সালকানতি পাসে ট্র্যাক করার উচ্চাশা ও বিপ্লবীর সাক্ষাৎ

কাউন্টারে কফির কথা বলে আমি রেস্তোরাঁর ওপেন-এয়ার টেরাসে এসে বসি।

নাম-না-জানা পর্বতের আড়ালে সূর্য সরে যাওয়াতে, মৃদু হয়ে এসেছে গড়িয়ে যাওয়া দুপুরের ঝকঝকে উজ্জ্বলতা। বিরল প্রজাতির অর্কিডে সাজানো পরিসরে নিরিবিলি বসে খানিক জিরিয়ে নিতে শারীরিকভাবে ভালোই লাগে, তবে মন থেকে অজ্ঞাত বিভ্রান্তিকে ঠিক কাটাতে পারি না। প্রায় আটদিন হতে চললো পেরুতে আমি ঘোরাফেরা করছি, পয়লা পাঁচদিন কেটেছে রাজধানী শহর লিমাতে, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মায়-মোলাকাতে এবং মরচেপড়া এসপানিওল ঝালাই করে নিয়ে ওয়ারি জনগোষ্ঠীর তৈরি পিরামিড প্রভৃতিতে ঢুঁ মেরে।

আত্মবিশ্বাস খানিক মজবুত হতেই আমি বাস পাকড়ে, নাঝকা সংস্কৃতির পুরাতাত্ত্বিক উপাত্তে ভরপুর উপকূলঘেঁষে আস্তে-ধীরে এগোই, আরিকিপা নামক চুনাপাথর চূর্ণের স্টাকো সুরকিতে তৈরি শ্বেতশুভ্র দালানকোঠায় সজ্জিত একটি নগরীর দিকে। জানালায় কুয়াশাচ্ছন্ন এক আগ্নেয়গিরির দৃশ্যপটে ঋদ্ধ একটি হোটেলেও ঘণ্টা সাতেক শুয়ে-বসে কাটানোর মওকা মেলে। অতঃপর জনাদুয়েক সহযাত্রীর সঙ্গে মিলেঝুলে ল্যান্ডরোভার ভাড়া করে এসে পৌঁছাই, এক জামানায় ইনকা-সম্রাটদের শাসনের জন্য প্রসিদ্ধ প্রাক্তন রাজকীয় রাজধানী কুসকো নগরীর প্রান্তিকে।

সচরাচর লিমা থেকে সড়কপথে কুসকোতে এসে পৌঁছতে লাগে ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা, যাত্রাপথে আমার ব্যয় হয়েছে প্রায় তেত্রিশ ঘণ্টা। হাতে অঢেল অবসর, সুতরাং সময় নিয়ে সংযত হওয়ার প্রয়োজন আমার নেই, কিন্তু শারীরিক ধকল ও ক্লান্তি আমলে আনতে হয়। ব্ল্যাক কফির কড়া ক্বাথে চুমুক দিয়ে ভাবি, আরো অন্তত ঘণ্টা পাঁচেক জেগে থাকাটা জরুরি।

আমি অপেক্ষা করছি, মাচ্চুপিচ্চু ট্রেইলে ট্র্যাকিংয়ের আয়োজন করে প্রসিদ্ধ হওয়া গাইড এলিয়াসিন পালোমিনোর। এই অঞ্চলের আদিবাসী কেচোয়া সম্প্রদায়ের সন্তান এলিয়াসিন আমার পরিচিত ও স্নেহভাজন। আজ থেকে বছর পনেরো আগে, কৈশোরোত্তীর্ণ এলিয়াসিন যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিল একটি প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামে শরিক হতে। তখন হোম-স্টে কর্মসূচির চাহিদা অনুসারে সে সপ্তাখানেক আমাদের পরিবারে বসবাস করে। প্রশিক্ষক ও মেন্টর হিসেবে আমার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠতে দেরি হয় না। যেহেতু আমার বয়স তার দ্বিগুণেরও বেশি, তাই ছেলেটি আমাকে কখনো ‘পাপা’ আবার কখনো ‘পাপিতো’ বা ‘পিতা’ সম্বোধন করে আত্মীয় হয়ে উঠেছে। আমি তার মারফত ইনকা-সম্রাটদের হারানো মাচ্চুপিচ্চুতে ট্র্যাক করতে যাওয়ার পরিকল্পনা করছি।

ট্র্যাকের আগে প্রস্তুতি হিসেবে কুসকো নগরীর হোটেল-ফোটেলে না থেকে, দু-রাত্রি কোনো পেরুভিয়ান আদিবাসী কেচোয়া সম্প্রদায়ের কারো সংসারে কাটানোর ইচ্ছা এলিয়াসিনকে জানালে, সে আমাকে তার বসতবাড়িতে উঠতে বলেছে। এলিয়াসিনের বয়োবৃদ্ধ পিতা সিনিওর থিয়াগো পালোমিনো এক আমলে ছিলেন শাইনিং পাথ নামে মাওবাদী গুপ্ত গেরিলা সংস্থার তাত্ত্বিক গুরু। পুরো এক যুগ কারারুদ্ধ থেকে বছরচারেক আগে তিনি ছাড়া পেয়েছেন। ইতোমধ্যে তাঁর স্ত্রীবিয়োগ হলেও ঘরদুয়ার বানিয়ে বিয়ে-শাদি করে এলিয়াসিন সংসার পেতেছে। আমি তাঁর বাড়িতে থেকে এ-সুযোগে সমাজে শ্রদ্ধেয় এই বিপ্লবীর ইন্টারভিউ করতে চাই। একটু আগে এলিয়াসিন টেক্সট-মারফত জানিয়েছে, মিনিট তিরিশেকের মধ্যে আমাকে পিক করতে সে এই রেস্তোরাঁটিতে এসে পৌঁছবে।

এলিয়াসিন এসে পড়ছে জানতে পেরে নিশ্চিন্ত হই, তবে নতুন জায়গায় এসে পড়ার বিভ্রান্তি কাটে না, বরং তাতে মিশ্রিত হয় অজানা এক অস্বস্তি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পাহাড়ি সড়কে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে হয়েছে ল্যান্ডরোভারে। তো উঠে পড়ে টেরাসের সংলগ্ন বাগানে হাঁটাচলা করে শরীরের খিল ভাঙার চেষ্টা করি। চোখে পড়ে, টিলা-টক্করের উঁচু-নিচু ধাপে, বেশ দূরে দূরে – গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে ফুটে উঠছে ইনকা-সম্রাটদের বিরাট আকারের ব্রোঞ্জ মূর্তির আদল।

ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকায় নোঙর করার আগে, এই এলাকায় প্রায় একশ বছরব্যাপী (১৪৩৮-১৫৩৩) ছিল
ইনকা-সম্রাটদের শাসন। যদিও মেক্সিকোর আজটেক সম্প্রদায়ের শাসকরা ছিলেন তাঁদের সমসাময়িক (১৩২৫-১৫২১ খ্রিষ্টাব্দ), তথাপি আকার-আয়তনে হাল-জামানার কলম্বিয়া থেকে চিলি পর্যন্ত বিস্তৃত ইনকাদের সাম্রাজ্য ছিল অনেক বড়। স্থাপত্যকীর্তি, নগর ও রাজপথ নির্মাণের জন্য নামজাদা ইনকা-সম্রাট পাচাকুতির পেল্লায় মূর্তির দিকে তাকিয়ে আমি ভাবি, দিল্লিতে ইনকাদের সমসাময়িক লোদি বংশের একাধিক সুলতান (১৪৫১-১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দ) এবং বাদশাহ হুমায়ুনও
(১৫৩০-১৫৪০ খ্রিষ্টাব্দ) আরো শতাব্দীকয়েক জনস্মৃতিতে দীপ্যমান হয়ে থাকবেন, বোধ করি স্থাপত্যকলায় তাঁদের অবদানের জন্য।

ইনকা শাসকদের সঙ্গে দিল্লির সুলতানদের প্রতিতুলনা বিষয়ক ভাবনা বিশেষ বিস্তৃত হতে পারে না। ফের অজ্ঞাত এক বিভ্রান্তিতে বিপন্ন বোধ করি। সোডাজলে বিস্ফোরিত বুদ্বুদের মতো স্ট্রেসকে অবজ্ঞা করতে পারি না। মনে হয়, অসাবধানে ছুড়ে ফেলা সিগ্রেটের আগুনে মিহিভাবে পুড়ছে সোফার সবচেয়ে সুন্দর কুশনের রেশমি ফুলটি। উদ্বেগের কার্যকারণ খুঁজে পেতে বিলম্ব হয় না।

