সাঁঝে-সকালের ঝিঙা ফুল

বাইরের উঠোনে সাইকেলের প্যাডেলে পা রেখে হরিহর হাঁক দিলো, ‘এসো!’

ঘরের ভেতর ভ্যানিটি ব্যাগে এটা-ওটা, মায় নিজের মোবাইল ফোনটা গুছিয়ে নিতে নিতে অণিতা উত্তর করল, ‘হ্যাঁ, যাই।’

 

সকালবেলা। ঝলমলে রোদ উঠেছে। বাঁশঝাড়ে নিম-চল্লার গাছে কাক-কুইরি যেমন ডাকে, ডাকছে। বেগুনঝাড়ের বেড়ায় লতিয়ে-ওঠা কাবাগুড়ি ফল পেকে এখন টকটকে লাল!

হরিহর সাইকেলের বেলটায় আলতো চাপ দিয়ে ‘ট্রি-নি-টি’ করে বাজাতে লাগল আর সকালবেলার ঝলমলে আলোয় ধোয়া চারধারটা দেখতে লাগল।

ওই তো –

গোবর-নাদির ঝুড়ি-মাথায় দাঁতনকাঠি চিবুতে চিবুতে ভরতের বউ চলেছে নদীধারের পালজমিনে। সরকারি পাতকো থেকে ঘড়্রি ঘুরিয়ে জল তুলছে বিপস্নবের বউ নিতম্ব দুলিয়ে। চাতালে ডাঁই-করা তার ক্ষারে-ভেজা গাদাগুচ্ছের কাপড়! একটু বাদেই ধোপার পাটের মতোই চাতালে কাপড় আছড়ানোর আওয়াজ উঠবে – ছ-পা-ট! ছ-পা-ট!!

ছাগলের দড়ি-হাতে টানতে টানতে উদারডাঙার মাঠের দিকে নিয়ে চলেছে – ওই তো বস্নু-শাড়ি-পরা বৈকুণ্ঠের বউ! মাঠেই খুঁটি পুঁতে ছাগলটাকে ছেড়ে আসবে। সারাদিন খুঁটির চারধারে ঘুরে ঘুরে ছাগলটা ঘাস খাবে। বেলা ‘আড়’ হলে, অর্জুন-বট-পাকুড়ের ছায়ায় সারামাঠ ঢাকা পড়লে, কপট গালি দিতে দিতে ফের ছাগলটাকে টানতে টানতে ঘরে নিয়ে আসবে বৈকুণ্ঠের বউ।

অ, এই তো – বউগুলোর সারাদিনের নিত্যকর্ম-পূজাপাঠ-পদ্ধতি। তার মধ্যে তার বউ-ই কেবল ‘অঙ্গনওয়াড়ী’।

সাইকেলের প্যাডেলে পা দিয়ে হরিহর রেডি-ই ছিল। অণিতা হন্তদন্ত এসে সামনের দিকে সাইকেলের রডের ওপর বসল। বসে ঘড়ি-পরা ডান হাতটা এলিয়ে দিলো সাইকেলের হ্যান্ডেলে।

হরিহর দেখল – ‘টাইটান।’ ছটা পঁয়তালিস্নশ। ‘একটু দেরি হয়ে গেল’ বলেই সে সাইকেল ছুটিয়ে দিলো ঘোড়ার বেগে!

 

পেরিয়ে গেল বড়োডাঙা-কুসুমতলা-সীতানালা খালপাড়-খান্দারপাড়া- দেউলবাড়-তিলকমাটি হুড়ি –

যে-দেশে যা নাম। এদেশের লোকেরা জঙ্গলাকীর্ণ উঁচু টিলাকে বলে ‘হুড়ি’। এভাবেই কি দেউলবাড় আর নিচু-পাতিনা গ্রামের মধ্যবর্তী পাতলা অরণ্যসংকুল দেড়-দুমাইল বিসত্মৃত উঁচু টিলার নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘তিলকমাটি হুড়ি’?

না বোধহয়। অর্থটা পুরো হলো না। ‘হুড়ি’ তো ‘হুড়ি’ –  তার সঙ্গে ‘তিলকমাটি’ শব্দটাও জুড়ে আছে যে! আসলে ওই যে ‘পাতলা অরণ্যসংকুল’ – তার মানে জঙ্গলের মাঝেমধ্যে ফাঁকা জায়গায় স্পষ্টত দৃশ্যমান হলুদ রঙের মাটি, যাকে বলে ‘তিলকমাটি’, যা দিয়ে তল্লাটের বোষ্টম-বোষ্টমিরা নাকে-কপালে-গলায় রসকলি আঁকে, সাঁওতাল বউড়ি-ঝিউড়িরা মাটির দেয়ালে ‘মধুবনী আর্ট’ দেয় – সেই তিলকমাটি-শোভিত হুড়িই ‘তিলকমাটি হুড়ি’।

বাঁদিকে তিলকমাটি হুড়ি, ডানে নদী সুবর্ণরেখা। নদীর পাশ দিয়ে গরু গাড়ি, সাইকেল আর পায়ে চলার রাস্তা। আগে ভোর ভোর রাস্তায় জনমনুষ্যের পায়ের ছাপ পড়ার আগে ধুলোয় ছাপ দেখা যেত চিতাবাঘের পায়ের।

এখন সে-চিতাও নেই, তার পায়ের ছাপ মেলাও দুষ্কর। না, ‘বাটা কোম্পানি’ তার পায়ের জুতসই জুতো বানাতে চাইলেও তার আর মাপ পাবে না। অথচ আগে আগে আশপাশের গ্রামের লোকেরা, গরুবাগালরা, সকাল হলেই কাঠি নিয়ে মাপতে বসত – ‘এক বিঘৎ দু-আঙুল’ – ‘এক চাঁখর এক আঙুল’ – ‘দু বিঘৎ থেকে ছ আঙুল কম’ –

তবে চিতা না হোক, দলমা-রাঁচি-রানিচুম্বার ওদিক থেকে ধান কি আখ পাকার মরশুমে দলে-দঙ্গলে ‘কালাপাহাড়ের’ মতো এখনো নেমে আসে হাতির পাল! তখন রাস্তার ধুলোয় পদ্মফুলের বড় বড় গোলাদার পাতার মতো হাতির পায়ের ছাপ দেখা যায়।

তা নিয়ে বড়দের তেমন কৌতূহল থাকে না। অবশ্য ছোটরা, গরু-চরানে ছাগল-চরানিরা হাতির পায়ের ছাপে একসঙ্গে দু-তিনজনের পায়ের ছাপ এঁকে ছড়া কাটে –

হাতি তোর গোদা গোদা পা।

হাতি তুই নেদে দিয়ে যা \

 

জলে ‘খল্বল্’ আওয়াজ তুলে হাতে জুতো নদী পারাপার করছে দুয়েকজন। তিলকমাটির ডুংরিতে গরু চরাতে এর মধ্যেই উঠে পড়েছে গরুবাগাল-কাড়াবাগালরা। কোথাও রাস্তার ধুলোয় হাতি-চিতার পায়ের ছাপ পড়ে নেই। শুধু ডুংরি থেকে চুরনি-গরুর গলায় বাঁধা ‘ঠরকা’র বাজনা বাজছে – ঠ-র-ক্! ঠ-র-ক্!!

সাইকেল না থামিয়ে প্যাডেল করতে করতেই হরিহর ফুর্তিতে জিজ্ঞাসা করল, ‘ডাকব?’

অণিতা হকচকিয়ে বলল, ‘কাকে?’

‘স্যাঙাৎকে।’ বলেই অণিতার অনুমতির অপেক্ষা না করে হরিহর সুরেলা গলায় ডেকে উঠল – ‘স্যা-ঙা-ৎ – হে-এ-এ-এ-এ-এ!’

সুরেলা ডাকের প্রত্যুত্তরে সে-ডাক তিলকমাটি হুড়ির গায়ে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এলো পুনরায় হরিহর-অণিতার কানে – ‘স্যা-ঙা-ৎ – হে-এ-এ-এ-এ-এ!!!’

অণিতা-হরিহর দুজনেই হেসে উঠল।

 

এখন দিনের বেলায়, প্রকাশ্য দিবালোকে, যখন এখানে-সেখানে ইতস্তত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দু-চারজন, তাদের গরুমোষ নিয়ে গরুবাগাল-কাড়াবাগালরাও উপস্থিত, এই মুহূর্তে এ-ডাক হাসির বিষয়বস্ত্ত হলেও সায়াহ্নে, যখন ওই অর্জুন-পাকুড়ের মাথার ওপর সন্ধ্যাতারাটি জ্বলজ্বল করে, এই দেড়-দুমাইল বিসত্মৃত বনস্থলীতে একটা জনমানুষও থাকে না, কেবল মশানির দহের ওদিকটায় ভুসাকালি-মাখা-মুখের হুলুম ঝুলুম করে বেরিয়ে আসা ‘ভুঁড়া-শিয়াল’ দেখে ঘেউ ঘেউ করতে থাকে দু-চাট্টা কুকুর, তখন এ-রাস্তায় চলমান পথিকের একমাত্র বল-ভরসা ওই ‘স্যাঁঙাৎ’ –

সে ডাক দেয় – ‘স্যা-ঙা-ৎ – হে-এ-এ-এ-এ-এ!!’

