সরস কথাকার সৈয়দ মুজতবা আলী

‘প্রথম যখন ঢাকাতে ঘোড়দৌড় চালু হল তখন একটি কুট্টি গিয়ে যে-ঘোড়াটাকে ব্যাক করল সেটা এল সর্বশেষে। বাবু বললেন, এ কী ঘোড়াকে ব্যাক করলে হে? সক্কলের শেষে এল?

কুট্টি হেসে বলল, কন্ কি কর্তা, দেখলেন না, ঘোড়া তো নয়, বাঘের বাচ্চা; বেবাকগুলোকে খেদিয়ে নিয়ে গেল।

আমি যদি নীতি-কবি ঈসপ কিংবা সাদি হতুম, তবে নিশ্চয়ই এর থেকে মরাল ড্র করে বলতুম, একেই বলে রিয়েল, হেলথি, অপটিমিজম।’ (‘কুট্টি’, বড়বাবু)

এমনি করেই ঢাকার কুট্টি-রসিকতার মেজাজকে তুলে ধরেছেন মুজতবা আলী রকমফের চুটকিতে। এই চুটকিগুলি কুট্টিদের ধারালো রসিকতার ঝিলিক। এই সাধারণ শ্রমজীবী গাড়োয়ান শ্রেণির রুচিবোধের ও উপস্থিত বুদ্ধির পরিচয় পেয়ে আমরা চমৎকৃত হই।

১৯০৪ সালে ১৩ই সেপ্টেম্বর সৈয়দ মুজতবা আলীর জন্ম বাংলাদেশের শ্রীহট্ট জেলার করিমগঞ্জে। তাঁর পরিবারধারা শিক্ষা আর রুচিকৌলীন্যে ছিল স্বতন্ত্র। ঠাট্টা করে মুজতবা আলী নিজেকে বলেছেন এই পরিবারের ‘একমাত্র ব্ল্যাকশিপ’। (‘দর্পণ’, কত না অশ্রুজল)। তা এই ব্ল্যাকশিপই শান্তিনিকেতন, আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়, বার্লিন আর বন বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিম-চষা। কখনো অধ্যাপক, কখনো অধ্যক্ষ, আবার কখনোবা আকাশবাণীর কেন্দ্র অধিকর্তা। পনেরো-ষোলোটি ভাষা হজম করেছেন তিনি, বলতে গেলে তিনি হলেন দ্বিতীয় হরিনাথ দে। বই লিখেছেন অসংখ্য – যেমন, দেশে বিদেশে, পঞ্চতন্ত্র (১ম ও ২য় খণ্ড), ধূপছায়া, চাচা কাহিনী, অবিশ্বাস্য, শবনম্, হিটলার, চতুরঙ্গ, বড়বাবু, ভবঘুরে, রাজা উজির, দ্বন্দ্বমধুর প্রভৃতি।

দুই

গল্প বলার এক অসাধারণ চলনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন সৈয়দ মুজতবা আলী। ‘কলের একদিক দিয়ে গরু ঢোকানো হচ্ছে, অন্যদিক দিয়ে জলতরঙ্গের মতো ঢেউয়ে ঢেউয়ে মিলিটারি বুট বেরিয়ে আসছে, টারালাপু টারালাপ করে, গাঙ্গুলিমশাই আর অন্যান্য ক্যাডেটরা বসে আছেন পা লম্বা করে, আর জুতোগুলো ফটাফট ফটাফট করে ফিট হয়ে যাচ্ছে – এ গল্প শুনে শান্তিনিকেতনের কোন ছেলে হেসে কুটিপাটি হয়নি?’ (‘কুট্টি’)

এরকম টুকরো টুকরো ঝকঝকে হাস্যরসে আমাদের সরস করে তোলেন মুজতবা আলী। ‘সেই প্রাচীন গল্প তাহলে আবার বলি। বার্নার্ড শ’র একটি নাট্য করে থিয়েটার থেকে গম্ গম্ তুলে ধরেছে, দ্রষ্টাদের সপ্রশংস চিৎকার, ‘নাট্য লেখককে স্টেজে বেরুতে বলো, আমরা তাকে দেখব’। শ’ এলেন। মিনিট পাঁচ ধরে চললো তুমুল হর্ষরব, করতালি। সবাই যখন শান্ত হলেন এবং শ’ তাঁর ধন্যবাদ জানাবার জন্য মুখ খুলতে যাবেন, এমন সময় সর্বশেষ সস্তা গ্যালারি থেকে একটা আওয়াজ এল ‘বূ বূ বূ বূ’। শ’ ওইদিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ব্রাদার, ঠিক বলেছ; এ নাট্যটা রদ্দি। কিন্তু তোমাতে-আমাতে, মাত্র দুজনাতে, এই শত শত লোকের পাগলামি ঠেকাই কি করে’। (‘অর্থং অর্থং’, পঞ্চতন্ত্র, ২য় খণ্ড)।

