সভ্যতার ভবিষ্যৎ

‘জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক গুণিজন বক্তৃতা’ প্রদানের আমন্ত্রণ লাভ করে আমি আনন্দিত হয়েছি এবং সম্মানিত বোধ করছি। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক সরল জীবনযাত্রা পছন্দ করতেন। তাঁর ছিল সীমাহীন জ্ঞানানুরাগ। অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ে দেশে-বিদেশে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ নতুন গ্রন্থের সংবাদ তাঁর কাছ থেকে জানা যেত। তিনি পাঠক ছিলেন এসব বিষয়ের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থাদির। তিনি না লিখলেও, গবেষণা না করলেও, যাঁরা লিখতেন ও গবেষণা করতেন, তাঁদের তিনি তথ্যাদি দিয়ে এবং আরো তথ্যাদি পাওয়ার সূত্র বলে দিয়ে সহায়তা করতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা ও এর অগ্রগতি সম্পর্কে তিনি অনেক কথা অত্যন্ত চমৎকারভাবে বলতেন। তাতে নিজের অভিজ্ঞতার ও অনুসন্ধানের কথাও থাকত। ঢাকার ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ ও ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ সম্পর্কেও তিনি কথা বলতেন। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কেও তিনি কথা বলতেন। ব্রিটিশ-শাসিত বাংলার জাগরণের কথা বলতে তাঁর আগ্রহ ছিল। আমি লক্ষ করেছি, মনীষীদের সৃষ্টিশীলতা ও মহত্ত্বের কথা বলার সময়ে তাঁদের সীমাবদ্ধতা ও
ত্রুটি-বিচ্যুতির কথাও উল্লেখ করতেন। বাংলাভাষার দেশে হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ তাঁর কাছে অত্যন্ত পীড়াদায়ক ছিল। অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েও তিনি ইংরেজ আমলের পশ্চাৎবর্তী মুসলমান সম্প্রদায়ের পক্ষ নিয়ে কথা বলতেন। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর ১৯৭৪ সালে সরকার তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক পদে অধিষ্ঠিত করেছিল। তাঁর লেখা কম হলেও তিনি লিখেছেন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এবং সেগুলো পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগায় এবং পাঠককে সন্ধিৎসু করে। আজীবন অকৃতদার এই জ্ঞানানুরাগী মনীষী সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কথা আরো আছে। সেগুলো নিয়ে আলোচনার জন্য দীর্ঘ সময় ও পরিসর দরকার। আজকের এই অনুষ্ঠানে আমরা তাঁর মনীষার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।

আজকের বক্তৃতার জন্য আমি বিষয় ঠিক করেছি ‘সভ্যতার ভবিষ্যৎ’। পৃথিবীব্যাপী যে-অবস্থা এখন বিরাজ করছে, তাতে মানবজাতির উন্নতিশীল ভবিষ্যৎ সৃষ্টির জন্য সভ্যতা, সংস্কৃতি, প্রগতি, যুদ্ধ ও শান্তি ইত্যাদি বিষয়ে গভীর
আলোচনা-সমালোচনা দরকার। সুদূরভবিষ্যতের কথা ভাবতে হবে। অদূরভবিষ্যতের কথাও ভাবতে হবে। যুদ্ধবিগ্রহ ও সংঘাত-সংঘর্ষ তো চলছে! এগুলোও তো সভ্যতারই অন্তর্গত।

এসব বিষয়ে কথা বলার সামর্থ্য আমার অল্পই আছে। তবু এই অনধিকার-চর্চায় আমি এগিয়েছি, বিষয়টির প্রতি সুযোগ্য ব্যক্তিদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। ‘গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ’ ও ‘মাস্টার ডিসকোর্স’ পরিহার করে চিন্তা করার যে প্রবণতা দেখতে পাই, তা আমার কাছে কল্যাণকর মনে হয় না। আমি আরো মনে করি, কেবল অংশের দিকে নয়, অংশের সঙ্গে সমগ্রের দিকেও এবং সমগ্রের সঙ্গে অংশের দিকেও তাকাতে হবে। অত্যুন্নত নতুন প্রযুক্তির বিস্তার (১৯৮০-র দশক থেকে) ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির (১৯৯১) পর, বিভিন্ন দেশে মানুষ কোন গন্তব্যের দিকে পরিচালিত হচ্ছে? রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক – সব দিক দিয়েই প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে হবে। মানুষের ইতিহাসে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সম্পর্ককে বুঝতে হবে। কোনো বিষয়ের জ্ঞানই সেই বিষয়ের ইতিহাসের জ্ঞান ছাড়া পর্যাপ্ত ও কার্যোপযোগী হয় না।

১. সভ্যতা-সৃষ্টি ও সভ্যতার ধারণা

বিভিন্ন ভূভাগে অবস্থিত প্রতিটি প্রাচীন-সভ্যতার ক্রমবিকাশ ও স্বাতন্ত্র্য লক্ষ করলে বোঝা যায়, মানুষ জীবনধারণের ও
সমৃদ্ধি-অর্জনের জন্য দীর্ঘকাল যাবৎ সভ্যতা সৃষ্টি করেছে সভ্যতা সম্পর্কে কোনো ধারণা না নিয়ে। মধ্যযুগেও কি কোথাও সভ্যতার ধারণা দেখা দিয়েছিল? সভ্যতার ধারণা সৃষ্টি হয়েছে অনেক পরে – ইউরোপে রেনেসাঁস চলার কিংবা আধুনিক যুগের বিকাশের কোনো পর্যায়ে। রেনেসাঁস বিকশিত হয়েছে আঁকাবাঁকা উঁচুনিচু ধারায় – বলা যায় ‘পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পথযাত্রা’। এই পথযাত্রা আজো চলছে। অদূরভবিষ্যতে এবং সুদূরভবিষ্যতে কী হবে?

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৮) পর থেকেই স্পেংলার (Oswald Spengler ১৮৮০-১৯৩৬), সুইটজার (Albert Schweitzer ১৮৭৫-১৯৬৫) প্রমুখ দার্শনিক মত প্রকাশ করেন যে, চৌদ্দ শতক থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত পশ্চিম-ইউরোপের জাতিগুলোর মধ্যে যে রেনেসাঁস বিকশিত হয়ে চলছিল, উনিশ শতক শেষ হতে-না-হতেই ইউরোপে তা ক্ষয় পেয়ে নিষ্প্রভ হতে থাকে এবং সেই ক্ষয়ের  ধারায় সংঘটিত হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৮)। তারপর বিশ বছরের মধ্যেই শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-৪৫)। এই অবস্থাকে দার্শনিক-বৈজ্ঞানিকেরা সভ্যতার সংকট, ইউরোপীয় সভ্যতার অবক্ষয়, অন্ধকারাচ্ছন্ন কাল, দুঃসময় ইত্যাদি বলে অভিহিত করেছেন। সংকট কাটানোর জন্য তাঁরা ইউরোপের রেনেসাঁসের সমালোচনার মধ্য দিয়ে, অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে, নতুন রেনেসাঁস সৃষ্টির প্রয়োজনের কথা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলেছেন। উজ্জ্বল-উদ্ধারের জন্য তাঁরা জোর দিয়েছেন নতুন রেনেসাঁস সৃষ্টিতে। ইউরোপে রেনেসাঁসের মর্মে তাঁরা লক্ষ করেছিলেন ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত ও কর্তব্য-অকর্তব্য সম্পর্কে ধারণার ব্যাপকতা ও গভীরতা এবং ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত জীবনে ন্যায়, উচিত ও কর্তব্যের পক্ষ অবলম্বন করে সামনে চলা। সৃষ্টিশীলতা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়ে রেনেসাঁসের ও সভ্যতার ধারণা ক্রমে স্পষ্টতর ও বিকশিত হয়েছে।

সভ্যতার সংকট কাটানোর জন্য নতুন রেনেসাঁসের কোনো বিকল্প তাঁরা ভাবতে পারেননি। যত সময় যাচ্ছে, ততই তাঁদের বক্তব্যের সঠিকতা বেশি করে প্রমাণিত হচ্ছে। কিন্তু তাঁদের চিন্তা উত্তরকালের জ্ঞানীদের, রাজনীতিবিদদের ও আন্দোলনকারীদের (activists) মনোযোগ কমই পেয়েছে।

এর মধ্যে উদ্ভাবিত ‘আধুনিকবাদ’ (modernism) ও ‘উত্তরাধুনিকবাদ’ (post-modernism) নিয়ে সভ্যতার সংকট বেড়েছে। এসব মতধারা রেনেসাঁসবিরোধী। দার্শনিক নোয়াম চমস্কি, অর্থনীতিবিদ জোসেফ ই. স্টিগলিজ প্রমুখ মনীষী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চলমান কর্মকাণ্ডের এবং যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্বায়নের কঠোর সমালোচক। সমালোচনার মধ্য দিয়ে দরকার নতুন রেনেসাঁস সৃষ্টিতে নিবিষ্ট হওয়া। চমস্কি উনিশ শতকের রুশ দার্শনিক বাকুনিনের (Mikhail Bakunin ১৮১৪-৭৬) চিন্তাধারার অনুসারী। বাকুনিনের মতবাদ নিঃরাষ্ট্রবাদ (anarchism) ইউরোপে তাঁর সমকালে, উনিশ শতকে, ইউটোপিয়ান বলে সমালোচিত হয়েছে। ইউরোপে সাংগঠনিক উদ্যোগে ওই চিন্তাধারার বাস্তবায়নের চেষ্টা গতি পায়নি। চমস্কি fabianism-এরও সমর্থক। এই মতবাদ উনিশ শতকের ইউরোপে সমালোচিত হয়েছে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের বিরোধী, সুবিধাবাদীদের সমাজতন্ত্র বলে। চমস্কির চিন্তা ফ্যাবিয়ান এনার্কিজম বলেও পরিচিতি পেয়েছে। চমস্কি ও স্টিগলিজের চিন্তাধারা কি বাস্তবায়নযোগ্য? দুজনকেই নোবেল পুরস্কার দিয়ে সম্মান জানানো হয়েছে।

রেনেসাঁস কথাটার আভিধানিক অর্থ ‘নতুন জন্ম’। প্রত্যেক জাতির ইতিহাসেই যুগ-যুগান্তর আছে। প্রকৃত যুগান্তরে অর্থাৎ নতুন যুগে জাতির নতুন জন্মের পরিচয় প্রকাশ পায়। ইতালিতে সূচিত এবং ক্রমে বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত ইউরোপের রেনেসাঁসের লক্ষ ছিল, মধ্যযুগের বিজ্ঞানবিরোধী সংস্কার-বিশ্বাস, ভ্রান্তি ও অনাচার অতিক্রম করে নতুন অর্থনীতি-রাজনীতি নিয়ে, সৃষ্টিশীল জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্য অবলম্বন করে, সম্পূর্ণ মানবীয় প্রচেষ্টায় প্রগতির পথ ধরে নতুন সভ্যতা সৃষ্টিতে এগিয়ে চলা। এখন যে-অবস্থা বিরাজ করছে তাতে নতুন রেনেসাঁসের লক্ষ্য হবে আধুনিক যুগের সংস্কার-বিশ্বাস, ভ্রান্তি ও অনাচার এবং যুদ্ধ-বিগ্রহকে পেছনে ফেলে, নতুন অর্থনীতি-রাজনীতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্য অবলম্বন করে প্রগতির পথ ধরে উন্নততর নতুন সভ্যতা সৃষ্টির ধারায় এগিয়ে চলা। এই অগ্রযাত্রার অভাবে গত অন্তত চার দশক ধরে পৃথিবীব্যাপী প্রায় সব জাতির মধ্যে পুরাতন পরিত্যক্ত সব সংস্কার-বিশ্বাস ও অদৃষ্টবাদ পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে। এ-অবস্থায় প্রতিটি জাতির বিবেকবান চিন্তাশীল ব্যক্তিদের বিবেচনার কেন্দ্রীয় বিষয় হওয়া উচিত এই পশ্চাৎগতির অবসান ও সম্মুখগতির সূচনা কীভাবে করা যায়, তার উপায় সন্ধান করা।

মানুষের কেবল মনের বা চিন্তার জগতে পরিবর্তন ঘটালে তা টেকে না। বর্তমান বাস্তবতায় কার্যকর, প্রগতিশীল অগ্রগতির জন্য সংশ্লিষ্ট জাতির মানসিক পরিবর্তনের সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক সব ব্যবস্থারই পরিবর্তন সাধন করতে হবে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানবপ্রজাতির মহান সৃষ্টি। এই সৃষ্টির ধারাকে রক্ষা করতে হবে এবং এর বিকাশের সুযোগ অবারিত রাখতে হবে। বিজ্ঞানকে মানুষের মনোজগতে সীমাবদ্ধ না রেখে, কার্যোপযোগী করে, জীবনযাত্রায় ও কাজকর্মে পরিব্যাপ্ত করতে হবে। মনোবিজ্ঞান ও নীতিবিদ্যাকে বিদ্যায়তনিক চর্চায় সীমাবদ্ধ না রেখে সর্বজনীন কল্যাণে সৃষ্টিশীল নতুন রূপে বিকশিত করতে হবে। পশ্চাৎবর্তী দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে অগ্রবর্তী শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো থেকে বিচার-বিবেচনাপূর্বক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গ্রহণ করে শক্তিশালী হতে হবে। শক্তিশালী হওয়ার উপায় দুর্বল জাতি ও রাষ্ট্রগুলোকেই খুঁজে বের করতে হবে। পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গের আধিপত্যনীতির শিকার হয়ে পড়লে দুর্বলতা বাড়বে। দুর্বল থাকলে শোষণ-বঞ্চনা ভোগ করতেই হয়। দুর্বল থাকা অন্যায়।

প্রকৃতির ন্যায় মাৎস্যন্যায়। বড় মাছ ছোট মাছকে ধরে খায়, বাঘ সিংহ হরিণকে মেরে খায়। মানুষও মাছ-মাংস খায়, প্রাণী হত্যা করে। কোনো প্রতিকার নেই। মানুষের সমাজে প্রবল দুর্বলের ওপর শোষণ, বঞ্চনা, প্রতারণা চালায়। এক্ষেত্রে প্রতিকার আছে। মানুষকে সমাজে ও রাষ্ট্রব্যবস্থার ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য এবং অন্যায়কে প্রতিহত করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে চেষ্টা চালাতে হয়, নিজেদের নেতৃত্ব ও নেতা সৃষ্টি করতে হয়। এর জন্য প্রত্যেক জাতির মধ্যেই জনগণের দিক থেকে দরকার হয় সাধনা ও সংগ্রাম। দুর্বলেরা শক্তিশালী হয় ঐক্যবদ্ধ হয়ে।

শোষণ-বঞ্চনা-প্রতারণা থেকে মুক্তির জন্য এবং সৃষ্টিশীলতা ও প্রগতির জন্য নিরন্তর চেষ্টা চালাতে হয়। কোনো জাতির মধ্যে এই চেষ্টা কমে গেলে, জনগণ নিঃস্পৃহ হয়ে ঘুমিয়ে থাকলে তাদের ওপর শোষণ, বঞ্চনা, প্রতারণা ও পীড়ন বেড়ে চলে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সদ্ব্যবহারের জন্য সর্বজনীন কল্যাণের লক্ষ্যে ‘বিজ্ঞানসম্মত রাজনীতি’ গড়ে তুলতে হবে এবং মহান রাজনৈতিক নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে হবে। নতুন রেনেসাঁস দেখা দিলে এসব বিষয় কেন্দ্রীয় বিবেচনা পাবে এবং তাতে আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক ও

সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার পুনর্গঠনও সম্ভব হবে।

২. সভ্যতার স্বরূপ : সভ্যতা-বিষয়ে সচেতনতার প্রশ্ন

সভ্যতা মানবীয় ব্যাপার। মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণীরই সভ্যতা নেই। মানুষের সভ্যতা-সৃষ্টির সামর্থ্যই মানুষকে অন্যসব প্রাণী থেকে আলাদা করে রেখেছে। মানুষ শুধুই প্রাকৃতিক নিয়মের, সামাজিক প্রথা-পদ্ধতির ও রাষ্ট্রীয় বিধি-বিধানের শৃঙ্খলে বাঁধা অবস্থার দাস নয়, মানুষ আপন প্রবৃত্তিরও দাস নয়। মানুষের মধ্যে সেই শক্তিও নিহিত রয়েছে যার বলে সে অতি মন্থর গতিতে হলেও নিজের অভীষ্ট সাধন করতে পারে। একক প্রচেষ্টায় অনেক কিছু হয় না, সম্মিলিত প্রচেষ্টায় হয়। এক জেনারেশনের চেষ্টায় অনেক কিছু হয় না, জেনারেশনের পর জেনারেশনের চেষ্টায় হয়। বিজ্ঞানের আবিষ্কার-উদ্ভাবনের ইতিহাস লক্ষ করলে এটা বোঝা যায়।

সভ্যতার সংকট কাটানো ও উন্নত নতুন সভ্যতা সৃষ্টির উপায় সন্ধান করতে হলে সভ্যতা কী, এ সম্পর্কে ধারণা স্পষ্টতর করতে হবে।

ইংরেজিতে civilization কথাটা একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। civil, civic, civics ইত্যাদি কথার সঙ্গে সম্পর্ক আছে civilization কথাটির। civilized এবং uncivilized কথা-দুটোর অর্থও বুঝতে হবে। civilization-এ গুরুত্ব পায় মানুষের জীবন-জীবিকা, পরিবার, সরকার, রাষ্ট্র, শাসনপদ্ধতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, মন্দির, মসজিদ, গির্জা, ঘর-বাড়ি, শিক্ষাদীক্ষা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, চিকিৎসা, হাসপাতাল, ভালো-মন্দ বিচার, নীতি-আদর্শ, আইন-কানুন, বিধি-ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট, চলাচল, স্থাপত্য-ভাস্কর্য, কৃষি, শিল্প-কারখানা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ও আবিষ্কার-উদ্ভাবন, সাহিত্য ও শিল্পকলার চর্চা, বিনোদন, সৃষ্টিশীলতা ও উৎপাদনশীলতা, ইত্যাদি সব মানবীয় কর্মকাণ্ড। সবকিছুই গতিশীল, কোনোটাই স্থির নয়, স্থবির নয়। সভ্যতাও গতিশীল আছে, থাকবে। সার্বিক পরিবর্তনের – উন্নতির বা প্রগতির গতিধারা এগুলোকে অবলম্বন করেই সন্ধান করা হয়। civilization-এর বা সভ্যতার ক্রমবিকাশ ব্যাপারটিকে দেখা হয়েছে দৈশিক ও জাতীয় ব্যাপার রূপে। তথ্যপ্রযুক্তি ও জীবনযুক্তির বিপ্লবের সময় থেকে – বাংলাদেশে গত শতাব্দীর আশির দশক থেকে – world civilization, globalization প্রভৃতি কথা বারবার সামনে আনা হচ্ছে।

বিশ্বসভ্যতা কি জাতীয় সভ্যতার পরিপন্থী? বিশ্বসভ্যতার বিকাশের জন্য জাতীয় সভ্যতাগুলোকে কি বিলুপ্ত করতে হবে? এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এসব নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা দরকার। civilaization একটি নৈতিক ধারণাও বটে; এর বিপরীতে রয়েছে barbarism. প্রকৃতি ও মানবসমাজ বিকাশশীল, সভ্যতা ও সভ্যতার ধারণাও বিকাশশীল। স্থান-কাল-পাত্রভেদে ধারণাটি নিয়ে নানা মত আছে। কোনো খ্যাতিমান প্রভাবশালী ব্যক্তি যখন কোনো বিমূর্ত বিষয়ে মত প্রকাশ করেন, তখন অনেকেই তার পুনরাবৃত্তি করেন। দেশে-বিদেশে যাঁরা জাতীয় সংস্কৃতি, জনসংস্কৃতি, গণসংস্কৃতি ইত্যাদি নিয়ে জীবনব্যাপী ভেবেছেন, তাঁদের কেউ কেউ শেষ পর্যন্ত সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে সমার্থক মনে করেছেন। Decline of the West গ্রন্থে স্পেংলার civilizalition-এর জায়গায় culture লিখেছেন। মনে রাখতে হবে, সভ্যতা, সংস্কৃতি কেবল চিন্তার ব্যাপার নয়, চিন্তার সঙ্গে কাজেরও ব্যাপার। কোনো জনগোষ্ঠীর বা জাতির সব কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়েই প্রকাশ পায় তার সভ্যতা ও সংস্কৃতি।

বাংলায় প্রতিদিনের কথাবার্তায় সভ্যতা বলতে বোঝায় সদাচার বা ভদ্রতা। অসভ্য মানে, সদাচার যে জানে না। এটা
ব্যক্তি-পর্যায়ের কথা। ভারতীয় ঐতিহ্যে দেখতে পাই ‘সভা’ ‘সভ্য’ ও ‘সভ্যতা’ – এই শব্দগুলো পরস্পর সম্পর্কিত – ব্যুৎপত্তিগত দিক দিয়ে যেমন, অর্থের দিক দিয়েও তেমনই। সভা মানে সম্মেলন, সংগঠন, সম্মিলিত জীবন, যৌথ জীবন। সভ্য মানে সংগঠিত বা যৌথ জীবনের অংশীদার – সংগঠনের সদস্য। আর সভ্যতা হলো সভ্যের বা সদস্যের গুণাবলি, সম্মিলিত বা যৌথ জীবনের অংশীদার হওয়ার ও অংশীদার থাকার যোগ্যতা। সংস্কৃত ভাষায় সভ্য বলতে বোঝায় যা সভার উপযোগী, যেখানে বহুজন বন্ধুভাবে মিলিত হয় সেখানকার উপযোগী। এককথায় সভ্যতাকে বলা যায় মানুষের সামাজিক ও সাংগঠনিক গুণাবলি।

