কোনটি বেশি, কোনটি কম, পরিমাপ করা কঠিন। আনন্দ এবং বেদনার দুটি অনুভূতির মিশেলে এ-এক নতুন অনুভূতি। গুরু মহর্ষি বিশ্বামিত্র, তাঁর প্রিয় শিষ্য গালব, দুজনই আনন্দ-বেদনার যৌথ স্রোতধারায় ভাসছেন।
গালবের শিক্ষালাভ শেষ হয়েছে। গুরু বিশ্বামিত্র শিষ্য গালবকে বললেন, এবার যাও, গার্হস্থ্য জীবনে ফিরে যাও। যা-বিদ্যা অর্জন করেছ, জীবজগতের কল্যাণ করো।
বিশ্বামিত্রের ঠোঁট কাঁপছে, চোখে অশ্রুরেখা। গালবের বুকের ভেতর রোদনের ঢেউ।
আচম্বিত উড়ে আসা কোনো ঝরাপাতার মতো গালবের মনে পড়ল, অনেক দিন আগে গুরুদেবের উচ্চারিত একটি শব্দ, ‘গার্হস্থ্য জীবন’। গুরুদেব আজো সেই শব্দটি বেশ জোর দিয়ে উচ্চারণ করেছেন।
গালবের স্পষ্ট মনে পড়ছে, সেদিন পাঠদান শেষে মহর্ষি ধ্যানমগ্ন হয়েছেন। গালব জঙ্গলে বেরিয়ে পড়ে। কিছু ফলমূল, মধু সংগ্রহ করতে হবে। সে জঙ্গল চেনে, জানে এর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের খবর। একসময় জঙ্গলই তার বাসস্থান ছিল।
নদীর অববাহিকা ধরে হাঁটছে। এই পথেই গালবের প্রতিদিনের যাতায়াত। ঝোপের খোঁপার ফুল, গাছের শাখায় ফল, বানরের দুষ্টুমি। নুয়ে আসা একটা গাছের ফল পাড়তে গিয়ে চেখে পড়ে – পাতাঘরে আশ্চর্য সুন্দর একজোড়া হলুদ পাখি, চঞ্চুমিলনে ব্যস্ত। পাখিদম্পতির প্রেমকেলি গালবকে আকৃষ্ট করে। চোখ সরে না। একসময় পাখিদুটি পরিপূর্ণ সঙ্গমে ডুবে যায়। এ অপূর্ব দৃশ্য গালবের শরীরে কেমন এক শিহরণ জাগিয়ে তোলে। সে কত পাখি দেখেছে। পাখিদের গান শুনতে শুনতে রাতে ঘুমিয়েছে। ভোরে জেগেছে পাখিদের মধুর কলরবে। কিন্তু এমন দৃশ্য কখনো দেখেনি, এমন চঞ্চল হাওয়া বয়ে যায়নি মনের ভেতর! কোনোরকমে, কিছু ফলমূল নিয়ে গালব ডেরায় ফিরেছে। কিন্তু চোখ থেকে সরছে না পাখিদম্পতির অদ্ভুত সঙ্গমের দৃশ্যটি।
পাঠে গালবের মন নেই। সকল কাজে ঔদাস্য। বিষয়টা গুরু বিশ্বামিত্রের নজর এড়ায়নি। এরকম তো কখনো দেখা যায়নি। এরপরই তো ওর ব্রহ্মজ্ঞান লাভের প্রস্তুতি শুরু হবে। এমন ব্যাকুলতায় ওর বিদ্যালাভের পথে বিঘ্ন হতে পারে!
গুরু বিশ্বামিত্র গালবকে কাছে ডেকে স্নেহস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার চিত্তে এই কম্পন কেন? আমি তোমার গুরুপিতা, আমাকে সব খুলে বলো। ইতস্তত ভাব কাটিয়ে, জঙ্গলে দেখা পাখিমিলনের দৃশ্যটি গালব খুলে বলল।
সামান্য নীরবতা। বিশ্বামিত্র উঁচু করে হাসলেন, ও হো, এই ব্যাপার!