আর একটি দারুণ হাসির প্রসঙ্গে আসা যাক।  ‘একদা জনৈক অর্থ-পিশেচ, মজ্জা-কিপটে কোটিপতি – কখনো কানাকড়িটি দান করেছে একথা তার কোন হাতই জানে না – এসেছে এক রাব্বির কাছে। জানালার কাছে  নিয়ে গিয়ে রাব্বি তাকে বললেন, ‘বাইরের দিকে তাকিয়ে আমায় বলো, কি দেখতে পাচ্ছো।’ ধনী বললেন, ‘লোকজন – বিস্তর মানুষ।’ রাব্বি বললেন, ‘উত্তম প্রস্তাব।’ তারপর একটা আয়নার সামনে তাকে দাঁড় করিয়ে শুধোলেন, ‘এবার কি দেখছ?’ ‘আমি নিজেকে দেখতে পাচ্ছি -’ বলল কিপটে। ‘ততোধিক উত্তম প্রস্তাব’, বললেন রাব্বি, ‘এইবার শোনো বৎস, কান পেতে মন দিয়ে। জানলার শার্সি কাঁচের তৈরি, আয়নাও কাঁচের তৈরি – তফাৎ কী? আয়নার পিছনে রয়েছে অতিশয়, হাল্কা চেয়েও হাল্কা সামান্য একটু রূপোর প্রলেপ – ধর্তব্যের মধ্যেই নয়। কিন্তু বৎস, যেই না এল সামান্যতম রূপো, অম্নি তুমি আর অন্য মানুষকে দেখতে পাও না, দেখতে পাও শুধু নিজেকে।’ (‘ইজরায়েল বিশ্বের প্রবাদ সত্যরূপে গণ্য হবে’, পঞ্চতন্ত্র, ২য় পর্ব)।

তিন

একটা দেশের রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি ও তার ভৌগোলিক চালচলনে মিলিয়ে মিশিয়ে এমনই এক মজাদার খানা তৈরি করেছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী, যা কমবেশি হজমক্ষমতা যার যাই থাকুক না কেন, সে-খাবার সব রকমের পাঠকের চোখে রুচবে আর মাথায় সাধ্যিমতো পরিপাকও হবে। সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে বিদেশে এমনই এক বই যা কখনো বাসি হয় না। হুটপাট শাসক বদলের মধ্য দিয়ে আফগানিস্তান বরাবরই ছেঁড়াফাটা হয়। লুটপাটের দমকা দমকা টাইফুনে সাধারণ মানুষের জীবনধারা ক্রমাগত উলচাল হয়। কোনো নিয়মকানুনই থিতু হওয়ার সময় পায় না। শাসক বদলের সঙ্গে সঙ্গে পুরনো নিয়মকানুন উপড়ে আবার নতুন নতুন নিয়মকানুনের পত্তনি হয়। তবু এই রুখোশুখো মাটির প্রাণশক্তি শুকিয়ে যেতে যেতেও আবার দাঁড়িয়ে ওঠে।