প্রাচীন ভারতে নগরবাসীদের সভ্য আর গ্রামবাসীদের অসভ্য বলার রীতি ছিল। আর্য ও অনার্যদের মধ্যে পার্থক্য অত্যন্ত প্রখর ছিল। আর্যরা অনার্যদের মনে করত অসভ্য। মধ্যযুগে সব দেশেই আভিজাত্যবাদ প্রবল ছিল। ভারতে ছিল এবং আজো আছে জাতিভেদপ্রথা (caste-system)। জাতিভেদের প্রখরতা কমে গেছে এবং কমে যাচ্ছে। দেশ-কাল-পাত্রভেদে সামাজিক গুণাবলির ধারণায় কমবেশি বিভিন্নতা ছিল, আছে। প্রত্যেক দেশে সময়ের ব্যবধানে মানুষের সামাজিক গুণাবলির ধারণা কমবেশি পরিবর্তিত হয়।

প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর জীবনধারায়ই সভ্যতা আছে এবং সভ্যতার গতিধারায় যুগ-যুগান্তর আছে। আর প্রত্যেক যুগের সভ্যতায় আছে চড়াই-উতরাই। একটু গভীরে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, ভারতীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী সভ্যতার সম্পর্ক আছে সমিতি, সংস্থা, সংঘ, সংসদ, ঐক্য, শৃঙ্খলা, সহিষ্ণুতা, গ্রহিষ্ণুতা, সম্প্রীতি, সৃষ্টিশীলতা ও উন্নতিশীলতার সঙ্গে। সভ্যতা পারিবারিক, সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনধারার ব্যাপার – রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চা, আবিষ্কার-উদ্ভাবন ও প্রগতির ব্যাপার। সভ্যতার মর্মে আছে নীতি, আইন, আদর্শ, ন্যায়নিষ্ঠা, সদ্ভাব, শিষ্টাচার, সম্প্রীতি, সহানুভূতি,
জীবনযাপন-প্রণালির উৎকর্ষমানতা এবং উৎপাদনশীলতা ও সৃষ্টিশীলতা। এর মধ্যে অন্যায়-অবিচারের দিকও আছে।  ইতিহাসে সভ্যতাকে মনে করা হয়েছে দৈশিক বা জাতীয় ব্যাপার। বিভিন্ন জাতির সভ্যতায় পারস্পরিক প্রভাব আছে। বাস্তবে দেখা যায়, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সভ্যতার দিক দিয়ে প্রত্যেক দেশ, প্রত্যেক জাতি স্বতন্ত্র। তবে এক জাতির সভ্যতার সঙ্গে অন্য জাতির সভ্যতার মিলও আছে। সভ্যতা, সভ্যতার ধারণা বিকাশশীল। পরিবার, জাতি, রাষ্ট্র, গোটা পৃথিবী – সবই সভ্যতার অবলম্বন। সভ্যতার প্রতি ক্ষেত্রেই ভালোর সঙ্গে মন্দও আছে।

প্রতিটি সভ্যতাই উদ্ভব ও বিকাশের ধারা ধরে, শৈশব, কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব ও বার্ধক্যের স্তর পার হয়ে পরিণতিতে পৌঁছেছে। কোনো সভ্যতা বাইরের কোনো প্রবল শক্তির চাপে পড়লে কিংবা পরাধীন হয়ে গেলে সেই সভ্যতার স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হয়। স্বাভাবিক অবস্থায় প্রত্যেক জাতির জীবনে এক সভ্যতার বিলয়ে নতুন আর এক সভ্যতার উত্থান ঘটেছে। প্রত্যেক জাতির জীবনে দুই সভ্যতার অন্তর্বর্তী সময়টা কাটে উদীয়মান শক্তি ও বিলীয়মান শক্তির দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে। এই রকম সময়কে বলা হয় ক্রান্তিকাল (transition period)। প্রকৃতপক্ষে সভ্যতা আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক ব্যাপার – জনজীবনের সার্বিক অগ্রগতির ব্যাপার। প্রাচীন সভ্যতা, মধ্যযুগের সভ্যতা, আধুনিক সভ্যতা, ইউরোপীয় সভ্যতা, চীনা সভ্যতা, ভারতীয় সভ্যতা, হিন্দু-সভ্যতা, মুসলিম-সভ্যতা ইত্যাদি কথা অবলম্বন করে ইতিহাসের গতিধারায়, বর্বরতার বিপরীতে সভ্যতা ব্যাপারটিকে বোঝার চেষ্টা করা যেতে পারে। প্রত্যেক জাতিরই বিকাশ ঘটে তার অন্তর্গত বর্বরতা ও সভ্যতার বিরোধের মধ্য দিয়ে। আজকের দিনে যারা হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য যুদ্ধ চালাচ্ছে, তারা তো বর্বরতারই পরিচয় দিচ্ছে! প্রত্যেক জাতিকে বিদেশি আগ্রাসী শক্তির সঙ্গেও মোকাবিলা করতে হয়। প্রত্যেক জাতির এই চলমানতার মধ্যে কখনো সভ্যতার শক্তি, কখনো বর্বরতার শক্তি প্রবল হয় এবং কর্তৃত্ব করে। যে-কোনো জাতির অভ্যন্তরে সভ্যতার শক্তির মধ্যে অন্তর্বিরোধ থাকে; আবার বর্বরতার শক্তির মধ্যেও অন্তর্বিরোধ থাকে। রাজনীতির বেলায় বলা হয় inner-party struggle এবং inter-party struggle।

নর-নারী সম্পর্কও সভ্যতার একটি মূল পরিমাপক। বাংলাদেশে পরিবার, বিয়ে, সন্তান পালন, পরকীয়-পরকীয়া,
ধর্ষণ-গণধর্ষণ, হত্যা-আত্মহত্যা ইত্যাদির যে-বিবরণ প্রচারমাধ্যমে প্রচারিত হয়, তা কোন ধরনের সভ্যতার পরিচায়ক? সভ্যতার ভেতরে বর্বরতাও থাকে।

সংস্কৃত ভাষায় সভ্যতাবিষয়ক মনুসংহিতার ধারণার সঙ্গে আধুনিক ইউরোপীয় civilaization-এর ধারণার সংশ্লেষণের মধ্য দিয়ে আধুনিক যুগে বাংলাভাষায় সভ্যতার ধারণা রূপ লাভ করেছে। এখন তো ইউরোপ-আমেরিকার জাতিগুলো
সভ্যতা-সংস্কৃতি নিয়ে বিশেষ চিন্তা করে না। প্রবল জাতিগুলো যুদ্ধবাজ। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ন্যাটো, জি সেভেন মানবপ্রজাতিকে কোন গন্তবের দিকে নিয়ে যেতে চায়? রাশিয়া, চীন, ভারত কী-রকম ভবিষ্যৎ চায়?

রবীন্দ্রনাথের ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে সভ্যতার স্বরূপ ও গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। এটি তিনি বাংলায় পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করেছিলেন তাঁর মৃত্যুর মাত্র তিনমাস একুশদিন আগে। ওই দিন Crisis in Civilization নামে ইংরেজিতেও তিনি পুস্তিকা আকারে এটি প্রকাশ করেছিলেন। অসুস্থ অবস্থায় মৃত্যুর আসন্নতা উপলব্ধি করে তাঁর কিছু উপলব্ধি এতে তিনি ব্যক্ত করেছিলেন। এতে তাঁর আত্মপক্ষ-সমর্থনের ব্যাপার যেমন আছে, তেমনি আছে মানবজাতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাঁর সারা জীবনের উপলব্ধির কথা।

প্রত্যেক জাতির জীবনে প্রত্যেক ঐতিহাসিক কালেই কিছু সাধনা ও সংগ্রাম থাকে। তা নিয়েই সেই জাতির সেই যুগের সভ্যতা বা সংস্কৃতি পরিচিতি লাভ করে। এখানে আমি জাতীয় সংস্কৃতির কথা বলছি – জনসংস্কৃতির কথা বলছি – গণসংস্কৃতির কথা বলছি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে যে-সংকটের সূচনা, অত্যুন্নত নতুন প্রযুক্তির বিস্তার ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর সে-সংকট কোনো কোনো দিক দিয়ে অনেক গভীর ও ব্যাপক হয়েছে। অবশ্য কিছু সমস্যার সমাধান হয়েছে, কিছু নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টিও হয়েছে। কালের অগ্রগতি ও পরিবর্তন সত্ত্বেও শতাব্দীর বেশি সময় ধরে মানবপ্রজাতি যে সংকটে নিমজ্জিত, তা থেকে উদ্ধারলাভের জন্য নতুন সভ্যতা সৃষ্টিতে মনোযোগী হওয়া আজ প্রত্যেক জাতির ও গোটা মানবজাতির বিবেকবান চিন্তাশীল ব্যক্তিদের মূল কর্তব্য। বর্তমান অতীতের সৃষ্টি, আর ভবিষ্যৎ সৃষ্টি হচ্ছে বর্তমানের দ্বারা। সভ্যতা কেবল অতীতের ব্যাপার নয়, বর্তমান ও ভবিষ্যতেরও ব্যাপার। আর সভ্যতা বা সংস্কৃতি কেবল চিন্তার ব্যাপার নয়, চিন্তার সঙ্গে কাজেরও ব্যাপার। এ নিয়ে দেশে-বিদেশে নানা জনের নানা মত দেখা যায়। কেবল মত নিয়ে থাকলে হবে না, কাজ করতে হবে। প্রত্যেক জাতির প্রগতিপ্রয়াসী চিন্তক ও কর্মীদের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান ও নিবিড় সংহতি দরকার। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও তা দরকার। রাষ্ট্র এবং আন্তঃরাষ্ট্রিক সম্পর্ক – দুটোকেই সর্বজনীন কল্যাণে উন্নত করতে হবে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলোপের (১৯৯১) পরেই যুক্তরাষ্ট্রের ‘Official Philosopher’ ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা The End of History গ্রন্থে মানবজাতির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের, এবং যুক্তরাষ্ট্রের আরেকজন ‘Official Philosopher’ স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন Clash of Civilaizations গ্রন্থে  মানবজাতির ধর্ম ও সংস্কৃতির ইতিহাসের যে-বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন, তা পৃথিবীব্যাপী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যকে কেন্দ্র করে, সব জাতির সব রাষ্ট্রের ধনিক-বণিকদের স্বার্থরক্ষার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে করেছেন। মালিকানা-লিপ্সাকে, অধিক থেকে অধিকতর বিষয়-সম্পত্তির মালিক হওয়ার কামনাকে তাঁরা মানুষের সক্রিয় শক্তিশালী মূল কামনা বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁরা পুঁজিবাদকে রক্ষা করার ও বিকাশশীল রাখার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে লিখেছেন। এর জন্য তথ্যবিবরণ সংগ্রহে ও উপস্থাপনে তাঁদের অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় আছে। দুটি গ্রন্থ পরস্পর সম্পূরক। দেশে-বিদেশে এগুলোর পক্ষে-বিপক্ষে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। এইসব চিন্তা নিয়ে মানুষ কি দারিদ্র্যমুক্ত সমৃদ্ধিমান সম্প্রীতিময় নতুন ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে? সর্বজনীন কল্যাণে সর্বজনীন গণতন্ত্রের জন্য আমাদের তো কর্মমুখী ভিন্ন চিন্তাধারা দরকার।

কেবল শাসক-শোষকদের ও ধনিক-বণিকদের স্বার্থে নয়, কৃষক-শ্রমিক-নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তসহ সবার কল্যাণে ইতিহাস প্রণয়ন ও ইতিহাসের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দরকার। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর সে-ধারায় গুরুত্বপূর্ণ কিছুই এখনো ভাবা হচ্ছে বলে মনে হয় না। ইতিহাস হলো পরিবর্তনের বা গতিশীলতার রহস্য উদ্ঘাটনের বিদ্যা। কারণ-করণীয়-করণ ও ফলাফলের সূত্র ধরে ইতিহাস রচনা করা ও ইতিহাসের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা সমীচীন। কী উদ্দেশ্যে ইতিহাস রচনা করা হচ্ছে, তার ওপর রচিত-ইতিহাসের প্রকৃতি নির্ভর করে। ফুকুয়ামা তাঁর গ্রন্থটিতে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ইতিহাসের মার্কসীয় ধারণার চির-অবসান ঘটে গেছে বলে মত প্রকাশ করেছেন। ক্ষুধা ও যৌন তাড়নার পরেই ধনলিপ্সাকে মানুষের সবচেয়ে শক্তিশালী অপরিবর্তনীয় কেন্দ্রীয় প্রবণতা বলে মত প্রকাশ করেছেন তিনি। তাঁর উদ্দেশ্য অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব নানাভাবে নতুন পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার যৌক্তিকতা ব্যক্ত করেছেন। হান্টিংটন তাঁর গ্রন্থটিতে অর্থনৈতিক-রাষ্ট্রিক বিষয়াদি যথাসম্ভব পরিহার করে কেবল ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঘটনাপ্রবাহ অবলম্বন করে মানবজাতির গোটা ইতিহাসের গতিধারা বিশ্লেষণ করেছেন এবং নতুন পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার তাগিদ দিয়েছেন। 

সভ্যতার স্বরূপ সম্পর্কে বিভিন্ন ভাষার অর্থনীতিবিদদের, সমাজবিজ্ঞানীদের, ইতিহাসবিদদের, দার্শনিক ও চিন্তকদের গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য অবশ্যই অনেক পাওয়া যাবে। সভ্যতা, সংস্কৃতি, প্রগতি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বাংলা ভাষায় এবং অন্য সব ভাষায়ও আলোচনা-সমালোচনা দরকার। কেবল উচ্চশ্রেণির পাঁচ শতাংশ লোকের জন্য নয়, অবশিষ্ট পঁচানব্বই শতাংশ লোকের জন্যও কল্যাণকর উন্নতিশীল নতুন সভ্যতা আমরা কামনা করি। উচ্চশ্রেণির লোকদের জন্যও আমরা চাই সম্মানজনক
আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক অবস্থান। কথিত ‘উদার গণতন্ত্র’ নয়, ‘নব্য-উদার’ গণতন্ত্রও নয়, আমরা চাই ‘সর্বজনীন প্রগতিশীল গণতন্ত্র’। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও সমাজতন্ত্রকে পরস্পরবিরোধী রূপে না রেখে পরস্পর-সম্পূরক রূপ দিতে হবে। ভোগবাদ ও সুবিধাবাদ পরিত্যাজ্য। পরিবার, জাতি, রাষ্ট্র, আন্তঃরাষ্ট্রিক সম্পর্ক – এগুলোই সভ্যতার মূলভিত্তি। এগুলো পরিবর্তিত হবে। এই পরিবর্তনের ধারায় কারা নেতৃত্ব দেবেন তার ওপর নির্ভর করে সভ্যতার ভবিষ্যৎ রূপ ও প্রকৃতি। জনগণ ঘুমিয়ে থাকলে তো সর্বজনীন কল্যাণে কিছুই হবে না। জনগণ জাগ্রত হলে, জনগণের ভেতর থেকে সর্বজনীন কল্যাণে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি করা হলে, ভবিষ্যৎ সভ্যতা সবার জন্য কল্যাণকর হতে পারে।

৩. সভ্যতার গতিধারা : রেনেসাঁসের উদ্ভব ও বিস্তার

চৌদ্দ শতকে পশ্চিম-ইউরোপের দেশগুলোতে ফিউডাল লর্ডস ও ভূমিদাসদের দ্বারা সম্পন্ন কৃষি ও কুটিরশিল্প-ভিত্তিক অর্থনীতি, অভিজাততান্ত্রিক বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র, আর বাইবেল ও গির্জাকেন্দ্রিক সংস্কৃতি নিয়ে গঠিত নিরঙ্কুশ-কর্তৃত্ববাদী রাজ্যব্যবস্থার অবক্ষয়পর্বে উদ্ভব ঘটেছিল নতুন ব্যবসা-বাণিজ্যের ও রেনেসাঁসের। ইতিহাসের ধারা ধরে বলা যায়, শুভকর যুগান্তরকারী পরিবর্তন বা রেনেসাঁসের সূচনা হয়েছিল ইতালির কোনো কোনো নগরে। ইতালিতে ছিল নগররাষ্ট্র। রোমে ছিল কেন্দ্রীয় রোমান ক্যাথলিক গির্জার ও পোপের অবস্থান। ল্যাটিন ছিল প্রাচীন রোমের ভাষা। ইউরোপের ইতিহাসে খ্রিষ্টীয় মধ্যযুগকে বলা হয় অন্ধকার যুগ। রেনেসাঁসে ছিল সেই অন্ধকার যুগের গ্রাস থেকে মুক্তিলাভ এবং বিবেক ও যুক্তি অবলম্বন করে এগিয়ে চলার উদ্দীপনা। রেনেসাঁসে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি সব সময়েই গুরুত্ব পেয়েছে। ইতালিতে সূচিত রেনেসাঁস ক্রমে ইউরোপের ও অন্যান্য মহাদেশের সকল জাতির মধ্যেই বিস্তারলাভ করে। পশ্চিম-ইউরোপের জাতিগুলোর মধ্যে যাঁরা রেনেসাঁসের সূচনা করেছিলেন তাঁরা প্রথমেই তাঁদের কাজের বিরাট তাৎপর্য উপলব্ধি করেননি। কনস্টান্টিনিপলের পতনের (১৪৫৩) পর সেখানে পাওয়া গ্রন্থাদির মধ্যে প্রাচীন গ্রিস ও রোমের সমৃদ্ধ চিন্তাধারার সঙ্গে ইতালি, পর্তুগাল, স্পেন প্রভৃতি রাষ্ট্রের জ্ঞানী ও জ্ঞানানুরাগীরা পরিচিত হন এবং নতুন সৃষ্টির প্রেরণা লাভ করেন। এই নবচেতনার সূচনা ও বিকাশই অভিহিত হয়েছে রেনেসাঁস বলে। রেনেসাঁসের মর্মে ছিল প্রচলিত পুরাতন সংস্কার-বিশ্বাসের বন্ধন থেকে মানুষের মনকে মুক্ত করা এবং মানুষের চেষ্টায় সকলের জন্য উন্নত অবস্থা সৃষ্টি করা।

গির্জার ভেতরেই গির্জা-পরিচালিত বিদ্যায়তনসমূহের কোনো কোনো শিক্ষকের মনে প্রথম দেখা দেয় জীবন-জগৎ সম্পর্কে বাইবেলের পরিসর ও গির্জার কর্তৃত্ব অতিক্রম করে নতুন অনুসন্ধিৎসা ও নতুন চিন্তা, এবং ইনকুইজিশনের (গির্জা দ্বারা গঠিত গির্জার আওতাধীন এলাকার পাপীদের শাস্তি দেওয়ার সংস্থা) দুর্ভেদ্য ব্যূহ ভেদ করে তা ক্ষুদ্রসংখ্যক শিক্ষিত লোকদের মধ্যে পরিব্যাপ্ত হয়েছিল। রেনেসাঁসে দেখা যায় জীবন-জগৎ সম্পর্কে নতুন ধারণার উদ্ভব এবং মানুষের চিন্তা ও চেষ্টায়  সভ্যতা-সংস্কৃতির নবজন্ম। জাতীয় ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি ও মর্ম সন্ধান করতে গিয়ে কেউ কেউ জাতির বিকাশের কোনো কোনো পর্যায়ে পুরাতন জীবনধারার অবসান ও নতুন জীবনধারার সূচনা দেখতে পান। বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়ে এই নতুনের জয়যাত্রাই রেনেসাঁস। রেনেসাঁস-সাধকদের যাত্রাপথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না, ছিল কণ্টকাকীর্ণ। বিজ্ঞানসম্মত নতুন মত প্রকাশ করতে গিয়ে তাঁরা ইনকুইজিশনের রায় অনুযায়ী দণ্ড ভোগ করেছেন, কেউ কেউ প্রাণদণ্ডেও দণ্ডিত হয়েছেন।

রেনেসাঁসের মর্মে ছিল জগৎ ও জীবন সম্পর্কে জানার অন্তহীন আকাঙ্ক্ষা, সত্য ও ন্যায়ের সন্ধানে অদম্য স্পৃহা এবং মিথ্যা, অন্যায় ও দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্তির সাধনা ও সংগ্রাম। রেনেসাঁসের মধ্যেই মানুষ অলৌকিকতামুক্ত শাস্ত্রনিরপেক্ষ যুক্তি অবলম্বন করে এবং পরকালের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ইহকালের দিকে ভালো করে তাকায়, আর ঈশ্বরকেন্দ্রিক বাইবেলকেন্দ্রিক গির্জাকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির স্থলে মানুষকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করে। ক্রমে মানবজাতির মধ্যে উপলব্ধি জাগে যে, মানুষের শক্তি ও সম্ভাবনা ক্রমবর্ধমান ও অন্তহীন। তাতে মানুষের চিন্তা ও কর্মের প্রকৃতি বদলে যায়। মানুষ আত্মশক্তিতে আস্থাশীল ও আত্মনির্ভর হতে থাকে এবং ঈশ্বরের ও ধর্মগ্রন্থের ওপর নির্ভরশীলতা ত্যাগ করতে থাকে। ধর্মগ্রন্থের ও ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের বাইরে গিয়ে মানুষ আইনসভা ও আইন তৈরি করার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের বাইরে গিয়ে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদ উদ্ভাবিত হয় এবং সেগুলো অনুশীলিত হতে থাকে। কোনোটাই সহজে হয়নি – অনেক সাধনা, অনেক সংগ্রাম, অনেক আত্মত্যাগ লেগেছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর্যায়ে ইউরোপের দার্শনিক-বৈজ্ঞানিকদের অনেকে রেনেসাঁসের ভাবধারা থেকে বিচ্যুতিকে সভ্যতার সংকটের মূল কারণ মনে করেছেন। তাঁরা শাস্ত্রনিরপেক্ষ নৈতিক প্রশ্ন সামনে এনেছেন এবং বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে শ্রেয়োনীতি নির্ধারণ করে তা অবলম্বন করে কাজ করার কথা বলেছেন।

