সন্ধ্যা : প্রেম আর বিচ্ছিন্নতা নামের এক লগ্নের নাম

কাজী রাফি

আট মে সন্ধ্যা সাতটায় শেষনিঃশ্বাস ত্যাগের ঠিক পূর্বমুহূর্তে তোমার মনে পড়ল, তোমার দাদি প্রায় সত্তর বছর আগে ‘সাঁঝের মায়া’ কেমন তা সরেজমিনে দেখানোর জন্য এক সন্ধ্যায় পুকুরপাড়ে বসে চাঁদের ভেতরের কালো কালো দাগমতো দৃশ্য দেখিয়ে তোমাকে চাঁদ-বুড়ির চরকা কাটার গল্প শুনিয়েছিলেন।

সন্ধ্যা নিয়ে তোমার রয়েছে আশ্চর্যজনক অনুভূতি আর বিধুরতা। সন্ধ্যা তোমাকে আনমনা করে দেয়। সন্ধ্যায় বৃষ্টি-ঝড়ের তান্ডব অথবা ঝিঁঝির কলতান সবকিছুই তোমার কাছে অদ্ভুত তানে নিনাদিত হয়। এই সন্ধ্যাতেই তোমার ভাব-বিহবলতা দার্শনিক হয়ে ওঠে। মনে হয়, গোধূলির  ফিকে আলো, সাঁঝের মায়ায় লুকানো পুকুরজলের স্তব্ধ নীরবতা যুগ-যুগান্তরের এমন নৈসর্গিক খেলায় মত্ত, যেন পৃথিবীতে মানুষ নামক মহাশক্তিধর প্রাণীর অস্তিত্ব ভুলে গিয়েই তারা শুধু ক্ষান্ত হয়নি; বরং আসন্ন এই ঝড় গাছগুলোর ছায়া, ’৭১-এ বিধ্বস্ত খবিরন বেওয়ার সেই ভাঙাচোরা বাড়ির আরো ভাঙা আসবাবপত্র, ছড়ানো-ছিটানো হাঁড়ি-পাতিল; তার চেয়েও শিশুদের ছেঁড়া জামায় এমন অলস ভঙ্গিতে খেলায় মত্ত, যা তোমাকে মনে করিয়ে দেয় – নশ্বর মানুষের বিরান অস্তিত্বের ফাঁপা সভ্যতা একদিন এভাবেই পৃথিবীজুড়ে পড়ে থাকবে! কোটি কোটি বছর। তবু সন্ধ্যার রহস্যঘেরা এই সাঁঝের মায়া, পুকুরজলে চুপটি করে নেমে আসা অাঁধারের রহস্যময়তা শেষ হবে না। ফুরোবে না তাদের অলস ভঙ্গিমার আরো নিরলস খেলা! জগৎকে নিবিড় করে উপলব্ধির সন্ধ্যা তোমার কাছে তাই প্রেম আর বিচ্ছিন্নতা নামের যুগসন্ধির পরমমুহূর্ত। আর এই সময়ের এই উপলব্ধি তোমার জীবনকে যেন প্রলম্বিত করে দেয়। কারণ এই অনুভবের তাড়নায় তুমি আগ্রহী হয়ে ওঠো এমনি সন্ধ্যায় কাটানো তোমার পূর্বপুরুষদের জীবন নিয়ে। অতীত ভাবনার এই যোগসূত্রই তোমার জীবনকে দীর্ঘায়িত করে। মনে হয় তুমি দীর্ঘদিন এ-পৃথিবীর প্রান্তে পা ফেলে ফেলে চলছ।