অমনি তার কানে বাজে – ‘আছি – হে-এ-এ-এ-এ-এ – ’

সত্যি সত্যি কে যেন তার সামনে-পেছনে থেকে সাহস জোগায় – ‘চল, চল! ভয়ের কী! আমি তো আছি!’

তদুপরি আশপাশের গ্রামের লোক – যে কিনা সদ্য সদ্য গোহালে ফেরা তার গরুগুলোর জাবনার জন্য ‘ঘ্যাঁ-এ-স-র্’ ‘ঘ্যাঁ-এ-স-র্’ করে বসেছে খড় কাটতে, যে কিনা বিল-বাতান থেকে এইমাত্র উঠে এসে উঠোনে জলের কলসি গড়িয়ে পা ধুয়ে পুবের দিকে জোড়-হাত করে দাঁড়িয়েছে সান্ধ্য-আহ্নিক সারতে, যে কিনা অনেকদূর সাইকেল চালিয়ে ধূলিধূসরিত দেহে এই তো সবে তাদের ঘরের নাচদুয়ারে একটা পা রেখেছে মাটিতে – ‘স্যা-ঙা-ৎ হে-এ-এ-এ’ ডাক শুনে ভাবল নির্ঘাত কোনো ডরপুক্ লোক তিলকমাটি হুড়ির হাবড়ে পড়েছে!

অমনি সাইকেল ঘুরিয়ে, চটজলদি আহ্নিক সেরে, থাকল পড়ে জাবনার খড়কাটা – চলল তারা লাঠি-লণ্ঠন-হাতে উদ্ধার করতে ডরপুক্ লোকটাকে।

হয়তো এর মধ্যে আবারো ডাক আসে – ‘স্যা-ঙা-ৎ হে-এ-এ-এ-এ-এ!!!’  এদিক থেকে ওদিক থেকে সম্মিলিত উত্তর যায় – ‘আছি – হে-এ-এ-এ-এ-এ!!!’

 

অণিতাকে নিয়ে তিলকমাটি হুড়ি পেরিয়ে গেল হরিহর, যেমন রোজ যায়। তালডাঙরা পেরিয়ে উপর-পাতিনা গ্রামে ঢুকে পড়ল। অজিত চৌধুরীর ভাড়াবাড়িতে ‘অঙ্গনওয়াড়ী’ কেন্দ্রে অণিতাকে নামিয়ে দিলো সে।

কেন্দ্রের সামনে এর মধ্যেই দু-চারজন আদিবাসী মহিলা শিশুকোলে উপস্থিত। একজন তো উদোম বুকে শিশুকে মাই দিচ্ছে, শিশুটি তার মায়ের একটি বুক মুখে গুঁজেছে, বাকিটাও হাতছাড়া করছে না। চেপে ধরে আছে হাতে। ওইটুকু হাত কি আর সম্পূর্ণ বেড় পায়!

তবে তার মায়ের কোনো হিন্দোল নেই। পেছনে ঈষৎ হেলে পড়ে হাতে কাঠিখুঁচি নিয়ে পিঠের ঘামাচি মারছে তো মারছেই।

সাইকেল থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়ে অণিতা ধমকে উঠল, ‘এ্যায় ঝুমরি! টিকে জুত্ করি বুসো!’ তার মানে একটু ঠিক করে বসো।

সচকিত ঝুমরি পরনের কাপড় গুছিয়ে ছেলে কোলে উঠে দাঁড়াল। নাকবিন্ধি চামরবাঁধ মলতাবনী ফুলবনী আর উপরপাতিনার আদিবাসী অধ্যুষিত প্রায় সাতশো জনসংখ্যার জন্য এই অঙ্গনওয়াড়ী কেন্দ্র। অণিতা তার একজন কর্মী।

ঝুমরির ‘রকম’ দেখে হরিহর মুচকি হাসছে। ঝটিতি তার দিকে ফিরে অণিতা বলল, ‘রোজ রোজ তোমার এই দিতে আসা আবার নিতে আসা, কষ্ট না! তার চাইতে আমাকে একটা সাইকেল কিনে দাও, লেডিজ। যেতে-আসতে পারব একা-ই।’

হরিহর বলল, ‘আচ্ছা’।

 

দুই

নতুন ঝকঝকে লেডিজ সাইকেল, গায়ে এখনো গন্ধ লেগে আছে। সারা দিনমান দৌড়ুচ্ছে তো দৌড়ুচ্ছে – এ-গ্রাম থেকে সে-গ্রামে, এ-বাখুল থেকে সে-বাখুলে। নতুন স্পোকগুলিতে সূর্যের আলো পড়ে যতই ঝকমকাচ্ছে, ততই সাইকেলের গতি যেন বাড়িয়ে দিচ্ছে অণিতা।

কোথায় কোথায় না যেতে হয় তাকে! কত কী যে খবর নিতে হয় – কার ঘরে আছে গর্ভবতী মা, কে-ই বা প্রসূতি, আর কার ছেলেমেয়েরই-বা বয়স ছ-বছরের নিচে। গর্ভনিরোধক পিল কম পড়ল কার, কার শেষ হয়ে এলো ‘কনট্রাসেপ্টিভস্ টিউব’! পাল্স পোলিও কি খাওয়ানো হয়েছে? আগামী রোববার কিন্তু দিন আছে।

 

সাইকেলটা গাছের গায়ে ঠেস দিয়ে রাখা। ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্তিও তো আসে! দুপুরবেলা। বট-অশ্বত্থের ছায়ায় ঝিম এসে যায়।
পাখ-পাখালিও ঝিমুচ্ছে। কিন্তু অণিতার ঘুম-নিদ্রা নেই। কৌতূহলভরে চারধারটা দেখছে।

হাল-লাঙল চলছে জমিতে। মাটি যত ফালা হচ্ছে, তার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে পোকামাকড়। আর তাই খেতে উড়ে-ঘুরে-বেড়াচ্ছে কাকপক্ষী, শালিকচটা। ‘হাটুয়া’ ঘরের মেয়ে, ‘হাটুয়া’ ঘরের বউ অণিতা – এসব তার দেখা।

সামান্য ঝিমুনি কি এসে গিয়েছিল চোখে? তন্দ্রাভাব? চটকা ভেঙে সে তো দেখল – গলগল করে রক্ত ঝরছে! লাঙলের লোহার ফলা গিঁথে গিয়েছে সামনের জমিতে লাঙলধরা মাহিন্দরটির পায়ে। আর সে খুঁজে পেতে গরুর গোবর এনে ঘায়ের ওপর থেপে থেপে লাগাচ্ছে। তবু কি রক্ত বন্ধ হয়?

ঝাঁপিয়ে পড়ল অঙ্গনওয়াড়ী অণিতা। গ্রামের লোকেরা ‘অঙ্গনওয়াড়ী’ তো বলে না, বলে ‘অঙ্গনারী’।

‘কী করছেন? টিটেনাস হয়ে যাবে যে! ধনুষ্টংকার!’

একে মেয়েমানুষ ‘অঙ্গনারী’ – তার ওপর সে পাড়ার হরিহরের বউ। খানিকটা ইতস্তত করছিল হেলে-মাহিন্দর। বলল, ‘মোর কিছো হবে নি গো। টিকে চুন-চিনির মলম লেপি দিনে সারি যাবে ধাঁইধাঁই করি।’

গরুর গোবর, চুন-চিনির মলম? – অজ্ঞতা আর কাকে বলে। পরিষ্কার জলে পা ধুয়ে এলে ক্ষতস্থানে অণিতা ‘কনট্রাসেপ্টিভস্ টিউব’ গর্ভনিরোধক পিল, ইত্যাদির বটুয়া খুলে লাগিয়ে দিলো ‘টিন্চার আয়োডিন’।

পেছনের ক্যারিয়ারে থাপ্পড় মেরে বলল, ‘উঠুন!’

হেলে-মাহিন্দর বুঝতে পারছে না – কেন তাকে উঠতে  হবে সাইকেলে। দূরসম্পর্কের ভাশুর-ভাদ্র বউ। তার ওপর মেয়ে-সাইকেল। ‘না’ ‘না’ করছিল সে।

‘উঠতেই হবে আপনাকে।’

‘হঁ ত, যাইতে হব কঁঠে?’

‘হেলথ সেন্টারে। টিটেনাস ইনজেকশান দিতে হবে।’ – সাইকেলের এপাশে-ওপাশে পা রেখে বেলটায় আলতো চাপ দিয়ে ‘ট্রি-নি-টি’ করে অণিতা বাজাচ্ছে।

‘ধুর বাবু! তোমার জাগ্তরি রখ ত! অখন হাল-লাঙল ছাড়ি হাসপাতালে গেনে মোর মালিক মোকে বাঁশ দিই পিটাইবে!’