আসার পথে দুবার আমাকে বদল করতে হয়েছে বাস। আয়াকুচো নামে ইস্পানিয়া থেকে আসা ঔপনিবেশিক প্রশাসকদের হাতে গড়া এক নগরীতে ঘণ্টা-তিনেকের জন্য থেমেছিলাম, ওখানে প্রথম চাক্ষুষ করি আন্দিজ পাহাড়ের বিপুল বিস্তার। পর্বতটিকে খুঁজতে হয়নি এক বিন্দু, আয়াকুচো শহরটি মূলত তৈরি হয়েছে ফুটহিলসের অন্দরমহলে। ওখানে ঘোরাফেরার সময় কফিবার, গিফট শপ কিংবা বাথরুমে ফেলে এসেছি ক্যামেরা ও নোটবুক। আমি সচেতন যে, যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক আলোকচিত্র ও ডিটেইল নোটস ছাড়া লিমা কিংবা আরিকিপা অথবা আয়াকুচো সম্পর্কে আমি বিশেষ কিছু লিখতে পারবো না। টুকরা-টাকরা অভিজ্ঞতার ভাংতি মুদ্রায় পরিপূর্ণ খুঁতিটি হারানোতে বেজায় খিন্ন বোধ করি, ভাবি, এ ডিসঅ্যাপয়েন্টমেন্ট মোকাবিলা করার একটা উপায় এখনই খুঁজে বের করতে হয়।

না হয় যাত্রাপথের নগর, পর্বত কিংবা সমুদ্রসৈকত নিয়ে না-ই বা লিখলাম, যা হারিয়ে গেছে তা নিয়ে আফসোস না করে বরং আমার উচিত কুসকো নগরীর আশপাশে কী খুঁজে পেতে পারি, সেদিকে নজর দেওয়া। আই শুড বি লুকিং ফরোয়ার্ড, বলে হৃদয়-মনকে প্রবোধ দিতে গিয়ে সচেতন হই যে, যাত্রাপথের স্মৃতিটি ওভেন থেকে বের করে আনা পাউরুটির মতো টাটকা, এবং স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, ট্রিপটি ছিল আলট্রা একসেলেন্ট, আর আমিও উপভোগ করেছি যাকে বলে – রিয়েল গুড টাইম। সহযাত্রীদের কথা মনে ফিরে আসে।

ল্যান্ডরোভার ভাড়া করার ব্যাপারটা সুরাহা হয়ে যেতেই আরিকিপা শহরের হোটেলটির আঙিনায় কফি নিয়ে আমরা তিন সহযাত্রী চুপচাপ বসেছিলাম। আমাদের চোখের সামনে দিগন্তজুড়ে জগদ্দল হয়ে দাঁড়িয়েছিল ‘মিস্টি ভলকেনো’ নামে  পরিচিত, চূড়ায় মিহি ধোঁয়া-ওড়া ত্রিভূজাকৃতির শ্বেতশুভ্র জ্বলজ্যান্ত একটি আগ্নেয়গিরি। সহযাত্রী লুই পিয়ারে একটি পাখিকে আধার খাওয়াচ্ছেন। ফেঞ্চ-কানাডিয়ান এই সুদর্শন প্রৌঢ়ের বসতবাড়ি কুবেক-সিটিতে। তাঁর বাঁ-কানের ইয়াররিং থেকে ঝুলছে সিলভারের ছোট্টমোট্ট একটি সারসের প্রতীক। নিবিড়ভাবে বিনুনি করা পনিটেইলেও গাঁথা ম্যাকাও পাখির রঙচঙে পালক। পাখিদের হেবিট্যাট সংরক্ষণ এবং পিঞ্জিরায় অন্তরীণ খেচরদের বনানীতে অবমুক্ত করে পিয়ারে সবিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। এ-যাত্রায় তিনি খোপে খোপে বিভক্ত একটি পিঞ্জিরায় করে ক্যারি করছেন চারটি পোষা পাখি। এগুলো সংগ্রহ করেছেন কানাডার কুবেক-সিটিতে পাখি-পালক নাগরিকদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে। হাওয়াই জাহাজে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে এদের লিমাতে নিয়ে আসতে তাঁর কোনো সমস্যা হয়নি। তবে পেরুর ডোমেস্টিক এয়ারলাইন্স কার্গো হিসেবে পাখ-পরিন্দা বহন করতে অস্বীকৃতি জানায়। তো পিয়ারে পিঞ্জিরা ভর্তি চারটি খেচর নিয়ে বাসযোগে আরিকিপাতে এসেছেন।

আমাদের কফি-পান সমাপ্ত হওয়ার আগেই, আধার খাইয়ে একটি পাখিকে তিনি আগ্নেয়গিরি নিশানা করে অবমুক্ত করেন। তার ধারণা, মিস্টি ভলকেনোর নিচের ধাপের বনানী হচ্ছে এর আদি হেবিট্যাট, এখানেই নীড় বেঁধে এই খেচরের পূর্বপুরুষরা প্রজন্ম প্রজন্ম ধরে বসবাস করে চলছে। আমরা তাঁর উদ্যোগকে চিয়ার্স বলে সাধুবাদ জানাই। পিয়ারে বিড়বিড়িয়ে নালিশ করেন, হাওয়াই জাহাজ যেখানে হামেশা সার্কাসের হাতি কিংবা গণ্ডার ক্যারি করছে, সেখানে চারটি পুঁচকে পাখির এয়ার ট্রাভেলে এত আপত্তি কীসের? তিনি ফরাসি ভাষায় বিমান কোম্পানিকে খিস্তি-খেউড় করে বলেন, ‘কাম অন গাইজ, লেটস হিট দ্য রোড নাও’ – বলে আমাদের উঠে পড়তে তাড়া লাগান।

আমাকে এ-রেস্তোরাঁয় ড্রপ করে দিয়ে লুই পিয়ারে অন্য এক সহযাত্রী মেরি-প্যাট ম্যানিংগারের সঙ্গে কুসকো থেকে প্রায় ২৮ কিলোমিটার দূরে চিনচিরো শহরের দিকে রওনা হয়েছেন। তাঁর ধারণা, ওখানকার পার্বত্য উপত্যকা হচ্ছে অন্য একটি পাখির প্রাকৃতিক হেবিট্যাট বা নিবাস। এ-যাত্রায় আমার অন্তরঙ্গতা হয়েছে আটাত্তর বছর বয়স্ক মেরি-প্যাটের সঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা অঞ্চলের এই নারী তারুণ্যে ছিলেন ক্রপ ডাস্টার বা ক্ষেত-খামারে কীটনাশক ওষুধ স্প্রে করা হলুদ রঙের ছোট্টমোট্ট বিমানের পাইলট। কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতন হয়ে একপর্যায়ে চাকরি ছেড়ে মাঠে নামেন চাষিদের সচেতন করতে। তখন রাসায়নিকে দূষিত ফসলের জলাভূমিতে সংক্রমিত হওয়া পরিব্রাজক পাখিদের চিকিৎসার জন্য ভ্রাম্যমাণ ক্লিনিকেরও বন্দোবস্ত করেন। হালফিল তিনি ভ্রমণ করছেন পৃথিবীর হরেক দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর পল্লি-গ্রাম; উদ্দেশ্য – তাদের প্রার্থনার ভাষা ও পদ্ধতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা।

লিমার একটি গেস্টহাউসে আমি ও মেরি-প্যাট পাশাপাশি কামরায় বসবাস করি দিনকয়েক। তখন কথাবার্তায় তাঁর সম্পর্কে বেশকিছু ব্যক্তিগত তথ্যও আমার গোচরে আসে। পেরুতে আসার মাসখানেক আগে তিনি শিকার হয়েছিলেন দ্বিতীয়বারের স্ট্রোকে। শারীরিক এই বিপর্যয়ের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতা আছে। তাঁর যে মেয়াদ সীমিত এ-ব্যাপারে তিনি পুরোমাত্রায় সচেতন, তাই তৃতীয় স্ট্রোকের আগে পেরুর নানা এলাকায় ঘুরেফিরে প্রার্থনা সংগ্রহবিষয়ক কাজটির একটি উপসংহারে আসতে চান।

