হারিকেনের সলতে জোর করে জ্বালানো হচ্ছিল, কাচের অর্ধেকের বেশি কালিতে ভরা, যে-কোনো সময় তেলের অভাবে দপ করে নিভে যাবে। রাহেলার বুকে জমা ক্ষোভটা সলতের মতো কালিমাখা কাচের ভেতর তোলপাড় তুলে ওষ্ঠাগত হতে চায়। প্রতিবেশীর বাড়িতে আসতে ঝোপঝাড়ের সরুপথ, অন্যরাতে জোনাকি জ্বলে, আজ তারা কোথায় যেন লুকিয়ে আছে! পথে হোঁচট খেয়ে ভারী দেহ কোনোরকমে সামলেছে। তাই হারিকেনের লাল আলোয় মুখটা বাদুড়ে রহস্যে ভরা, ক্ষোভের চিহ্ন নিয়ে প্রতিবেশীর হেঁসেলের পিঁড়িতে বসে।

– বলা নেই, কওয়া নেই, রাত্রি করি ছোট বউয়ের আমার হাতনেতে পা পড়িলো যে!

– হঠাৎ করি কুটুম আসিচে, আমাদের দুজনরে তোমাদের খালি ঘরে থাকতি দিতি হবিনে গো।

– তোমরা তো দুজনা, থাকতি পারো। গৃহকর্ত্রী সোৎসাহে জানান দেন। তোমার ভাই একনো আসিনিকো, তাই বসি আচি। আজ নাকি থানাবাজারে রাজাকারদের বড় সাহেব এয়েচে। দেশে শান্তি আনার জন্যি তোমার ভাই ওকানে নাম লেকায়েচে।

গৃহকর্ত্রী হারিকেনটা রাহেলার কাছে এগিয়ে দেয়, তা বলি কার কুটুম এসেলো?

– কুটুম না ছাই! রাহেলা আজ রাতে ঘর হারানোর ক্ষোভ উগরে দেয়, একগাদা মুক্তিবাহিনীর লোক এয়েচে। রান্নাবান্না করি দিয়ে আইচি। তোমার ছোট ভাই খাতিনদারি করি একানে শুতি আসপেনে।

গৃহকর্ত্রী যেন হারিকেনের কালিতে মিশে যেতে চায়। পাশের বাড়িতেই বাঘের বড়মাসি, যেন সাক্ষাৎ যম! তার উজ্জ্বল মুখাবয়ব আলোর অভাব বোধ করে, বাঁশবাগানের অন্ধকারে মিশে যেতে চায়। পাশের বাঁশবাগানের নিচ দিয়ে বাড়ি আসার পথ, সেখানেই লোকমানের বাপরে আটকাতে হবে। বলেকয়ে দূরের সর্দারপাড়ায় বোনের বাড়িতে শোয়ার জন্য পাঠাতে হবে।

কিন্তু রাত করে বাড়ি এসে লোকমানের বাপ সব ঠান্ডা মাথায় শোনে, রান্নাঘরে খেয়েদেয়ে গৃহকর্ত্রীকে কিছুই বলে না। তারপর ঘরে না ঢুকে সেই রাজাকারের কালচে পোশাকে সর্দারপাড়ার উল্টোদিকে থানা শহরের রাস্তা ধরে। অন্ধকারের মাঝে গৃহকর্ত্রী স্বামীর পায়ের শব্দ মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকে।

দুই

মাথার ওপর একটা শেল্টার প্রয়োজন। একরাত অথবা দু-রাতের শেল্টার কেমন হওয়া উচিত, ভাবনার বিষয়, অঘোষিত দলনেতা মামুনের মাথায় রওনা দেওয়া থেকে ঘুণপোকা কুরে কুরে চলে। বিচিত্র সব শেল্টার ও হাইড আউটের কথা মাথায় আসে। জুলাই মাসে মাগুরার পুলম থেকে রওনা দিয়ে একরাতের বেশি কোথাও থাকা লাগেনি। দলের মানসিক অবস্থা বিধ্বস্ত থাকলেও নড়াইলের ভেতরের প্রতিটি শেল্টারে যত্নআত্তির অভাব ছিল না। নড়াইল নূর হোসেন ভাইয়ের এলাকা, কৃষক-গেরস্তদের হৃদয়ে তার স্থান।

