(রকিবুল হাসান নিটোল ও সানজিদা বহ্নিকে)
লিচু বাগানের ভেতর দিয়ে আমরা যাচ্ছি। আমরা মানে – আমি, কৃষ্ঠু হাঁসদা আর হাঁসদার কোলের বাচ্চাটা। আমাদের পরিচয়ের বয়স বড়জোর দেড় ঘণ্টা। এইটুকু পরিচয়ে হাঁসদা আমাকে নিয়ে এগিয়ে চলছে, আর আমিও ওর পিছু পিছু পা ফেলছি।
কিন্তু জনশূন্য এই লিচু বাগানটা যাতায়াতের পথ হয় কীভাবে সেটাই আমার মাথায় আসে না। ভাবনাটা কিছুক্ষণ আগে এলেও কিছুতেই এত দূরের অচেনা পথে অপরিচিত এই সাঁওতাল রমণীর পিছু পিছু পা বাড়াতাম না।
একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে তিনদিন ধরে সীমান্ত জেলা ঠাকুরগাঁও আছি। জেলা শহরের একটা রিসোর্টে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। গত দুদিন দলবেঁধে দেশের একদম উত্তরের স্থান বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর, মহানন্দা পাথুরে নদী, চা বাগান ঘুরে ঘুরে আজ সকালে ভাবি – একা একা এলাকাটা একটু ঘুরে আসি। কাউকে কিছু না বলে একটি টুকটুকি গাড়ি নিয়ে ঠাকুরগাঁও শহর থেকে প্রায় দেড় কিলো দক্ষিণে চলে আসি। পথে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের একটি স্কুল চোখে পড়ে। ড্রাইভারকে থামাতে বলি। ভাড়া মেটাতেই এক দিদিকে দেখতে পাই। তার কাছে জানতে পাই এখানে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাঁওতালদের বাস আছে। আমি তাদের সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হলে তিনি আমাকে স্থানীয় বাজারে নিয়ে যান এবং কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন। কিন্তু কেউ আগ্রহ দেখাচ্ছিল না। তাদের ভাষাও আমি বুঝতে পারছিলাম না। অবশেষে কৃষ্ঠু হাঁসদার সঙ্গে দেখা। ওর কোলের বাচ্চাটিকে দুটি পটেটো ক্র্যাকার্স কিনে দিতেই কিছুটা সহজ হলো হাঁসদা। ও বাজার-সওদা করে, আমি ওর জন্য অপেক্ষা করি। কেনাকাটা শেষ হলে ওর সঙ্গী হই। ওরা হেঁটেই আসে, হেঁটেই যায়। কিন্তু আমি একটা টুকটুকি গাড়ি নিই। চালক নানা গল্প করতে করতে আমাদের নিয়ে দক্ষিণে ছুটতে থাকে। প্রায় দুই কিলো পথ অতিক্রম করলে রাস্তার পাশে গাড়ি থামাতে বলে হাঁসদা।
একপাশে ভুট্টা ক্ষেত, অন্যপাশে লিচু বাগান। হাঁসদা নেমেই লিচু বাগানের পথ ধরে। আমাকে বলে – আসেন।
আমি ভাড়া মিটিয়ে কী করব, কী করব না ভাবছিলাম। কোনো বসতিই তো দেখছি না। মন বলছে যাসনে। ততক্ষণে হাঁসদা অনেকটা এগিয়ে গেছে। কিন্তু মুহূর্তেই আমার পা আবেগের প্রশ্রয়ে হাঁসদাকে অনুসরণ করল।
হাঁসদা আরো কিছুটা পথ এগিয়ে গেছে। এই তীব্র শীতেও ওর পায়ে জুতা নেই। বিপরীতে কেডসের ভেতর পুরু মোজায় জড়ানো পা, জিন্স প্যান্ট, কয়েক স্তরের পোশাকের ওপর ভারী জ্যাকেটেও আমার শরীর গরম হচ্ছে না। আর পাতলা শাড়িতে শরীরের পুরোটা আবৃত না হলেও এই রমণীর যেন শীতের কোনো অনুভূতি নেই। শিশুটির শরীরেও নেই গরম পোশাক। হাঁসদার এক হাতে বাজার-সওদার থলে, অন্য হাতে কোলের শিশু। শিশুটি ‘এংগা এংগা’ সম্বোধন করে ওদের ভাষায় কিছু একটা চাইছে। কিন্তু হাঁসদা এখনই দিতে চাচ্ছে না। শিশুটি কান্না শুরু করলে আমার কিনে দেওয়া দুটি পটেটো ক্র্যাকার্স থেকে একটা খুলে হাঁসদা ওর হাতে দিলো। মুহূর্তে শিশুটির কান্না থেমে গেল। আমি পিছিয়ে পড়েছি দেখে ভাঙা ভাঙা বাংলায় হাঁসদা জিজ্ঞেস করে – ‘ভয় লাগছে?’ ভয় লাগলেও আমি তা প্রকাশ করি না। গা ছমছম ভয় সঙ্গে নিয়ে হাঁসদার পেছন পেছন এগিয়ে চলি।
জিজ্ঞেস করি, আর কত পথ?