আবারো হাসলেন। বললেন, ব্রহ্মজ্ঞান লাভ শেষে তুমি গার্হস্থ্য জীবনে যাবে। তখন নিজের প্রখর বোধশক্তি দিয়ে বুঝতে পারবে সঙ্গমের পূর্ণ-মহিমা। শুধু মানব নয়, সম্মত সঙ্গম হচ্ছে প্রতিটি প্রাণীর জীবনধর্মের অংশ। এতে কোনো পাপ নেই, আছে পুণ্যের আলোক।
গালব বিশ্বাস করে, গুরুদক্ষিণা ছাড়া কোনো শিক্ষা পরিপূর্ণ হয় না। সে চায়, যা-কিছু হোক, গুরুদক্ষিণা দিতেই হবে। বিশ্বামিত্র বারবার অনাগ্রহ প্রকাশ করছেন। কিন্তু গালব নাছোড়। প্রিয় শিষ্যের অনড় আবদারে গুরু রাজি হলেন। বিশ্বামিত্র গুরুদক্ষিণা হিসেবে চাইলেন আটশো ঘোড়া। এ-কথা শুনে গালব পড়ল বিপদে। আটশো ঘোড়া সে কোথায় পাবে! আর এ তো যে-সে ঘোড়া নয়। ঘোড়ার শরীরের রং হবে জ্যোৎস্নার স্রোতের মতো সোনালি-সাদায় মেশানো। একটি কান হবে কালো রঙের।
একমাত্র রাজা যযাতি এ-ব্যাপারে সাহায্য করতে পারেন। তিনি হাজারটা যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছেন। কত হাজার লোককে যে গো-ভূমি, সোনাদানা, শস্য দান করেছেন, এর কোনো হিসাব নেই। তিনি দানকেই সম্মানলাভের উপায় এবং সম্মানলাভকেই মহত্তম পুণ্য বলে জ্ঞান করেন। তাঁকে যদি সব খুলে বলা যায়, নিশ্চয় সাহায্য করবেন। কিন্তু তাঁর কাছে কী করে পৌঁছানো যায় – এমন দুশ্চিন্তা গালবের মাথায় ঘুরতে থাকল।
দুই
প্রতিদিনের মতো রাজা যযাতি সভাকক্ষে বসেছেন। তখনো সাহায্যপ্রার্থীর তেমন সমাগম ঘটেনি। এর আগে গালব কোনো রাজপ্রাসাদ দেখেনি। যত দেখে, তার চোখে-মুখে মুগ্ধতার পর মুগ্ধতা হেসে ওঠে। প্রতিটি খোপে আলোকদ্যুতি। রঙিন শার্শি লাগানো চকচকে কপাট, জানালা।
প্রথমে ডাক এলো এক তপস্বীর। রাজা যযাতি তাঁর হাতে কয়েকটি তাম্রমুদ্রা তুলে দিলেন।
তপস্বী তা নিলেন না। মৃদু হেসে বললেন, রাজা যযাতি, আমি বিষয়ী নই। আমার কোনো তাম্রমুদ্রার প্রয়োজন নেই।
রাজা যযাতি কেমন একটু অপ্রস্তুত হলেন। পরক্ষণেই ভূর্জপত্র ও কলম হাতে নিলেন। বললেন, বুঝতে পেরেছি। আপনাকে তবে একখণ্ড ভূমি দিই। আপনি সম্মত হলে এখনই দানপত্র লিখে দিচ্ছি।
তপস্বী এবার আরো শক্ত করে বললেন, আমি গৃহী নই। ভূমিখণ্ড আমার কোনো কাজে আসবে না।
একমুঠো যবকণা হাত নিয়ে রাজা যযাতি বললেন, আপনার চীরবস্ত্র পাতুন, সামান্য শস্য দান করি।
তপস্বী বললেন, আমি ক্ষুধার্ত নই।
যযাতি বললেন, তাহলে আপনি কী চান? আমার সাধ্যের মধ্যে হলে অবশ্যই দেব।
তপস্বী বললেন, আমি আপনার কাছ থেকে কিছু নিতে আসিনি। তবে, কিছুটা সময় যদি দেন, আপনাকে একটি দিব্য লোকনীতির কথা স্মরণ করিয়ে বিদায় নেব।