আরিকিপা শহরে আসার পরপরই তাঁর শ্বাসপ্রশ্বাসে অ্যাজমার টান প্রবল হয়ে ওঠে। যাত্রাপথে আমরা আয়াকুচোতে থামলে খেয়াল করি, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৯১৫৮ ফুট উচ্চতায় উঠে এসে মহিলা আলটিচিউড সিকনেসে ভুগতে শুরু করেছেন। তখন জানতে পারি যে, হাই এলিভেশনে এই শরীরিক সমস্যার প্রতিষেধক ওষুধও মেরি-প্যাট খুঁজে পাচ্ছেন না। বিষয়টা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে শুরু করলে আমার নিজস্ব ওষুধ তাঁকে খেতে দিই। এ-ধরনের ওষুধ ক্রিয়াশীল হতে দিন তিনেক লাগে, মহিলা আজ গিয়ে পৌঁছবেন চিনচিরো শহরে, যার সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা ১২৩১৬ ফুট। বিষয়টা আমাকে উদ্বিগ্ন করে।

পদশব্দে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখি, আঙিনার ঘাস মাড়িয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে এলিয়াসিন, সঙ্গে তার সেকেন্ড গ্রেডে পড়ুয়া ছেলে। বাচ্চাটি সানগ্লাস-পরা চোখে খুব কিউট ভঙ্গিতে আমাকে ‘সালুদ’ বা ‘সালাম’ বললে, আমি ‘কমো তু ইয়ামা?’ বা ‘তোমার নাম কী’ – জানতে চাই। পরিষ্কার ইংরেজিতে সে জবাব দেয়, ‘দিস ইজ মাস্টার আমারু, আই ওয়েলকাম ইউ।’ গাড়িতে ড্রাইভরত এলিয়াসিনের পাশের সিটে বসে আড়চোখে তাকে পর্যবেক্ষণ করি। অনেক বছর পর সামনা-সামনি দেখছি, কৈশোরোত্তীর্ণ তরুণ এলিয়াসিন ইতোমধ্যে অ্যাডভেঞ্চার ট্যুর চালানো দায়িত্ববান পুরুষ হয়ে উঠেছে। তার মুখ থেকে সামাজিক দুর্বিপাকজনিত স্ট্রেস মুছে গিয়ে ফুটে উঠেছে দৃঢ় প্রত্যয়।

ট্র্যাফিকের ঝুট-ঝামেলায় বিপর্যস্ত কুসকো নগরীকে পাশ কাটিয়ে হাইওয়ের দিকে গাড়ি ছোটাতে ছোটাতে সে মন্তব্য করে, ‘পাপা সুলতান, লেট মি টেক ইউ টু রেইনবো মাউন্টেইন ফার্স্ট, তোমার ক্যামেরাতে চার্জ-টার্জ দেওয়া আছে তো?’ মিনমিনিয়ে ডিজিটাল যন্তরটি হারানোর ঘটনা রিপোর্ট করি। কোনো সহানুভূতি না জানিয়ে সে বলে, ‘আই সি অ্যান আইফোন ইন ইয়োর হ্যান্ড, ওটা দিয়ে তো দিব্যি ছবি তোলা যায়, নো প্রবলেমা।’ বলতে বাধ্য হই যে, টেলিফোন দিয়ে ছবি-টবি তুলতে আমি কমফোরটেবল না। পেছনের সিট থেকে মাস্টার আমারু আওয়াজ দেয়, ‘এসতে এ্যস মুই ফাসিল’, বা ‘সেলফোনে ছবি তোলা খুবই সহজ’, জলবৎতরলং।

আমি কিছু না বলে সিট পেছন দিকে টিল্ট করে রিল্যাক্স হয়ে বসার চেষ্টা করি। এলিয়াসিন জানতে চায়, ‘পাপিতো, তুমি আলটিচিউড সিকনেসের ওষুধ খেতে শুরু করেছো তো?’ বলতে বাধ্য হই যে, ওষুধ এক বৃদ্ধাকে ডোনেট করতে হলো। বিরক্ত হয়ে এলিয়াসিন বলে, ‘হেভেনস্ সেইক, কুসকো নগরীর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এভারেজ উচ্চতা হচ্ছে ১১১৫০ ফুট, এ মুহূর্তে আমরা ড্রাইভ করে যাচ্ছি রেইনবো মাউন্টেইনের কাছাকাছি চিকাকুপে শহরে, যার উচ্চতাতে যুক্ত হয়েছে আরো এক্সট্রা ৩০০ ফুট, তারপর যেখানে আমাদের বাসা, সেখানকার উচ্চতা ১১৭৫০ ফুটের মতো। ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড পাপা, ইউ আর গোয়িং টু হিট বাই আলটিচুড সিকনেস রাইট অ্যাওয়ে।’

কোনো জবাব না দিয়ে চুপচাপ ঘাড় হেলিয়ে আমি চলমান দৃশ্যরাজির দিকে নজর দিই। বাঁ-হাতে স্টিয়ারিং হুইলটি ধরে, সে ডানহাতে কফি-হোল্ডার থেকে খুঁজে বের করে ওষুধের একটি কৌটা আমার দিকে বাড়িয়ে দেয়। আলটিচিউড সিকনেসের ট্যাবলেটটি গিলে নিয়ে প্রশ্ন করি, সে কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রেসক্রিপশন ড্রাগটি জোগাড় করলো? জানতে পারি যে, ট্র্যাকার গোছের যেসব আমেরিকান পর্যটক তার গাইডেন্সে মাচ্চুপিচ্চু ট্রেইলে অ্যাডভেঞ্চার করতে আসে, ট্রিপ শেষে তারা অব্যবহৃত ওষুধ-বিসুদ ও টিনজাত খাবার ফেলে দেশে ফিরে যায়। রসদপত্র ও ব্যাকপ্যাক ক্যারি করা শ্রমিক-পোর্টাররা সচরাচর টিনজাত খাবার প্রভৃতি ভাগ করে নেয়, তবে আলটিচিউড সিকনেস জাতীয় ক্রিটিক্যাল ওষুধপত্র এলিয়াসিন নিজে স্টক করে রাখে – যদি-বা কোনো ট্যুরিস্ট কিংবা ট্র্যাকারের প্রয়োজন হয়।

 আমারু আইসক্রিমের বায়না ধরলে কুসকো-শহরতলির প্রান্তিকে এলিয়াসিন গাড়ি দাঁড় করায়। স্ট্যান্ডের পাশে সিমেন্টের বেঞ্চে বসে লোকজন শিশুসহ সপরিবারে উপভোগ করছে বরফ-শীতল মিষ্টান্ন। কোন চুষতে গিয়ে কী ভেবে আমারু আমাকে সেলফোনে ছবি তোলার কৃৎকৌশল শিখিয়ে দেয়। হুইলচেয়ারে বসা একজন প্রৌঢ় আইসক্রিম খেতে খেতে জানতে চান, কোন দেশ থেকে এসেছি। জবাবে আমি বাংলাদেশ বলতেই তাঁর পরবর্তী প্রশ্ন হয়, দেশটি কী পার্বত্য? আমি টোটাফাটা এসপানিওলে অনেক নদনদীতে শোভিত একটি ব-দ্বীপের বর্ণনা করার চেষ্টা করি। বেঞ্চে বসা মহিলাটি মন্তব্য করেন, তোমাদের দেশে নিশ্চয়ই সফল বিপ্লব হয়েছে? জবাব এড়িয়ে গিয়ে জানাই, স্বদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা পরিবর্তিত হয়েছে, এবং আজকাল খুব উমদা মানের আইসক্রিমও পাওয়া যাচ্ছে। কথাবার্তা বলে গাড়িতে ফিরে আসার সময় হুইলচেয়ারে বসা মানুষটি হাসিমুখে হাত নেড়ে, ‘সিনিওর, কে তে ভায়া বিয়েন’, বা ‘ আশা করছি আপনার সময় সুন্দর কাটবে’ – বলে শুভেচ্ছা জানান।

