প্রতিবারের মতো এবারো ট্রেন থেকে নেমে খানিকক্ষণ দাঁড়াল রানা। ধীরপায়ে রাস্তার মোড়ের বটগাছটার কাছে এলো। পাশেই রিকশাস্ট্যান্ড। রিকশাওয়ালাগুলি যাত্রী ধরার জন্য হুটোপাটি করছে। কেউ আবার তুমুল দরদাম জুড়েছে। ওদিকে তাকিয়ে রানা মনে মনে হাসল। পুরনো স্মৃতি ডানা ঝাপটাল। স্টেশন চত্বরজুড়ে সযত্নে লালিত নানা রঙের বোগেনভেলিয়া। গন্ধ নয়, রং ছড়াচ্ছে তারা। রং দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মনের গভীরে ইচ্ছে জাগায়, ছুঁয়ে দেখার। আর গন্ধ? সে তো মনপ্রাণ মোহিত করে রাখে। শুধু ছুঁয়েই মন ভরে না। লম্বা শ্বাস নিয়ে বুকের ভেতর ঢুকিয়ে নিতে সাধ জাগে।
রানার দিকে কেউ ফিরেও দেখছে না। সবাই এখন রানাকে চিনে গেছে। এক পা-দু পা করে রানা চায়ের ঘুমটিটার কাছে গেল। কিছু বলতে হলো না। রানাকে দেখে একগাল হেসে বুড়ো দোকানি বলল, ‘আবার এইয়ে পড়েছেন বাবু। বসেন, চা দিতাছি।’
বসার আগে হাত দিয়ে ভালো করে বেঞ্চের ধুলো ঝেড়ে নিল রানা। দোকানি তোবড়ানো গালে একমুখ হেসে বলল, ‘নোংরা নাই বাবু। এইমাত্র মুচছি।’
রানা আজ নিজের সবচেয়ে ভালো পোশাকটি পরে এসেছে। প্রতিবারই তাই করে। বুকের ভেতর চলছে তুমুল ঝড়। প্রতিবারই হয়। হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে। প্রতিবারই যায়। বারবার চোখ চলে যাচ্ছে দোকানের উল্টোদিকের রাস্তাটার দিকে। প্রতিবারই চোখ যায় সেই রাস্তায়; কিন্তু এবার মনের ভেতর দৃঢ় সঙ্কল্প। সত্যটা তাকে জানতেই হবে।
‘বাবু, আপনার চা।’
সম্বিত ফিরল রানার। মাটির ভাঁড়ে গরম ধোঁয়া-ওঠা চা নিয়ে এসেছে দোকানি। রানা চায়ের ভাড়টা নিল। পাশে রাখতে গিয়েও রাখল না। নিজের পরনের সাদা প্যান্টটার দিকে একবার তাকাল। অসাবধানে যেন তাতে দাগ না পড়ে। সতর্ক হলো। বিড়ি খাওয়া কালো, পুরু চামড়ার ঠোঁট ছোঁয়ালো মাটির ভাঁড়ে। গরম চা গলা দিয়ে নামতেই মনের ভেতরে উত্তেজনা আরো বেড়ে গেল। শরীরে একটা মৃদু শিহরণ। কানের কাছে সেই ফিসফিস আওয়াজ। কপালে বিন্দু বিন্দু স্বেদকণিকা ।
দুই
‘ও রানা, তাড়াতাড়ি ওঠ বাবা। বাজার যেতে হবে যে। এক্ষুনি রমারা চলে আসবে। দেরি করিস না। উঠে পড়।’
রোয়া-ওঠা কম্বলটাকে আরো নিবিড় করে আঁকড়ে ধরল রানা। সারা শরীরজুড়ে ক্লান্তি। বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। রোববার। সপ্তাহে এই একটিমাত্র ছুটির দিন।
‘কী রে, ওঠ।’ বলে রানার মা সুধাময়ী মশারির দড়ি খুলতে লাগল। রানার মনে মনে রাগ হলো। তার ইচ্ছে-অনিচ্ছের যেন কোনো দামই নেই এই বাড়িতে। অথচ তার উপার্জনেই এই সংসার চলছে। মনের রাগ মনেই থাকে রানার। কোনোদিনই তার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারে না। নিজের ক্লান্ত শরীরটাকে টেনে তুলল। পাশে রাখা চাদরটাকে গায়ে জড়িয়ে নিল। বিছানা থেকে নেমে এগিয়ে গেল ভাঙাচোরা শ্যাওলা-ওঠা বাথরুমটার দিকে।
হাতমুখ ধুয়ে ফিরতেই সুধাময়ী এক কাপ চা আর একটা বড় ফর্দ ধরিয়ে দিলো রানার হাতে।
চা মুখে দিতেই রানার মুখ কুঁচকে উঠল। ‘ইস, কী তেতো চা!’