হাঁসদা উত্তরে কী বলে, বুঝতে পারি না।
লিচু বাগানটা শেষ হতেই দিগন্তবিস্তৃত আখক্ষেত। আখক্ষেতের পাশ দিয়ে যেতে যেতে মানুষের দেখা মিলল, তবে তাদের হাতে তির-ধনুক, বল্লম দেখে আমার পিলে চমকে যাওয়ার অবস্থা। লোক দুটি হাঁসদার কাছে সাঁওতালি ভাষায় কীসব জিজ্ঞেস করে – আমি কিছুই বুঝতে পারি না। ওদের একজনের হাতে তিরবিদ্ধ একটি খরগোশ। মাত্রই শিকার করেছে – রক্ত গড়িয়ে পড়ছে ছোট্ট দেহ থেকে।
ধনুক হাতের লোকটিকে বলি – ‘একটি অনুষ্ঠানে আপনাদের জেলায় এসেছি, ভাবলাম এলাকাটা ঘুরে দেখি, বাজারে দিদির সঙ্গে পরিচয়, চলে এলাম।’
লোকটির কথায় বুঝতে পারি সে হাঁসদার স্বামী। নাম মন্টু সরাং। কিন্তু আর কিছুই বুঝতে পারি না। যেটুকু বাংলা বলে তাও ঠাকুরগাঁওয়ের স্বর ও আঞ্চলিক শব্দের বুনন – হা করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আমার আর কিছুই করার থাকে না। তবু তাদের আন্তরিকতা অনুভব করি। কিছুটা ভয় কাটে। আমরা ক্ষেতের ভেতর থেকে সরু পথ ধরে একজনের পিছু একজন করে সামনের দিকে এগোতে থাকি। সবার সামনে তির-ধনুক হাতে মন্টু সরাং, তারপর কৃষ্ঠু হাঁসদা, তারপরে আমি, সবার পেছনে একহাতে বল্লম আর এক হাতে মৃত খরগোশ নিয়ে মন্টু সরাং-এর সহযোগী। বিস্তীর্ণ ভুট্টাক্ষেতের ভেতর থেকে চলতে চলতে এক অদ্ভুত ভয় মেশানো ভালো লাগা দানা বেঁধে ওঠে।
হঠাৎ ভুট্টাক্ষেতের ভেতর থেকে গান ভেসে আসে –
দায়া দুলোড় ঞেঁলতে
কুলি মেঘে সানাঞাঁ
মনের : ভাবনা বাচোম লৌহওঞঁ
মন তিংমা চুট্চট কোড়াম তিংমা ধাক্ধাক
আম তুলুচ বড় গেচো বাচঞ দিলা।
আমাদের দেখতে পেয়ে মেয়েটি গান থামিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়।
আমি বলি, তুমি গাইছিলে গান! যদিও ভাষা বুঝতে পারিনি। তবু দারুণ লেগেছে। তোমার কণ্ঠ খুব সুন্দর।
মেয়েটি লজ্জা পায়। তারপর চোখ তুলে তাকায়, এর বাংলা হচ্ছে – আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে আমার মনের কথা বলতে পারছিনে। আমার বুক কাঁপছে। আমি সাহস হারিয়ে ফেলছি।
জিজ্ঞেস করি, তুমি ভালোবাসো কাউকে?
ও লজ্জায় দু-হাতে মুখ লুকোয়।
মেয়েটির নাম প্রতিমা টুডু। দারুণ বাংলা বলে। নৃ-গোষ্ঠীদের স্কুলে লেখাপড়া শিখেছে ও। বেশ কিছুটা পথ পাড়ি দিয়ে আমরা মন্টু সরাং-এর আঙিনায় উঠি। পাশাপাশি কয়েকটি ঘর। অধিকাংশই মাটির দেয়াল, ছন বা খড়ের চালা। আমার পিছু পিছু অনেক নারী-পুরুষ-শিশু জড়ো হয়েছে। নতুন পরিবেশে আমার যেমন বিস্ময় জাগছে – আমাকে দেখে এদেরও বিস্ময়ের সীমা নেই। তীব্র শীতেও এদের কারো শরীরে গরম পোশাক নেই, পায়ে নেই সামান্য স্যান্ডেল। তবু কী সুন্দর হাসছে এরা!
