ঘোর অন্ধকার। একে তো অজপাড়াগাঁ, তার ওপর পল্লিবিদ্যুতের আলো-আঁধারির লুকোচুরি। এই আসে, এই যায়।
পিরোজপুর জেলার ভান্ডারিয়া থানার ছোট্ট এক গ্রাম। গ্রামের নাম গাজীপুর। একই নামে ঢাকার পাশের একটি জেলা থাকায় অনেকেই দ্বিধায় ভোগেন। তাই কেউ কেউ গ্রামটিকে বলেন লোদের হাট। স্থানীয় এক হিন্দু ধনী পরিবারের অধিকর্তার নাম লোদমশাই। তাঁর নামেই এই ছোট্ট বাজারের নাম। সেই নামটিই বিস্তৃত হয়েছে গ্রামের নামে।
গ্রামে ভোর আসে দ্রুত, সন্ধ্যাও নামে তাড়াতাড়ি। তেমনই এক সন্ধ্যার লোডশেডিংয়ে এক বাবা তার দুই সন্তানকে নিয়ে মাদুুর পেতে গল্পের আসর বসিয়েছেন। যতক্ষণ অবধি পল্লিবিদ্যুতের আলো ফিরে না আসবে ততক্ষণ গল্প চলতে থাকবে। গল্পের শ্রোতাদের একজন আমি।
সাঁঝরাত্তিরে লোডশেডিং হলে একটা অন্যরকম আনন্দবোধ হতো কিশোরকালে। কারণ বাবা বৈঠকখানায় বসে গল্প শোনাতেন। ছোট ছোট গল্প। ক্লাসের পাঠ পড়াতে কোনো তাগিদ ছিল না, বরং আগ্রহ বেশি থাকতো বোনাস হিসেবে বাবার গল্প শোনা।
বাবার গল্পের পুনরাবৃত্তি হতো। হয়তো কোনোদিন ছোট ছোট পাঁচটি গল্প বললেন বাবা। তার ভেতরে অন্তত দুটি গল্প আগেই শোনা হয়ে গেছে আমি আর আমার বোনের। তবুও শুনতে ভালো লাগতো। বাবা এক অদ্ভুত নাটকীয়তা নিয়ে গল্পগুলো বলতেন। মনে হতো, আলো-আঁধারির রঙ্গমঞ্চে কোনো একক অভিনয় চলছে।
গ্রামের বাড়ির লোডশেডিংয়ে হারিকেনের আলোয় বাবার গল্প শোনার অদ্ভুত এক মাদকতা ছিল। এর ভেতরে একটি গল্প ছিল অনেকবার শোনা। প্রায়ই সেই গল্পটি দিয়ে শুরু হতো।
গল্পটি ছিল ‘শেখ সাহেবের গল্প’।
বাবা যখন এই গল্প বলতেন তখন তাঁর ভেতর অদ্ভুত এক উত্তেজনা দেখতে পেতাম। জীবনের সেরা বিস্ময়গুলো মানুষ নিজের অবাক-করা গল্পের মতো করে সঞ্চয় করে রাখে। কোনো আবেগময় পিতা তাঁর সন্তানদের গল্প শোনাচ্ছেন আর দুই ছেলেমেয়ে তার দুই হাঁটুতে মাথা পেতে শুয়ে তা শুনছে – এ এক অতি মনোরম দৃশ্য।
সৈয়দ মো. ওমর ফারুক, আমার বাবা, তাঁর গল্পটা এভাবেই শুরু করতেন –
মুক্তিযুদ্ধে মারা গেছেন আমার বড় ভাই, মানে তোমাদের বড় চাচা। তোমরা তো জানো তাঁর নাম হাবিব ছিল। এও জানো তাঁর ছিল দুটো মেয়ে। যুদ্ধে মারা গেলেও আমি আমার ভাইয়ের মৃত্যুর খবর জেনেছি অনেক পরে।
আমার তখন কৈশোর। সেই কৈশোরেও আমি বাড়ির বাইরেই ছিলাম। ঢাকার বাংলাবাজারে একটা প্রেসে কাজ করতাম। ঢাকায় কারফিউর ভেতরে একবার আমাকে পাকিস্তানি হানাদাররা ধরে নিয়ে যায়। আমাকেসহ ছয়জনকে একসঙ্গে দাঁড় করিয়ে মারতে মারতে অজ্ঞান করে একটা ড্রেনে ফেলে দিয়েছিল – ভেবেছিল আমি মারা গেছি। বাকি পাঁচজনকে গুলি করে। আমি তিনজনকে গুলি করার শব্দ শুনতে পাই। তারপরই আমি চেতনা হারাই। অন্যদের গুলি করার শব্দ আমি হয়তো আমার অবচেতনেই শুনেছিলাম। কে জানে। বেঁচে যে ফিরবো তার বিন্দুমাত্র নিশ্চয়তা ছিল না। কিন্তু বেঁচে গেলে একসময় ড্রেন থেকে উঠে গ্রামে ফিরে আসি।
