেলার দোয়েল শালিক, প্রজাপতি

প্রসন্ন সব শাপলা শালুক

পালকি এবং পাখির পালক।

শীতের তোড়ে কাঁপছি আমি, কাঁপছে আজো

করুণ স্বদেশ

লক্ষ লক্ষ বছর ধরে একটি কাঁথা বুনলি আপা

তবু তো তোর শিল্পকলা শেষ হল না, শেষ হল না!

(‘ছোটো’পা তোর নকশি কাঁথা’)

সার্থক কোনো বয়ান যখন ধাপে ধাপে অনুসরণ করি, প্রকৃতপক্ষে তাতে সাংস্কৃতিক বিশ্বকোষের অনুসৃতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এখানে যেমন আপার (দিদির) নকশিকাঁথা বুননে উত্তরায়ণপন্থী প্রাকৃতায়নের উৎসাভিমুখী যাত্রা কবিতার নিজস্ব পরাভাষায় ব্যঞ্জিত হয়েছে। সবকিছুরই শেষ আছে, শেষ নেই কেবল অফুরান ঐতিহ্যবোধের। বাঙালি পড়–য়াদের বড় অংশই যখন সম্ভোগ-সর্বস্ব বিশ্বপুঁজিবাদের অপসাংস্কৃতিক যুক্তিশৃঙ্খলায় বন্দি হয়ে ঐতিহ্যবিনাশী আধুনিকোত্তরবাদী মরীচিকার প্রতি উদ্ভ্রান্তভাবে ধাবমান – মোহাম্মদ সাদিকের কবিতা জোগান দেয় শুশ্রƒষার বিশল্যকরণী, আর সবচেয়ে বড় কথা, নানাভাবে তাড়িত ও কোণঠাসা

বাঙালি-সত্তার কাছে নিয়ে আসে বিশ্বাস পুনরুজ্জীবনের বার্তা। ‘শীতের তোড়ে কাঁপছি আমি’ যথার্থই বহুস্বরিক বাচন, কেননা বহুমাত্রিক শৈত্যপ্রবাহে আমরা সবাই বেপথুমান যদিও, হায়, মর্মান্তিক অসহায়তার সত্য সম্পর্কে আমরা নিজেরাই উদাসীন। আঁধার রাতের একলা পাগল কবি আমাদের বুঝিয়ে দিতে চাইছেন আত্মহননকারী সেই উদাসীনতার কথা। জাগিয়ে দিতে চাইছেন আলোয়-উত্তাপে প্রত্যয়ে উত্তরণের ভরসায়।

এ এক অন্য ভুবনের কথকতা, যেখানে স্মৃতিসত্তা বিনাশের আয়োজন প্রতিহত হয়। সম্বোধিত সত্তার প্রতি কবির এই উচ্চারণ খুব তাৎপর্যপূর্ণ; ‘তুমি সুকুমার শিল্পকলা/ তুমি অসুস্থ সময় ঘিরে নেমে-আসা জীবনের/ মমতা-মন্থন ভিনদেশী…।’ আর, কবির উত্তরায়ণ চেতনায় লালিত নন্দনবোধের এই গূঢ়ার্থবহ অভিব্যক্তিও :

তিলে তিলে গড়ে ওঠে যেসব কবিতা

তুমি তার মূলসূত্র, তুমি থাকো গোলাপের

সাহসী শাখায়

যখন বানের ভেলা ভাটিয়ালি দেশে যায়

তুমি উজানের স্রোত ঠেলে ফিরে চলো বেহুলার মতো

গাঙের কিনার থেকে গাঙচিল চেয়ে থাকে

মরমি নদীর দিকে, আর

মনমাঝি তার বৈঠা ভুলে উদাস হাওয়ায়

একতারা হাতে কাঁদে লালনের গান!

(‘তদেব’)

হ্যাঁ, সত্যিই আমরা এখন ‘সে-ভাষা ভুলিয়া গেছি’। সভ্যতার অহমিকায়, নাগরিক পরিশীলনের ঔদ্ধত্যে, ভোগবাদী জীবন-যাপনের অভ্যস্ততায়, গ্রামে-গাঁথা-দেশের বাস্তবকে আমরা কেবল ভুলেই থাকিনি, আধুনিকতাবাদ ও আধুনিকোত্তরবাদের আত্মবিনাশক প্ররোচনায় ‘গ্রাম্য’ ও ‘পশ্চাদ্গামী’ বলে তাকে উপেক্ষাও করতে শিখেছি। ‘ভাটিয়ালি দেশ’, ‘বেহুলা’, ‘মরমি নদী’, ‘মনমাঝি’, ‘বৈঠা’, ‘একতারা’, ‘লালন’ তো কেবল শব্দানুষঙ্গ নয় – উদ্ভ্রান্ত ‘আধুনিকতাবাদী’ কিংবা ‘আধুনিকোত্তরবাদী’ বাঙালি পড়–য়ার কাছে লুপ্ত ভুবনের কথকতা। সেজন্যে কবি সাদিকের নান্দনিক বোধের দার্শনিক মাত্রা সম্পর্কেও অবহিত করে তোলে তাঁর পরাবাচনের গ্রন্থনা।

নিছক খেয়ালের বশে সময় যাপনের জন্যে কবিতা লেখেন না সাদিক। ‘জনৈক সাহিত্য সম্পাদক সমীপেষু’ শীর্ষক বয়ানকে ভাবা যেতে পারে তাঁর কবিতাবিষয়ক উপলব্ধির ব্যক্তিগত ইশতেহার :