এই ভিটা এদের না। এদের নিজস্ব কোনো ভূমি নেই। জোতদারের জমিতে ঘর করে থাকে। জোতদারের জমি চাষ করে, ফসল ফলায়; সামান্য যা মজুরি পায় তা দিয়ে আর বিভিন্ন প্রাণী শিকার করে অতি কষ্টে চলে সংসার।
মন্টু সরাং আমাকে তির চালানো শেখায় আর সাবধান করে দেয় – এগুলো কিন্তু বিষাক্ত। আমি ভয়ে ভয়ে তির ধরি। অন্যরা তাতে মজা কুড়োয়। আমার পিঠে বেঁধে দেয় তিরসহ খাপ। অল্প সময়ে আমিও হয়ে উঠি তিরন্দাজ। যদিও প্রতিটি নিক্ষেপই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। ছোট-ছোট ছেলেমেয়ে আমার ব্যর্থতা দেখে হাসে। আমিও মজা কুড়োই। কৃষ্ঠু হাঁসদা ততক্ষণে খরগোশটির চামড়া ছাড়িয়ে মাংস টুকরো টুকরো করে রান্নার উপযোগী করে তুলেছে।
প্রতিমা টুডু আমায় নিয়ে সারা পাড়া ঘুরে বেড়ায়। এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি যেতে জনহীন ভয়ধরা বিস্তীর্ণ ক্ষেত পেরিয়ে যেতে হয়। এখানে কেউ আমায় বেঁধে রাখলে বা মেরে ফেললে খুঁজেও পাবে না আমার আপনজন। এইসব কথা ভাবি, আর টুডুর পেছন পেছন হাঁটি।
টুডু জিজ্ঞেস করে, আপনার ভয় লাগছে?
কী উত্তর দেবো তাই ভাবছি, এরই মধ্যে কয়েকজন লোক আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। ক্রোধ নিয়ে কথা বলছে লোকগুলো। প্রতিমা টুডুও চিৎকার করে কথা বলছে। যদিও লোকগুলোর হাতে লাঠি, তবু কথায় ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নয় টুডু। ওদের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ ঝগড়া চলে। ভাষা বুঝতে না পারলেও এটুকু বুঝতে পারি, ওরা কোথাও আমাদের নিয়ে যেতে চায়। সামনে কী বিপদ আমার জন্য অপেক্ষা করছে তাই অনুমান করার চেষ্টা করি।
টুডুর কাছে জানতে চাই এরা কারা।
টুডু বলে, এরা মানঝি পরিষদের সদস্য জগ মানঝির লোক।
এবার আমার আতঙ্কটা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এদের সম্পর্কে কিছুই জানি না আমি।
জিজ্ঞেস করি, আমাদের ধরে নিয়ে যেতে চায় কেন? এরা কি দস্যু? কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের সদস্য?
টুডু আমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই ওরা আমাকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে।
টুডু চিৎকার করে কীসব বলছে। কিছুই শুনছে না ওরা।
নিরুপায় আমি হাঁটতে থাকি। হঠাৎ অনেক কুয়াশা পড়েছে। তবু আমি ঘামতে থাকি।
নিরুপায়ী টুডুর চিৎকার থেমে যায়। টুডুও হাঁটতে থাকে। এবার লোকগুলো কিছুটা সহজ হয়। আমার হাত ছেড়ে দেয়। আমরা সামনের দিকে এগোতে থাকি।
এরই মধ্যে একজন গান ধরে –
আবো সাঁওতাল হপন আবোয়া : বিচার
আ’ন আরি লেকা মেনা : তাবন
ঘুষ বাবো জমা একেন খাটি সারি
সারি কথা বোন রড়েদা।
বুক ধুক-ধুক করলেও গানের সুর ও প্রতিটি শব্দ গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনি। কিন্তু কিছুই বোধগম্য হয় না।
টুডু কখন আমার পাশে চলে এসেছে খেয়াল করিনি। ও ফিসফিস করে বলছে, গানের অর্থ হলো – ‘আমরা সাঁওতাল, আমাদের বিচার আমরা আইন মতো করি। ঘুষ আমরা খাই না, ন্যায়বিচার করি। সত্য কথা বলি আর সত্য পালন করি।’
এবার আমার রাগ ধরে। বলি – কিন্তু আমি তো কোনো অন্যায় করিনি। তোমাদের পাড়ায় কেবল বেড়াতে এসেছি। অনেক আগেই চলে যেতাম, তোমরা আন্তরিকতা দেখিয়েছ বলেই এতক্ষণ ধরে আছি। এখন আবার বিচার! অদ্ভুত!
টুডু এবার হেসে ফেলে। আপনি সত্যিই ভয় পেয়েছেন দেখছি। এটা সাঁওতাল আদিবাসীদের একটি লোকসংগীত। আপনাকে বিচার করবে এই উদ্দেশ্য নিয়ে গায়নি। ও শিল্পী, তাই গেয়েছে।
শিল্পী আবার দস্যুও?
