সাহিত্যের বিশ্বপট : মাঘনিশীথের কোকিলেরা

বিশ^বীক্ষা সাম্প্রতিক সাহিত্য-সমালোচনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বীজশব্দ। কোনো স্রষ্টার সৃষ্টিই এছাড়া তাৎপর্যপূর্ণ হয় না। জীবন ও জগৎকে দেখার বিশেষ ধরন যদি নান্দনিক যোগ্যতার সঙ্গে ব্যক্ত না হয়, তবে তার মূল্যই থাকে না কোনো। এই শব্দটি অবশ্য বিশ^ায়িত হয়েছে জার্মান ভাষা থেকে। কুটুর থেকে যেমন কালচার বা সংস্কৃতি, তেমনই ‘হ্বেলটানশাউঙ্গ’ থেকে বিশ^বীক্ষা। স্রষ্টা দ্রষ্টা চক্ষু দিয়ে যে-জগৎ দেখেন, তা প্রাথমিকভাবে তাঁর আপন দেশ-কাল-সমাজ হলেও আশ্চর্যজনকভাবে তা সমস্ত ছোট পরিসরের সীমানা পেরিয়ে অন্যসব দেশ-সমাজ ও কালান্তরের দ্যোতনা বয়ে আনে। এমন হয় বলেই গ্রিক হোমার-সোফোক্লিস, রোমান ভার্জিল, ইতালীয় দান্তে-ত্যাসো, জার্মান গ্যয়টে-টমাস মান-রিলকে-কাফকা, কলোম্বিয়ার মার্কেজ, পেরুয়োরসা, পর্তুগিজ হোসে সারামাগো, ফরাসি বোদলেয়ার-র্যাঁবো-মোপাসাঁ-কাম্যু ও রুশ টলস্টয়-ডস্টয়েভস্কি-চেকভ পুশকিন-গোর্কি, বাংলার রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ অনন্য বিশ^বীক্ষার বার্তা বয়ে আনেন। যুগ থেকে যুগান্তরে, এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের কাছে তার আলাদা আলাদা উদ্ভাসন ঘটে। এঁরা প্রত্যেকেই নিজ ভাষার সম্পদ হয়েও বিশ^জনীন আর তাই বিশ^সাহিত্যের পক্ষে অপরিহার্য আলোকস্তম্ভ।

তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যেহেতু সবকিছুরই ধারণা বদলে যায়, বিশ^সাহিত্যের প্রতীতিতেও জোয়ার-ভাটা দেখা গেছে। আধুনিকতাবাদের জয়যাত্রার সঙ্গে পুঁজিবাদ ও জাতীয়তাবাদের সম্পর্ক যেহেতু খুব নিবিড়, জাতীয় সাহিত্যের শিরোপা মানে আধুনিকতারও উত্থান। আর, সেইসঙ্গে পুঁজিবাদেরও পুষ্পিত হয়ে ওঠা। আমাদের দেশ যখন ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের কবল থেকে মুক্ত হয়ে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করল, দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পরে ও ঠান্ডাযুদ্ধের সমকালে তখনকার বিশ^প্রেক্ষিতের কূট পাটিগণিত অনুযায়ী ‘কমনওয়েলথ’ শিবিরেরও জন্ম হলো। উপমহাদেশের অধিবাসী হিসেবে আমরা খুবই অবহিত কমনওয়েলথ ক্রীড়া-সমাবেশ সম্পর্কে। অবসংগঠন ও অধিসংগঠনের দ্বান্দ্বিক সম্বন্ধ অনুযায়ী বহুদিন কমনওয়েলথ সাহিত্য এদেশের ইংরেজি বিদ্যায় বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো উপস্থিত ছিল। ক্রমশ দুনিয়ার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আবহ যত বদলে গেল, নিঃশব্দে কমনওয়েলথ সাহিত্যকে কলকে দেওয়া বন্ধ হয়ে গেল। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধেই সূচিত হয়েছিল ব্রিটিশ শক্তির অস্ত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদয়। যদিও ‘কমনওয়েলথ’-এর পতাকা উড়িয়ে অতীত গৌরব প্রাণপণে ধরে রাখতে চাইছিল ইংল্যান্ড, বাণিজ্য-পুঁজির উদীয়মান বিশ^কেন্দ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তাকে হার মানতেই হলো।

নব্যপুঁজিবাদী বিশে^র উদ্ধত নেতা বেনিয়া আমেরিকা ক্রমশ হয়ে উঠল আধিপত্যবাদের বড়ো কর্তা আর ইংল্যান্ড হলো তার লেজুড়-ধরা ছোট তরফের পুরোনো জমিদার। দুনিয়ার মালিকানা নেওয়ার ধূর্ত কৌশল আবিষ্কারের সাহায্যে যেহেতু এককেন্দ্রিক বিশ^ তৈরির নীল নকশা নিয়ে এগোল, কমনওয়েলথ সাহিত্য আর প্রাসঙ্গিক রইল না। এলো তুলনামূলক সাহিত্য, এলো অনুবাদতত্ত্ব; এদের সূত্র ধরে এলো বিশ^সাহিত্যবিষয়ক ভাবনা। প্রথমোক্ত দুটি ভাবনার আঁতুড়ঘর অবশ্য ইউরোপ। দীপায়ন ও মানবতাবাদের প্রশাখায় এদের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ হয়েছিল বলে বিদ্যায়তনিক চর্চায় গুরুত্ব কম নয়। কিন্তু দশকের পর দশক ধরে একদিকে আমেরিকার ক্রমাগত উত্থান এবং অন্যদিকে কমনওয়েলথ সাহিত্যের নিষ্প্রভ হয়ে যাওয়া আর তুলনামূলক সাহিত্যের উদয়াস্ত : এর মধ্যে কোনো কার্যকারণ সম্পর্ক রয়েছে কি! বিশ শতকের শেষ পর্বে অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাগুরু জাঁ বদ্রিলার তাঁর Verso : London : 1988) বইতে যে-আমেরিকাকে আবিষ্কার করেছিলেন, তা মনে পড়ে : ‘ÔExtraordinary sites, capitals of fiction become reality. Sublime transpolitical sites of extraterritoriality, combining as they do the earthÕs undamaged geological grandeur with a sophisticated, nuclear, orbital, computer technology. I went in search of ‹sidereal› America, not social and cultural America but the America of the empty, absolute freedom of the freeways, not the deep America of desert speed, of motels and mineral surfaces…

ÔDisaffection finds its pure form in the barrenness of speed. All that is cold and dead in desertification or social enucleation rediscovering its contemplative form here in the heat of the desert. Here in the transversality of the desert and the irony of geology, the transpolitical finds its generic, mental space. The inhumanity of our ulterior, asocial superficial world immediately finds its aesthetic form here, its ecstatic form for the desert is simply that an ecstatic critique of culture, an ecstatic form of disappearance.’ (১৯৮৮ : ৪-৫)

বিয়োগপর্বের চিন্তাগুরুর দ্রষ্টাচক্ষুতে এই যে উদ্ভাসিত হলো আমেরিকার নির্মোকসর্বস্ব অমানবিক অস্তিত্ব, তার

রাজনীতি-অতিযায়ী অসামাজিক উপস্থিতির আগ্রাসনে বাস্তব হার মেনেছে প্রকল্পনার কাছে। নিজের ভৌগোলিক সীমাকে মুছে দিয়ে দুর্ধর্ষ কম্পিউটার প্রযুক্তির সাহায্যে শূন্যগর্ভ স্বেচ্ছাচারিতার উদ্দাম তাণ্ডব ছড়িয়ে দিয়েছে বিশে^র সর্বত্র। সামাজিক পরিসরের মরুভূমিকরণের সঙ্গে মিলিত হয়েছে অকল্পনীয় গতির বন্ধ্যত্ব। প্রতীয়মান আকরণের বিন্যাসে নিরন্তর শূন্যের বন্দনা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠছে যত, প্রতিনন্দনের বহিরঙ্গ উল্লাসে মানুষ ও তার পরিচিত জগতের উধাও হয়ে যাওয়া আড়ালে পড়ে যাচ্ছে। সর্বগ্রাসী প্রতাপের ঔদ্ধত্যে এককেন্দ্রিক বিশ^ব্যবস্থার কর্ণধার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর সর্বত্র পণ্যসর্বস্বতার মায়াবী কুহক ছড়িয়ে দিচ্ছিল যখন, তার নিজস্ব ছাঁচে তৈরি বিশ^সাহিত্যের ধারণাকে সেই

তালে-লয়ে-সুরে গেঁথে নেওয়ার তাগিদও জোরালো হয়ে উঠল। মানুষের সাংস্কৃতিক অণুবিশে^ কখন নেমে আসছে অতলান্ত নৈঃশব্দ্য, অন্তর্জালের মোহে অন্ধ সুযোগসন্ধানী বিদ্বজ্জনেরা তা বোঝার চেষ্টা করেননি। কিন্তু এই নৈঃশব্দ্যের তাৎপর্য উপলব্ধি করেছিলেন চিন্তাগুরু বদ্রিলার আর অপূর্ব কবিত্বময় উচ্চারণে লিখেছিলেন : ÔAnd for there to be silence, time itself has to attain a sort of horizontality; there has to be no echo of time in the future, but simply a sliding of geological strata one upon the other giving out nothing more than a fossil murmur.Õ (তদেব : ৬)। প্রতিবাস্তব ও প্রতিসংস্কৃতির দুর্নিবার প্রভাবে সময় ও পরিসরের পরিচিত স্বভাবেও যেন আদিগন্ত মরুভূমি আর অজস্র মরীচিকার ছায়া প্রগাঢ়ভাবে ব্যাপ্ত হয়ে পড়েছে।