এক সন্ধ্যায় যেদিন তোমার প্রত্যন্ত গ্রামের বাড়িটার পাশের বাঁশবাগানকে আকাশের তুমুল বজ্রপাত আর ঝড় টিনের ছাদে নুয়ে ফেলছিল, সেদিন তুমি হারিকেনের আলোয় আবেশী এক অনুভবে মগ্ন হয়ে লিখলে এক কবিতা। লুকিয়ে লেখা সেই কবিতা তোমার শিক্ষক-বাবা খুঁজে পেয়ে তোমাকে নিয়ে শুধু গর্বিতই হলেন না, তিনি গ্রাম্য সন্ধ্যার আড্ডায় ছাড়াও দু-একজন প্রিয় মানুষকে তোমার কবিতাটা আবৃত্তি করিয়ে শুনিয়ে স্বর্গীয় আনন্দ পাওয়ার অভ্যাস এমনভাবে রপ্ত করলেন, যেন তার জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্নকে হাতের মুঠোয় পেয়েছেন। তিনি তোমাকে নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করলেন, ‘আমার মহিবুর একদিন আকাশের সমান উচ্চতায় উঠবে, তোমরা দেখো।’

সেই থেকে আকাশের সমান উচ্চাকাঙ্ক্ষা তোমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। তোমার বাবা যেদিন মারা গেলেন, তার ঠোঁটের কোণে সেদিন স্বর্গীয় হাসি লেগে থাকলেও তোমাকে তখন দুঃখ তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে, এজন্য নয় যে তোমার বাবার মৃত্যু তোমাকে আকুল শোকের সাগরে ভাসিয়েছে – তা বরং এজন্য যে, অনেক চেষ্টা করেও তোমার কবিতা কোনো পত্রিকা প্রকাশে রাজি হয়নি। আসলে তুমি শিল্পের গভীরতম বোধকে হৃদয়ে ধারণ করতে পারোনি বলেই প্রচারসর্বস্ব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলে।

তারপর মাস্টার্স পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি পেয়েও যখন তুমি একটা চাকরির জন্য ঘোরাঘুরি করে প্রাণান্ত তখনো তোমার বাবা তোমাকে ‘আশা’ নামক কুহেলিকার চিরন্তন বাণী শুনিয়েছেন, ‘কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে … দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহিতে?’

যেদিন তোমার ঘরে ছোট্ট এক শিশুসন্তান এলো সেদিন থেকেই তুমি তোমার মৃত বাবার ধ্যান-ধারণা চিরতরে বাতিল করে দিলে। সংসারের অভাব ঘোচানোর জন্য তুমি বিভিন্ন পথ খুঁজতে খুঁজতে একদিন তার সূত্র তুমি ময়েজ মিয়ার আড়তে সহজেই পেয়ে গেলে। ময়েজ মিয়ার আড়তে কলা-আম থেকে শুরু করে সব ফলের ফলন শুরু হওয়ার আগেই তা পাকানো হয়। মৌসুম শুরুর আগে ফলগুলো বাজারজাত করতে পারলে দ্বিগুণ মুনাফা করা যায়। পাকানো ফলে ফরমালিন মেশালে তা পচে যাওয়ার সম্ভাবনাও কমে যায়।

সারাজীবনের সব শিক্ষা জলাঞ্জলি দিয়ে, কবিতার মতো ফালতু আর জটিল বিষয় নিয়ে বড় হওয়ার স্বপ্নকে তুমি পায়ে দলে, ময়েজ মিয়ার মতো ব্যবসা করেই বড় হওয়ার পণ করলে। কৃষকদের কাছ থেকে স্বল্প দামে কেনা কাঁচা টম্যাটোগুলোতে সামান্য কার্বাইড আর ফরমালিন ব্যবহার করে সুউচ্চ দরে বিক্রি করে যেদিন তোমার ঘরে প্রথম মুনাফা এলো, সেদিন তুমি তোমার বাবার আত্মার প্রতি এই বলে রুষ্টতা জানালে যে, ‘শিক্ষকরা আসলে সমাজের অচল পয়সা! বাবার আকাশ-কুসুম স্বপ্নকে লালন করলে নির্ঘাত না খেয়ে মরতে হতো।’