‘দূর থেকে মনে হল ফ্যাকাশে সাদা গাছগুলোতে বুঝি কোনওরকম সবুজ পোকা লেগেছে। কাছে গিয়ে দেখি গাছে গাছে অগুনতি ছোট ছোট পাতার কুঁড়ি, জন্মের সময় কুকুরছানার বন্ধ চোখের মতো। তারপর কয়েকদিন লক্ষ্য করিনি, হঠাৎ একদিন সকালবেলায় দেখি সেগুলো ফুটেছে আর দুটি দুটি করে পাতা ফুটে বেরিয়েছে – গাছগুলো যেন সমস্ত শীতকাল বকপাখির মত ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার পর হঠাৎ ডানা মেলে ওড়ার উপক্রম করছে। … কাবুল নদীর বুকের ওপর জমে যাওয়া বরফের জগদ্দল-পাথর ফেটে চৌচির হল। পাহাড় থেকে নেমে এল গম্ভীর গর্জনে শত শত নব জলধারা – সঙ্গে নেমে আসছে লক্ষ লক্ষ পাথরের নুড়ি আর বরফের টুকরো। নদীর উপরে কাঠের পুলগুলো কাঁপতে আরম্ভ করেছে – সিকন্দর শাহের আমল থেকে তারা হাঁটু ভেঙে কতবার নুয়ে পড়েছে, ভেসে গিয়েছে, ফের দাঁড়িয়ে উঠেছে তার হিসেব কেউ কখনো রাখতে পারেনি।’ (দেশ বিদেশ, একত্রিশ পরিচ্ছদ)

আফগানিস্তানের মাটি-মানুষ সম্পর্কে এতো ক্ষীরসার মন্তব্য আর হয় না। দেশে বিদেশে এমনি এক গল্পখোর মানুষজনের কথা বলে যাদের প্রত্যেকে গল্প বলা আর শোনার ঘোরে যন্ত্রের মতো খাবার তুলে তুলে খায়। সেক্ষেত্রে যে পোলাও খাচ্ছে সে পোলাওই খেতে থাকে, যে মাংস খাচ্ছে সে মাংসই। বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন এক অধ্যাপকের কথা আছে যার স্ত্রী-পুত্র মারা গেলে তিনি টাল খান, কিন্তু ভাই মারা গেলে একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। আছে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলকারী আমির হবিবউল্লা খানের কথা, যিনি তখত-তাউস দখল করেও খান সাদা রুটি, পনির আর কিসমিস। কচিৎ কখনো দু-মুঠো পোলাও। আর আছে সবার ওপর আলী সাহেবের দেখভাল করার পানশিরের আবদুর রহমান, যার ময়লা পাগড়ি ‘বরফের চেয়ে শুভ্রতর’। এই আবদুর রহমান চরম রাজনৈতিক উপদ্রবের মধ্যে ধ্বস্ত কাবুলে চরম বিপদে-আপদে অর্ধাহার-অনাহারে  আলী সাহেবের শরিক হয়ে রয়ে গেছে। এমন বুকঢালা ভালোবাসার মানুষ আলী সাহেব আর কজন পেয়েছেন জানি না, কিন্তু এই কাহিনির প্রায় ছত্রে ছত্রে তিনি সেই ভালোবাসাকে পরম যত্নে খোদাই করেছেন।

আর সবার ওপর দেশে বিদেশে-এর সরস কথাচল। সারা বইয়ে ছড়িয়ে থাকা কথা বলার এই দরাজ প্রসন্নতা কোথাও ধাক্কা খায়নি। ‘কিন্তু কী বেশভূষা। পাজামা পরেনি, পরেছে পাতলুন। কয়েদীদের পাতলুনের মতো সেটা নেমে এসেছে হাঁটুর ইঞ্চি তিনেক নিচে, ঊরুতে আবার সে পাতলুন এমনই টাইট যে মনে হয়, সপ্তদশ শতাব্দীর ফরাসী নাইট সাটিনের থ্রিচেস্ পরেছে। শার্ট কিন্তু কলার নেই। খোলা গলার উপর একটা টাই বাঁধা। গলাবন্ধ কোট, কিন্তু এত ছোট সাইজের যে বোতাম লাগানোর প্রশ্নই ওঠে না তাই ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে শার্ট আর টাই। দু’কান ছোঁয়া হ্যাট ভুরু পর্যন্ত গিলে ফেলেছে। আবদুর রহমান নয়া বাদশার হুকুমমফিক ‘দেরেশি পুশিদম’ অর্থাৎ ‘সুট পরেছি’। আবার কিছুদিন পর বাচ্চায়ে সকাল যখন শহরে ঢোকার উপক্রম করেছে তখন কাবুলি ‘দেরেশি’ ফেলে ফের ‘মুসলমান’ হয়েছে।’