রেনেসাঁস হলো মধ্যযুগের গর্ভ থেকে আধুনিক যুগকে মুক্ত করার এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে জীবনবাদী নতুন নতুন সৃষ্টি ও আবিষ্কার-উদ্ভাবন দিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অবস্থাকে সমৃদ্ধ ও সুন্দর করার আন্দোলন। রেনেসাঁস হলো এক দীর্ঘস্থায়ী সাংস্কৃতিক আন্দোলন, যা দ্বারা মানুষের জীবন-জগৎদৃষ্টিতে মৌলিক পরিবর্তন ঘটে চলে এবং সর্বক্ষেত্রে প্রগতির ধারা বহমান থাকে। ক্রমে ‘ঈশ্বরকেন্দ্রিক’ দৃষ্টিভঙ্গির স্থলাভিষিক্ত হতে থাকে ‘মানুষকেন্দ্রিক’ দৃষ্টিভঙ্গি। সকলেই যে বিজ্ঞানমনস্ক হবেন, বস্তুবাদী হয়ে উঠবেন, তা ভাবা যায় না। ভাববাদীদের সঙ্গে বস্তুবাদীদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানেরও প্রশ্ন আছে। মার্কসবাদীরা এ-প্রশ্নে অল্পই চিন্তা করেছেন। মানুষের মনের দিকটাকে তাঁরা অল্পই গুরুত্ব দিয়েছেন।

রেনেসাঁসে ভালোর সঙ্গে মন্দও ছিল। ভালো-মন্দ মিলিয়েই মানুষ ও তার পরিবেশ। পৃথিবীতে মন্দবিহীন শুধুই ভালো কি কিছু পাওয়া যায়? রেনেসাঁসের ভাবপ্রবাহের বিকাশের মধ্যেই পর্যায়ক্রমে দেখা দেয় ক্রুসেড, উপনিবেশবাদ, ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ। খ্রিষ্টান ও ইহুদিদের মধ্যেও দেখা দিয়েছে বিরোধ।

ব্রিটিশশাসিত ভারতের কয়েকটি প্রদেশে হিন্দু-মুসলমান বিরোধ ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল। উপনিবেশবাদ, ফ্যাসিবাদ, আধিপত্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মানুষ সংগ্রাম করেছে। মানুষের সমাজে ভালো-মন্দকে পরাজিত রাখবে এবং প্রগতিশীল শক্তি বাধাবিপত্তি মোকাবিলা করে করে এগিয়ে চলবে – এটাই ছিল রেনেসাঁস-সাধকদের কাম্য। রেনেসাঁসের মধ্য দিয়ে বিকশিত শিল্প-সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদের লক্ষ্য ছিল ক্রমে পৃথিবীকেই স্বর্গে উন্নীত করা। দুই বিশ্বযুদ্ধ মানুষের এই স্বপ্নকে প্রবলভাবে আঘাত করেছে। পরে সভ্যতার ওপর অত্যুন্নত নতুন প্রযুক্তির অভিঘাত এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তি মানুষের সেই স্বপ্নকে বানচাল করে দিয়েছে। এখন দুনিয়াব্যাপী নৈতিক উত্থানের তাগিদ অনেকেই ব্যক্ত করছেন। নৈতিক প্রশ্নে বিজ্ঞানসম্মত কোনো চিন্তা বিকশিত না হওয়ার ফলে এবং গণতন্ত্রী ও সমাজতন্ত্রীদের ব্যর্থতার কারণে অনেক মানুষ ধর্মের দিকে ঝুঁকে গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে দরকার সর্বজনীন গণতন্ত্রের আদর্শ উদ্ভাবন করা এবং তার বাস্তবায়নের জন্য ‘দলভিত্তিক আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের সরকার’ গঠন করা। রাজনৈতিক দল গঠনে গুরুত্ব দিতে হবে। বিশ্বব্যবস্থাকেও পুনর্গঠিত করতে হবে। জাতিসংঘকে দিয়ে সুফল অল্পই হচ্ছে। জাতিসংঘের আমূল পুনর্গঠন দরকার। মানবজাতির উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য পৃথিবীর সব জাতির মধ্যেই নতুন অনুসন্ধিৎসা ও চিন্তা-ভাবনা দরকার। দুই বিশ্বযুদ্ধে এবং বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অপব্যবহারের ফলে যে-স্বপ্ন মানুষ হারিয়ে ফেলেছে, সেই স্বপ্নকে আজকের নতুন বাস্তবতায় নতুন রূপ ও প্রকৃতি দিয়ে পুনর্গঠিত করতে হবে।

কোনো জাতির রেনেসাঁসকে বুঝতে হলে সেই জাতির ইতিহাসের কাল-কালান্তরকে কারণ-কার্যসূত্র ধরে গভীরভাবে বুঝতে হবে। প্রত্যেক জাতির ইতিহাসে কিছু সময়কে বলা হয় অন্ধকার যুগ, আর কিছু সময়কে বলা হয় স্বর্ণযুগ। স্বর্ণযুগগুলোকেই বলা যায় রেনেসাঁসের কাল। কোনো জাতির জীবনেই রেনেসাঁস কেবল একবার ঘটে না – একাধিকবার ঘটে। কালের অগ্রগতির সঙ্গে রেনেসাঁসের ধারণাও বিকশিত হয়। যে-ব্যক্তিরা রেনেসাঁস নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেছেন, সময়ের ব্যবধানে তাঁদের নিজেদের ধারণাও পরিবর্তিত হয়েছে। রেনেসাঁসের ধারণা ইতিহাসের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মধ্য দিয়েই দেখা দিয়েছে এবং বিকশিত হয়ে চলছে। তা নিয়ে নানা জনের নানা মত থাকবেই। যাঁরা ইতিহাসের গতিধারা নির্ধারণের জন্য কাজ করেন, কাজে তাঁদের সাফল্য-ব্যর্থতার দ্বারা ভুল-শুদ্ধ নির্ধারিত হয়।

বাংলা ভাষার দেশে উনিশ শতকের প্রথম পাদে রামমোহনের (১৭৭২-১৮৩৩) চিন্তা ও কর্মের মধ্য দিয়ে সূচিত হয়েছিল রেনেসাঁস। বেগম রোকেয়ার (১৮৮০-১৯৩১) চিন্তা ও কর্মের মধ্য দিয়ে বাঙালি মুসলমান সমাজে সূচিত হয়েছিল রেনেসাঁস। রোকেয়ার সমকালে ও পরে, বিশেষ করে ঢাকায় বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন (১৯২৬-৩৮), রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও পাকিস্তানকালের পূর্ববাংলার বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে চিন্তক ও কর্মীদের জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতে রেনেসাঁসের উদ্দীপনা কাজ করেছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত সময়ে ঢাকাকেন্দ্রিক জাতীয় সংস্কৃতিতে বহমান ছিল রেনেসাঁসের উদ্দীপনা। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে সার্বিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে সে ধারা একান্তই ক্ষীয়মাণ হয়ে পড়েছে। তবে বাংলাদেশে ও পশ্চিমবাংলায় কোনো কোনো লেখকের চেতনায় রেনেসাঁসের উদ্দীপনা বহমান আছে। বাংলাদেশ, পশ্চিমবাংলা, আগরতলা ও বাংলাভাষী অন্যান্য অঞ্চলের জনগণের মধ্যে সাংস্কৃতিক সহমর্মিতা সবার জন্যই উন্নতির সহায়ক হবে।

৪. জনজীবনে প্রযুক্তির বিস্তার : প্রায় সর্বত্র অশুভ শক্তির কর্তৃত্ব

কোনো জাতির মধ্যে যখন ‘ঈশ্বরকেন্দ্রিক’ জগৎ-জীবনদৃষ্টির স্থলে ‘মানুষকেন্দ্রিক’ জগৎ-জীবনদৃষ্টি প্রাধান্য লাভ করে, তখন সেই জাতি আধুনিক যুগে প্রবেশ করে। ইতিহাসে আধুনিকতার মূল বৈশিষ্ট্য অলৌকিক সব কিছুর প্রতি অনাস্থা এবং মানবীয় প্রচেষ্টা দ্বারা ক্রমে সবকিছু করা যাবে – এই উপলব্ধি। বিজ্ঞানমনস্কতা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, সমাজবোধ, জাতীয় চেতনা, গণতন্ত্র, স্বাধীন চিন্তাশীলতা, আইনের শাসন বা মানবাধিকার ইত্যাদি আধুনিকতার লক্ষণ। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক – সব দিক দিয়েই আধুনিকতার এবং আধুনিক যুগের বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা যেতে পারে। আধুনিক রাষ্ট্রে নানা বিশ্বাস নিয়ে মানুষ বসবাস করে। বহুত্ববাদ  কথাটাও কেউ কেউ বলেন এবং লেখেন। এতে যে-সমস্যা দেখা দেয়, তার সমাধানের জন্য যে-কর্মনীতি দরকার, কবি রবীন্দ্রনাথ ও মহাত্মা গান্ধি তাকে বলেছেন, ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’। তাঁরা আরো বলেছেন, প্রয়োজন অনুযায়ী কখনো বৈচিত্র্যে কখনো ঐক্যে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। আধুনিক যুগে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গির প্রাধান্য থাকে। বহুত্বমূলক ঐক্য – এই কথাটাও একইভাবে গ্রহণ করা যেতে পারে। আধুনিক যুগে সভ্যতার মর্মে কাজ করেছে রেনেসাঁসের উদ্দীপনা। আধুনিক সভ্যতাকে বুঝতে হলে রেনেসাঁসকে বুঝতে হবে। রেনেসাঁস নিয়ে নানা মত আছে। সেগুলোকে বুঝতে হবে। রেনেসাঁসের ধারণাও বিকাশশীল।

চৌদ্দ শতক থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত ইউরোপের বিভিন্ন জাতির মধ্যে রেনেসাঁসের উদ্দীপনা নানাভাবে কার্যকর ছিল। উনিশ শতকের শেষে ইউরোপ-আমেরিকার বৃহৎ শক্তিবর্গ যখন দুনিয়াব্যাপী কর্তৃত্ব বিস্তারের ও উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতায় মত্ত হয়ে সংঘাতের দিকে এগিয়ে চলে, তখন রেনেসাঁসের উদ্দীপনায় ভাটা দেখা দেয় এবং তা দ্রুত ক্ষয় পেতে থাকে। ওই সময়েই সংঘটিত হয় দুই বিশ্বযুদ্ধ ও মানবতা-বিরোধী বড় বড় নানা ঘটনা। যুদ্ধের ও আনুষঙ্গিক ঘটনাবলির অভিঘাতে মানুষের জীবনোপলব্ধি ও চিন্তা-চেতনা বদলে যেতে থাকে। সে-অবস্থায় কাউন্টার-রেনেসাঁস রূপে প্রথমে শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রচারিত হয় আধুনিকবাদ (modernism), এবং পরে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রায় সকল শাখায় দেখা দেয় উত্তরাধুনিকবাদ (post-modernism)। আধুনিকবাদ ও উত্তরাধুনিকবাদকে বুঝতে হবে এসব নিয়ে আন্দোলনকারীদের প্রচারিত অর্থ নিয়ে। শব্দগত অর্থ আর মতবাদগত অর্থ একরকম হয় না। আধুনিকবাদীরা ও উত্তরাধুনিকবাদীরা রেনেসাঁসের বিরুদ্ধে কোনো ঘোষণা না দিয়ে কাজ করে চলেন রেনেসাঁসের উদ্দীপনা ও ভাবধারাকে অতীতের বিষয়ে পরিণত করার জন্য। আধুনিকবাদের মর্মে ছিল নৈরাশ্যবাদ (pessimism) ও কলাকৈবল্যবাদ (art for art’s sake)। আর উত্তরাধুনিকবাদ নেতিবাদী (negativist) ও শূন্যবাদী (nihilist)।

মানবজাতির উন্নতিশীল উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সৃষ্টি নিয়ে আশাভঙ্গের প্রত্যক্ষ কারণ বিশ শতকের প্রথমার্ধের দুই বিশ্বযুদ্ধ। আর নৈরাশ্যবাদী ও শূন্যবাদী চিন্তার উদ্ভবের কারণ মানবজাতির উন্নত ভবিষ্যৎ সৃষ্টি নিয়ে আশাভঙ্গ – হতাশা। মানুষের প্রতি মানুষের আকর্ষণ (affinity) ও আস্থা কমে গেছে, বেড়ে গেছে সামাজিক বিযুক্তি (alienation)। রেনেসাঁস নিয়ে নানা জনের নানা প্রবণতা ছিল বটে, তবে দার্শনিক-বৈজ্ঞানিকদের ও শিল্পী-সাহিত্যিকদের মধ্যে সৃষ্টিশীলতা ও জনমুখী প্রবণতা অব্যাহত ছিল। আধুনিকবাদ ও উত্তরাধুনিকবাদ জনবিমুখ, প্রগতির পরিপন্থী। তবে শিল্পের জন্য শিল্পচর্চায় এবং জ্ঞানের জন্য জ্ঞানচর্চায় তাঁদের উৎসাহ কম ছিল না। সেক্ষেত্রে কেউ কেউ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। গভীর দুঃখবোধের ও নিরঙ্কুশ নেতিবাদী চেতনার সুন্দর শিল্পিত প্রকাশ আছে ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান প্রভৃতি ভাষার কারো কারো কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে, নাটকে, চিত্রকলায়; কিন্তু সদর্থক (positive) দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা গঠনমূলক (constructive) প্রবণতা সেগুলোতে দুর্লভ। বাংলাভাষায় বিশ শতকের রবীন্দ্রোত্তর কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের একটি ধারার সৃষ্টিতে আধুনিকবাদ ও উত্তরাধুনিকবাদ চর্চার দৃষ্টান্ত আছে। জীবনানন্দ দাশ আধুনিকবাদী বলে পরিচিত। আর বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ বাংলাভাষায় আধুনিকবাদী
সাহিত্য-আন্দোলনের সংগঠক রূপে পরিচিত। রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় তাঁর বাসভবনে দুইবার আধুনিকবাদী তরুণদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। কিন্তু কোনো সমঝোতা হয়নি; শেষ পর্যন্তই রবীন্দ্রনাথ আধুনিকবাদের বিরোধী ছিলেন।

প্রত্যেক জাতির মধ্যেই রেনেসাঁস একটি সৃষ্টিশীল সার্বিক আবেগের, সেইসঙ্গে বিকাশশীল মূল্যবোধের ব্যাপার। রেনেসাঁসের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বুদ্ধিজীবীদের ব্যাপার, গণজাগরণ থেকে তা আলাদা। তবে রেনেসাঁস-সাধকেরা জনগণের কল্যাণেই চিন্তা করেন এবং তাঁদের চিন্তা গণজাগরণের সহায়ক হয়। দেশান্তর যাত্রা, দুঃসাহসী অভিযান – আমেরিকা, উত্তরমেরু ও দক্ষিণমেরু আবিষ্কার, অস্ট্রেলিয়ার ও অন্ধকারাচ্ছন্ন আফ্রিকার রহস্য-সন্ধান, এভারেস্ট বিজয়, মহাকাশ অভিযান ইত্যাদির মর্মেও কাজ করেছে রেনেসাঁসের উদ্দীপনা।

ইউরোপে মানববাদ, উপযোগবাদ, পুঁজিবাদ, ধনতন্ত্র, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদ ইত্যাদির উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে রেনেসাঁসের ধারা ধরেই। সেই ধারায়ই উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, প্রাণিবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, ভূতত্ত্ব, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন ও বিভিন্ন ধারার প্রযুক্তি। অলৌকিকতামুক্ত ইহলৌকিক-উপলব্ধিজাত মানববাদী শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টির মর্মেও কাজ করেছে জ্ঞাত কিংবা অজ্ঞাত রেনেসাঁসের উদ্দীপনা। প্রত্যেক জাতির মধ্যেই রেনেসাঁসকালে রেনেসাঁসবিরোধী শক্তিও সক্রিয় ছিল। রেনেসাঁসের ধারায়ও নেতৃত্ব নিয়ে, ক্ষমতা ও খ্যাতি-প্রতিপত্তি নিয়ে, আর্থিক স্বার্থ নিয়ে বিরোধ ছিল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৮) ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-৪৫) বিশালতার এবং আধুনিকবাদের ও উত্তরাধুনিকবাদের উদ্ভব ও বিকাশের পেছনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অপব্যবহারের বিরাট ভূমিকা ছিল। বৃহৎ শক্তিবর্গের উপনিবেশ বিস্তারের পেছনেও সহায়ক হয়েছিল উন্নত প্রযুক্তি। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সদ্ব্যবহারের যেমন অন্তহীন সুফল আছে, তেমনি এসবের অপব্যবহারেরও আছে অন্তহীন কুফল। সদ্ব্যবহার ও অপব্যবহার নির্ভর করে তাঁদের ওপর, যাঁরা এসবের মালিকানা দখল করেন কিংবা এগুলোর ওপর কর্তৃত্ব করেন। দার্শনিক-বৈজ্ঞানিকেরাও ভুল করেন। ১৯৪৫ সালে জাপান যখন আত্মসমর্পণের ঘোষণা দেয় তখন নাগাসাকি ও হিরোশিমায় যে আণবিক বোমা নিক্ষেপ করে, সেই বোমা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কোথায় পেয়েছিলেন? পেয়েছিলেন বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের কাছ থেকে। ওই সময়ে আইনস্টাইন হিটলার-শাসিত জার্মানি ছেড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে গিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে অত্যন্ত সমাদরের সঙ্গে গ্রহণ করেছিল। আণবিক বোমা তৈরিতে যুক্ত হয়ে যে-ভুল আইনস্টাইন করেছিলেন তার জন্য তিনি অনুতপ্ত ছিলেন। আবিষ্কারক-উদ্ভাবকেরা, দার্শনিক-বৈজ্ঞানিকেরা নিজেদের সৃষ্টির ওপর কর্তৃত্ব রক্ষা করতে পারেন না, কর্তৃত্ব দখল করে নেয় হীন-স্বার্থান্বেষীরা ও কায়েমি-স্বার্থবাদীরা। এই জায়গায়
দার্শনিক-বৈজ্ঞানিকেরা আজো অসহায়। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অপব্যবহার অনেক জাতিকে পরাধীন করেছে, দুনিয়াব্যাপী সামাজিক অবিচার বাড়িয়েছে, যুদ্ধ-বিগ্রহকে ভয়াবহ রূপ দিয়েছে, এবং অনেকের মধ্যে রুগ্ণ চেতনার ও হতাশার জন্ম দিয়েছে। রাজনৈতিক নেতৃত্বে শুভবুদ্ধির উপর অশুভবুদ্ধি প্রাধান্য বিস্তার করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেই প্রশ্ন উঠেছে – বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ? মানুষের কি কোনো ভবিষ্যৎ আছে? মানুষ কি যন্ত্রের দাস হয়ে যাচ্ছে?