যখন বাড়ি ফিরলাম, শুনতে পেলাম যুদ্ধে আমার বড়ভাই মারা গেছেন। বুকের ভেতর একদলা হাহাকার আর অনিশ্চয়তা। কারণ বাবা মারা যাওয়ার পর বড় ভাই-ই সংসারের অভিভাবক ছিলেন। আমার তো রোজগার নেই। যুদ্ধও থামেনি। কবে থামবে তখন জানি না।
ভাবি-বাচ্চারা সবাই গ্রামে এসে পড়েছে। কারণ পিরোজপুর সদরে রাজাকারদের ভয়াবহ উৎপাত ছিল। এক কঠিন সময়ের ভেতর দিয়ে আমরা সবাই পার হলাম। আমাকে সংসারের হাল ধরতে হবে।
যুদ্ধ যখন থেমে গেল, বিজয়ের খবর পেলাম যেদিন, মনে হলো, কিছু একটা হবে নিশ্চয়ই। দেশে তখন প্রচণ্ড অভাব। ভাত-কাপড়ের কষ্ট। কীভাবে এই অভাব কাটবে, তার কিছুই জানি না!
আমার চাকরি নেই। যেখানে চাকরি করতাম, সেখানে আবার ফিরব কি না, তারা ঠিকঠাক আছে কি না – কিছুই জানি না। এদিকে দুই কন্যা নিয়ে সদ্য বিধবা ভাবি স্বামী হারানোর শোকে নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। ভাবি শিক্ষিত গৃহিণী ছিলেন।
আমি যে প্রেসে কাজ করতাম, যার নাম ছিল আল আমিন প্রেস, তার ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করতে ঢাকায় গেলাম। কিন্তু আমার ভাবনায় ছিল, আমার ছোট চাকরি, যদি ভাবির একটা ব্যবস্থা করা যেত। ম্যানেজার আমাকে খুব পছন্দ করতেন।
তিনি বললেন, ফারুক, তুমি তোমার ভাবিরে নিয়া শেখসাবের লগে দেখা করো। তিনি একটা ব্যবস্থা কইরাই দিবেন।
– কী বলেন ভাই! তাঁর কী সময় আছে? এতো বড় মানুষ। আমাদের সঙ্গে কথা বলবেন তিনি? আর কীভাবে যাবো তাঁর কাছে? সে কি সম্ভব?
– শোনো, সকাল করে সরাসরি তাঁর বাড়িতে চলে যাও। দুপুর নাগাদ প্রায়ই তিনি বাসায় থাকেন, তখন সবার সঙ্গে দেখা করেন, কথা শোনেন। এরকম নেতা পৃথিবীতে পাইবা না। তুমি যাও। দেখবা, কাজ হবে। তোমার ভাই শহিদ হইছেন না? তোমার একটা ব্যবস্থা তিনি করবেনই।
তখনো বিশ্বাস হয়নি। বিষয়টা দুরাশা ভেবেই বসে ছিলাম। তারপরও মনের ভেতরে আশার খলবল করে।
‘একবার গেলে কেমন হয়? চেষ্টা করতে দোষ কী?’
সিদ্ধান্ত নিলাম যাবো, ভাবিকে নিয়েই। ভাবির একটা চাকরির ব্যবস্থা হলে দুই মেয়েকে নিয়ে চলতে পারবেন। আমিও ঢাকায় করে-কেটে খেতে পারবো। দেখা যাক, যদি দেখা পাই?
আমরা রওনা হলাম এক সকালে, এক পরিচিত গন্তব্যে, কিন্তু অনেক অজানা অনুভূতি নিয়ে। বঙ্গবন্ধুর দেখা পাব, এটি ভেবে মন শিহরিত হলো। এর আগে ঢাকা গিয়েছি অনেকবার; কিন্তু এমন শিহরণ জাগেনি কোনোদিন, কখনো। সেই শিহরণের নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমাদের শেখ সাহেব। নিজের ভেতর চাপা উত্তেজনা পুষে রাখি। কারণ আমি আর ভাবি ছাড়া অন্য কেউ জানে না যে আমরা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। কাউকে এ-বিষয়ে বলবো না – এটা আমরা দুজনে আলোচনা করে ঠিক করে রেখেছিলাম।
এদিকে গ্রাম তো কানাকানি, ফিসফাসের হাটবাজার। তাই রটে গেল – ফারুক তো বড়ভাইয়ের বউ লইয়া ভাগতেয়াসে!