কতটা আগুন পুষে শরীরে সিনায়

কতটা রক্তের দাগ জীবনের ক্ষত –

মিশে মিশে একাকার হলে

কবিতার কোমল বাগানে তবে ফুল ফোটে, আমাকে বলুন

… … …

কবিতায়, শুধু কবিতায় আমি যদি জীবনের সব কথা

খুলে বলি

যদি যৌবনের সলতে দিয়ে জ্বেলে দিই

কালের প্রদীপ

যদি বিনিদ্র রাতের চোখ খোলা রাখি

নীরব ঋষির মতো মৃত্তিকার মতো কিংবা উদ্ভিদের মতো

যদি ছবি আঁকি, জীবনের, যন্ত্রণার, উদ্ভব ও উত্থানের –

যদি মহাপ্লাবনের মতো ছুটে-আসা মানুষের মুখোমুখি

একাকী দাঁড়াই, বলি

হে মানুষ শোনো, রক্ত ও হিংসার দেশ শোনো –

যদি তারা শোনে না কখনো, যদি তারা

আমার মৃত্যুর হোলিখেলা শেষে ঘরে ফিরে যায় আর

বিনিময়ে শান্তি নামে

অনন্ত সাম্যের মতো শান্তি –

তবে কি কবিতা হবে?

তবে কি কবিতা?

কাকে বলব কবিতা, কেনইবা বলব কবিতা – এই নিয়ে দেশে দেশে কালে কালে গভীর ও সংবেদনময় সন্দর্ভের অভাব নেই। আগেই লিখেছি, বিদ্বান গবেষক হয়েও সাদিক জ্ঞানমার্গের পথিক নন; তিনি আউলবাউল দরবেশদের সহজিয়া বোধিপথের পান্থজন। তাই প্রাকৃতায়নে লালিত অনুভব নিয়ে তিনি জানান, বহুমাত্রিক যন্ত্রণাকে আত্মস্থ না করলে কবিতার জন্ম হয় না। শুধু কবিতার সমস্ত উপলব্ধির কথা তিনি জানিয়ে দিতে চান। তিনি যে সর্বংসহ মৃত্তিকার কিংবা উদ্ভিদের কথা স্মরণ করেন, তা খুব তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর কবিতা ছবি আঁকতে চায় জীবনের, যন্ত্রণার, উদ্ভব ও উত্থানের। তাঁর কবিতা মানুষের মুখোমুখি একাকী দাঁড়াতে চায়। রক্ত ও হিংসায় কলুষিত পরিসরে অনন্ত সাম্যের মতো শান্তি প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। অতএব সাদিকের কবিতার নন্দন যুগপৎ দার্শনিক বোধে ও সমাজ-সংবিদে উদ্ভাসিত। বস্তুত কুটিল বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক রাজনীতির নখরাঘাতে বাঙালির ভুবন যদিও ছিন্নবিচ্ছিন্ন এবং রাষ্ট্রীয় নিপীড়নে কোথাও কোথাও ব্যক্তি পরিসরও উন্মূল, সাদিকের কবিতা মানুষের অনুভব নিয়ে মানুষের মুখোমুখি একাকী দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করে।

অনিবার্যভাবেই এই সংকলন থেকে কিছু প্রিয় পঙ্ক্তি এবং বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অপ্রতিরোধ্য কিছু কবিতা বেছে নিতে হয়। কেননা শেষ পর্যন্ত প্রিয় কবিকে পাঠকেরা এভাবেই মনে রাখেন। যেমন ‘অনিবার্য দেখা’ কবিতার এসব আন্তরিকতায় শুদ্ধ পঙ্ক্তিগুলো :

পথ যেরকম দেখতে যায় পথের ঠিকানা

নদী যেরকম খুঁজে নেয় অন্য এক নদী

রক্ত যেরকম খুঁজে ফেরে রক্তবাহী শিরা

দুঃখ যেরকম দেখতে যায় আরো এক –

দুঃখের জীবন

তেমনি এসিছি আমি।

আপন কবিসত্তার উপস্থিতি প্রত্যয়ের সঙ্গে জানান কবি। ‘শ্মশানে হরিশ্চন্দ্র’ শীর্ষক কবিতায় অতিপরিচিত প্রতœকথার স্বাধীন বিনির্মাণ করে সাদিক তাঁর বয়ানকে সূক্ষ্মভাবে সাম্প্রতিকে সম্পৃক্ত করে নিয়েছেন :

বার বার স্মৃতিভ্রষ্ট বার বার হত্যা করি আমার হৃদয়

বার বার ডুবে যাই বন্য এক হাহাকারে নেশার সীমায়

দুঃখের নিঃশ্বাস শুনে তাড়া খেয়ে ফিরে যায় রাতের বাতাস

দুঃখের নিঃশ্বাস লেগে বার বার নিভে যায় হাতের মশাল

… … …

রাজদ্রোহী লাশগুলো আমি তুলি অনন্তের অন্তিম শয্যায়

পৃথিবীর প্রতিবাদ দিনে দিনে জমা করি হাতের মুঠোয়

স্বপ্ন শস্য শক্তি বীর্য সব আমি শেষ করি নিজ হাতে তুলে

সারাদিন সারারাত জ্বেলে রাখি অবিনাশী আগুনের জিভ

 

