অনুবাদ : সম্পদ বড়ুয়া

সে দিন শনিবার বিকেলে খামারের মালিক তার শ্রমিকদের প্রাপ্য মজুরি পরিশোধ করছিল। সূর্যটা তখন পশ্চিমে হেলে পড়েছে। এ-কাজ করতে করতে অন্ধকার ঘনিয়ে এলো। রান্নাঘরের দরজায় যে লণ্ঠনটা ঝুলছিল সেটা থেকে হলদে আলোর রেখা লোকজনের যাতায়াতের পথে গড়াগড়ি খাচ্ছে। গাছগাছালি আর তার নিচে অন্ধকার মুখগুলো সে-আলোতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

এই শনিবারে শ্রমিকরা তাদের মজুরি নিয়ে বরাবরের মতো নিজ নিজ গন্তব্যের দিকে না গিয়ে একটু দূরে গাছের পত্র-পল্লবের নিচে অন্ধকারে সরে দাঁড়াল আর সময় কাটানোর জন্য নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে লাগল। সবার শেষের লোকটাকে মজুরি দেয়ার পর মালিক বলল, ‘এবার মহিলা আর ছেলেমেয়েদের ডাকো। এই সীমানা ঘেরার মধ্যে যারা আছে প্রত্যেককে এখানে থাকতে হবে।’ টেবিলের পাশে দাঁড়ানো শ্রমিকপ্রধান সবার নাম একে একে ডাকছে, একটু সামনে এগিয়ে এসে নামগুলো ধরে ধরে আবার বলছে। অনেকটা নিঃস্পৃহ কণ্ঠে সে
এ-কাজটি করছে, যা দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবছর এটা করা হয়ে আসছে। গাছের নিচে অপেক্ষমাণ মহিলারা সামনের দিকে চলে এলে পেছনে ভিড়ের মধ্যে একটা নিয়ন্ত্রিত চলাচল লক্ষ করা গেল। মহিলাদের ঘাগড়ার গোছা, তামার বালা আর

মাথায় উজ্জ্বল কাপড়ের ওপর সেই আলো ঠিকরে পড়ছে।

ঈষৎ আলোকিত এসব মুখ এখন আশা করছে শিগগির এ-মজুরি প্রদানের অনুষ্ঠানটি শেষ হবে আর তারা তাদের কুঠিরের রান্নাঘরে ফিরে যাবে। কোনো নির্দেশ না পেলেও তারা আরো কাছে এসে ভিড় জমাতে শুরু করল।

খামারের মালিক এবার কথা বলতে শুরু করল। সে ভাবছে, অন্ধকারে ভালো করে দেখা না গেলেও তার এই বিস্তীর্ণ এলাকায় বাতাসে সাগরের মতো একটা ক্ষীণ হুড়মুড় করে প্রবাহিত হওয়ার মতো গোলমেলে শব্দ ভেসে আসছে। এ-ধরনের কাজ সে আগে অনেকবার করলেও এবার এটাকে সময় নষ্ট মনে করে অনেকটা নিরাশ হয়ে কাজে হাত দিলো। এসব ভালো উর্বর জমিতে কচি কচি চারার ওপর সূর্যের আলো পড়ার কথা স্মরণ করে তার কণ্ঠে সনির্বদ্ধ আহ্বান আর একই সঙ্গে ক্ষোভ ঝরে পড়ছে।

সমস্যা যেটা হয়েছে তা হলো, প্রতি বছর কিছু কালো হাত গভীর রাতে ভুট্টা গাছের বোঁটা থেকে ভুট্টাদানা আর তার বস্তা তুলে নিয়ে যাচ্ছে। মালিক কিছুতেই চোর ধরতে পারছে না। চুরির পরের দিন সকালে ভুট্টাক্ষেতে সারি সারি গাছের মাঝখানে ধুলোর ওপর পায়ের দাগ শুধু দেখা যায়। মালিক সর্বতোভাবে চেষ্টা করছে, সবাইকে সতর্ক করেছে, ভয় দেখিয়েছে, রেশন কমিয়ে দিয়েছে – এমনকি পুরো এলাকার সবার ওপর সম্মিলিতভাবে জরিমানা আরোপ করেছে; কিন্তু এতেও কোনো পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়নি। এই সীমানা পরিবেষ্টিত জায়গার পাশে যে জমি পড়ে আছে সেটার ফসল লুট করা হয়েছে। যখন মাড়াই করার লোকজন ফসলের বোঝা ঘরে আনে, প্রত্যেকে জানে যা আশা করেছিল তার অনেক কম ফসল তারা পেয়েছে।

