গাঁথুনিতে সৃজিত হয় মানুষ, জনপদ, সমাজ ও তার বেদনার চিত্রমালা। মানুষের বেদনাকে মামুন হুসাইন ভালোবাসেন পরম মমতায় আর তার আদি-অন্ত চিনে নিতে চান নিবিড় আবেগে, মননে ও মনীষায়। শ্রেয়োবোধের দীপ্র আকাক্সক্ষায় তিনি তুলে আনেন সামাজিক দুঃখব্যথা, আদিবাসী যাতনার বিমূঢ় অবয়ব। তাঁর গল্পকথায় মানুষের ও সমাজের যে-অন্ধকার নিয়ত গ্রাস করে সবকিছু, তা এক মঙ্গল আলোয় শেষে দীপ্তিময় হতে চায়। এই মঙ্গল আলোই লেখকের আরাধ্য, সাধনার অপার্থিব ধন। অগণন অন্যায়-দুঃশাসন-অনিয়মের তিমির হননের মধ্য দিয়ে আসে স্নিগ্ধ এক মঙ্গলালোক – কথাশিল্পী মামুনের মানবিক ভালোবাসা। এমন নিরুপায় ভালোবাসা, প্রচ্ছন্ন সতেজ মানবিক প্রেমের দেখা মেলে জলছাপের চিত্রশালার ক্যানভাসগুলিতে।
সাঁওতাল জনপদে গল্পকথনের স্বকীয় যে-ভঙ্গি, স্মৃতি পরম্পরায় তা সংরক্ষণের অনন্য যে ধারা, তারই সূত্র ধরে গল্পকার বলে যান তাঁর আপন গল্পমালা। ‘দুঃখ লাগা’ আর তার মানবিক আখ্যান।
মুখে মুখে রচিত সাঁওতাল-উপাখ্যানে দেখা যায় আদি এই জনগোষ্ঠীর আপন সত্তার প্রকাশ; ব্যাপ্তি যার শুধু নিজ জনপদে, একান্ত পরিজনের স্মৃতিতে – ভালোবাসায়। অন্য মানুষে ভিন্ন জনপদে স্মৃতিসত্তার এই একান্ত অনুরাগ প্রকাশে তাদের বড় অনীহা। তাই তারা হৃদয়ের আখ্যান, স্মৃতির সারবত্তা শুধু নিপুণ ধরে রাখে হৃদয়ের প্রকোষ্ঠে, মস্তিষ্কের কোষে। এসব আপন অনুভূতি লিখে রাখতে তাদের সূক্ষ্ম রুচিতে বাধে। তাই কখনো এই আখ্যানের স্থান হয় না মায়াবী গ্রন্থে, সুচিন্তিত প্রতিবেদন কিংবা প্রবন্ধে। তারা বিশ্বাস করে, ‘অল খনাঃ থুতি গে সরেসা’ – লিখে রাখার চেয়ে মুখে বলা অনেক ভালো। তাই তারা মুখে বলে। মুখে মুখে আনন্দ-বেদনার যাবতীয় গল্পগাথা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পরিভ্রমণ করে। যেমন, জগৎ ও মানব সৃষ্টির পবিত্র আখ্যান তাদের স্মৃতি পরম্পরায় আজো উজ্জ্বল হয়ে আছে এভাবে – কেঁচো জলময় জগতের তলদেশ থেকে মাটি তুলে এনে কচ্ছপের পিঠে জমা রাখে; আর তাতেই তৈরি হয় পৃথিবী। স্মৃতিকথা তাদের আরো স্মরণ করিয়ে দেয় পিলচু হড়ম ও পিলচু ঘুড়ি তাদের আদি পিতা-মাতা। আর এই সেদিন পর্যন্ত, হিহিড়ি পিপিড়ি ছিল তাদের আদি নিবাস – ভূমিদস্যু দ্বারা দখল হওয়ার আগে।
শুধুই কি ভূমি দখলের স্মৃতি জ্বলজ্বলে হয়ে আছে? গত বছর, তার আগের বছর, তারও আগের বছর যাদের সিঁথির দখল নিয়ে সিঁদুর পরিয়ে দেওয়া হতো কিংবা সিঁদুর মুছে ফেলা হতো চিরতরে, সেই স্মৃতি সাঁওতাল মানুষ ভুলতে পারে না, যদিও তা প্রচলিত ইতিহাসের শ্রমসাধ্য বই-পুস্তকে স্থান পায়নি কখনোই। বিপরীতে, তারা কালের কৃষ্ণ পৃষ্ঠায় রক্তের অক্ষরে সাজিয়ে তোলে বেদনার কথা, মৃত্যুর কথা। এই রক্ত আসে পানসিরি সরেন, লুনকু, যসিন্তা সরেন, জগন্নাথ সরেন আর আলফ্রেড সরেনের মতো মানুষের তেজি ধমনী থেকে।