যেন জামিন থাকছে অণিতা। বলল, ‘আমি তো আছি।’

নাছোড় সাইকেল চলল। – ‘চলুক গাড়ি বেলপাহাড়ি -।’ অর্ধেক চষা জমিতে জোয়াল কাঁধে জোড়া বলদ দাঁড়িয়ে। তাদের নধর পেট, পিঠের ‘শিব’ শিউরে উঠছে মাঝে মাঝে।

হেলে-মাহিন্দরকে ‘বাবু’ হয়ে সাইকেলের ক্যারিয়ারে চড়ে যেতে দেখে তারাও যেন বলল, ‘যাও! টা-টা!’

লাল মোরামের ওপর দিয়ে রিমরিম করে গাড়ি ছুটল চাঁদাবিলা হেলথ সেন্টারের দিকে। গাড়ি হেলে-মাহিন্দরকে নিয়ে গেল যেমন, দিয়েও গেল তেমন। তখন বেলা ধীরে ধীরে ‘আড়’ হচ্ছে।

 

আড়বেলায় ফের সাইকেলে উঠল অণিতা। ফের শুরু হলো সাইকেলের নতুন স্পোকে অপরাহ্ণ সূর্যের আলো খেলা। ঝিকঝাক ঝিকঝাক! যে-ই দেখছে, দূর থেকে চেঁচাচ্ছে – ‘ওই-ওই যাচ্ছে অঙ্গনারী! অণিতা অধিকারী। সাকিন বড়োডাঙা – ওরে ছুয়া সরে দাঁড়া – ’

এ-সবই তাদের মুখে মুখে রচনা ওই যারা ডুব্কা-ডুংরিতে গরু চরাচ্ছে, ছাগল চরাচ্ছে, ওই যারা ক্ষেতে-খামারে কাজের ফাঁকে উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙছে। শুনতে তো মন্দ লাগে না অণিতার। তবে এমনও তো শুনতে হয় যখন এ-ওকে চিমটি কেটে ‘টিজ’ করে বলছে – ‘চা না বে, চা!’ – ‘কী?’ – ‘রাঙতা মোড়া বেলুন’ – তখন কান-মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে, দু-গালে পটাপট চড় কষাতে ইচ্ছা হয় –

অণিতা পারে না – সে যে অঙ্গনওয়াড়ী। ‘সুসংহত শিশু বিকাশ সেবা প্রকল্পে’র কর্মী। তার দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে নোটিশ তো ঝোলানোই আছে –

প্রতিমাসে শিশুদের ওজন ও সেই অনুযায়ী বৃদ্ধি তালিকায় যথাযথ রেখাচিত্র অংকন, শিশুদের ও মায়ের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বা অন্য কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঠাবার জন্য পরামর্শ ও চিকিৎসা।

গৃহপরিদর্শনের মাধ্যমে বাবা-মাদের শিক্ষিত করে তোলা যাতে তারা শিশুদের বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্যোন্নতির জন্য যথাযথ ভূমিকা পালন করে।

সরকার-প্রদত্ত খাদ্যসামগ্রী দিয়ে ৬ মাস থেকে ৬ বছরের শিশু, গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েদের জন্য পরিপূরক পুষ্টি খাবারের ব্যবস্থা করা।

হেনতেন, জুতো সেলাই থেকে চ-ীপাঠ – আরো কত কী যে করতে হয় তাকে! এই তো এক হেলে-মাহিন্দরকে টিটেনাস দিতে নিয়ে যেতে হলো চাঁদাবিলায়। এখন আবার নাকবিন্ধির লোধা বস্তিতে –

 

খেজুরপাতার চাটাইয়ে বসে আছে অণিতা। খেজুর তো নয়, ‘খাজুর’। ঘাড় হেঁট করে বুনো ‘খাজুর’ পাতায় বোনা মাদুরের কাজ দেখছে সে। কেমন মাছের কাঁটা, মাছের কাঁটা! আশপাশে দু-চাট্টা মুরগি ঘুরে বেড়াচ্ছে টি-টি করে। একটা লাউচারাকে পরম মমতায় ঘুপচির ছাদে তোলার ব্যবস্থা পাকা। যদিও রুগ্ণ, অনমনীয় – চায় না উঠতে কিছুতেই। তাই ডগায় দড়ি বেঁধে ঝোলানো হয়েছে।

পোয়াতি সুরগুঁজা লোধানি ঘরে নেই, গিয়েছে জঙ্গলে। কাঠ কুড়োতে, পাতা ছিঁড়তে। তার মেয়ে সুসি চাটাই পেতে বসতে বলল, ‘বুসো না! মা এই আইল বলে! ক-খ-ন গেছে!’

বলেই সে ঘাড় তুলে ‘বেলা’ দেখল। তারপর সাইকেল – নতুন, ঝকঝকে! সাইকেলের ঘণ্টিতে হাত ঘষল – নতুন, ঝকঝকে! ঘণ্টির হাড়ায় নিজের মুখ দেখল – গোল, থুম্বা! আঙুল টিপে বেল বাজাল, বাজছে –

‘ট্রি-নি-টি’!

ঘণ্টাধ্বনিতে চোখ তুলে অণিতা হাঁ – কজন অচেনা ছোকরা মাথায় টুপি, পায়ে গামবুট পরে লোধাপাড়ার রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে! বুকটা ধক্ করে উঠল তার। এতদিন আসছে – কই? কোনোদিন তো দেখেনি!

– ‘এ্যাই সুসি – ’

‘কী গ?’ কাছে এসে দাঁড়াল মেয়েটা।

তার কানে কানে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করল অণিতা, ‘ওরা কারা?’

একপলক দেখে নিয়ে সুসি উত্তর করল, ‘নাই জানি কারা। তবে কদিন ধরেই ত আসছে – নাকি গুলতি দিয়ে এ-গাছে সে-গাছে ক্যাঁক্লাস মারছে!’

‘কী মারছে? ক্যাঁকলাস? তার মানে গিরগিটি?’

মাথা নাড়ল মেয়েটা। আর সঙ্গে সঙ্গে চোখ চলে গেল অণিতার – ওই সেখানে রুক্ষ হাঁদা মাটিতে অতিশয় রুগ্ণ লাউচারাটি গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে রয়েছে, অদূরবর্তী ঘুপচিঘরের দেয়ালে ওই যেখানে অপটু হাতে কাঠ-কয়লা, তিলকমাটি আর পাতার রস দিয়ে আঁকা হয়েছে গরুগাড়ির চাকার মতো আলপনা। সেখানেই একটা গিরগিটি হেলানো লাঠির গা বেয়ে সন্তর্পণে ধীরে ধীরে উঠছে।

একটু উঠল তো থমকে দাঁড়াল। এদিক-ওদিক দেখছে, ওপর-নিচ লাঠি বরাবর মাথাটা ঘনঘন নাড়াচ্ছে। দেহের তুলনায় মাথাটা ভারী। মাথার রং আদ্ধেক হলুদে তো আদ্ধেক খয়েরি। মাথার শিরা বরাবর ঘোড়ার কেশরের মতো খাঁজকাটা। চোখ যেন চামড়ায় ঢাকা।

কে জানে শিকার ধরতে কখন আবার এখানেও এসে পড়বে ক্যাঁকলাস-শিকারিরা!

‘উঠি রে!’ বলেই উঠতে যাচ্ছিল অণিতা, আর মাথা থেকে ঝুড়িকাঠের বোঝা উঠোনেই আছড়ে রাখল সুরগুঁজা।

পেটটা ভুয়াঙ লাউয়ের মতো ফুলে আছে। উঁচু হয়ে ওপরের দিকে ঠেলে উঠেছে। ন-মাসেরও বেশি চলছে। চোখদুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসবে। হাঁপাচ্ছে। তবু সে হাসছে!

‘এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না, সুরগুঁজা।’

‘কিসের কী?’

‘এই যে ভরা পেট নিয়ে জঙ্গলে যাওয়া। একটা কিছু ঘটে গেলে – ’উবু হয়ে বসে দু-হাত দু-হাঁটুতে মেলে ধরে লোধানি বলল, ‘কী ঘটবে? জঙ্গলে খালাস ত?’

অবাকদৃষ্টিতে চেয়ে ছিল অণিতা। চোখে তার হলুদ-খয়েরি মাথাওয়ালা সেই ক্যাঁকলাস! মাথা দোলাচ্ছে তো দোলাচ্ছে –

‘হলে হবেক। কী-ই আর করব! হামাদের উ’রস হয়। হলে শালা জংলি পাল্হা-পতরে পুঁছে লুবো, ববাস!’

অঙ্গনওয়াড়ী অণিতা এবার ধমকে উঠল, ‘থাম!’

লোধানিকে কে থামাবে। সে বকেই চলে, ‘হায় দেখ-অ! বিশ্বাস করলে নাই ত? সীতারানী লব-কুশকে কোথায় বিয়াইছিল? এই তপোবনের জঙ্গলে ওই দুটা শালগাছের তলায় ত?’