প্রযুক্তি সাধারণত মানুষের বৈষয়িক সম্পদ বৃদ্ধির অবলম্বন হয়; কিন্তু বিজ্ঞান-প্রযুক্তির আবিষ্কার-উদ্ভাবন ও বৈষয়িক সম্পদ বৃদ্ধির সঙ্গে মানুষের মন-মানসিকতা ও নৈতিক চেতনা উন্নত হয় না, মানবিক গুণাবলিও বৃদ্ধি পায় না। ফলে সংকট সৃষ্টি হয়। রেনেসাঁসের সাধকেরা এ-সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছেন, কিন্তু পারেননি। আধুনিক যুগের মহান অগ্রগতির মধ্যে অনেক অনাচার ও দুরাচারও আছে। এসব থেকে মুক্তির জন্য দরকার মুক্তিপ্রয়াসীদের ও জনসাধারণের নৈতিক চেতনার উন্নতি সাধন এবং তার অনুকূলে আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক ব্যবস্থার সংস্কার-সাধন। এ ধারায় অগ্রসর হতে হলে প্রথমে দরকার মানবপ্রকৃতি বা মানুষের স্বভাব সম্পর্কে জানা। human nature পাশ্চাত্য দর্শনের একটি সমস্যা; বিষয়টিকে the nature of man এবং the concept of man বলেও আভিহিত করা হয়। যেসব সমস্যা সম্পর্কে অনেক জানার পরেও আরো জানার প্রয়োজন থাকে এবং প্রয়োজন  শেষ হয় না, সেগুলোই দর্শনের সমস্যা – দর্শনের আলোচ্য বিষয়।

৫. শিল্পবিপ্লবের অভিঘাতে সভ্যতা

ইউরোপের বিভিন্ন জাতির রেনেসাঁসের অগ্রগতির এক পর্যায়ে, আঠারো শতকের অন্তিমপর্বে, যখন বাষ্পীয় ইঞ্জিন তৈরি হয় এবং তা মানুষের ব্যবহারে আসে, তখন পশ্চিম-ইউরোপের দেশগুলোতে সূচিত হয় শিল্পবিপ্লব। শিল্পবিপ্লব গতিশীল – বিকাশশীল। সাম্প্রতিক কালকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কাল বলে অভিহিত করা হচ্ছে। শিল্পবিপ্লবের ইতিহাস ও বিভিন্ন পর্যায় সম্পর্কে পরিচ্ছন্ন ধারণা বিশেষজ্ঞদের থেকে লোকে জানতে চায়। চড়াই-উতরাই সংবলিত আঁকাবাঁকা পথপরিক্রমার মধ্য দিয়ে শিল্পবিপ্লবের ধারা বহমান আছে। আধুনিক বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও বৃহদায়তন শিল্পকারখানা রেনেসাঁসেরই প্রসূন।

ইতিহাসে প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের ধারণাকে বহাল রেখে, পরবর্তী সময়কে শিল্পবিপ্লবের পর্যায় অনুযায়ী বিভক্ত করা সমীচীন। ইতিহাসে যুগবিভাগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। বিভ্রান্তি যাতে না ঘটে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। যে অবস্থা চলছে তাতে প্রতিটি জাতির মধ্যেই প্রগতির প্রয়োজনে রেনেসাঁস ও গণজাগরণ নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা দরকার। অবস্থার উন্নতির জন্য ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তা করা ও কাজ করা অপরিহার্য।

এরই মধ্যে সংঘটিত হতে থাকে রাষ্ট্রবিপ্লব। সবচেয়ে প্রভাবশালী রাষ্ট্রবিপ্লব হলো – ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯), রুশ বিপ্লব (১৯১৭) ও চীন বিপ্লব (১৯৪৯)। প্রতিটি রাষ্ট্রবিপ্লবের পেছনেও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে
জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। আধুনিক যুগে যে-কোনো মতাদর্শের (creed) উদ্ভব ও বিকাশের পেছনেও কাজ করে জনগণের জীবনধারায় নতুন প্রযুক্তির অভিঘাত। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অভাবনীয় বিকাশ, তথ্যপ্রযুক্তি ও জীবপ্রযুক্তির বিপ্লব এবং সোভিয়েত  ইউনিয়নের  বিলোপ (১৯৯১) ইত্যাদির  ফলে  সৃষ্ট  বাস্তবতায় (১৯৮০-র দশক থেকে) পৃথিবীতে এখন বিরাজ করছে মানবীয় সবকিছুকে পুনর্গঠিত ও নবায়িত করার প্রয়োজন। দুনিয়াব্যাপী জনসাধারণ এখন ঘুমন্ত, প্রগতির  প্রয়োজনে সব জাতির ঘুমন্ত জনসাধারণকে জাগাতে হবে। সভ্যতার দিক দিয়ে এখন চলছে এক ‘সম্ভাবনাময় ক্রান্তিকাল’।

সভ্যতার যেমন বস্তুগত দিক আছে, তেমনি আছে মানসিক ও চিন্তাগত দিক। উৎপাদন ও বণ্টন, আইন-কানুন ও শাসনব্যবস্থা এবং উন্নত ভবিষ্যতের আশা ও আদর্শ হয়ে থাকে সভ্যতার অগ্রগতির অবলম্বন। আধুনিক যুগে ও উভয়কালে এর মধ্যে আরো থাকে রাজনীতি, রাজনৈতিক দল ও সরকার। এগুলোতে ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত ও ভালো-মন্দ থাকে। সভ্যতাকে বলা যায় সমাজে মন্দের সঙ্গে ভালোর সংগ্রাম, সেইসঙ্গে মানুষের পারস্পরিক সহযোগিতা, সুসম্পর্ক, উৎপাদনশীলতা, সৃষ্টিশীলতা ও সম্প্রীতির মনোভাব। সভ্যতার মর্মে ক্রিয়াশীল থাকে নৈতিক চেতনা – ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত ও কর্তব্য-অকর্তব্য সম্পর্কে ধারণা এবং বাস্তব-জীবনধারায় শ্রেয়োনীতির অনুশীলন। প্রতিটি সভ্যতারই আছে সূচনা, বিকাশ ও পরিণতি। এক সভ্যতার বিলয়ে দেখা দেয় নতুন আর এক সভ্যতা। মাঝখানে থাকে ক্রান্তিকাল। মানুষের ইতিহাসে কোনোটাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটে না, প্রযুক্তির নিয়মের সঙ্গে মানুষের ইচ্ছাশক্তি, চিন্তাশক্তি ও শ্রমশক্তি কাজ করে।

ইতিহাসে দেখা যায়, বিজ্ঞানের বড়রকমের অগ্রগতি ও জনজীবনে নতুন প্রযুক্তির ব্যাপক বিস্তার ঘটলে সভ্যতা সংকটে পড়ে। সংকটের কারণ – প্রচলিত মূল্যবোধ, আইন-কানুন ও বিধি-ব্যবস্থা নিয়ে পরিবর্তিত নতুন অবস্থার মধ্যে চলা যায় না। নতুন বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অভিঘাতে কখনো কখনো চলমান সভ্যতা বহুলাংশে ভেঙে পড়ে এবং নতুন সভ্যতা সৃষ্টির চাহিদা দেখা দেয়। প্রভাবশালী নতুন প্রযুক্তি যখন ব্যাপকভাবে মানুষের ব্যবহারে আসে, তখন তার অভিঘাতে মানুষের জীবনযাত্রা-প্রণালি ও সামাজিক সম্পর্ক লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। তাতে মানুষের মূল্যবোধ ও সংস্কার-বিশ্বাস বদলে যেতে থাকে। প্রথা-পদ্ধতি, রীতি-নীতি, আইন-কানুন, রাষ্ট্রব্যবস্থা – সবকিছুতেই পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে ওঠে। পরিবর্তনকে সর্বজনীন কল্যাণের ধারায় রূপ দেওয়ার জন্য দরকার হয় অনুকূল নেতৃত্ব।

প্রযুক্তি সব সময়েই মানুষকে শ্রমের দায় থেকে কম-বেশি মুক্তি দেয়, মানুষের আরাম-আয়েসের সুযোগ বাড়ায়, নতুন নতুন বৈষয়িক সম্পদ উৎপাদনের অবলম্বন হয়। বাস্তবে দেখা যায়, কয়েমি-স্বার্থবাদীরা ও হীন-স্বার্থান্বেষীরা বিজ্ঞান-প্রযুক্তি,
শিল্প-কারখানা, উৎপাদন ব্যবস্থা ও সম্পদের মালিকানা কিনে নেয়। সর্বজনীন কল্যাণের বিবেচনাকে যথোচিত গুরুত্ব না দিয়ে  শেষ পর্যন্ত তারা সবকিছুকে ব্যবহার করে কেবল নিজেদের স্বার্থে। সাধারণ মানুষ নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় ও অধিকার-প্রতিষ্ঠায় পিছিয়ে থাকে। অনেক সময়েই তারা নিজেদের নেতৃত্ব তৈরি করতে ও ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না। ঐক্যবদ্ধ হলে তারা শক্তিশালী হয়, অনৈক্যে দুর্বল থাকে। স্বল্পসংখ্যক প্রবল সবকিছু দখল করে নেয়, এবং তাদের দ্বারা বিপুলসংখ্যক দুর্বল শোষিত ও নির্যাতিত হয়; সমাজে বিভিন্ন শক্তির পারস্পরিক সম্পর্কে শিথিলতা (alienation/ estrangement) দেখা দেয়, বিরোধ বাড়ে, সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য ও সংহতি নষ্ট হয়। তখন সবকিছুকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে হয়। সমস্যার একদিকে থাকে প্রবল, অপরদিকে থাকে দুর্বল – কখনো কখনো দেখা যায়, একদিকে জালেম, অপরদিকে মজলুম। লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ায় এবং মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বে চীনে শ্রমিক-কৃষকদের কল্যাণে যে ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, তা টিকলো না কেন?

সব সমাজেই ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত ও ভালো-মন্দ সম্পর্কে কিছু ধারণা প্রচলিত থাকে। প্রথা-পদ্ধতি, রীতি-নীতি, আইন-কানুন সেসব ধারণার সঙ্গে কম-বেশি সংগতি রেখে প্রতিষ্ঠিত থাকে। নতুন প্রযুক্তি যখন সমাজে মানুষের
জীবনযাত্রা-প্রণালিতে প্রবেশ করে, তখন প্রয়োজন দেখা দেয় আইন-কানুন ও বিধি-ব্যবস্থার পুনর্গঠনের বা নবায়নের। এই পুনর্গঠন বা নবায়ন যথাসম্ভব সর্বজনীন কল্যাণে সাধিত হলে সভ্যতা বিকাশশীল থাকে, আর কেবল কায়েমি-স্বার্থবাদীদের জন্য করা হলে সভ্যতা সংকটাপন্ন ও বিকারপ্রাপ্ত হয়, আইনের শাসন দুর্বল হতে থাকে এবং সমাজে, রাষ্ট্রে আমূল পরিবর্তনের বাস্তবতা তৈরি হয়।

শিল্পবিপ্লবের ধারায় প্রযুক্তি ও শিল্প-কারখানার বিকাশ এবং সভ্যতা-সংস্কৃতির উপর কায়েমি-স্বার্থবাদীদের কর্তৃত্ব দেখে,
জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে সক্রিয় সৃষ্টিশীল ব্যক্তিরা উদ্বিগ্ন ও বিচলিত হন। ইতিহাসে দেখা যায়, সংকটকালে দার্শনিক-বৈজ্ঞানিকেরা মন-মানসিকতা এবং সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তন ও প্রগতি-সাধনের মাধ্যমে সংকটের সমাধান খুঁজেছেন; আর শিল্পী-সাহিত্যিকেরা মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশ হয়েছেন এবং নৈরাশ্যবাদী অবস্থান নিয়েছেন। অবশ্য দুই ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রমও ছিল। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি শিল্পোন্নত রাষ্ট্রে চিন্তার ও অনুভূতির, দর্শন-বিজ্ঞানের ও শিল্প-সাহিত্যের অগ্রযাত্রার ইতিহাসে এ ব্যাপারটি লক্ষ করা যায়। বিশ্বযুদ্ধ পর্বে আধুনিকবাদ ও উত্তরাধুনিকবাদের উদ্ভব ও বিকাশ ওইসব দেশেই ঘটেছে এবং ক্রমে এগুলোকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সব দেশে, সব রাজধানীতে, সব জাতির মধ্যে।

গত কয়েকশো বছর ধরে চিন্তা ও কর্মের ক্ষেত্রে মানবজাতির উপর প্রাধান্য বিস্তার করে আছে গ্রেকো-রোমান-ইউরো-আমেরিকান সভ্যতা। সেজন্য বাংলাদেশে দেখা যায়, ওই সভ্যতার ধারা ধরে চলার চিন্তা ও চেষ্টা। মনে হয়, প্রত্যেক জাতির কর্তব্য নিজের ন্যায়স্বার্থ বিবেচনায় রেখে সর্বজনীন কল্যাণে ‘জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদ’ অবলম্বন করে চিন্তা ও কাজ করা। জাতীয় স্বার্থ বিবেচনার সময় জাতির অন্তর্গত সব মানুষের স্বার্থ বিবেচনা করতে হবে। সর্বজনীন কল্যাণ আর প্রবলদের স্বার্থ – দুটোর মধ্যে বিরোধ আছে – বিরোধ থাকবে। তবে বিরোধ কমানো সম্ভব। পর্যায়ক্রমে সেটাই করতে হবে।

শোষণ-পীড়ন-প্রতারণা, অন্যায়-অবিচার, সহিংসতা, উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ, আধিপত্যবাদ, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও রাষ্ট্রবিপ্লবের পটভূমিতে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অপব্যবহারের ফলে সৃষ্ট সমস্যা চিন্তক ও কর্মীদের এবং রাজনীতিবিদদের যতটা মনোযোগ দাবি করে, ততটা মনোযোগ পায়নি। সংকটকালে নৈতিক উন্নতির অপরিহার্যতার কথা বারবার কেবল বলা হয়েছে, কিছু করা হয়নি। চেষ্টা করতে হবে, ক্রমাগত চেষ্টা করলে সফল হওয়া যাবে, হাল ছেড়ে দিলে যাত্রা খারাপের দিকে হবে।

৬. পুঁজিবাদ ও মার্কসবাদ

ইউরোপে কোনো কোনো জাতির সভ্যতার ধারায় প্রথম শিল্পবিপ্লবের অভিঘাতে উদ্ভব ঘটে সমাজতান্ত্রিক চিন্তার এবং তার অনতিপরে মার্কসবাদের। সময়টা ছিল গণজাগরণের ও বিপ্লবী উত্তেজনার। কমিউনিস্ট পার্টির ইশতিহার প্রথম প্রকাশিত হয় লন্ডনে, জার্মান ভাষায়, ১৮৪৮ সালে। তার পরেই এটি ইউরোপের অন্তত বারোটি ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করা হয়। সকল জাতির চিন্তাশীলদের বিরাট অংশ – বিশেষ করে ছাত্র-তরুণেরা – মার্কসবাদ, রুশ বিপ্লব (১৯১৭) ও চীন বিপ্লবের (১৯৪৯) ধারা ধরে সংকটের সমাধান ও মানবজাতির সমৃদ্ধিমান প্রগতিশীল ভবিষ্যৎ আশা করে চলছিলেন। তাঁরা আশা করেছিলেন, বিভিন্ন দেশ-কালে অনুশীলনের মধ্য দিয়ে মার্কসবাদীদের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে সামনে চলা যাবে। কার্যক্ষেত্রে মাকর্সবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদকে পরিণত করা হয়েছিল ধর্মের মতো একটি ব্যাপারে। এর ফল ভালো হয়নি। রুশ বিপ্লবের পরে পৌনে এক শতাব্দী পার হতে না হতেই সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত হয়ে গেছে (১৯৯১), তারপরে চীন পর্যায়ক্রমে মার্কসবাদ ও মাও সে তুংয়ের চিন্তাধারা থেকে সরে যাচ্ছে। শ্রেণিসংগ্রাম ও শ্রমিক শ্রেণির একনায়কত্বের দ্বারা মানবজাতির মুক্তি ও প্রগতির মতবাদ এখন আর আবেদন সৃষ্টি করে না। ‘শ্রমিক শ্রেণির একনায়কত্ব’ প্রতিষ্ঠার ধারণা নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন প্রভৃতি রাষ্ট্র বেশিদূর এগোতে পারেনি। কেন পারেনি?

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৮) আরম্ভ হওয়ার দুই দশক আগে থেকে, ইউরোপ-আমেরিকায় রেনেসাঁসের ধারা ক্ষীণ হয়ে চলার ও শিল্প-সাহিত্যে আধুনিকবাদের উদ্ভবের সময় (১৮৯০-এর দশক) থেকে মানবজাতি গভীর সভ্যতার সংকটে নিপতিত হয়েছে। তবে এর মধ্যে অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে – কিছু সমস্যার সমাধান হয়েছে এবং কিছু নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে। মার্কসবাদীরা মার্কসবাদকে অনন্ত-সম্ভাবনাময় মনে করেছেন। কিন্তু মার্কসবাদের মহান সব অবদান সত্ত্বেও মার্কসবাদীরা মার্কসবাদ নিয়ে বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেননি। মনে হয়, মানুষের স্বরূপ সম্পর্কে মার্কসবাদীদের ধারণা বাস্তবসম্মত ছিল না। মানুষের মনের দিকটাতে তাঁরা অল্পই গুরুত্ব দিয়েছিলেন। মার্কসবাদকে তাঁরা ধর্মের মতো রূপ দিয়েছিলেন। বিশ শতকের আশির দশক থেকে তথ্যপ্রযুক্তি ও জীবপ্রযুক্তির বিপ্লব ও বিস্তার এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলোপ (১৯৯১) সংকটকে গভীরতর করেছে। জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, জি সেভেন, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর কর্তৃত্বে পরিচালিত মুক্তবাজার অর্থনীতি, পুঁজিবাদ, ধনতন্ত্র, বহুত্ববাদ ও অবাধ-প্রতিযোগিতাবাদ অবলম্বন করে বিশ্বায়নের নামে যে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে, তাতে সভ্যতার সংকট ঘনীভূত হচ্ছে, দুনিয়াব্যাপী সাধারণ মানুষ – জনগণ এখন মনোবলহারা (demoralized)। দুনিয়াব্যাপী নব্বই শতাংশ মানুষ এখন নিজেদের অবস্থার উন্নতি আশা করে না। মানুষ জেনারেশনের পর জেনারেশনের সম্মিলিত চেষ্টায় পৃথিবীকেই স্বর্গে উন্নীত করতে পারবে, এ-বিশ্বাস পৃথিবীর কোথাও কারো মধ্যেই আর খুঁজে পাওয়া যায় না।

কার্যক্ষেত্রে দেখা যায়, জাতিসংঘ কাজ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ও তার সহযোগী বৃহৎ-শক্তিবর্গের পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পরে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গ মানবজাতিকে যে ধারায় পরিচালিত করে চলছে, তার দ্বারা সভ্যতার সংকট কাটছে না – কাটবে না। যেভাবে দুনিয়াটাকে চালানো হচ্ছে, তাতে অন্যায়-অবিচার, যুদ্ধ-বিগ্রহ, নারীনির্যাতন  বেড়ে চলছে। বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনাও বাড়ছে। মানবজাতিকে পর্যায়ক্রমে যুদ্ধমুক্ত করতে হবে। যুদ্ধ, যুদ্ধজোট, যুদ্ধের অস্ত্র উৎপাদন ও যুদ্ধাস্ত্রের বেচাকেনা বন্ধ করতে হবে। এর জন্য দুনিয়াব্যাপী বিবেকবান চিন্তাশীল ব্যক্তিদের এবং জনগণের যা-কিছু করা দরকার, সবই করতে হবে। কায়েমি-স্বার্থবাদীদের ও হীন-স্বার্থান্বেষীদের বাইরে অবস্থান নিয়ে, প্রতিক্রিয়ার মোকাবিলা করে করে তাঁদের সামনে চলতে হবে। সংঘশক্তি দরকার, রেনেসাঁস দরকার, গণজাগরণ দরকার, উদ্দেশ্যনির্ণয় ও উদ্দেশ্যনিষ্ঠা দরকার। চিন্তার সঙ্গে কাজ দরকার, উন্নত-চরিত্রের নতুন নেতৃত্ব ও নতুন রাজনীতি দরকার।

৭. মানুষের নৈতিক চেতনার ও আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক ব্যবস্থাদির উন্নতি

স্বামী বিবেকানন্দ, মহাত্মা গান্ধি, শ্রীঅরবিন্দ, সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণণ এবং বিভিন্ন জাতির আরো কয়েকজন মনীষী মানুষের নৈতিক চেতনার যে জাগরণ এবং যে নতুন মানবসমাজ গড়ে তোলার কথা ভেবেছেন, পরিপূর্ণ গুরুত্ব দিয়ে সেই চিন্তাকে বাস্তবসম্মত, বিজ্ঞানসম্মত, কার্যোপযোগী রূপ দিতে হবে, এবং সময়ে সময়ে শ্রেয়োনীতি নির্ধারণ করে প্রত্যেক জাতির রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে তা কার্যকর করে চলতে হবে। নৈতিক চিন্তাকে হতে হবে বিজ্ঞানসম্মত ও বাস্তবানুগ। ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন জাতির মহান সব চিন্তাধারার সঙ্গে এশিয়ার বিভিন্ন জাতির মহান সব চিন্তাধারার সংশ্লেষণ (synthesis) ঘটাতে হবে। ইতিহাসের ধারায় সভ্যতার বিকাশে ধর্মের ভূমিকাকে বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। মানুষের ধর্মবোধকে সরাসরি আঘাত করা উচিত হবে না। মনে হয়, ধর্মপ্রসঙ্গে বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের বিচার-বিবেচনা ও সিদ্ধান্ত বাস্তবসম্মত, বিজ্ঞানসম্মত, গুরুত্বপূর্ণ ও প্রগতির সহায়ক। ধর্ম-ব্যবসায়ীদের স্বরূপ উন্মোচন করতে হবে। গণতন্ত্রী ও সমাজতন্ত্রীদের কার্যকলাপের মূল্যবিচার অপরিহার্য। প্রত্যেক জাতির সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্য এবং আত্মবিকাশের সুযোগ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের দ্বারা নিশ্চিত রাখতে হবে। শিল্প-সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির নবায়ন ঘটাতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নতির কর্মসূচির মধ্যে নৈতিক উন্নতির বাস্তবসম্মত কর্মসূচি যুক্ত রাখতে হবে।

বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার আধিপত্যবাদী লক্ষ্য নিয়ে স্ব-স্বার্থে মহাত্মা গান্ধির অহিংসা-বিষয়ক কিছু উক্তি প্রচার করে। কিন্তু সে-রাষ্ট্রের শাসকেরা চলছে সহিংস নীতি নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবাজ, যুক্তরাষ্ট্র শান্তির শত্রু, যুক্তরাষ্ট্র গান্ধির সত্যাগ্রহ, অহিংসা, সর্বোদয়, অন্যায়কারীদের প্রতি অসহযোগ ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে আস্থাহীন। স্বার্থসন্ধানে তার আচরণ ভয়ংকর। বিশ^শান্তি ও প্রগতির প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা কমানো অপরিহার্য।

প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের শ্রেষ্ঠ মনীষীদের চিন্তারাজিকে প্রয়োজন অনুযায়ী বিকশিত করে, কল্যাণকর বাস্তবসম্মত বিজ্ঞানসম্মত রূপ দিয়ে, গোটা মানবজাতির কল্যাণে কাজে লাগাতে হবে। নৈতিক বিবেচনাকে সব সময় রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক বিবেচনার মর্মে স্থান দিতে হবে। উপযোগবাদী বিজ্ঞানসম্মত নীতিবিদ্যা প্রণয়ন করতে হবে। শোষণ-পীড়ন-প্রতারণা থেকে পর্যায়ক্রমে মুক্তির ও উন্নতির এটাই উপায়।

