জাহিদ মুস্তাফা
নতুন এক শতাব্দীতে আমরা পরিবর্তনের নানা প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে চলেছি। চারুশিল্পও এ-প্রক্রিয়া থেকে দূরে নয়। দীর্ঘকাল ধরে দৃশ্যশিল্পের যে-অবয়ব দর্শকদৃষ্টিকে তৃপ্ত করে এসেছে, সেই জায়গাটিতে পরিবর্তন এনেছে কনসেপচুয়াল আর্ট অর্থাৎ ভিডিও আর্ট, স্থাপনাশিল্প, শিল্পীর পারফরম্যান্স প্রভৃতি। প্রচলিত দৃশ্যশিল্পও তো বদলেছে। রূপকধর্মী, প্রতীকী চিত্রের প্রকাশভঙ্গির জায়গায় এখনকার নবীন ও তরুণ শিল্পীর চিত্রপট বিষয়, বক্তব্য ও অভিব্যক্তি প্রকাশে সচকিত। নবীন প্রতিভাধর শিল্পী বিশ্বজিৎ গোস্বামী আমাদের দেশে এ-দলের প্রধান একজন।
১১ থেকে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত দুই সপ্তাহব্যাপী ঢাকার গুলশানে বেঙ্গল আর্ট লাউঞ্জে ‘ইন মোশন’ শিরোনামে শিল্পী বিশ্বজিৎ গোস্বামীর তৃতীয় একক চিত্র-প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথম একক প্রদর্শনী ২০১১ সালে ঢাকার গুলশানে ইজুমি আর্ট স্পেসে ও দ্বিতীয় একক ২০১৩ সালে ঢাকার নরডিক ক্লাব গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হয়। দুটি প্রদর্শনীই ছিল আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য। সে-অর্থে তৃতীয় এককই সর্বসাধারণ্যের জন্য প্রথম। এ-প্রদর্শনীতে শিল্পীর সাম্প্রতিককালে আঁকা অন্তত পঁচিশটি চিত্রকর্ম স্থান পায়। এর বেশিরভাগ ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক মাধ্যমে আঁকা। ক্যানভাসে তেলরঙেও কাজ করেছেন শিল্পী।
আমাদের শিল্পাঙ্গনে নবীন বয়সেই সুপরিচিতি পেয়েছেন তিনি সুচারু বাস্তবধর্মী কাজের দক্ষ প্রকাশভঙ্গির জন্য। সমসাময়িক চিত্রশিল্পীদের কাজের ধরনে এই বাস্তবানুগতার প্রতি আনুগত্য দেখা যাচ্ছে। কারিগরি দক্ষতা অর্জনেও তাঁদের পারদর্শিতা দর্শকদৃষ্টিকে মুগ্ধতা দিচ্ছে। ডিজিটাল আলোকচিত্রের ব্যাপক প্রয়োগ অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। প্রযুক্তির এ-সুবিধা নিতে কসুর করেননি বিশ্বজিৎ ও তাঁর সমসাময়িকেরা। নিত্যনতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় নিজের কৃৎকৌশলকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন বিশ্বজিৎ। তরুণ এই শিল্পীর জন্ম ১৯৮১ সালে নেত্রকোনায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে ২০০৮ সালে অঙ্কন ও চিত্রায়ণ বিভাগে স্নাতক সম্মান শেষ করে ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন থেকে ২০১০ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। উভয় পরীক্ষায় তিনি ডিসটিংশনসহ প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। ২০১১ সালে কলাভবনে তিনি গ্রাফিক্সে পাঠ নেন। বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রভাষক।
এখনো এদেশের প্রভাবশালী শিল্পীদের বড় অংশ চিত্রতলের বিন্যাস, আঙ্গিক, বুনট প্রভৃতি ঠিক রেখে দৃশ্যকলার প্রচলিত ধারায় কাজ করে চলেছেন। উত্তরাধুনিক চিন্তন প্রক্রিয়ায় আমাদের নবীন শিল্পীকুলের একটি অংশ নিজেদের প্রকাশ-প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। এই আধুনিকতাও এসেছে পশ্চিম থেকে। তবে শিল্পোপকরণ প্রয়োগের বাধ্যবাধকতার বিলোপ ও শিল্পের পেছনে দর্শন-চিন্তার গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের শিল্পের বৈষম্য দূর হওয়ার সুযোগ অবারিত হয়েছে এতে। আমাদের তরুণরা সমকালীন বিশ্বশিল্পের গতিপ্রকৃতি বুঝে নিজেদের করণীয় নির্ধারণ করে স্বকীয়তার সঙ্গে পথ চলতে চাইছেন।