চার

‘একদা শয়তানের রাজা ধাড়ি শয়তান এক বাচ্চা শয়তানকে তালিম দিচ্ছিল, সৎপথগামীদের কোন কোন পদ্ধতিতে বিপদগামী করা যায়।’ এমনি করেই পঞ্চতন্ত্র-এর দ্বিতীয় পর্বে এক গল্প ফেঁদেছেন সৈয়দ মুজতবা আলী। ধাঁড়ি শয়তানের কথায়, ‘আচারনিষ্ঠ সাধুজনকে বরঞ্চ আমাদের পথে (মানবীয় ভাষায় কুপথে) নিয়ে যাবার চেষ্টা করো। কিন্তু জ্ঞানী পণ্ডিতকে সমঝে-বুঝে চলো। ওরা বড়ই ভীষণ প্রাণী। সৃষ্টির আদিমকাল থেকে ওরাই আমাদের আদিম দুশমন।’ তা বাচ্চা শয়তান তো অবাক। তপস্বীরা তো সারাদিন জপতপ নিয়ে থাকেন। শয়তানের কথা ভাবার তাদের অবসর কোথায়! বরং পণ্ডিতরা ‘খেতে পায় না, পরতে পায় না আর আকাট মূর্খ নিষ্কর্মারা বড় বড় চাকরীর পদবী নিয়ে ওদের মাথায় ডান্ডা বোলায়।’ হলো প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা। বাচ্চা শয়তান দেবদূত অর্থাৎ ফেরেশতার বেশ ধারণ করে এক আগাপাছতলা সাধুকে বলল, ‘তোমার তপশ্চর্যায় পরিতুষ্ট হয়ে আল্লা-তালা আমাকে পাঠিয়েছেন সশরীরে স্বর্গে নিয়ে যাবার জন্য। তুমি আমার স্কন্ধে আরোহণ কর।’ এই বলে সে বুরাকের অর্থাৎ পক্ষীরাজের মতো বেশ ধারণ করল। এদিকে ধেঁড়ে শয়তান নিশ্চিত মনে সবকিছু দেখছে। ‘সে বিলক্ষণ জানে, এসব আচারনিষ্ঠ জন বড় দম্ভী হয়।’ এরা ভাবে, সংসারের সর্বভোগ যখন ত্যাগ করেছি, তখন আর সর্বসুখ পাব না কেন? সুতরাং তপস্বী চেপে বসল সেই ভেজাল বুরাকের কাঁধে। তারপর যা হবার তাই হলো। সাধুর যখন জ্ঞান হলো তখন সে বিষ্ঠাকুণ্ডে। এরপর দেবদূতের বেশেই এক আলিমের কাছে গেল বাচ্চা শয়তান, পূর্ববৎ তাকেও স্বর্গে নিয়ে যাবার প্রস্তাব। পণ্ডিতের চড়াকসে মনে পড়ে গেল মুসা, ঈসা ও হজরত ছাড়া আর কেউ আল্লার সমীপবর্তী হবার সৌভাগ্য লাভ করেনি। সুতরাং তিনি এমন কিছু পুণ্যশীল ‘প্যাকম্বর’ নন যে আল্লা তাকে স্বর্গে যাবার জন্য ডেকে পাঠাবেন। তাই মৌলবী বললেন, এই ভেজালের রমরমায় তিনি কি করে বুঝবেন যে দেবদূতই তার কাছে এসেছেন। যদি দেবদূত ‘মূআজিজা কেরামৎ’ (গরৎধপষব) দেখাতে পারেন তবেই তিনি তার সঙ্গে যাবেন। বাচ্চা শয়তানের খুব আনন্দ। মৌলবী তাকে তার বদনার নালি দিয়ে বদনার ভেতর ঢুকতে বললেন। তৎক্ষণাৎ সেই শয়তান বদনার নালির ভেতর দিয়ে ঢুকে পড়ল। মৌলবী পাশের একটা পিড়ি বদনার ওপর চেপে তার ওপর আরো ভাল করে চেপে নিজে বসে বদনার নালিতে ঢুকিয়ে দিলেন একটা খেজুর। ধেঁড়ে শয়তান বুঝে ফেলল বাচ্চা শয়তানের আর রক্ষা নেই। সঙ্গে সঙ্গে সে মৌলবীর  পায়ে এসে পড়ল। বাচ্চাটাকে বাঁচাবার জন্য সন্ধি হলো যে, ‘শয়তান এবং তস্য গোষ্ঠী ঐ মৌলবী পণ্ডিত গোষ্ঠীর কাউকে প্রলোভিত করতে পারবে না।’ আজকের পৃথিবীর মানবসম্পদের যে বিপুল অপচয়, অপঘাত বিকৃতি ঘটে যাচ্ছে, তার উৎস বুঝতে গেলে এ-গল্পটি আমাদের সহায়তা করবে।