রাজা যযাতি একটু থমকে থেকে বললেন, বলুন যোগীবর।
তপস্বী বেশ নরম কণ্ঠে, স্বচ্ছ উচ্চারণে বললেন, পুণ্য অর্জন নিঃসন্দেহে লোকজীবনের একটি লক্ষ্য। কিন্তু সেই পুণ্য অর্জনের পথটিও পুণ্যময় হওয়া চাই। যেমন, মহিষের শিংয়ের আঘাতে ফুল ফোটে না, এর জন্য চাই বাতাসের মৃদু ছোঁয়া, নিষাদের হাতে-ধরা কাঠের ক্রুদ্ধ আগুন দেখে পাখিদের ঘুম ভাঙে না, ভাঙে সকালের আসন্ন আলোর ইঙ্গিতে।
রাজা যযাতি চোখ বন্ধ করে তপস্বীর কথার মর্মার্থ বুঝতে চেষ্টা করছেন। কিছু সময় পর যখন চোখ খুললেন, তপস্বীকে দেখতে পেলেন না।
এরপর ডাক পড়ল সভাগৃহের কোনায় বসে থাকা গালবের। তার সব কথা শুনে যযাতি বললেন, দ্যাখো, তোমাকে আটশো ঘোড়া কিনে দেওয়ার মতো আর্থিক সংগতি আমার নেই।
গালব হতাশ হলো না। মনে আশার একটা সরলরেখা এঁকে বলল, শুনেছি আপনি দানের গৌরবে সিক্ত হয়ে স্বর্গলোকের সকল রাজর্ষির মধ্যে মানীশ্রেষ্ঠ হতে সংকল্প করেছেন। আপনার সেই স্বপ্ন পূর্ণ করার সুবর্ণসুযোগ আমি এনে দিয়েছি। আমি মহর্ষি বিশ^ামিত্রের শিষ্য। আমার প্রার্থনা যদি পূরণ করতে পারেন, আপনার খ্যাতির দীপ্তিতে সকল দানীর খ্যাতি তলিয়ে যাবে, আপনি হবেন মানীশ্রেষ্ঠ।
চঞ্চল হয়ে ওঠে যযাতির মন। সুযোগ বারবার আসে না। ন্যায়নীতি মানলে চলবে কেন। সোজা পথ নেই, তাতে কী! বাঁকা পথ আছ। ঋষি গালবের প্রার্থনা পূরণ করতেই হবে। কিন্তু উপায়? কূট নির্মম যুক্তিরুদ্ধ – যে-কোনো পথে যেতে হবে। সমুন্নত রাখতে হবে নিজের দানশীলতার অহংকার।
কিছু সময় চিন্তার পর রাজা যযাতি বললেন, পুণ্য লাভের আশায় দু-হাতে দান করেছি। আমার রত্নাগার এখন শূন্য। কিন্তু তরুণ ঋষি, আমার প্রাসাদে একটি দুর্লভ রত্ন আছে। অপেক্ষা করো। আশা করি তোমার প্রার্থনা রক্ষা করতে পারব।
বোজা চোখ খুলে যযাতি আবারো বললেন, তোমাকে দান করার পুণ্য থেকে আমি বঞ্চিত হতে চাই না।
রাজা যযাতি দ্রুত ভেতর মহলে চলে গেলেন।
সময় যাচ্ছে। এদিকে রাজা যযাতির কাছ থেকে প্রার্থিত অর্থের প্রতিশ্রুতি পেয়ে গালবের মনে নতুন আশা জেগেছে। যাক, শেষ পর্যন্ত গুরুঋণমুক্ত হয়ে নিজে যশস্বী হতে পারব।
কিছু সময় পর যযাতি যখন ফিরলেন, তাঁর সঙ্গে রয়েছে পুষ্পের আভরণে সজ্জিত এক কুমারী, ব্রীড়াকুণ্ঠিতা। গালব প্রথমটায় একটু ভ্যাবাচেকা খেল। তার মাথায় তো একটাই ভাবনা, কখন যযাতির কাছ থেকে মূল্যবান উপহার পাবে, সেটা দিয়ে কিনবে আটশো ঘোড়া। গুরুদক্ষিণা দিয়ে বিদ্যালাভের দায়মুক্ত হবে।