পিচঢালা সড়ক ধরে এলিয়াসিন ফের গাড়ি ছোটায়। মুহূর্ত কয়েক আগে, আইসক্রিম স্ট্যান্ডের কাছে চমৎকার অপরাহ্ণ উপভোগ করা পরিবারের সঙ্গে কথাবার্তা বলার মুগ্ধতা নিয়ে আমি চুপচাপ বসে থাকি। দুপাশে বৃক্ষলতাহীন পাহাড়-পর্বতও হাইস্পিড মোটরকারের সাঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটছে।

রাজপথের পাশেই গড়ে উঠেছে কয়েকটি অপরিকল্পিত দোকানপাট ও বিপণি। আমারু কেচোয়া ভাষায় কিছু বলে, তো দ্বিধান্বিতভাবে এলিয়াসিন গাড়িটি দাঁড় করায়। আমরা ফুটপাতে নেমে আসি।

আমারু আমাকে তার নানাবাড়ির লোকেশন দেখাতে চাইছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি পুরো কাহিনি শুনি। আমারুর জননী ডোরা যখন সেভেনথ্ গ্রেডের ছাত্রী, তখন তার সঙ্গে ঘটেছিল গুপ্ত রাজনৈতিক সংগঠন শাইনিং পাথের ক্যাডারদের সংযোগ। তাদের প্ররোচনায় সে কুরিয়ার হিসেবে মেসেজ আদান-প্রদানের কাজ করতো। বিষয়টি জানাজানি হলে পেরুর স্প্যাশিয়েল ফোর্স তাদের বসতবাড়ি ঘিরে ধরে। কিন্তু কোনো এক কৌশলে রক্ষীরা ঘরে ঢোকার আগেই মেয়েটি পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছিল।

ডোরা সে-যাত্রা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল বটে, তবে ফোর্সের লোকজন তার পরিবারের অন্য সদস্যদের বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে তাদের তিন পুরুষের পৈতৃক ভিটায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। এসব অনেক বছর আগের ঘটনা, রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলেও পারিবারটি আর পুড়ে ভস্ম হওয়া বসতবাড়ির দখল ফিরে পায়নি। একপর্যায়ে আত্মগোপনে থাকা ডোরাও ফিরে আসে তার পিতামাতার সংসারে। ততদিনে সে শুধু তরুণীই হয়ে ওঠেনি, মানসিক রোগেও আক্রান্ত হয়েছে।

ডোরার পারিবারিক ভিটায় বছরচারেক আগে গড়ে উঠেছে কনডর ট্রাভেল নামে একটি ট্যুর কোম্পানি। তার পরিবার মামলা-মোকদ্দমা করে চেষ্টা করছে বাড়ির মালিকানা-স্বত্ব পুনরুদ্ধার করতে। এ-অভিজ্ঞতার ট্র্যাজেডিকে হালকা করার জন্য আমি প্রস্তাব করি এলিয়াসিন ও তার পুত্রের যুগল ছবি তুলে দেওয়ার। আইফোনে স্ন্যাপশট নেওয়ার পরপর আমারু এগিয়ে এসে চেক করে – আমি সঠিকভাবে আলোকচিত্রটি তুলেছি কি না। আমরা ফিরে আসি গাড়িতে।

সড়ক পাড়ি দিতে দিতে আমি – একটু আগে ডোরার পরিবার সম্পর্কে যা জানলাম, তার সঙ্গে অতীতে এলিয়াসিনের কাছ থেকে যা শুনেছি, তা মেলানোর চেষ্টা করি। বেশ কয়েক বছর আগে, আমি যখন সিয়েরা লিওনে কর্মরত, তখন বিয়ের ঘোষণা দিয়ে এলিয়াসিন ই-মেইল পাঠায়। স্কাইপে বাতচিত করে জেনেছিলাম, কনে ডোরা হচ্ছে সেকেন্ডারি স্কুলে এলিয়াসিনের এক ক্লাস নিচের ছাত্রী। সে মেয়েটিকে ‘নবিও ডে-লা ইসকুয়েলা সেকুনডারিয়া’ বা ‘স্কুল-জীবনের সুইটহাটর্’ বলে উল্লেখ করে জানিয়েছিল, ডোরা ভুগছে প্রবল ডিপ্রেশনে, মাঝেমধ্যে বিঘ্নিত হচ্ছে তার মানসিক ভারসাম্য, এলিয়াসিনের ধারণা, দাম্পত্য জীবনের পারস্পরিক ভালোবাসায় সে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবে। আমি তার সঙ্গে সহমত পোষণ করে পাঠিয়েছিলাম

প্রীতি-উপহার।

এদের সংসারের কথা ভাবতে ভাবতে খানিক অন্যমনস্ক হয়েছিলাম, পেছনের সিট থেকে কেচোয়া ভাষায় আমারু প্রশ্ন করে, ‘কখন তার নানি বাড়িটি ফিরে পাবে?’ এর জবাব আমার কিংবা এলিয়াসিন – কারো মুখেই জোগায় না। নীরবতা অসহনীয় হয়ে উঠলে আমি ব্যাকপ্যাক হাতাপাতা করে বের করি শিশুতোষ গিফট হিসেবে নিয়ে আসা একটি পকেট-রোবোট। আমারু যান্ত্রিক খেলনাটি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

একটু ঝিমিয়ে পড়েছিলাম। দু-কানে অস্বস্তিকর অনুভূতি নিয়ে জেগে ওঠি। শ্বাস-প্রশ্বাসও দ্রুত হয়ে উঠছে। পিচঢালা সড়কে নেমে জার্কিং দিতে দিতে গাড়িটি থামে। পায়ের মাসলে প্রচণ্ড ক্র্যাম্প হচ্ছে, তাই আমাকে নামতে হয়। দারুণ নির্জন এক পাহাড়ি পথের পাশে আমি কয়েকটি ঘরবাড়িও চাক্ষুষ করি। ওখানে দিনযাপনের কোনো তৎপরতা দেখতে না পেয়ে পাঁজরের ভেতর কী যেন হাহাকার করে ওঠে। ফের গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে এলিয়াসিন মন্তব্য করে – ‘রোডস আর ভেরি রাফ অ্যান্ড আওফুলি টাফ হিয়ার, পাপিতো।’

আমরা এবার যে প্রবল রকমের পার্বত্য এক টেরেইনে ক্রমশ ক্লাইম্ব করছি, তা বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না। একটি লুকআউটে এসে এলিয়াসিন গাড়ি পার্ক করে। নামতে নামতে খেয়াল করি, জায়গাটি নির্জন না, দু-চারজন পর্যটক বাইনোকুলার, ট্রাইপড-টেলিক্যামেরা প্রভৃতি নিয়ে তাকিয়ে আছেন, দিগন্তের দিকে ধাপে ধাপে উঠে যাওয়া পর্বতের দিকে। এলিয়াসিন কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘ট্রাই টু ফাইন্ড রেইনবো মাউন্টেন পাপা, কেচোয়াদের ভাষায় পর্বতটি ভিনিকুনতা নামে পরিচিত। সামিটের উচ্চতা ১৭০০ ফিট।’

আমি দ্রুত অংক কষি, অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় রঙধনু পাহাড়টি উচ্চতার নিরিখে আমাদের এভারেস্টের অর্ধেক। সারফেসের ঘাস-বিরল বর্ণে খেলা করছে একাধিক শেড, দৃশ্যটি ব্যতিক্রমী। এলিয়াসিন কাছ থেকে সতর্ক করে, ‘পাপিতো, ইউ হ্যাভ অনলি ফাইভ-মিনিটস, আই অ্যাম সো স্যরি, দিস ইজ টু হাই … তোমার শরীর এখনো অ্যাডজাস্ট করে উঠতে পারেনি।’

তখনই মেঘদল ভেসে গিয়ে শেষ বিকালের তেরছা আলো পড়ে দূর পাহাড়ের রিজে। সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হয়ে ওঠে একাধিক বর্ণের বর্ণালি, আর মনে হতে থাকে আমি যেন দাঁড়িয়ে আছি ভিন্ন কোনো গ্রহের পার্বত্যাঞ্চলে। চোখের সামনে রঙধনু পর্বতটি পরিবর্তিত হয় নিসর্গের অতিকায় এক প্রিজমে, তারপর তাবৎ কিছু ঝলসে দিয়ে মৃদু হতে হতে ছড়াতে থাকে ভিন ভিন্ন্ন রকমের কালার প্রোফাইল।