এই জগতে তোমার চলাচল যত তোমার অভিজ্ঞতার ঝুলিকে সমৃদ্ধ করল, ততো তোমার ব্যবসার দিগন্ত বিস্তৃত হতে থাকল। সবজি-ফলেই তুমি সীমাবদ্ধ না থেকে ট্যানারির বর্জ্য দিয়ে পোলট্রি ফিড তৈরির কৌশল রপ্ত করলে। অভাব-অনটনে চলা জীবনের সাদা-কালো অধ্যায়কে অতিক্রমের কী এক নেশায় পেয়ে বসল তোমাকে, যে-নেশা টাকার পেছনে ছোটার অবিরত তাড়না হয়ে তোমাকে ছোটাল দিনভর। দিন দিন তুমি ব্যবসার নতুন নতুন দিগন্তের কাছে পৌঁছালে।

 

সারাদেশে কৃষকের যখন সারের তীব্র সংকট তখন স্থানীয় রাজনীতিকের বুদ্ধি এবং ছত্রছায়ায় তুমি ভেজাল সার-কীটনাশকের ব্যবসা শুরু করলে। পাশের দেশ থেকে সস্তা কীটনাশক আমদানি করে তাতে নিষিদ্ধ ডিডিটি মিশিয়ে তুমি  যে-কীটনাশক বাজারে ছাড়লে তা কৃষকের কাছে খুব গ্রহণীয় হয়ে উঠল। সবাই তোমার প্রশংসায় এই বলে পঞ্চমুখ হয়ে উঠল যে, তোমার ‘শেফার্ড’ নামের কীটনাশক অব্যর্থ। পামরি থেকে শুরু করে ফসলের সব কীট অনায়াসেই মরে যায়। কিন্তু তোমার এই কীটনাশকের কারণে সমগ্র অঞ্চলে দেশি মাছ দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠল। কীটনাশকে মেশানো ডিডিটি নামের সেই বিষ যেন তীব্র আলোক-কণার গতিতে সুতীব্র তীর হয়ে মাছের খাদ্যনালি থেকে পাশের জলাশয়, পুকুর, ঘাস-আগাছা, পচনরত নল-খাগড়ার পচন-প্রক্রিয়ায় এবং ধানভাঙা মেশিনঘরের কাছে এসে ডানে বাঁক নিতে নিতে পরিশেষে মানুষের অন্ত্রে ছড়িয়ে পড়ল। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলজপ্রাণী আর মাছের শরীরে ছড়িয়ে পড়া ক্যান্সারের বিন্দু বিন্দু রক্তকণার ধারা আকুল অভিযোগ নিয়ে একটা রেস্টুরেন্ট অতিক্রম করে ছুটে চলল মূল্যবোধের কাছে চিরনিদ্রায় নিদ্রিত এক থানার কাছে, হাসপাতাল আর মানুষরূপী ডাক্তারদের অতিক্রম করে এই বিষক্রিয়া আদালতের গায়ে দাগ না ফেলে চলে যাচ্ছে অলস ভঙ্গিতে খেলায় মত্ত পুকুরজলে নেমে আসা তোমার প্রিয় সাঁঝের মায়া আর ছায়ার কাছে। পরিশেষে এই বিষক্রিয়া হারিয়ে যাবে মানুষের মহান অস্তিত্বের ফাঁপা সভ্যতার কাছে এসে।

 

তুমি নিজেই কয়েকটা আড়তের মালিক এখন। উপার্জিত কাঁচা টাকার সঙ্গে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তোমার শহরে   জায়গা-বাড়ি-গাড়ি সবই যখন হলো তখন মাসে মাসে বিরাট অঙ্কের ব্যাংকঋণ শোধ করার জন্য তোমাকে আরো প্রাণান্ত শ্রম আর বুদ্ধি খাটাতে হলো। অনেক লোক তোমার অধীনেই এখন কাজ করে। গ্রামের মতো শহরেও যখন মানী-গুণী ব্যক্তি হিসেবে তুমি পরিচিত হয়ে উঠলে তখন তুমি এই বলে তৃপ্ত হলে যে, তুমি তোমার বাবার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে পেরেছ।