‘তা হোক তবু সে-যুগ আর এ-যুগ!’ বলেই সুরগুঁজার উঁচু পেটে হাত বুলোচ্ছে, কান চেপে ধরে শুনছে নবাগতের জীবন-স্পন্দন, যৎকিঞ্চিৎ হলেও নড়ানড়ি –

‘লড়ছে?’ হি-হি করে হাসছে সুরগুঁজা।

ঘাড় নাড়ল অণিতা। তারপর টুকিটাকি ওষুধের বড়ি হাতে গুঁজে দিয়ে সাইকেলে উঠল সে। অচেনা মানুষগুলোর সম্পর্কে একটা
কথাও জিজ্ঞাসা করল না লোধানিকে। কে জানে কী আছে কার মনে! সে তো ‘অঙ্গনারী’ – অত পুরুষের খোঁজে তার কী দরকার? তিন

মুদিখানার কারবারি হরিহর। তেল-নুন বেচে। হপ্তার মাল গস্ত করতে এসেছিল সুবর্ণরেখা নদী পেরিয়ে সাউয়েদের দোকানে রণজিৎপুরে।

রোহিণী-রণজিৎপুর বড় গঞ্জ এলাকা। ‘নদী সেপারে’ মানুষদের কাছে বিলাত-আমেরিকা। লন্ডন-নটিংহ্যামশায়ার-কানাডা কি ক্যালিফোর্নিয়া। এখানে আছে বিডিও অফিস। একটা হাইস্কুল। মেয়েদের স্কুল। আর আছে মান্ধাতা আমলের রোহিণীগড়ের ‘বাবুঘর’। আরো কত ‘গ্যাঁড়াকল’!

হপ্তায় হাট বসে দুদিন – মঙ্গল আর শুক্রবার। হাটে এলে হরিহরের ওই কবিতাটা খুব মনে পড়ে। ওই যে – ‘হাট বসেছে শুক্রবারে বক্সিগঞ্জে পদ্মাপারে।’ আসলে এখানেই ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছে কি না সে!

সকাল-সন্ধে এখানে বাস ছাড়ে, বাস আসে। আর আসে বাস-কন্ডাক্টরের হাত মারফত খবরের কাগজ। হরিহরের গ্রাম বড়োডাঙায় খবরের কাগজ তো যায় না, যায় হাটুরে লোক মারফত ‘খবর’। কখনো-সখনো শখদার লোকের হাত ঘুরে একটা আস্ত খবরের কাগজ।

হরিহর খুব ফুর্তিতে আছে – সকাল সকাল মাল গস্ত হয়ে গিয়েছে। তদুপরি সে একটা সাইকেল কিনে দিয়েছে অণিতাকে, লেডিজ। সে-সাইকেল এখন কোথায় কোথায় না ছুটে বেড়াচ্ছে! উপর-পাতিনা-নামো-পাতিনা-তালডাংরা-মলতাবনী-নাকবিঁধি-চামরবাঁধ –

ওই তো –

রিমরিম করে ছুটে চলেছে! পেরিয়ে যাচ্ছে রামেশ্বর ডাঙা-টিয়াকাটি-কেয়াঝরিয়া, আঁটারি-চুরচুরঝাড়, বাবুই ঘাসের বন, কদো-গুঁদলি খসা-কুরথির ক্ষিত। চাকা ঘুরছে কি ঘুরছে না – বোঝা যাচ্ছে না। সূর্যের আলো পড়ে সাইকেলের ‘আরা’ বা স্পোকগুলো ঝকমকাচ্ছে – ঝকমক ঝকমক!

ঝকমক ঝকমক!

 

সাউয়েদের দোকানের পূর্বদিকে পুকুরপাড়ে – ওই যেখানে নিমগাছের তলায় কতক খালি কতক ভরতি কেরোসিনের ব্যারেল সত্মূপীকৃত হয়ে পড়ে আছে – সেখানে লালরঙের পস্নাস্টিকের চেয়ার পেতে খবরের কাগজ পড়ছে সাউয়েদের মেজতরফ।

পেছন থেকে গায়ের ওপর উটকো ছায়া পড়তেই ঘাড় ঘুরিয়ে মেজকর্তা বলল, ‘অঃ তুই? মুই ভাবনু – কে না কে! খবর শুনিছু?’

‘কী খবর মেজদা?’ পায়ের কাছে মাটিতেই বসে পড়ল হরিহর। কাছে-পিঠেই দোকান থেকে ছুড়ে দেওয়া মসুর ডালের দানা খুঁটে খাচ্ছে ঘুরে ঘুরে ‘বক্ বক্ বকম্’ ‘বক্ বক্ বকম্’ করতে করতে খানকতক গোলা পায়রা। যেন ভাবখানা – ‘মারিতং গ-ার, লুটিতং ভা-ার!’

তার মধ্যেই মেজকর্তা কাগজটা মেলে ধরে বলল, ‘হা দ্যাক! নদী-সেপারের পরিস্থিতি নিই কী লিখছে, পড়!’

হরিহর মাথা নিচু করে পড়তে লাগল – ‘ওড়িশাসংলগ্ন সুবর্ণরেখা-নদীতীরবর্তী নয়াগ্রাম ও গোপীবল্লভপুর থানায় এবার সক্রিয় মাওবাদীরা। নয়াগ্রাম থানার দক্ষিণ-পূর্বে ওড়িশার বালেশ্বর জেলা ও দক্ষিণ-পশ্চিমে ময়ূরভঞ্জ জেলা। আবার, গোপীবল্লভপুরের পশ্চিমে ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ আর উত্তর-পশ্চিমে ঝাড়খ–র পূর্ব সিংভুম জেলা। সবটাই জঙ্গল অধ্যুষিত!

গোয়েন্দা সূত্রে খবর, মাস তিন-চার ধরেই এতদ্ অঞ্চলে মাওবাদীরা তাদের মুক্তাঞ্চল গড়ে তুলতে তৎপর। লালগড়-ঝাড়গ্রাম ছেড়ে মাওবাদী স্কোয়াড সদস্যরা যেমন নয়াগ্রাম-গোপীবল্লভপুর-সাঁকরাইলে ঢুকছে, তেমনি ওড়িশা বা ঝাড়খ- থেকেও নয়াগ্রাম-গোপীবল্লভপুরে ঢুকে পড়ে বড়সড় হামলা চালানোর ফন্দি আঁটছে।

মুক্তাঞ্চল গড়ে তোলার মতলবে মাঝেমধ্যেই আক্রমণ শানাচ্ছে তারা। এর মধ্যেই আক্রমণ চালিয়েছে – কলমাপুকুরিয়ায়, কাদোকোঠায়, নরিশোলে। পাতিনা চাঁদাবিলা বড়খাঁকড়ি মলম আর বড়নিগুই অঞ্চলে গোপনে গোপনে প্রভাব বাড়াচ্ছে মাওবাদীরা – ’

জোরে জোরেই পড়ছিল হরিহর, থেমে গেল। তার চোখের সামনে ততক্ষণে ঘূর্ণায়মান সাইকেলের নতুন আর ঝকঝকে স্পোকের ওপর থেকে আচমকা সরে সরে যাচ্ছে আলো, ‘ছায়া ঘনায়েছে’ ধীরে ধীরে আঁটারি-কুড়চির বনে। সবকিছুই ঝাপসা লাগছে। ঝাপসা, ঝাপসা। ঝাপসা দৃষ্টিতে কাগজটাও আর পড়তে পারছে না সে।

মেজকর্তা বলল, ‘থাক, আর পড়তে হবে না। মোটকথা তোদের ওদিককার অবস্থাও খারাপ হয়ে গেল রে হরিহর। সাবধানে চলাফেরা করিস!’