সবাই যেহেতেু বিষয়টা জানে তাহলে দশম বারের জন্য একই দৃশ্যের অবতারণা কেন? এ-প্রশ্নটাই খামারি তার সামনে থাকা মুখগুলোর মধ্যে দেখতে পাচ্ছে। অস্থির দেহ আর বারবার নড়াচড়া করা পায়ের ওপর তাদের শান্ত মুখগুলো একবার এদিকে আর একবার ওদিকে ফিরিয়ে নিচ্ছে। তারা কেবল ভাবছে কখন কুটিরে ফিরে যাবে আর তাদের জন্য অপেক্ষমাণ রাতের গরম খাবার খাবে। যৌক্তিক ভদ্রতা নিয়ে অধীন লোকদের প্রতি সৌজন্য প্রদর্শনের পরও তার প্রতি যে ব্যবহার করা হয়েছে তা তাকে ক্ষোভে ক্ষিপ্ত করে তুলেছে। কথা বলার সময় বাক্যের মাঝপথে সে থেমে যায়, হাতের কব্জি দিয়ে টেবিলে প্রচণ্ড আঘাত করে আর তাই তার দিকে যেসব মুখ, পা আবিষ্ট হয়ে আছে সেসব নিশ্চল হয়ে থাকে।

‘জোনাস’ মালিক ডাক দিলো। বাইরে স্বল্পালোকিত স্থানে শান্ত চেহারার একজন লম্বা বয়স্ক লোক পা রাখল। তবে এখন তাকে বেশ বিষণ্ন দেখাচ্ছে। মালিক তার সেই অভিব্যক্তি দেখল আর তাকে মোকাবিলা করার জন্য শক্তি সঞ্চয় করল। বেশ অনেক বছর লোকটা খামারে কাজ করছে। ‘বুড়ো বদমাশ’ – এ-নামেই খামারের মালিক তাকে ডাকাডাকি করে। স্নেহবশতই এভাবে ডাকে। লোকটাকে সে পছন্দ করে, কারণ তারা দীর্ঘদিন ধরে একত্রে কাজ করেছে। বছরের অর্ধেক সময় জোনাস এটা-সেটা করে দিন চালায় – বাগানে পানি এনে দেয়, পশুর চামড়ার পরিচর্যা করে, ঘাস কাটে। তবে ফসল বেড়ে ওঠার সময় সে একজন অতি প্রয়োজনীয় ব্যক্তি হয়ে ওঠে।

‘এখানে এসো জোনাস’, খামারের মালিক আবার বলল। চেয়ারের সঙ্গে সবসময় ঝোলানো রাইফেল-৩৩টা হাতে তুলে নিল। বর্ষার সময় জোনাস তার কুটিরে ঘুমিয়ে দিন কাটায় আর ঠান্ডা ভোর আসা পর্যন্ত সারাটা রাত মাঠে হরিণ আর শূকরের আক্রমণ থেকে গাছের কচি চারা রক্ষার জন্য পাহারা দেয়। এসব প্রাণী বিশেষ করে একপাল শূকর এক রাতেই পুরো এলাকার ফসল নষ্ট করে দিতে পারে। বন্দুকটা সে হাতে নিল, হাসিমুখে ওটাকে সম্ভাষণ জানাল, হাতে তুলে নিলে ওটার জানা ওজনটা ভালো করেই অনুভব করল। তবে তার মধ্যে কেমন যেন একটা অনীহা ভাব এসে গেছে।

‘জোনাস, এ-বছর তুমি যা কিছু দেখবে একেবারে গুলি করে দেবে, বুঝেছ?’

‘হ্যাঁ, মালিক।’

‘সবকিছু – হরিণ, বড় বাঁদর, শূকর। যা কিছু তুমি শুনতে পাবে। তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে না। কোনো গোলমালের শব্দ শুনলেই গুলি করবে।’

যারা এসব কথা শুনছে তাদের মধ্যে একটু নড়াচড়া, হালকা প্রতিবাদী শোরগোল শোনা গেল।

‘আর যদি দেখো যে, ওটা একটা মানবীয় শূকর, তাহলে তো আরো খারাপ হবে। আমার জমিতে কোনো ধরনের শূকরের স্থান নেই।‘

জোনাস কোনো কথা বলল না। তবে অন্যদের দিকে ফিরে বন্দুকটা অস্বস্তিকর অবস্থায় হাতে ধরে রাখে; ভাবখানা এমন যে, অন্যরা তাকে মূল্যায়ন করতে পারেনি।

‘তোমরা যেতে পারো।’ খামারের মালিক বলল। অল্পক্ষণ পরেই তার সামনের জায়গাটা খালি হয়ে যায়। অন্ধকার পথে লোকজনের নিজ নিজ গন্তব্যে খালি পায়ে রওনা হওয়ার শব্দ সে শুনতে পাচ্ছে, তাদের উচ্চস্বরে রাগত বাক্যালাপও শোনা যাচ্ছে। জোনাস মালিকের পাশেই দাঁড়িয়ে রইল।

‘তাহলে সব ঠিক আছে তো, জোনাস?’