দুই

বাণিজ্যপুঁজির সর্বাত্মক সাফল্যের সূত্রে যে আধুনিকোত্তরবাদের প্রচ্ছায়া ভারতীয় উপমহাদেশে অনুভূত হচ্ছে, নন্দনের কোন বোধ দিয়ে বিশ^ায়ন পর্বের সাহিত্যকে গ্রহণ করব আজ! পণ্যায়নের যুক্তিশৃঙ্খলার কাছেই যদি বিকল্পবিহীনভাবে সমর্পিত হই, দান্তের ইনফের্নোতে যেমন পেয়েছি নরকের তোরণে উৎকীর্ণ সতর্কবাণী : ÔAbandon all hope ye who enter here’, তেমনই আমরা সব আশা ত্যাগ করে মরীচিকা-ভরা ‘Ôsideral’-এর প্রতিজগতে প্রবেশ করব! কিংবা গ্যয়টের ফাউস্টের মতো এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার নিয়ন্তা মেফিস্টোফিলিসের কাছে আত্মাকে বিক্রি করব, যাতে মার্কিন নব্যমুল্লুকে দুধে-ভাতে নয়, মাংস-মদ্যে পরম সুখে, কোনো পিছুটানের মূর্খ উদ্বেগ ছাড়া, কালাতিপাত করতে পারি। ভারতীয় উপমহাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ^সাহিত্যের পরিগ্রহণ নিয়ে যখন ভাবি, তা কেবল বাল্মীকি-কালিদাস-বাণভট্ট-রবীন্দ্রনাথ-বঙ্কিমচন্দ্র-জীবনানন্দ-বিষ্ণু দে-ওয়ালীউল্লাহ্-আল মাহমুদ বিষয়ক আলোচনা নয়। ঐতিহ্যানুষঙ্গ আমাদের কাছে কালাতীত সম্পদ হিসেবে যত গুরুত্বপূর্ণই হোক, সমকালের মহাপ্লাবন সম্পর্কে চোখ বন্ধ করে থাকা কি সম্ভব! অবসংগঠন ও অধিসংগঠনের সম্পর্ক সংক্রান্ত ধ্রুপদী ধারণাতে ব্যাপক পরিবর্তন না-ঘটিয়ে কোনো নতুন প্রতিবেদন পেশ করা যাবে না। কেননা জীবন ও জগতের যাবতীয় বয়ান-উপকরণ-আন্তঃসম্পর্ক এখন মুহুর্মুহু বিনির্মিত হয়ে চলেছে। বহমান সময়ের অভূতপূর্ব জটিলতার অভিঘাতে বিশ্বপুঁজিবাদের ছায়ায় লালিত আজকের উপমহাদেশের ভারতীয় সমাজও হয়ে উঠছে উত্তরোত্তর দিশাহীন-অষ্টাবক্র-উৎকেন্দ্রিক। বিশ্বপুঁজিবাদের নিষ্ঠুর আগ্রাসনে সমস্ত স্থানিক উপাদান-বৈশিষ্ট্য-পরম্পরা অবলুপ্তপ্রায়। আমাদের অভিজ্ঞতায় যে ঐতিহ্যাশ্রয়ী ও বিচিত্র দ্বন্দ্বখচিত উপনিবেশোত্তর জাতীয় সংস্কৃতির অনুভব অত্যন্ত সক্রিয়, তাতে মরীচিকার হাতছানিজনিত দ্বিমেরুবিষম ভাবাদর্শগত অবস্থান কীভাবে যুগপৎ স্থির ও অস্থির, তা অনুধাবন করা আজকের জিজ্ঞাসুদের জরুরি কৃত্য। এ সময়ের আরেক প্রথিতযশা চিন্তাগুরু টেরি ঈগলটনের The Idea of Culture (২০০০) বইটি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য; সেইসঙ্গে পড়া যেতে পারে ÔThe Crisis of Contemporary CultureÕ শীর্ষক ১৯৯২ সালে রচিত তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধটিও।

ঈগলটনের চিন্তাসূত্র অনুযায়ী আমরাও বুঝে নিতে পারি কতখানি বেপরোয়াভাবে ভারতীয় উপমহাদেশের নানা প্রান্তে বিশ্বপুঁজিবাদের আগ্রাসী লোলুপতা মুছে নিচ্ছে পরম্পরার অন্তিম অবশেষও। জাতীয় সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ যখন বিকর্ষণে পরিণত হয়েছে, কমনওয়েলথ সাহিত্য বিলীন বাস্তবের অপস্রিয়মাণ ছায়া, তৃতীয় বিশে^র সাহিত্যসংক্রান্ত ভাবনা কেন্দ্রবিহীন পরিধির বিন্যাস, বিশ^সাহিত্য কি হয়ে উঠছে বিশ্বায়ন পর্বের উপযোগী অভিনিবেশের বিষয়! হ্যামলেটের উচ্চারণে লিখতে ইচ্ছে করে :

Ay, thereÕs the rub;

For in the sleep of death what dreams may come?

When we have shuffled off this mortal coil

Must give us pause: there’s the respect

That makes calamity of so long life;

For who would bear the whips and scorns of

                                                                time

The oppressor’s wrong? [ Act iii : Scene i]

আমাদেরও ঘিরে আছে যেন আত্মিক মৃত্যুর ঘুম যাতে স্বপ্ন আসে ছেঁড়াখোঁড়া। দীর্ঘতর জীবনে যন্ত্রণার বোঝা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হ্যামলেটকে বারবার স্তব্ধ করে দেয়, কেড়ে নেয় উদ্যম। আর, আমরা! সময়ের কালো জোব্বা পরে কোন-সে দুর্নিয়তি চাবুক কষায়, আমাদের তিক্ত শ্লেষে বিদ্ধ করে। অত্যাচারীর পীড়ন কে সইতে চায়! তবু হ্যামলেটের অনুক্ত উচ্চারণ থেকে বুঝে নিতে হয়, পুনরুচ্চারণও করতে হয়, না, সর্বগ্রাসী বিশ্বপুঁজিবাদের সন্ত্রাসে পর্যুদস্ত হতেই হয়। হ্যাঁ, Ôthere’s the rub’। তাই তো বিশ^ায়নের ছন্দে-লয়ে বাঁধা বিশ্বসাহিত্যের ধারণা শ্লাঘ্য হয়ে ওঠে। তার মানে কেবল বিদ্যায়তনিক চর্চা নয়, পণ্যায়নের যুক্তিশৃঙ্খলাকে বিনা প্রশ্নে মান্যতা দেওয়া। অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদের ভাষা ইংরেজিই অনুবাদের বিশ^স্ততম মাধ্যম; পৃথিবী জুড়ে লাখ লাখ বই বিক্রি করার সমস্ত ব্যবস্থা পাকাপোক্ত। এতে যে-কোনো প্রান্তে পৌঁছে যেতে পারে জাপানি লেখক হারুকি মুরাকামি বা পর্তুগিজ লেখক হোসে সারামাগো বা ইতালীয় লেখক উমবের্তো একোর বই। এঁরা না-হয় অসামান্য স্রষ্টা কিন্তু এই সুযোগের বেশি সদ্ব্যবহার করেছে মার্কিন ধাঁচে তৈরি বেস্টসেলারগুলি। পণ্যদেবতার প্রসাদধন্য Exodus বা Airport বা The Da Vinci Code-এর মতো বিনোদন-বোমাই তো সাধারণ পাঠকের কাছে ‘বিশ^সাহিত্য’ হিসেবে গণ্য।

বিশ শতকের শেষ দুটি দশকে চিন্তায় নৈরাজ্যের সংক্রমণ বিনা বাধায় বাড়তে শুরু করেছিল; কিন্তু তখনো ইতিবাচক সংস্কৃতি ও ভাবাদর্শের দোহাই দিয়ে কেউ কেউ জোরালো প্রতিপ্রশ্ন তুলে ধরত। সম্ভোগের মহাপ্লাবনে আজকের মতো ভেসে যায়নি নিজস্ব ঐতিহ্যের কাছে দায়বদ্ধতা, আপন ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সংবেদনশীলতা। কিন্তু সর্বগ্রাসী বাণিজ্য-পুঁজির তোড়ে ইদানীং বুদ্বুদের মতো লীন হয়ে গেছে সবধরনের স্বাতন্ত্র্যের অভিজ্ঞান। ফলে জীবনের বদলে প্রতিজীবন, সংস্কৃতির বদলে প্রতিসংস্কৃতি, ভাবাদর্শের বদলে প্রতিভাবাদর্শ বেছে নিয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে প্রথম বিশ্ব ও সাবেক তৃতীয় বিশে^র বাসিন্দারা। এই পরিস্থিতিতে বিশ^সাহিত্যের সংজ্ঞা নির্ণয়ে ধ্রুপদী আভিজাত্য কতটা প্রাসঙ্গিক! একদা-গ্রাহ্য কমনওয়েলথ সাহিত্যের অভিধায় পৃথিবীর যতটুকু অংশকে একটি কৃত্রিম সূত্রে বাঁধার চেষ্টা হয়েছিল, সেই অভিধাকে ঈগলটন উদ্ভট বলেছিলেন। সত্যিই তা-ই, এ যেন ইঁদুর ও বেড়াল কিংবা ব্যাঙ ও সাপের অসম্ভব সহাবস্থান। পরবর্তী পর্যায়ে যৌক্তিকভাবে অনেক বেশি পরিশীলিত ও গ্রাহ্য ‘তৃতীয় বিশ্বের সাহিত্য’ অভিধাটি যদিও ক্রমশ গৃহীত হয়েছে, ঈগলটন তাকে গাণিতিকভাবেও অযথার্থ বলেছেন। এর চেয়ে বরং বিশ^পুঁজিবাদের সাংস্কৃতিক যুক্তিশৃঙ্খলার অভিব্যক্তি হিসেবে ‘আধুনিকোত্তর সাহিত্য’ বিজ্ঞজনের কাছে পরিচিত যেহেতু তা চরিত্রে আন্তর্জাতিক এবং অন্তর্জালের মুখ্য ভাষা ইংরেজির দৌলতে অন্য ইউরোপীয়-লাতিন আমেরিকান (বিরল ক্ষেত্রে জাপানি-চীনা-আফ্রিকার) সাহিত্যকেও অভিন্ন পণ্যায়ন-শৃঙ্খলায় বেঁধে নিতে পেরেছে, ঢিলেঢালাভাবে (অর্থাৎ uncritically) অনেকেই বিশ^সাহিত্য আর আধুনিকোত্তর সাহিত্যকে ইদানীং সমার্থক ভাবছেন। কিন্তু তা ইতিহাসের নিরিখেও ভুল। আধুনিক পর্যায়েই তুলনামূলক সাহিত্যের জন্যে একসময় যে তুমুল উৎসাহ তৈরি হয়েছিল, বিশ^সাহিত্যের ধারণাও তখনই পোক্ত হতে শুরু করে। এরা সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ পাই রবীন্দ্রনাথের মধ্যে তবে সে-কথায় আসছি আরো একটু পরে।