‘আর সাবধান!’ বলেই ছাঁৎ করে সরে এলো সে। না জানি কাগজটায় আরো কত কী লেখা আছে! হয়তো আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে লিখেছে – নয়াগ্রাম-গোপীবল্লভপুরে ঢুকে পড়ে বড়সড় হামলা চালানোর ফন্দিই শুধু আঁটেনি, তপোবন জঙ্গলমহালের ভেতর দিয়ে চাঁদাবিলা যাওয়ার মোরাম রাস্তার ধারে গুলি করে মাথা থেঁতলে রেখে দিয়েছে ‘লাশ’। পাশেই সাদা কাগজের ওপর লাল কালিতে লেখা মাওবাদী পোস্টার – ‘পুলিশের চরকে চরম শাস্তি দেওয়া হলো’। হয়তো লিখেছে, সুরুবালাকে রাতের অন্ধকারে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছে, চুনিবালাকে ঘরের মধ্যেই আগুন জ্বেলে পুড়িয়ে মারা হয়েছে, কোপানো হয়েছে নিরুবালাকে, খুন হয়ে গিয়েছে এক ভুসিমালের দোকানদার –

‘অও যে হরিহর! খালি ঘুরি বুলুটু, মুদিমালের ফর্দটা মিলা!’ বলেই গড়গড় করে পড়ে যেতে লাগল সাউয়েদের বড়কর্তা – ‘হরিদ্রা ২ কেজি, জিরা ১ কেজি, ধনিয়া ১ কেজি, পিপল ৫০০ গ্রাম, শুঁট -’

প্রায় ছোঁ মেরে ফর্দটা ছিনিয়ে নিল হরিহর – ‘আর মিলাইতে হবেনি বড়দা, বেলা পড়ি গেলা।’ সত্যি সত্যি বেলা আড় হয়ে গেছে কখন! গাছে পাতায় রৌদ্রে ঝিম ধরা ভাব।

ঝিম ধরা ভাব তার মনেও।

 

‘ভারী’র কাঁধে মালপত্র গছিয়ে দিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এলো বিষণ্ণ অপরাহ্ণের মতো হরিহরও। সে এবার যাবে রণজিৎপুর থেকে রোহিণী। রোহিণীর পরমেশ্বর দে-র কাপড়ের দোকান থেকে মোহিনী মিলের একটা ধুতি কিনবে, একজোড়া শাড়ি।

রণজিৎপুর থেকে রোহিণী এক হাঁকের ভেতর। বলাই যায় – রোহিণী-রণজিৎপুর পিঠাপিঠি দুভাই। তাছাড়াও রোহিণীগ্রামের আলাদা একটা ইতিহাস আছে। এই গ্রামেই ১৬৩৩ খ্রিষ্টাব্দে জন্মেছিলেন বৈষ্ণবাচার্য রসিকানন্দ, যাঁর জীবন অবলম্বন করে তাঁরই প্রিয় পার্ষদ গোপীজনবল্লভ দাস লিখেছিলেন রসিকমঙ্গল কাব্য। যেখানে আছে –

উৎকলেতে আছয়ে সে মল্লভূমি নাম।

তার মধ্যে রোহিণীনগর অনুপম \

ডোলঙ্গ বলিয়া নদী গ্রামের সমীপে।

গঙ্গোদক হেন জল অতি রসকূপে \ …

সে রসিকমঙ্গল কাব্য ও রোহিণীর ইতিহাস হরিহরের সহসা জানার কথা নয়। কারণ সে রোহিণী হাইস্কুলের ক্লাস এইট। তবে গ্রামের সমীপে ও রোহিণী হাইস্কুলের সন্নিকটে ‘ডোলঙ্গ’ বা ডুলুঙ নামের যে নদী আছে, বর্ষাকালেও সে-নদী ডুবসাঁতার চিৎসাঁতার দিয়ে কত পারাপার করেছে! গ্রীষ্মে হাতড়ে হাতড়ে কত বাটা-মাগুর-চ্যাঙ-গড়ুই ধরেছে!

রোহিণীগ্রাম সাঁকরাইল থানার অন্তর্গত। যে-সাঁকরাইল থানা হালের ইতিহাসে ঢুকে পড়েছে, সে-ইতিহাস অবশ্য হরিহরের অজানা নয়। হাটুরে লোকেরাই খবরটা পৌঁছে দিয়েছে নদী-সেপারে। মাওবাদীরা সাঁকরাইল থানায় ঢুকে গুলি করে মেরেছিল দুই ছোট দারোগাকে, অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল বড় দারোগাকে।

রোহিণীর হাটতলায় আম্রকুঞ্জে উড ক্র্যাফটের টিচার কুইলা স্যারের সঙ্গে হরিহরের মুখোমুখি দেখা –

‘কী হে হরিহর, আছো ক্যামন?’

‘আর থাকাথাকি স্যার!’ কেমন শুষ্ক-শ্রীহীন দেখাচ্ছে হরিহরকে।

‘কেন হে, কী হলো?’

‘যা সব শুনছি – যা সব খবরের কাগজে বেরোচ্ছে স্যার – ’

মুহূর্তে বুঝে গেলেন কুইলা স্যার, যা পরিস্থিতি হাঁ করলে একটা ছোট ছেলেও বুঝতে পারবে। বললেন, ‘স্থানীয় ছেলেছোকরারাই আছে, না হলে  এতদূর আস্পর্ধা – আচ্ছা, চলো তো দেখি – কী লিখেছে খবরের কাগজে!’

বলেই হরিহরের হাত ধরে নিয়ে গেলেন একটা চায়ের দোকানে। চেয়ার টেনে বসলেন কুইলা স্যার, হরিহর বেঞ্চিতে বসল। একটা লোক কাগজ পড়ছিল।

‘দেখি তো মনতোষ, কাগজটা – আজকের কী খবর।’

কাগজ ছেড়ে সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়াল মনতোষ। বলল, ‘পড়ুন স্যার!’

‘উড ক্র্যাফটে’র স্যার কাগজ পড়ছেন। পেছনে দাঁড়িয়ে ঘাড়ের ফাঁক দিয়ে লাইন বাই লাইন দেখছে হরিহর –

…‘পুরুলিয়ার বান্দোয়ান থানার লেদাম গ্রামে এক অঙ্গনওয়াড়ী কর্মীকে অপহরণ করল মাওবাদীরা। অপহৃতার নাম অণিমা বেসরা। তার খোঁজে মেদিনীপুরের জঙ্গলমহালেও তল্লাশি চলছে।

মাওবাদীদের হাতে অঙ্গনওয়াড়ী কর্মী অপহরণের ঘটনা নতুন নয়। এ বছর বাকুড়ার সারেঙ্গা থানার বেজডাঙা গ্রামের এক বধূকে তুলে নিয়ে যায় মাওবাদীরা। পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনি থানার ভাঙ্গাবাঁধ গ্রামের অঙ্গনওয়াড়ী কর্মী ছবি মাহাতোরও আজ অবধি কোনো হদিস নেই।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বান্দোয়ান বাজার থেকে প্রায় ছাবিবশ কিলোমিটার দূরে জঙ্গলঘেঁষা লেদাম গ্রামে রবিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা নাগাদ হানা দেয় সশস্ত্রকারীরা। প্রথমে দরজায় ধাক্কা। দরজা খুললে অণিমা বেসরাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে …’

আর দেখতে পারছে না। হরিহর অস্থিরতায় মনে মনে ছটফট করতে করতে বলে উঠল, ‘চলি স্যার! ছোট হয়ে আসছে বেলা।’

হাটচালা থেকে বের হলেই ডুলুঙের ধারে সারি সারি বট-অশ্বত্থের ছায়া। দেখলেই একটু বসি বসি মন করে। কিন্তু হরিহর বসতে পারছে না – কে জানে এতক্ষণে ওদিকে অণিতা -!

থাকল পড়ে পরমেশ্বর দে-র দোকানে মোহিনী মিলের ধুতি-শাড়ি খরিদ করা, বট-অশ্বত্থের ছায়ায় বসে দুদ- সুদূর দিকচক্রবালে তাকিয়ে থাকা, পাখি দেখা, কত পাখি উড়ছে – ঢেপচু-ক্যারকেটা-ট্যাঁসা-মাছরাঁকা –

হরিহর দৌড়ুল – দৌড় দৌড় –

মুদিমালের ভার-কাঁধে অনেকটাই এগিয়ে গেছে বাহক দামু সিং। নদী-বালিতে একটা বিন্দুর মতো – ওই – ওই তো দেখা যাচ্ছে! ধরতে হবে তাকে। দুজনে জোট বেঁধে যাওয়াই ভালো। গায়ে তার গন্ধ আছে না!

দামু সিংকে ধরতে হরিহর লদোপদো দৌড়ুচ্ছে।

 

চার

পরের দিন থেকেই সাইকেলটার আর দেখা নেই। মোরাম দেওয়া রাস্তায় আর আওয়াজ উঠছে না রিমরিম করে। রৌদ্রে আর ঘুরন্ত স্পোকে দেখা যাচ্ছে না আলোর ঝলকানিও। হরিহরই নিষেধ করে দিয়েছে অণিতাকে বেরোতে।

ডুব্কা-ডুংরিতে গরু-ছাগল চরাতে গিয়ে ছাগলবাগাল গরুবাগালরাও মুষড়ে পড়েছে। তারা তো আর সাইকেলটাকে দেখামাত্র চেঁচিয়ে জরপ করে বলতে পারছে না – ‘ওই-ওই যাচ্ছে অঙ্গনারী! অণিতা অধিকারী। সাকিন বড়োডাঙা – ওরে ছুয়া সরে দাঁড়া।’ তারা হাত কামড়াচ্ছে।

‘ইভটিজার’রা – ওই যারা ক্ষেতে-খামারে কাজে-অকাজে থাকে, তাকে দেখামাত্র লুকিয়ে-চুরিয়ে এ-ওকে উসকে দিয়ে রাঙতামোড়া ‘বেলুন’ চায় – তারাও আড়ভাঙার অজুহাতে উঁকিঝুঁকি মারছে, দেখতে না পেয়ে হতাশ হচ্ছে। হাই তুলতে তুলতে নিজের ভাষায় খেদোক্তি করছে, ‘কাঁই গেলা রে! অখনো ত আইলানি!’

