সাজেদুল আউয়াল : শ্রদ্ধার্ঘ্য

সাজেদুল আউয়াল – নাট্যকর্মী, নাট্য রচয়িতা-নির্মাতা, চলচ্চিত্রকার, গবেষক ও কবি।

সংস্কৃতি ও সাহিত্যজগতে বিচরণ করেছেন দৃপ্ত পদক্ষেপে। তবে বেশির ভাগ সময়ই নেপথ্যের কারিগর ছিলেন তিনি। প্রকাশ্যে আসতে যেন বড্ড সংকোচ ছিল তাঁর। ভালোবাসতেন লেখালেখি করতে। প্রিয় বিষয় ছিল নাটক-চলচ্চিত্র। কিন্তু তাঁর হৃদয়-গভীরে ফুটে ছিল পদ্যের পদ্ম। কর্মক্ষেত্রে ছিলেন নিবিষ্ট শিক্ষক, গবেষক ও নির্মাতা। স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগ এবং বাংলাদেশ সিনেমা ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ছিলেন তিনি।

কর্মচঞ্চল, বিনয়ী, সদা হাস্যোজ্জ্বল সাজেদুল আউয়ালের জন্ম  ১৯৫৮ সালের ২৫ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তিতাস পাড়ে জন্ম হওয়ায় আজন্ম তিতাসের প্রতি দুর্বলতা লালন করেছেন অন্তরে। সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি শৈশব থেকেই ঝোঁক ছিল তাঁর। মাত্র আট বছর বয়সে প্রথম মঞ্চে অভিনয় করেন তিনি। বেড়ে উঠেছেন পদ্মাপুরাণ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন শুনে; যাত্রা, পুতুলনাচ, সার্কাস দেখে।

১৯৭৩ সালে নেপথ্যকর্মী হিসেবে যোগ দেন ঢাকা থিয়েটারে। ১৯৭৪ সালে জড়িয়ে পড়েন চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সঙ্গে। তাঁর প্রথম রচিত কাব্যনাটক ফণিমনসা, যা ১৯৮০ সালে মঞ্চস্থ হওয়ার পর ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।

১৯৭৪ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে যুক্ত ছিলেন শহীদ আলতাফ মাহমুদ সংগীত বিদ্যানিকেতন, সিনে আর্ট সার্কেল ও বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদের সঙ্গে। বাংলাদেশ শর্টফিল্ম ফোরামের সঙ্গে প্রতিষ্ঠাকাল (১৯৮৬) থেকে জড়িত ছিলেন সাজেদুল আউয়াল। ছিলেন বাংলা একাডেমির জীবন সদস্য এবং এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশের সদস্য। ২০০৯-১০ সময়কালে ছিলেন বাংলাদেশ ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের সদস্য। এছাড়া দায়িত্ব পালন করেছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০১২-এর জুরি বোর্ডের সদস্য (২০১২) ও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বাছাই কমিটির সদস্য (২০১৩-১৫) হিসেবে।

চলচ্চিত্রের একনিষ্ঠ ভক্ত সাজেদুল আউয়ালের প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্ভানা মুক্তি পায় ১৯৯৯ সালে। এই চলচ্চিত্রের বিষয় ছিল বৌদ্ধ জীবনদর্শন। ২০১৭ সালের ১ ডিসেম্বর মুক্তি পায় তাঁর পরিচালিত পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ছিটকিনি। এই চলচ্চিত্রের সংলাপ, কাহিনি ও চিত্রনাট্য সাজেদুল আউয়ালের। নির্মাণ করেন সরকারি অনুদানে। প্রযোজনা করে ইমপ্রেস টেলিফিল্ম। চলচ্চিত্রটি দর্শক ও বোদ্ধা মহলে ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করে। ছিটকিনিতে অভিনয় করা শিশুশিল্পী আপন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। অন্যদিকে মেরিল-প্রথম আলো ‘সমালোচক পুরস্কার (চলচ্চিত্র)’ ক্যাটাগরিতে সেরা অভিনেত্রী হন রুনা খান। ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকারি অনুদানের জন্য ‘মৃত্যুঞ্জয়ী’ নামে একটি চিত্রনাট্য জমা দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সে-চলচ্চিত্র নির্মাণ থেকে এখন বহু যোজন দূরে চলে গেছেন সংস্কৃতি অন্তঃপ্রাণ এই মানুষটি।