কিন্তু ইদানীং মুক্তিবাহিনীর চাপ বন্যার পানির মতো, সেপ্টেম্বর মাসে বর্ষা একটু কমলে সীমান্ত পেরিয়ে প্রশিক্ষিত ছেলেরা ভারী অস্ত্রসহ দলে দলে ঢুকছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধের সব প্রস্তুতি নিয়েছে। তাদের লক্ষ্য হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করা এবং দ্রুত ক্ষমতার মসনদে বসা। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভারত-সোভিয়েত ব্লক অস্থির, তারা চীন-আমেরিকাকে পাকিস্তান টিকিয়ে রাখার সুযোগ দিতে চায় না, এটা মামুনদের ভালো জানা। তাই অক্টোবরের মাঝে কমরেডের সাংকেতিক চিঠি, শেল্টার বদলাও, ডুমুরিয়া আর নিরাপদ না, সোভিয়েত অক্ষশক্তি নভেম্বরে সর্বাত্মক আক্রমণে যাবে।

মামুনের মনে পড়ে, চেয়ারম্যান মাও সে তুং দলবল নিয়ে লুকানোর শেল্টার খুঁজতেন, এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘাঁটি বদলাতে তাদের অগ্রগামী দল থাকতো, চরদের ধোঁকা দিতে তাঁরা পাহাড়ি পথে অদ্ভুত সাংকেতিক ব্যবস্থা রেখে যেত। যাত্রাপথে বিপদ আসন্ন হলে কাছের পাহাড়ের গুহায়, অথবা একেবারে নির্জন জঙ্গলে চলে যেত। কিন্তু মামুনদের ছয়জনের অগ্রগামী দল বা পথ প্রদর্শক নেই। প্রয়োজনও নেই। ডুমুরিয়ার আস্তানা ছেড়ে সকালে পায়ে হেঁটে উত্তরে ভরতরাজার দেউল বরাবর চুকনগর বাঁয়ে রেখে চলা। সকালে বেরুনোর সময় তাড়াহুড়ো, ডুমুরিয়া শেল্টারের অবস্থা ভালো না, শেফালির মায়ের হাতে দীর্ঘদিনের পরিচিত গরম ভাত, মোষের দুধের ঘি, সঙ্গে ডিম ভাজার নাস্তা। মামুনের পেটের অবস্থা ভালো না, গরম ভাত চটকে লবণ দিয়ে কোনোরকম মুখে তুলেছে।

আর একদিনও থাকা উচিত নয়। খানেদের নিয়ে যত না ভয় তারচেয়ে কঠিন খানেদের সহযোগী দেশি যোদ্ধাদের মোকাবিলা করা। ডুমুরিয়া ঘাঁটির অবস্থানে পাকিদের আসার আগেই টের পাওয়া যায়, লুকানোও সহজসাধ্য; বড় তেঁতুলগাছের ডালে, নদীর ভাঙাড়ে, সময় একটু বেশি পেলে দূরের আখক্ষেতে। কিন্তু বর্ডারের ওপারে ট্রেনিং নেওয়া ভাইদের চোখে ধুলা দেওয়া কঠিন। হাইকমান্ডের নির্দেশ – আস্তানা গুটিয়ে যশোরের কোনো নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে হবে। এখনো জানানো হয়নি নিরাপদ ঘাঁটি, পথে জানা যাবে।