এটা ঠিক যে, ইংরেজি অনুবাদে ফরাসি-জার্মান-রুশ-স্পেনীয়-ইতালীয়-পর্তুগিজ-জাপানি সাহিত্যের সাম্প্রতিক প্রবণতাগুলি পৌঁছাচ্ছে আমাদের কাছে। গড়ে উঠছে বিশ্বসাহিত্যের ধারণা ও প্রেক্ষাপট। তবে সমৃদ্ধ দেশগুলিতে পুঁজিবাদ যেহেতু বেশি শক্তিশালী, অন্যসব বিক্রয়যোগ্য সামগ্রীর মতো সাহিত্যপণ্যকেও ওরা রফতানি করছে যথেষ্ট ত্বরিত গতিতে। প্রতিতুলনায় লাতিন আমেরিকার সাহিত্য পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে অনেক দেরিতে এবং অনেক কম মাত্রায়। আফ্রিকা কৃষ্ণমহাদেশ হিসেবে যেন রোমান্সীকৃত, টনি মরিসন-চিনুয়া আচেবেকে যতটুকু পড়ার সুযোগ পেয়েছি, সেই তুলনায় ঢের বেশি প্রচারের আলোয় এসেছে অ্যালেক্স হ্যাইলির রুটস, যদিও তাতে রয়েছে রোমান্স-সুলভ ইচ্ছাপূরণ। এও মনে করি, আরবি কথাকার নাগুইব মাহফুজ (কায়েরো-ত্রয়ীর জন্যে বিখ্যাত) যদি নোবেল পুরস্কার না পেতেন, ইংরেজি অনুবাদে তিনি আমাদের কাছে পৌঁছাতেন না আদৌ। তবে অনূদিত হলেও, বিশ্বব্যাপ্ত হওয়ার জন্যে তাঁর রচনাকে পণ্যায়নের যুক্তিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়েই পরিস্রুত হতে হয়েছে। একই কথা প্রযোজ্য সাম্প্রতিক কালের পাঠক-চিত্তরঞ্জক তুর্কি সাহিত্যিক ওরহান পামুক বা পর্তুগিজ কথাকার হোসে সারামাগো সম্পর্কেও। আর, জাপানি কথাকার হারুকি মুরাকামি অসামান্য রচনা-সামর্থ্যরে অধিকারী – এ-কথা স্বীকার করেও লিখব, পামুক (এবং কিংবদন্তিতুল্য গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ) এর চেয়েও অনেক বেশি মাত্রায় মুক্ত যৌনতা ও শরীরী তৃষ্ণাকে ব্যবহার করেছেন তিনি যাতে স্বভাষী পাঠকদের চেয়েও বহুগুণ বেশি ভিন্নভাষী পড়ুয়াদের কাছে অতিদ্রুত পৌঁছাতে পারেন। কেননা তুর্কি বা পর্তুগিজ বা জাপানি পড়ুয়ারা জাতীয়তাবাদী আবেগ থেকে তাঁদের গ্রহণ করবে, কিন্তু ইংরেজি আসলে অনুবাদ-মাধ্যম হিসেবে বহুভাষীর সমাবেশ। আন্তর্জাতিক পরিগ্রহণের মধ্য দিয়ে বিলম্বিত পুঁজিবাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বিশ্বসাহিত্যের মাইলফলক হয়ে উঠছেন তাঁরা, এটাই আসল কথা। জাতীয় সাহিত্য তাতে ঋদ্ধ হলো কি হলো না, এ সম্পর্কে খুব বেশি চিন্তিত তাঁদের হওয়ার কথা নয়।

তিন

আমরা যারা বাংলা ভাষার পরিমণ্ডলে বাস করি এবং ঐতিহাসিকভাবে নির্ধারিত হয়েই ইংরেজির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের লিখিয়েদের সঙ্গে পরিচিত হই – আমাদের বঙ্কিমচন্দ্র-রবীন্দ্রনাথ-তারাশঙ্কর-বিভূতিভূষণ-মানিক ওয়ালীউল্লাহ-ইলিয়াস-হাসান আজিজুল হক-জীবনানন্দ-বিষ্ণু দে ওই বিশ^ব্যাপ্ত পণ্যায়নের শৃঙ্খলে কতখানি গৃহীত হয়েছেন? রবীন্দ্রনাথের অবস্থান অবশ্য অন্যদের তুলনায় স্বতন্ত্র। কিন্তু তিনিও সোফোক্লিস-দান্তে-শেক্সপিয়র-গ্যয়টে-টলস্টয়দের ধ্রুপদী সাহচর্যে যতখানি বিশিষ্ট, সাম্প্রতিক রফতানিযোগ্য সাহিত্যপণ্যের ধারায় নিশ্চিতভাবে পুরোপুরি বেমানান। কিন্তু কথা হলো, যে-কারণে বাংলা বা হিন্দি বা তামিল বা মালয়ালম ভাষার রচয়িতাদের পুঁজিবাদী বিশ^সাহিত্যের পঙ্ক্তিভুক্ত হতে দেখি না – সেই কারণেই কালো আফ্রিকার সাহিত্যিকেরা প্রবেশাধিকার পান না। নিয়তির চক্রের চেয়েও এই বাস্তব দুর্ভেদ্যতর। তুলনামূলক সাহিত্য অধ্যয়নে যতটুকু বিদ্যায়তনিক তাগিদ ছিল, চক্রব্যূহতুল্য নতুন বিশ^-আবহে পণ্যায়নের তালে-লয়ে-সুরে গাঁথা ‘বিশ^সাহিত্য’ পাঠে সেই তাগিদ গৌণ হয়ে পড়েছে। আসলে বিদ্যাচর্চার নিয়ামক ভাবাদর্শ ও সাংস্কৃতিক অন্বিষ্ট নব্য অর্থনীতির কাছে হার মেনেছে। পৃথিবীর আনাচে-কানাচে যত দুর্নিবার বেগে ছড়িয়ে পড়েছে পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার জাল, তার প্রতিসংস্কৃতির চাহিদা মেটানোর জন্যে এবং দ্রুত রূপান্তরিত ভোগবাদী বাস্তবের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে নির্দিষ্ট অঞ্চলভিত্তিক জাতীয় সাহিত্যের সীমানাকে আর প্রশ্নাতীত মান্যতা দেওয়া যাচ্ছে না। ইংরেজি বিদ্যাচর্চায় ‘অস্ট্রেলিয়ার সাহিত্য’, ‘আমেরিকার সাহিত্য’, ‘আফ্রিকার সাহিত্য’, ‘ভারতীয় ইংরেজি সাহিত্য’ ইত্যাদি প্রশাখা তৈরি হয়েছিল পুঁজিবাদী বিস্তারের যে-বাস্তবে, স্পষ্টতই দুই সহস্রাব্দের সন্ধিক্ষণ থেকে সেই বাস্তব এবং তার নিয়ামক সাংস্কৃতিক চাহিদা ও ভাবাদর্শগত ভিত্তি বিপুলভাবে পরিবর্তিত হতে শুরু করল। এতে সমস্যা হলো মূলত তাদেরই যারা জীবন-জগৎ-সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে পরম্পরাগত বিশ^াস-ধারণা-মূল্যমানকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে রাজি নয়। মার্কিন মুল্লুকের দানবাকৃতি পুঁজির হুঙ্কারে প্রাগ্রসর ইউরোপের চিন্তাবিদও যে তীব্র আপত্তি প্রকাশ করেছেন, তা খুব লক্ষণীয়। প্রতিজগৎ ও প্রতিসংস্কৃতির উৎস হিসেবে তা বদ্রিলারের কাছে, চিরকালীন মরুভূমি (Desert forever) যেন। তিনি সুস্পষ্ট বাচনে লিখেছেন : ‘Here the cities are mobile deserts. No moments and no history, the exaltation of mobile deserts and simulation. There is the same wildness in the endless, indifferent cities as in the intact silence of the Badlands.Õ (America : 1988 : 123)

সবকিছুর মধ্যেই যখন অধিবাস্তব সংক্রমিত, (insance ease of life) (তদেব : ১২২) এর উপযোগী প্রতিসন্দর্ভই তো রচিত হতে পারে নিরবচ্ছিন্নভাবে। আর, কার্যত অন্তহীন, পণ্যায়নের কৃৎকৌশল দিয়ে Ôorgies and cannibalism’ ভরা প্রতিবাস্তবের বেস্টসেলার উৎপাদিত ও দুনিয়ার সর্বত্র রফতানি হতে থাকবে। ক্রমশ আগ্রাসী পুঁজিবাদের রঙ্গমঞ্চে শরিক হতে হতে দ্রুত রচনাশৈলী ও বিষয়বস্তু কীভাবে পালটে গেল, তার সামান্য হদিস পাওয়া যেতে পারে এই নিতান্ত অসম্পূর্ণ তালিকায় : আর্থার হ্যাইলে-র দ্য ফাইন্যাল ডায়েগনোসিস, ইন হাই প্ল্যাসেজ, হোটেল, এয়ারপোর্ট, ফেডরিখফোরসাইথ-এর দ্য ফোর্থ প্রোটোকোল, নো কামব্যাক্স, দ্য ডে অফ দ্য জ্যাক্যাল, দ্য ওডেসা ফাইল, দ্য শেফার্ড, দ্য ডেভিলস অলটারনেটিভ, মারিয়ো পুজো-র দ্য গডফাদার, দ্য সিসিলিয়ান, দ্য ফ্যামিলি, দ্য ফরচুনেট পিলগ্রিম, দ্য লাস্ট ডন, ড্যান ব্রাউন-এর দ্য দা ভিঞ্চি কোড, অ্যাঞ্জেল্স অ্যান্ড ডেমন্‌স, ডিসেপশন পয়েন্ট, লস্ট সিম্‌বল, ডিজিট্যাল ফোরট্রেস ইত্যাদি। একসময় অ্যালবের্টো মোরাভিয়া, লিওন উরিস-এর বইও লাখ লাখ কপি বিক্রি হতো। বেস্টসেলারগুলি অবশ্য ঔষধিবৃক্ষের মতো কিংবা পদ্মপত্রে জল।

ইংরেজি-জানা দুনিয়া যেমন লুফে নিত এইসব চক্রান্ত-রিরংসা-কমিউনিস্ট বিরোধিতা, নির্বাধ ঐশ^র্য ও ক্ষমতায়নের উপকথা, তেমনি ‘ব্যবহার করো এবং ছুড়ে ফেলে দাও’ নীতিতে এদের ভুলে যেতেও সময় লাগত না। পণ্যসর্বস্ব দুনিয়া শুধু অভিনব সাম্প্রতিকে বিশ^াসী, যা অতীত তা তার কাছে মৃত। তাই বেস্টসেলারের বিশ^ায়ন মানে বিশ^সাহিত্যের বৈধতার প্রমাণ নয়। প্রথম প্রকাশের বছরপাঁচেক পরে এসব বিনোদন-সামগ্রীর কোনো গুরুত্বই থাকে না। বিশ^পুঁজিবাদের যুক্তিশৃঙ্খলায় সাহিত্য মানে মানুষের পৃথিবীর জন্যে সম্ভ্রম নয় কেননা নির্মাণবয়ানের তোড়ে প্রতিবাস্তব ও প্রতিজগতের চমকই প্রত্যাশিত কেবল। মরীচিকার কি গভীরতা থাকতে পারে?