ফের গাড়িতে চাপি। দক্ষ হাতে এলিয়াসিন ড্রাইভ করে নেমে আসে প্রায় সাড়ে পাঁচশো ফুট নিচে। আমার জোরাজুরিতে সে গাড়ি থামায়। দূরের সুউচ্চ-রিজের তলায় আশ্চর্য এক উপত্যকাকে চাক্ষুষ করার সুযোগ হয়। ওখানে চরছে হাই এলিভেশনের মেষজাতীয় প্রাণী আলপাকা ও লামা। পশুপালকদের ঘরদুয়ারের আউটলাইনও দেখতে পাই, কিন্তু কোথাও কোনো রাখাল দেখতে পাই না।

সামান্য দূরে – গোধূলির আভায় ফের বর্ণিল হয়ে ওঠা পর্বতের দিকে নিশানা করে দাঁড়িয়ে এক পর্যটক, মিউজিক কন্ডাক্টরের কায়দায় তিনি চোখ মুদে অঙ্গভঙ্গি করছেন। পাথরের ওপর রাখা ডিভাইসে প্রপাত থেকে উথলে-ওঠা জলকণার মতো ছিটকে উঠছে ঝংকার। সংগীতপ্রিয় এই পর্যটক নিঃসঙ্গ না, আলাপাকার ভেস্ট পরা তার সঙ্গিনী এক তাড়া সিডি নিয়ে আমার দিকে হেঁটে আসে। অ্যাপিল ছড়ানো হাসিতে চোখমুখ উদ্ভাসিত করে মেয়েটি বলে, ‘অনলি টেন ডলার।’ সিডিটির টাইটেলে লেখা ‘মিস্টিরিয়াস মাউন্টেন’, শব্দদুটি পড়ে সংগীতবিষয়ক পণ্যটি খরিদ করার প্রণোদনা পাই।

এলিয়াসিনের তাড়ায় ফিরে আসতে হয় গাড়িতে। ড্রাইভ করতে করতে সে বলে, ‘ইউ নিড অ্যাটলিস্ট দু ডেইজ টু অ্যাডজাস্ট উইথ দ্য হাই এলিভেশন। শরীর যখন পরিবর্তিত আবহাওয়ার সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে যাবে, পারহেপ্স ইউ ক্যান গো অ্যান্ড হাইক দ্য রেইনবো মাউন্টেন। প্লিজ বি অ্যা গুড বয় পাপিতো, অ্যান্ড ফলো মাই গাইডেন্স।’ গাড়িটি শার্প টার্ন নেয়, রঙধনু পর্বত চলে যায় দৃষ্টির আবডালে, তবে মনের নিভৃতে লেগে থাকে পুষ্পরেণুর মতো এক মুঠো রং।

এলিয়াসিনদের বাসার সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় অনুভব করি, পা টেনে ওপরের দিকে উঠতে অসুবিধা হচ্ছে, আর লাইট হেডেড বা করোটিতেও তাবৎ কিছু খালি হয়ে তা ছেয়ে যাচ্ছে শূন্যতায়। ঘরে ঢুকে ধপ্ করে বসে পড়ি সোফায়। কামরাটিতে আসবাবপত্রের বাহুল্য কিছু নেই। তবে দেয়ালজোড়া শেলফে থরে-বিথরে সাজিয়ে রাখা রাজ্যের সব বই। এলিয়াসিনের পিতা সিনিওর থিয়াগো পালোমিনো শাইনিং পাথের সশস্ত্র বিপ্লবে যোগ দেওয়ার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন, ইনকা সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিষয়ক ইতিহাস। বিপ্লবের এই তাত্ত্বিক গুরুর সংসারে বইপত্র থাকাটা বিচিত্র কিছু নয়। কিন্তু তিনি কোথায়?

এলিয়াসিনও আমার বস্তাসদৃশ ব্যাকপ্যাক টেনে নিয়ে অদৃশ্য হয়েছে ভেতরের কামরায়। একটু বিবমিষার মতো লাগে। মস্তিষ্কের ভেতরটা খালি হয়ে যাওয়াতে বিশেষ একটা উৎকণ্ঠিত হই না, কারণ আমি সচেতন যে, বিষয়টা আপার চেম্বারে সারবস্তুর অনুপস্থিতির জন্য নয়, বরং খালি খালি লাগাটা সম্পর্কিত হাই এলিভেশনের সঙ্গে।

লাঠিতে ভর দিয়ে বেরিয়ে আসেন সিনিওর পালোমিনো। ব্যাকব্রাশ করা রুপালি-চুলো বুড়ো মানুষটির সঙ্গে কোথায় যেন – এক যুগে স্বদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব কমরেড লালা শরবিন্দু দে-র মিল আছে। ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াই। তিনি আলিঙ্গনের ভঙ্গিতে আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলেন, ‘বিয়েনবেনিডো মি এরমানো, বিয়েনবেনিদো আ মি কাসা…’ বা ‘আমাদের সংসারে আপনাকে ওয়েলকাম হে আমার ভাই।’

গ্রেইপ ব্র্যান্ডি পিসকোর একটি বোতল নিয়ে এলিয়াসিন কামরায় ঢোকে। সিনিওর পালোমিনোর নির্দেশে ছোট্ট দুটি শার্টগ্লাসে সে ঢালে, হালকা ঘোলাটে-হলুদ রঙের পাকস্থলিতে অগ্নিউদ্দীপক তরল। সিনিওর ‘সালুদ’ বলে টোস্টের জন্য পাত্র তুলে ধরেন, ইনকা তথা কেচোয়া সংস্কৃতির এই ওয়েলকামিং রিচুয়েলের সঙ্গে আমি পরিচিত। তো বয়োবৃদ্ধ বিপ্লবীর সুস্বাস্থ্য কামনা করে পেয়ালা ঠোঁটে ছোঁয়াই। পূর্ণিমার স্পর্শে উথলে ওঠা সমুদ্রজলের মতো মথিয়ে ওঠে বিবমিষা। এক ঢোকে পুরো পাত্র খালি করে আমার বিব্রত অবস্থা অনুভব করেন, অতঃপর সহানুভূতির সঙ্গে তিনি বলেন, ‘নো তে প্রেঅকুপে…’, বা ‘নো প্রবলেম’। এলিয়াসিন পরিস্থিতি আমলে এনে বলে, ‘ইউ নিড টু রেস্ট পাপিতো, তিন-চার ঘণ্টার মধ্যে আলটিচ্যুড সহনীয় হয়ে উঠবে।’

সিনিওর পালোমিনো ইতোমধ্যে শেলফ থেকে টেনে বের করেছেন, ভারতবর্ষের স্বনামধন্য বিপ্লবী-দার্শনিক এম এন রয়ের ঢাউস একখানা বই। আন্তর্জাতিক পরিসরের এই প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা যে আমার স্বদেশের সন্তান – এ-ব্যাপারে সচেতনতার পরিচয় দিয়ে সিনিওর তৎক্ষণাৎ আমার শ্রদ্ধা অর্জন করেন। আমি গ্রন্থটির প্রচ্ছদ ছুঁয়ে মনে মনে এসপানিওল শিরোনামটি তর্জমা করার চেষ্টা করি। বইটি রচিত হয়েছে ‘নিউ হিউম্যানইজম ও র‌্যাডিকেল ডেমোক্রেসি’ নিয়ে। কিন্তু আমাদের কথাবার্তা জমে উঠতে বাদ সাধে এলিয়াসিন। সে চাচ্ছে ডিনার করে আমি যেন এখনই শুয়ে পড়ি। আগামীকাল ভোরে আমার শরীর যখন হাই এলিভেশনের সঙ্গে খাপ খেয়ে উঠবে, তখন না হয় বিপ্লব নিয়ে বিস্তারিত বাতচিত করা যাবে।