রাজা যযাতি জানালেন, সঙ্গের যুবতীটি তাঁর একমাত্র কন্যা মাধবী।
গালব ভাবতে থাকল, রাজা যযাতি নিশ্চয় কন্যাকে দিয়ে তার হাতে মূল্যবান উপহার তুলে দেবেন। সভাগৃহে এখন শুধু একটি অপেক্ষা – রাজা যযাতি কী বলেন। তিনি বেশ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, আমার কাছে চেয়ে কেউ খালি হাতে ফেরেনি। গালব, তুমিও ফিরবে না। আটশো ঘোড়া কেনা যাবে, তত নগদ অর্থ আমার নেই। কিন্তু, (কন্যাকে দেখিয়ে) যুবাঋষি, এই অতি মূল্যবান রত্নটি তোমাকে দিলাম। নিশ্চয় তুমি আনন্দিত হবে।
গালব বিব্রত ও বিচলিত বোধ করছে। এতক্ষণ তার মনে প্রত্যাশার যে আনন্দ ছিল, তা এখন ব্যথিত পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে পড়েছে। চাপা ক্ষোভ। গালব রাজা যযাতিকে বলল, আপনি আমাকে অর্থের প্রতিশ্রুতি দিলেন, এখন বঞ্চিত করছেন কেন? আপনার কন্যা রূপসী, নিশ্চয় গুণবতীও। কিন্তু মূল্যহীন এই কুমারীকে দান হিসেবে নিয়ে আমি কী করব!
গালবের এমন কথায় রাজা যযাতি দুঃখ পেলেন। কিন্তু উদ্যোগ হারালে তো চলবে না। নরম কণ্ঠেই বললেন, বিশ্বামিত্রের কাছে তুমি অনেক বিদ্যালাভ করেছ। কিন্তু তোমার গার্হস্থ্যজ্ঞান এখনো কাঁচা। আমার কন্যাকে তুমি মূল্যহীন মনে করছ কেন? যে-কোনো দিকপাল নরপতির রাজকোষে যত ধনরত্ন থাকে, আমার কন্যাটি এর থেকে শতগুণ মূল্যবান।
রাজা যযাতির কথা শেষ হতেই একটি আর্তকণ্ঠ শোনা গেল, পিতা!
মাধবী তাকাল পিতার মুখের দিকে। এতক্ষণ পিতা যা বললেন, সে এর অর্থ অনুধাবন করতে পেরেছে। পিতা তাকে তরুণ ঋষির কাছে তাঁর অতি আদরের কন্যাটিকে সম্প্রদান নয়, দান করছেন মাত্র। পিতা তো সামান্য যবকণা, তাম্রমুদ্রা প্রার্থীকে সবসময়ই দান করে থাকেন। এটাও তেমনি একটা দান। পিতার এই দান কন্যা মাধবীর পতিলাভের আয়োজন নয়। ঋষি গালব শুধু দাতা যযাতির কাছ থেকে একটি জীবন্ত বস্তু লাভ করেছে, এটার বিনিময়ে মূল্যবান ধনরত্ন সংগ্রহ করা যাবে।
এতক্ষণ অবগুণ্ঠিত থাকা মাধবী এক ঝাটকায় উঠে দাঁড়াল। যযাতি ও গালবের কাছে এসে বলল, পিতা তোমার মনোবাসনা পূর্ণ হবে। তরুণ ঋষির কাছে আমাকে দান করে তুমি যে পুণ্য লাভ করবে, এতে ত্রিলোকবিশ্রুত রাজর্ষিদের মধ্য শ্রেষ্ঠ স্থান নিশ্চয় পাবে। তরুণ ঋষি তাঁর কাক্সিক্ষত আটশো ঘোড়াও পেয়ে যাবেন। তবে এর জন্য আমাকে কিছুটা সময় দিতে হবে।
মাধবীর কথায় গালব যথেষ্ট উৎফুল্ল। বেশ গদগদ হয়ে জানতে চাইল, কত সময় লাগবে?