কোথায় গেল! এখনো তো এলো না!

মোটকথা অঙ্গনওয়াড়ী অণিতার অনুপস্থিতির জন্য গাঁ-গঞ্জ মাঠ-ঘাট বিল-বাতান – যেখানে সারাদিন রৌদ্র-ছায়ার খেলা চলত – সেখান থেকে যেন সহসা রৌদ্রই উবে গেছে! ছায়াচ্ছন্ন এখন সবকিছুই।

 

বাইরের উঠোনে যদিও হরিহর আগের মতোই পা রেখেছে, তবু হাঁক দিয়ে সে আর ডাকতে পারল না, ‘এসো।’ উত্তরে অণিতাও আর সাড়া দিয়ে বলল না, ‘হ্যাঁ, যাই।’

সাইকেল নিয়ে একা একাই বেরিয়ে পড়ল হরিহর। সঙ্গে সাইকেলের ক্যারিয়ারে থাকল অণিতার সেই বটুয়া। বটুয়ার ভেতর গর্ভনিরোধক পিল, কন্ট্রাসেপ্টিভস্ টিউব, ‘ফার্স্ট এইড’-এর টুকিটাকি। রোজ যেমন থাকে।

হরিহরের সাইকেলটাও নতুন নয়, আজ থেকে বছর-দশেক আগে কেনা। রং চটেমটে একশা, স্পোকগুলোয় জং ধরেছে। তাই সূর্যের আলো পড়ে ঝলসে ওঠার কথাও নয়। তবে হ্যাঁ, স্টিলের ঘণ্টিটা এখনো ঝকঝক করছে। রং চটেনি একফোঁটাও।

রোজকার অভ্যাসবশত ঘণ্টিতে বুড়ো আঙুলের আলতো চাপ দিয়ে বাজাল হরিহর। বাজছে – ট্রি-নি-টি! ট্রি-নি-টি! ঘরের ভেতর থেকে শুনল অণিতা, কোনো সাড়া দিলো না। ‘তাকে চোখে দেখিনি, শুধু বাঁশি শুনেছি’ – গোত্রের একটা রহস্যময় আবহ তৈরি হলো।

তার মধ্যে সাইকেল ছুটিয়ে বেরিয়ে পড়ল হরিহর।

 

বড়োডাঙা-কুসুমতলা-সীতানালা খালপাড়-খান্দারপাড়া-দেউলবাড় …। ‘তিলকমাটি হুড়ি’র কাছে এসে যা একটু থমকে দাঁড়াল। এক পা সাইকেলে এক পা মাটিতে রেখে ঘাড় ঘুরিয়ে ‘হুড়ি’ দেখছে হরিহর।

কেমন থম মেরে আছে হুড়িপাহাড়! দৃশ্যমান তিলকাঞ্চলও যেন ডোরাকাটা বাঘের রূপ নিয়েছে। মাঝেমধ্যে হেথা হোথা ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ছে মাটি ও পাথর। কারা যেন হেঁটে-চলে বেড়াচ্ছে। কারা কী, অন্যসময় হলে হরিহর অনায়াসেই বলে দিত – হেঁটে-চলে বেড়াচ্ছে শিয়াল-ভাম-খাটাস, বড়জোর একটা-দুটো বনবরা-ঝিঁকর, নদী-সেপারের কাঠকুড়ানিরা। কিন্তু এখন? কথা পেটে আসছে তো মুখে আসছে না, আনতে নেই।

পড়ি-কি-মরি সাইকেল ছুটিয়ে দিলো হরিহর।

ডুব্কা-ডুংরিতে গোঠে-ডহরে গরু চরাচ্ছে ছাগল চরাচ্ছে গরুবাগাল ছাগলবাগালরা, যেমন রোজদিন চরায়। ক্ষেতে-খামারে বিলে-বাতানে কাজে ডুবে আছে মুনিষ-মাহিন্দররা, যেমন থাকে।

সহসা অণিতার বদলে সাইকেল আরোহী হরিহরকে যেতে দেখে তাদের মধ্যে কোনো ‘পদ্য’ই রচিত হলো না, কোনো ‘অশস্নীল’ আবদারও তৈরি হলো না আজ। সে-অবকাশও নেই। খালি যা হতচকিত দু-একজন মুখ ফসকে বলে উঠল, ‘উরিঃ হা দ্যাক্! আজ অঙ্গনারীর বদলে অঙ্গপুরুষ যায়েটে বে!’

কথাটা শুনেও শুনল না হরিহর, সে এগিয়ে গেল।

 

কিন্তু অঙ্গনওয়াড়ী কেন্দ্রে পৌঁছে সে অঙ্গপুরুষের উপস্থিতি হাড়ে হাড়ে টের পেল।

যারা উদলাবুকে মাই দিচ্ছিল শিশুকে, এই যেমন আদিবাসী ঝুমরি, – যারা উদলাপিঠে কাঠিখুঁচি দিয়ে ঘামাচি মারছিল, এই যেমন ভূঁইয়াদের ফর্সা মেয়ে কিরণ, – যারা, গর্ভবতী মায়েরা, পেট খুলে হাওয়া খাওয়াচ্ছিল অনাগত ছ-মাস ন-মাসকে, এই যেমন লোধানী সুরগুঁজা – তারা সবাই ধ্যাড়াস ধ্যাড়াস করে একধারসে চাপাচুপি দিয়ে উঠে দাঁড়াল। শুধু যা ‘ন্যাঙটা ভুটুঙ সাধের কুটুম’ কচিকাঁচারা – ওই যারা কোমরের ঘুনসির বাড়তি ‘অঁটাদড়ি’টা মুখে পুরে চুষছিল – তারাই কেবল অনড় থেকে তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল।

প্রসূতি ও গর্ভবতী বধূদের কেউ একজন মাথায় ঘোমটা টেনে দিয়ে উলটোদিকে মুখ করে হরিহরকে জিজ্ঞাসা করল, ‘বউদি মেনে আইলা নি কেনে গো?’

হরিহর সাইকেলের ক্যারিয়ার থেকে অণিতার সেই বটুয়া খুলতে খুলতে বলল, ‘কেনে মোকে দিই হবেনি?’ আমাকে দিয়ে হবে না?

পথচলতি একজন মোটরসাইকেল আরোহী হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে ব্যাপারটা লক্ষ করছিল এতক্ষণ। শুনতে পেয়ে সে-ই উত্তর দিলো, ‘হ্যাঁ হবে, কাল থেকে কিন্তু শাড়ি পরে আসতে হবে।’

বলেই সে গাড়ি স্টার্ট দিলো। উপস্থিত প্রসূতি ও গর্ভবতী বধূরা একযোগে হেসে উঠল। পোয়াতি ঝুমরির হাসি আর থামে না। দেখাদেখি বাচ্চাকাচ্চারাও না বুঝে হাসছে। একটা কুকুরও যেতে যেতে আচমকা বসে পড়ে জিভ বের করে হ্যালহ্যাল করছে।

হরিহর গায়ে মাখল না। অণিতার করা ‘লিস্ট’ অনুযায়ী যার যা বরাদ্দ দিতে থাকল। বাড়ি বাড়ি ঘুরে যার যা জিনিস, টুকিটাকি ওষুধ, গর্ভনিরোধক পিল – দিয়েও এলো।

সবকিছুই করল ফর্দ মিলিয়ে, হুবহু। শুধু যা একটা জিনিসই সে করতে পারল না – কোনো গর্ভবতী বধূর স্ফীতকায় উদরে হাত বুলোতে, কান-মাথা চেপে ধরে অনাগত নবজীবনের স্পন্দন শুনতে।

‘অঙ্গনারী’ তো সে নয় – সে ‘অঙ্গপুরুষ’।

 

একটু বেলার দিকে রাঁধুনিদের সঙ্গে সে বসে গেল। ‘মিড-ডে-মিলে’র তদারকিতে। এ-কাজে সে বড়ই পারদর্শী। গ্রামে বিবাহে-শ্রাদ্ধে-উৎসবে অপরাপর প্রীতিভোজে তার ব্যবস্থাপনার নামডাক আছে।

তদুপরি মুদিমালের কারবারি হরিহর চাল-ডালের পরিমাপটাও বোঝে ভালো। পুষ্টি প্রকল্পের চার্টটাও তার সঙ্গে দিয়েছে অণিতা –

* গর্ভবতী ও প্রসূতি (শিশুর বয়স ছয় মাস পর্যন্ত) মহিলার জন্য বরাদ্দের পরিমাণ –

চাল ৭২ গ্রাম

ডাল ৪০ গ্রাম

* শিশু যেখানে অত্যন্ত অপুষ্ট আর বয়স ছয় মাস থেকে তিন বছর, সেখানে –

চাল ৭২ গ্রাম

ডাল ২০ গ্রাম

* প্রসূতি মহিলা যার শিশুর বয়স তিন থেকে ছয় বছর, তার জন্য বরাদ্দ –

চাল ৩৬ গ্রাম

ডাল ২০ গ্রাম

চাল-ডাল তো আর শুকনো খাওয়া যাবে না, যার যা তার তা দিয়ে দিলে রান্নার তেল-নুন তারা জোটাতেও পারবে না। অতএব, রান্না করা রেডিমেড খাবারই তাদের দিতে হবে।

ওই তো হাপিত্যেশ করে বসে আছে মায়েরা! ন্যাংটা-ভুটুঙ সাধের কুটুমরা – ওই যারা কোমরের ‘অঁটাদড়ি’ চুষছিল আর ভ্যালভ্যাল করে তাকাচ্ছিল।

হরিহর ভাঁড়ার খুলে চাল-ডাল দিয়েছে পরিমাপ করে, দিয়েছে তেল-নুন, আরো কিছু মসলাপাতি, ডিম। রাঁধুনিরা রান্না করছে, পাশে বসে এটা-সেটা জরপ করে বলছে হরিহর –

‘এক নোকের দু পো এক ঝি। ঝিটার নাম করলী। বড় পো বাহা হিছে, ছোট পো হিনি -’

‘ছোটটার বিয়ে হয়নি তো এখনো? এবার হবে। তার আগে একবারটি চলো!’