দীর্ঘ এই কবিতায় ধ্রুপদী সংগীতের সমে ফিরে আসার মতো পুনরুচ্চারিত হয় : ‘দ্যাখো হরিশ্চন্দ্রকে দ্যাখো প্রিয়তম মশালের উসকানো আলোয় কঠিন’। পড়তে পড়তে অনুভব করি, কবির অভিপ্রেত হলো প্রসঙ্গাতিযায়ী দেশ-কালের বার্তা। সেজন্যে শব্দান্তর্বর্তী নির্বাক শূন্যতারও পাঠ আবশ্যিক হয়ে পড়ে। বুঝে নিতে হয় কেন কবি লিখেছেন ‘তবু আমি প্রতিদিন জেগে উঠে নিজ হাতে পুড়াই জীবন’। আর, তখনই প্রশ্ন দেখা দেয় মনে, এই ‘হরিশ্চন্দ্র’ প্রতীকের আড়ালে প্রচ্ছন্ন রয়েছে কোন ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া? কে এই সামূহিক সত্তার প্রতিনিধি ‘আমি’ যে শুনতে পায় ‘অলৌকিক পৃথিবীর ভাষা’? পরিচিত বাস্তব অপরিচিতিকৃত হলে যদি শিল্পসৃষ্টি হয়, কিসের সংকেত ফুটে উঠেছে এসব পঙ্ক্তিতে :

সভাসদ নতমুখে প্রশংসার পঞ্জিকায় তুলেছে শ্লোগান

আমার সুখের রাজ্যে সুখী সব প্রজা মিলে সুখের মিছিল

ধ্রুপদ সংগীতে তারা বন্দনা করেছে এই হরিশের নাম

তোমরা বলেছ খুন সংশোধনী হত্যাযজ্ঞ হোক শেষবার

আমি তো বলেছি ক্ষমা, ক্ষমা করো বন্ধ হোক তীব্র রক্তপাত

বলেছি বিনাশ কেটে গেলে একদিন ফুল্ল দিন ফিরে পাব

আমরাও ফিরে পাব অমরতা ভালোবেসে স্বর্গের ঠিকানা

আমি তো চেয়েছি বিশ্বময় বিনাশবিরোধী শান্তিবাহী সুখ

আমি তো চেয়েছি শুধু সমতার মতো করে সাজাব জীবন

মনে হয় নাকি পুরাণকথার হরিশ্চন্দ্র ছায়ামূর্তি হয়ে সরে গেছেন পশ্চাৎপটে; সম্মুখায়িত হয়েছে সর্বজনীন ক্ষমা বিধানকারী বঙ্গবন্ধুর উচ্চতম আদর্শবাদের সুরে তালে লয়ে গাঁথা মহৎ জীবনের দ্যোতনা। প্রকৃত কবি এভাবেই তাঁর বাচনকে বহুস্বরিকতায় ঋদ্ধ করে চিরকালকে সমকালের সঙ্গে একই সূত্রে গ্রথিত করতে পারেন। সাদিক ইতিহাসের প্রতি তাঁর দায়বোধ যে ভোলেন না কখনো, এর নিদর্শন রয়েছে ‘কবির মৃত্যুর পর’-এর বয়ানে যেখানে সুগভীর বেদনার সঙ্গে মিশে গেছে প্রবল আত্মশ্লেষ :

গভীর শোকের মতো এলোমেলো আমার স্বদেশ

 

আমাদের প্রিয় যে প্রতিটি শব্দ তারা আজ দুঃখ হয়ে যায়

আমাদের প্রিয় যে প্রতিটি দেখা সেসব এখন বৃষ্টিভেজা বৃষ্টি

আমাদের প্রিয় যে প্রতিটি উচ্চারণ তারা আজ

উচ্চ আর্তনাদ হয়ে ওঠে

… … …

আমাদের ছায়া নেই, সত্য নেই, পবিত্র পুনরুদ্ধার নেই

আমরা কবিতার চেয়ে নষ্ট রাজনীতি বেশি ভালোবাসি

আমরা কবিদের চেয়ে হিংস্র কসাইকে বেশি ভালোবাসি

আমরা সত্যের চেয়ে শক্তির উপাসনায় সহজে সাহসী

আমরা সৃষ্টির চেয়ে ধ্বংসের কাছেই নতজানু আজ

সাদিক মূলত জীবন-বিমুগ্ধ কবি; তাই তিনি কেবল সত্য চান। তিনি চান ক্রমাগত লুপ্ত হতে থাকা শুভ আস্তিক্যবোধের পুনরুদ্ধার। চারদিকে যখন বিনাশের হিংস্র তৎপরতা তিনি চান শুদ্ধতাবোধের পুনঃসৃষ্টি এবং সবধরনের আধিপত্যপন্থা প্রতিহত করার মতো আত্মশক্তির পুনঃপ্রতিষ্ঠা। নষ্টধস্ত জগতে কবিকে আলোর প্রহরী হতে হবে : এই সংকেতই দিচ্ছেন সাদিক। কীটদুষ্ট সাম্প্রতিকে ‘একে অপরের দিকে ছুঁড়ে দিই শানিত তিরের মতো দৃষ্টি/ বিদ্বেষের বোঝা পড়ে কবিতার বুকে’। আর কবিতার খাতা ভরে ওঠে রক্তপাতের নথি রচনায়। নির্জনতাপ্রিয় এক নিরিবিলি কবি যদি তখন ভালোবাসার কথা করুণার কথা লিখতে পারেন তাই হয়ে ওঠে প্রতিবাদের শিল্পিত অভিব্যক্তি। ‘শিকড়ের শিলালিপি’ নামক দীর্ঘ কবিতায় ধাড়ারগাঁয়ের স্মৃতিপীড়িত সত্তা আসলে পরম্পরা-বিযুক্ত পড়–য়াদের সম্বোধন করে।