কনসেপচুয়াল শিল্পের পথ থেকে ভিন্ন হয়েও আমাদের সমকালীন তরুণ শিল্পীদের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও উজ্জ্বল শিল্পী হিসেবে বিশ্বজিৎ সোম সুপরিচিত হয়ে উঠেছেন। চিত্রগত দর্শনচিন্তা নিয়েই প্রচলিতের মধ্যে নিজের সৃজন কাজের একটি ধারা নির্মাণে প্রয়াসী হয়েছেন তিনি। পাশ্চাত্য একাডেমিক অঙ্কনরীতির অনুপুঙ্খতাকে অনুসরণ করে ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক ও তেলরঙে নাটকীয় আবহে শরীর-কাঠামো সংস্থাপনে বিশেষ ঝোঁক রয়েছে তাঁর। প্রথাগত মানব অবয়বকে উপস্থাপনার স্বাতন্ত্র্যে উঁচুমানের কৃৎকৌশলের দক্ষতায় ফুটিয়ে তোলায় তিনি প্রায় অতুলনীয়। ক্যামেরা রিয়ালিজমের সঙ্গে প্রতিযোগিতার চ্যালেঞ্জ পাই তাঁর চিত্রকর্মের গঠন ও বিন্যাসে। মানবশরীরের ভঙ্গি ও অভিব্যক্তিকে সাদৃশ্যময় প্রকাশ করেও কখনো কখনো তাকে অতিরঞ্জনে এমনভাবে তুলে ধরেন যাতে এই রূপান্তর বিমূর্ততার পথে বাঁক নেয়। পেশিবহুল শরীরের ছন্দময়তায় দর্শকদৃষ্টিকে আকৃষ্ট করে তিনি পা বাড়ান মেটামরফসিস অর্থাৎ রূপান্তরণের পথে। বস্ত্তরূপের বর্তমান থেকে নিত্যরূপের চিরায়তের সন্ধানে। বিশ্বজিৎ শুরু করেছিলেন একক শরীরের সরল উপস্থাপনায়। অবয়বের দুমড়ানো টানাপড়েন এত অনুপুঙ্খ যে, তা যেন দেয়াল পেরিয়ে দর্শকের কাছে চলে আসে। শিল্পীর পরিকল্পনায় আলো-ছায়ার ব্যবস্থাপনায় কল্পিত এক আবহে তিনি স্থাপন করেন পুরুষ অবয়ব, যেন বাস্তবতা পেরিয়ে এক ফ্যান্টাসি রূপ ফুটে ওঠে তাতে। শরীরকাঠামোর বাইরের রূপের মোহ কাটিয়ে ক্রমান্বয়ে তিনি সাদৃশ্য থেকে রূপান্তরের প্রতি আকৃষ্ট হন। শরীরের নানা অংশ খন্ডিত অংশকে লহরের মতো আলাদা আলাদা সজ্জিত করেছেন শিল্পী। এগুলো অনেকটা পরাবাস্তব ধরনে মানব রূপ ধারণের দিকে এগোয়। এই রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় একসময় আমরা লক্ষ করি, মানুষের শরীরের অংশগুলো যেন ক্রমান্বয়ে পাখির অবয়বে পূর্ণতার পথে ধাবিত হয়।
এসব নানামুখী চিত্ররচনায় শিল্পী ব্যস্ত থাকলেও বিশ্বজিতের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পুরুষের পেশিবহুল শরীরের নানা অভিব্যক্তি। এগুলোর গঠন-অঙ্কন এতটাই বাস্তবানুগ যে, এ নিয়ে মুগ্ধতার শেষ নেই। রিয়ালিস্টিক উপস্থাপনা বরাবরই পছন্দনীয় দর্শক ও নবীন শিল্পশিক্ষার্থীর কাছে; বোদ্ধাদের কাছেও এর মূল্য নেহাত কম নয়। কিন্তু এর পেছনে নয়নজুড়ানো মুগ্ধতা যতটা আছে, তেমন চিন্তন-প্রক্রিয়া আছে বলা যাবে না। বিশ্বজিৎ যে সেটি উপলব্ধি করেন তা সুস্পষ্ট। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় নিজের সৃজন-দর্শনকে কাজের ভেতরে তুলে ধরার প্রয়াস আছে তাঁর। এই প্রদর্শনীতে একটি চমক দিয়েছেন শিল্পী। সাধারণত পেশিবহুল পুরুষশরীরের ছবি আঁকলেও এবারই শুভ্র চাদরে আবৃত কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে শায়িত নারীর ছবি এঁকেছেন বিশ্বজিৎ গোস্বামী। নারীশরীরের বাঁক যেন চাদর ছাপিয়ে যায়। এই চিত্রটি গ্যালারির একটি কক্ষে এক আলংকারিক খাটে স্থাপন করায় একটি নাটকীয়তা তৈরি হয়েছে। এটি ক্যানভাসে তেলরঙে আঁকা।
একই মাধ্যমে শিল্পী আরো দুটি কাজ করেছেন। এগুলোরও শিরোনাম দেননি। দুটিতেই পুরো শরীরে সাদা বস্ত্র-আবৃত একজন পুরুষের পোশাকি খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসার যুদ্ধ প্রতিফলিত। এটা কি শিল্পীর সঙ্গে নিজের সৃজনযুদ্ধকেই মনে করায় না!
গোলাকার চিত্রপটে হংসবলাকা নিয়ে বেশকটি কাজ করেছেন শিল্পী। শিরোনাম দিয়েছেন – রূপান্তরণ ও শারীরিকভাবে টিকে থাকা। শূন্য পরিসরে ঘুরে-ঘুরে উড়ে-উড়ে হাঁসসদৃশ পাখির গতিময়তায় রূপান্তরের একটা কল্পিত চেহারা যে দাঁড়ায়, সেটি তুলে ধরেছেন শিল্পী। এগুলো ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক রঙে আঁকা।
প্রদর্শনীটি শিল্পী বিশ্বজিৎ গোস্বামীর দক্ষ হাতে আঁকা বাস্তবানুগ চিত্ররচনার কৃৎকৌশলের এক উৎকর্ষতম আয়োজন হিসেবে দর্শক-বোদ্ধাদের মনে থাকবে। সৃজনশিল্পী হয়ে এই অল্প বয়সেই তিনি আমাদের সবার মনোযোগ আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছেন, এটি কম কৃতিত্ব নয়। তিনি নিশ্চয়ই আরো বহুদূর অগ্রসর হবেন।