তবে মাগুরার পুলমের মূল ঘাঁটিতে আর যাওয়া যাবে না। পার্টির কিছু নেতার হঠকারিতা মামুনদের ভালো লাগেনি, ভীষণ ভুগিয়েছে। যুদ্ধের শুরু থেকে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত, সেই দিনগুলি নিয়ে তাদের আলোচনায় সন্তুষ্টির জাবর কাটে। পুলম হাইস্কুলের শিক্ষক ছাড়াও বিশাল জনগণের সঙ্গে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত নিতেও তাদের সম্পৃক্ত করা হতো। থানার মালখানা লুট, পুলিশ ফাঁড়ির সামনে সংকেত দেওয়াসহ সব কাজে স্থানীয়দের অংশগ্রহণের কমতি ছিল না। জনযুদ্ধ জনগণকে সঙ্গে নিয়ে, এটাই পার্টির মূলমন্ত্র। সেই জুলাইতে পুলমের পতন হলে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে আপসরফায় ওরা পাঁচজন নড়াইলের ঘোরাপথে ডুমুরিয়ায় আসে।   

দু-তিন রাত, অথবা তারচেয়ে বেশি সময় পথের শেল্টারে পার করতে হবে। কিন্তু মামুনের শরীরটা ভালো না, কীভাবে যে পেটের পীড়া দেখা দিলো! কিছু ওষুধ খাওয়াতে পাতলা পায়খানা বন্ধ, কিন্তু গতরাতে তলপেটে চিনচিনে ব্যথা, ঝোপজঙ্গলে বসলেও পেট পরিষ্কার হয় না। এর মাঝেই সবাইকে নিয়ে পথচলা।

ওরা ভরতরাজার দেউল বরাবর মাঠ পেরিয়ে জানাশোনা এক গৃহস্থ খবিরের বাড়িতে ঢুকে পড়ে। চারদিক বাগিচায় ঘেরা, ভেতরের কিছু দেখা যায় না। গৃহস্থের গোয়ালঘরের জাউনার ভাঙা নান্দায় গ্রেনেড, পিস্তল ও গুলির প্যাকেটগুলো ফেলে রেখে ওপরটা কিছু পচা বিচুলিতে ভরে দেয়। আর বড় অস্ত্রগুলো গোয়ালঘরের একপাশের মাটিতে পুঁতে রাখে। এরপর খালি হাত, কোনো প্রতিরোধের সুযোগ থাকবে না। এই সামান্য অস্ত্র-গোলাবারুদ নিয়ে খানেদের সঙ্গে, এমনকি মুক্তিবাহিনীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সুযোগ নেই। জুন মাসের পর হাতিয়ার সংগ্রহের সুযোগ আর হয়নি। একদিকে উন্মত্ত খানসেনা, অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর চাপ। ‘দুই কুকুরের লড়াই’ বলে পার্টির হাইকমান্ড এ-যুদ্ধে না-জড়ানোর বিবৃতি দিয়েছিল। মামুনরা সেটা মেনে নিলে, এখন ভারতের কোনো আশ্রয়ে থাকতে পারতো, অথবা প্রথমেই মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে পারতো। কিন্তু যশোর-খুলনার পার্টির নেতারা হাইকমান্ডের নির্দেশ মানতে পারেনি। নিরস্ত্র বাঙালি হত্যার প্রতিশোধে পাকিস্তানি হানাদারদের প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নেয়। মামুনরা অন্য কিছু ভাবতে পারেনি, স্বার্থপরতায় ভোগেনি, লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তাদের জিজ্ঞাসা; বর্তমান ঘটে যাওয়া পাকিস্তানিদের শোষণ, গণহত্যা, লুটপাটকে উপেক্ষা করে এদেশে বৈষম্যহীন, শোষণহীন জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কী করে কায়েম করা যাবে? যদি হানাদার বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞে জনগণই উন্মূল হয়, তাহলে কাদের জন্য শোষণহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা! 