দস্যু না এরা।
তাহলে আমায় ধরে নিয়ে যাচ্ছে কেন?
এরা হচ্ছে মানঝি পরিষদের সদস্য জগ মানঝির লোক।
যারাই হোক না কেন, দস্যু না হলে আমাকে ধরে নিয়ে যাবে কেন? আমি কি কারো ক্ষতি করেছি?
আপনাকে ধরে নিয়ে যাওয়াটা মোটেই ঠিক হচ্ছে না – তবে এরা দস্যু না। হাঁটতে হাঁটতেই বলে যাচ্ছে টুডু। শুনুন, আমাদের একটি সমাজকাঠামো আছে। এটা ঐতিহ্যগত এবং পুরুষানুক্রমে চলে আসছে। গ্রামভিত্তিক এই সমাজকাঠামোই হচ্ছে মানঝি পরিষদ। পরিষদে সাতজন সদস্য থাকেন। এরা হলেন – মানঝি হাড়াম, পারানিক, নাইকি, জগ মানঝি, জগ পারানিক, গোড়েৎ ও কুডাম নাইকি। এই পরিষদের প্রধান মানঝি হাড়াম, তিনি সমগ্র গ্রামের নেতা। তিনি শাসন জারি করেন এবং তাঁর আদেশ আমরা পালন করি। আর পারানিক হচ্ছেন মানঝি হাড়মের সহকারী।
কিন্তু যাঁর নির্দেশে আমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তিনি কে? আমি জিজ্ঞেস করি।
জগ মানঝির কথা বলছি – গ্রামের যুবক-যুবতীদের নজর ও শাসনে রাখা তাঁর কাজ। গ্রামে আমার মতো সব যুবক-যুবতীর তালিকা তাঁর কাছে আছে। আমাদের চরিত্র গঠন, স্বাস্থ্য ও কর্মদক্ষতা যেন ভালো থাকে সেদিকে তিনি নজর রাখেন।
যুবক-যুবতী কেউ নষ্ট হয়ে গেলে তার জন্য জগ মানঝিকে কৈফিয়ত দিতে হয়।
তথ্যগুলো বেশ ভালো লাগে আমার। শঙ্কা ভুলে বলি, বেশ মজার তো!
টুডু বলে, তাই?
হ্যাঁ, তবে তোমার উপস্থাপনাও চমৎকার।
টুডু এবার লজ্জা পায়।
আমি বলি, তা জগ মানঝি আমার আবার কী চরিত্র গঠন করবে? আমি তো বাইরের লোক। অবশ্য তুমি আমার সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছ, তোমাকে আবার কোনো সমস্যায় পড়তে না হয়!
টুডুর চোখে দুশ্চিন্তার ছাপ। তবু ও বলে, কিছু হবে না।
আমায় ধরে নিয়ে আসা লোকগুলো আরো সহজ হয়। আমিও এদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিই।
গল্পে গল্পে আমাদের পথটুকু ফুরিয়ে যায়। আমরা জগ মানঝির উঠানে উঠি। বেশ কিছু লোক আগে থেকেই উপস্থিত। হয়তো কোনো বিচারকার্য চলছে। আমরা পৌঁছানো মাত্র নীরব হলো সবাই। আমার মুখাবয়ব-পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে সমীহ করলেন জগ মানঝি। উপস্থিত অন্য সবাই হা করে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো। এরই মধ্যে পেছন থেকে উচ্চস্বরে কীসব বলতে বলতে জগ মানঝির দিকে এগিয়ে এলো এক উত্তেজিত যুবক। টুডু কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে, আর জগ মানঝির লোকেরা দুজনকে থামিয়ে দিচ্ছে। কিছুই বুঝতে পারছি না আমি।
আমাকে একটি চেয়ারে বসতে দেওয়া হলো। যুবকটি এখনো উত্তেজিত। উপস্থিত সদস্যদের ভেতর আলোচনা চলছে। হা করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আমার কিছুই করার নেই। ডান দিকে চোখ ঘুরাতেই দেখি – মন্টু সরাং ও কৃষ্ঠু হাঁসদাও উপস্থিত। এদেরকেও জেরা করা হলো।
খানিক বাদেই আমার পালা। জগ মানঝি আমায় প্রশ্ন করতে লাগলেন। ভালোই বাংলা বলেন তিনি। আমি তার উত্তর দিতে থাকি। তাঁর প্রশ্ন যেন শেষই হয় না। মাঝে মাঝে আমার হয়ে টুডু উত্তর দিতে চাইলে ওকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দেন জগ মানঝি।
আমি আসলে কোনো কুমতলব নিয়ে এসেছি কি না, আদিবাসীদের কোনো নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ফেলতে চাই কি না তা-ই যাচাই করছেন এরা। বুঝতে পেরে, নিজেকে সৎ প্রমাণ করার জন্য যুক্তি উপস্থাপন করি।