সাধারণত বাস্তবে যে-প্রত্যাবর্তন সম্ভব হয় না, কবি সেই স্বপ্ন-যাত্রার কথাই লেখেন। সার্বিক বিচ্ছিন্নতার আবহে এই স্মৃতিমথিত যাত্রাকথা কার্যত হয়ে ওঠে প্রতিবাদের ও বিকল্প জীবন-সন্ধানের নিজস্ব ভাষ্য। ধাড়ারগাঁয়ে যেন সাদিকের নিজস্ব নিশ্চিন্দিপুর, যেখানে পৌঁছাতে হয় স্বপ্নে ও কল্পনায়। গোপনে যতই ক্ষয় হোক বুকের পাঁজর, আনন্দের শেষ আলপনা লুপ্ত হোক – প্রত্যাশার কারুকাজ বুকে নিয়ে ফিরে যেতে চান তিনি বিলুপ্ত সময়ে। অতিদূর শৈশব যখন প্রিয় অনুষঙ্গসহ ঝাপসা, স্মৃতিমগ্ন ইতিহাসের আহ্বানে সাড়া দিতে জানেন কবি। আপাত-তুচ্ছ দৈনন্দিন অনুপুঙ্খে সম্পৃক্ত যত সামাজিক ও রাজনৈতিক অনন্বয় সেসবও কবির জন্যে নিবিড় চিহ্নায়ক হয়ে ওঠে। যেহেতু সাদিকের কবিতা বিশ্বজুড়ে ব্যাপ্ত থাকে মাটির সোঁদা গন্ধ, আটপৌরে নিসর্গের অস্তিত্ব সব মিলিয়ে সঞ্চারিত হয় অপ্রতিরোধ্য মায়া। কবিতা যখন আপাত-মোহনায় পৌঁছায়, কবি স্বপ্নময় প্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষাই ব্যক্ত করেন : ‘অপেক্ষায় থেকো আমি ফের ফিরব আকাশ/ গভীর মৃত্তিকা থেকে পুরোনো মুদ্রার মতো ফিরব রোদ্দুর।’

বৈচিত্র্যের খোঁজে সাদিক ভিন্ন ধরনের কবিতাও লেখেন। সৃজনশীল সত্তার পক্ষে এই ইচ্ছা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু এই সংকলন যে-কারণে স্বতন্ত্র, তাদের হদিস মেলে সেসব কবিতায়, যেখানে কবি আবহমান ঐতিহ্যের অবতলে ডুবুরির মতো রতœ-সন্ধানী। সেসব বয়ানে তাঁর সহজ-সরল বাক্ভঙ্গির আড়ালে অতলান্ত গভীরতার ইশারা অনুভব করা যায়। এ-ধরনের কিছু পঙ্ক্তি বেছে নিচ্ছি এবার :

আমি একজন বাউলকে জানি

পৃথিবীর মানচিত্র জুড়ে যার ছায়া পড়ে আছে

তার চুল স্পর্শ করছে সমুদ্রের জল

তার একহাত ভালবাসে জলের উচ্ছ্বাস

অন্যহাতে নীরবতা নীল কোনো নদী

(‘বাউলের উপাখ্যান’)

মেঘনা নদী থাকতেও লালন ফকির যদি জল-পিপাসায় বিধুর হতে পারেন, সুরমাপাড়ের ফকিরি ভাবধারায় দীক্ষিত নাগরিক বাউল মোহাম্মদ সাদিক কেন নিজের জন্যে বিজন পরিসর নির্মাণ করে অযুত আলোকবর্ষ ধরে জাগ্রত উপলব্ধির কথা কবিতার নিজস্ব শিল্পভাষায় লিখবেন না? কিন্তু তিনি তো কেবল ভাবমগ্ন

সংসার-বিযুক্ত বাউল কবি নন। তাই সময়ের অভিঘাত-খচিত বাচনে তিনি ইতিবাচক পুনর্জাগরণের স্বপ্নকথাই প্রকাশ করেন :

শরীরে ধানের গন্ধ আমি ধান হব আমি ধান হব

পিঠে চাবুকের দাগ ছুঁয়ো না ওখানে, আমি ধান হব

… … …

 

ফুল ফুটুক না ফুটুক ও মশাই সাদা সাদা জোছনার মতো ভাত

ফুটুক

ভাত ফুটুক

(‘বসিয়া বিজনে কাজ করো মনে’)

সাদিকের কবিতার বয়ানজুড়ে রয়েছে লোকজীবনের সামূহিক অন্তঃস্বর। তাই প্রাগুক্ত কবিতায় পুনরাবৃত্ত হয় আবহমান গ্রামবাংলার হৃৎস্পন্দনে সম্পৃক্ত গানের পরিচিত পঙ্ক্তি :

ঘাটে লাগাইয়া ডিঙা পান খাইয়া যাও

ও আল্লার দোহাই লাগে।

(‘বসিয়া বিজনে কাজ করো মনে’)

কবিকৃতির এই বিশিষ্ট নিমিত্তি-প্রকরণই তাঁর অর্জিত মননে স্বরাজের অভিজ্ঞান :

ক্রমশ কালের ফলা খুঁড়ে খায় লাঙল নিমক

মহাকাব্য, রূপকথা, ইতিহাস, জারিগান ভেসে যায়

ধামাইল নাচের ধারায় আকাশে উঠেছে গোল চাঁদ

শোক তাপ দেখো তার, নাচ দেখো আজ।

(‘বহুকাল চাঁদে পায়’)

আমার শরীরে আজ কোনো শব্দ ছন্দ যতি মাত্রা নেই

নিমাই চলিয়া গেছে বিষ্ণুপ্রিয়া ঘরে কাঁদে নিঃসঙ্গ করুণ

তারো আগে কবে কোন কালরাতে কপিলাবস্তুর

সেই সোনার পুতুল

ঘর থেকে বার হল কবে গেল নীলাচলে লালনের পাখি

(‘চিহ্ন’)