এসব কথা শুনে চোখ-কান বুঁজে রওনা হলাম। কারণ আমি জানি, যদি বলি শেখ সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি, কেউই সেটা বিশ্বাস করবে না। পথে এলাকার বড়ভাই সালেক খন্দকার জিজ্ঞেস করেন, ‘কী মিয়া, মতলব কী? ভাবিরে লইয়া ঢাকা যাও, বাজারে তো তোমাগো লইয়া কথা কইতেয়াসে। বংশের ইজ্জতটা রাইখো।’
অবশেষে তাকে বলতে বাধ্য হলাম। বললাম, ‘শেখ সাবের লগে দেখা করতে যাই। একটা চাকরির ব্যাপারে চেষ্টা করতেয়াছি। দোয়া কইরেন।’
হো হো করে হেসে উড়িয়ে দিলেন তিনি। টিপ্পনি কেটে বললেন, ‘ও, তুমি মিনিস্টার বুঝি! মিটিং করতে যাও! হা হা হা। যাও। যাও।’
সালেক খন্দকারের হাসির মানে বুঝতে কিছু বাকি রইল না। ভাবিকে নিয়েও তিনিও টিপ্পনি কাটলেন। কোনো জবাব দিতে পারলাম না, বুঝলাম, সত্যটা না বলে অন্য কিছু বলা উচিত ছিল।
এরপর ট্রলারে করে রওনা দিলাম। পরিচিত দুয়েকজন পাওয়া গেল। সেই একই প্রশ্ন। বললাম, ‘ভাবির চিকিৎসার জন্য যাই।’ মনে হলো, কেউই আমার কথা বিশ্বাস করল না। সমাজে অন্যের গুজবে যারা মজা পায়, তারা সত্যের পাশ দিয়েও হাঁটতে চায় না। ওই গুজবকেই চিরস্থায়ী করতে চায়।
ঢাকা পৌঁছে ম্যানেজার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করি, বলি, ‘ভাই আপনিও চলুন আমাদের সঙ্গে। আপনার যেহেতু যোগাযোগ আছে।’
তিনি বললেন, ‘না। তুমিই যাও। তিনি সরাসরি সব পছন্দ করেন।’
অনেক সাধাসাধির পরও তিনি গেলেন না। অগত্যা আমি আর ভাবি রওনা দিলাম। ভয়, শিহরণ, যেন একটা অ্যাডভেঞ্চার – এরকম সব অনুভূতি তখন মনের মধ্যে কাজ করছিল।
যেতে যেতে মনে হলো, চাকরি যদি নাও হয়, শেখ সাহেবকে কাছ থেকে দেখতে পারলেও এই যাতায়াতের পয়সা উসুল!
আমরা সকাল ৭টার ভেতরে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর বাড়ির গেটে। ভাবি শেখ সাহেবের জন্য কিছু পিঠা আর নারকেলের নাড়ু বানিয়ে নিয়ে এসেছেন। আমি মানা করছিলাম, বলছিলাম, ‘তিনি এসবে বিরক্ত হলে আসল কাজ হবে না।’
কিন্তু ভাবি জবাব দিলেন, ‘শোনো, তাঁর অর্ডারে তোমার বড়ভাই যুদ্ধে গিয়েছিলেন। তাঁর সৈন্যের পরিবার আমরা। এতো বড় নেতা। বিরক্ত হবেন কেন? শুধু আমাকে তাঁর সামনে নিয়ে যাও, বাকিটা আমি বুঝব।’
৩২ নম্বরের যত কাছাকাছি যাই, আমি খেয়াল করেছি, ভাবির ভেতরে যেন উত্তেজনা বাড়ছে। তিনি তাঁর স্বামীর ‘লিডারে’র সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন। আর আমি শিহরিত। এমন মানুষকে সত্যিই কাছ থেকে দেখতে পাবো তো!