মানুষের স্বভাব ও আচরণ এমন যে, কোনো জাতি বা জনসমষ্টি নৈতিক দিক দিয়ে একবার জয়ী হলে তা চিরকালের বিজয় হয় না; সেজন্য মানুষের সমাজে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম ক্রমাগত চালিয়ে যেতে হবে। বাস্তবে দেখা যায়,
ন্যায়-প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে ধারা জয়ী হয়, সেই ধারা ক্ষমতাসীন হয়ে অন্যায়কারী হয়ে উঠতে থাকে। শোষণমুক্ত, হিংসামুক্ত, অন্যায়মুক্ত সমৃদ্ধিমান সমাজ প্রতিষ্ঠা স্বল্প সময়ের মধ্যে করা যাবে না, তা এক অন্তহীন প্রচেষ্টার ব্যাপার।

মানুষের স্বরূপ যতটা সম্ভব বুঝতে হবে এবং সম্মিলিত জীবনধারায় সংঘশক্তি অবলম্বন করে মানবপ্রকৃতিকে পর্যায়ক্রমে উন্নত করতে হবে। সভ্যতার সংকট কাটিয়ে প্রগতির ধারায় উত্তীর্ণ হতে হলে রাষ্ট্রীয় অথনৈতিক উন্নতির প্রচেষ্টার সঙ্গে নৈতিক উন্নতির প্রচেষ্টাকে অবিচ্ছেদ্য রূপে যুক্ত রাখতে হবে। কায়েমি-স্বার্থবাদীরা নানাভাবে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করে। আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক উন্নতির কর্মসূচির মধ্যে নৈতিক উন্নতির কর্মসূচি যুক্ত রাখা হলে তার ফল অবশ্যই ভালো হবে। 

৮. ঘুমন্ত জনসাধারণকে জাগাতে হবে

গ্রেকো-রোমান-ইউরো-আমেরিকান চিন্তার এবং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মের সুস্পষ্ট দুটি ধারা লক্ষ করা :

এক ধারায় দেখা যায় সর্বজনীন কল্যাণচিন্তা, মহান আবিষ্কার-উদ্ভাবন, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ইতিহাস, শিল্প-সাহিত্য, দর্শন ও মতাদর্শ (creed)। এ ধারা সৃষ্টিশীল, উন্নতিশীল বা প্রগতিশীল, সব জাতির জন্য কল্যাণকর। প্রত্যেক জাতির কর্তব্য নিজের প্রয়োজন ও সামর্থ্য অনুযায়ী অন্য জাতি থেকে এগুলো গ্রহণ করা।

অপর ধারায় দেখা যায় কায়েমি স্বার্থবাদ ও প্রতিক্রিয়াশীলতা – উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ, ভোগবাদ ও সুবিধাবাদ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিছু আগে থেকে এই দ্বিতীয় ধারার চিন্তক ও কর্মীরা পর্যায়ক্রমে শক্তিশালী হয়েছে এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব কেন্দ্রে কর্তৃত্ব দখল করে আছে। এই শক্তিকে বলা যায় অপশক্তি। আজকের অত্যুন্নত নতুন প্রযুক্তির দুনিয়ায়, প্রায় নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব দখল করে আছে এই অপশক্তি। অপশক্তিকে পরাজিত রাখার জন্য দরকার সারা দুনিয়ার ন্যায়কামী জনগণের ঐক্য ও অন্তহীন সংগ্রাম। এর জন্য নতুন চিন্তা, নতুন রাজনৈতিক দল ও নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে হবে। বাংলাদেশে এবং আরো শতাধিক রাষ্ট্রে জনগণের মধ্যে এখন বিরাজ করছে রাজনীতির প্রতি, রাজনৈতিক দলের প্রতি এবং নেতাদের প্রতি আস্থাহীনতা ও বিরূপ মনোভাব। এসব রাষ্ট্র কীভাবে উন্নতি করবে? বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভবিষ্যৎ কী?

সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর যে-বাস্তবতা সৃষ্টি হয়েছে, তাতে দুনিয়াব্যাপী সব রাষ্ট্রে সাধারণ মানুষ – জনগণ – মনোবলহারা (demoralized), বিবেকবান চিন্তাশীল ব্যক্তিরা, সর্বত্র কোণঠাসা, প্রায় কোনো রাষ্ট্রেই প্রচারমাধ্যম প্রগতির অনুকূলে নেই। সর্বত্রই  দেখা যাচ্ছে, প্রচারমাধ্যমের মালিকানা ও কর্তৃত্ব কায়েমি-স্বার্থবাদীদের দখলে। দুনিয়াব্যাপী প্রযুক্তির অনেক সদ্ব্যবহার হচ্ছে, তাতে মানুষের অনেক উপকার হচ্ছে। পাশাপাশি অপব্যবহারও অনেক হচ্ছে। অপব্যবহারের কুফলও মানবজাতি ভোগ করছে। অন্যায়-অবিচারের শক্তিকে প্রবল দেখে সর্বত্র জনগণ পরিবর্তনবিমুখ, প্রগতিবিমুখ – হতবুদ্ধি।
যে-কোনো পরিস্থিতিতে প্রায় সকলেই ধরে নেন যে, অন্যায়-অবিচার, জুলুম-জবরদস্তি, বঞ্চনা-প্রতারণা, নারীনির্যাতন, হত্যা-আত্মহত্যার কোনো প্রতিকার নেই – দুনিয়া এসব নিয়েই চলছে – চলবে।

প্রায় কোনো রাষ্ট্রেই এখন জনগণের কোনো রাজনৈতিক দল নেই। চীন কি এমন কিছু করছে যা সকল রাষ্ট্রের অনুসরণীয়? চীন থেকে কখনো কখনো বলা হচ্ছে, উন্নত নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। চীনের এই বক্তব্য সব সময়েই রাশিয়া সমর্থন করে। কিন্তু বিশ্ববাসীর সামনে নতুন বিশ্বব্যবস্থার সম্ভাব্য রূপ ও প্রকৃতি নিয়ে তাঁদের থেকে কিছুই বলা হচ্ছে না। ন্যায়ের পথে চলার জন্য প্রত্যেক রাষ্ট্রেই জনগণের রাজনৈতিক দল দরকার – জনগণের ভেতর থেকে, জনগণের দ্বারা, জনগণের কল্যাণে গঠিত রাজনৈতিক দল। সে কাজ কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। দল নেই যার, বল নেই তার। অবশ্য খারাপ দলের দৃষ্টান্তেরও অভাব নেই। আমরা ‘উদার গণতন্ত্র’ চাই না, আমরা চাই ‘সর্বজনীন গণতন্ত্র’। সর্বজনীন কল্যাণের জন্য ভালো রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্ব অপরিহার্য। তার জন্য সব রাষ্ট্রেই বিবেকবান চিন্তাশীল ব্যক্তিদের নতুন চিন্তা ও কাজ আরম্ভ করা দরকার।

রাশিয়ার উচিত ১৯১৭ সালের বিপ্লব থেকে আজ পর্যন্ত কালের তাদের অভিজ্ঞতার ইতিহাস বই লিখে বিশ্ববাসীকে জানানো। চীনের উচিত ১৯৪৮ সালের বিপ্লব থেকে আজ পর্যন্ত সময়ের তাদের অভিজ্ঞতার ইতিহাস বই লিখে বিশ্ববাসীকে জানানো। লেনিনের, মাও সে তুংয়ের এ-বিষয়ে সচেতনতা ও কাজ ছিল।

ফরাসি বিপ্লব থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তি (১৭৮৯-১৯৯১) পর্যন্ত দুশো দু-বছর মানুষ ছিল পরিবর্তন-উন্মুখ; এখন মানুষ পরিবর্তন-বিমুখ। পরিবর্তন-উন্মুখতা সব রাষ্ট্রে একসময়ে দেখা দেয়নি। জনমনে তখন উন্নত ভবিষ্যতের আশা ছিল, স্বপ্ন ছিল, প্রগতির উপলব্ধি ছিল। সংকটের গভীর উপলব্ধি ও সংকট অতিক্রম করার প্রবল আকাঙ্ক্ষা – কোনোটাই এখন কোনো জাতির মধ্যে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। মানুষের ওপর মানুষের আস্থা একেবারেই কমে গেছে। দুর্বলরা চলছে প্রবলদের জুলুম-জবরদস্তি মেনে নিয়ে। দুর্বল মানুষ দল গঠন করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রবল হওয়ার চিন্তা ও চেষ্টা করছে না। নেতৃত্ব আশা করছে, কিন্তু নেতৃত্ব তৈরি করার দায়িত্ব গ্রহণে এগোচ্ছে না। মানুষ কি কেবল খেয়ে-পরে, সব-রকমের
জুলুম-জবরদস্তি, অন্যায়-অবিচার, মিথ্যা ও প্রতারণা সহ্য করে, নীরবে জীবন যাপন করে চলবে? নতুন প্রযুক্তির পরিমণ্ডলে মানুষ কি তার আচরণ ও স্বভাবকে উন্নত করতে চেষ্টা করবে না? যাঁদের মধ্যে সংগ্রামী স্পৃহা থাকার কথা, তাঁদের মধ্যে তা দেখা যাচ্ছে না। অধিকাংশ মানুষ চলছে যন্ত্রের গতিতে, বিচার-বিবেচনা কমই করছে। বহুল প্রচারিত চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কালে মানুষ কি যন্ত্রের দাস হয়ে পড়বে?

বিভিন্ন জাতির উত্থান-পতনের ইতিহাস স্মরণ করে বলা যায়, অবস্থা এ রকম থাকবে না, আবার মানুষ পরিবর্তনে আগ্রহী হবে – একসময়ে পরিবর্তনের জন্য উন্মুখ হয়ে উঠবে। অপশক্তির নেতৃত্ব কেন মানুষ মেনে নিচ্ছে? শোষণ-পীড়ন-প্রতারণা ও বঞ্চনা সহ্য করে কতকাল মানুষ প্রতিবাদহীন ও অসংগঠিত থাকবে? যাঁরা জনগণের হয়ে রাজনীতি করবেন তাঁদের অবশ্যই মানুষের স্বভাব সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করতে হবে। মানুষের জন্য উন্নত অবস্থা সৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। মানুষে চাইলে, চেষ্টা করলে, অবশ্যই নিজেকে এবং নিজের অবস্থাকে উন্নত করতে পারবে। প্রগতির সম্ভাবনা অন্তহীন। প্রগতির ভাবধারাকে উচ্চে স্থান দিতে হবে। প্রগতিপ্রয়াসী শক্তিকে চিরজয়ী থাকতে হলে প্রতিক্রিয়াশীলদের সঙ্গে নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। একবারের বিজয় চিরকালের বিজয় নয়, একবারের পরাজয়ও চিরকালের পরাজয় নয়।

মানুষের মধ্যে দুঃখ, বঞ্চনা, ভয়, ঘৃণা ও অশান্তি সৃষ্টির শক্তি যেমন আছে, তেমনি আছে সম্প্রীতিময়, সুখকর, আশাপ্রদ, সমৃদ্ধ-সুন্দর, উন্নতিশীল অবস্থা সৃষ্টির শক্তিও। মানুষ নিজেকে এবং নিজের পরিবেশকে ক্রমাগত উন্নত করতে পারে। মানবীয় শুভকর শক্তিটিকে আজো ভালো করে কাজে লাগানো হয়নি। তবে যেটুকু হয়েছে তা থেকে বোঝা যায়, পরিকল্পিত নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থায় মানুষের জীবন ও পরিবেশ কত উন্নত ও সুন্দর হতে পারে। যদি মানুষ সম্মিলিতভাবে মানবীয় গুণাবলিকে পূর্ণমাত্রায় বিকশিত করে, সেইসঙ্গে পরিবেশকে উন্নত করতে চেষ্টা করে, তাহলে ভবিষ্যতে মানুষ এমন এক উচ্চতায় পৌঁছবে যা আজ আমরা কল্পনাও করতে পারি না। যে উন্নত রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থার কল্পনা আমরা করি, তাতে দারিদ্র্য, ভয়, রোগ-শোক, অন্যায়-অবিচার, অপ্রেম ও নিষ্ঠুরতা পর্যায়ক্রমে লোপ পাবে এবং সম্প্রীতি ও সহযোগিতা আর সৃষ্টিশীলতা ও প্রগতিশীলতা অন্ধকার রাত্রির অবসান ঘটাবে। বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে মানুষের ভবিষ্যৎ কেমন হবে তা মানুষের ওপরেই নির্ভর করে।

৯. মানুষ ও তার পরিবেশ বদলে গেছে : সামনে কী হবে

গত চার দশকের মধ্যে নবআবিষ্কৃত তথ্যপ্রযুক্তি, জীবপ্রযুক্তি ও অন্যান্য প্রযুক্তির অভিঘাতে পৃথিবীর সর্বত্র মানুষের পরিবেশ ও মানুষ বদলে গেছে, এবং পরিবর্তনের এই ধারা চলমান আছে। এতে দেখা যাচ্ছে, মানুষের নৈতিক চেতনা নিম্নগামী। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর কর্তাব্যক্তিদের কর্মকাণ্ড লক্ষ করলে কী দেখা যায়? বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উন্নতি হলেও এবং অর্থসম্পদ বৃদ্ধি পেলেও মানুষের মন উন্নত হয়নি। নৈতিক উন্নতির জন্য জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় পরিসরে পরিপূর্ণ সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন দরকার। গোটা মানবপ্রজাতিকে সামনে নিয়ে রাষ্ট্রসংঘকে এই ধারার কাজ করতে হবে। পরিকল্পনা তৈরি করার মতো অনেক লোক অনেক দেশে আছেন, কিন্তু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার লোক কোথায়?

বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা দেখে এবং  ক্ষমতাবান ও শক্তিমানদের বেপরোয়া আচরণ লক্ষ করে নানা দেশে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, মানুষের চেতনা থেকে ন্যায়-অন্যায়ের বোধ কি উবে যাচ্ছে? যারা কায়েমি-স্বার্থবাদী ও হীন-স্বার্থান্বেষী, প্রশ্ন তাদের নিয়ে নয়, গণজাগরণের ভয়ে সব সময় তারা ভীত থাকে; যারা সাধারণ মানুষ, যারা সংখ্যায় মোট জনসংখ্যার নব্বই শতাংশ, প্রশ্ন তাদের নিয়ে। বিভিন্ন জাতির ভেতর থেকে বিবেকবান, চিন্তাশীল, সত্যসন্ধ, সত্যনিষ্ঠ কিছু ব্যক্তি কি আত্মপ্রকাশ করবেন না? গণজাগরণ কীভাবে ঘটবে? সমাজে মানবিক গুণাবলির কদর না থাকলে, মনুষ্যত্ব-প্রয়াসীদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ না থাকলে, জনজীবন উন্নতিশীল হবে কীভাবে?

চৌদ্দ শতকে ইতালিতে রেনেসাঁসের সূচনা থেকে পরবর্তী ছয়শো বছরব্যাপী বিভিন্ন জাতির যে বিকাশ, সাধারণভাবে তা ছিল প্রগতির ধারায়। এতে পশ্চিম-ইউরোপের কয়েকটি জাতি ছিল অগ্রযাত্রী। ধীরে ধীরে অন্য সব জাতি, তাদের থেকে
জ্ঞান-বিজ্ঞান গ্রহণ করে, উন্নত হয়েছে। ওই সময়টাই আধুনিক সভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশের কাল। আধুনিক যুগের মর্মে নানা প্রবণতার মধ্যে প্রধান ছিল রেনেসাঁসের উদ্দীপনা, যা এখন নিষ্প্রভ। তবে আঠারো শতকের শেষ দিক থেকে শিল্পবিপ্লবের ধারা নানা পর্যায় অতিক্রম করে চলমান আছে। ক্রমাগত নতুন প্রযুক্তি সামনে আসছে। শ্রমশক্তি দ্বারা ব্যবহৃত এসব প্রযুক্তির ফলে উৎপাদন অনেক বেড়েছে এবং বৈষয়িক সম্পদে মানবজাতি আজ সম্পন্ন। কিন্তু সবকিছু কিছু লোকের দখলে পুঞ্জীভূত। মানুষে মানুষে এবং জাতিতে জাতিতে বৈষম্য বেড়েছে এবং বাড়ছে।

এটাও উল্লেখ্য যে, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা এবং বিভিন্ন ভূভাগের প্রান্তিক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীসমূহ নতুন প্রযুক্তি ও নতুন সভ্যতা আয়ত্ত করে মানবজাতির মূল ধারায় শামিল থাকতে পারেনি। প্রবল জাতিগুলো নানা কৌশলে তাদের দাবিয়ে রেখেছে এবং রাখছে। তারা নিজেরাও নিজেদেরকে শামুকের মতো, ঝিনুকের মতো নিজেদের মধ্যে গুটিয়ে রাখছে। পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিগুলো তাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাদেরকে চিরকালের জন্য আদিবাসী করে রাখার নীতি গ্রহণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার রেড ইন্ডিয়ানদের এবং অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের অবস্থা দেখলে এটা বোঝা যায়। জাতিসংঘের – ইউনেস্কোর – আদিবাসী-নীতি অবিলম্বে পরিবর্তন করা দরকার। বিলীয়মান মাতৃভাষাসমূহকে রক্ষা করা যাবে না। বিকাশশীল মাতৃভাষাসমূহের প্রতিটির বিকাশের সম্ভাবনা অন্তহীন। তাদের বিকাশের সুযোগ অব্যাহত রাখতে হবে। আদিবাসীদের মানবজাতির মূলধারায় আসতে দিতে হবে। আদিবাসীদের উন্নতির জন্য তাদের নিজেদের চিন্তা-চেতনার উন্নতি দরকার – নিজেদেরকে নিজেদের মধ্যে গুটিয়ে রাখার মনোভাব তাদের উন্নতির মূল অন্তরায়। যারা তাদেরকে চিরকালের জন্য আদিবাসী করে রাখতে চায়, তারা চায় না যে তাদের শিক্ষা-দীক্ষা ও চিন্তা-চেতনা উন্নত হোক। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসমূহের উন্নতির জন্য সরকারকেই কাজ করতে হবে। রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ কী? তারা কি আরাকানে ফিরে যেতে পারবে? মিয়ানমারে সামরিক শক্তি মানবতাবিরোধী যুদ্ধে লিপ্ত।

রেনেসাঁসের কালে, মানুষের উপলব্ধিতে বর্তমান যতই সমস্যাসংকুল হোক, মানুষ আশা করেছে উন্নততর ভবিষ্যৎ। তখন শাসকদের প্রগতির পরিপন্থী কার্যক্রম ও হীন-স্বার্থান্বেষীদের কার্যক্রম দ্বারা প্রগতির ধারা বাধাগ্রস্ত হলেও বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে, ক্ষয়-ক্ষতি অতিক্রম করে সে-ধারা বেগবান হয়েছে। প্রগতি সাধিত হয়েছে প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে মোকাবিলার মধ্য দিয়ে। রক্ষণশীলেরা পরিবর্তনের ধারা লক্ষ করে ক্রমে প্রগতিশীলদের অনুসারী হয়েছে। অত্যুন্নত নতুন প্রযুক্তির অভিঘাতে বাস্তবতা এখন এমন এক রূপ নিয়েছে যে, এখন গোটা পৃথিবীতেই, অন্তত রাজনীতির ক্ষেত্রে, কোনো প্রগতিপ্রয়াসী শক্তির সন্ধান পাওয়া যায় না। প্রগতিশীল বলে যাঁরা কখনো কখনো আত্মপরিচয় দেন, তলিয়ে দেখলেই দেখা যায় তাঁরা প্রগতিশীল নন, সুবিধাবাদী। কেবল ধর্মের বিরোধিতা করার, আর উসকানিমূলক বক্তব্য প্রচার করে হইচই সৃষ্টির মধ্যে তো প্রগতির কিছুই থাকে না! বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, গত চার দশক ধরে কথিত ধর্মপন্থীরা যত আক্রান্ত হয়েছে, ততই সক্রিয় হয়েছে এবং বেড়েছে। গণতন্ত্রী ও সমাজতন্ত্রীদের আদর্শগত ও সাংগঠনিক দুর্বলতাই এর কারণ। লক্ষণীয় যে, ধর্মপন্থীদের কোনো কোনো অংশেও এখন জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির চর্চা আছে। আবার মনে হয় মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের উত্থানের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সজ্ঞান-সচেতন-সক্রিয় পরিকল্পিত ভূমিকা ছিল, আছে। বিবিসি রেডিও ও টেলিভিশন সুকৌশলে পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গের স্বার্থে প্রচার চালিয়েছে। বিবিসি রেডিও ও টেলিভিশন, ভয়েস অফ আমেরিকা ও সিএনএন মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যত প্রচার চালিয়েছে, মৌলবাদী ও জঙ্গিবাদী শক্তি ততই বেড়েছে।