‘এ-বছর আমি কোনো গুলি চালাতে চাই না।’

খামারের মালিক এ-বিষয়ে একটা ব্যাখ্যার জন্য অপেক্ষা করে। যে-আদেশ সে দিয়েছে সেটা নিয়ে মোটেই বিব্রত নয়। প্রায় প্রতিবছরই লোকটা এ-খামারে কাজ করে আসছে, কাউকে গুলি করা হয়নি, যদিও প্রতি ঋতুতে রাতে ভুট্টার শীষের সারিতে চোর হানা দেয় আর জোনাস বন্দুক নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। প্রয়োজন হলে সে চিৎকার করে কিংবা অনুপ্রবেশকারীদের ভয় দেখানোর জন্য আকাশের দিকে ফাঁকা গুলি ছোড়ে। ভোর হলে কোনো কিছু দেখার সঙ্গে সঙ্গে সে তার দিকে গুলি ছোড়ে। এসবই ছিল একধরনের প্রতারণা। এরকম ভীতি প্রদর্শন কিছু ভীরু লোককে ঘাবড়ে দিতে পারে। তবে উভয় পক্ষই বরাবরের মতো জানে, এটা ধাপ্পাবাজি। ভুট্টাদানা ঠিকই অদৃশ্য হবে, কেউ এটাকে আটকাতে পারবে না।

‘তাহলে কেন গুলি করতে পারবে না?’ মালিক শেষে জানতে চায়।

‘আমার বউয়ের জন্য। আমি আপনাকে বিষয়টা দেখার জন্য আগেই বলেছিলাম।’ জোনাস তার আঞ্চলিক ভাষায় কথাগুলো বলল।

‘ওহ, তোমার বউ!’ খামারের মালিকের মনে পড়েছে। জোনাস অনেকটা সেকেলে ধরনের। তার দুই বউ – প্রথম বউ একজন বয়স্কা মহিলা, যে অনেক ছেলেমেয়ের জন্ম দিয়েছে। আর আছে যুবতী বউ, যে তাকে ভালোই বিপদে ফেলেছে। গত বছর এই নতুন বউটি তার জীবনে এসেছে। বউকে ফেলে রাতে বাইরে থাকতে হবে বলে সে
এ-কাজটি নিতে চায়নি।

‘তাহলে দিনের বেলায় কাজের খবর কী?’ মালিক অনেকটা পরিহাসচ্ছলে টিপ্পনি কাটল। কারণ গত বছর সে-ই তো ছিল। সে দাঁড়িয়ে ঘরের ভেতর যাওয়ার জন্য তৈরি হলো।

জোনাস মালিকের কথার কোনো উত্তর দিলো না। চুরির বিরুদ্ধে নিজের লোকদের দ্বারা দাপ্তরিক পাহারাদার নিযুক্ত হওয়ার ইচ্ছে তার একেবারে নেই। সেটাও বড় কোনো ব্যাপার ছিল না, কারণ আক্ষরিক অর্থেই তার পক্ষে এরকম আদেশ প্রতিপালনের ঘটনা কখনো ঘটেনি। তবে এবারের দায়িত্বটা যেন বোঝার ওপর শাকের আঁটি। দিন দিন তার বয়স বাড়ছে, গাছপালা ঝোপঝাড়ের মধ্যে ঘোরাফেরা না করে নিজের কুঁড়েঘরে শান্তিতে রাত কাটাতে চায় সে। গত বছরই এ-দায়িত্ব পালন তার খুব অপছন্দ ছিল আর এখন আরো খারাপ হয়েছে। রাতে সে বাইরে বের হলে এক যুবক তার সুন্দরী যুবতী বউয়ের কাছে চলে আসে।

একবার নিদারুণ হতাশায় হাত বাড়িয়ে সে একটা লাঠি তুলে নিয়েছিল বউটাকে মারার জন্য। তারপর আবার সেটা ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল। আসলে সে তো বুড়ো হয়ে গেছে, আর ওই লোকটা যুবক। বউটাকে মারলেও তার নিজের ব্যথা প্রশমিত হবে না। এ-বিষয়টা নিয়ে একবার সে মালিকের সঙ্গে আলাপ করতে এসেছিল, যেভাবে একজন মানুষ আরেকজনের সঙ্গে আলাপ করে। কিন্তু মালিক কিছুই করতে পারবে না বলে সাফ জানিয়ে দেয়। সত্যিই তো, তার কী করার আছে? আর তাই সেই সময়ে তাকে যা বলেছিল তা পুনরায় বলতে বলতে মালিক এক হাতে বাতিটা কাঁধের ওপর উঁচু করে ধরে রান্নাঘরের সিঁড়ি বেয়ে ভেতরে ঢোকার জন্য পা বাড়ালো। বাতি থেকে বিচ্ছুরিত আলোকরশ্মি কাছের ঝোপঝাড়ে আন্দোলিত হচ্ছে। ‘আমি তোমার বউ সম্পর্কে কোনো কিছু শুনতে চাই না, জোনাস। তুমি নিজেই তার দেখাশোনা করবে। তুমি বউকে সঙ্গে রাখার জন্য যদি এত বুড়ো না হও, তাহলে তোমার এত বেশি বয়সও নয় যে, গুলি চালাতে পারবে না। বরাবরের মতো এ-বছরও তুমি বন্দুক সঙ্গে রাখবে, শুভরাত্রি।’ এই বলে পুরো বাগানকে ঘুটঘুটে অন্ধকার ও পথহীন রেখে ঘরের ভেতর চলে গেল সে। জোনাস তখনো সটান দাঁড়িয়ে থাকে, তার চোখ দুটো অন্ধকারের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করে, তারপর সে নিচে নামার পথ ধরে পা চালায়। পায়ের নিচে আলগা পাথরের স্পর্শই তাকে চলার পথ দেখায়।