ডাইনিং টেবিলে বসে আমি সৌজন্যবশত জানতে চাই, ‘ডোরা কোথায়?’ জবাব দেয় মাস্টার আমারু, ‘মামিতা এসতা ইরানদো’, বা ‘মামণি কাঁদছে।’ এলিয়াসিন ও আমার চোখে-চোখে বার্তাবিনিময় হয়। আমারুর কথা শুনতে না পাওয়ার ভান করে আমি খাবারে হাত দিই। ‘পয়ো আ লা ব্রাসা’ বা রোস্টেড চিকেনের সঙ্গে পরিবেশিত হয়েছে ‘পাপা আ লা হোয়ানসিয়েনা’ বা চিজের প্রলেপ দেওয়া ভাজা আলু।

তারতিয়া-রুটি দিয়ে প্যাঁচিয়ে তা মুখে তুলি, স্বাদেগন্ধে আহার্যটি অপূর্ব, কিন্তু খেতে রুচি হয় না।

মুখে না তুলে নীরবে খাবার ঘাঁটছিলাম। সিনিওর পালোমিনো জানতে চান, আমি নকশাল আন্দোলন সম্পর্কে অবগত কি না? কথা বলার সুযোগ পেয়ে আমি আমার কৈশোরের প্রসঙ্গ পাড়ি। প্রত্যন্ত এক গ্রামে যখন বেড়ে উঠেছিলাম, তখন পশ্চিম বাংলার প্রায় সর্বত্র দানা বেঁধে উঠছিল এই আন্দোলন, পূর্ব বাংলার কোনো কোনো অঞ্চলেও তা বিস্তৃত হচ্ছিল প্রবল উদ্যমে। বলি, ‘এ আন্দোলনের সাম্প্রতিক বিবর্তন সম্পর্কে আমি ওয়াকিবহাল নই। তারপরও আপনি যদি প্রেক্ষাপট সম্পর্কে ধারণা পেতে চান, আগামীকাল বিকালে না হয় এ নিয়ে কথা বলা যাবে।’

জবাবে খুশি হন সিনিওর পালোমিনো। খেতে আমার অসুবিধা হচ্ছে বুঝতে পেরে এলিয়াসিন বলে, ‘ইউ ডোন্ট হ্যাভ টু ইট পাপা, আলটিচিউডের ব্যাপারটা যখন স্ট্রাইক করে, তখন ঘণ্টাকয়েক কোনো খাবারেই রুচি হয় না।’ আমি ছুরি-কাঁটা রেখে হাত গোটাই।

পেছন থেকে নারীকণ্টে ‘বুয়োনাস নচেস’ বা ‘ শুভসন্ধ্যা’ আওয়াজ হতেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাই। পুদিনার মতো দেখতে একগুচ্ছ সুগন্ধি পাতা হাতে নিয়ে ভারি সুন্দর করে হাসে ডোরা। আমি তেমন একটা খেতে পারিনি শুনে ভ্রুকুটিও করে। শাইনিং পাথের জাংগোল ড্রেস পরা নারী-ক্যাডারদের ছবি আমি পত্রিকায় দেখেছি। আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তরুণী-মা’টিকে কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষয়িত্রী চরিত্রের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো যায়, কিন্তু কিছুতেই ডোরাকে গেরিলা-যোদ্ধাদের তথাকথিত ইমেজের সঙ্গে মেলাতে পারি না।

আমি যে ভাতখোকো গোত্রের মানুষ, ডোরা এ-তথ্যও জানে, তাই সে ইউটিউব দেখে চাল, দুধ ও চিনি দিয়ে তৈরি করেছে, অনেকটা আমাদের পায়েসের মতো সুমিষ্ট ‘আরস কন লেচে’। কথা হয় যে, পায়েসের বাটিটি ফ্রিজে রাখা থাকবে।  আগামীকাল আমার শরীর একটু অ্যাডজাস্ট করে নিলে তখন না হয় খেয়ে নেব। সে মাইক্রোওয়েভে দ্রুত তৈরি করে দেয়, মোনা-টি বা পুদিনার মতো সুগন্ধি ভেষজের উষ্ণ ক্বাথ।

বিবমিষায় অব্যর্থ চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে চলে আসি বেডরুমে। তক্তপোষের উপর রাখা পশমের ভারী কম্বল। ড্রেসিং টেবিলে সাজানো সাদামাটা কিছু প্রসাধনী এবং হুক থেকে ঝুলছে কয়েকটি নেকলেস। এলিয়াসিন আমাকে সবকিছু দেখিয়ে দিচ্ছে, সঙ্গে আমারুও আছে। মোনা-টিতে যদি বিবমিষা না কাটে, তাহলে একটি ট্যাবলেট ট্রাই করার কথা বলে এলিয়াসিন মেডিসিনের স্ট্রিপটি জলের গ্লাসের কাছে রাখে।

আমারু আচমকা বলে ওঠে, ‘এটা আমার মায়ের কামরা’, বলে সে সাইডটেবিলে রাখা নোটবুক ও টিপকলম দেখিয়ে দিয়ে জানায় যে, তার মামিতা নাকি বলেছে আমি একজন রাইটার, তারপর ফিক করে হেসে প্রশ্ন করে, ‘কে ভাস আ এসক্রিবির?’ বা ‘কী লিখবে তুমি?’ সাতপাঁচ ভেবে জবাব দিই, ‘আ পোয়েম অ্যাবাউট রেইনবো মাউন্টেন।’ ছেলেটি ‘কুল’ বলে হাততালি দেয়।

এলিয়াসিন তাকে ইগনোর করে তিন-চারটি ফ্ল্যাশকার্ডে হাতে-আঁকা এই এলাকার মানচিত্র দেখিয়ে জানায়, খুব ভোরে সে বেরিয়ে যাচ্ছে। আমার উচিত ঘণ্টা দেড়েক হাঁটাহাঁটি করে হাই এলিভেশনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া, চিকাকুপে শহরটি এখান থেকে মাত্র সাড়ে তিন মাইল দূরে। সে ম্যাপগুলো একটি ড্রয়ারে রেখে দিয়ে গুড নাইট বলে।

দারুণ সব স্বপ্নের ঘোরে কেটে যায় একটি রাত। বেশ বেলা করে বিছানা ছাড়ি। স্বপ্নে দেখা রেইনবো মাউন্টেইন তার বর্ণাঢ্য সব ডিটেইল নিয়ে ফিরে আসে মনে। পাহাড়ের

সাত-রঙে গড়া পরিসরে সামুদ্রিক প্রাণী তথা তিমি, সিল, হাঙর ও জায়ান্ট সাইজের জেলি মাছের ফসিলগুলো আমি স্পষ্টভাবে চাক্ষুষ করেছি। নোটবুক হাতে নিয়ে আমি তাতে বর্ণনা করি স্বপ্নে পাওয়া দৃশ্যপট। পর্বতে ফসিল থাকা কিন্তু বিচিত্র কিছু না, তবে রঙধনু রঙের ঊর্মি-প্রতিম বালুকায় এদের সচল হয়ে বুক ঘষটে ঘষটে চলাফেরা করতে দেখে স্বপ্নের ঘোরেও চমকে উঠেছিলাম! আমাকে আরো অবাক করেছিল, পাথর-বালুকায় হোঁচট খেতে খেতে আমারুকে ছুটতে দেখে। অনুসরণ করা সামুদ্রিক প্রাণীদের আতঙ্কে সে কেঁদেকেটে ফুঁপিয়ে বলছিল, ‘মামিতা তেংগো মিয়েডো’, বা ‘মামণি, আমার ভীষণ ভয় করছে।’

নোট নিতে নিতে অনুভব করি, আমার ভেতরে দানা বাঁধছে, ‘রঙধনু পাহাড়ের জীয়ন্ত জীবাষ্ম’ শিরোনামে শিশুতোষ-থ্রিলার টাইপের একটি গ্রন্থের প্লট। বেশ খোশমেজাজে হাইকিং-শু পরে নিয়ে, উষ্ণ জ্যাকেট ও গলাবন্ধ মাফলারে সুরক্ষিত হয়ে হাতে-আঁকা মানচিত্রের তালাশে ড্রয়ার খুলি। হাতে উঠে আসে কয়েকটি ফ্ল্যাশকার্ড। প্রথমটিতে লেখা ‘সয় উনা মাদ্রে টেরিবলে’, বা ‘আমি খুব বাজে মা’, দ্বিতীয় ফ্ল্যাশকার্ড থেকেও চোখ সরাতে পারি না, তাতে একবার নয়, একাধিকবার কারসিভ হরফে লেখা, ‘পারা মি তোদো সে রেডুখো আ সেনিসাস’, বা ‘আমার জন্য সব কিছু জ্বলেপুড়ে ছাই হলো।’