রেনেসাঁসের কালে পৃথিবীব্যাপী ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও জাতি আত্মশক্তিতে বিশ্বাসী ছিল। মানুষ অপরিসীম শক্তি ও অন্তহীন সম্ভাবনার অধিকারী – এই বোধ তখন মানবজাতির মধ্য থেকে যেভাবে অভিব্যক্ত হয়েছে, বিশ্বযুদ্ধের কালে এসে তা আর বজায় থাকেনি। মানুষ তার ইচ্ছাশক্তি, চিন্তাশক্তি ও শ্রমশক্তির বলে ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা দ্বারা মানবীয় ও প্রাকৃতিক সব কিছুকে মনের মতো করে পুনর্গঠিত করে নিতে পারবে, পৃথিবীকে ঋদ্ধিমান ও সম্প্রীতিময় করে তুলবে – এ-বিশ্বাস তখন মানুষের মনে দৃঢ়মূল ছিল। একজনে না পারলে বহুজন মিলে পারবে, এক জেনারেশনে না পারলে জেনারেশনের পর জেনারেশনের চেষ্টায় পারবে – মানুষের শক্তি-সামর্থ্যরে প্রতি মানুষের এ-বিশ্বাস ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল। সাধারণভাবে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সদর্থক, আশাবাদী – খারাপের চেয়ে ভালোটাকে মানুষ বেশি গুরুত্ব দিত। পরাজিত মানসিকতা ও নৈরাশ্যবাদ খুব কম লোকের মধ্যে ছিল। শ্রমজীবী ও সাধারণ মানুষ তখন জাগ্রত ছিল, এবং প্রতিটি সাধারণ মানুষকে তখন দেখা হতো অন্তহীন-সম্ভাবনাময় সত্তা রূপে। ভবিষ্যৎ নিয়ে মানুষের মধ্যে ছিল বাস্তবভিত্তিক, বাস্তবায়নসম্ভব, অন্তহীন আশা ও স্বপ্ন-কল্পনা। মানুষের সামনে বাস্তব জীবন, বাস্তব সমাজ, বাস্তব রাষ্ট্র ও বাস্তব পৃথিবীর ঊর্ধ্বে ছিল ভবিষ্যতের অভিপ্রেত কল্পিত আদর্শ-জীবন, কল্পিত আদর্শ-সমাজ, কল্পিত আদর্শ-রাষ্ট্র ও কল্পিত আদর্শ-পৃথিবী। মহান লক্ষ্য নিয়ে তখন মানুষ সংঘশক্তি গড়ে তুলতে পারত। ত্রুটি-বিচ্যুতি, অপরাধ-অধর্ম থাকা সত্ত্বেও তখন আদর্শ উপলব্ধির ও বাস্তবায়নের জন্য সাধনা ও সংগ্রাম ছিল। অত্যুন্নত নতুন প্রযুক্তির বিস্তার ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর সেসব আর নেই।

১০. বিশ্বব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থা বদলে গেছে : মানুষও বদলে গেছে

অত্যুন্নত নতুন প্রযুক্তির বিস্তার (১৯৮০-র দশক থেকে) এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির (১৯৯১) পর পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিগুলো মানবজাতির জন্য কল্যাণরাষ্ট্রের এবং ‘জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদে’র ধারণাকে কার্যকর ও বিকশিত না করে, সরকার ও রাজনীতিকে দুর্বল করে দিয়ে, কথিত সামাজিক ব্যবসা, আদর্শ এনজিও ও আদর্শ সিভিল সোসাইটি অরগানাইজেশন নিয়ে কাজ করছে। তারা পুঁজিবাদের পক্ষে অকপটে কথা বলছে।

কায়েমি-স্বার্থবাদীদের ও হীন স্বার্থান্বেষীদের দিক থেকে গণতন্ত্রের ধারণাকে ধনিক-বণিকদের স্বার্থ হাসিলের অনুকূল রূপ দেওয়া হয়েছে। প্রচারমাধ্যমকে ব্যবহার করা হচ্ছে জনসাধারণকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার কাজে। দুর্বল রাষ্ট্রগুলোতে চালানো হচ্ছে নিঃরাজনীতিকরণের কার্যক্রম। রাজনীতির ও রাষ্ট্রব্যবস্থার ওপর পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গের কঠোর নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হয়েছে সিএসওসমূহের (Civil Society Organaizations) দ্বারা। এখন পৃথিবীব্যাপী মানুষ ভুগছে অদ্ভুত এক হীনতাবোধে (inferiority complex)। তবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আবিষ্কার-উদ্ভাবন চলছে। কিন্তু সর্বত্রই মানুষের মধ্যে নৈতিক শক্তি দুর্বল, সৎসাহস দুর্লভ, সৃষ্টিশীলতা দুর্গত। হয়তো ব্যতিক্রম আছে। আমি ব্যতিক্রমের কথা বলছি না, সাধারণ অবস্থাটার কথা বলছি। পৃথিবীব্যাপী উচ্চ ও উচ্চমধ্যবিত্ত স্তরের মানুষ এখন কেবল বর্তমান নিয়ে ভাবছে এবং ভোগবাদী, সুবিধাবাদী, স্বপ্নহীন, কল্পনাহীন, আদর্শহীন জীবন যাপন করছে। আর যে স্বল্পসংখ্যক লোক বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়েছে এবং অত্যুন্নত নতুন প্রযুক্তির ওপর কর্তৃত্ব নিয়ে আছে, তারা নিরঙ্কুশ ভোগবাদী ও সুবিধাবাদী জীবনযাত্রায় মেতে আছে।

মানুষের জীবনে ভোগের বাসনা আছে, তার চরিতার্থতারও দরকার আছে। কিন্তু মানুষের জীবনে কেবল ভোগই কি সব? যৌথ জীবন, সম্মিলিত জীবন, সংযম, সামঞ্জস্য, পারস্পরিক সহানুভূতি, সম্প্রীতি, উৎপাদনশীলতা, সৃষ্টিশীলতা ও সর্বজনীন কল্যাণবোধ ইত্যাদিকেও যথোচিত গুরুত্ব দিতে হবে। ভোগবাদীরা এগুলোকে অল্পই বিবেচনায় নেন। কোনো নীতির প্রতি, কোনো আদর্শের প্রতি তাঁদের আগ্রহ থাকে না।

অত্যুন্নত নতুন প্রযুক্তি নিয়ে, বিচার-বিবেচনা না-করে, উচ্চবিত্ত ও উচ্চমধ্য পর্যায়ের প্রায় সবাই যন্ত্রের গতিতে চলছে – চলতে বাধ্য হচ্ছে। পৃথিবীর কোথাও এখন জনগণ কোনো মহান লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ নেই। প্রায় সব রাষ্ট্রেই সরকার এখন আগের থেকে ভিন্ন চরিত্রের – সর্বজনীন কল্যাণের চিন্তা কমই আছে। রাজনীতিকে পরিণত করা হয়েছে ব্যবসায়ের পুঁজিতে। সর্বজনীন কল্যাণে সংঘশক্তি গড়ে তুলে উন্নততর নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রশ্নে – ‘মানুষে পারবে’র জায়গায় ‘মানুষে পারবে না’ – এই হলো মানুষ-সম্পর্কে আজকের-মানুষের ধারণা। এখন অনেক জাতির মধ্যেই মানুষীশক্তির ওপর পাশবিক শক্তি কর্তৃত্ব বিস্তার করে আছে।

তথ্যপ্রযুক্তি ও জীবপ্রযুক্তির বিপ্লব আর সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর বিশ্বব্যবস্থা বদলে গেছে, প্রায় সর্বত্র রাষ্ট্রব্যবস্থাকে নতুন উদ্যমে পুঁজিবাদী রূপ দেওয়া হচ্ছে, পুঁজিবাদের অন্যায়সমূহ অবাধে বেড়ে চলছে, আর মানুষ মানবিক ও সামাজিক গুণাবলি হারিয়ে চলছে (dehumanization of man in society)। কল্যাণরাষ্ট্রের ধারণাকেও ত্যাগ করা হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, বিশ্বব্যবস্থা বহুকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। আদর্শহীন শ্রেয়োনীতিহীন প্রতিযোগিতার মধ্যে পৃথিবী এককেন্দ্রিক থাকলে কিংবা বহুকেন্দ্রিক হলে সুফল-কুফল কী হবে? মনে হয়, ক্রান্তিকাল অতিক্রম করে পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলো আবার দ্বিকেন্দ্রিক রূপ নিচ্ছে। প্রচারমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, পৃথিবীর অধিকাংশ রাষ্ট্রে জুলুম-জবরদস্তি, শোষণ-পীড়ন-প্রতারণা ও হত্যা-আত্মহত্যা বাড়ছে। প্রত্যেক রাষ্ট্রেই ধনীদের সঙ্গে গরিবদের, শক্তিশালীদের সঙ্গে দুর্বলদের বৈষম্য, আর ধনী ও শক্তিশালী রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে দরিদ্র ও দুর্বল রাষ্ট্রসমূহের বৈষম্য অতীতের যে-কোনো সময়ের চেয়ে দ্রুততর গতিতে বাড়ছে। অন্যায়-অবিচার বাড়ছে এবং সরকারকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য অধিক থেকে অধিকতর পরিমাণে দণ্ডমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হচ্ছে। আগ্রাসনের পর আগ্রাসন চালানো হচ্ছে – যুদ্ধের পর যুদ্ধ লাগানো হচ্ছে। যুদ্ধের প্রভাব পড়ছে সকল রাষ্ট্রের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে। দুনিয়াব্যাপী অনবরত জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। মানবীয় সবকিছুরই স্বাভাবিক বিকাশের সম্ভাবনা নষ্ট করা হচ্ছে।

নতুন প্রযুক্তির মালিকানা ও রাষ্ট্রক্ষমতা যাঁদের হাতে, সেই ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক শক্তি সর্বজনীন কল্যাণে পুরাতন আইন-শৃঙ্খলার জায়গায় উন্নততর নতুন আইন-শৃঙ্খলা গড়ে তুলছেন না। সামাজিক নিরাপত্তা ও শান্তিরক্ষার নামে তাঁরা কঠোর থেকে কঠোরতর আইন-কানুন ও সরকারের বলপ্রয়োগমূলক বিধিব্যবস্থা বাড়িয়ে চলছেন – পর্যায়ক্রমে সামাজিক ন্যায় বাড়ানোর ও অন্যায় কমানোর কথা ভাবছেন না। সর্বজনীন কল্যাণের উদ্দেশ্য নিয়ে দেখলে দেখা যায়, বিশ^ব্যাপী রাষ্ট্রীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে নিকৃষ্ট রূপ দেওয়া হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির ও জীবপ্রযুক্তির বিপ্লবের এই কালে সময়ের দাবিতেই প্রকৌশল, কারিগরি ও ব্যবসা-বাণিজ্য বিষয়ে পেশামূলক শিক্ষার প্রসার ঘটানো হচ্ছে। এগুলোর সঙ্গে জাতীয় ইতিহাস, পৌরনীতি ও রাষ্ট্রনীতি, সভ্যতা-সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানসম্মত নৈতিক শিক্ষাকে যথেষ্ট স্থান দেওয়া দরকার ছিল; কিন্তু তা দেওয়া হয়নি – হচ্ছে না। বাংলাদেশে শিশু-কিশোরদের ধর্মীয় ‘নৈতিকতা’ শেখানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।  প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা, খ্রিষ্টধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা, হিন্দুধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা, বৌদ্ধধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা নামে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যপুস্তক চালু আছে।

বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের অত্যন্ত কঠোর একটি উক্তি স্মরণযোগ্য : ‘It is essential that the student acquire an understanding of and a lively feeling for values. He must acquire a valid sense of the beautiful and of the morally good. Otherwise he, with his specialized knowledge, more closely resembles a well-trained dog than a harmoniously developed person.’

১১. ন্যায় বাড়াতে হবে, অন্যায় কমাতে হবে

বাংলাদেশে ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে র‌্যাব (Rapid Action Battalion) ও তার শাখা-প্রশাখা : চিতা, কোবরা  ইত্যাদি। তারপর এদের দ্বারা চালানো হচ্ছে ক্লিনহার্ট অপারেশন, এনকাউন্টার, ক্রসফায়ার ও বন্দুকযুদ্ধের নামে বিনাবিচারে কথিত সন্ত্রাসী হত্যা। নতুন করে কার স্বার্থে, কেন এ ব্যবস্থা দরকার হলো, এর গতি কোন দিকে – সব জাতিরই বিবেকবান চিন্তাশীল সকলেরই তা তলিয়ে দেখা কর্তব্য। এর মধ্যে জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে জেএমবি, তালেবান, আলকায়দা, আইএস ও আরো কয়েকটি জঙ্গিবাদী সংগঠন। এসবের অবসান ঘটিয়ে স্বাভাবিক অবস্থা প্রতিষ্ঠা করা প্রচলিত আইন ও বিচারব্যবস্থা দ্বারা সম্ভব হবে না। মানুষের, সন্ত্রাসীদের ও জঙ্গিবাদীদের মনের দিকটাতেও গুরুত্ব দিতে হবে। পর্যায়ক্রমে রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক-প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক গোটা ব্যবস্থাকে পুনর্গঠিত করতে হবে। সর্বজনীন কল্যাণে আইন-কানুন উন্নত করতে হবে। কেবল শাস্তিমূলক ব্যবস্থা দ্বারা অবস্থা স্বাভাবিক করা যাবে না। রাষ্ট্রব্যবস্থায় ও জনজীবনে ন্যায় বাড়াতে হবে, অন্যায় কমাতে হবে।

গণতন্ত্রকে ‘উদার গণতন্ত্র’ নাম দিয়ে পরিণত করা হয়েছে কায়েমি-স্বার্থবাদীদের ও হীন-স্বার্থান্বেষীদের স্বার্থ হাসিলের প্রধান উপায়ে। গণতন্ত্রকে পরিণত করা হয়েছে নির্বাচনতন্ত্রে। মধ্যপ্রাচ্যে তেল, গ্যাস ও অন্যান্য খনিজ-সম্পদে সমৃদ্ধ রাষ্ট্রগুলোতে গণতন্ত্রের নামে যুদ্ধ ও গণহত্যা চালিয়ে জনগণের ওপর ‘পুতুল সরকার’ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে সেখানে দেখা দিয়েছে সহিংসতা ও জঙ্গিবাদ। যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগী বৃহৎ শক্তিবর্গ মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোর তেল, গ্যাস ও অন্যান্য খনিজসম্পদ লুটে নিচ্ছে। অবিচার বৃদ্ধির প্রতিবাদে সৃষ্ট সহিংসতার নাম দেওয়া হয়েছে ‘সন্ত্রাস’। যুক্তরাষ্ট্র-কথিত ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে’র, এবং কথিত ‘সশস্ত্র ইসলামি মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’র, আর কথিত ‘গণতন্ত্রের জন্য যুদ্ধে’র  সুযোগ বেড়েছে। প্রতিটি যুদ্ধের ব্যয়ভার বহন করতে হচ্ছে সকল রাষ্ট্রের জনসাধারণকে।

মানবজাতি আজ এমন এক অবস্থায় আছে যে, প্রত্যেক রাষ্ট্রে পঁচানব্বই শতাংশ মানুষ পাঁচ শতাংশ মানুষের
হীন-উদ্দেশ্য-সাধনের যন্ত্রে পরিণত হয়ে আছে। এই অবস্থা সৃষ্টির পেছনে আছে, কিছু লোকের প্রবল, অসংযত, অন্তহীন ভোগলিপ্সা, ক্ষমতালিপ্সা, সম্পত্তিলিপ্সা এবং বিপুল অধিকাংশ লোকের ঔদাসীন্য, আলস্য, হতাশা ও নিষ্ক্রিয়তা। এই বাস্তবতার মধ্যে সহিংসতা ও যুদ্ধ-বিগ্রহ অনিবার্য। যুক্তরাষ্ট্রের ওকুপাই ওয়াল স্ট্রিট মুভমেন্ট (২০১১-১২) থেকে বলা হয়েছে, ‘বিশ্বায়নের নামে শতকরা এক ভাগ লোক বাকি শতকরা নিরানব্বই ভাগ লোককে বঞ্চিত করে নিজেদের জন্য সম্পত্তির ক্রমবর্ধমান পাহাড় গড়ে চলছে।’ তাঁদের মতে, শোষণ-পীড়ন-প্রতারণা ও বঞ্চনাই বর্তমান পাশ্চাত্য রাষ্ট্রব্যবস্থার ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্বায়নের কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য। বিশ্বায়নের স্বরূপ যাঁরা তলিয়ে দেখতে চান, মনে হয় তাঁরা এই রকমই অনুভব করেন। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে চলমান বিশ্বায়নে তাঁরা মানবজাতির ভবিষ্যৎকে অন্ধকার দেখেন। তাঁরা সর্বজনীন কল্যাণে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ^ব্যবস্থা পরিবর্তন করে উন্নত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবি তোলেন মাত্র। কাজ কারা করবেন?

১২. নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা ও নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে

পৃথিবীর সর্বত্রই আজকের সভ্যতার-সংকটের উপলব্ধি অগভীর। দুনিয়াব্যাপী কায়েমি-স্বার্থবাদী সব প্রচারমাধ্যম এমনভাবে প্রচার চালায় যে, সাধারণ মানুষ কায়েমি স্বার্থবাদী শক্তির প্রতি নির্ভরশীল মনোভাব নিয়ে চলে। নানা কৌশলে জনমনে এই ধারণা বদ্ধমূল করে দেওয়া হয়েছে যে, প্রচলিত অন্যায়-অবিচার মেনে নিয়েই তাদের বাঁচতে হবে। কায়েমি-স্বার্থবাদীদের বাইরে সর্বজনীন কল্যাণে কাজ করবে এমন কোনো নেতৃত্বের উত্থান কোনো রাষ্ট্রের জনগণই এখন আশা করতে পারছে না। জনগণ মনোবলহারা। রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতা জনগণের মনোবল অর্জনের প্রতিকূল। তবে আস্থাযোগ্য নেতৃত্ব এবং কল্যাণকর কর্মসূচি সামনে এলে জনগণের মধ্যে অপরাজেয় সংগ্রামী স্পৃহা দেখা দেবে। এই সংকট গতানুগতিক প্রচেষ্টায় স্বল্প সময়ের মধ্যে কাটিয়ে ওঠা যাবে – এমনটা মনে করা ভুল। উত্তরণের জন্য দীর্ঘস্থায়ী সাধনা ও দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম লাগবে। জঙ্গিবাদীদের ও সন্ত্রাসীদের মন-মানসিকতা বুঝতে হবে। মনের জগতে পরিবর্তন ঘটানো যাবে কি না তা দেখতে হবে। কেবল চলমান মৌলবাদবিরোধী, জঙ্গিবাদবিরোধী, সন্ত্রাসবাদবিরোধী কর্মকাণ্ড দিয়ে সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। গণতন্ত্রের নামে চলমান ভাওতা-প্রতারণা ও দুষ্কর্মের কঠোর সমালোচনা আর শতভাগ মানুষের গণতন্ত্র উদ্ভাবনের ও প্রবর্তনের চিন্তা ও কার্যক্রম দরকার। ভোটাভুটিসর্বস্ব ব্যবস্থা নয়, দরকার সর্বজনীন গণতন্ত্র – সকলের জন্য রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক গণতন্ত্র। তার জন্য গভীর চিন্তা ও জনমত গঠন করা দরকার।

অত্যুন্নত বিজ্ঞান-প্রযুক্তির এই কালে মানবজাতি বিরাট-বিপুল সম্ভাবনা নিয়েও যে-সভ্যতার সংকটে নিপতিত, তা থেকে উদ্ধার লাভের জন্য উন্নততর নতুন বিশ্বব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা ও জীবনপদ্ধতিতে উত্তীর্ণ হতে হবে। তার জন্য দরকার ভবিষ্যৎমুখী দৃষ্টি নিয়ে রেনেসাঁস, সভ্যতা, সংস্কৃতি, ন্যায়, প্রগতি, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদ ইত্যাদি প্রত্যয়ের আমূল পুনর্বিবেচনা, পুনর্গঠন ও নবায়ন। নানা আদর্শ থাকতে পারে, তবে সর্বজনীন কল্যাণে একটি আদর্শ গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে। সেই আদর্শ সামনে রেখে আদর্শ-অভিমুখী কর্মসূচি অবলম্বন করে কাজ করতে হবে।

উত্তরাধুনিকবাদ মানবপ্রজাতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকেই grand narrative ও master discourse বলে বিবেচনার বাইরে রাখে, সমগ্রের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে কেবল অংশের দিকে দৃষ্টি দেয়, আর সমাধানের লক্ষ্য বাদ দিয়ে কেবল সমস্যা বিশ্লেষণ করে। এই মতবাদ অতীতের ব্যাপার বলে যেসব বিষয়কে বিবেচনার বাইরে রাখে, সেগুলোকে বিবেচনার বাইরে রাখা সম্পূর্ণ অনুচিত। সমালোচনা ও অভিজ্ঞতার সারসংকলন দ্বারা অতীতের জ্ঞান ও শিক্ষার মর্মবস্তুকে অবশ্যই আত্মস্থ করতে হবে। যাঁরা নেতৃত্বে থাকবেন তাঁদের জন্য ক্লাসিকের ও অভিপ্রেত আদর্শের চর্চা অপরিহার্য।

রাষ্ট্রীয় যে-কোনো ব্যাপারে শুধু উচ্চশ্রেণির পাঁচ শতাংশকেই নয়, মধ্য ও নিম্নশ্রেণির পঁচানব্বই শতাংশকেও সব সময় যথোচিত গুরুত্বে বিবেচনায় ধরতে হবে। বুঝতে হবে যে, নতুন বাস্তবতায় গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র বিষয়ক ধারণাগুলোকে বিভ্রান্তিকর করে ফেলা হয়েছে। বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে, লেনিন-স্টালিন, মাও সে তুং, ফিদেল ক্যাস্ট্রো প্রমুখ আদর্শপরায়ণ নেতা শ্রমিক-কৃষকদের ও নিম্নবিত্তদের কল্যাণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে যে-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলেন, তা রক্ষা করা হলো না কেন? নতুন কালের প্রয়োজনে সবকিছুকেই নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। জনগণের কল্যাণে দুনিয়াটাকে বদলানো যাবে, বদলাতে হবে – উন্নতিশীল করতে হবে। উন্নতিশীলতর সম্ভাবনা অন্তহীন।