জবাবে মাধবী বলল, এক বছর পর একবার যোগাযোগ করতে হবে।
তিন
মাধবী আর রাজপ্রাসাদে থাকেনি। কোন সম্পর্কের বৈধতায় সে গালবের সঙ্গে যাবে! পিতা যযাতিকে বলেছে, প্রাসাদের অদূরে কোথাও কোনো বনস্থানে একটি কুটির তৈরি করে দিতে। সেখানে সে একা থাকবে। তার পূর্বানুমতি ছাড়া ওখানে কেউ যেতে পারবে না। একজন সখী থাকবে, সে-ও কারো সঙ্গে কোনো সংশ্রব রাখবে না। ব্যতিক্রম শুধু পিতা যযাতি। কন্যার খোঁজ রাখায় তাঁর জন্য কোনো বারণ নেই।
পিতা সানন্দে মাধবীর প্রস্তাব মেনে সব ব্যবস্থা করে দিলেন। আর দেবেনই-না কেন! কন্যা পিতার পুণ্য অর্জনের জন্য এত কঠিন কাজে সম্মত হয়েছে। সে গালবের জন্য আটশো ঘোড়া জোগাড় করতে রাজি না হলে, কী হতো – ভাবতেও ভয় হয়!
যাক। দিনের নিয়মে দিন যেতে থাকে। এদিকে গালব অস্থির হয়ে উঠেছে, এক বছর সময় এত দীর্ঘ হয় কেন! সবসময়ই মাধবীকে মনে পড়ে, সে এত সময় নিল কেন? রাগ ধরে। এক বছর পর দেবে মাত্র দুইশো ঘোড়া। বাকি ছয়শোর কী হবে, কবে হবে?
তবে, মাঝে মাঝে মাধবীকে মনে পড়ায় কেমন একটা অন্যরকম বিষয় এসে যায়। এমন বিষয়কে কি মায়া বলে! মায়াই তো। আটশো ঘোড়া জোগাড়ের প্রতিশ্রুতি পেয়ে গালব বিদায় নিয়েছে। মনে আনন্দ। কয়েক পা এসে কেন যেন পেছনে তাকাল। মাধবী পাথরের মতো স্থির। তার চোখ দুটো মৃদু কাঁপছে। চোখে আবছা জলরেখা কি ছিল?
এক বছর পর, পূর্বানুমতি নিয়ে, কুটিরে মাধবীর সঙ্গে গালব দেখা করল। মাধবীকে দেখে গালব চমকে ওঠে, এ কে! এই কদিনে মানুষের চেহারা এতটা বদলে যায়? স্বচ্ছ জলস্থানে যেন মেঘের ছায়া পড়ে আছে। দুজনের মধ্যে একটা নীরবতা দাঁড়াল। মাধবীই প্রথম বলল, কাশীশ্বর নৃপতি দিবোদাসের কাছে যাও। তিনি তোমাকে দুশো ঘোড়া দেবেন। ওগুলি তোমার গুরু বিশ্বামিত্রকে পৌঁছে দিও। তিনি আশ্বস্ত হবেন – শিষ্যটি গুরুদক্ষিণা দিতে শুরু করেছে।
পরে, এক বছর পর অযোধ্যাপতি হর্ষেশ্বরের কাছ থেকে দুশো এবং আরো এক বছর শেষে ভোজরাজ উশীনরের কাছ থেকে পাওয়া গেল দুশো করে ঘোড়া। হলো ছয়শো। আটশোর আর দুশো বাকি। ত্রিভুবনের কোথাও এমন ঘোড়া আর নেই। কিছু ডুবেছে বিতস্তার জলে, বিলুপ্ত হয়ে গেছে এই বিশেষ প্রজাতির ঘোড়া। এখন উপায়? গালবই জানাল, নৃপতি দিবোদাস, হর্ষেশ্বর আর উশীনরকে তুষ্ট করে ছয়শো ঘোড়া পাওয়া গেছে। রাজর্ষি বিশ্বামিত্রকেও সন্তুষ্ট করে অদত্ত অংশের মূল্য পরিশোধ করতে হবে। গালবের এমন প্রস্তাব শুনে মাধবীর মুখে শব্দ আটকে গেল – যেন পরিত্যক্ত কোনো প্রাসাদ। একসময় এখানে জৌলুস ছিল, আজ স্তব্ধতার নিচে সব চাপা পড়ে আছে।
চার
তিন ঐশ্বর্যবান ও এক রাজর্ষি পেয়েছে পুত্রসন্তান, গালব আটশো ঘোড়া গুরুদক্ষিণা দিয়ে নিজেকে করেছে গৌরবান্বিত। রাজা যযাতিও তৃপ্ত। জ্ঞানী গালবের মতো ঋষির প্রার্থনা পূর্ণ করায় তাঁর হাতে এসে গেছে স্বর্গলোকে পৌঁছার ছাড়পত্র। কিন্তু একটি প্রশ্ন তো থেকেই গেল – মাধবী কী পেল?