তাই মিলান কুন্দেরা-ইতালো ক্যালভিনো-হোসে সারামাগো-উমবের্তো একো-ওরহান পামুক-মারিয়ো ভার্গোস য়োসা-গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ কিংবা আরো একটু আগেকার প্রজন্মের টমাস মান-ফ্রানৎস কাফকা-আলবেয়ার কাম্যু-জাঁ পল সার্ত্র প্রমুখ সাহিত্যস্রষ্টা ইংরেজি ভাষান্তরে বাঙালি পড়ুয়ার কাছে মোটামুটি ব্যাপকভাবে পৌঁছেছেন যেহেতু, তাঁদের রচনার বিক্রয়যোগ্যতা কি বেস্টসেলার উৎপাদকদের মোহ-নির্মাণের সমতুল্য বিবেচিত হবে? সবটাই কি বিশ্বসাহিত্যের পঙ্ক্তিভুক্ত হবে? পণ্য-সামর্থ্য যদি বিবেচনার মানদণ্ড হয়, তা কি একসূত্রে আগাছা ও বটগাছকে গেঁথে নেবে না! সবই যেমন গাছ, সবই দু-মলাটের মধ্যে বিন্যস্ত বই! তবে মেধা যখন পণ্যায়িত হতে শুরু করে, তা তো প্রকাশনাশিল্পের আওতায় রুদ্ধ থাকে না। সেলুলয়েডের মায়ায় রূপান্তরিত হয়ে বিক্রয়মূল্যকে কোটি থেকে অর্বুদে নিয়ে যায়। সেইসঙ্গে সর্বাত্মক সাংস্কৃতিক রাজনীতির পেশিশক্তিতে তৈরি হয় দর্শকের পক্ষে অপ্রতিরোধ্য চলচ্চিত্র। হলিউডে তার দৃষ্টান্ত দেখা গেছে গডফাদার, ওডেসা ফাইল, দ্য ভিঞ্চি কোড-এর মতো অসংখ্য ‘সফল’ ছবির উৎপাদনে। এই বিষচক্র বিশ^পুঁজিবাদের ‘সাংস্কৃতিক’ বিজয় নিশান। তাহলে বিদ্বজ্জনেরা যাকে ভাবাদর্শের সর্বাত্মক যুদ্ধ বলেন, বোধের জগতে তা আগে লড়তে হবে। কিন্তু বেস্টসেলারগুলির মালমশলা যদি দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্যে ব্যবহার করতে শুরু করেন ওরহান পামুক বা হারুকি মুরাকামির মতো সংবেদনশীল কথাকারেরা, প্রখর বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সেইসব আড়াল করার চেষ্টা করলেও পণ্যসর্বস্ব দুনিয়ার বিষক্রিয়া থেকে মুক্ত কি থাকে বয়ান? বস্তুত এতে যে সংকট তৈরি হচ্ছে তা বড়ো সাংঘাতিক। আর, এই বিন্দুতে দাঁড়িয়ে মনে হয়, বদ্রিলার চমৎকারভাবে আমাদের মনের কথা লিখে গেছেন : ‘We fanatics of aesthetics and meaning of culture, of flavour and seduction, we who see only what is profoundly moral as beautiful and for whom only the heroic distinction between nature and culture is exciting, we who are unfailingly attached to the wonders of critical sense and transcendence find it a mental shock and a unique release to discover the fascination of nonsense and of this vertiginous disconnection, as sovereign in the cities as in the deserts. To discover that one can exult in the liquidation of all culture and rejoice in the consecration of indifference.’ (A : 123)

চার

সত্যিই তো, আমরা যারা বাচনিক সৃষ্টিতে নন্দন ও তাৎপর্য খুঁজি, সংস্কৃতির সত্য খুঁজি, ভাবাদর্শের নিরীক্ষাভূমি হিসেবে পথের দিশা খুঁজি – উত্থানের কথকতা থেকে জীবনের স্বাদ আর স্খলনের বিবরণ থেকে মৃত্যু-ফাঁদ শনাক্ত করতে চাই, সোফোক্লিস-দান্তে-শেক্সপিয়র গ্যয়টে-টলস্টয়-ডস্টয়েভস্কি-রবীন্দ্রনাথ-মান-কাম্যু-মার্কেজ-এর পরম্পরা আমাদের চিরবন্ধু, চিরনির্ভর। তাঁদের রচনায় যখন আবিষ্কার করি যা সুন্দর, তা-ই নৈতিক শক্তিতে বলীয়ান আর যা নৈসর্গিক তা-ই বিস্ময়কর, সময়-সমাজ-ভাষাগত ব্যবধান অলীক হয় নাকি। পৃথিবীর যে-দেশেই থাকুন না কেন সংবেদনশীল পড়ুয়া, কাহিনি-ঘটনা-কুশীলবদের বাহ্যিক সময়ানুষঙ্গ ও পরিসরগত অনুপুঙ্খ তাঁর কাছে গৌণ এবং অন্তর্ভূত বার্তা-প্রধান বিবেচ্য হয়ে পড়ে। সোফোক্লিসের ঈডিপাস-জোকাস্টা-আন্তিগোনে-ক্রেয়নের জটিল অন্তর্দ্বন্দ্ব বহিরঙ্গ জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টির অনন্বয়, ব্যক্তিগত পরিণামে দর্শন ও রাজনীতির অন্তর্বয়ন যদি কোনো বাঙালি পাঠকের কাছে পৌঁছায়, চিরকালীন বিশ^সাহিত্য হিসেবে চিনে নিই তাদের। তেমনই দান্তের ডিভাইনা কমেডিয়ায় ইনফের্নো-পুর্গেটোরিয়ো-প্যারাডাইজোর প্রগাঢ় বহুমাত্রিকতায় পাই সত্তার অধিবিদ্যাগত ক্রমিক যাত্রায় দর্শন-ইতিহাস-রাজনীতি-ধর্মতত্ত্বের অন্তর্বয়ন ঋদ্ধ প্রতীকবিশ^। পাই বিশুদ্ধ কবিতার নান্দনিক প্রতীতি আবার নৈতিকতারও আরোহী উদ্ভাসন শেক্সপিয়রের হ্যামলেট যে করণীয়-অকরণীয়-এর দ্বন্দ্বে বিদীর্ণ হয় জ্ঞানপাপীর মতো, অপরিমেয় উচ্চাকাক্সক্ষার কাছে দুর্বলচিত্ত ম্যাকবেথ নিজের ইতিবাচক গুণকে আহূতি দেয়, অতিরিক্ত সন্তান-বাৎসল্যে বিচারমূঢ় আচরণ করে রাজা লিয়ার নিজের ধ্বংস ডেকে আনে, অন্ধ ঈর্ষার কাছে পরাভূত হয় বীর ওথেলোর ভালোবাসা – প্রতিটি যুগে প্রতিটি দেশের মানুষ এদের মধ্যে সমকালীন বাস্তবের অভিজ্ঞতাজাত উপলব্ধি মিলিয়ে নিয়েছে। গ্যয়টের ফাউস্ট যে অপ্রতিহত ঐশ^র্য ও প্রতাপ অর্জনের বিনিময়ে নিজের আত্মাকে শয়তানের কাছে জিম্মা রেখেছে – আজকের ভারতীয় উপমহাদেশে কদর্য ও নির্লজ্জতম রাজনৈতিক পাশাখেলায় তার ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত রোজ দেখছি। টলস্টয়ের রিজারেকশন-এর কথকতা প্রতীকমূল্যে অসামান্য এবং বিশ^জনীন। একই কথা প্রযোজ্য ডস্টয়েভস্কির ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট সম্পর্কেও। রবীন্দ্রনাথের গোরার আত্মপরিচয় অর্জনের প্রক্রিয়া যেখানে শুরু হয়ে যে-বিন্দুতে শেষ হলো, তারও তুলনা নেই। আর, তা প্রতিটি দ্বন্দ্ববিক্ষত সমাজের কাছে জরুরি পাঠ। তেমনি চতুরঙ্গ ও ঘরে-বাইরের প্রতীকিতা সত্তার তাৎপর্য-সন্ধানী প্রতিটি দেশে-কালে গভীর সংকেত। টমাস মানের বাডেনব্রুকস-এ পারিবারিক আভিজাত্যের বেদনাময় বিলয়কথা বা ম্যাজিক মাউন্টেন-এর বহুস্বরিক শুদ্ধ নিষ্কর্য সন্ধানের কথকতা কি ইতিহাস-তাড়িত আত্মহননে অভিশপ্ত বাঙালি জাতিরও আপনকথা নয়! কাম্যুর আউটসাইডার তো আধুনিকতা-ক্লিষ্ট বিচ্ছিন্নতায় নিমজ্জিত সর্বজনীন ব্যক্তিসত্তার ইতিবৃত্ত। তাঁর প্ল্যাগ-এর রিউ-এর মতো প্রতীকী চরিত্রকে একাকী যুদ্ধে লড়ে যেতে দেখছি আমাদের সমাজেও। মহাভারতের কর্ণের মতো এমন মানুষদেরও মনের কথা : ‘যে-পক্ষের পরাজয় সে-পক্ষ ত্যাজিতে মোরে করো না আহ্বান।’ তেমনই মার্কেজের শতবর্ষব্যাপী নিঃসঙ্গতা বা সারামাগোর ‘অন্ধতা’ ও ‘পাথরের ভেলা’।