নাটক-চলচ্চিত্রে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকার পাশাপাশি লেখালেখিতে আগ্রহ ছিল সাজেদুল আউয়ালের। বাংলা নাটক ও অসংখ্য চলচ্চিত্রের নানা দিক নিয়ে তাঁর বহু রচনা রয়েছে। প্রথম কাব্যনাটক ফণিমনসা। অন্য নাটকগুলো হলো – দক্ষিণবঙ্গীয় উপকূলে পঞ্চদশ শতকে পর্তুগিজ জলদস্যুদের হামলার ঘটনা উপজীব্য করে রচিত উপাখ্যান রাঙামিলার পাঙ্খাবিবি (১৯৮২)। এছাড়া লিখেছেন একক সংলাপভিত্তিক নাটক জুম্মান জমাদার (১৯৯২), কাব্যনাটক ছত্রিশ প্রহরের মাঠ (২০০৭)। রচনা করেছেন গবেষণাধর্মী গ্রন্থ তিতাসপারের মানুষ ও তাঁদের গান। এছাড়া বিখ্যাত নাট্যকার ওলে সোয়িঙ্কার নাটক দ্য সোয়াম্প ডুয়েলার্স অনুবাদ করেছিলেন অ্যালুমাকুরি কথা নামে। তাঁর অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে বাংলা নাটকে নারী-পুরুষ ও সমাজ (১৯৯৯), চলচ্চিত্রকলা (২০১০), চলচ্চিত্রকলার রূপ-রূপান্তর (২০১১), চলচ্চিত্রচর্যা (২০১৬), নাট্যচর্যা (২০১৮) উল্লেখযোগ্য। সম্পাদিত গ্রন্থের তালিকায় আছে – ঋত্বিকমঙ্গল (২০০১), সত্যজিতের স্রষ্টাবৃত্তি (২০১৩), বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের ইতিবৃত্ত (২০১৪), মৃণালমানস (২০১৫), বাঙালির চলচ্চিত্রচিন্তা।

ফিল্ম আর্কাইভের উদ্যোগে ২০০৮ সাল থেকে প্রকাশিত হতে শুরু করে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ জার্নাল পত্রিকাটি। শুরু থেকেই এই প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সাজেদুল আউয়াল। লেখা যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ছিলেন নিষ্ঠাবান ও গভীর মনোযোগী। ২০২০ সাল পর্যন্ত এই পত্রিকার সম্পাদনা পর্ষদের সদস্য এবং নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

২০০৯ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্র : সমাজবাস্তবতা ও নির্মাণভাবনা’র জন্য ডক্টর অব ফিলোসফি উপাধি লাভ করেন এই গুণী।

২০২১ সালের ১৫ এপ্রিল করোনা সংক্রমণ-পরবর্তী জটিলতায় অনন্তলোকের পথে যাত্রা করেন সাজেদুল আউয়াল।

মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে কালি ও কলমে ফোন দিয়েছিলেন। জানিয়েছিলেন, করোনাকাল নিয়ে কবিতাগুচ্ছ লিখছেন। ইচ্ছে ছিল কালি ও কলমে প্রকাশের জন্য দেবেন। লিখেও ছিলেন দুটি পদ্য। আরেকটি লেখা হলেই পাঠাবেন – এমনটিই কথা ছিল। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। তার আগেই মারা যান তিনি। তাঁর শেষ ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানিয়ে সেই দুটি পদ্য এ-সংখ্যায় প্রকাশ করা হলো শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে।

করোনাকালের কাব্য

সাজেদুল আউয়াল

ফুততা-বেটা সমাচার

এক.

আরহাম ওই আসছে তেড়ে

হাতে নিয়ে স্টেথিস্কোপটা,

করোনা বলে পালাই পালাই

কে জানত এরা ফুততা-বেটা!

সকাল : ০৬ : ১৫

১৫/০৩/২১

দুই.

পালাই পালাই পালাই বলেও

এখনো তুই পালালি না!

আমার ফুততার ফুসফুস ছেড়ে

এখনো তুই গেলি না?

রাত : ১১ : ৪০

১৭/০৩/২১

তিন.

শোন্, সব গালি তোকে দেব 

আলো দেব পিছলা-কচকচ;

সাথে অনতুন দেব, তানতিনও,

ডেলি-ডেলি দুধ-লুটি খাওয়াব।

কী বল্লি, এতেও তোর হবে না!

দাঁড়া, এখন তবে স্ক্রু-ড্রাইভার দিয়ে 

ফুটো করছি তোর পেট;

সোজা হাতে ধরিয়ে দেব 

উহান যাওয়ার টিকেট!

সকাল : ০৫ : ২৫

১৮/০৩/২১

[কোভিড-১৯ ইউনিট, কক্ষ নং : ঊড-১০০৮/অ,

স্কয়ার হাসপাতাল]

টিসুকথা

গত সনে এ-সময় শুয়ে ছিল বেডে

শাহীন, ছোট্ট ভাইটি আমার –

ডায়ালাইসিস চলত সপ্তাহে দুবার;

দেখিতে সুন্দর, চোখ বেয়ে গড়াত কেবল জল –

টিসু দিয়ে মুছে দিতাম আমি।

আজ এ-সনে আমি শুয়ে বেডে

কোভিড-১৯ নিউমোনিয়া নিয়ে।

চোখ বেয়ে নামে জল রাত-বিরেতে –

নিজ হাতে মুছি জল টিসু দিয়ে।

জানি, পারলে আজিমপুরের মাটি ফুঁড়ে

দুরন্ত বেগে ঝড়ে ছুটে চলা টিনের চালের টুকরোর মতো 

একলাফে ছুটে এসে বসত বেডের পাশে –

মুছে দিত বড়ো ভাই শামীমের চোখ;

হায়, পোড়া নসিব, করোনা খেয়ে যায় 

ফুসফুস আমার।

রাত : ০৩ : ০৫

১৮/০৩/২১

[কোভিড-১৯ ইউনিট, কক্ষ নং : EW-1008A, স্কয়ার হাসপাতাল]