বাগানের হাসির মতো প্রফুল্ল মন নিয়ে রাজা যযাতি দরবারে বসেছেন। প্রবেশ করলেন চীরধারী এক তপস্বী। যযাতি চিনেছেন, কিছুদিন আগে আসা সেই তপস্বী।
শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর মৃদু হেসে তপস্বী বললেন, আজ আমি আবার আপনাকে লোকনীতির কথা স্মরণ করিয়ে দিতে এসেছি।
যযাতি উদগ্রীব কণ্ঠে জানতে চাইলেন, কী সেই লোকনীতিকথা।
তপস্বী বললেন, পুণ্যাজর্নের পথটিও পুণ্যময় হওয়া চাই। আপনি এই সর্বলোকনীতি ভঙ্গ করেছেন। আপনার অভীষ্ট সিদ্ধ হয়নি। আপনি কন্যা দান করে পুণ্যলাভের গর্ব অনুভব করছেন। মাধবী পরপর চারজন পুরুষের সঙ্গে অস্থেয় বিয়েতে বদ্ধ হয়েছে। চার ঘরে চারটি সন্তান জন্মেছে। নাড়িছেঁড়া এই চার সোনামুখ ছেড়ে আসতে মাধবীর কী কষ্ট হয়েছে, আপনারা কেউ তা সামান্যও অনুভব করেননি। সবাই পেয়েছেন যার যা প্রাপ্তির সুখ।
যযাতি বিমর্ষ, অস্থির। আর্তচিৎকার করে বললেন, এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত কী?
তপস্বী বললেন, মাধবীর স্বয়ংবর সভার ব্যবস্থা করুন। পরিস্থিতির কারণে পরিসীম পরিণয়ের রীতিও প্রচলিত আছে। যথানির্দিষ্ট সময় শেষ হলে পরিণীতা আবার কন্যকাদশা লাভ করে কুমারীরূপে স্বীকৃতি পায়।
পাঁচ
মাধবীর স্বয়ংবর সভায় রাজকুমার, বীরপুরুষ – অনেকে এসেছেন। তার মনে ছোট্ট আশা, হয়তো গালবও আসবে। মাধবী উপস্থিত জায়াপ্রার্থীদের সবার মুখ দেখল – না, কোথাও গালব নেই।
গালব অবশ্য এসেছিল। ততক্ষণে মাধবী বনপথে চলে গেছে। সেই পথে যেতে যেতে গালব মাধবীকে পেয়ে যায়। একটি প্রবীণ বৃক্ষের নিচে আধাশোয়া। চারপাশে ছড়িয়ে আছে বরমালার ফুল। মাধবীকে বুকে নিয়ে গালব বলতে থাকে, মাধবী আমি এসেছি। তাকাও, দেখো, আমি এসেছি।
মাধবী মৃদু করে চোখ খোলে, বলে, এলে যদি এত দেরি করলে কেন?
গালব বলল, আমার সকল জ্ঞান, পুণ্য আজ ব্যর্থ হয়ে গেছে। যেখানে প্রেম নেই, মায়ার মুগ্ধতা নেই, সে-জীবন আমি চাই না।
ভেজা চোখ। মাধবী বলল, আমার তো কিছু নেই। সব শূন্য করে তুমি চলে গেলে। শূন্যতার অনেক ভার! বইতে পারছি না।
মাধবীকে বুকে মিশিয় গালব বলল, তোমার সকল শূন্যতা আমি প্রেমের প্রাচুর্যে ভরিয়ে দেব।
কথা ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে। গালব ঠিকই বুঝতে পারছে। মাধবী বলছে, তোমার শূন্যতাগুলি তুলে দাও আমার এ ভাঙাচোরা বুকে।
ছয়
এখন, এখানে সময়ের কোনো হস্তক্ষেপ নেই। দুজন নিজেদের স্থাপন করেছে বিশ্বাসের ছায়ার ভেতর।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.