একদিকে নৈসর্গিক মানুষ, অন্যদিকে পরিশোধিত কৃষ্টি। এদের টানাপড়েনও কত উদ্দীপক হতে পারে, বিশ^সাহিত্যের কালজয়ী বয়ানগুলি তার প্রমাণ। বদ্রিলার যেমন লিখেছেন, আমরা যারা সাহিত্য-সমালোচনার অন্তঃগূঢ় বিস্ময় ও আনন্দের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং মানুষের নতুন নতুন সৃষ্টিশীল উপস্থাপনায় অস্তিত্বের উত্তরণ উপলব্ধি করতে চাই, তাদের কাছে পণ্যসর্বস্ব দুনিয়ার বেস্টসেলার আসে মানসিক আঘাতের মতো। এদের চমক-ভরা ছদ্ম-প্রতিবেদনগুলিতে দেখতে পাই অর্থহীন প্রগল্ভতা, শরীরী তৃষ্ণা ও সন্ত্রাসের কুহক, অসংযোগের চূড়ান্ত মরীচিকা; অতএব বিশ^সাহিত্য তাকেই বলি যা বাইরের আয়নায় ঘরের পথ ও পাথেয়কে প্রতিফলিত করে। নিজের ভাষায় রচিত সাহিত্যে আকাশ আছে, জমিও আছে; তবে সেই আকাশ যে অন্তহীন মহাকাশের শরিক এবং আপন জমিও বিপুল ব্যাপ্তিসম্পন্ন মহাপরিসরের অঙ্গ – বিশ^সাহিত্যের সঙ্গে নিবিড় পরিচয় সেই সত্য সম্পর্কে আমাদের অবহিত করে। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দু-একটি মন্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে। ‘সাহিত্যের বিচারক’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন : ‘সাহিত্য যাহা আমাদিগকে জানাইতে চায় তাহা সম্পূর্ণরূপে জানায়, অর্থাৎ স্থায়ীকে রক্ষা করিয়া, অবান্তরকে বাদ দিয়া, ছোটোকে ছোটো করিয়া, বড়োকে বড়ো করিয়া, ফাঁককে ভরাট করিয়া, আলগাকে জমাট করিয়া দাঁড় করায়। মন প্রকৃতির আরশি নহে, সাহিত্যও প্রকৃতির আরশি নহে। মন প্রাকৃতিক জিনিসকে মানসিক করিয়া লয়; সাহিত্য সেই মানসিক জিনিসকে সাহিত্যিক করিয়া তোলে। … প্রকৃত সাহিত্যে আমরা আমাদের কল্পনাকে, আমাদের সুখ-দুঃখকে, শুদ্ধ বর্তমান কালে নহে চিরন্তন কালের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করিতে চাহি। সুতরাং সেই সুবিশাল প্রতিষ্ঠাক্ষেত্রের সহিত তাহার পরিমাণ সামঞ্জস্য করিতে হয়। ক্ষণকালের মধ্য হইতে উপকরণ সংগ্রহ করিয়া তাহাকে যখন চিরকালের জন্য গড়িয়া তোলা যায় তখন ক্ষণকালের মাপকাঠি লইয়া কাজ চলে না।’ স্পষ্টত রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের মধ্যে কোনো সংকীর্ণ সীমাকে ঈপ্সিত ভাবছেন না। যা শুধুই বর্তমানের দাবি মেটায়, যাকে চিরন্তন কালের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না – তা কাম্য নয়। ক্ষণকালের মাপকাঠি কোনো কাজে লাগে না; খুঁজে নিতে হয় সেই মানদণ্ড যা চিরকালের সম্পদকে চিনিয়ে দেয়। এতে এই ইঙ্গিত পাচ্ছি যে, প্রকৃত সাহিত্য স্বতঃশ্চলভাবেই ‘জাতীয় গণ্ডি’ পেরিয়ে হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক, সর্বমানবিক। তবে কোনো একটি বিশেষ সময়ের সত্যকে সর্বকালীন সত্যে যাঁরা রূপান্তরিত করতে পারেন, তাঁরাই বিশ^সাহিত্যের গৌরবময় পরিসরে উত্তীর্ণ হন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যায়, তেমন সৃজনী প্রতিভাসম্পন্ন সাহিত্যিক বিশ^মানব-মনের সূত্রধর।

প্রাগুক্ত প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ আরো লিখেছেন যে, প্রকৃত সাহিত্যিক তাঁর নিজের অন্তরের মধ্যে দুটি অংশের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারেন। একটা অংশ তাঁর নিজস্ব এবং অন্য অংশ তাঁর মানবত্ব। কথাটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি আরো জানিয়েছেন, যদি কেউ এই দুয়ের মধ্যে দুর্ভেদ্য দেয়াল তুলে দেয়, তার আত্মা অন্ধকূপের মধ্যে বাস করে। সংবেদনশীল সাহিত্যিক তাঁকেই বলা যায় যিনি নিজের ভেতরের খণ্ডাকাশ ও তার সঙ্গে পরিব্যাপ্ত মহাকাশকে ধ্যানের মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করতে পারেন। আর, এই সামর্থ্যইে তিনি ক্ষণিককে অমর করে তোলেন এবং খণ্ডকে সম্পূর্ণতা দান করেন। জীবনের সত্য শুধুমাত্র তাঁর কাছেই ধরা দেয়। রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য হলো : ‘অন্তরের জিনিসকে বাহিরের, ভাবের জিনিসকে ভাষার, নিজের জিনিসকে বিশ্বমানবের এবং ক্ষণকালের জিনিসকে চিরকালের করিয়া তোলা সাহিত্যের কাজ। … সাহিত্যকারদের শ্রেষ্ঠ চেষ্টা কেবল বর্তমান কালের জন্যে নহে। চিরকালের মনুষ্য সমাজই তাহাদের লক্ষ্য। … কালে কালে মানুষের বিচিত্র শিক্ষা ভাব ও অবস্থার পরিবর্তন সত্ত্বেও যে-সকল রচনা আপন মহিমা রক্ষা করিয়া চলিয়াছে তাহাদেরই অগ্নিপরীক্ষা হইয়া গেছে।’ এতে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে, রবীন্দ্রনাথ প্রকৃত সাহিত্য বলতে যা বুঝেছেন, তা-ই চিরঅমøান বিশ^সাহিত্য। একটু আগে যে-সমস্ত পাঠকৃতির কথা উল্লেখ করেছি, তাদের রচয়িতারা তৎসাময়িক ও তৎস্থানিক বিষয়ে দৃষ্টি রুদ্ধ রাখেননি। চিরকালের মনুষ্য-সমাজই লক্ষ্য ছিল বলে তাঁদের স্থায়ী মহিমার অগ্নিপরীক্ষা হয়ে গেছে।

‘বিশ^সাহিত্য’ নামক নিবন্ধেও রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : ‘সাহিত্যের মধ্যে মানুষ আপনার আনন্দকে কেমন করিয়া প্রকাশ করিতেছে, এই প্রকাশের বিচিত্র মূর্তির মধ্যে মানুষের আত্মা আপনার কোন নিত্যরূপ দেখাইতে চায়, তাহাই বিশ^সাহিত্যের মধ্যে যথার্থ দেখিবার জিনিস। নির্মাণবায়িত প্রতিজগতে যখন আদিগন্ত-ব্যাপ্ত কৃষ্ণবিবরের উপস্থিতিই বড়ো হয়ে ওঠে, প্রকাশ কি আদৌ প্রাসঙ্গিক? নাকি বিচূর্ণায়িত ও কেন্দ্রচ্যুত পরিসরের নৈরাজ্যে মানুষের ছবি খোঁজার চেষ্টাই গণ্য হতে পারে নান্দনিক প্রতিবাদ হিসেবে। নইলে কালাতীত বিশ্বসাহিত্যকে খোঁজার উৎসাহ কি অবশিষ্ট থাকবে আদৌ? মানুষকে সমগ্রভাবে দৃষ্টির বিষয় করে নিলে অনুভূত হবে – ‘জ্যোতির ঝড় বহিতেছে’, কিন্তু আমরা কি এখন এ ভাষা বুঝতে পারি! চারদিকে ব্যাপ্ত মরীচিকার মধ্যে আমরা কীভাবে রবীন্দ্রনাথের মতো ‘বিশ্ব মানবের হৃদয়সুধা’ খুঁজে পাব সাহিত্যে! কিন্তু তাঁর বয়ান তো উৎসারিত হয় সুদৃঢ় বিশ^াসের ও শুশ্রƒষার জলঝর্ণা থেকে : ‘অনবরত মানুষ আপনার চারিদিকে যে বিকিরণ সৃষ্টি করিতেছে তাহাতে বাহিরে যেন নিজেকে নিজে ছাড়াইয়া, নিজেকে নিজে বাড়াইয়া চলিতেছে। যে মানুষ অবস্থা দ্বারা সংকীর্ণ, সেই মানুষ নিজের ভাব সৃষ্টি দ্বারা নিজের এই যে বিস্তার রচনা করিতেছে সংসারের চারিদিকে যাহা একটি দ্বিতীয় সংসার তাহাই সাহিত্য। বিশ^সাহিত্যের মধ্যে বিশ^মানবকে দেখিবার লক্ষ্য আমরা স্থির করিব, প্রত্যেক লেখকের রচনার মধ্যে একটি সমগ্রতাকে গ্রহণ করিব এবং সেই সমগ্রতার মধ্যে সমস্ত মানুষের প্রকাশ-চেষ্টার সম্বন্ধ দেখিব।’

পাঁচ

এই বয়ানের শুরুতেই যে-বিশ^বীক্ষার কথা লিখেছি, তা রবীন্দ্রনাথ কথিত ঐ ‘সমগ্রতার মধ্যে সমস্ত মানুষের প্রকাশ-চেষ্টা’র উদ্ভাসন সূত্রেই বিশ^সাহিত্যের প্রতীতিকে সম্ভব করে তোলে। নিজেকে নিজে ছাড়িয়ে গিয়ে, নিজেকে নিজে বাড়িয়ে নিয়ে যে বিস্তার ও গভীরতার বোধ জাগে – তা-ই ক্রমশ ‘জাতীয়’ সাহিত্যের গণ্ডি পেরিয়ে পৌঁছে যায় আন্তর্জাতিক ও সর্বমানবিক বিশ^সাহিত্যে। কিন্তু এ কি কেবলই ‘স্বর্গ হতে নিয়ে-আসা বিশ্বাসের ছবি’! কারণ বিশ^পুঁজিবাদের উদগ্র লোভ ও সন্ত্রাসের তাণ্ডবে মানুষকে তার আপন জগৎ থেকে উৎখাত করার আয়োজন এখন অবাধ। বেস্টসেলারের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে চলচ্চিত্রের বিভ্রম-ভরা প্রতিজগৎ এখন মগজে উপনিবেশ স্থাপন করে ফেলেছে। লক্ষ করছি বদ্রিলারের মতোই, মানুষের চলমান ইতিহাস দুরূহতম প্রত্যাহ্বানের মুখোমুখি আমরা – ‘delivered from all depth there — brilliant, mobile, superficial neutrality, a challenge to meaning and profundity, a challenge to nature and culture, on outer hyperspace, with no origin, no reference points.’ (তদেব : ১২৪)। বড়ো অব্যর্থ ও লক্ষ্যভেদী এই উচ্চারণে মানুষের অস্তিত্বগ্রাসী সংকট বিবৃত হয়েছে। ‘বিশ^জোড়া ফাঁদ পেতেছ কেমনে দিই ফাঁকি’! কিন্তু, না, ‘আধেক ধরা পড়েছি গো’ – এমন নয়; চুল থেকে নখ অবধি ডুবে গেছি আমরা ‘পণ্যদেবো ভব’ মন্ত্রের সম্মোহনে। বিশ^পুঁজিবাদ এখন সর্বত্র গভীরতাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছে। রয়েছে কেবল চোখ-ধাঁধানো ঝাঁ-চকচকে মুখোশ, লক্ষ্যশূন্য গতির অজুহাতে উদ্দাম অস্থিরতা, মলাটসর্বস্ব নিরেট নিরপেক্ষতার ভান এবং তাৎপর্য-গৌরব-প্রকৃতি-সংস্কৃতির প্রতি আত্মহনন-সূচক প্রত্যাহ্বান। এহেন পরিস্থিতিতে মারিয়ো পুজো-ড্যান ব্রাউনদের উদ্ভট বেস্টসেলার ছাড়া আর কী বা উৎপাদিত হতে পারে। পৃথিবী যখন এঁদোডোবা, কচুরিপানার ঝাড়েরই তো বাড়বাড়ন্ত হওয়ার কথা। এ যেন বিচিত্র কূটাভাস : একদিকে অকল্পনীয় গতি ও অধিপরিসরের বার্তা বয়ে-আনা মহাবিশ্বে উৎসহীন অবলম্বনশূন্য পরাউপস্থিতি এবং অন্যদিকে দানবাকৃতি সন্ত্রাস-ভাবাদর্শে অন্তর্ঘাতমূলক উদ্ভট কাহিনির সমাবেশ-উন্মুক্ত যৌনতা-অনখশির সম্ভোগের মধ্য দিয়ে বিবরায়ন আর, তারই অনিবার্য ফলশ্রুতি হিসেবে বেস্টসেলার নামক ঘুম-পাড়ানিয়া বুদ্বুদপুঞ্জের অতিদ্রুত আবির্ভাব ও তিরোধান। বদ্রিলারের মতো, আমরাও দেখতে পাচ্ছি তাই Ôthere is an absolute fascination – the fascination of the very disappearance of all aesthetic and critical forms of life in the irradiation of an objectless neutrality.’ (তদেব )