কার্ডগুলো হয়তো ডোরার, তার ব্যক্তিগত জিনিস স্পর্শ করে ফেলার গ্লানিতে ভারি লজ্জিত বোধ করি। এ অপরাধ শুধরানোর আপাতত কোনো উপায় দেখি না। তো গিল্ট ফিলিং নিয়ে অন্য ড্রয়ারটি খুলি। বেরিয়ে  আসে – এলাকার সড়কাদির মানচিত্র আঁকা তিনটি ফ্ল্যাশকার্ড, তা হাতে নিয়ে চলে আসি ডাইনিং রুমে।

বাড়ি থেকে সবাই মনে হয় বেরিয়ে গেছে। চেয়ার টেনে বসতে গিয়ে চোখে পড়ে, সাইডটেবিলে রাখা কমরেড এম এন রয় রচিত গ্রন্থটি। স্মৃতিতে ফিরে আসে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের তাসখন্দে, ভারতীর কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের (১৮৮৭-১৯৫৪) আন্তর্জাতিক পরিসরে এম এন রয় ছদ্মনামে পরিচিত হওয়ার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। পুস্তকটি ফের উল্টেপাল্টে দেখি, ব্যাক কভারে বুকব্লার্বের স্পেসে তাঁর একটি উদ্ধৃতিও দেখতে পাই। চেষ্টা করি, টোটাফাটা তর্জমায় এই কোটেশনের সারাৎসার ধরে রাখতে, ‘স্বাধীনভাবে উড়ে বেড়ানো খেচরের মতো একদিন মানুষের জীবনযাপনেও প্রাধান্য পাবে স্বাধীনতা। সমাজ থেকে বিলুপ্ত হবে শোষণ, বৈষম্য ও অবিচার; ফুরিয়ে আসবে ভৌগোলিক সীমারেখার প্রয়োজনীয়তাও।’

এম এন রয়ের বাণী নিয়ে চেষ্টা করি নীরবে প্রতিফলন করার। ইনহেইলার হাতে খুক-খুকিয়ে কাশতে কাশতে বেরিয়ে আসেন সিনিওর পালোমিনো। ডোরা আমারুকে নিয়ে স্কুলে গেছে। তবে যাওয়ার আগে তামালে বা যবধানের পিঠা ও আলু ভাজা রেখে গেছে একটি বাটিতে। কাউন্টারে ড্রিপ-কফি প্রভৃতি দেখিয়ে দিয়ে ক্ষমা চেয়ে সিনিওর ফিরে যান তাঁর বেডরুমে। তিনি ভুগছেন প্রবল অ্যাজমায়, ওষুধ নিয়েছেন, বিকালে একটু সুস্থ হলে আমার সঙ্গে কথাবার্তা বলবেন। আমি মাইক্রোওয়েভে তামালে গরম করে নিই। ব্রেকফাস্ট সেরে সিঁড়ি বেয়ে অতঃপর নেমে আসি সড়কে।

শ^াসপ্রশ^াস খানিকটা দ্রুত হয়ে এসেছে বটে, কিন্তু হাঁটতে বিশেষ অসুবিধা হয় না। চলতে চলতে আমি মাচ্চুপিচ্চুতে ট্র্যাক করার বিষয়টা নিয়ে ভাবি। আমি যেতে চাচ্ছি, প্রচলিত ইনকা ট্রেইলের বিকল্প সালকানতি পাস ধরে। পার্বত্য এ পথরেখা পর্যটকদের কাছে ‘মোস্ট স্পেকটাকুলার ট্র্যাকিং রুট’ বলে প্রশংসিত। এক জায়গায় অতিক্রম করতে হয় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৫০৯২ ফুট উঁচু গিরিপথ। পেরুতে আসার আগে আমি পুরো তিন মাস প্রশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে কঠোর ব্যায়াম করে প্রস্তুতি নিয়েছি। আমার ধারণা, অক্সিজেনের ঢালাও ব্যবহার করে আমি পেরিয়ে যেতে সক্ষম হবো দুর্গম এই মাউন্টেইন পাস।

 মাচ্চুপিচ্চুতে আমি একা যাচ্ছি না। এ-যাত্রায় আমার সাথি, পেশাদারি সূত্রে দীর্ঘদিনের চেনাজানা দুজন পুরুষ ও একজন নারী মিলিয়ে আরো তিনজন সিনিওর সিটিজেন। বার্ধক্য ও রোগশোকের কথা বিবেচনা করে উনারা প্রচলিত ইনকা ট্রেইল ধরে মাচ্চুপিচ্চুতে পৌঁছার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমাদের আলাদা আলাদা দুটি ট্র্যাক পরিচালিত হচ্ছে এলিয়াসিনের তত্ত্বাবধানে। আমি দিনতিনেক আগে রওনা দিয়ে সালকানতি পাস হয়ে ইনকা ট্রেইলের একটি ক্যাম্পিং সাইটে ওদের সঙ্গে মিলিত হবো। তারপর একসঙ্গে হাইক করে গিয়ে পৌঁছবো ইনকা সাম্রাজ্যের বিলুপ্ত নগরী মাচ্চুপিচ্চুতে।

পথের পাশে ছাপড়া-মতো একাধিক রুটির দোকান। একটি দোকান থেকে রুটির প্যাকেট হাতে পড়িমড়ি হয়ে ছুটে এসে  এক তরুণী আবেদন করে, ‘সিনিওর, পরফাভর কম্প্রে-মে পান-সুটো’ বা ‘আমার কাছ থেকে দয়া করে রুটি কিনুন’। পর্যটনী-পুস্তক ঘাঁটাঘাঁটির কল্যাণে আমি পেরুভিয়ানদের প্রিয় ডেলিকেসি, মৌরি ও দারুচিনির ফ্লেভার দেওয়া মিষ্টি রুটি
পান-সুটোর রেপুটেশনের সঙ্গে পরিচিত। এলিয়াসিনের পরিবারের কথা ভেবে কিনে নিই, এক প্যাকেট পান-সুটো ও কেসো ফ্রেসকো বা টাটকা পনির।

তন্দুর থেকে বের করে আনা রুটির মুখরোচক গন্ধে বিভোর হয়ে হাঁটছিলাম। এদিকে সড়কের পাশে নিম্নবিত্তদের বেশ কতগুলো বাসাবাড়ি। একটা বিষয় খেয়াল করি, প্রতিটি ঘরের চালে কী এক কৌশলে আঁটকানো গরু, মেষ, ঘোড়া ও মোরগের ছোট্ট ছোট্ট ফিগারিন বা মূর্তি। আমি সচেতন যে, স্প্যানিশরা আন্দিজ পাহাড়ের উপত্যকাগুলো পাকাপাকিভাবে দখল নেওয়ার আগে, অত্র এলাকায় এই উল্লিখিত প্রাণীগুলোর কোনো অস্তিত্ত্ব ছিল না। পর্তুগিজ ঔপনিবেশিকদের কল্যাণে যেমন ভারতবর্ষে এক জামানায় প্রচলিত হয়েছিল – আনারস, পেঁপে, আলু, টমেটো কিংবা মরিচের চাষ, ঠিক তেমনি স্প্যানিশরা জাহাজে করে এখানে নিয়ে এসেছিল গরু, ঘোড়া, মেষ ও মোরগ। কিন্তু এ-তথ্যে ঘরের চালে ফিগারিন লাগানোর কারণ সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানতে পারি না। এসে পড়ি দেয়ালে বিরাট করে মোরগের চিত্র আঁকা একটি বাসাবাড়ির সামনে। চৌকাঠে বসে থাকা কেচোয়া সম্প্রদায়ের হ্যাট-পরা এক বৃদ্ধা কী যেন এক দুশ্চিন্তায় বিমর্ষ হয়ে বসে আছেন।