কবি আপনমনে খুঁজে বেড়ান কার কাছে রেখে যাবেন ‘হারানো পালক শোকগাথা এবং বিরহ’ যা কিছু একান্তই তাঁর। কাব্যভাষার বিশিষ্ট এই সঞ্চরণে স্পষ্ট হয়ে ওঠে কবির নিজস্ব দর্শন নিষ্ণাত বিশ্ববীক্ষা। কোনো বিচ্ছিন্ন অনুভূতির বয়ান নির্মাণ করার জন্যে কবিতা লেখেন না সাদিক। কখনো নিরুচ্চার আর কখনো সোচ্চারভাবে সত্তাতাত্ত্বিক ও জীবনতাত্ত্বিক জিজ্ঞাসা কবিতার ছলে নথিবদ্ধ করে যান তিনি। যেন নিজেরই সঙ্গে তাঁর একান্ত কথকতা প্রকাশিত হয় কবিতায়। তিনি খুঁজে বেড়ান ‘খরতপ্ত মাটির হৃদয়’ খোঁজেন কেন –

রক্তের করুণ ফোঁটা লেগে আছে স্ফটিকের মতো

সজল স্বপ্নের পাশে

মাটি, ধুলোকাদা শরীরের সুষমা ও বেদনার মতো

কে জানে কোথায় কবে কোনো এক বিধাতার শিল্পকর্ম

অবশেষে মানবিক হল

মানুষের স্বপ্ন আর সহবাসে মাটিও মানুষ হল

মাটি হল

(‘মাটি’)

এই শিল্পভাষা অবশ্যই উত্তরায়ণমনস্ক সংবিদের, যা ক্ষয় ও অবিশ্বাসের উলটো মেরুতে দাঁড়িয়ে সাহসের সঙ্গে নবনির্মাণের স্বপ্ন দেখাতে পারে। ‘শোকের সায়াহ্ন দেখে নির্জনতা দেখে’ এবং খ-কালের অনুষঙ্গ থেকে অনায়াসে পাড়ি দেয় মহাকালের চিরায়তনে। এ-ধরনের কবিতা শেষ কবে পড়েছি আমরা? কবে ধারাবাহিকভাবে পড়েছি ‘স্মৃতির সবুজ ঘাসের স্বপ্ন’, ‘উঠোনের ওপারে একটি শান্ত নীল দিঘি’র কথা যেখানে স্বচ্ছন্দভাবে সম্পৃক্ত হয়ে যায় ভাটিয়ালি গান শুনতে ভালোবাসেন এমন এক গ্রামীণ

কৃষক এবং কবি চ-ীদাসের উপস্থিতি? এই পৃথিবী যে কোনোদিন ছিল আমাদের, সেই সত্যই তো নিঃশব্দ হারিয়ে গেছে। তাই মনে হয়, ‘মরমি মাটির গন্ধ শরীরে শিরায়’ (‘কখনো সাহসী পুরুষ’) নিয়ে কবি সাদিক চান স্মৃতির পুনরুজ্জীবন। হয়তো লেখা উচিত স্মৃতিভ্রষ্ট আমাদের তিনি ফিরিয়ে দিতে চান কিছু অমূল্য মুহূর্তের স্মৃতি, যেসব কোনো-না-কোনোভাবে আমাদের প্রত্যেকের জীবনের ঝাঁপিতে অনাদরে সঞ্চিত রয়েছে। হয়তো আমরা তাকাই কেবল, দেখি না কিছুই। কবি লেখেন তাই স্মৃতিজাগানিয়া বাচন :

এখনো ঝিলের পাশে নীরবে নিঃশব্দে বসে মাছরাঙা

ধবল বুকের স্মৃতি সাদা বক, ফড়িঙের ডানা

কচুরিপানার পাশে মাছের নিশ্বাস

সরষে ফুলের বুকে মৌমাছি ও মধু

সুদূরের গ্রাম থেকে উড়ে-আসা সুতোছেঁড়া ঘুড়ি

(‘আবার দেখব বলে’)

হ্যাঁ, সাদিকও কবিতায় ছবি লেখেন। কিন্তু তা জীবনানন্দের মতো নয়, জসীমউদ্্দীনের মতো নয়, আল মাহমুদের মতোও নয়। সাদিক লেখেন ঠিক সাদিকেরই মতো। ছবির চিত্রলতার সঙ্গে মিশে যায় গানের সুরমূর্ছনা। অনুভবে বুঝি, লোকায়ত দর্শনে দীক্ষিত এই কবির বাচন নিবিড়ভাবে চিহ্নায়িত :

হাওরের পাড়ে আজো উড়িয়ে আঁচল তুমি অপেক্ষায় আছ

জোছনায় নিরিবিলি কাঁদো

বাউলের দোতরায় থাকো রাত, হাহাকার

আমি সেই হাহাকার ভালোবেসে বেঁচে আছি

(‘তদেব’)

যন্ত্রসভ্যতার বাহক মানুষের ঔদ্ধত্য বেপরোয়াভাবে বিদূষণ ছড়ায় সর্বত্র। সুরমা নদীর জলও বর্জ্য বিষ বইতে বইতে বেদনার্ত। কবির বহুস্বরিক বাচনে ব্যক্ত হয় :

আজো সে সুরমা

ধীরে বহে, তার

শরীরে সাঁতার দেয় উলঙ্গ কিশোর

আমি সে কিশোর হব বলে বেঁচে আছি

আমি সেই বাঁশি হব বলে রাত জেগে আছি।

(‘তদেব’)