তারপরও এরচেয়ে ভালো কিছু জুতসই মামুনদের ভাবনায় আসে না। মামুন ভাবতে থাকে সেই দিনের কথা, কলেজে নেতৃত্বের সময়। অগ্নিগর্ভ দিনগুলোতে, ঢাকায় আসাদ শহিদ হওয়ার পর আন্দোলন জেলা শহরে আছড়ে পড়লে পার্টির হাইকমান্ডের ইশতেহারে ঘোষণা আসে, সশস্ত্র আন্দোলন-প্রস্তুতির নির্দেশ। অস্ত্র প্রশিক্ষণে তাদের গ্রুপ জড়িয়ে পড়ে। বাইরে তারা মেনন ছাত্র ইউনিয়ন গ্রুপের নেতৃত্বে, ভেতরে তারা সশস্ত্র প্রস্তুতি সারে। তাই মার্চের পর বিদ্রোহী ইপিআরের পাশাপাশি যশোরে তারাও পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে চমক দেখায়। সেটা মে মাস অবধি চললেও পরে থিতিয়ে যায়। আস্তে আস্তে তাদের নিজস্ব রণনীতি কোণঠাসা হয়ে পড়ে। নিজের ঘরে অপাঙ্ক্তেয়, হিন্দু সমাজের মতো জাতিচ্যুত বা একঘরে হয়ে পড়া।

খবিরের বাড়িতে দুপুরের খাবার খেয়ে বারান্দায় যে যার মতো একটু বিশ্রাম সেরে নেয়। সবুজ প্রশান্তিতে চারপাশ ভরে আছে, কিন্তু মামুনের ভেতরটা মোচড় দেয়, তা কি পেটের অসুখ, না অনিশ্চয়তার টানাপড়েনের কেঁপে ওঠা!  মামুন সবার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়, তারা সন্ধ্যার পর রাত নামার পর হরিহর নদের পাড় ধরে শেল্টার গ্রামে ঢুকবে। আগেই গৃহস্থ আব্দুর রাজ্জাককে খবর দেওয়া আছে। হাতের কেমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নেয়। সবাইকে সেভাবে প্রস্তুতি নিতে বলে, বিকাল পাঁচটায় রওনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানানো হয়।

মামুনদের মাঝে ভয়টা আরো ঘরপোতা খুঁটিতে গেড়ে বসে, যখন অক্টোবরের প্রথমে খবর আসে, স্বাধীনতা সংগ্রামী দলের এলিট ফোর্স গড়ে তোলা এবং অধিকৃত অঞ্চলে যত না পাকবাহিনীর সঙ্গে মোকাবিলা, তারচেয়ে বেশি নিজেদের মাঝে শুদ্ধি অভিযানে নিজেদের যোদ্ধা হত্যা। হয়তো মাঝরাতে একটা অ্যামবুশ থেকে ফিরে যোদ্ধারা কোন শেল্টারে ঘুমিয়েছে। রাতের শেষ প্রহরে দরজায় টোকা, নিজেদের লোক জেনে এককথায় বেরিয়ে এসেছে। এরপর কোনো কথা না বলে হ্যান্ডসআপ করিয়ে বাইরে এনে ব্রাশ করেছে। এ সংবাদে ডুমুরিয়ায় মামুনরা রাতে কয়েক জায়গায় ভাগ হয়ে যায়, আর অনবরত শেল্টার বদলাতে থাকে। ডুমুরিয়ার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বামঘেঁষা, প্রথমে তাদের আশ্বস্ত করেছিল। বিশেষ করে মামুনের প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধের ভূমিকা, কলকাতা গমন, অস্থায়ী সরকারকে এপ্রিলের প্রারম্ভে সহযোগিতার ঘটনা তার জানা। কিন্তু দুদিন আগে লোক পাঠায়, তার ওপর রাজনৈতিক চাপ, দ্রুত এলাকা ছাড়তে হবে। মামুনের ব্যক্তিপরিচয়, সঙ্গের উচ্চশিক্ষিত লিয়াকতের অবস্থান, অন্যদের সামাজিক অবস্থান যুদ্ধের ময়দানে তুলার মতো উড়তে থাকে। অন্ধ বুলেট, বোবা মর্টার গোলার কাছে একটাই নিশানা, একটাই দিক, সেটা হলো বন্দুকের নল আর হুকুমের ট্রিগার। সে কিছু চেনে না, চেনে শত্রুর অব্যর্থ বুক।