সবশেষে বলি, আসলেই আমি অনুষ্ঠানে এসেছি কি না, আপনারা আমার সঙ্গে দুজন চলুন – দেখে আসবেন।
জগ মানঝি বলেন, আপনি কিছু মনে করবেন না। আমরা সংখ্যালঘু – ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর লোক। প্রতিটি মুহূর্তে শঙ্কায় থাকি – কখন কোন বিপদ আসে! মাঝে মাঝে আমাদের ওপর হামলা হয়। আমাদের উচ্ছেদ করতে চায় বিভিন্ন মহল – যেন আমরা মানুষ না, কোনো প্রাণীও না, আমাদের বাস করার কোনো অধিকার নেই এই ভূখণ্ডে। পাবনার গোবিন্দগঞ্জে আমাদের ওপর যে হামলাটা হলো; শ্যামল, মঙ্গল, রমেশ গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারালো। বাড়িঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিলো। সামান্য ঘটিবাটি যা ছিল, তাও লুট করল। তার তো আজো ন্যায়বিচার পেলাম না। এই বিচারহীনতা প্রমাণ করে জাতিগতভাবে আমাদের কতটা অবহেলার চোখে দেখা হয়। দেশের উন্নয়ন হয়। আমাদের ভাগ্যের কোনো উন্নতি নেই। চরম দারিদ্র্যের মধ্যে আমাদের বাস।
একজন বাঙালি হিসেবে, সত্যিই আমি লজ্জিত। কিন্তু, আমি এখানে এসেছি শুধু কৌতূহল নিয়ে, নতুন কিছু দেখার নেশায়। আপনাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমার ভালো লেগেছে।
জগ মানঝি এবার আন্তরিক হয়ে ওঠেন। আমাকে তাঁর ঘরে নিয়ে যান। এত সুন্দর মাটির ঘর হতে পারে, ধারণাই ছিল না আমার। গৃহজুড়ে অঙ্কিত নকশা। দেয়ালে টাঙানো বিভিন্ন ছবি। কোনো কোনো ছবিতে সাঁওতালি মেয়েদের নাচ, কোনোটায় কারুপণ্য হাতে সাঁওতাল রমণী, কোনোটায় সাঁওতাল তরুণের দল বাদ্য বাজাচ্ছে, কোনো ছবিতে তির-ধনুক হাতে সাঁওতাল যুবক শিকার করছে।
ছবিগুলো মুগ্ধ হয়ে দেখছি – কখন প্রতিমা টুডু এসে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে টের পাইনি।
ও বলে, এগুলো সাঁওতাল সংস্কৃতির অংশ।
আমি ওর দিকে তাকাই। ওর চোখে এখন আর দুশ্চিন্তার ছাপ নেই।
লক্ষ করি – উত্তেজিত যুবকটি আমাদের নজরে রাখছে।
প্রতিমা টুডুও দেখল ওকে। একটি ভেংচি কাটল বলে মনে হলো। যুবকটি আঘাত পায়। তবু ও নাছোড়বান্দা। আমাদের দিকে তীক্ষ্ন নজর ওর।
আমি বিষয়টি এড়িয়ে ফের ছবির দিকে মন দিই। একটি ছবিতে আটকে যায় চোখ। অর্ধনগ্ন বাবরি চুলের দুই যুবক। ধনুক হাতে দাঁড়িয়ে – যেন মৃত্যু জেনেও হাসিমুখে শত্রুবাহিনী লক্ষ করে তির ছুড়ছে। ছবির নিচে লেখা – সিধু মুর্মু ও কানু মুর্মু। নাম দুটি কোথায় পড়েছি চিন্তা করতে কিছুটা সময় লাগল।
ভেতর ঘর থেকে কিছু জলখাবার হাতে বেরিয়ে এলেন জগ মানঝি। তিনি বলতে লাগলেন, এঁরা দুজন হলেন – সাঁওতাল বিদ্রোহের নেতা সিধু মুর্মু ও তাঁর ভাই কানু মুর্মু। আপনার নিশ্চয়ই জানা আছে, ব্রিটিশ ভারতে জমিদার, মহাজন ও ইংরেজদের রাজস্ব ও কৃষি নীতির বিরুদ্ধে সাঁওতাল জনগোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন চার মুর্মু ভাই – সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরব।
আমি মনোযোগ দিয়ে তাকাই।