সুরমা নদীর গাঙচিল হেমাঙ্গ বিশ্বাস শূন্যে উড়াল দিয়ে বড়ো আকাশে পৌঁছে গিয়েছিলেন। কিন্তু মোহাম্মদ সাদিক উলঙ্গ কিশোরের মতো সুরমার জলে মগ্ন থাকলেই খুশি, সুনামগঞ্জের মাটি ও হাওরের সুরে দোহার হয়ে বাঁশি বাজাতে পারলে আর অন্য কিছু চাই না। কেননা তিনি নিসর্গের ও ফকিরি ধারার শরিক। সব কাঁটা ধন্য করে ফুল না-ই ফুটুক, তিনি শুধু বুঝে নিতে চান ‘কার কাঁটা ভালোবাসে কার কাঁটা দুখ জাগানিয়া’ (‘চাষবাস’)। দুঃখের নিবিড় মূল্যে জীবনকে যাচাই করে নিতে চান এই কবি, কেননা বেদনা তাঁর কাছে জীয়ন-ব্যাপ্ত নীরব তপস্যার অভিব্যক্তি। সর্বব্যাপ্ত দৃষ্টিহীনতার সন্ত্রাসের প্রেক্ষিতে দার্শনিক বীক্ষায় নিষ্ণাত কবিতা প্রকৃতপক্ষে চিরকালীন সাম্প্রতিকের প্রত্যয়দীপ্ত নান্দনিক ঘোষণা। এবং, তেমন বয়ানের স্রষ্টা হিসেবে বহুদিন স্মরণীয় থাকবেন মোহাম্মদ সাদিক। বস্তুত এই বর্গের পাঠকৃতি সম্পূর্ণ উদ্ধৃতিযোগ্য। পরিসরের অভাবে কয়েকটি মাত্র উল্লেখ করছি। ‘রূপান্তর’ কবিতাটি নিরভিমান সারল্যের ও বিপুল গভীরতার অনন্য দৃষ্টান্ত :

এই দেহ মাটি হবে

এর চেয়ে সত্য নেই

তবু এই দেহটাকে কী ভেবে সাজাও

সুপারি বাগান ভেবে যতœ-আত্তি করো

রোদেতে শুকাও

দেহখানি ধন তাই দেহতত্ত্ব সার

কার ছায়া কাকে দিয়ে মাঝি করে পার

 

মনিয়া পাখিরা বলে এই কথা ঠিক

হৃদয়ে হাসন রাজা শরীরে সাদিক।

পড়–য়ারা হয়তো অন্তিম পঙ্ক্তিকে এভাবে সম্প্রসারিত করতে পারেন : এই কবি শরীরে সাদিক হলেও হৃদয়ে এবং চৈতন্যে শেখ ভানু, সৈয়দ শাহনূর, শীতালং শাহ, দুদ্দুই শাহ, পাগলা কানাই। এত সহজ ভাষায় যে কবিতা লেখা সম্ভব, আধুনিকতাবাদ ও আধুনিকোত্তরবাদের অহংকারে আমরা কি ভুলে যাইনি। কেননা অগভীর চলাচলের মাদকে বুঁদ মানুষেরা কি নানা কারণে এবং অজুহাতে (রাষ্ট্রযন্ত্রের ফ্যাসিবাদী দমন, রাজনৈতিক সমাজের ক্রমবর্ধমান নির্লজ্জতা ও হিংস্রতা, পৌর সমাজের সম্ভোগ-সর্বস্বতা, লোলুপ ব্যক্তিসত্তার মেরুদ- সমর্পণ, আদর্শহীন তীব্রতিক্ত নিরালোক ইত্যাদি) কবিতার ভাষাকে মিথ্যায় সংক্রমিত করেনি? অথচ কবিদের কাছে আমাদের একদা প্রত্যাশা ছিল। অন্যেরা সবাই মিথ্যা বলে, বলুক, কবিদের কাছে আমরা সত্য চাই।

সাদিক লক্ষ করেছেন, ‘ইতিমধ্যে/ চুপচাপ হয়ে গেছে পৃথিবীর তাবত বিপ্লবী ভাষাহীন হয়ে গেছে কবিও/ মানুষ, তির ও ধনুক হাতে বেরিয়েছে শিকার যুগের নাগরিক। তবে তিনি তো সত্যনিষ্ঠ কবি; অতএব জীবনের উপলব্ধ সত্য সহজ ভাষায় প্রকাশ করে যাওয়া তাঁর কাছে ব্রতযাত্রা যেন। সুখ-শিকারীদের উল্টোমেরুতে দাঁড়াতে পারা এবং দাঁড়িয়ে থাকাই এসময় মস্ত প্রতিবাদ।’ ‘দুঃখের-দ্রাঘিমা’ কবিতার এই পঙ্ক্তিগুলো লক্ষ করা যাক :