মোদ্দা কথা হলো, মরীচিকার বিভ্রম যে ইদানীং সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছে, এর কারণ, ভাবাদর্শ ও সংস্কৃতির নীলাঞ্জন ছায়া থেকে বিচ্যুত সাম্প্রতিক মানুষ খুব সহজেই সার্বিক সম্মোহনের কবলে পড়ে যায়। এই সম্মোহনই সমস্ত নান্দনিক ও বিচার-বিশ্লেষণের প্রকরণকে জীবন থেকে অদৃশ্য করে দিয়েছে। চেতনার বন্ধ্যত্ব বিশ^পুঁজিবাদের সাংস্কৃতিক রাজনীতিরই অনিবার্য পরিণাম যা ত্বরান্বিত ও নিরঙ্কুশ হয়ে উঠছে এইসব বেস্টসেলারের কুচকাওয়াজে, বস্তুত এইসব বুদ্বুদতুল্য রচনা সামগ্রিক বিশ^পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে কার্য এবং কারণ দুটোই। অজস্র চিহ্নায়কের ফেনায়িত উচ্ছ্বাস আসলে নিশ্চিহ্নায়নেরই অন্য নাম যেখানে চিহ্নাকৃতির অস্তিত্বই নেই কোনো। তবু মানুষকেই ঘুরে দাঁড়াতে হয় মানুষের জন্যে। মানুষের নামে পড়তে হয়, লিখতে হয়, ভাবতে হয় নতুন সংহিতা। বলা ভালো, তা চির পুরোনো এবং চিরনূতন সঞ্জীবনী বিশল্যকরণী যাকে পাই রবীন্দ্রনাথ কিংবা গ্যয়টে কথিত বিশ^সাহিত্যের ভাবনায়। প্রাথমিক তথ্য হিসেবে উল্লেখ করা প্রয়োজন, পারিভাষিক দ্যোতনাসম্পন্ন ‘বিশ^সাহিত্য’ শব্দটি গ্যয়টে প্রথম ব্যবহার করেছিলেন ১৮২৭ সালের জানুয়ারিতে তাঁর তরুণ ভক্ত যোহান পেটের একেরমান-এর সঙ্গে আলাপচারিতায় সাতাত্তর বছর বয়সে গ্যয়টে বলেছিলেন, যতদিন যাচ্ছে এ-বিষয়ে তিনি দৃঢ়নিশ্চিত হয়েছেন যে, কবিতা মানবজাতির সার্বভৌম সম্পদ। হাজার হাজার মানুষের কাছে তা সর্বত্র সবসময় ধরা দিচ্ছে। রাষ্ট্রের সীমানা এতে বাধা হতে পারে না। একজন সৃষ্টিশীল লেখক হিসেবে তিনি জানতে উৎসুক থাকেন বিদেশের পড়ুয়াদের দ্বারা কীভাবে গৃহীত হচ্ছেন। এই সূত্রে গ্যয়টের বক্তব্য ছিল : ‘National literature is now a rather unmeaning term; the epoch of world literature is at hand, and everyone must strive to hasten its approach’(ডেভিড ডামরোশ কর্তৃক উদ্ধৃত : ২০০৩ : ১)। বিশ^সাহিত্যের মূল জার্মান কথাটি ছিল : ‘WeltliteraturÕ। মহাকবির মৃত্যুর তিন বছর পরে, ১৮৩৫-এ, একেরমান যখন ওই আলাপচারিতা বই হিসেবে প্রকাশ করলেন, পারিভাষিক শব্দ হিসেবে তার প্রচলন শুরু হয়ে গেল। এর মানে বিশিষ্ট সাহিত্য-প্রেক্ষিত এবং নতুন সাংস্কৃতিক চেতনা দুটোই; যা ক্রমশ বিশ^ব্যাপ্ত সাহিত্যিক আধুনিকতার ভিত্তি হয়ে উঠল।

কিন্তু সাহিত্য-প্রেক্ষিত তো বৃন্তহীন পুষ্পসম আপনাতে আপনি বিকশিত হতে পারে না। অনেকরকম সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক পরিস্থিতির অন্তর্গত ও বহির্ভূত দ্বন্দ্বে যত মূল্যবোধগত টানাপড়েন শুরু হয়, অবধারিতভাবে ততই বদলে যায় বিশ^বীক্ষা। ফলে পরিগ্রহণের রূপান্তরও অনিবার্য। তাতে অবশ্য গ্যয়টে-কথিত (এবং একটু আগে উল্লিখিত রবীন্দ্রনাথের) মৌল চিন্তাসূত্র অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায় না। কিন্তু গ্যয়টের সময়ে এবং তাঁর পরে রবীন্দ্রনাথের কালে এবং দুজনেরই আগে ও পরে সোচ্চার বা নিরুচ্চারভাবে উত্থাপিত মৌলিক প্রশ্ন আজো আমাদের ভাবায়। এই যে বিশ^সাহিত্য, তাতে বিশ^টা কাদের এবং সাহিত্যই বা কোনটা? জাতীয় সাহিত্য নাকি আন্তর্জাতিক সাহিত্য? ‘জাতীয়’ সাহিত্যের মধ্যেও যে কত ধরনের দুরূহ সমস্যা, তা খোদ ইংরেজি ভাষার সাহিত্যের দিকে তাকালেই বুঝতে পারি। এই নিবন্ধের অন্যত্র যে অস্ট্রেলিয়া-আমেরিকা-কানাডা-ভারত-এর মতো দেশে রচিত ইংরেজি সাহিত্য-এর কথা লিখেছি, তাদের নিরিখে জাতীয়তার সংজ্ঞা ও পরিধি কী হবে! তবে কি এখন থেকে ব্রিটেনের ইংরেজি সাহিত্য বলতে হবে। আরবি সাহিত্যও নানা দেশে রচিত হচ্ছে। অবশ্য ইসলামের নির্ণায়ক উপস্থিতিতে ‘জাতি’ অবান্তর। কিন্তু আমাদের বাংলা সাহিত্যেও একটা সংকট আছে যাকে আমরা সবাই মিলে দেখেও না-দেখার ভান করছি। দেশভাগ নামক আদিপাপের ফলে সবতরফেই যে সামূহিক স্মৃতিলোপ ঘটেছে, তার অনিবার্য প্রতিক্রিয়ায় বাংলা সাহিত্য কার্যত পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে রচিত সাহিত্য বাংলাদেশি নাকি বাংলা সাহিত্য – এই ধন্দ এখনো কাটেনি। এছাড়া রইল এক কোটিরও বেশি বাঙালি অধ্যুষিত উত্তর-পূর্ব ভারত যাদের সাবেক মানচিত্রটাই উদ্বাস্তু এখন। ওখানকার বাংলা সাহিত্য কি ঘুঁটে-কুড়ুনি দুয়োরানি হয়ে থেকে যাবে বড়ো ও মেজো তরফের ধনী আত্মীয়দের কাছে! স্পেনের সাহিত্য কি স্পেনীয় সাহিত্যের দাবিদার কেবল। লাতিন আমেরিকার স্পেনীয় ভাষার সাহিত্যকে কী বলব তবে। এবং, তার ওপর রইল ইদানীংকার বিদ্যায়তনিক চর্চায় যথেষ্ট জনপ্রিয় ‘ডায়াসপোরা’ বা প্রব্রজন-অভিবাসনের সাহিত্য। বিশ^ায়ন চেনা দুনিয়াকে নানাভাবে পালটে দিচ্ছে। অঞ্চলভিত্তিক ভাষিক-সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য এখন লুপ্তপ্রায়। এইসব কিছুর অভিঘাতে বিশ^সাহিত্যের ধারণাও বদলে যেতে বাধ্য। প্রশ্ন হলো, গ্যয়টে-রবীন্দ্রনাথের প্রধান বক্তব্যে নিহিত সত্যকে কীভাবে এখন সময়োচিতভাবে সম্প্রসারিত করব।