‘কখন থেকে তোকে ডাকছি। লিকার চা বারবার গরম করলে তেতো হবে না তো কী হবে?’ সুধাময়ী বিরক্ত কণ্ঠে বলল।
‘লিকার চা করেছ কেন? সপ্তাহের এই একটা দিন তোমায় দুধ-চা করতে বলি, তাও পারো না?’
ছেলের কথায় সুধাময়ী ফোঁস করে উঠল। ‘দুধ বাড়িতে থাকলে তো দুধ-চা বানাব? দুধের প্যাকেট কবে এনেছিস মনে আছে? সংসারে দিস তো ওই কটা পয়সা। তাই দিয়ে কী করে যে সারা মাস চালাই তা একমাত্র আমিই জানি। তোর বাবা থাকতে তো ছয়জনের সংসার দিব্যি হাসিখুশি চলত। এখন মাত্র তিনজনের সংসার। তাই তুই চালাতে পারছিস না।’
রানা মনে মনে বলল, বাবা বেঁচে থাকতে যেন আমরা রাজা-মহারাজাদের মতো থাকতাম। তখনো তো নিত্যদিন অশান্তি লেগে থাকত।
নামে রানা হলেও রানা প্রতাপ সিংহের মতো ব্যক্তিত্ব বা বুকের পাটা কোনোটাই তার নেই। কারো মুখের ওপর উপযুক্ত জবাব সে দিতে পারে না। এক চুমুকে পুরো চা শেষ করল রানা। পাশে রাখা ফর্দটা হাতে তুলে নিল। নারকেল, খেজুরের গুড়, চালের গুঁড়ো, দুধের প্যাকেট, ছোট মাছ, বড় মাছ, সবজি।
এবার আর চুপ করে থাকতে পারল না। মাসের শেষে এমন রাজসিক ফর্দ দেখলে কার না মাথা গরম হয়! বিরক্ত কণ্ঠে বলল, ‘এতসব আনতে হবে? এই ফর্দ অনুযায়ী সব জিনিস আনতে কত টাকা লাগবে তুমি জানো? মাসের শেষ। পকেট এখন গড়ের মাঠ। এত কিছু আনতে পারব না।’
‘না আনলে কী করে হবে শুনি? রমা আর বিজন আসছে। সঙ্গে আসছে বিজনের বন্ধু। মিলিকে দেখতে। একটু ভালোমন্দ না করলে চলে?’