দুঃখ এখন কান পেতে রয় রাতবিরেতে জেগে থাকে

দুঃখ এখন ম্যানিফেস্টো : উড়কি ধানের মুড়কি দেব

কুলুঙ্গিতে ময়লা জমে অনার্য এক মেøচ্ছ পাড়ায়

দুঃখ এখন মিছিল সেরে দুপুর রোদে বাড়ি ফিরছে

… … … …

দুঃখ এখন তেত্রিশ পৃষ্ঠা গদ্যে আছে, আর কোথাও কিচ্ছুতে নেই।

যথেষ্ট সপ্রতিভ এই বাচনভঙ্গি। তবে পাঠককে বুঝে নিতে হবে, ওই সপ্রতিভতার অন্তরালে প্রচ্ছন্ন বোধের অন্বিষ্ট কী? আস্তিত্বিক সন্তাপ যতই থাকুক, সেজন্যে তো খেদ নেই কবির। কারণ, তাঁর কবিতার বিভিন্ন পাঠকৃতিতে ছড়িয়ে আছে যুগপৎ নিমগ্নতা ও ঊর্ধ্বায়নের প্রতি তাঁর অস্খলিত বিশ্বাস। নইলে ব্যাপক অনন্বয় ও প্রতাপের প্রতি পতঙ্গের মতো ধাবিত হওয়ার আত্মঘাতী আয়োজন থেকে আপন কবিসত্তাকে তিনি বাঁচিয়ে রাখবেন কীভাবে? যেহেতু বাউলের হাতের একতারার মতো উঁচু তারে বাঁধা তাঁর মন, সাদিক অনুভব করেন :

এখন এখানে বেঁচে-থাকা মানে মুড়ির ঠোঙার মতো বাঁচা

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম কেরানির মতো বাঁচা

নুন আনতে পান্তা ফুরায়, পান্তার পানির মতো

নিরীহ নিয়মে বেঁচে থাকা

(‘কুশল সংবাদ’)

সতর্ক পাঠকের নিশ্চয় নজরে পড়ে আটপৌরে উপমা প্রয়োগে সহজ সুরের লক্ষ্যভেদী উচ্চারণ। এই কবিতার প্রারম্ভিক তিনটি পঙ্ক্তি উপলব্ধির ভিন্ন মাত্রার বার্তা দেয় :

পুরোনো পুথির মতো ছিন্নভিন্ন বেঁচে আছি

অথবা এখন বেঁচে নেই, ছায়া আছে শুধু

ছায়া আছে শরীরের শিরায় শিরায়

(‘কুশল সংবাদ’)

রক্তবহা ধমনিতে বয়ে যাচ্ছে ছায়া, নিঃসন্দেহে তা নতুন ধরনের ভাবনা। কোনো-না-কোনোভাবে নিগূঢ় দেহতত্ত্বের ভাবনা-পরম্পরার নির্যাসে সাদিকের চেতনাবিশ্ব ও ভাষাবিশ্ব লালিত, এ-কথাই মনে হয় বারবার। ‘ভূমিহীন’ কবিতার অন্তিম চারটি পঙ্ক্তি এর নিদর্শন :

আমার নামে কিছুই নেই, রাত্রি এবং আঁধার ছাড়া

শোকের বৃক্ষ বুকের ভেতর মেলছে ডানা

বাড়ছে কেবল শিকড়-বাকড় আর কিছু নেই

এই দেহজমিন ছাড়া আমার অন্য কোনো ভূমি তো নেই।

প্রসঙ্গত লিখি, সাদিকের কবিতাবিশ্বে যেসব আদিকল্পের প্রয়োগ বারবার ঘটেছে, তাদের উৎস লোকায়ত অধ্যাত্মভুবনে। ভাবনার যে-বিশেষ আকার এতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তাতেই কবির অনন্যতা প্রতিষ্ঠিত। প্রায় ৮০ বছর আগে বিখ্যাত কবিতাতাত্ত্বিক মড্ বড্কিন ‘অৎপযবঃুঢ়ধষ চধঃঃবৎহং রহ চড়বঃৎু’-তে আদিকল্প-প্রয়োগ বিশ্লেষণের যে-দিকনির্দেশ করেছিলেন সে-কথা মনে পড়ছে। সাদিকের কবিতার ভাষায় ব্যাপক প্রাকৃতায়নের বিষয়টি ইতোমধ্যে উল্লেখ করেছি। এই নিরিখে লক্ষণীয় ‘তিতিমিতি অন্ধকার জোনাক পোকার আলো ধান আর দূর্বা’র (‘যদি বলো ফিরব না’) মতো পঙ্ক্তি কিংবা/ আমার শুধু হাওরের কথা, ছইতোলা নৌকার কথা মনে পড়ে/ টিনের চালের পর মরমি বৃষ্টির শব্দ আর রেখার রোদন কণ্ঠে/ ‘সাধের একতারা আমার …’/ শিয়রে দাঁড়িয়ে-থাকা বিশাল বিষণœ এক পাহাড়ের কথা মনে পড়ে’ (‘ইচ্ছেগুলো স্বপ্নগুলো’) – এই পঙ্ক্তিগুলো। এই কবিতার অন্তিম দুটি পঙ্ক্তি সাম্প্রতিকতার গুণে স্মরণীয় ‘হৃদয় তখন শুধু একটি অপ্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মতো বালিশের নিচে পড়ে থাকে।’