বলেই কারা এসে ডেকে নিয়ে গেল হরিহরকে। বেশ কিছুক্ষণ বাদে ফের ছেড়েও দিলো। কিন্তু ফিরে-আসা এ-হরিহর যেন সে-হরিহর নয়। চোখদুটি লাল, মাথার চুল উসকোখুসকো। কাঁপছে ঠক্ঠক্ করে।

এতক্ষণে রান্নাবান্না, খাওয়া-দাওয়াও শেষ। হাঁড়ি-কড়া থালা-বাসন ধুয়েপুছে রাঁধুনিরাও চলে গেছে যে-যার সে-তার। মোটে তো ঘণ্টা-চারেক ডিউটি! প্যাডেলে পা রেখে গাড়ি ছুটিয়ে দিলো হরিহরও। অঙ্গনওয়াড়ী কেন্দ্রের দিকে সে আর ফিরেও তাকাল না – ওই যেখানে লেখা আছে, ‘সুসংহত শিশু বিকাশ সেবা প্রকল্প, অঙ্গনওয়াড়ী কেন্দ্র, পাতিনা।’

সাইকেলে পথ ভাঙছে হরিহর। উপরপাতিনা, তালডাঙরা, নিচুপাতিনা – চেত্লা খাল, মশানির দহ। বেলা ‘আড়’ হয়ে গেছে কখন! গরুর গোঠ এখন ঘরমুখো – পেছনে ধুলোর ঝড় চলেছে। ধুলো থেকে গা বাঁচিয়ে ধীরে ধীরে সাইকেল চালাচ্ছে সে।

কখনো চড়াই, কখনো উতরাই। সাইকেলসহ হরিহর একবার ডুবছে, একবার উঠছে! আসলে ‘তিলকমাটি হুড়ি’ সন্নিহিত গ্রামগুলি নদীর পাড় থেকে এতটা উঁচুতে অবস্থিত যে, বর্ষায় জঙ্গলমহালের ‘ঝোপ’ অর্থাৎ প্রবল জলধারা গ্রামগুলোকে বেষ্টন করে নদীতে নামার পথে তৈরি করে ফেলেছে বড় বড় খাদ, যাকে বলে ‘ঢড়া’। বর্ষায় ঢড়া-ভরতি জল, গ্রীষ্মে ঠা-ঠা।

তা সে ঢড়ায় পড়ে মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে হরিহর, ফের ভুস করে ভেসে উঠছে তার মাথা। উঠন্তি-ডুবন্তি।

অবশেষে এসে গেল সেই ‘তিলকমাটি হুড়ি’। হুড়ির আড়ালে এতক্ষণে ঢাকা পড়ে গেছে সূর্য। জায়গাটা ছায়াচ্ছন্ন, আঁধার আঁধার। আশ্চর্যজনকভাবে রাস্তায় আজ আর ইতস্তত লোক দেখা যাচ্ছে না একটাও। লোকগুলো তো বলেছিল – এখানেই সেই –

ছাঁৎ করে উঠল হরিহরের বুকটা! চোখের সামনে দেউলবাড় আর নিচুপাতিনা গ্রামের মধ্যবর্তী পাতলা অরণ্যসংকুল দেড়-দু মাইল বিসত্মৃত উঁচু টিলা। পাতলা আর কই! এখন যেন ঘন সন্নিবদ্ধ, ঠাসা। নদীর পাড় থেকে আর দূরেও নেই, যেন এগিয়ে এসেছে অনেকটা।

বিপদে-আপদে পড়লে ডরপুক মানুষ হাঁক দেয় – ‘স্যা-ঙ-ৎ হে-এ-এ-এ-এ-এ!’ বিপদে না পড়েও স্রেফ মজা করতে হরিহরই কতদিন ডাক দিয়েছে ‘তিলকমাটি হুড়ি’র স্যাঙাৎকে! কান খাড়া রেখে সে উত্তরও শুনেছে অব্যবহিত পরেই – ‘আ-ছি-হে-এ-এ-এ-এ-এ!’

আজ আর মজা-মজাকি নয়, কাদের যেন অঙ্গুলি-নির্দেশে মুখের কাছে দুহাত জড়ো করে যন্ত্রচালিতের মতো হরিহর হাঁক দিলো – ‘স্যা-ঙা-ৎ হে-এ-এ-এ-এ-এ!’ পরক্ষণে উত্তরও এলো – ‘আ-ছি হে-এ-এ-এ-এ-এ!’

উত্তরের আড়া-ধাড়া – সবকিছুই কি আগের মতো হুবহু? না, সামান্য তফাৎ। প্রতিধ্বনির সঙ্গে আলোর ঝলকানি। তিলকমাটি হুড়ির একটা নির্দিষ্ট জায়গা থেকে টর্চলাইটের ফোকাস দিঙ্-নির্দেশ করে বারকতক জ্বলল নিভল।

খানিক থমকে দাঁড়াল। ভাবল হয়তোবা। না, ভাবাভাবির কোনো অবকাশই আর নেই। নিশির ডাকের মতো আলোর উৎস অনুসরণ করে ‘তিলকমাটি হুড়ি’র দিকেই এগিয়ে চলল হরিহর।

 

পাঁচ

গ্রামে যখন ঢুকল, পেছনে পাকুড়গাছের মাথায় সন্ধ্যাতারা জ্বলজ্বল করছে। নদীঘাটের অস্পষ্ট অন্ধকারে এই বুঝি নৌকো ভেড়াল বদুকের পো! হাটুরে লোকজন কথা বলছে, তবে খুব চাপাস্বরে।

যেন একটা যুদ্ধ জয় করে ফিরছে হরিহর। তার খুব ইচ্ছা হচ্ছে হেঁকে-ডেকে চেঁচিয়ে কথা বলতে। তার হাতে মোবাইলও নেই যে কথা বলে অণিতার সঙ্গেও। কিনব কিনব করে এতদিনেও কেনা হয়নি, অথচ কিনলে কত সুবিধে হতো! ‘তিলকমাটি হুড়ি’র ডেরায় বসেও কথা বলা যেত –

সাঁক্ করে মাথার প্রায় ব্রহ্মতালু ছুঁয়ে একটা ‘রাতচরা’ উড়ে গেল। বাদুড়-টাদুড় হবে হয়তো – হরিহর গ্রাহ্য করল না। কিন্তু পরক্ষণেই পাখিটা ‘ট্রঁ্যা-ট্রঁ্যা’ করে ঘুরে এলো। দেখেই বুঝল – কালপ্যাঁচা!

 

সন্ধ্যার অন্ধকার যত ঘন হবে, পাকা ফল-পাকুড়ের সুবাস যত ছড়াবে, প্যাঁচা-বাদুড়ের উৎপাতও তত বাড়বে। তার ওপর এখন তো হাতি আর -। মুদিমালের কারবারি হরিহরের মনে হঠাৎ চিন্তার উদয় হলো – সাধারণ প্যাঁচা হলে বলার কিছু ছিল না, তা বলে ‘কালপ্যাঁচা’? ইত্যবসরে কোনো অঘটন ঘটে গেল না তো?