জগ মানঝি বলতে থাকেন – বিদ্রোহের সূচনা হয় মূলত ১৮৫৫ সালের জুন মাসে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ ও বিহারের ভগলপুর জেলায়। ইংরেজবাহিনী যুদ্ধ করে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে, আর সাঁওতালরা যুদ্ধ করে তির-ধনুকসহ নিজেদের তৈরি দেশীয় অস্ত্র দিয়ে। বন্দুক-কামানের কাছে তির-ধনুক টিকতে পারেনি। এ-যুদ্ধে অনেক ইংরেজসহ প্রায় দশ হাজার সাঁওতাল মারা যায়। মারা যায় সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রধান চার নেতা, চার ভাই – সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরব। মহাজন, ইংরেজদের অত্যাচার-নির্যাতন-শোষণ থেকে বাঁচাতে, আমাদের অধিকার আদায়ের জন্য তাঁরা লড়াই করেছিলেন।
আমি লক্ষ করি, জগ মানঝির গলা কাঁপছে। চোখ ভিজে উঠছে। বয়স হয়েছে তাঁর। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না পেলেও স্বশিক্ষিত বোঝা যায়। গামছা দিয়ে চোখ মুছে নিজে বসেন, আমাকেও বসতে বলেন। আমাকে জলখাবার খেতে তাগিদ দেন। আমি ধীরে ধীরে খেতে থাকি। প্রতিমাকেও নিতে বলি। ও উত্তেজিত যুবকটির সঙ্গে কীসব বলছে, বুঝতে পারি না কিছু।
জগ মানঝি বলেন, কতদিন আর সিধু-কানুর ছবি টাঙিয়ে বুকের ভেতর দ্রোহ পুষে রাখব! সমাজ তো ভেঙে যাচ্ছে দিন দিন। অস্তিত্ব সংকট আরো প্রকট হয়ে উঠছে। আমরাও তো ভূমিপুত্র, কিন্তু আমাদের অধিকাংশেরই ভূমি নেই। আমাদের ঘরে খাদ্য নেই, পোশাক নেই, চিকিৎসা নেই, শিক্ষার সুযোগ নেই। দেশে মাথাপিছু আয় বাড়ছে, সমৃদ্ধিশালী হচ্ছে দেশ। আমরা কি এদেশের সন্তান না? আমাদের সমৃদ্ধিটা কোথায়? আমরা অর্থ-বিত্ত চাই না – এখানের অসহায় মুখগুলো দেখেন – এরা অল্পতেই খুশি। আমাদের ন্যূনতম বেঁচে থাকার সুযোগটুকু দিন। আমাদের সমাজকাঠামো ভেঙে দিয়েন না। আমরা তো কারো ক্ষতি করি না।
আমি কিছুই বলতে পারি না। অসহায় মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি।
জগ মানঝি বলেন, আপনি কিছু মনে করবেন না, অনেক কিছু বলে ফেললাম। এভাবে আপনাকে বলা ঠিক হয়নি। আসলে কাউকে তো বলতে পারি না, অন্তরের ক্ষোভ কোথায় ঝাড়ব! এগুলো আপনাকে উদ্দেশ করে বলিনি, আপনি কষ্ট নেবেন না।
আমি বলি, না না, কিছু মনে করিনি। আসলে কৌতূহলবশত আপনাদের এখানে চলে এসেছি। এইটুকু আস্থা রাখবেন – আমার দ্বারা আপনাদের কোনো ক্ষতি হবে না।
জগ মানঝি বলেন, ও ছেলেটির নাম প্রদীপ সরেন। ওর এক ভাইকে বাঙালি ছোকরারা হত্যা করেছিল বলে কোনো বাঙালিকে সহ্য করতে পারে না ও। আপনি কিছু মনে করবেন না।
আমি প্রদীপ সরেনের কাছে যাই, ওর কাঁধে হাত রেখে বলি, সব বাঙালি তো এক না। তোমাদের ব্যথায় আমিও ব্যথিত।
প্রদীপ কোনো কথা না বলে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
জগ মানঝি আমাকে নিয়ে আবার আঙিনায় ফেরেন। গান পরিবেশনের নির্দেশ দিতেই বাদ্যযন্ত্র বেজে ওঠে। একটা মেয়ের কণ্ঠে দোল খায় সুর –
আগিল হাপড়াম মহাজন ঠেন
আডি কচলন কো কচলন কে : কোয়া
হায়রে হায়রে হায় বাছারে
সাঁওতাল আডি আত কচলন কো জম লেদা।
প্রতিমা টুডু আমার আসনের পেছনে দাঁড়ায়। গান শেষ হতেই ফিসফিস করে অর্থ বলে দেয় – পূর্বপুরুষ যারা ছিল, মহাজন দ্বারা অত্যাচার-শোষণে তারা সর্বহারা হলো। হায় হায় বিচার নাই। সাঁওতাল আমরা নির্যাতিত তাই।
আমরা একের পর এক গান শুনি। দেখি দূরে আমগাছের সঙ্গে ঠেস দিয়ে প্রদীপ সরেন মনমরা বসে আছে।
জগ মানঝির আসর থেকে বিদায় নিই। কেবল টুডু আমার সঙ্গে। সরুপথ দিয়ে পাশাপাশি হাঁটি। হঠাৎ চোখে পড়ে ওর হাতের কব্জিতে উল্কি চিহ্ন।
জিজ্ঞেস করি, এটা কেন করেছ?