মামুন ভাবতে থাকে তাদের পার্টির ধারাগুলোর বিবর্তনের কথা, সমাজতান্ত্রিক মত ও পথের মাঝে ধর্মীয় মাজহাবের মত অনেকগুলো বাস্তবায়নযোগ্য পথ। তেমনি মোটাদাগে সোভিয়েত ব্লক, আর চীন, তাদের শাখা-প্রশাখার কোনো শেষ নেই। তাদের চীনা ব্লকের মাঝে এখন তাত্ত্বিক দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঘুরপাক খায়, তা হলো চীনা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রায়োগিক পথ অনুসরণ নিয়ে, যা ভারতের চারু মজুমদার লাইন, শ্রেণিশত্রু খতম। বিগত বৎসরগুলোতে শ্রেণিশত্রু খতমের নামে গলাকাটা তরিকায় তার উপগ্রুপের সায় ছিল না। এলাকায় তারা বাস্তবায়ন করতেও দেয়নি। ফলে হাইকমান্ড নাখোশ হলেও এই দুঃসময়ে স্থানীয়ভাবে টিকে থাকতে তেমন অসুবিধে হয়নি। এখন পশ্চিমদিকের বর্ডার অতিক্রম করলে তাদের ভারতের জেলে, অথবা বেঘোরে প্রাণ দিতে হবে। কারণ তারা পিকিংপন্থী, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে। এখন না ঘরকা, না ঘাটকা অবস্থায় দেশের ভেতরে টিকে থাকা ছাড়া পথ নেই।

তিন

রাতে কয়েকবার দরজার শিকল খুলে মামুন পেটের ব্যথায় কাছের বাগানে সাড়া দেয়। পেটের অসুখ আমাশয়ে রূপ নিয়েছে। রাতে রাজ্জাক মিয়া ছোটভাইকে নিয়ে যত্ন করে আপ্যায়ন করেছেন। অন্যরা গভীর ঘুমে থাকলেও মামুনের চোখে ঘুম নেই, উঁচু মাটির ঘরে খাট আর নিচে মাদুর পেতে সবার শোয়ার ব্যবস্থা, অক্টোবর মাসে তেমন ঠান্ডা নেই, শুধু কাঁথাতেই চলে, এখনো পাতনের প্রয়োজন হয়নি। গভীর রাতে বাইরে যাওয়ার ফাঁকে পশ্চিম-উত্তর কোনায় যুদ্ধের ক্ষীণ শব্দ শোনা যায়। মনে হলো, চৌগাছার দিকে যুদ্ধ চলে। আস্তে আস্তে পশ্চিম সীমান্ত জুড়ে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। মুক্তি আর কতদূরে!

মামুন ঝোপের মাঝে বসে ভাবতে থাকে, সেও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে স্টেনগান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। একটার পর একটা পিন খুলে গ্রেনেড ছুড়ে পাকিস্তানি বাংকার ধ্বংস করে চলেছে। পাশের তেঁতুলগাছে বড় পাখিদের ওড়াউড়ি, যুদ্ধশব্দ ছাপিয়ে পেঁচার ডাক শোনা যায়। এখন আর শিয়ালের ডাক নেই, কিছুক্ষণ পর ভোর হবে। লোটা হাতে একটু এগোলেই পাঁচ ব্যাটারি টর্চের আলো মুখে পড়ে, হ্যান্ডসআপ বলে সামনে একজন থ্রিনটথ্রি উঁচিয়ে ধরে।