জগৎকে নিবিড় করে উপলব্ধির করা সন্ধ্যাগুলো এখন তোমার কাছে এক অতীত ‘কবি’র ভাব-বিহবলতামাত্র। সন্ধ্যা, সাঁঝের মায়া – এসব নিয়ে তোমার দার্শনিকতা তোমার কাছেই এখন পরিহাসের বিষয়! তুমি যখন মনে মনে পরিতৃপ্ত হয়ে হাসছ, তখন তোমার স্ত্রী মাহমুদা অতৃপ্ত হৃদয় নিয়ে বলল,

জীবনকে সুন্দর করতে টাকার প্রয়োজন। সেই টাকার জন্য জীবনের সবসময় যদি পার হয়ে যায় তাহলে টাকা দিয়ে কী লাভ? স্ত্রীর কথায় রুষ্ট তুমি তাকে শাসালে,

না খেয়ে থাকলে বুঝতে টাকার কী প্রয়োজন…

তোমার কথা শেষ হওয়ার আগেই স্থানীয় রাজনীতিবিদ এসে তোমাকে ইশারায় বাইরে ডাকে এবং জানায় যে, বড় ধরনের এক সর্বনাশ এগিয়ে আসছে। সাংবাদিকরা তোমার নকল সার-কীটনাশকের ব্যবসা নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছে আর পুলিশ তোমাকে শিগগিরই অ্যারেস্ট করবে। তুমি বিরক্ত হয়ে তাকে বললে,

এসব সামলানোর জন্য তো আপনাকে মাসে মাসে টাকা দিচ্ছিই চাচা। আপনাকে এত পয়সা দিয়ে আমার কী লাভ হলো? তিনি তোমাকে ধমকে বললেন,

তুই একটা অকৃতজ্ঞ। এ-শহরে বাড়ি-গাড়ি করলি যার বুদ্ধিতে তাকে তুই বলছিস, ‘আপনাকে দিয়ে আমার কী লাভ হলো?’

কিন্তু এখন আমার করণীয় কী?

এই তো বুদ্ধিমানের মতো কথা বলেছিস। শোন, সাংবাদিক নেতা, থানা-পুলিশ আর আমার বিরোধী দলের কয়েকজন পোলাপ্যাইনরে একটু ভাগ দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়।

এত মানুষের পেছনে দৌড়াব না ব্যবসা সামলাব?

সব সামলাব আমি। তুই শুধু মাসে চার লাখ টাকা দিবি।

কী কন চাচা, ব্যাংকের লোন শোধ করতে আমাকে মাসে গুনতে হয় আট লাখ টাকা। তাতেই আমি হিমশিম খাই! এত টাকা ক্যামনে জোগাড় করি।

আরে হারামজাদা, নতুন আরো ব্যবসা খুলবি।

‘হারামজাদা’ শব্দটি আবেগাপ্লুত করল তোমাকে। তোমার স্বনামধন্য শিক্ষক বাবার অপুষ্ট শরীরটার কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল, এক শুক্রবারের ছুটির দিনে আলুঘণ্টের ভেতর গোটা ডিমের বাবার ভাগের অর্ধাংশ বাবা তোমার পাতে তুলে দিলে মা বলেছিলেন,

দিন দিন তোমার শরীর তো ভেঙে যাচ্ছে, আধখান ডিমটুকু তুমি খাও, আমি না হয়…

বাবা হেসে মাকে থামিয়েছিলেন,

আমার আর শরীর, কদিন পর তো কবরেই যাবে! মহিবের বাড়ন্ত শরীর। ওর শরীরে এখন প্রচুর আমিষ দরকার। আমার দুঃখ হয়, আমার মেধাবী ছেলেটা জন্মেছে এক গরিব শিক্ষকের ঘরে!