হাঁটতে হয় আমাকে, তাই জোর কদমে আগে বাড়ি। পাঁজরের ভেতর হাঁপরের ওঠানামা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু এখনই থেমে পড়ার উপায় নেই। তো ফের পথদৃশ্যে নজর দিই। শাটার-ফেলা একটি দোকানের চিলতে বারান্দায় বসে এক কেচোয়া যুবতী, তার পিঠে বাঁধা শিশুটি ঝুঁকে আমাকে অবলোকন করছে। দাঁড়িয়ে পড়ে আমি সদ্য শেখা কেচোয়া ভাষায় বলি, ‘আলিয়ানচু’, বা ‘হ্যালো – হাউ আর ইউ?’ অত্যন্ত অনিচ্ছায় সে জবাব দেয়, ‘আলিয়ানমি’, বা ‘ভালোই তো আছি।’ মা ও মেয়েকে ছাড়িয়ে সামনে যেতে যেতে অনুভব করি – এ-নারীর বিষণ্ন মুখচ্ছবিও বোধ করি আঁকা হয়ে গেল স্মৃতিপটে।

মনে হয় এসে পড়েছি, চিকাকুপে শহরের প্রান্তিকে। পথপার্শ্বের পাহাড়ি ঢালে হালফ্যাশনের বেশ কিছু ঘরদুয়ার। আগ বাড়া আমার জন্য দুষ্কর হয়ে ওঠে। গুণ-টানার মতো বেহদ মেহনতে নিজের অনিচ্ছুক দেহটিকে টেনে নিতে হচ্ছে। আমার পাশ দিয়ে পিঠের বস্তায় বিরাট বোঝা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন মুটে-মজুর প্রকৃতির একজন মানুষ। তাঁর আপাত অক্লান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবি, আই মাস্ট পুশ মাইসেলফ।

হাঁটতে হাঁটতে বেশ খানিকটা দূরে – শত বছর আগে, স্প্যানিশ স্থাপত্যরীতিতে গড়ে ওঠা চিকাকুপে শহরটির খানিকটা দেখতে পাই। দুর্গের কায়দায় নির্মিত কয়েকটি দালানকোঠার তলা দিয়ে বয়ে যাচ্ছে পাহাড়ি এক নদী। বৃত্তাকার ব্রিজের সমান্তরালে দড়ি ও কাঠে তৈরি একটি ঝুলন্ত সাঁকো। কিন্তু ওদিকে আগ বাড়তে মন থেকে সায় পাই না, শরীরে কিছু একটা কাজ করছে না, কেমন যেন জ¦র-জ¦র লাগে, বুঝতে পারি – আই রিয়েলি নিড টু স্লো ডাউন অ্যা বিট।

ফ্ল্যাশকার্ডে আঁকা মানচিত্র ঘাঁটি। ভাবি, নদীর পাড় ধরে আস্তেধীরে না হয় ফিরে যাই এলিয়াসিনদের বাসায়। ঢালু সড়কে নেমে যেতে যেতে শুনি, পাথরকাটা নদীজলের প্রাণবন্ত ঝংকার। পাড়ের খোলামেলা জায়গায় নৃত্যে মেতে ওঠা এক যুগলের দেখা পেয়ে অবাক হই! একদিন আগে এদের কাছ থেকে আমি কিনেছি ‘মিস্টিরিয়াস মাউন্টেইন’ নামে একটি সিডি, রেইনবো মাউন্টেইন নিশানা করে পুরুষটি মিউজিক কন্ডাক্টরের কায়দায় অঙ্গভঙ্গি করছিলেন। আজ অবশ্য নারী-বন্ধুর সঙ্গে ইনি যুগল-নৃত্য করছেন। নাচের প্রকরণ বোধ করি স্লোওয়ালজ। ডিভাইস থেকে উৎসারিত সংগীতটিও চেনা মনে হয়। তাদের অতিক্রম করে যেতে যেতে আমি টিউনটির সঙ্গে ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে/ বহে কী বা মৃদু বায়/ তটিনী হিল্লোল তুলে/ কল্লোলে চলিয়া যায় … ’, শিরোনামের রবীন্দ্রসংগীতটির সাযুজ্য আছে বুঝতে পেরে কৌতূহলী হই। এরা নিজেদের নিয়ে এমন মগ্ন হয়ে আছেন যে, প্রশ্ন করে সংগীতের উৎস জেনে নেওয়ার কোনো উপায় নেই। চুপচাপ হাঁটি, আর কায়ক্লেশে পথ ভাঙতে ভাঙতে ভাবি, পর্যটক এ-জুটি এই মুহূর্তে উপভোগ করছেন একসেলেন্ট টাইম। মনে ফিরে আসে – খানিক আগে পথপার্শ্বের বসে থাকা আদিবাসী কেচোয়া সম্প্রদায়ের বৃদ্ধা, শিশুপিঠে যুবতী ও বস্তা বহন করে হেঁটে যাওয়া পুরুষের বিমর্ষ মুখচ্ছবি। পর্যটক জুটির ফান-লাভিং আপাত সুখী আচরণের সঙ্গে স্থানীয় মানুষের সমস্যা-ক্লিষ্ট মুখমণ্ডলের অভিব্যক্তিকে আমার মন নীরবে কনস্ট্রাস্ট করতে থাকে।

ধুলো উড়িয়ে পেছন পেছন আসছে রেইনবো মাউন্টেইন ট্যুরের একটি মাইক্রোবাস। হাত তুলে তা থামিয়ে আমি অনুরোধ করি, ‘আয়ুদা মে পরফাভর’, বা ‘প্লিজ হেলপ মি।’  হাতের ইশারায় ড্রাইভার আমাকে উঠতে বলে ম্যাপ-আঁকা ফ্ল্যাশকার্ডের উল্টোপিঠে এলিয়াসিনদের বাসার ঠিকানা খুঁটিয়ে দেখেন, তারপর একসেলেটরে চাপ দিতে দিতে বলেন, ‘নো এস উন প্রবলেমা সিনিওর’, বা ‘কোনো সমস্যা নেই।’ মিনিট দশেকের ভেতর এসে পৌঁছি বাসায়।

আমার অবসন্ন হালত দেখে ডোরা দ্রুত তৈরি করে দেয় কোকা পাতার নির্যাস। নারকোটিক ড্রাগ কোকেইনের উৎস যদিও কোকা-গাছ, তারপরও কোকা-টি নামে পরিচিত উষ্ণ পানীয়টি আন্দিজ পাহাড়ে যুগ যুগ ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, হাই এলিভেশনে আলটিচিউড সিকনেসকে মোকাবিলা করার জন্য। এটা পানে প্রশমিত হয় বিবমিষা, কিন্তু শ্বাসপ্রশ্বাসের জোরালো টান জারি থাকে। সন্ধ্যার পর অবস্থার অবনতি ঘটলে এলিয়াসিন অক্সিজেনের ব্যবস্থা করে। ভোরে তার তত্ত্বাবধানে ট্যুর কোম্পানির গাড়িতে করে রওনা হই, ইনকাদের সেক্রেড ভ্যালি বা পবিত্র উপত্যকার দিকে।

যেহেতু আমার শরীর হাই আলটিচিউডে খাপ খাওয়াতে স্ট্রাগল করছে, সুতরাং সে আমাকে সালকানতি গিরিপথ ধরে মাচ্চুপিচ্চুর দিকে ট্র্যাকের বিষয়ে জোরালোভাবে নিরুৎসাহিত করে। তার পরিষ্কার বক্তব্য, ‘ইউ আর নট ফিট ফিজিক্যালি পাপিতো, আই ক্যান্ট টেক অ্যানি হেলথ রিস্ক।’

কথা হয় যে, আমি সেক্রেড ভ্যালির নদীপাড়ে একজন মৃৎশিল্পীর বাড়িতে দিনতিনেক বাস করবো। যেহেতু জায়গাটি এখান থেকে ২১৩২ ফুট নিচে, এলিয়াসিনের ধারণা, ওখানে দিনকয়েক বাসবাস করতে পারলে শরীর এলিভেশনের সঙ্গে দ্রুত খাপ খাইয়ে নেবে। তারপর সুস্থ বোধ করলে ওখান থেকে আমার সিনিওর সিটিজেন বন্ধুদের সঙ্গে মিলিঝুলে ইনকা ট্রেইল ধরে পয়দলে যাওয়া যাবে মাচ্চুপিচ্চুর দিকে, যা সালকানতি মাউন্টেইন পাসের চেয়ে অনেক কম চ্যালেঞ্জিং।