জোনাস এখনো খাওয়া-দাওয়া করেনি। তবে মালিকের সীমানা-পরিবেষ্টিত জায়গাটার কাছে আসার পর ভাবল, সে আর অগ্রসর হতে পারবে না। রান্নাঘরের জ¦লন্ত শিখার বিপরীতে অনুজ্জ্বল পটভূমিতে কালো ছোট ছোট কুটিরের দিকে তাকিয়ে সে দাঁড়িয়ে পড়ল যেখানে আলোকোজ্জ্বল ধোঁয়ার ভেতর বিক্ষিপ্ত মেঘের ঘনঘটা চোখে পড়ে। ওখানেই তার কুটির, সে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে, দেখতে একটা ছোট্ট চেহারাকৃতির মতো। সেখানে তার বউ দুজনই আছে, তার জন্য খাবার বানিয়ে পরিবেশনের অপেক্ষা করছে।

কিন্তু সে কোনো খাবার খেতে আগ্রহ দেখায়নি। সে ভাবল, কুটিরে গিয়ে তার প্রথম বউয়ের মুখোমুখি হতে সে পারবে না। মহিলা তার চটুল বাক্যে তাকে উপহাস করবে। আর যুবতী বউটা বিনয়ের সঙ্গে তার কথার উত্তর দিলেও চলনে-বলনে কাজে-কর্মে তাকে অবজ্ঞা করবে। সে তাই অসুস্থ হয়ে পড়ে, নিদারুণ যন্ত্রণায় ভোগে, তার যে বন্ধুরা এ-বিকেলে চুলার পাশে সময় কাটানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তাদের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যায়, কারণ তার সঙ্গে প্রতারণার বিষয়টি বন্ধুদের চোখে সে দেখতে পাচ্ছে। ঈর্ষার শীতল যন্ত্রণা যা দীর্ঘদিন তাকে ক্রমাগত কামড় দিয়ে যাচ্ছে তা এখন পুরনো ক্ষতের মতো অনুভূত হচ্ছে; বর্ষা শুরুর আগে পুরনো ক্ষতের ব্যথার মতোই তা বাজে।

মাঠে যাওয়ার কোনো ইচ্ছে তার নেই। মাঠের বিভিন্ন কোনোয় গুলি ছোড়ার জন্য গোলাকার খুঁটি দিয়ে উঁচু আসনে বসার ব্যবস্থা রাখতে যেসব ছোট ছোট কেবিন রয়েছে তাদের একটিতে শক্ত অনড় হয়ে বসার ইচ্ছেও তার নেই। কিংবা অন্ধকারে বৈরী ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে হাঁটতেও সে নারাজ। তবে সে রাতে খাবার খেতে না গিয়ে বরাবরের মতো দীর্ঘ নৈশ পাহারা দেওয়ার জন্য যাত্রা করল।

যাই হোক, পরের রাতে সে আর বের হয়নি, পরের দিনও না, তার পরের রাতগুলোতেও সে যায়নি। সারাদিন রোদের মধ্যে ঢুলুঢুলু চোখে কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে থাকল, বারবার সূর্যের আলোর দিকে চেয়ে থাকে, যেন মনে হয় সূর্যরশ্মি তার মন থেকে অস্বস্তিকর বেদনা পুড়িয়ে প্রশমিত করে দেবে। সন্ধ্যা হয়ে এলে সে তার বন্দুক নিয়ে বেরুবার আগেই রাতের খাবার খেয়ে নিল। তারপর সেই সীমানাবেষ্টিত এলাকা থেকে দৃশ্যমান একটা গাছে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আসলে এ-জায়গাটা তার কুটিরের খুব কাছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে নীরবে চারদিকে নজর রাখছে। নিজেকে অসাড় আর ভারাক্রান্ত মনে হচ্ছে। কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই সে সেখানে অবস্থান করছে। মনে হচ্ছে, তার পা দুটো ওই স্থান থেকে জোড় পায়ে চলে যাওয়ার আদেশ মানছে না। সেই পুরো সপ্তাহ ধরে এলাকাটা অরক্ষিত রয়ে গেছে আর বন্যপ্রাণীরা যদি কচি কচি চারার ওপর হামলে পড়ে সে এসবে ভ্রুক্ষেপ করবে না। এখানে সে আছে শুধু রাত জেগে তার নিজের কুটিরের ওপর চোখ রাখার জন্য। কুটিরের ভেতরে কী হচ্ছে সেটা নিয়ে সে ভাবতে রাজি নয়। ঝোপের আগুন না নেভা পর্যন্ত সে শুধু পাহারা দেবে। একসময় ঝোপঝাড়গুলো ঠান্ডা হয়ে যায়। সে তখন এত নির্জীব হয়ে গেল যে সূর্যোদয়ের সময় বাড়িতে পৌঁছলে তার মুখে ফুটে ওঠে সারারাত হাঁটার পরিশ্রান্ত চেহারা।