১৩. দরকার  আদর্শগত পুনর্গঠন ও নতুন নেতৃত্ব

নতুন প্রযুক্তির বাস্তবতায় সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগী পশ্চিমা বড় শক্তিগুলো দুনিয়াব্যাপী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বিশ্বায়নের নামে প্রচলিত সব ধারণা ও কার্যক্রমকে পুনর্গঠিত ও বিকশিত করে চলছে। অনেকে মনে করেন, দুনিয়াব্যাপী পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী ধারার চিন্তা ও কাজে নতুন জোয়ার দেখা দিয়েছে। সর্বজনীন স্বার্থে কার্যকর প্রগতিশীল চিন্তা ও সংঘশক্তি পৃথিবীর কোথাও এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মনে হয়, অবস্থা এরকম থাকবে না, উন্নতিশীলতার সম্ভাবনা বুঝতে পারলে মানুষ আবার পরিবর্তন-উন্মুখ হবে।

অত্যুন্নত নতুন প্রযুক্তি নিয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থার যে পুনর্গঠন ও নবায়ন আমরা চাই, তা সর্বজনীন কল্যাণে; যারা শোষিত-বঞ্চিত-নির্জিত, অবশ্যই সেই নব্বই শতাংশেরও কল্যাণে। প্রচলিত কোনো চিন্তাধারা ও কর্মধারাকেই আমাদের কাছে ঠিক মনে হয় না। আমাদের উদ্ভাবন করে নিতে হবে আমাদের-অভিপ্রেত নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থার রূপ ও প্রকৃতি। তার জন্য পৃথিবীর সব জাতির মধ্যে দরকার নতুন সম্ভাবনার উপলব্ধি, সর্বজনীন কল্যাণ সাধনে কাজ করার সংকল্প, নতুন আশা, নতুন উৎসাহ-উদ্দীপনা, নতুন চিন্তা-ভাবনা, নতুন বৌদ্ধিক (intellectual) জাগরণ ও গণজাগরণ। আদর্শ ও
আদর্শ-অভিমুখী পরিকল্পনা ও কর্মসূচি অবলম্বন করতে হবে। এরই মধ্যে সৃষ্টি করতে হবে নতুন রাজনৈতিক দল, নতুন নেতৃত্ব, নতুন নেতা। এই প্রক্রিয়ায় জনসাধারণকেও জাগ্রত ও সক্রিয় থাকতে হবে।

দুর্বল জাতিগুলোকে শক্তিশালী জাতিগুলো থেকে উন্নত জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি গ্রহণ করতে হবে, পশ্চিমের দার্শনিক-বৈজ্ঞানিক ও শিল্পী-সাহিত্যিকদের প্রগতিশীল মহান সব ভাবধারা প্রয়োজন ও সাধ্য অনুযায়ী আত্মস্থ করতে হবে। এতে দুর্বল জাতিগুলোকে শক্তিশালী হওয়ার উপায় বের করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু বৃহৎ শক্তিবর্গের কূটনীতি, গোয়েন্দানীতি, প্রচারনীতি, আধিপত্য ও নির্ভরশীলতা নীতি এবং লগ্নিপুঁজির জালে আটকা পড়লে সর্বনাশ। আমাদের দরকার এমন জ্ঞান যা জনজীবনের সার্বিক উন্নতিতে কাজে লাগবে – যা হবে at once a method of enquiry and a mode of action। এর জন্য দরকার স্বাধীন চিন্তাশীলতা ও প্রয়োজনীয় বিষয়ে সৃষ্টিশীল গবেষণা। অ্যাকাডেমিক গবেষণার প্রকৃতি
এ-রকম হয় না।

পশ্চিমা আধিপত্যবাদীদের চাপিয়ে দেওয়া উন্নয়নতত্ত্ব ও উদার গণতন্ত্র নিয়ে দুর্বল জাতিগুলোর স্বাভাবিক উন্নতির ও নিজেদের রাষ্ট্র গড়ে তোলার সম্ভাবনা নস্যাৎ হয়ে যাচ্ছে – স্বাভাবিক চিন্তা-চেতনা বিকারপ্রাপ্ত হচ্ছে। পরনির্ভর চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করে রাজনীতি, অর্থনীতি, উন্নয়ন-পরিকল্পনা, প্রশাসন, শিক্ষা-সংস্কৃতি, আইন ও বিচারব্যবস্থা – সব বিষয়ে দরকার নিজেদের চিন্তা – স্বাধীন চিন্তা। বাংলাদেশে, বাংলাভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতিকে সবদিক দিয়ে বিকশিত ও সমৃদ্ধ করতে হবে। বাংলাদেশকে বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক শক্তিমান রাষ্ট্ররূপে গড়ে তুলতে হবে। পৃথিবীর প্রত্যেক জাতিকেই স্বকীয় ঐতিহ্য ও বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করে নিজ নিজ উন্নতির উপায় নির্ধারণ করে কাজ করতে হবে।

১৪. বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আদর্শ ও উন্নয়ন

প্রাচুর্যের মধ্যেও মানবজাতি যে-সভ্যতার-সংকটে রয়েছে, তার প্রকৃতি এবং তা থেকে উদ্ধার লাভের ও উন্নতিশীল নতুন সভ্যতা সৃষ্টির উপায় সম্পর্কে পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের বিবেকবান চিন্তাশীল ব্যক্তিদের পরিপূর্ণ মনোযোগ দরকার। প্রায় সব জাতির মধ্যেই আশা ও সাহসের অভাবে, চিন্তাহীনতা ও পরিবর্তন-বিমুখতা দেখা দিয়েছে। এতে সমস্যা বাড়ছে। এ থেকে উত্তরণের ও প্রগতির জন্য প্রথম পর্যায়ে চেষ্টা করতে হবে নতুন রেনেসাঁস সৃষ্টির জন্য। রেনেসাঁস কেবল জ্ঞান দিয়ে হয় না, জ্ঞানের সঙ্গে অবশ্যই জ্ঞানীদের চরিত্রবল (intellectual character) ও কর্মমুখিতা দরকার হয়।

নিজ নিজ রাষ্ট্রে প্রযুক্তির প্রসার ও শিল্পায়ন নিয়ে প্রকৌশলী, প্রযুক্তিবিদ ও প্রশাসকেরা চিন্তা করবেন – এটা স্বাভাবিক। তবে তাঁদের চিন্তায় অবশ্যই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিবেচনার সঙ্গে জাতির আত্মনির্ভরতা ও জনজীবনের সার্বিক কল্যাণের বিবেচনাও অন্তর্ভুক্ত রাখতে হবে। ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্ন গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। যত মন্থর গতিতেই হোক, ন্যায় বাড়াতে হবে এবং অন্যায় কমাতে হবে। প্রযুক্তির প্রসার ও শিল্পায়নের সঙ্গে রাজনৈতিক ও আদর্শগত বিবেচনাও অন্তর্ভুক্ত রাখতে হবে। পর্যায়ক্রমে জনজীবনভিত্তিক পরিকল্পনা ও কর্মসূচি অবলম্বন করে তা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করতে হবে। সরকারের ও রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে, গতানুগতিক রাজনীতি ও নেতৃত্ব দিয়ে এসব হবে না, সর্বজনীন কল্যাণে কাজ করার মতো নতুন রাজনৈতিক দল, নতুন নেতৃত্ব, নতুন রাষ্ট্রচিন্তা ও নতুন রাজনীতি লাগবে।

বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রীয় আদর্শের এবং বাস্তবে রাজনৈতিক দলগুলোর যে অবস্থা, তাতে প্রকৌশলীদের, প্রযুক্তিবিদদের, প্রশাসকদের এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রের চিন্তক ও কর্মীদের উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করার সুযোগ কতখানি আছে, তা বিচার করে দেখতে হবে। সরকার যেভাবে সংবিধান নিয়ে কাজ করে, তা জাতীয় ঐক্যের পরিপন্থী। জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি ও বিরুদ্ধশক্তিতে বিভক্ত করে স্থায়ী অনৈক্যের মধ্যে রাখা হয়েছে। সংবিধানে লিপিবদ্ধ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের লক্ষ্য সামনে নিয়ে উন্নয়ন-পরিকল্পনা প্রণয়ন দুঃসাধ্য। রাষ্ট্রীয় শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষানীতি কী রূপ ও প্রকৃতি নিয়ে চলছে? রাষ্ট্রীয় আদর্শের ধারণাগুলো একমুখী নয়। কার্যক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রধান সব রাজনৈতিক দলই সমাজতন্ত্রবিরোধী। তারা চলছে মুক্তবাজার অর্থনীতি, অবাধ-প্রতিযোগিতাবাদ, বহুত্ববাদ ও ‘গণতন্ত্রের বদলে নির্বাচনতন্ত্র’ নিয়ে। এসব দল ও সরকার জাতীয় সংসদের নির্বাচন করার সামর্থ্যও আজো অর্জন করেনি। জনমনের ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের যে-বিভক্ত-দশা, সর্বত্র যে-অসহিষ্ণুতা ও হিংসা-প্রতিহিংসা, তাতে কীভাবে এসব আদর্শ নিয়ে জনসাধারণের সার্বিক উন্নতির উপায় করা যাবে? বাস্তবে অবস্থা এখন এমন যে, সমাজে যার ক্ষতি করার শক্তি যত বেশি, তার প্রভাব-প্রতিপত্তি তত বেশি; এ-সমাজে মানুষের কল্যাণ করার শক্তি কোনো শক্তি বলেই স্বীকৃতি পায় না। যে-বিশ্বব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থা আমরা প্রস্তাব করছি, তার অনুকূলে বাংলাদেশের সংবিধানে পরিবর্তন ঘটাতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধান ও রাজনৈতিক কার্যক্রম এমন হতে পারে যে তা পৃথিবীর সব জাতির জন্য অনুসরণীয় হয়।

১৫. হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ : জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবাদ

বাংলা ভাষার দেশে, উনিশ শতকের প্রথম দিকে, যখন রামমোহনের যুগান্তকারী চিন্তা ও কর্মের মধ্য দিয়ে রেনেসাঁসের সূচনা হয়, তখন বাংলায় আধুনিক প্রযুক্তির ও বৃহদায়তন শিল্পের সূচনাও হয়নি। রামমোহনের কর্মকালে (১৮১৪-৩৩)
বাংলা-বিহার-ওড়িশা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনাধীন ছিল। ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের পরে ব্রিটিশ সরকার ভারতের শাসন-ক্ষমতা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে নিজের কাছে নিয়ে নেয়। বাংলার রেনেসাঁসের পেছনে প্রেরণাদায়ক ছিল ইউরোপের উন্নত জাতিগুলোর রেনেসাঁস। শিক্ষিত ও শিক্ষানুরাগী বাঙালি সেদিন ইউরোপের প্রগতিশীল ভাবধারাকে গ্রহণ করেছিল নিজের সত্তায় – আত্মসত্তাকে সমৃদ্ধ ও উন্নত করার জন্য। বাঙালি সত্তা, ভারতীয় সত্তা তাঁরা ত্যাগ করেননি।

এ-দেশে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে হিন্দু সমাজ ও মুসলমান সমাজ বিকশিত হয়েছে একই শাসনব্যবস্থার মধ্যে – দুই স্বতন্ত্র ধারায়। দুই ধারাই আলাদা-আলাদাভাবে  নিজ  নিজ  ধর্মীয়  ধারণা  ও  ধর্মবিশ্বাস  সংস্কার  করে  করে  এগিয়েছে। তাদের  মধ্যে  বিরোধ  ছিল,  ঐক্যও  ছিল।  নানা  ঐতিহাসিক কারণে ব্রিটিশ-শাসিত বাংলায় হিন্দু সমাজের তুলনায় মুসলমান সমাজে রেনেসাঁস দেখা দেয় প্রায় শতাব্দীকাল পরে। বিশ শতকের শুরুতে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের (১৯০৫-১১) মধ্য দিয়ে দেখা দেয় গণজাগরণ। রেনেসাঁসের মনীষীরা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে গণজাগরণ ও গণআন্দোলনের সমর্থক ও সহায়ক ছিলেন। 

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সময় থেকে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে স্বতন্ত্র সম্প্রদায়চেতনা দ্রুত বেড়ে চলে। ওই আন্দোলনের মধ্যেই হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ রাজনৈতিক রূপ লাভ করে এবং তা সারা ভারতে বিস্তৃত হয়। ইংরেজ সরকার ভারতে তার অন্যতম মূল-শাসননীতি হিসেবে Divide and Rule Policy নিয়ে সক্রিয় থাকে। তখন জাতীয়তাবাদের বদলে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিয়ে মুসলিম লীগ ও হিন্দু মহাসভা আত্মপ্রকাশ করে। ইতিহাসে হিন্দু মহাসভার ভূমিকাকে বিবেচনার বাইরে রাখা ঠিক নয়। কংগ্রেস কখনো কখনো হিন্দু মহাসভা দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। জাতীয়তাবাদের (nationalism) স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে সাম্প্রদায়িকতাবাদকে (communalism) – হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদ ও মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাবাদ। রেনেসাঁসের ও গণজাগরণের মধ্যেই সূচিত হয় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা। আন্দোলনের ফলে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ ১৯১১ সালে রদ করা হলেও ১৯৪৭ সালে কথিত দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময়ে বাংলা আবার ভাগ হয়, এবং পূর্ববাংলা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। পাঞ্জাবও তখন ভাগ হয়। ১৯৪৭-সালে বাংলাভাগের জন্য হিন্দু মহাসভা প্রবলভাবে সক্রিয় ছিল। ফজলুল হক, নাজিমউদ্দিন, সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আকরম খাঁ তখন বাংলাভাগ প্রশ্নে নীরব ছিলেন। তখন বাংলায় মুসলমানেরা ছিলেন সংখ্যাগুরু। ফজলুল হক, নাজিমউদ্দিন, সোহরাওয়ার্দী একাদিক্রমে বাংলার প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের উচ্চবর্ণের লোকদের মনে ধারণা সৃষ্টি হয় যে, ভোটের রাজনীতিতে হিন্দুরা কোনোক্রমেই আর বাংলার রাজনীতিতে কর্তৃত্বশীল অবস্থানে যেতে পারবে না। দ্বিজাতি-তত্ত্ব জিন্নাহর অনেক আগে থেকেই ছিল, জিন্নাহ সেই ধারণাটিকে তাঁর দলীয় রাজনীতিতে কার্যকরভাবে ব্যবহার করেছিলেন।

পাকিস্তানকালে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি-জাতীয়তাবাদ সৃষ্টির প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং পূর্ববাংলার বাঙালি-জাতীয়তাবাদ প্রবল হয়, এবং তা নিয়ে দীর্ঘ সংগ্রাম ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশ।

১৯৬০-এর দশকে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর শেখ মুজিবুর রহমান আত্মপ্রকাশ করেন বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতা রূপে। একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধ পর্যন্ত কালে ঢাকাকেন্দ্রিক জাতীয় সংস্কৃতিতে রাজনৈতিক নেতাদের ও বুদ্ধিজীবীদের জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতে রেনেসাঁস ও গণজাগরণ বহমান ছিল। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর সার্বিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে এবং এনজিও ও সিএসও সিভিল সোসাইটি অরগানাইজেশন গড়ে তোলার পর রেনেসাঁস ও গণজাগরণ দুটোই অবসিত হতে থাকে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভবিষ্যৎ নিয়ে গুরুতর চিন্তাভাবনা দরকার। বিশ্বায়নের কালে জাতিরাষ্ট্র কি বিলুপ্ত হয়ে যাবে?

১৬. প্রগতির বাধা দূর করে চলতে হবে : পৃথিবীকে যুদ্ধমুক্ত করতে হবে

ব্রিটিশ-শাসিত বাংলার লেখকেরা উপযোগবাদ ও নৈতিক বিবেচনাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। ধর্মকেও তাঁরা বুঝতে চাইতেন যৌক্তিক বিচার-বিবেচনার আলোকে। কলকাতায় ও ঢাকায় ১৯২০-এর দশক থেকে শিল্প-সাহিত্যে আধুনিকবাদের (modernism) এবং ১৯৮০-র দশক থেকে শিল্প-সাহিত্যসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব শাখায় উত্তরাধুনিকবাদের
(post-modernism) প্রসার ঘটে। চিন্তার এই দুটি ধারারই উদ্ভব ফ্রান্সে এবং সেখান থেকে এগুলো লন্ডন, ওয়াশিংটন, নিউইয়র্ক ও কলকাতা হয়ে ঢাকায় আসে।

ঢাকায় আধুনিকবাদের প্রসারকে গতিশীল করে রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন, প্রতিবছর সংগ্রামী চেতনা নিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি উদ্যাপন, ১৯৫৪ সালের পূর্ববাংলার প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচন ও যুক্তফ্রন্টের একুশ দফা কর্মসূচি, আওয়ামী লীগের ছয়দফা আন্দোলন (১৯৬৬-১৯৭১), ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সূচনাকালের ছাত্রসংগ্রাম গণপরিষদের এগারো দফা কর্মসূচি, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের অহিংস অসহযোগ আন্দোলন ও স্বাধীনতাযুদ্ধ। এসব ঘটনার মর্মে লেখক ও কর্মীদের চেতনায় তাঁদের জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতে রেনেসাঁসের উদ্দীপনা ক্রিয়াশীল ছিল।

বাংলাদেশের তরুণ লেখক-গবেষকদের একাংশ, জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতে, ভীষণভাবে বৃত্তাবদ্ধ হয়ে আছেন কলাকৈবল্যবাদে ও উত্তরাধুনিকবাদে। কলাকৈবল্যবাদীরা মনে করেন, সাহিত্যে বিষয়বস্তু গৌণ, রচনানীতি বা স্টাইল মুখ্য। শিল্প-সাহিত্যের বিষয়বস্তুতে মূল্যবোধের প্রশ্নকে তাঁরা বিবেচনার বাইরে রাখেন। অ্যাকাডেমিক গবেষণায় বিষয়বস্তুতে ও মূল্যবোধে গুরুত্ব না দিয়ে methodolog-তে গুরুত্ব কেন্দ্রীভূত রাখা হয়। কলাকৈবল্যবাদ ও উত্তরাধুনিকবাদ নিয়ে সৃষ্ট সাহিত্যে ও অ্যাকাডেমিক গবেষণায় প্রাণশক্তির পরিচয় অল্পই পাওয়া যায়।

বাংলাদেশে জাতীয় সভ্যতার বা জাতীয় সংস্কৃতির স্বকীয় প্রকৃতি আছে, তাতে সংকট চলছে; তার উপর কাজ করছে বৈশি^ক সংকট। কথিত উন্নয়ন-সহযোগীরা (development-partners) ও কথিত দাতাসংস্থাগুলো (doner-agencies) বাংলাদেশকে সংকট অতিক্রম করে প্রগতিশীল ধারায় উঠতে দিচ্ছে না। তারা কাজ করছে তাদের ‘আধিপত্য ও নির্ভরশীলতা নীতি’ অবলম্বন করে। দুর্বল নেতৃত্বের কারণে প্রযুক্তি গ্রহণে ও শিল্পায়নে বাংলাদেশ স্বাধীনতা রক্ষা করে চলছে না। সিভিল সোসাইটি অরগানাইজেশনগুলোর কর্মকাণ্ড রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের গড়ে ওঠার প্রতিকূল। সংকট থেকে উত্তরণের ও প্রগতির জন্য জনগণের ভেতর থেকে নেতৃত্ব সৃষ্টি অপরিহার্য।

যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগীদের নেতৃত্বে চলমান বিশ্বায়নে রাষ্ট্র বিলুপ্ত হবে না – জাতিরাষ্ট্র থাকবে। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশ যদি পরনির্ভরতা ও হীনতাবোধ ত্যাগ করে, এবং তার জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় সত্তা, প্রাকৃতিক সম্পদ, ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নিয়ে স্বাধীনভাবে উন্নতির উপায় খোঁজে, সকল জাতির মহান ঐতিহ্য ও সৃষ্টিধারা থেকে প্রয়োজন ও সামর্থ্য অনুযায়ী ভাবসম্পদ আহরণ করে ও আত্মশক্তি বৃদ্ধি করে, তাহলে এই রাষ্ট্র হয়ে উঠবে স্বাধীন, শক্তিমান, সমৃদ্ধসুন্দর, সৃষ্টিশীল ও প্রগতিশীল। অভিপ্রেত সেই রাষ্ট্রের রূপ ও প্রকৃতি, সরকার ও শাসনপদ্ধতি এবং জনজীবন নিয়ে
আলোচনা-সমালোচনা দরকার। উন্নত ভবিষ্যতের একটা ভিশন, একটা ব্লু-প্রিন্ট জনগণের সামনে দেওয়া দরকার। সর্বজনীন কল্যাণে দূরদর্শিতার সঙ্গে লক্ষ্য নির্ধারণ করে পর্যায়ক্রমে তার বাস্তবায়নে অগ্রসর হতে হবে। পৃথিবীর সব জাতিই স্বকীয় সত্তা বজায় রেখে যাতে এই ধারায় চিন্তা ও কাজ করতে পারে, তার জন্য প্রথমে প্রচার চালাতে হবে।