বাবার কথাগুলো মনে হওয়ায় তোমার চোখ জলে ভরে এলো। তুমি রাজনীতিকের কথার প্রতিবাদ করে বললে,

চাচা, আপনি ভালো করে জানেন, আমি কার ছেলে। পুরো অঞ্চলের মানুষ আমার বাবাকে কত সম্মান করে কথা বলেন। লোকটি তোমার কথায় হাসল, বলল,

এখন আর করে না  যদিও স্বার্থের কারণে ওপরে ওপরে তারা ভাব দেখায় তুই বিরাট সম্মানী লোক! যা হোক শোন, ভাবাবেগে তোর ভোগাটা আর মানায় না। নাচতে নেমে ঘোমাটা কে দেয় বল? নতুন যে-ব্যবসাটার পথ তোকে দেখাব তাতে টাকা আসবে পানির মতো। টাকা থাকলে এদেশে সব কেনা যায়। কোন কুত্তার বাচ্চা তোকে সম্মান করল না করল তাতে তোর কী এসে-যায়? টাকা থাকলে ওদের বাপরাও তোকে সম্মান করবে। একদিন ওরাই বলবে তুই … মাস্টারের যোগ্য ছইল।

সুতরাং অন্ধকার গলিতে হাঁটতে হাঁটতে মোবাইল স্ক্রিনের আলোয় তিনি তোমাকে সেই ব্যবসার উপাদান দেখান। লালচে বর্ণের কয়েকটি ট্যাবলেট দেখে তুমি বিস্মিত স্বরে বলো,

ওষুধ ব্যবসা!

আরে না, এর নাম ইয়াবা…

ইয়াবার লাগামহীন এক গোপন জগৎ, তার চেয়েও লাগামহীন তার চাহিদা। নতুন এই ব্যবসা তোমাকে এনে দিলো অফুরান অর্থ, যার বেশিরভাগই খেয়ে ফেলল এই ব্যবসার পরামর্শদাতা, সাঙ্গোপাঙ্গ, থানা-পুলিশ। অবশেষে এক রাতে তুমি যখন ভাবলে তোমার সব কষ্ট, উদ্বিগ্নতা আর শ্রমের ফসল খেয়ে যাচ্ছে পিঁপড়ায়, তখন তোমার মাথায় খেলে গেল এক ভয়ংকর বুদ্ধি। তাই তো! তোমার পরিশ্রমের উপার্জনে যে বিনা কারণে ভাগ বসায় তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে তোমার তাকে প্রতি মাসে দেওয়া চাঁদার সামান্য একভাগই যথেষ্ট। সঙ্গে সঙ্গে তোমার মনে পড়ল সে একদিন তোমাকে ‘হারামজাদা’ বলে গালি দিয়েছিল। বাবার নামে তুমি শপথ করলে, এই অপমান আর যন্ত্রণার শোধ তুমি নেবেই। বিছানা ছেড়ে রাতেই তুমি বের হয়ে পড়লে ক্যাইলা শামছুর বাড়ির উদ্দেশে।

স্থানীয় এক প্রভাবশালী ব্যক্তিকে ‘গায়েব’ করে এত সহজে এই সমাজে শুধু পার পাওয়াই নয়, তোমার প্রতিপত্তি উল্টা বেড়ে গেল দেখে তোমার জীবনদর্শন দ্রুত বদলে গেল। তুমি স্বপ্ন দেখলে একজন রাষ্ট্রীয় ব্যক্তিতে পরিণত হওয়ার। ইয়াবার ব্যবসা যত বিস্তৃত হলো, তোমার সমাজকর্ম তত বেড়ে গেল। দলের ফান্ডে, মসজিদ-মাদ্রাসায়, এতিমখানায় অথবা কোনো দাতব্য প্রতিষ্ঠানে তোমার অবারিত দান তোমাকে যখন সমাজের তুঙ্গে তুলল, ততক্ষণে দেশের তরুণ প্রজন্ম এমন নেশায় বুঁদ হয়ে গেছে যে, তারা জানে না সম্মান-প্রতিপত্তির সংজ্ঞা কী? ভালো আর মন্দের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে না পারা এই প্রজন্ম হাতে স্মার্টফোন আর নেশার উপকরণ পেয়েই খুশি। ছেলেদের কানে দুল, মেয়েদের গভীর রাতে বাড়ি ফেরাকে তারা তাদের চরম আধুনিকতা যখন ভাবতে শিখেছে এবং ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য নিরূপণে অসমর্থ বলে ‘প্রতিবাদ’ শব্দের অর্থ বই পাঠে অভ্যস্ত তরুণদের ছুড়ে দেওয়া ‘ব্যাকডেট’ শব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ, তেমনি সময়ে একদিন তুমি জানলে তোমার ষোড়শী কন্যাটি হাসপাতালে, যার আনন্দময় জীবনযাপনে তুমি লাখ টাকা খরচ করতে কার্পণ্য করো না। যখন তুমি জানলে মাদকাসক্তের  কারণে তার জীবন প্রায় নিভু নিভু, তুমি সঙ্গে সঙ্গেই তাকেসহ তোমার একমাত্র পুত্রকে দেশের বাইরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলে।