ও হাত দিয়ে অন্য হাতের কবজি এবং দুই বাহুতে একই রকম চিহ্ন দেখিয়ে বলে, আরো একটি আছে।
কোথায়?
বলা যাবে না। টুডু ঠোঁটের কোনায় লজ্জা নিয়ে হাসে।
ঠিক আছে থাক, বলতে হবে না।
টুডু বলে, আমার বুকে।
আমি বিস্মিত হই। এভাবে যন্ত্রণা পেয়ে কেউ উল্কি আঁকে?
আমাদের সমাজে এটাই নিয়ম। বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বিবাহযোগ্য ছেলেমেয়েদের সিকাচিহ্ন দিতে হয়। বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। চলে গান-বাজনা, পানভোজন। খোদনী তিন মুখের লোহার শলাকা দিয়ে সিকাচিহ্ন এঁকে দেয়। এ-চিহ্ন দেখেই বোঝা যায় বিবাহযোগ্য। তাছাড়া কেউ যদি সিকাচিহ্ন ছাড়া মারা যায়, সে পরকালে যমরাজের শাস্তি পায়।
কিছুটা পথ এগোতেই টুডু আমায় ভুট্টাক্ষেতের ভেতর নিয়ে আসে।
জিজ্ঞেস করি, এদিকে কেন?
প্রদীপ আমাদের পিছু নিয়েছে।
কখন পিছু নিল?
নিয়েছে। আপনি দেখেননি।
নিলেই বা কি?
নেবে কেন?
আমি বলি, আমাদের সঙ্গেই তো ও আসতে পারত।
টুডু কোনো কথা বলে না। অভিমান করেছে বোধহয়।
আমি কিছু একটা বলব, টুডু আমার মুখ চেপে ধরে, যেন কথা না বলি। শুনতে পাই কে বা কারা যেন এগিয়ে আসছে।
টুডু আমায় নিয়ে বসে পড়ে। ওর দুই হাতের মধ্যে আমার হাত। ফিসফিস করে বলছে, বলছিলাম না, প্রদীপ ঠিকই আমাদের পিছু নেবে!
আমিও ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করি, ওর উদ্দেশ্য কী?
আপনাকে আমি সঙ্গ দিচ্ছি এটা ও চায় না।
আরে, কে বা কারা ওর ভাইকে মেরেছে, তার জন্য আমাকে ও শত্রু ভাববে কেন?
শুধু সেজন্য না।
তবে?
বাপলা।
বা-প-লা? সেটা আবার কী?
এবার কিছুটা লজ্জা ফুটে ওঠে ওর ঠোঁটে। ও আমাকে বাপলা করতে চায়।
বাপলা মানে কি বিবাহ?
লজ্জা ঠেলে ওর কণ্ঠে এবার ক্রোধ জেগে ওঠে। না, আমি ওকে বিয়ে করতে চাই না। আমি পড়াশোনা করতে চাই।
বিয়ে করতে না চাইলে করবে না। ও তো তোমাকে জোর করে বিয়ে করতে পারবে না।
পারবে।
কীভাবে?
আমাদের সমাজে চার ধরনের বিবাহ পদ্ধতির প্রচলন আছে। এর মধ্যে একটি হলো ইত্তু বাপ্লা বা কৌশল বিবাহ।
সেটা কেমন?