যে-সভ্যতার সংকট নিয়ে মানবজাতি এখন চলছে, তা সৃষ্টি হয়েছে সভ্যতার উপর নতুন জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির  অভিঘাতের মধ্যে বিজ্ঞানসম্মত কার্যকর উন্নতিশীল নৈতিক চেতনার বিকাশ না-ঘটার, সভ্যতার ধারাকে অবারিত রাখার মতো নেতৃত্ব সৃষ্টি না-করার এবং বিশ্বব্যবস্থায় উপনিবেশবাদী-সাম্রাজ্যবাদী-ফ্যাসিবাদী শক্তির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার তৎপরতার কারণে। সমস্যার সূচনা অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে শিল্পবিপ্লব সূচিত হওয়ার পরেই। স্টিম ইঞ্জিন ও অটোমোবাইলস, বিদ্যুৎ, আণবিক শক্তি, তথ্যপ্রযুক্তি ও জীবপ্রযুক্তি ইত্যাদির আবিষ্কার ও ব্যবহার পর্যায়ক্রমে জনজীবনে ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় সৃষ্টি করেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের চাহিদা। সুবিধা অনেক হয়েছে, কিছু সমস্যার সমাধান হয়েছে, তবে সভ্যতা-সংস্কৃতির দিক দিয়ে নতুন নতুন সমস্যা দেখাও দিয়েছে, অন্যায়-অবিচার বেড়েছে, অসাম্য বেড়েছে। দুই বিশ্বযুদ্ধের কালে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলয়ের পরে জনজীবনে সমস্যা ব্যাপক ও গভীর রূপ ধারণ করেছে। কারণ-করণীয়-করণ ও ফলাফলের সূত্র ধরে ঘটনাপ্রবাহকে গভীরভাবে বুঝতে হবে। তারপর উন্নতিশীল নতুন জীবন, সমাজ, জাতি, রাষ্ট্র ও বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে হবে।

পর্যায়ক্রমে পৃথিবীকে যুদ্ধমুক্ত করা মানবজাতির অন্যতম মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। নতুন প্রযুক্তি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গোটা পৃথিবীতে সকল রাষ্ট্রের ওপর কর্তৃত্ব করার জন্য আগের চেয়ে বেশি যুদ্ধমনস্ক হয়েছে। বসনিয়া, হারজেগোবিনা ও সার্বিয়ায় যুদ্ধ, আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়ায় যুদ্ধ – সবই হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগী পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিগুলোর দ্বারা। সম্প্রতি ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার যে যুদ্ধ চলছে, তাও প্রকৃতপক্ষে রাশিয়ার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগী বৃহৎ শক্তিগুলোর যুদ্ধ। ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুত করে ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা দ্বারা যে সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে, তার পেছনে প্রথমে ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও তার সহযোগী শক্তিগুলো, এবং পরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার সহযোগী শক্তিগুলো।

১৭. নতুন সভ্যতা সৃষ্টির পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে

সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর মানবপ্রজাতির সামনে কার্যকর কোনো আদর্শ – মহান কোনো লক্ষ্য নেই। জনগণের জন্য অতীতের সব আদর্শকেই করে ফেলা হয়েছে অনাকর্ষণীয়। কায়েমি-স্বার্থবাদীরা ও হীন-স্বার্থান্বেষীরা সুপরিকল্পিতভাবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদকে বিভ্রান্তিকর করে রেখেছে। মনে হয় কোনো জাতি, কোনো রাষ্ট্র এখন মহান কোনো লক্ষ্য সামনে নিয়ে চলছে না। যে-বিশ্বায়নের কথা সর্বত্র ক্রমাগত প্রচার করা হয়, তা সাম্রাজ্যবাদেরই উচ্চতর স্তর মাত্র। মানবজাতির উন্নততর নতুন ভবিষ্যৎ সৃষ্টির জন্য প্রচলিত সবকিছুরই আমূল পুনর্বিবেচনা ও নবায়ন দরকার। সমন্বয়বাদী (thesis-antithesis-synthesis) দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে, দূরদর্শী বিচার-বিবেচনা অবলম্বন করে, সুস্পষ্ট কর্মসূচি প্রচার করে নতুন অভিযাত্রা আরম্ভ  করতে হবে।

অত্যুন্নত নতুন প্রযুক্তির এই কালে জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদ বিষয়ক চিন্তাভাবনাকে নবায়িত ও বিকশিত করতে হবে। জাতীয়তাবাদের মর্মে স্থান দিতে হবে ‘শতভাগ মানুষের গণতন্ত্র’ বা ‘সর্বজনীন গণতন্ত্র’। সর্বজনীন গণতন্ত্রের রূপ ও প্রকৃতি প্রত্যেক জাতিকেই নিজ নিজ জাতীয় ঐতিহ্য অবলম্বন করে উদ্ভাবন করে নিতে হবে। জাতীয়তাবাদের সঙ্গে রাষ্ট্রগঠনের আদর্শ ও কর্মসূচি না থাকলে জাতীয়তাবাদ অল্প সময়ের মধ্যেই অচল হয়ে পড়ে। অভিপ্রেত নতুন বিশ্বব্যবস্থায় জাতিরাষ্ট্র, জাতি, জাতীয় ভাষা ও জাতীয় সংস্কৃতি বিকাশমান থাকবে। জাতিরাষ্ট্রগুলোকে সর্বজনীন গণতন্ত্রের নীতি অনুযায়ী নতুনভাবে গঠন করে নিতে হবে। প্রস্তাবিত রাষ্ট্রসংঘ জাতিরাষ্ট্রসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির, বিরোধ মীমাংসার ও প্রগতির লক্ষ্যে কাজ করবে। নতুন বিশ্বব্যবস্থায় যুদ্ধ ও যুদ্ধের সম্ভাবনাকে পর্যায়ক্রমে তিরোহিত করতে হবে।

বিশ্বরাষ্ট্র-গঠনের কথা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই কেউ কেউ বলেছেন। আমিও সে-ধারায় চিন্তা করেছি। কিন্তু
বিচার-বিবেচনার পর মনে হচ্ছে, সে-ধারায় না এগিয়ে জাতিরাষ্ট্র ও রাষ্ট্রসংঘ গঠনের ধারায় চিন্তা ও কাজ করা সমীচীন।

স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোনোটাই হবে না, যাঁরা উন্নতিশীল নতুন ব্যবস্থা চাইছেন, তাঁদের সাধনা ও সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। যে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থার কথা আমরা ভাবছি, মানবজাতিকে তার দিকেই এগোতে হবে। এ উদ্দেশ্যে অবিলম্বে আন্তর্জাতিক বৌদ্ধিক আন্দোলন (intellectual movement) গড়ে তোলা দরকার। হতাশা ও হীনতাবোধ কাটিয়ে, সদিচ্ছা ও গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পর্যায়ক্রমে লক্ষ্যাভিমুখে এগিয়ে চললে, বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে অবশ্যই লক্ষ্যে পৌঁছা যাবে।  দুনিয়াব্যাপী জনসাধারণের সম্মিলিত ইচ্ছাশক্তি, চিন্তাশক্তি ও শ্রমশক্তির সক্রিয়তা দ্বারা পরিকল্পিত অনেক কিছুই করা যাবে। মহান নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে হবে।

কেবল কথা দিয়ে হবে না, কেবল ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও প্রিন্ট মিডিয়া দিয়েও হবে না। আদর্শের রূপ ও প্রকৃতি নির্ণয় করে লিখিত পুস্তক-পুস্তিকা রূপে তা জনগণের মধ্যে প্রচার করতে হবে। ইলেকট্রনিক মিডিয়াকেও অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে। আদর্শকে বাস্তবায়িত করতে হবে প্রয়োজনীয় দল ও নেতৃত্ব সৃষ্টি করে এবং পর্যায়ক্রমিক দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি কর্মসূচি অবলম্বন করে। নেতৃত্ব গঠিত হয় রাজনৈতিক দল দিয়ে। আদর্শের রূপ ও প্রকৃতি গণবিরোধী হলে তা নতুন সভ্যতার পরিপন্থী হবে। সর্বজনীন কল্যাণের আদর্শ, কর্মসূচি ও কর্মনীতি কার্যকর থাকলে সভ্যতা-সংস্কৃতি-প্রগতি বিকাশমান থাকবে। আদর্শের বাস্তবায়নের কাজ রাজনৈতিক দলের ভেতর থেকে আরম্ভ করতে হবে। গণতন্ত্র কেবল নির্বাচন নয়, নির্বাচনের সঙ্গে আরো অনেক কিছু। অগণতান্ত্রিক দল দিয়ে গণতন্ত্র হবে না। সর্বজনীন গণতন্ত্রের জন্য প্রত্যেক রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ‘দলভিত্তিক আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের সরকার’ গঠনের রীতি অবলম্বন করতে হবে। দল গঠন আগে, সরকার গঠন পরে। রাজনৈতিক দলের কোনো বিকল্প নেই। রাজনৈতিক দল বলতে আমি আমাদের দেশের বর্তমান দলগুলোর মতো কোনো দলের কথা বলছি না। দল সম্পর্কে নতুনভাবে চিন্তা ও কাজ করতে হবে।

দলভিত্তিক আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের সরকার গঠনের পদ্ধতি গ্রহণ করা হলে নির্বাচন অনেকটাই জটিলতামুক্ত হবে। সরকারি দল ও বিরোধী দল থাকবে না। তার দ্বারা সর্বজনীন গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা সূচিত হবে। বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য অবলম্বন করে বাংলাদেশের জন্য দলভিত্তিক আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের সরকার গঠনের পদ্ধতি রচনা করতে হবে।

সকলের, বিশেষ করে সমাজের নিচের স্তরের পঁচানব্বই শতাংশ মানুষের মুক্তি ও উন্নতি চলমান উদার গণতন্ত্র দিয়ে হচ্ছে না। তাদের মুক্তির ও উন্নতির জন্য তাদেরকে কাজ করতে হবে। সকলকেই রাজনীতি বিষয়ে জানতে হবে, শিখতে হবে, কমবেশি কাজ করতে হবে। রাষ্ট্রের অন্তর্গত তারা নিজেরা নিজেদের কল্যাণে কাজ না করলে কেউ তাদের অবস্থা উন্নত করে দেবে না। ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯) থেকে আজ পর্যন্ত গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের আদর্শগত ও বাস্তবায়নগত অভিজ্ঞতার সারসংকলন করে এবং সভ্যতার বিকাশে ধর্মের ভূমিকাকে সদর্থক দৃষ্টিতে বিচার করে, ভবিষ্যতের জন্য গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি আদর্শের সমন্বয়ের (thesis-antithesis-synthesis) মাধ্যমে গড়ে তুলতে হবে সর্বজনীন গণতন্ত্রের আদর্শ। দলের কর্মসূচিতে সর্বাঙ্গীণ জাতীয় উন্নতির লক্ষ্য অপরিহার্যরূপে যুক্ত রাখতে হবে। জাতীয় উন্নতির কর্মসূচির মধ্যে জাতির অন্তর্গত শতভাগ মানুষের উন্নতির সুযোগ অবারিত রাখতে হবে। কর্মসূচি হবে মেয়াদি – স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে নতুন মেয়াদের কর্মসূচি প্রস্তুত করতে হবে। রাজনীতির কাজ হবে জাতি ও রাষ্ট্র গঠন, জনজীবনের সমস্যার সমাধান, সার্বিক উন্নয়ন এবং পর্যায়ক্রমে অন্যায় কমানো ও ন্যায় বাড়ানো। দলভিত্তিক আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের সরকার গঠনের ধারণাকে বাস্তবসম্মত রূপ দিয়ে জনগণের (of the people, by the people, for the people) রাজনৈতিক দল গঠনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। জনসাধারণকে জাগাতে হবে। সর্বজনীন গণতন্ত্র নিয়ে, জাতিরাষ্ট্র ও তার সম্পূরক রাষ্ট্রসংঘ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অভিপ্রেত নতুন মানবজাতি গড়ে তোলা সম্ভব হবে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলয়ের পর অত্যুন্নত নতুন প্রযুক্তির পরিবেশে আমাদের প্রস্তাবিত নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাই হতে পারে মানবপ্রজাতির সামনে লক্ষ্য। এর জন্য আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক ও বৈশ্বিক সকল কর্মকাণ্ডের মর্মস্থলে চাই জাগ্রত নৈতিক চেতনা; নৈতিক বিবেচনা এবং শ্রেয়োনীতি নির্ধারণ করে তা নিয়ে কাজ করতে হবে।

চিন্তা ও কাজকে একই প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য দুই অংশ রূপে গণ্য করতে হবে। দুয়ের যে-কোনো একটিকে বাদ দিলে প্রক্রিয়া খণ্ডিত ও ব্যর্থ হবে। জাতীয় পরিসরে রাজনৈতিক দলের প্রচারকার্য কেবল নির্বাচন সামনে নিয়ে করলে হবে না, সব সময়ে রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য ও কর্মসূচি দল থেকে জনগণের মধ্যে প্রচার করতে হবে। রাজনীতির অপরিহার্যতা ও অপরিসীম গুরুত্ব সম্পর্কে জনমনে নতুন চেতনা সৃষ্টি করতে হবে। বাংলাদেশে রাজনীতির প্রতি জনগণের যে ধারণা প্রচলিত আছে, তার আমূল পরিবর্তন ঘটাতে হবে। রাজনীতির গুরুত্ব সকলকেই বুঝতে হবে এবং দায়িত্ব পালন করতে হবে। অন্যথায় শোষণ-পীড়ন ও বঞ্চনা-প্রতারণা সহ্য করতে হবে।

বাংলাদেশে, জনগণের পক্ষ থেকে গণতন্ত্রী ও সমাজতন্ত্রী বলে আত্মপরিচয়দানকারী সংগঠনগুলো যদি এই ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনে অগ্রসর না হয়, উদ্দেশ্যনির্ণয়ে ও উদ্দেশ্যনিষ্ঠায় দুর্বলতার পরিচয় দেওয়া, দেশ-কাল উপযোগী নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টিতে সফল না হয়, তাহলে অল্প সময়ের মধ্যেই একটি সুদীর্ঘ ঐতিহাসিককালের জন্য পুনরুজ্জীবিত ধর্মীয় শক্তির রাষ্ট্রক্ষমতা দখল অনিবার্য হবে। গণতন্ত্রের নামে অনাচার, জুলুম-জবরদস্তি ও দুর্নীতি দেখে সাধারণ মানুষ অসহায় বোধ করছে এবং ধর্মের দিকে ঝুঁকছে। অনেক মানুষ অদৃষ্টবাদী হয়ে পড়েছে, গণতন্ত্রী ও সমাজতন্ত্রীদের থেকে নেতৃস্থানীয় কেউ কেউ ধর্মীয় ধারায় চলে যাচ্ছেন। আমরা বাংলাদেশে গণতন্ত্রী ও সমাজতন্ত্রীদের ব্যর্থতা দেখতে চাই না, সাফল্য দেখতে চাই – পূর্ণ সাফল্য। আমরা আমাদের জাতির জীবনে এবং গোটা মানবপ্রজাতির মধ্যে নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে মহান নেতৃত্বের আত্মপ্রকাশ ও মহান সব সম্ভাবনার বাস্তবায়ন চাই। মানবীয় প্রচেষ্টায় ক্রমে পৃথিবীকে স্বর্গে পরিণত করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করতে হবে।

গ্রন্থপঞ্জি

1.             Oswald Spengler, The Decline of the West, 2 vols (Eng. trans), New York, 1926, 1928.

2.             Albert Schweitzer, The Decay and Restoration of  Civilization (Eng. trans.), London, 1923.

3.             Civilization and Ethics (Eng. trans.), London, 1923.

4.             Arnold Toyenbee, The World and the West, London, 1912.

5.             A Study of History (abridgement of volumes I-IV by D.C. Somervell), New York, 1946.

6.             H.G. Wells, A Short History of the World, Penguin Books, 1946.

7.             Anindita N. Balslev edited, On World Religions, New Delhi, 2014.

8.             V. Gordon Childe, What Happened in History, London 1963.

9.             Man Makes Himself, Penguin Books, 1951.

10.           Albert Einstein, Ideas and Opinions, Rupa and Co, New Delhi, 2008.

11.           Fernanad Braul, A History of Civilizations, Penguin Books, 1993.

12.           R. Palme Dutt, Problems of Contemporary History, London, 1963.

13.           Herbert Marcuse, One-Dimentional Man, G.B., 1964.

14.           Albert Bergesen edited, Crises in the World-System, London, 1983.

15.           Errol E. Harris & James A. Yunker edited, Toward Genuine Global Governance, London, 1999.

16.           Our Global Neighbourhood : Report of the Commission on Global Governance, Oxford Universtiy Press, 1995.

17.           Han Nianlong, Diplomacy of Contemporary China, Hong Kong, 1990.

18.           Rebert Cox, Approaches to World Order, New York, 1996.

19.           Meghnad Desai & Paul Redfern edited, Global Governance : Ethics and Economics of the World Order, New York, 1995.

20.           J.G. De Beus, The Future of the West, London, 1953.

21.           Bertrand Russel, Has Man a Future, London, 1961.

22.           Human Society in Ethics and Politics, London, 1958.

23.           Power : A New Social Analysis, New York, 1938.

24.           History of Western Philosophy, London, 1980.

25.           Erich Fromm, The Sane Society, New York, 1955.

26.           The Fear of Freedom, G.B. 1942.

27            To Be or To Have, G.B., 1940.

28.           Francis Fukuyama, The End of History and the Last Man, first published in the USA, in Great Britain and the Peuguin Books. 1992.

29.           Samuel P. Huntington, The Clash of Civilizations and the Remaking of World Order, first published in the USA, 1996, published in Penguin Books, 1997.

30.           Muhammad Yunus, Building Social Business : the New Kind of Capitalism that Servers Humanity’s Most Pressing Needs, USA, 2010.

31.           Creating a World without Poverty : Social Business and the Future of Capitalism, New York, 2007.

32.           Eric Hobswn, How to Change the World : Reflections on Marx and Marxism, Yale University Press, 2011.

33.           Ernest Barker, National Character; London, 1948.

34.           J. B. Bury, The Idea of Progress, New York, 1960.

35.           John, M. Hunn, Contemporary Crisis of the Nation-State, Washington DC, 1994.

36.           John Dewey, Philosophy and Civilization, New York,1931.

37.           Joseph E. Stiglitj, Globalization and Its Discontents, New York, 2002.

38.           Nicholas Hagger, The World Government : A Blueprint for a Universal World State, UK, 2010.

39.           Uoity Yang, A Global State through Democratic Federal World Government, UK, 2011.

40.           Samir Amin, The World We Wish to See, New York, 2009.

41.           Willium Morris, How We Live and How We Might Live, Kolkata, 2012.

42.           Saval Sarkar, Eco-Socialism or Eco-Capitalism, London, 1999.

43.           Barbara Parkar, Introduction to Globalization and Business, New Delhi, 2005.

44.           Gown Baylis, Steve Smith, Patricia Owners, The Globalization of World Politics, Oxford University Press, UK, 2008.

45.           Edward Said, Orientalism, Vintage Books, London, 1990.

46.           Hans Lofgren & Prakash Sarangi edited, The Politics and Culture of Globalization, Delhi, 2009.

47.           Zygmust Beumah, Postmodern Ethics, Blackwell, Oxford, UK, Cambridge, USA, 1996.

48.           Culture and Imperialism, Vintage Books, 48London, 1994.

৫০.           সমির আমিন ও ফ্রাঁসোয়া উতার সম্পা., প্রতিরোধের বিশ্বময়তা, কলকাতা ২০০৪।

৫১.           বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ইতিহাস (দুই খণ্ড), কলকাতা, ১৯৮৬।

৫২.           কাভালজিৎ সিং (মনোয়ার মোস্তফা ও এম এম আকাশ-অনূদিত), বিশ্বায়ন : কিছু অমীমাংসিত প্রশ্ন, ঢাকা,  ২০০৫।

৫৩.           মিয়কুমার বাগচি-সম্পাদিত, বিশ্বায়ন : ভাবনা দুর্ভাবনা (দুই খণ্ড) কলকাতা, ২০০২।

৫৪.           জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিকল্প বিশ্বায়ন, কলকাতা, ২০০৪।

৫৫.           শোভনলাল দাশগুপ্ত, সমাজ-মার্কসতত্ত্ব ও সমকাল, কলকাতা, ২০০৯।

৫৬.          শামসুজ্জোহা মানিক, মার্কসবাদের সংকট ও বিপ্লবের ভবিষ্যৎ, ঢাকা, ২০১০।

৫৭.           উইল ডুরান্ট, সভ্যতার জন্ম; বাংলা অনুবাদ : কিউ. এন. জামান, বাঙলায়ন, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১৩।

৫৮.           আনু মাহমুদ, বাংলাদেশে এনজিও, ঢাকা, ২০১১।

৫৯.           আনু মুহাম্মদ, বিশ্বায়নের বৈপরীত্য, ঢাকা, ২০০৩।

৬০.          রতনতনু ঘোষ-সম্পাদিত, বহুমাত্রিক বিশ্বায়ন, ঢাকা ২০০৯।

৬১.          আবুল কাসেম ফজলুল হক ও মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম সম্পা., মানুষের স্বরূপ, ঢাকা, ২০০৭।

৬২.          শ্যামলী গুপ্ত, মালিনী ভট্টাচার্য ও ইশিতা মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত, নারী ও বিশ্বায়ন, কলকাতা, ২০০৭।

৬৩.          মাসুদুজ্জামান ও ফেরদৌস হোসেন-সম্পাদিত, বিশ্বায়ন : সংকট ও সম্ভাবনা, ঢাকা, ২০০৪।

৬৪.          বদরুদ্দীন উমর, সাম্রাজ্যবাদের ধ্বংসের মুখে সমাজতন্ত্রের পদধ্বনি, ঢাকা, ২০১২।

৬৫.           এনজিও : দরিদ্রতা : উন্নয়ন, ঢাকা, ২০১৪।

৬৬.          ফকরুল চৌধুরী  সম্পা. সিভিল সোসাইটি, ঢাকা, ২০০৮।

৬৭.          অমল বন্দ্যোপাধ্যায়, উত্তর-আধুনিক চিন্তা ও কয়েকজন ফরাসি ভাবুক, কলকাতা, ২০১১।

(জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশনের আয়োজনে ২৮শে নভেম্বর ২০২৪-এ ‘জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক গুণিজন
বক্তৃতা’-এ পঠিত)