– তোমরা কারা? মামুনের প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে পিছন থেকে রাইফেলের আঘাতে সে পড়ে যায়।

– তুই আমারে চিনিস না! আমি থানা রাজাকার কমান্ডার মাবুদ। কলেজে আমারে কথা বলতি দিতিস না। তোদের জোরে আমরা পোস্টার লাগাতি পারতাম না। এখন! ঘুঘু বারবার ধান খায়, আর চলবে নানে। এটা পাকসেনাদের মুল্লুক, ঘরের মদ্দি যে-কটা আছে, তোরা বান্ধে আন।

অন্ধকারের মাঝে রাজাকারের দল টর্চলাইট হাতে ওদের ঘরের হাতনেতে উঠে পড়ে, বাড়িটা আট-দশজনে ঘিরে ফেলেছে। মামুনের পেটের ব্যথা, পিঠের যন্ত্রণাও উধাও, সামনে রাজাকার কমান্ডার মাবুদ। মনে পড়ে, কলেজের ছাত্রনেতা, এখন পাকিস্তানিদের দোসর। কিন্তু বিগত কয়েকদিন শেল্টার নির্বাচনে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ বিবেচনা করা হয়েছে। দেশীয় মীরজাফরদের চিন্তা কেন মাথায় আসেনি! এ অঞ্চলে মুক্তিফৌজের তৎপরতা কম, সেই সুযোগে বেইমানরা ঘাপটি মেরে আছে। তারা এমনভাবে এখানে উঠেছে যে, কেউ টের পাওয়ার কথা নয়। তাহলে কীভাবে রাজাকাররা টের পেল!

ভোরের লালচে আভা ছড়িয়ে পড়লো। মামুনের কাছে আজকের সূর্য অপরিচিত, কোনোদিন দেখেনি, হিলিয়াম আর হাইড্রোজোনের বিষবাষ্প কোটি কোটি মাইল পথ বেয়ে তার চোখমুখ চেপে ধরে, চোখ খুলে একটু শ্বাস নিয়ে দেখতে পায়, সবাই গরুর দড়িতে পিঠমোড়া বাঁধা। এখন তার পালা। রাজাকাররা উল্লাস করে, কমান্ডার বলতে থাকে, হরিয়াল ঘুঘু পেয়েচি, লবণ দিয়ে কাঁতি হবেনে, ছুরি-বঁটি নিয়ে আয়! আজ আর ছাড়াছাড়ি নাই। বাজারের ইউনিয়ন অফিসে আগে তোল। তারপর দেখা যাবেনে।

রাজাকারের দল মামুনদের ঘিরে কোথায় চলেছে! সন্ধ্যার পর আগাম কুয়াশা, শীতের মহড়া যেন! হরিহর পাড়টা যেন নিঃশব্দে মরে আছে, মৃতদের বোবাকান্না নদের বুকে উথলে উঠে বিষণ্ন কুহকের সুর তোলে; সেই কবে গাজীর সঙ্গে মুকুট রায়ের ব্রাহ্মণ নগরের যুদ্ধে কত রক্তপাত বুকের কাদায় মিশে আছে, আর কত রক্তধারা বুকে নেওয়া যায়! রাত আটটা হবে, এখন তো বিষাক্ত সূর্য নেই, পরজীবী হতাশ চাঁদেরও দেখা নেই। দ্বিপদী কিছু শ্বাপদ ছাড়া আশেপাশে কেউ নেই। প্রকৃত শ্বাপদরা অনেকদূরে আচছড়ি গাছের আড়ালে লুকিয়ে ঘোলাচোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে, নিশিরাতের হুতুমপেঁচা পাশের তেঁতুলডাল ছেড়ে আগেভাগে নদের বুকে মাতম তোলে। সব আয়োজন যেন ইশারায় চলে! যেন পুতুল নাচ! দূরে কোন ঊষার লগ্ন কী দেখা যায়! চাষি, শ্রমিক, মজুর, তাঁতি, কামার, কুমার, নাপিত, মেথর, কলু, ধীবররা তো ছুটে আসছে, ওই তো তারা সবাই এসে গেছে; কুয়াশার কোন মায়া তাদের আটকে রাখে! হয়তো মরুর দেশের ভেসে আসা বাণী! তারপরও কেন তাদেরকে হরিহরের পাড়ে অর্ধমৃত টেনে আনা হলো! তাহলে কী মামুনরা লখিন্দর হতে চলেছে! কে তাদের টেনে নেবে, মায়ের মমতায় হরিহর কী বুকে আগলে রাখবে!