এতসব লিখেও মনে হচ্ছে, কবি মোহাম্মদ সাদিকের কবিতার ভেতরে প্রচ্ছন্ন আদিগন্ত ব্যাপ্ত হাওরের কথা কিছুই লেখা হলো না। লেখা হলো না তাঁর নিবিড়তম উপলব্ধির সত্যের কথা। লেখা হলো না কবিকৃতির সেই অসামান্যতার কথাও, যা সাম্প্রতিক বাংলা কবিতায় বিরল হয়ে পড়েছে। শফাত শাহের লাঠি সংকলনের শেষ ৫৮টি পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে একের পর এক অনির্বচনীয়ের হাতছানি। তুরীয় এই পর্যায় শুরু হয়েছে ‘পাঠ করো যে কোনো কবির নামে’ শীর্ষক দীর্ঘ কবিতা দিয়ে। সম্পূর্ণ কবিতাটি উদ্ধৃত করতে না পারলে ‘ঘাসের বুকের মধ্যে ক্ষীণকায় ফুলের জীবন’ আর ‘হারানো ডানার মহাকাব্য’-এর তাৎপর্যের হদিস দেওয়া অসম্ভব। কবি তাঁর শিল্পসিদ্ধির শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছেছেন এসব কবিতার মধ্য দিয়ে। নিবিড়তম অনুভবের সামর্থ্যে কবি জানিয়েছেন, ‘এ কবিতা শুধুমাত্র তার কথা বলে/ মিথ্যাকে বর্জন করে’ ‘কবি মানে প্রেম’, ‘কবি-যিনি নির্মাণ করেন, কবিতা মানেই নির্মাণের কথাকতা।’ সম্পূর্ণ কবিতাটি পড়ার পরে মনে হয় যেন আলোর সাগরে অবগাহন করে এলাম। আর, পরমুহূর্তেই মনে হয়, বারবার অবগাহন না করলে বুঝি আনন্দের বোধ সম্পূর্ণ হবে না।

এই তুরীয় পর্যায়ে কবির ছন্দবোধ অপরূপ সূক্ষ্মতায় ব্যক্ত হয়েছে। পরপর পড়তে হবে ‘দেহ’, ‘এবং বিদায়’, ‘লিলুয়া বাতাসে কান্দে’, ‘কবি, কবিতা ইত্যাদি’, ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে’, ‘যেন কেউ চেনা নয়’ ইত্যাদি বয়ান। শেষোক্ত কবিতার অন্তিম চারটি পঙ্ক্তিতে সম্বোধক ও সম্বোধিত অপূর্ব সুরসাম্যে সম্মিলিত হয়েছে :

ও ধূলি আমাকে নাও, ও বৃক্ষ আমাকে রাখো

ছন্দহীন, শব্দহীন ভাষা ভুলে যে মানুষ

পথে দাঁড়িয়েছে – তার আর্তনাদ নিঃশব্দ চিৎকার

তুমি কি শুনতে পাও?

একই কথা প্রযোজ্য ‘চিঠি’, ‘পকেট থেকে হারিয়ে গেছে’, ‘নৌকা ও নদীর গল্প’, ‘এক জোছনায় একজন প্রাচীন পুঁথিকর’, ‘আট

কুঠুরি নয় দরোজা’, ‘শূন্যের মাঝার’, ‘কে লইব খবর’, ‘সর্বত্র বিরাজিত তুমি’, ‘শফাত শাহের লাঠি’, ‘যে কথা বলতে চাই তুমি শুনবে না’, ‘যাও পাখি বোলো তারে’, ‘পারাপার বড়ই কঠিন’, ‘অরূপ কথা’, ‘একে শূন্যে দশ’, ‘কে কোথায় থাকে’, ‘গুরু উপায় বলো না’, ‘পরাণ মাঝি’, ‘আরেক জীবন’, ‘অনুকাব্য’ ইত্যাদি কবিতা সম্পর্কেও।

সেই কবে থেকে স্মরণযোগ্যতাকে আমরা ভেবে নিয়েছি কবিতার সবচেয়ে মৌলিক অভিজ্ঞান। এই নিরিখে শফাত শাহের লাঠি সংকলনটি সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। আর, যাকে একটু আগে কবিসত্তার তুরীয় পর্যায় বলে চিহ্নিত করেছি, উল্লিখিত পাঠকৃতিগুলো সম্পূর্ণ অভিনিবেশ দিয়ে পড়ার পরে এদের লক্ষ্যভেদী সামর্থ্য নিয়ে কোনো দ্বিধা প্রকাশের অবকাশ থাকবে বলে মনে হয় না। মোহাম্মদ সাদিকের পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে এ-কারণেই আগ্রহ থাকবে যে বুঝতে চাইব তিনি কীভাবে নিজেকে পেরিয়ে যাবেন। তিনি কীভাবেই-বা উত্তরায়ণমনস্ক চেতনার দিগন্ত বিস্তার ঘটাবেন। অস্তিত্ববোধ ও দার্শনিক সংবিদের এই যুগলবন্দি কি সম্ভাব্য কোনো পরবর্তী উদ্ভাসনের প্রাক্কথন হিসেবে বিবেচিত হবে? অথবা জীবনানন্দের সেই উচ্চরণই অমোঘ : ‘এই পৃথিবী একবার পায় তারে/ পায় না কো আর’! আমরা অপেক্ষা করব।

আপাতত সমাপ্তিবিহীন উপসংহারে ‘আরেক জীবনে’র ছন্দদোদুল শুদ্ধতম ও মহত্তম বিষাদ সিঞ্চিত উচ্চরণ স্মরণ করি :

চোখের কোণে অশ্রু আসে কেমন করে মন

জীবন মানে কাঁদতে মানা জীবন মানে বন

… … …

মিথ্যা সকাল মিথ্যা বিকেল মিথ্যা মধ্যরাত

মিথ্যাবাদীর আছে এখন সাড়ে তিনশ হাত

এ কারণেই কান্না আসে কেমন করে মন

কাঁদতে মানা সবার শুধু কাঁদেন মহাজন

‘কলসিভরা সমুদ্দুর’ নিয়ে আসলে অলক্ষে কাঁদেন মহাজন মোহাম্মদ সাদিকও তাঁর কবিতায়। সত্যের জন্যে কান্নাই তাঁর কবিতা, যা

প্রকৃতপক্ষে ঈপ্সিত জীবন নির্মাণের কথকতা।