সন্তানদের বাইরে পাঠানোর এক বছর আট মাস সাতদিন পর মাদক ব্যবসা থেকে ১০ এপ্রিল তারিখের যে-সন্ধ্যায় তুমি সরে আসার সিদ্ধান্ত নিলে, ঠিক সেই রাতেই তুমি এক ব্যর্থ খুনের প্রয়াস থেকে বেঁচে গেলেও একটা বুলেট তোমার ডান কাঁধের মাংসপেশি ভেদ করে তোমাকে শয্যাশায়ী করল। হাসপাতালে দীর্ঘদিন ভর্তি থেকে তুমি ৭ নভেম্বর বুধবার বাড়িতে এলে হুইল চেয়ারে করে। কারণ তোমার শরীরের ডান পাশ চিরতরে অবশ হয়ে গেছে।

ডান পাশে বুলেটবিদ্ধ হলে মাথার বাঁপাশ কেন বিদ্রোহ করল ভেবে যখন তুমি আবেগাপ্লুত হয়ে স্ত্রীকে কাছে ডাকলে, তখন অবাক হয়ে খেয়াল করলে, মাহমুদা নামের সেদিনের গ্রাম্য ছটফটে সুন্দরী কিশোরীটির মাথার কেশগুচ্ছে সাদা চুল আধিপত্য বিস্তার না করলেও মুখে তার কখন বার্ধক্য এসে বাসা বেঁধেছে। পয়সা খরচের উৎস হিসেবে এক মডেল কন্যা আর এক নায়িকা মাঝখানে কিছুদিন স্ত্রী নামধারী অঙ্কশায়িনী হলেও তারা এখন তোমার অস্তিত্ব অস্বীকার করছে। মাঝেমধ্যে অনিচ্ছাকৃতভাবে শারীরিক সম্পর্ক হলেও দীর্ঘ পঁচিশ বছর পর এই প্রথম স্ত্রী মাহমুদার দিকে তোমার মনোযোগী দৃষ্টি তাকে আকুল করে তুলল;  শাড়ির অাঁচল তুলে সে ঠোঁট লুকিয়ে চোখের অশ্রু মুছল। তুমি বিরক্ত হয়ে তাকে প্রশ্ন করলে,

নিজের যত্ন করো না?

ডায়োবেটিস শরীর… যত্ন মানে না…

তুমি কথা না বাড়িয়ে আমেরিকায় বসবাসরত মেয়েটাকে ফোনে মিলিয়ে দিতে বললে। ফোনে মেয়েকে যখন পাওয়া গেল, তখন বয়ফ্রেন্ডের বাহুলগ্না কন্যাটি ফোনের অপর প্রান্ত থেকে কোনো কুশল বিনিময় ছাড়াই বলল, বাবা এখন আমি ব্যস্ত। ফ্রি হয়ে পরে কথা বলছি।

ছেলেকে ফোন করলে সেমিস্টার ফি আর তার আগামী জন্মদিনে বন্ধুদের উদ্দেশে দেওয়া পার্টি বাবদ কয়েক লাখ টাকা পাঠিয়ে দিতে বলে মেয়ের মতো সেও পরে ফোন করবে বলে জানিয়ে ফোন রেখে দিলো।