চোখের সামনে খবরের কাগজের পাতাটা এখনো জ্বলজ্বল করছে –  ‘… স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বান্দোয়ান বাজার থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার দূরে জঙ্গলঘেঁষা লেদাম গ্রামে রবিবার সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ হানা দেয় সশস্ত্রকারীরা। প্রথমে দরজায় ধাক্কা। দরজা খুললে অণিমা বেসরাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে …’

হরিহর এই ভরসন্ধ্যাবেলাতেও সুনসান গ্রামের রাস্তায় সাইকেল ছুটিয়ে দিলো জোরে। জোরে, জোরে।

 

নিজের ঘরের উঠোনে পৌঁছে দেখল – আলো নেই, বাতিহীন তুলসীতলায় দু-চাট্টা যা জোনাকি পেছনে ‘টিপা-লাইট’ গুঁজে
ঘুরে বেড়াচ্ছে ইতস্তত। – ওই খুঁটি পোঁতাই হয়েছে, গ্রামে বিদ্যুৎ-আসা এখনো সুদূরপরাহত। জোনাকির মিচিক্ মিচিক্ আলোতেও ঝকমক করছে দাওয়ায় ঠেস দিয়ে রাখা অণিতার নতুন কেনা লেডিজ সাইকেলটা। যেন ‘প্রতাপ’হীন ‘চৈতক’।

ধক! ধকধক করে উঠল হরিহরের বুক! এমন তো কতই দেখা যাচ্ছে, শোনা যাচ্ছে – সাইকেল রাখা আছে যেমনকার তেমন, এক-দেড় মাইল দূরে শাল কি পিয়াশাল গাছের নিচে পড়ে আছে আরোহীর থ্যাঁতলানো মুখ! মোটরবাইক স্টার্ট দেওয়াই আছে, হাত-পা বাঁধা অবস্থায় গাছের ডালে ঝুলছে বাইকবালার গুলিবিদ্ধ দেহ –

মুখে কথা সরছে না, উন্মাদের মতো হরিহর সাইকেলের বেল বাড়াচ্ছে – ‘ট্রি-নি-টি’ – করে তো নয় – ‘ক্রিং-ক্রিং-ক্রিং’ – পাগলা-ঘণ্টির মতো বাজিয়ে চলেছে, বাজিয়েই চলেছে – ততক্ষণ, যতক্ষণ পর্যন্ত না অণিতা এসে হাত চেপে ধরল তার।

‘হচ্ছিটা কী?’

অণিতার হাতের স্পর্শে ধাতস্থ হলো সে। কোনো কথা না বলে অণিতার মুখের দিকে দুদ- তাকিয়ে থাকল। মুদিমালের কারবারি হলে কী হবে, কতকটা – ‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয় – সে কি মোর অপরাধ’ – সেই ঢংয়ে।

তারপর সম্বিৎ ফিরে পেয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘হেরিকেন জ্বালাওনি যে?’ আদুরে গলায় অণিতা বলল, ‘এই তো এলাম!’

মুহূর্তে ফের দাওয়ায় ঠেস দিয়ে রাখা ‘লেডিজে’র দিকে চোখ চলে গেল হরিহরের। – ‘কঁঠে সাইথিলো?’ কোথায় গিয়েছিলে?

নিচুস্বরে অণিতা উত্তর করল, ‘ক-হি-টি’। নিজের কথা সহসা না বলে উলটে পরিহাসচ্ছলে স্বামীকেই জিজ্ঞাসা করল, ‘অঙ্গপুরুষের এতে দেরি হেলা যে?’

সন্তর্পণে চারপাশটা দেখে নিয়ে ততোধিক নিচুস্বরে হরিহর বলল, ‘ঘরে চলো – সব বলছি!’

 

সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় থেকে গাঢ়তর হলো। জঙ্গলমহালের গাঁ-গঞ্জ ‘তরুছায়ামসীমাখা’ তো নয়, সত্যি সত্যি ঘোরঘট্ট কালিমায় ঢাকা পড়ল। তার মধ্যেও আকাশে তারার মতো জোনাকির মিচমিচানি, দূরদূরান্তে ডিবরি-আলোর ঝলকানি, দু-চাট্টা টর্চের ফোকাস – এদিক-সেদিক। ‘হাতি ঝুলঝুল আইল বান’ – হাতি নামারও সময় এসে গেল।

হাত-মুখ ধুয়ে ঘরের ভেতর পাশাপাশি বসল দুজনে। বাটিতে মুড়ি ঢেলে নুন-লংকা-পেঁয়াজ দিলো অণিতা, নিজেও নিল। ক্ষেতেরই লংকা, ছোট ছোট পেঁয়াজ –

দু-গাল খেয়েই টর্চ-হাতে উঠে পড়ল হরিহর। ঘরের চারধারে টর্চ-লাইটের ফোকাস ফেলে তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখল – কেউ কোত্থাও লুকিয়ে নেই তো! ওই তো –

উদারডাঙার মাঠ – জনমনুষ্যহীন, খাঁ খাঁ, শুধু অন্ধকারের ধোঁয়া ‘গাবাচ্ছে’। কতক ‘বাঘযুগ্নি’ পোকাও উড়ছে-ঘুরছে। নদীধারের পালজমিন – রাতের টসাটসা শিশির ঝরছে ডিঙলা-রহড় কাঁকুড়ের ক্ষতির ওপর। দু-চাট্টা শেয়াল যা থেকে থেকে সমস্বরে ডেকে উঠছে, ‘হু-উ-উ-উ’ – ! জঙ্গলমহাল – শুকনো পাতায় খড়মড়ে আওয়াজ, ও কিছু নয় ও কিছু নয়, বুকে হেঁটে ‘নিশিলতা’ সলসল করে পথ ভাঙছে, পথ ভাঙছে –

ঘরে ঢুকে ফের বাটির মুড়িতে আঙুল চালাতে চালাতে হরিহর নিরুদ্বেগ কণ্ঠে বলল, ‘আর কোনো ভয় নেই, কাল থেকে তুমি ডিউটিতে নির্ভয়ে যেতে পারবে।’

শুনেও কিছুক্ষণ গুম মেরে থাকল অণিতা, কোনো কথা বলল না। এক-দু মুঠো মুড়িও চিবোল, চিবোচ্ছে –

তারপর আচমকা মুখ তুলে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী করে?’

নদীধারে এসময় একঝাঁক শেয়াল ডেকে উঠল একসঙ্গে ‘হু-উ-উ-উ!’ তবে তো হাতির দঙ্গল ডিঙলা-রহড়-বেগুন-বাইগনের ক্ষতিতে শুরু করে দিয়েছে তা-ব!

করুক গে। হরিহর মরিয়া, হরিহর বেপরোয়া। গলার স্বর নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলল, ‘তুমি-আমি – আমরা আজ থেকে ‘মাও’ হয়ে গেলাম অণিতা।’

বলেই উত্তেজনায় উঠে দাঁড়াল হরিহর, হাতের চেটোয় থাপ্পড় ঠুকে নির্লজ্জ হাসিতে ফেটে পড়ে বলে উঠল, ‘মার দেয়া কেল্লা – আর কাকে ভয়?’

তেল-নুনের হিসাবী হরিহরের এহেন অংক-কষা মন্তব্যে আর নির্ভীক আস্ফালনেও রা কাড়ল না অণিতা। চুপচাপ, শেষ
হয়ে-যাওয়া মুড়ির বাটি জলে ধুয়ে তুলে রাখল। রাত বাড়ছে। ধীরেসুস্থে রাতের রাঁধাবাড়া সারতে অতঃপর রান্নাঘরে ঢুকল সে।

রাত বাড়ছিল, রাত তো বাড়েই। ঝিঁঝি ডাকে, রান্নাঘরের আশপাশে থাকা ‘কটকটি ব্যাঙ’ কটকট করে মাঝেমধ্যেই ডেকে ওঠে। আজ যেন সবকিছুই খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল সে। একসময় রান্নার কাজ সেরে হাত-পা ধুয়ে নিশ্চিন্তে মুদিখানার হিসাব-নিকাশে ব্যস্ত – কুশলী ‘ম্যানেজার’ – তার স্বামীর কাছে এসে বসল অণিতা।

ভেজা হাত-পা শাড়ির আঁচলে মুছতে মুছতে বলল, ‘তার আর দরকার নাই।’

যেন আকাশ থেকে পড়ল হরিহর। মুখ তুলে জিজ্ঞাসা করল, ‘কিসের কী?’

‘কাল ডিউটিতে যাবার।’ খানিক থেমে দাঁতে ঠোঁট কামড়ে অণিতা কোনোমতে বলল, ‘মুই ত আজ বি-ডি-ও আপিসে ‘রেজিগ্নেশান লেটার’ জমা করি আইনু!’

 

আর কোনো সাড়াশব্দ নেই, অনেকক্ষণ চুপচাপ। যেন ঘরের মধ্যে মড়া আগলে বসে আছে স্বামী-স্ত্রী। এখন আর কিছু করার নেই। দিঙ্ দিঙ্ করে রাত বাড়ছে, রাত ক্রমশ বড় হচ্ছে –

সহসা তারা দুজনেই জানালার দিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখল – গ্রিল টপকে ঘরের ভেতর শুঁড় বাড়াচ্ছে ঝিঙালতা! গতকালের সাঁঝে ফোটা ঝিঙাফুল সারাদিনে বাসি, মলিন হয়ে ঝরে যাচ্ছে আর আজকের সাঁঝে ফোটা ফুলে ঝিঙালতা রদবদিয়ে ভরে আসছে।

‘ওঠো! রাত অনেক হলো, খাবে চলো!’

Published :


Comments

Leave a Reply