তাহলে একটু আগে যে লিখেছি কোনটা কার সাহিত্য, তা আগে ঠিক হোক। তারপর আসবে বিশ^সাহিত্য বনাম বেস্টসেলারের প্রসঙ্গ। হয়তো বা সেইসঙ্গে শস্যের মধ্যে ভূতের কথাও। আর, কাদের বিশ^ : এর চেয়ে জরুরি প্রশ্ন আর কী আছে! বদ্রিলার কথিত ‘exaltation of mobile deserts and simulationÕ-এর বিশ্বকেন্দ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার লেজুড় পুঁজিবাদী দেশের সম্ভোগসর্বস্ব অপমানুষদের পৃথিবী? নাকি প্রান্তিকাকৃতি এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার ত্রস্তবিপন্ন মানুষদের? জনসংস্কৃতি ও এলিটভোগ্য বৌদ্ধিক সামগ্রীর যে প্রধান বিকল্প দেখতে পাই, এর টানাপড়েন কি কোনো তাৎপর্য নিয়ে আসে এদের কাছে! এছাড়াও রয়েছে ধ্রুপদী ঐতিহ্য পুনরাবিষ্কারের তাগিদ আর নিজস্ব ইতিহাসে আধারিত আধুনিকতার নির্মাণ সংক্রান্ত সমস্যাও। যদি গ্যয়টে বা রবীন্দ্রনাথের কাছে দিশা সন্ধান করি, কখনও কখনও বিমূঢ়তা বেড়ে যায়। কেননা তাঁরা কেউই একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে স্থির ছিলেন না; বরং তাঁদের সৃজনী ব্যক্তিত্ব ক্রমাগত রূপান্তরিত হয়েছে। দুজনকেই কখনো মনে হয় ধ্রুপদী, কখনো রোমান্টিক, কখনো জাতিসত্তার পুরোহিত, কখনো আন্তর্জাতিকতার নকিব। একেরমান যেমন গ্যয়টেকে হিরের সঙ্গে তুলনা দিয়ে লিখেছিলেন যে, প্রতিটি দিকে তিনি নানারকম রং বিচ্ছুরিত করেন, তেমনই রবীন্দ্রনাথ বা টলস্টয় বা দান্তে বা শেক্সপিয়ার বর্ণালি বিচ্ছুরণের চির উৎস। কথা হলো, গ্রহীতার বাস্তব বা পরিগ্রহণের চাতুর্যপূর্ণ সাংস্কৃতিক রাজনীতির বিদূষণে আক্রান্তজনেরা কীভাবে ওই বিচ্ছুরণে সাড়া দেবে, তা নিশ্চিতভাবে একরকম নয়; অবস্থানগত ভিন্নতায় প্রতিক্রিয়া অবশ্যই হবে আলাদা-আলাদা। তার ওপর রয়েছে পণ্যায়নের যুক্তিশৃঙ্খলায় আধারিত গ্রহণ-বর্জন, সত্য-মিথ্যা, মহৎ-তুচ্ছ বিষয়ক পরিবর্তনশীল ধারণা। এতসব জটিলতা সত্ত্বেও যে-সাহিত্য আমাদের তৃপ্তি ও অস্বস্তির শরিক হয়, সংবেদনাকে শানিত করে – তা ভিনদেশের রচনা হলেও অপরিহার্য নিকটাত্মীয় হিসেবে গণ্য হতে পারে। পুঁজিবাদের আগ্রাসনে চারদিকে যত বড়ো বিচ্ছিন্নতা ও অসংযোগের নরক তৈরি হোক না কেন, অন্য দেশ-কালের ভাষা হয়ে ওঠে আমাদেরও একান্ত আপন ভাষা। সংযোগের সৌন্দর্য ও শৌর্যের কাছে পরাভূত হয় বেস্টসেলারের তাৎক্ষণিক আস্ফালন। কোন রচনা কেন আমার হয়েও সবার এবং সবার হয়েও আমার, এই অপূর্ব রহস্যের সমাধান বেস্টসেলারে থাকার কথা নয়, রয়েছে অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে।

ছয়

ধ্রুপদী নন্দনচিন্তার অন্যতম ভগীরথ হোরেস আর্স পোয়েটিকা বইতে যে প্রখ্যাত শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছিলেন – ÔUt picture poesis’ (As is painting, so is poetry), তাকে পরবর্তীকালে তত্ত্বসূত্র হিসেবে গ্রহণ করা হয়নি কেবল, বহুদূর অবধি সম্প্রসারিতও করা হয়েছে। কবিতা ও ছবির নিবিড় আত্মীয়তাকে বাচনিক ও চাক্ষিক সৃষ্টির নানা প্রশাখায় প্রসারিত করে আমরা পেয়েছি সময় ও পরিসরের দ্বিবাচনিকতার অজস্র আশ্চর্য নিদর্শন। আর্স পোয়েটিকার ডি.এ. রাসেল-কৃত অনুবাদ থেকে প্রাসঙ্গিক অংশ উদ্ধৃত করছি : ÔPoetry is like painting. Some attracts you more if you stand near, some if you’re further off. One picture likes a dark place; one will need to be seen in the light, because it’s not afraid of the critic’s sharp judgement. One gives pleasure once, one will please if you look it over ten time.Õ

 এই বক্তব্যের আধেয় তার আপাত-আধারকে ছাড়িয়ে গিয়ে আমাদের কাছে মৌলিক শিল্পতত্ত্ব হিসেবে পৌঁছেছে। কবিতার মতো ছবি বা ছবির মতো কবিতাই নয় কেবল, মিকেলেঞ্জেলোর সিটিন চ্যাপেলের ফ্রেস্কো বা রদ্যার ভাস্কর্য কিংবা হোমার-ভার্জিল-মিলটন-বাল্মীকি-দান্তের মহাকাব্য অথবা বালজাক-টলস্টয়-প্রস্ত-মার্কেজের মহাউপন্যাসও আমাদের আকর্ষণ করে বেশি যদি সময় ও পরিসরের দূরত্ব থেকে তাদের দেখি। বোদলেয়ার-র‌্যাবো-রিলকে-লোরকা-এলিয়ট-জীবনানন্দ-বিষ্ণু দে-র কবিতা কি তবে ভ্যানগঘ-পল গগ্যাঁ-মানে-মোনে-সেজাঁ-পিকাসো-পল ক্লি-র ছবির মতো কাছে গিয়ে বুঝতে হয়? নাকি হোরেসের বক্তব্যকে সামান্য সংশোধন করে লিখব, কাছে থেকেও দেখতে-পড়তে-বুঝতে হবে এবং দূরবর্তী সময় ও পরিসর থেকেও। প্রকৃত কালাতিগ শিল্পসৃষ্টির সঠিক ঠিকানা না আলোয়, না অন্ধকারে। একবার মাত্র বিনোদন জোগান দিয়ে ফুরিয়ে যাবে – এ মন তো নয় এসব নিয়মাতিযায়ী সৃষ্টি। আরো কথা আছে। ছবি বা ভাস্কর্যের নিবিষ্ট দর্শকের মতো মগ্ন পড়ুয়াকে বারবার, অনেকবার খুঁটিয়ে দেখে-পড়ে অনুপুঙ্খ বা অনুষঙ্গের মর্মসত্য বুঝে নিতেই হয়। এমন হতেই পারে যে, সৃষ্টির মুহূর্তে সময়-পরিসরের দ্যোতনা যেভাবে স্রষ্টা দ্বারা অনুভূত হয়েছিল, নানা প্রজন্মের দর্শক-পাঠক বহতা কালের অমোঘ অভিভবে পরিবর্তিত উপলব্ধি অনুযায়ী সেইসব আদি-চিহ্নায়কদের পুরোপুরি নতুনভাবে গ্রহণ করবেন। এই যে কথাগুলি লিখলাম, তা পণ্যবিশ্বের চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদিত ফেনিল বেস্টসেলারগুলি সম্পর্কে আদৌ প্রযোজ্য নয়।

কিন্তু বিশ^ায়নের অগভীর ও বুদ্বুদসর্বস্ব প্রতিজগতে তর্কাতীত সত্যও বারবার উচ্চারণ করতে হয়। নতুনভাবে অভিনিবেশ আকর্ষণ করতে হয় গ্যয়টে ও রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিক চিন্তাসূত্রের প্রতি। লিওন উরিস-আর্থার হ্যাইলি-ভ্যান ব্রাউনদের জয়জয়কার যাদের মধ্যে, তারা আসলে পণ্যভোক্তা মাত্র; কখনো পাঠক নয়। ক্লিশে শোনালেও লিখব, সকলেই পাঠক নয়; কেউ কেউ পাঠক। এবং, এখানে সেই পাঠকের কথাই ভাবছি যিনি পিটুলিগোলা জল ও দুধের তফাৎ বোঝেন আর বহুদিন ধরে তিলতিল করে কঠিন অধ্যবসায়ের মধ্য দিয়ে পাঠ-সামর্থ্য অর্জন করেন। এঁদের উদ্দেশে ওরহান পামুক লেখেন, আপন ঔপন্যাসিক-সত্তার উপলব্ধি নিংড়ে নিয়ে : ÔNovels, just like paintings, present frozen moments … when we read a novel, we visualize these word-formed moments, these points of Time. That is, we transform them into space in our imaginations’ [The Naive and the Sentimental Novelist : Penguin 2011 : 97]

জীবনের সুগভীর বিন্যাস গ্রথিত হয় যেসব উপন্যাসে এবং অন্যান্য শিল্পিত প্রতিবেদনে, তাতে নিজস্ব বিশ^বীক্ষার বৈধতা পরীক্ষা করতে করতে তাঁদের সৃষ্টিকে রচয়িতারা মহৎ যাত্রায় রূপান্তরিত করেন। প্রতিটি নতুন বয়ানে এই যাত্রা, পুনর্নবায়িত হয়। এমন নয় যে, স্রষ্টার এই শিল্পিত ভ্রমণ বৃত্তাকার পথে চলে। তাই যে-বিন্দু থেকে সূচনা হয় তাঁর যাত্রা, আপাত-সমাপ্তিতে পৌঁছে দেখা যায় যে, তিনি পুরোনো সূচনাবিন্দুতে ফিরে আসেননি। তাই আপাত-সমাপ্তির উপলব্ধি তাঁর পক্ষে হয়ে ওঠে আরেকটি নতুন সূচনার প্রেরণা। স্রষ্টার সঙ্গে তাঁর পাঠকও সম্পৃক্ত হয়ে যান ওই যাত্রায়, যার আছে কেবল নতুন নতুন আরম্ভ, শেষ নেই কোথাও। না লিখলেও চলে, এই প্রক্রিয়ায় ক্রমাগত যে নতুন ভুবনগুলি উদ্ভাসিত হয়, প্রতিমানবিক বিশ^ায়নের পণ্য-জোগানদারেরা তাদের ছুঁতে পারে না কখনো।

বিশ^সাহিত্য অভিধা প্রাপ্য কেবল সেইসব উদ্ভাসনময় সৃষ্টির কেননা দেশ-কাল জাতীয়তার সীমানা তাদের পক্ষে অবান্তর। অথচ প্রতিটি প্রজন্ম নতুন পাঠে ওই উদ্ভাসনী বয়ানগুলিতে খুঁজে পায় নতুন তাৎপর্য আর নিজেদের আরো ভালো করে চিনে নেওয়ার মতো আশ্চর্য মায়াবী দর্পণ।

এজন্যে হ্যামলেট-ফাউস্ট-রিজারেকশন-গোরা-গীতাঞ্জলি-প্ল্যাগ-ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট এবং সমতুল্য আরো কিছু পাঠকৃতি সকল কালের সকল মানুষের আত্মোপলব্ধির চিরসঙ্গী। এ প্রসঙ্গে আরো একবার গ্যয়টের কাছে ফিরে যাচ্ছি। তাঁর সময় বেস্টসেলারের জোয়ার ছিল না যদিও, সুলভে মনোরঞ্জন করার মতো অগভীর ছদ্ম-বয়ানেরও অভাব ছিল না, তাদের তিনি ‘বন্যা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অবশ্য তাঁর সময় যা ছিল বন্যা, বিশ^পুঁজিবাদের সন্ত্রাসে, এখন তা সস্তা জনপ্রিয়তার সুনামিতে পরিণত হয়েছে।

কার্লাইল-রচিত দার্শনিক শিলের জীবনী সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে গ্যয়টে লিখেছিলেন : ‘What pleases the crowd spreads itself over a limitless field and, as we already see, meets with approval in all countries and regions. The serious and intellectual meets with less success, but … there are everywhere in the world such men, to whom the truth and the progress of humanity are of interest and concern … the serious-minded must therefore form a quiet, almost secret, company since it would be futile to set themselves against the current of the day; rather must they manfully strive to maintain their position till the flood has passed’.