ছেলের ওপর ভয়ংকর অভিমান থেকে তুমি তাকে আর কখনো ফোন করবে না বলে যখন পণ করেছ, তার দুদিন পর এক সকালে মেয়ের ফোন তোমাকে খুশি করল। তুমি কাঁদো কাঁদো গলায় তাকে তোমার দুর্দশা আর অসহায়ত্বের কথা বলায় সে শঙ্কিত হয়ে বলল,

আর যা-ই হোক বাবা, চলতে-ফিরতে পারছ না বলে তুমি আবার আমাকে পাঠানো টাকার পরিমাণ কমিয়ে দিয়ো না প্লিজ। জানোই তো, একজন ব্যক্তিগত ড্রাইভার আর বাঙালি এক বাবুর্চি পালতেই আমার কত খরচ।

মেয়ের আশঙ্কাই সত্যি হলো। এককালে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিককে খুন নিয়ে এতদিন পর পত্রিকা-প্রশাসন এবং আদালতপাড়া সরব হয়ে উঠল। তোমার মনে হলো, এক হায়েনার দল তোমাকে ছিঁড়ে-খুঁড়ে খাওয়ার জন্য তোমার চারপাশে ভিড় জমিয়েছে। তাদের উদরপূর্তি করতে গিয়ে তোমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শহরের জানা-অজানা ফ্ল্যাট-বাড়ি সবই যখন বিক্রি করতে হলো এবং তোমাকে তোমার গ্রামে, বাবার রেখে যাওয়া বাস্ত্তভিটার শীর্ণ ঘরে এসে আশ্রয় গ্রহণ করতে হলো তখন কী মনে করে সবাই শান্ত হয়ে গেল।

তুমি ভেবেছিলে ছেলে না হলেও অন্তত মেয়েটা একবার তোমাকে দেখতে আসবে। কিন্তু তোমার দুর্দশা তাদের ন্যূনতম দৃষ্টি আকর্ষণ না করতে পারলেও তুমি তাদের আর অর্থ পাঠাতে সমর্থ নও বলে তোমার বেহায়াপনাকে তারা তিরস্কার করতে ভুলল না। মেয়েটা আরো একধাপ এগিয়ে বলে বসল,

একজন সুন্দরী তরুণীর জন্য অর্থ উপার্জনের অনেক পথ খোলা আছে। যার বাবা প্রয়োজন ছাড়াই অর্থ উপার্জনে বেলাল্লাপনায় মেতে ওঠে, তার মেয়ে বাধ্য হয়ে সেই একই কাজ করলে খুব বেশি পাপ হয় না।

মেয়ের এ-কথা শোনার পর থেকে তোমার নিজ মুখটা নিজে দেখার ইচ্ছাটা মরে যাওয়ার চেয়েও মানুষকে তুমি তোমার মুখ দেখাতে খুব লজ্জিত হয়ে উঠলে। ভয়ংকর এক নিঃসঙ্গতা তোমাকে গ্রাস করল – নিঃসীম অাঁধার যেভাবে গ্রাস করে রাতের পুকুরজলের অবয়ব। তোমার  মরে যাওয়ার ইচ্ছা যত প্রবল হলো, তত তোমার মনে হতে থাকল, জীবন এক প্রলম্বিত প্রহসন। অথচ তোমার মাঝখানের জীবন-যৌবন কত দ্রুত চলে গেছে! যেন তোমার যৌবন শুরুই হয়নি। যেন তুমি রয়ে গেছ তোমার কৈশোরের প্রিয় স্বপ্নলোকে। একটাই বাক্য           ধ্বনি-প্রতিধ্বনি করে তোমার আত্মা হয়ে ছড়িয়ে পড়ল পুকুরপারে চুপটি করে লুকিয়ে থাকা সাঁঝের মায়ায়… জীবনে কী যেন করার ছিল, কী যেন বাকিই রয়ে গেল…