পরের শনিবার বিয়ার পানের একটা অনুষ্ঠান ছিল। জোনাস যদি চায় ওখানে উপস্থিত থাকার জন্য ছুটিও পেয়ে যাবে। সূর্যাস্তের সময় বরাবরের মতোই সে নিজের কুটির ছেড়ে বেরুল। মনে হলো, তাকে বেরিয়ে যেতে দেখে নতুন বউ খুশি হয়েছে।

প্রতিরাতের মতোই সে একটা গাছের গুঁড়ির দিকে পিঠটা ঠেস দিয়ে রাখে, যা তাকে একটা ভালো নির্ভরতা দিচ্ছে। বন্দুকটা সে তার বুকের দৈর্ঘ্য বরাবর ধরে রাখে; চোখ দুটো সরাসরি অন্ধকার ছবির দিকে নিবদ্ধ, যা তার কুটিরই হবে। তার যুবতী বউটার মুখ দেখতে কেমন সেটাই সে মনে করার চেষ্টা করছে। ওই ব্যাপারটা নিয়ে কিংবা একই ধরনের আরো বিষয় নিয়ে ভাবতে নিজেকে সুযোগ করে দিলো। যুবক ছেলেটার কথা মনে করলো; মাত্র কয়েকদিন আগে ছেলেটাকে সে দেখেছে – বউটা তখন শস্য চূর্ণ করার জন্য হাঁটু গেড়ে বসলে ছেলেটা তার দিকে ঝুঁকে দুজনে বেশ হাসাহাসি করছিল। পথের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে হঠাৎ তারা চমকে ওঠে। তাকে আসতে দেখে দুজনের মুখ একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে যায়।

ওই দৃশ্যটা কল্পনা করতে গেলে সে অনুভব করে তার মাংসপেশি উত্তেজনায় বন্দুকের লক্ষ্যভেদীর মতো টান টান হয়ে যাচ্ছে। সেজন্য একটু আরাম পেতে বন্দুকটা নিচে মাটিতে নামিয়ে রাখে। তার হাত দুটো নিচে পড়ে থাকে। তবে এত কষ্ট সত্ত্বেও সে ক্রমাগত চিন্তা করতে থাকে আজ রাতের জন্য তার ভেতরে ভেতরে অনেক কিছুর পরিবর্তন হচ্ছে, পুরো বিষয়টাকে সে আর অসাড় বা উদ্দেশ্যহীন ভাবছে না। সটান দাঁড়িয়ে থাকে সে, চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি। বন্দুকের লম্বা ঠান্ডা ব্যারেলটা তার আঙুলের মাঝখানে ছুঁয়ে যাচ্ছে; তার পেছনে গাছের শক্ত অবস্থান দ্বিতীয় মেরুদণ্ডের মতো মনে হচ্ছে। সেই যুবক ছেলেটার কথা ভাবলেই আরেকটা ছবি তার মনের ভেতর বারবার উঁকি দেয়। গত বছর একটা বড় হরিণকে সে গুলি করেছিল। সেটা গুলি খেয়ে তার পায়ের কাছে কোমল হয়ে পড়েছিল। ওটাকে তুলতে গেলে ওর জিহ্বা বাইরে ধুলার সঙ্গে মিশে যায়। সদ্য মৃত বলে ওর রক্ত তখনো গরম চামড়ার নিচে কাঁপছে। ওটার ঘাড়ের নিচে ছোট ভেজা জায়গা থেকে আঠালো কয়েক ফোঁটা রক্ত চকচকে মোটা লোমের ওপর গড়িয়ে পড়েছে। সেখানে দাঁড়িয়ে হরিণটার রক্ত আর নিস্তেজ মৃত শরীর নিয়ে যখন সে ভাবছিল তখন সেই যুবক ছেলেটা আর তার বউ হাসাহাসি করছিল। তার মন শান্ত হলো, ছেলেটার প্রতি যে দুঃসহ মনোভাব ছিল তা চলে গেছে।