বাড়ির গেটের সামনে যারা পাহারায় ছিলেন তাদের কাছে জানতে চাইলাম, বঙ্গবন্ধু সঙ্গে দেখা করা যাবে কি না। তারা আমাদের আপাদমস্তক ভালো করে দেখলেন। আমাদের তখন সারাদিনরাত ভ্রমণ-করা ক্লান্ত শরীর। দেখে হয়তো তাদের মায়া হলো – অপেক্ষা করতে বললেন, বললেন, ‘কোথা থেকে এসেছেন?’
আমরা জানালাম।
দেখলাম আরো কিছু মানুষ এসেছেন। মাঝে একটা গাড়ি ঢুকলো। আবার বেরিয়ে গেল। কোনো গাড়ি বেরুতেই মনে হতো, এই বোধহয় শেখ সাহেব বেরিয়ে গেলেন, আর বোধহয় দেখা হলো না।
ভাবি নফল নামাজ পড়েছেন। রোজা রেখেছেন, যেন শেখ সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়। তার সংসারের যেন একটা কূল-কিনারা হয়।
সকাল ১০টার দিকে একজন এসে বললেন, ‘আপনারা ভেতরে গিয়ে বসুন।’
ভেতরে ঢুকতেই দেখি আরো দুজনের সঙ্গে কথা বলছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এতো কাছে এই বিশাল মানুষটিকে দেখে আমি কথা হারিয়ে ফেললাম। অল্প উচ্ছ্বাসেই আমার তোতলামি শুরু হয়ে যায়। এ তো জীবনের সবচেয়ে অবাক হওয়ার সময়। আমি বুঝতে পারছিলাম, বঙ্গবন্ধু কোনো প্রশ্ন করলে আমি তোতলানো শুরু করবো। তাই নিজেকে স্বাভাবিক করার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম; কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। হঠাৎ কানে গেল – ‘কী রে পিচ্চি, নাম কী তোর? বাড়ি কই?’
আমাকে উদ্দেশ করে এইটুকুনই কথা! আমি জবাব দেব কী! হাঁ করে তাকিয়ে থাকলাম শেখ সাহেবের দিকে। জবাব দিতে গিয়ে যথারীতি তোতলানো শুরু করে দিলাম।
তখন ভাবিই সবিনয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে সব কথা খুলে বললেন। ভাবি বললেন, ‘স্যার, আমার দুই মেয়ে। স্বামী যুদ্ধে শহিদ হয়েছেন। এখন আমার যে অবস্থা তাতে দুই মেয়ে নিয়ে রাস্তায় ভিক্ষায় নামার জোগাড়। তাই আপনার কাছে এসেছি।’
– মা, তোমাকে কেন ভিক্ষা করতে হবে?
এই বলে বঙ্গবন্ধু কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, ‘দেখতেসি।’
ভাবি পুঁটলি থেকে নাড়ু আর পিঠা বের করে তাঁর দিকে বাড়িয়ে দিলেন।
বঙ্গবন্ধু খুব অস্বস্তিতে পড়লেন। পাশের দুজনকে বললেন, ‘দেখছস? এই হইল বাঙালি। এই হইল আমার জনগণ। নিজে না খায়া মরতেছে। স্বামী নাই। চাকরি নাই। অথচ আমার জন্য মিষ্টি নিয়ে আসছে।’
একথা বলতে বলতেই বঙ্গবন্ধু খুব আবেগাতাড়িত হয়ে পড়লেন। বাইরে আরো মানুষ। কত দুঃখ-কষ্ট নিয়ে সবাই আসেন। এতো সহজে আমাদের কথা তিনি শুনবেন – কল্পনাও করতে পারিনি। মনে মনে ম্যানেজারের জন্য দোয়া করলাম।
এরপরই ঘটল অবাক করার মতো কাণ্ড। বঙ্গবন্ধু সেখানে, আমাদের সামনেই, ফোন করলেন পিরোজপুরে। ভাবিকে পিরোজপুর সদর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের ব্যবস্থা করে দিলেন। তাঁর এক ফোনেই আমাদের পুরো পরিবারের সব সমস্যার যেন সমাধান হয়ে গেল। মাত্র চার থেকে পাঁচ মিনিটের ভেতরে ঘটলো এই ঘটনাগুলো। আমি তখনো মোহগ্রস্ত।
বিশালহৃদয় মানুষটির পা ছুঁয়ে সালাম করতে এগিয়ে গেলাম। বঙ্গবন্ধু তখন আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। এই আদর-স্নেহ আমার প্রত্যাশা বা কল্পনাতেও ছিল না।
পিঠ চাপড়ে তিনি বললেন – ‘ভালো করে পড়াশোনা করবি। তোর বড়ভাই নাই। এখন তো তোরই সব দায়িত্ব। তোর ভাই তোরে দেশটা দিয়া গেছে, এখন তুই দেশটা সাজাবি ব্যাটা!’