কোনো সাঁওতাল যুবক যদি কোনো সাঁওতাল যুবতীর প্রেমে পড়ে, তাকে বিয়ে করতে চায়, কিন্তু যুবতী যদি রাজি না হয়, তখন যুবক ইত্তু বাপ্লা বেছে নেয়। সুযোগ বুঝে ছলে-বলে-কৌশলে যুবতীর কপালে সিঁদুর পরিয়ে দেয়। অবিবাহিত কন্যার কপালে একবার সিঁদুর এঁকে দিতে পারলে তাকে আর অন্যত্র পাত্রস্থ করা যায় না। এমন অবস্থায় যুবতীর পিতা গ্রামের মানঝি হাড়মের কাছে বিচার চায়। বিচারে যুবককে অপরাধী সাব্যস্ত করে অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। যুবক জরিমানা প্রদান করে এবং যুবতীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়।
তোমার পরিবারে আগেই জানাও। তারা আগে থেকেই ব্যবস্থা নিক।
আপ্পা-এংগা জানলে তো প্রদীপের সঙ্গে বাপলা দিতে আরো উঠেপড়ে লাগবে। টুডুর চোখ দিয়ে জল নেমে আসে।
কী করবে আর! সাবধানে থেকো।
যদি কোথাও চলে যেতে পারতাম! যদি আবার লেখাপড়া করতে পারতাম! দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে টুডু।
ওকে কোনো আশার বাণী শোনাতে পারি না আমি।
আমরা ভুট্টাক্ষেতের ভেতর থেকে বের হয়ে বিকল্প পথ ধরি। এ-পথে প্রদীপ আসবে না টুডু নিশ্চিত। সাঁওতালদের বিভিন্ন গোত্র, ভাষা, সমাজকাঠামো, পালা-পার্বণ, সোইরাই উৎসব, বাহা উৎসব, এরা উৎসব, লোক-বিশ্বাস ও সাহিত্য, মৃত ব্যক্তির সৎকার সবকিছু বলে যায় একে একে। এত সুন্দর ও সাবলীলভাবে ও বর্ণনা করে – ক্রমেই আমি অবাক হই।
টুডুকে বলি, তুমি তো আমার বন্ধু হয়ে গেলে।
খুশিতে ওর চোখ ছলছল করে ওঠে।
টুডু আমাকে ওদের বাড়ি নিয়ে আসে। ঘরের এককোণে রাখা বাঁশের তৈরি টুলের ওপর থেকে বই সরিয়ে আমায় বসতে দেয়। বই দুটো হাতে নিয়ে দেখি – বেগম রোকেয়ার অবরোধবাসিনী ও সুলতানার স্বপ্ন।
টুডু বলে, আমার একটা বাঙালি বন্ধু আছে, নাম মারিয়া, কলেজে পড়ে, ওদের ঘরে অনেক বই। বই দুটো ওর। মাঝে মাঝে ওর কাছ থেকে বই এনে পড়ি।
টুডুর মা-বাবাসহ সবার আন্তরিকতায় আমি মুগ্ধ হই। নিজেদের তৈরি বিশেষ পানীয় ‘হাঁড়িয়া’ খেতে দেয় আমায়। ঘরে মোবাইল নেই, তবু আমার নম্বরটা রেখে দেয় টুডু। পাকা রাস্তা পর্যন্ত ও আমাকে এগিয়ে দেয়। আমি একটা খালি টুকটুকি গাড়িতে উঠে হাত নাড়ি, চোখের আড়ালে না যাওয়া পর্যন্ত টুডুও হাত নাড়ে।
দু-মাস পরে ফোন এলো। প্রতিমা টুডুর ফোন! ও ফোন কিনেছে। অনেকক্ষণ ধরে কথা হলো আমাদের।
টুডু বলে, আপনাকে খুব মনে পড়ে! সিকাচিহ্নের মতো আপনার কথা আমার অন্তরে গেঁথে আছে।
আরো বলে, ওর বন্ধু মারিয়ার কাছ থেকে এনে আরো কিছু বই পড়েছে। জেনে খুশি হই আমি। কলেজে ভর্তি হওয়ার স্বপ্নটা এখনো মনের মধ্যে জিইয়ে রেখেছে। আমি ওর কাছে কিছু বই পাঠাতে চাইলে আনন্দে আত্মহারা হয়। মলিন মুখে কীভাবে হাসি ফুটে ওঠে তার প্রতিটি অনুরণন এ-প্রান্ত থেকে শুনতে পাই। কিন্তু ও কী ঠিকানা দেবে ভেবে পায় না।
আমি বলি, ঠিক আছে, পরে ফোন করে একটি ঠিকানা দিও।
টুডু বলে, আচ্ছা, রাখি।
টুডুর নম্বর থেকে আর ফোন আসে না। ওর ফোনের প্রতীক্ষায় থাকি – কিন্তু ফোন আসে না। অধৈর্য হয়ে নিজেই ফোন দিই। রিং বাজে না। ফোন দিই – রিং বাজে, রিসিভ হয় না। ফোন দিই, রিং বাজে, কেটে দেয়।
অতঃপর টুডুর নম্বরে যতবার ডায়াল করি, অপর প্রান্ত থেকে একটি পুরুষকণ্ঠ ভেসে আসে। কণ্ঠটি একদম প্রদীপ সরানের। হ্যালো শব্দ ছাড়া সাঁওতালি ভাষায় কী বলে কিছুই বুঝতে পারি না। প্রতিমা টুডুর নাম উল্লেখ করতেই উত্তেজিত হয়ে দ্রোহে বিষাক্ত কয়েকটি শব্দবাণ নিক্ষেপ করে লাইনটি কেটে দেয়।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.