একটা দীর্ঘ নিশ্বাস নিয়ে সে আবার বন্দুকটা তুলে নিল। যখন সে সীমানার মধ্যে গাছপালার ভেতর দিয়ে তাকালো তখন বন্ধুর মতো ওটাকে কাছে টেনে নিল।

সূর্যাস্তের লাল আভা আকাশ থেকে এখনো মুছে যায়নি। বড় বড় গাছের নিচে যেসব ঝোপঝাড়ের কাছে জোনাস দাঁড়িয়ে আছে সেখানে তখন অন্ধকার। কুটিরগুলোর মাঝখানে পরিষ্কার খালি জায়গায় নানা রকম ছবি প্রতিভাত হচ্ছে, তারা কথা বলছে, হাসছে আর নাচের প্রস্তুতি নিচ্ছে। রান্নার জন্য ছোট ছোট আগুন জ্বালানো হয়েছে, কেন্দ্রীয় বড় আগুনের মশাল অগ্নিশিখায় জ্বলছে, মেঘের ধোঁয়ার ভেতর হচ্ছে স্ফুলিঙ্গের বর্ষণ। কোমলভাবে বেজে যাচ্ছে ঢোল। সহসা শুরু হবে নৃত্য। ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে অনেক দূরের খামার এলাকা থেকে দর্শনার্থীরা আসছে। এবার হবে একটা দীর্ঘ প্রতীক্ষার পালা।

পূর্বের অবস্থান থেকে সরে এসে যুবক লোকটি সামনে দিয়ে পার হচ্ছে কি না তা দেখার জন্য মাথা ঘোরানোর আগেই তার কাছাকাছি পথ ধরে হাঁটার নরম পায়ের শব্দ জোনাস তিনবার শুনেছে। গত সপ্তাহের প্রতি রাতেই লোকটা অনেকটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে লঘুচিত্তে উৎসুকভাবে এ-পথ অতিক্রম করেছিল, তার দু-চোখ নিবদ্ধ থাকত জোনাসের কুটিরের দিকে। বজ্রপাতের আঘাতে গাছ যেমন স্তিমিত হয়ে যায় জোনাসও তেমনি এবার নিশ্বাস বন্ধ করে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। গাছের ঘন ছায়া তার চারপাশে কালো অন্ধকার হয়ে থাকায় তাকে অবশ্য দেখা যাচ্ছে না। যুবক লোকটার ওপর সে নজরে রেখেছে। কুটিরগুলোর ভেতর দিকে জ্বলন্ত শিখার চারপাশে পথ খুঁজে বের করে লোকটা চলতে শুরু করেছে। বাইরে দলে দলে অপেক্ষমাণ লোকগুলোর একপাশ দিয়ে জোনাস খুব সতর্কতার সঙ্গে অতিক্রম করল যেন মনে হচ্ছে নিজের কুটিরের দরজার ভেতর প্রবেশের আগে কেউ তাকে স্বাগত জানাবে কি না সে নিশ্চিত নয়।

সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। যারা নাচছে, লাফাচ্ছে, বাদ্যযন্ত্রের শব্দ শুনছে, সবকিছুর ওপর জোনাস নজর রাখছে যখন তারাগুলো তার মাথার ওপরে দোল খাচ্ছে আর রাতের পাখিরা তার চারপাশে ঝোপের ভেতর পরস্পর কথা বলছে। আগে এ বিষয়ে চিন্তায় নিজেকে না জড়ালেও এখন সে সরাসরি ভাবছে – সেই ছোট্ট অন্ধকারাচ্ছন্ন কুটিরে কী ঘটছে যা ক্রমান্বয়ে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। সেখানে আগুন নিভে যাওয়ায় নর্তকীরা নাচ ছেড়ে তাদের কম্বলের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। তার পেছনে যখন চাঁদটা ছোট আকারে অনেক উঁচুতে শান্ত অবস্থায় থাকে, যখন চলাচলের পথের ওপর গাছপালা তীক্ষ্ন কালো ছায়া ফেলে, তখন সে বাতাসের গায়ে সকালের গন্ধ খুঁজে পায়; সে দেখে, যুবকটা আবার তার দিকে হেঁটে আসছে। এখন জোনাস তার ভেতরের একরোখা ভাব একটু হালকা করার জন্য পা দুটোর গতি একটু পরিবর্তন করল, বন্দুকটা তার হাতের কাছেই রাখল যাতে ট্রিগারের বাঁকটা আঙুল দিয়ে অনুভব করা যায়।