রক্ত ঝরে তাদের বিচিত্র কারণে – রক্তসম্পর্ক টোল খাওয়ায়, জ্ঞাতিধর্ম ত্যাগ করায়, উচ্চ ফলনশীল ঋণ নেওয়ায়, জমির অবৈধ মালিকানায় অথবা ভূমিতে ন্যায্য পানি চাওয়ায়। ভূমি দখলের আগে রক্ত ঝরার আগে নিমঘটু মুণ্ডুমালার কৃষকের কাতর আর্তি – ‘অবিনাশ দা, একটু জল দাও, আমার ক্ষেতটাকে বাঁচাও।’
কিন্তু ঈশ্বরীপুরে পানু টুডু ও অভিনাথের স্ত্রীর ক্ষেত শুকিয়ে ধানের চারা সাদা হয়ে আসে, তবু পানি নেই, দয়া নেই কোনোখানে। জমিতে পানিহীনতায় আর বিবেকহীনতায় অভিনাথ মারান্ডি আর তার অনুজ রাবি মারান্ডির মনে খুব দুঃখ লাগে। তারা যৌথ আয়োজনে জমির বুকের ওপর দুঃখ লাঘবের জন্য মারণ বিষ পান করে। জীবন দিয়ে তারা জমির তৃষ্ণা মেটায়।
শোকে বিহ্বল সাঁওতাল জনতা তখনো বলে, ‘অল খনাঃ থুতি গে সরেসা।’ তারা জানে, শোক পুষে রাখতে হয় হৃদয়ে আর স্মৃতিতে – বংশপরম্পরায়। কিন্তু এই শোক যাদের ছুঁতে পারে না সেই আমরাই লিখি শোকের অনুপুঙ্খ বৃত্তান্ত, তৈরি করি বিশেষজ্ঞ প্রশ্নমালা।
‘যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আপনি যাচ্ছিলেন তখন কি মনে হয়েছিল, জীবনটা আর বহন করতে পারছেন না, দ্রুত নিষ্পত্তি চাইছেন? তাহলে কিভাবে ভেবেছিলেন কি পদ্ধতিতে জীবন-প্রদীপ নির্বাপিত করবেন? ওই সময় উদ্বেগ, ভয়, ক্রোধ, জিঘাংসা, বিষাদ, বিবমিষা ইত্যাদির কথা স্মরণ হয়? আপনি কি মদ্যপায়ী? বন্ধুদের সঙ্গে, পরিবার-পরিজনের সঙ্গে যোগাযোগ কেমন? আপনি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী? এর আগে কখনো কি সচেষ্ট হয়েছিলেন আত্মহননে? আত্মহনন করতে হবে এমন কোন দৈব বাক্য শুনতেন অহরহ?’
এদিকে যুগল ভ্রাতার যৌথ আত্মহননে নিমঘটু গ্রামে আচম্বিতে স্তব্ধতা নেমে আসে। নিঃসীম এ-স্তব্ধতা গাঢ় হয়ে ওঠে অভিনাথের স্ত্রীর নিরুপায় বিলাপে, সন্তানের দিশাহীনতায়। হিউম্যান রাইটস অ্যাকটিভিস্টের ঝলমলে কন্যারা শোক প্রশমনের মোক্ষম কৌশল বাতলে দেয় – ‘তুমি তোমার যাতনা লিখতে পারো, আলিঙ্গন করো, গান শোনো, চিৎকার করো, বন্ধুদের সঙ্গে হাঁটো, সাইকেল চালাতে পারো, একা থাকো খানিকক্ষণ। ঘাসের ওপর খালি পায়ে হাঁটো, খুব ধীরে ধীরে শ্বাস নাও, পানিতে ইট-নুড়ি ছুঁড়ে দাও …’ – মনোবিকলনের এইসব লিখিত দাওয়াই মারান্ডি পরিবারের বিপন্নতা শুধু বাড়িয়েই চলে।
বিষণ্ন বিপন্নতার গাঢ় অন্ধকারে ডুবে যায় অভিনাথের স্ত্রী সন্তান আর নিমঘটু মুণ্ডুমালার তাবৎ মানুষ। অন্ধকারে দূর গির্জাঘর থেকে ভেসে আসে সান্ত্বনার পুলিটিশ দেওয়া সংযমের বাণী – ‘খ্রীষ্ট সকলের জন্যই মৃত্যুবরণ করেছেন, আর সকল মানুষের লক্ষ্যও এক ও অভিন্ন; … বন্ধুর জন্য জীবন দেওয়ার চেয়ে বড় ভালবাসা আর নেই। … হে প্রেমময় পিতা, সকল অমঙ্গল হতে আমাদের রক্ষা কর। পৃথিবীতে শান্তি প্রদান কর।’
কিন্তু শত শান্তি কামনায় সাঁওতাল চিত্রশালায় অনিয়ম আর নিপীড়নের জলছাপ মুছে যায় না, ম্লান হয় না সহসাই!
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.