এই বলতে বলতে বারান্দা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। কয়েক কদম হাঁটলেন। নিজের চোখকে তখন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নেতা আমাদের এতো সম্মান করলেন!
সবকিছুই আমার আর ভাবির কাছে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল। আমরা তখন বুঝে উঠতে পারিনি – কে আমাদের বারান্দা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছিলেন। একজন প্রেসিডেন্ট। সেও কী সম্ভব? এদেশের প্রণেতা। এদেশকে যিনি মানচিত্র দিয়েছেন। সেই ঘটনার পর ঘোরের ভেতর ছিলাম অনেকদিন। সেই ঘোর আজো কাটেনি!
বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে বারবার মনে হচ্ছিল – এ কী করে সম্ভব? এতো বড় মানুষ আমার পিঠ চাপড়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন! বারান্দা অবধি এগিয়ে দিলেন! স্বপ্নের মতো লাগছিল সবকিছু।
একবুক সাহস আর নতুন আশায় বুক বেঁধে বাড়িতে ফিরে এলাম।
কী অবাক কাকতাল।
লঞ্চ থেকে নামতেই সেই সালেক খন্দকারের সঙ্গে দেখা। তিনি মনে মনে ভাবছিলেন হয়তো আমরা ঢাকায় কোনো কূল-কিনারা না করতে পেরে দুদিনেই ফিরে এসেছি।
পাশ থেকে বলাও শুরু করেন – ‘তা তোমাগো দুদিনের ঘোরাঘুরি শ্যাষ। ভালোই তো। তবে ওই শহরে সংসার করা এতো সহজ না।’
মেজাজ আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলাম না। চিৎকার করেই বললাম – ‘সালেক মিয়া। মুখে লাগাম দিয়েন। কথা আমরাও কইতে পারি। যা জানেন না সেইডা নিয়া কথা কইবেন না। আপনি যে ছিঁচকা রাজাকার আছিলেন, ভুলি নাই কিন্তু। তাই মুখ সামলায়ে কথা কইবেন! স্বাধীন দেশে আপনার তো গা চুলকাইবোই।’
আমার তেজ দেখে তিনি দমে গেলেন। এসব মিচকা শয়তান শক্তের ভক্ত, নরমের যম হয়।
সালেক মিয়ারে খানিক অপ্রস্তুত দেখা গেল। তিনি পুরোপুরি হতবাক। আমাকে আর ভাবিকে একটা রেস্টুরেন্টে বসালেন। তখন আমাদের খিদে লেগেছিল প্রচণ্ড। ভান্ডারিয়া বাজার থেকে দেড় ঘণ্টা হাঁটাপথ। নদীতে ভাটার টান। তাই নৌকা চলবে রাতে। আমরা হেঁটেই বাড়ি যাবো বলে ঠিক করলাম।
সালেক মিয়াই খাবারের বিল দিতে চাইলেন; কিন্তু ভাবি কোনোভাবেই দিতে দিলেন না, বললেন, ‘মইরা যামু। তাও আল্লাহ যেন তোমার ট্যাহায় না খাইতে দেয়।’
ভাবির উঁচু আওয়াজে পুরো হোটেলের লোকজন জড়ো হয়ে গেল। বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে আসার পর ভাবির সাহস দেখে আমিও অবাক। স্বামী হারানোর শোকে যে নারী নিজেকে প্রায় হারিয়েই ফেলেছিলেন, মাত্র পাঁচ মিনিটের সাক্ষাতে তাঁর আদল বদলে দিয়েছেন শেখ সাহেব।
অনেকেই জেনে গেলেন, শেখ সাহেব ভাবিকে মাস্টারির চাকরি দিয়েছেন। পুরো গ্রামে চাউর হয়ে গেল। পরদিন বাড়িতে লোকজনের ভিড়। সবাই বঙ্গবন্ধুর গল্প শুনতে চান।
সেই থেকে আমি যতবার এই গল্পটা বলি, ততবারই শিহরিত হই, আনন্দিত হই। কখনো বিরক্ত লাগে না। বারবার মনে পড়ে, পিঠে দুবার হাত চাপড়ে দিয়ে শেখ সাহেব বললেন –
‘তোর ভাই তোরে দেশটা দিয়া গেছে, এখন তুই দেশটা সাজাবি
ব্যাটা!’
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.