গল্প-উপন্যাস লেখার মধ্য দিয়ে সৈয়দ মুজতবা আলীর আরেকটি দিক দেখতে পাই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রেম যে মানুষকে কত বিচিত্র অরূপতায় তুলে ধরে মুজতবা আলী টুনি মেম, শবনম্ প্রভৃতি লেখায় তা দেখিয়েছেন। এক্ষেত্রে রবীন্দ্ররুচি যেন মুজতবা আলীর মধ্যস্থতায় স্নিগ্ধকোমল দেহ ধরে ধরে এগিয়ে গেছে। দুঃখ, বেদনা, বিরহ, বিচ্ছেদের ক্রমাগত উৎপীড়নের ভালোবাসা হারায়নি তার সজল আভায়। টুনি মেম-এর ভেতরে ‘এক অধ্যায়’ নামে ইতিহাস-আশ্রয় এক রোমান্স গল্পের এক জায়গায় একটি মুর্শিদিয়া গীত তুলে এনেছেন মুজতবা আলী। ‘দীপ নাই শলিতা নাই,/ কইয়ো গিয়া মুরশীদের ঠাঁই/ জ্বলে শখের বাতিলের/ কইয়ো গিয়া ও ভাই …।’ আসলে গল্প-উপন্যাস লেখার মাধ্যমে মুজতবা আলী শুধু আমাদের তাপিত হৃদযকে সোঁদা করেননি, তাঁর নিজেরও শুকনো কলজেকে সিক্ত করেছেন। বঞ্চিত, বিধ্বস্ত মানুষের প্রতি তাঁর দরদ গল্প-উপন্যাসে যেন বাগ মানেনি।

পাঁচ

অসংখ্য লেখা লিখে গেছেন সৈয়দ মুজতবা আলী। সাহিত্য, দর্শন, ভাষাতত্ত্ব, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, সামাজিক আচার-আচরণ – সবদিকই তাঁর কলম আলোকিত করেছে। শুধু এদেশেই নয়, বিদেশেও তিনি সমানভাবে সমাদৃত। তাঁর লেখা পড়লেই বোঝা যায়, উর্বর অতৃপ্তি তাঁকে আজীবন ছুটিয়েছে। তবে কোথাও তাঁর অচলা আনুগত্য নেই, নেই অন্ধ বিদ্বেষও। আপ্তবাক্যকে আপ্তবাক্য হিসেবে গ্রহণ করা ছিল তাঁর স্বভাববিরোধী। বরং বাদপ্রতিবাদের ভেতর থেকেই আপন মতামত তিনি গড়ে তুলেছেন। এতো বড় পণ্ডিত ছিলেন, তবু কোথাও ছিল না তাঁর আত্মজাহিরি। বরং তাঁর লেখাই প্রমাণ করে দেয়, যে-কোনো পরিবেশে যে-কোনো মানুষের সঙ্গে মনের সুখে-দুঃখে কথা বলায় তাঁর কোনো আড়ষ্টতা ছিল না। এ পোড়া দেশের মানুষকে তিনি হাসাতে চেয়েছেন। সে-হাসি কখনো নির্মল, কখনো ঝকঝকে। কখনো তা আমাদের ঝাঁকুনি দেয়, কখনো নিজেদের ভেতর গোঁড়ায়, আবার কখনোবা ভেতরজমা সব চাপ দমকায় কিছুক্ষণের জন্য হলেও উড়িয়ে দেয়। কোনো কোনো সময়ে হাসির ঢলে ভেসে যেতে যেতে আমরা খেয়াল করি না এই ছদ্ম-অনাবিলতার সুযোগ নিয়ে তিনি আমাদের বুকের গভীরে দু-একটা কাঁটা ঢুকিয়ে দেন। কয়েক ফোঁটা চোখের জলকে কাঁটা করার জাদু তিনিই জানেন। সব মিলিয়ে তিনি আমাদের দরাজ দেখতে বলেন, পড়তে বলেন ও গভীরভাবে ভাবতে বলেন। অনুকরণ নয়, আত্মমৌলিকতাকে সমৃদ্ধ করতে বারবারই পরামর্শ দেয় তাঁর লেখাগুলি।