[Some Passages in Schultz and Rhein (ed) Comparative Literature – The Early Years : 1973 : 10]

সাত

মনে ঝিলিক দিয়ে যায় কবি জীবনানন্দের সুপরিচিত বাক্যটি : ‘ভিড়ের হৃদয় পরিবর্তিত হওয়া দরকার’। ভিড় চিরকালই ভিড় থেকে যায়; তাদের হৃদয় নেই, অভ্যাসের প্রতি আনুগত্য আছে কেবল। কী জীবনানন্দের আগে, কী জীবনানন্দের পরে। নতুন কথা নতুন ভঙ্গিতে বলার অপরাধেই তো সক্রেটিসের হাতে বিষের ভাঁড় তুলে দিয়েছিল জগদ্দল পাথরের রক্ষকেরা। জিওর্দানো ব্রুনোকে পুড়িয়ে মেরেছিল ওরাই; গ্যালিলিও গ্যালিলেইকে নাকে খত দিয়ে বলতে হয়েছিল : ‘না, না, সূর্যই পৃথিবীর চারদিক ঘুরছে।’ ভিড়কে কী যে প্রসন্ন করে, তার হদিস গ্যয়টে পুরোপুরি পাবেন কী করে! সব দেশে সব কালে কঠিনের পথে যারা যায়, তাদের জন্যে পদে-পদে অপেক্ষা করে থাকে কুশাঙ্কুর, গুপ্তশত্রু। তবু ভিড়ের পানে দৃকপাত না করে সামনের দিকে এগিয়ে যান সৃজনপথের যাত্রীরা। অবধারিতভাবে এখানে মনে পড়ে যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথের বহুপঠিত ‘এবার ফিরাও মোরে’র কয়েকটি পঙ্ক্তি :

মহাবিশ^জীবনের তরঙ্গেতে নাচিতে নাচিতে

নির্ভয়ে ছুটিতে হবে সত্যেরে করিয়া ধ্রুবতারা।

… তারি লাগি রাত্রি-অন্ধকারে

চলেছে মানবযাত্রী যুগ হতে যুগান্তরপানে,

ঝড়ঝঞ্ঝা বজ্রপাতে জ্বালায়ে ধরিয়া সাবধানে

অন্তর-প্রদীপখানি। ….

জানি, ‘সে-ভাষা ভুলিয়া গেছি’। তবু প্রশ্ন যখন সত্য খুঁজে নেওয়ার, বিশ^পুঁজিবাদের জাদুপুরোহিতদের মন্ত্রণায় কেন সত্য-প্রগতি-ভাবাদর্শকে মহাসন্দর্ভ হিসেবে মান্যতা দিয়ে তাদের মৃত্যু-ঘোষণায় শরিক হবো? বরং গ্যয়টে-রবীন্দ্রনাথের যুগলবন্দিতে জেনে নেব, বিশ্বসাহিত্য সর্বজনীন মানব-সত্যের সন্ধানী। সাফল্য নামক মরীচিকা তো পুঁজিবাদের অন্যতম মারণ অস্ত্র যার কাছে সত্তাকে সঁপে দেয় কত ম্যাকবেথ, কত ফাউস্ট। কিন্তু যারা ব্যক্তিগত সত্যের বদলে সামূহিক সত্যকে খোঁজে এবং সেইজন্যে মানুষের জগৎকে নতুনভাবে গড়ে নিতে চায়, গ্যয়টে লিখেছেন তাদেরই কথা। নিরিবিলিতে, গোপনে এইসব গভীরতা-কর্ষণকারী মানুষেরা গড়ে তুলুক নিজস্ব সংঘ স্রোতের শ্যাওলা হয়ে যারা ভেসে যায় না, যারা সাহস-ভরে প্রতিস্রোতপন্থী হয় – এরাই মানব-সত্যের উন্মোচন-প্রয়াসী সম্ভাব্য বিশ^সাহিত্যের প্রকৃত প্রতিহারী। ছোট সময় ও ছোট পরিসরের বিবরে যারা রুদ্ধ থাকে, তারাই সাময়িক উত্তেজনার বন্যায় খড়কুটোর মতো ভেসে যায়। গ্যয়টে তাই লিখেছেন, ক্ষণিকের আবর্ত শেষ হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করাই সমীচীন। ছদ্মবিশ^ মানে বিকার, পীড়া ও বন্ধ্যত্ব; বিশ^ায়নে এইসব উপাদানেরই মাদকতা প্রবল সুনামি তৈরি করেছে। অতএব মহাকবি গ্যয়টে ও রবীন্দ্রনাথ পণ্যসর্বস্বতার দুঃসহ এই পর্যায়ে প্রতিষেধক হয়েই আসেন আমাদের কাছে।

আরো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা হয়তো অনুক্তই থেকে গেল। হয়তো কেন, নিশ্চয়ই। মানুষের পৃথিবীটাকে দুমড়ে-মুচড়ে, বিকৃতি আর জান্তবতায় মুড়ে দিয়ে যারা সাহিত্য-সংস্কৃতি-সৌন্দর্য-চেতনা-অনুভব থেকে ‘মানব-বিশ^’ অভিধাটিকে তার যাবতীয় তাৎপর্য ও সম্ভাবনা সমেত ছেঁটে ফেলে দিচ্ছে – তাদের তৈরি করা প্রতিবাস্তব-প্রতিজগৎ-প্রতিসন্দর্ভকেই মান্যতা দেব কেন একতরফা? বিনাপ্রশ্নে মান্যতা দিয়ে যাওয়ার এই যে অভ্যাস, তাও তো পণ্যসর্বস্ব ক্ষমতাবানদেরই সুচতুর নির্মাণ। কিন্তু এতসব লেখার পরেও প্রশ্ন থেকে যায়, বিশ^সাহিত্যের ধারণাও তো তৈরি হচ্ছে ইংরেজি অনুবাদের মাধ্যমে। বিভিন্ন দেশে যেসব লেখক ইতোমধ্যে নিজেদের বিক্রয়যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন, অন্তর্জাল যাঁদের প্রচারের দায়িত্ব নিয়েছে – তাঁদের বাইরেও কি রয়ে গেলেন না আরো অনেক অসামান্য স্রষ্টা! ইয়াসুনারি কাওয়াবাতার পরে হারুকি মুরাকামি নিয়ে ইংরেজি-জানা দুনিয়া উত্তাল। এসময় জাপানি সাহিত্যের আরো একাধিক আদল নিশ্চয় আছে। কীভাবে জানব তাদের? একই কথা প্রযোজ্য ওরহান পামুক ছাড়া তুর্কি সাহিত্য কিংবা হোসে সারামাগো ছাড়া পর্তুগিজ সাহিত্য সম্পর্কে। বিশ^সাহিত্যে যে-মানববিশ^ উপস্থাপিত হচ্ছে, তা তাহলে খণ্ডিত ও অসম্পূর্ণ? কোনো কথাই তো লেখা গেল না সুইডিশ বা নরওয়েজীয় বা ডেনমার্ক কিংবা ব্রাজিল-মেক্সিকো-ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ-কালো আফ্রিকার সাহিত্য নিয়ে। সাম্প্রতিক চীনা বা ইরানি সাহিত্যের ধরনই বা কীরকম? নোবেল পুরস্কারের কল্যাণে সুইডিশ কবি টমাস ট্র্যান্সট্রোমার-এর লেখা পড়েছি। তার বাইরে সুইডেনের সাহিত্য কেমন? আবার তাহলে ঘুরেফিরে ‘জাতীয়’ সাহিত্যের প্রসঙ্গ এসে যাচ্ছে। যাবেই। কারণ উৎসের পরিচয় না জেনে কি আন্তর্জাতিক মানববিশ্বের অন্বিষ্টে পৌঁছানো যায় সত্যিই!

মানুষকে মানুষের অভিজ্ঞান ফিরিয়ে দেওয়াই আজকের যুদ্ধকথা। প্রতিটি তাৎপর্যই যেহেতু সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে অর্জনীয়, পণ্যসর্বস্বতার নরকের প্রতি তর্জনি-সংকেত করেই তাকাব সমস্ত অপর পরিসরের দিকে। কেননা পৃথিবীটা তো সমস্ত মানুষের; শুধুমাত্র ঐশ^র্য ও প্রতাপের অধিকারীদের নয়। অতএব পুরনো প্রশ্নটাই ফিরিয়ে আনি; কোন সমাজ কোন সংস্কৃতি কোন সাহিত্য কোন মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা ও পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যে যুদ্ধ করতে চাইছি! এবার বরং ১৭৮ বছর আগে উচ্চারিত কালজয়ী মানব-সত্যের পুনরুল্লেখ করি কেননা কুহক ও সংশয়ভরা আত্মহননের এ-সময়ে এ-উপলব্ধির নবায়ন বড়ো প্রয়োজন : ÔAssume man to be man and his relationship to be a human one; then you can exchange love for only love, trust for trust etc. If you want to enjoy art, you must be an artistically cultivated person; if you want to exercise influence over other people, You must be a person with a stimulating and encouraging effect on other people.’ [Karl Marx : Economic and Philosophic Manuscript : 1844]

সমাপ্তিবিহীন এই বয়ানের কি কোনো ভরতবাক্য সম্ভব? বরং বের্টল্ট ব্রেখটের একটি কবিতার সামান্য অংশ শোনাই নিজেদের :

Today everywhere, from the hundred-storeyed
                                                                           cities

Over the seas cross-ploughed by teaming liners

To the loneliest villages, the word has spread

That mankind’s fate is man alone. Therefore

We now ask you, the actors

Of our time a time of overthrow and of boundless
                                                                      mastery

Of all nature, even man’s own — at last

To change yourselves and show us mainkind’s
                                                                          world

As it really is made by men and open to
                                                                    alteration

                            [Collected Poems : Methuen : 23]

মানুষের মননে-কল্পনায় সৃষ্টি হওয়া মানুষের সাহিত্যে ব্যক্ত মানুষের চিরঅমøান জগৎ, আসুন, দেখি এবং দেখাই। আর, দেখতে-দেখতে দেখাতে-দেখাতে পালটে দিই নিজেদেরও। মানুষের জন্যে, মানুষের হয়ে। কারণ সবকিছু শেষ আছে; শেষ নেই শুধু মানুষের হওয়ার, হয়ে ওঠার। শেষ নেই নতুন নতুন বিন্দুতে মানুষের আত্ম-আবিষ্কারের এবং সেই আবিষ্কারের অন্তহীন আনন্দ-বিষাদময় বিহ্বল প্রকাশের …