চার

রাহেলার ঘর এখন ফাঁকা। সিগারেটের ময়লা, কিছু পরিত্যক্ত পরিধেয় সাফ করে সে ঘরটাকে প্রস্তুত করেছে। এক রাতের মাঝে ঘরটা কত অচেনা লাগে! গতরাতে পাশের লোকমানদের ঘরে ঘুম ভালো হয়নি। ভোরবেলা তাই জন্মের ঘুম চেপে ধরে, সকালে উঠে স্বামীকে পাশে পায়নি। তাই শেষরাতে পাশের নিজ বাড়িতে যা ঘটেছে, তা লোকমুখে শোনা। বড়জা যখন বলে উঠলো, লোকমানের বাপ কাজটা ঠিক করেনিকো। রাতের আন্ধারে থানা শহরে গিয়ে রাজাকারদের খবর দিয়ে আনিলো! বাপেরও বাপ আছে, টের পাতি হবিনে! এটা শোনার পর রাহেলার মুখভার, তা হাঁড়ির কালির মতো না হলেও শ্রাবণ মেঘ যেন।

মুক্তিসেনারা আসার পর ভাসুর ঘর ছাড়তে বললে তার মাথা বিগড়ায়। বাড়িতে আর কোনো ঘর নেই! কারোর কোনো দায়িত্ব নেই, কুটুম এলে তাকেই শুধু ঘর ছাড়তে হয়। তাই বলে সে মুক্তিসেনাদের অমঙ্গল চায়নি। লোকমানের মা কি তাহলে …? রাহেলা আর কিছু ভাবতে পারে না।

বাড়ির লোকজন রাহেলাকে নিয়ে বসে আছে। রাত আটটার দিকে তার জ্ঞান ফেরে। সবাই বলাবলি করে, পোয়াতির প্রথমদিকের রক্তশূন্যতায় ফিট হওয়ার লক্ষণ। তাও আবার গতরাতে পাশের বাড়িতে ভালো ঘুম হয়নি। হাতনেতে সবাই মেয়েলোক, পুরুষরা কোথায়! রাহেলা চারপাশে তাকায়, স্বামীকে খুঁজে পায় না। এমন সময় উত্তর দিকের নদীর পাড় থেকে পাঁচটা গুলির শব্দ আসে। আজকাল কমবেশি দূরে-কাছে গোলাগুলির শব্দ শোনে। কিন্তু এই শব্দে সবাই গুলির শানে-নজুল নিয়ে বলাবলি করতে থাকে। এতে রাহেলার মন বিক্ষুব্ধ হয়ে যায়। গুলির শব্দে আস্তে আস্তে ভয়ে পরিবেশ নিঝুম হয়ে উঠলে নদীর দিক থেকে অসময়ের আনকোরা একঝাঁক পাখি ঘরের চালের ওপর দিয়ে উঁচু তেঁতুলগাছে বসে।

সবার মাঝ দিয়ে নির্বাক রাহেলা হঠাৎ হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে তেঁতুলগাছের দিকে হাঁটতে থাকে।