যুবক লোকটা ক্লান্তির কারণে একপাশে কাত হয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে থাকলে জোনাস তার কয়েক পা পেছনে ধুলোময় পথে নীরবে স্বচ্ছন্দগতিতে চলতে থাকে। তরুপল্লবের খসে পড়া শাখা এসে তার মুখ দুরন্তভাবে ভিজিয়ে দেওয়ার কারণে সে একটু পিছিয়ে আসে, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কুয়াশার বড় বড় ফোঁটা তার পায়ে আছড়ে পড়ছে। বাতাস বেশ ঠান্ডা, তার নিশ্বাস একটা পাতলা মুক্তাখচিত কুয়াশাচ্ছন্ন অশ্রুবাষ্পে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে, যা চাঁদের আলোয় ধীরে ধীরে মিশে যাচ্ছে।

যুবকটা তার সামনে এত কাছে দাঁড়িয়ে আছে, ইচ্ছে করলে তাকে উদ্যত বন্দুক দিয়ে স্পর্শ করা যায়। সে যদি তখনই সেখানে নিজেকে হাজির করে তাহলে গোপনীয়তার কোনো কিছু থাকবে না। তবে জোনাস দৃঢ় আত্মবিশ্বাস নিয়ে সতর্কতার সঙ্গে হেঁটে গেল, আর সারাক্ষণ ভাবতে লাগল কীভাবে একটা দুরন্ত কম বয়সের হরিণকে দশ পা দূর থেকে গুলি করা যায় যখন ওটা ঝোপঝাড়ের ভেতর থেকে ভয়ানক চিৎকার দিয়ে হিমশীতল চন্দ্রালোকিত মাঠে চলে আসে।

তারা জমির একেবারে প্রান্তসীমায় এসে পড়ে যেখানে ভুট্টার শীষ ঢালু হয়ে নিচে নেমে গেছে। তারার গম্বুজের নিচে হালকাভাবে অনুজ্জ্বল সবুজ আলোর মধ্যে জোনাস তখন বিড়ালের মতো হাঁটতে শুরু করে। এখন তার একেবারে নিশ্চিত হওয়ার সময় এসেছে যখন মাঠের কোনায় গুলি ছোড়ার মঞ্চ থেকে সে মাত্র পঞ্চাশ গজ দূরে অবস্থান করছে, যেটা এ-আলোতে দেখতে একটা খুঁটির ওপর বাতিকগ্রস্ত পাখি শিকারের ঘর মনে হচ্ছে। ক্লান্তি আর পানাহারের কারণে যুবক লোকটা টলমলভাবে হাঁটছে। যখন সে তার ভারী পায়ের নিচে প্রাণরসে ভরপুর ভুট্টার শীষ দুমড়ে-মুচড়ে দিচ্ছে, তার পায়ের প্রতিটি পদক্ষেপে তা মড়মড় করে ভেঙে পড়ছে।

ঝোপের ভেতর থেকে আসা বল্লমের মতো গুলি হরিণটার গায়ে লাগল। যখন ওটা লাফ দিতে গেল তখনই গুলির সিসা এসে বিঁধল বুকে। বল্লম যেভাবে বাঁকা হয়ে মাটিতে এসে পড়ে হরিণটা সেভাবেই পড়ে রইল। ওটা অন্ধের মতো অনিশ্চিতভাবে পথ হাতড়ে চলেনি, বিপদের সময় পালিয়েও যায়নি, এতটুকু নড়াচড়া করেনি। জোনাস এবার এই যুবক লোকটার প্রতি নিদারুণ বিরক্তি প্রকাশ করল। প্রতিদ্বন্দ্বী লোকটার প্রতি তার যে বিস্ময় আর মুগ্ধতা ছিল তা ফুৎকারে উবে গেল। ছিপছিপে লম্বা এই যুবক যে পাহারাদারের বউকে হাসতে হাসতে বেকায়দায় ফেলে দেয়, তার সামনে এই বেয়াড়া প্রাণীটি এমন প্রচণ্ড শব্দ করে ভেঙে পড়লেও তার কিছুই করার ছিল না। চারদিকে এত চিৎকার-চেঁচামেচি শোনা গেল যে ভয়ে বিস্ময়ে চমকে ওঠার মতো সেখানে মাইলের পর মাইল কোনো খেলা আর অবশিষ্ট নেই।

সবাই যখন গুলি ছোড়ার মঞ্চে এসে পৌঁছাল, জোনাস মরার মতো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থেকে যুবকটাকে যাওয়ার পথ করে দিলো। বন্দুকটা তার চিবুক বরাবর তুলে এনে দেখে ওটার লম্বা ব্যারেল আকাশের দিকে তির্যকভাবে তাক করে আছে, যা পেছনে বন্দুকের স্টিলের নিচে আলোর ঝিলিক পাঠাচ্ছে। সে অপেক্ষা করছে, একান্তে দাঁড়িয়ে আছে, ভুট্টাক্ষেতের শীষের ওপর যুবক লোকটার শরীরের পেছনের দিকটা যেভাবে আন্দোলিত হচ্ছে তা চেয়ে চেয়ে দেখছে। তারপর একেবারে ঠিক সময়ে সে আবার গুলি করার জন্য বন্দুকটাকে চেপে ধরে আঙুলটা আরো কাছে ঠেসে ধরল।

