সম্পাদকীয়

চল্লিশের ও পঞ্চাশের দশকে নর-নারীর সম্পর্কের নতুন মূল্য নিরূপণ, ফ্রয়েডীয় বিশ্লেষণে মানবমনের অন্ধকার দিক সম্পর্কে নবীন আলোকপাত ও মার্কসবাদী সাহিত্য-আন্দোলনের ভেতর দিয়ে মানবিক চেতনার বিকাশ বাংলা ছোটগল্পের অন্তঃপুরে নতুন চেতনার সৃষ্টি করেছিল। একই সঙ্গে শিল্প ও সাহিত্যের সৃজনভূমিতে এই বিভাব নব চৈতন্যের সৃষ্টি করেছিল। গতানুগতিকতামুক্ত নব্য জীবনবাদী ধারার সূচনা বাংলা ছোটগল্পকে পরিণতমনস্ক করে তুলেছিল। লেখা হয়েছিল এমনসব ছোটগল্প যা ছিল দ্যুতিময়, জীবনের নানাদিকের উন্মোচনে ঋদ্ধ। 

বাংলা ছোটগল্পের ধারায় এই সমৃদ্ধি এবং তরুণ গল্পকারদের জীবনের বহুকৌণিক দিক নিয়ে চিত্রায়ণ গতানুগতিক ধারায় নতুন অভিঘাত সৃষ্টি করেছিল। এতদিন অন্ত্যজ ও প্রান্তিক মানুষের বড় কোনো স্থান ছিল না সাহিত্যের আঙিনায়। কোমল ভাবাবেশ গল্পের অন্তঃশরীরে বৃহত্তর কোনো জীবন-চেতনা তুলে ধরতে পারেনি। নিচুতলার মানুষেরা সেদিন ক্ষোভ, যন্ত্রণা, দুঃখ নিয়ে, কখনোবা এই দুঃখ-বেদনাকে জয় করার প্রত্যয় নিয়ে সাহিত্যে উপজীব্য হয়ে উঠল।
রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছের অবিস্মরণীয় সব গল্পে জীবনের মানবিক দিকের প্রতিফলন বাংলা ছোটগল্পের দিগন্তে প্রসারিত চেতনার জন্ম দিয়েছিল। পরবর্তীকালের ছোটগল্পকাররা এই ধারায় অবগাহন করে বিচিত্রমুখী, নিরীক্ষাপ্রবণ ও জীবনের নানাদিক প্রতিফলনে বিশ্বস্ত হয়ে উঠেছিলেন।
বাংলা ছোটগল্প রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করেছিলেন জীবনের বহুবিচিত্র অনুষঙ্গকে প্রতিফলিত করে। রবীন্দ্রনাথের কাছে সেজন্য আমাদের ঋণের শেষ নেই। বিশ্বজগৎ এবং জীবনকে সম্পূর্ণভাবে দেখার চোখ তিনি খুলে দিয়েছিলেন।
পঞ্চাশের দশক থেকে বাংলাদেশের ছোটগল্পও নানাভাবে সমৃদ্ধ হতে থাকে। বৈরী রাজনৈতিক বাস্তবতা এই সৃজনধারাকে ব্যাহত করতে পারেনি। এ-অঞ্চলের নদী, মাটি ও মানুষের সঙ্গে ছোটগল্পকারদের নিবিড় সংযোগের ফলে এবং বোধ ও বুদ্ধির প্রয়োগে ছোটগল্প তার বৈশিষ্ট্য নিয়ে উজ্জ্বল হতে থাকে।
ষাটের দশকে এমনসব ছোটগল্প রচিত হলো, যা ছিল জীবন ও সময়চেতনার দিক থেকে মনোগ্রাহী ও শিল্পিত রূপায়ণ।
কালি ও কলম জন্মলগ্ন থেকে যতেœর সঙ্গে নানা ধারার ছোটগল্পের পরিচর্যা করে আসছে। বিশেষত বাংলাদেশের নবীন গল্পকারদের রচনায় জীবনের নানাদিক রূপায়ণের প্রয়াস আমাদের সত্যিকার অর্থেই আশান্বিত করেছে। আমরা ভালো বোধ করেছি এদেশের ছোটগল্পে উজ্জ্বল শিল্পচৈতন্য ও জনজীবনের নানাদিক প্রতিফলনের প্রয়াস দেখে। এ-সংখ্যায় আমরা বাংলাদেশের ছোটগল্পের সেই সমৃদ্ধি ও সম্ভাবনাকেই ধরে রাখতে চেয়েছি। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমরা চেষ্টা করেছি এ-সংখ্যাটিকে সমৃদ্ধ করতে। এ-গল্পসংখ্যায় যা আছে তা এদেশের ছোটগল্পের নানা প্রবণতার তাৎপর্যসঞ্চারী পরিচয় বহন করছে, এ-ব্যাপারে আমাদের সন্দেহ নেই। আমরা এ-সংখ্যায় বিশেষ গুরুত্ব ও প্রাধান্য দিয়েছি নবীন ছোটগল্পকারদের রচনার প্রতি।
কালি ও কলম কবি আবুল হোসেন এবং শিল্পী সুবীর চৌধুরীর তিরোধানে গভীরভাবে শোকাহত। এঁরা দুজনই ছিলেন কালি ও কলমের সুহৃদ। পরের সংখ্যায় এ দুজনকে নিয়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপক রচনা পত্রস্থ হবে।