তোমার বাবার কথা মনে হলো, যিনি ভোর দেখে অকারণে খুশি হয়ে উঠতেন। ছাত্রদের পড়ানোর আনন্দে তুমুল বৃষ্টির দিনে ছাতা মাথায় হেঁটে যেতেন চার মাইল দূরের স্কুল-পথ। ভালো কোনো বইয়ের সন্ধান পেলে যার চোখের ভাষায় খেলা করত প্লাবিত উচ্ছ্বাস। সন্ধ্যাবেলায় গ্রামের মানুষগুলো তার কথা যখন মন্ত্রমুগ্ধের শুনতেন, তিনি তখন হয়ে উঠতেন আবেগী দার্শনিক। তোমার বুঝতে বাকি থাকল না যে, বাবার জীবনটাই তোমার রক্তের মধ্যে বাস করছে। সেই জীবনকে যাপন না করার জন্যই তোমার মনে হচ্ছে কী যেন করার বাকি রয়ে গেল। অচেনা পথে পার হয়ে আসা আরো অচেনা এক জীবন তোমার অজান্তে কখন খেয়ে ফেলেছে তোমার যৌবনকে। তোমার কৈশোরের স্বপ্ন ফিরে ফিরে এসে তোমাকে নিষ্ঠুর এবং আরো নির্জনতর নিসঙ্গতায় তলিয়ে নিল। স্মৃতিহীনতা এসে কেড়ে নিল যৌবনের সকল প্রহরের সকল পাপ।

অথচ অদ্ভুতভাবে তুমি পুনরায় ফিরে পেলে সেই সন্ধ্যা নিয়ে তোমার হারিয়ে যাওয়া অনুভব। তা যত স্পষ্ট হতে থাকল যৌবনস্মৃতি ততই তুমি বিস্মৃত হতে থাকলে। তোমার এখন আর মনে পড়ে না, বিদেশে বাস করা তোমার দুই ছেলের মুখাবয়ব এমনকি তাদের নাম। তোমার অঙ্কশায়িনী সব নারীর রূপ-সৌন্দর্য কোনোভাবেই তোমাকে এখন আর মনেই করাতে পারে না, তুমি একদিন যৌবনপ্রাপ্ত হয়েছিলে। শুধু মাহমুদা নামের গ্রামের এই প্রথম স্ত্রীকে দেখলেই কেন যেন তোমার মনে হয়, তুমি একজন শিক্ষক। তোমার একদল ছাত্র চার মাইল দূরের সেই স্কুলে অধীর আগ্রহে তোমার কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করছে। আর ‘সাঁঝের মায়া’ কবিতাটি শেখানোর জন্য পুকুরপারে অপেক্ষা করছেন তোমার দাদি। যিনি মারা গেছেন আরো পঁয়ষট্টি বছর আগে।

অবশেষে তোমার সেই মহার্ঘ্য ক্ষণ ফিরে এলো। মে মাসের আট তারিখে তুমি তোমার দাদির কাছে যাওয়ার সব প্রস্ত্ততি যখন শেষ করলে, তোমার বুকের বাঁপাশে বয়ে গেল এক আনন্দস্রোত। বাবা এসে তোমাকে বললেন,

বাবা তুমি কি ‘সাঁঝের মায়া’ কবিতাটা লেখা শেষ করেছ? তুমি উদ্ভাসিত নেত্রে তাকে উত্তর দিলে,

আমি তা শেখার জন্য দাদির কাছে যাচ্ছি বাবা।

তোমার বুকের বাঁপ্রান্তে বয়ে চলা আনন্দস্রোত থামিয়ে দিলো তোমার ফুসফুসের স্পন্দন। সবকিছু ভুলে যাওয়ার আগে তোমার শেষবার মনে পড়ল, তোমার দাদি প্রায় সত্তর বছর আগে ‘সাঁঝের মায়া’ কেমন তা সরেজমিনে দেখানোর জন্য এক সন্ধ্যায় পুকুরপাড়ে বসে চাঁদের ভেতরের কালো কালো দাগমতো দৃশ্য দেখিয়ে তোমাকে চাঁদ-বুড়ির চরকা কাটার গল্প শুনিয়েছিলেন।