গুলির শব্দ চারদিকে প্রতিধ্বনিত হলে সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন গোলাকার মাথাটা অদ্ভুতভাবে ঝাঁকুনি খেল, তারায় তারায় মাঠ যেন একেবারে ঢেকে গেছে, শরীরটা মনে হয় ভয়ে গুটিসুটি হয়ে আছে আর একটা হাত ওপরের দিকে ওঠানো যেন লোকটি মাটিতে একপাশে কাত হয়ে পড়ে আছে। তারপর সে ভয়ে সুতীব্র চিৎকারে ভুট্টার শীষের ভেতর অদৃশ্য হয়ে যায়। জোনাস এবার বন্দুক নামিয়ে কান পেতে রাখে। কিছু একটা আছড়ানোর শব্দ সেখানে, একটা ভয়ানক ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ বেরিয়ে আসছে, ঘুমের ভেতর কথা বলার মতো মুখে শব্দগুলো বিড়বিড় করছে।

জোনাস ভুট্টাক্ষেতের সারিতে পা রাখল। মনে হচ্ছে, পাতার ধারালো প্রান্ত তার পা কাস্তে দিয়ে কেটে কেটে নিচ্ছে যতক্ষণ না সে সটান দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে। গাছের পাতা-ফুলের ভেতর এখন শরীরটা মৃদুভাবে ঝাঁকি দিচ্ছে। ওটা নিশ্চল না হওয়া পর্যন্ত সে অপেক্ষা করে; তারপর দেখার জন্য একটু ঝুঁকে এলো, ভালোভাবে দেখার জন্য শীতল চান্দ্র-সবুজ পাতা সরিয়ে নিল।

এটা কোনো পরিষ্কার ছোট গর্ত ছিল না; কাঁচা মাংস মস্ত ফাঁক হয়ে আছে, রক্ত মাটিতে ভিজে কালো হয়ে গেছে, শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিশ্রী সৌন্দর্যহীনভাবে একত্রে গাদাগাদি করে আছে। মুখটা চেপে আছে মাটিতে।

‘একটা শূকর’, পা দিয়ে ওটাকে একপাশে সরাতে সরাতে জোনাস চিৎকার করে শ্রবণরত চাঁদকে বলে, ‘একটা শূকর ছাড়া আর কিছু নয়।’

কথাগুলো শুনতে কেমন লাগে তা অনুভবের জন্য সে আবার বলতে থাকে, ব্যাখ্যা করে, কীভাবে সে অন্ধের মতো ঘোঁৎ ঘোঁৎ করা অদৃশ্য পশুর দলে গুলি ছুড়েছিল।

ডরিস লেসিং : ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক ডরিস লেসিংয়ের জন্ম ১৯১৯ সালের ২২শে অক্টোবর ইরানের কেরমানশাহে স্থানে। তিনি দক্ষিণ রোডেশিয়ার (বর্তমানে জিম্বাবুয়ে) রোমান ক্যাথলিক ডোমিনিকান কনভেন্ট হাই স্কুলে পড়াশোনা করেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি স্কুল ত্যাগ করেন। ১৯৩৭ সালে কাজ নিয়ে সালিসবেরিতে চলে যান এবং বিভিন্ন পেশায় নিজেকে ব্যস্ত রাখেন। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে তিনি আজীবন সোচ্চার ছিলেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস The Grass is Singing (১৯৫০)। তাঁর The Golden Notebook (১৯৬২) প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হন। জীবনের একটা বড় সময় তিনি আফ্রিকায় কাটিয়েছেন আর তাই তাঁর লেখায় বারবার উঠে এসেছে আফ্রিকার বর্ণবাদ আর ঔপনিবেশিক শাসনের বর্বরোচিত বাস্তবতা।

মানুষের মনের গভীর অতলান্তিক অলিন্দে প্রবেশ করে তার সুখ-দুঃখগুলো মুক্তোর মতো তুলে এনে তা প্রকাশের এক আশ্চর্য ক্ষমতা দেখিয়েছেন ডরিস লেসিং। মানুষের জন্মগত স্বাধীনতার স্পৃহা, সামাজিক বৈষম্য, মনস্তাত্ত্বিক বিভাজন, নরনারীর চিরন্তন সম্পর্কের ঘাত-প্রতিঘাত ঘুরেফিরে এসেছে তাঁর গল্প-উপন্যাসে। কালজয়ী এ লেখিকা ২০০৭ সালে ৮৭ বছর বয়সে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৩ সালের ১৭ই নভেম্বর লেসিং লন্ডনে মৃত্যুবরণ করেন। ‘শূকর’ গল্পটি ডরিস লেসিংয়ের ‘The Pig’ গল্পের বাংলা অনুবাদ।