রানা, রমা, তুলি আর মিলি। চার ভাইবোন। রানাই বড়। বাবা একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করত। কোম্পানিতে কাজ করতে করতে অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। রানা তখন একুশ বছরের যুবক। বাবা মারা যেতেই পড়াশোনার পাট চুকে গেল। ওই কোম্পানিতেই একটা চাকরি দেওয়া হয় রানাকে। খুব সামান্য মাইনে। সেই থেকে সংসারী না হয়েও সংসারের জোয়াল বয়ে চলেছে। যেহেতু বাবার কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছে, তাই মা আর বোনেরা এমন ভাব করে যেন, এ-সংসারের সবার
সুখ-দুঃখ দেখার দায়িত্ব শুধু রানার। পান থেকে চুন খসলেই বোনেরা মুখ কালো করে বলে, ‘বাবা নেই, আমাদের কথা আর কে ভাববে।’
অথচ রানা ভেবেছিল, বড় বোনের বিয়ের পর মা তার বিয়ের কথা তুলবে। কিন্তু না। বড় বোনের বিয়ের পর মা মেজো বোনের বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লাগল। সেটা হতেই এখন ছোট বোন তুলির বিয়ের জন্য মায়ের যত চিন্তা।
মাঝে মাঝে রানার অস্তমিত যৌবন বিদ্রোহ করে ওঠে। শরীরী মন খোরাক চায়। শরীরের সঙ্গে মনের যুদ্ধ চলে। গভীর রাতে একলা বিছানায় ঘুম আসে না। ছটফট করতে করতে হেরে যাওয়া সৈনিকের মতো একসময় ক্লান্ত হয়ে হাত-পা ছেড়ে দেয় রানা।
তিন
‘এ সপ্তাহে তোমায় পুরুলিয়ায় যেতে হবে।’
অফিসের বড়বাবুর কথায় রানা চমকে উঠল। পুরুলিয়ায়! ওখানে তো এ-সময় ভীষণ ঠান্ডা!
অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে রানা বড়বাবুকে বলল, ‘স্যার আমাকে কলকাতার আশেপাশে কোথাও পাঠালে ভালো হয়। বুঝতেই পারছেন, বাড়িতে তো আমিই একমাত্র পুরুষ মানুষ।’
বড়বাবু একবার রানার চেহারার দিকে তাকাল। রানার দিকে কেউ তাকালেই রানা কেমন যেন কুঁকড়ে যায়। পাঁচ ফুট উচ্চতার পুরুষমানুষকে পুরুষ হিসেবে মান্যতা দিতে চায় না এ-সমাজ। যদিও ইতিহাস ঘেঁটে দেখলে দেখা যায়, নেপোলিয়ন থেকে শুরু করে শচীন তেন্ডুলকারসহ বহু সফল পুরুষই শরীরী উচ্চতায় নয়, তাঁদের কাজের উচ্চতায় আকাশ ছুঁয়েছিলেন। কিন্তু সে-কথা বলতে গিয়ে বহুবার হাসির খোরাক হয়েছে সে। বন্ধুরা তাকে ব্যঙ্গ করে ডাকে ‘রানা লিলিপুট’।
নিজের নামটা নিয়েও রানাকে বারবার অপ্রস্তুত হতে হয়। এমন কালো বেঁটে পকেট ফুটো ছেলের নাম কি না ‘রানা’। কেউ নাম জিজ্ঞেস করলে রানা তোতলে ওঠে। মেয়েদের থেকে শতহস্ত দূরে থাকে। তবু একসময় মনে হতো, মা হয়তো কিছু একটা ব্যবস্থা করবে; কিন্তু এই পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে এসে সে-আশাও আর নেই।
রানাদের কোম্পানিটা হলো প্রাইভেট ইন্স্যুরেন্সের কোম্পানি। বিভিন্ন জায়গায় সার্ভে করতে যেতে হয়। রানাকে সবসময় আন্ডার ডেভেলপড জায়গাতেই পাঠানো হয়। কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্তাদের ধারণা, রানার যেমন চেহারা তাতে এসব জায়গার লোকজন রানার কাছে প্রাণ খুলে কথা বলবে। খুব বেশি সুদর্শন ছেলের কাছে গ্রামের মানুষ মনের কথা বলতে দ্বিধা করে। কোন পুকুরে কী ধরনের ছিপ ফেলতে হয় তা কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা খুব ভালো করেই বোঝে।
সেবার কোম্পানি থেকে সার্ভে করতে এই স্টেশনেই নেমেছিল রানা। স্টেশনে নামতেই ঝুপ করে সন্ধে নেমে এসেছিল। শীতের বিকেল খুব তাড়াতাড়ি চুরি হয়ে যায়। সূয্যিমামা টা-টা বাই-বাই করতেই সন্ধ্যামাসি তার ভালোবাসার চাদর জড়িয়ে দেয়। স্টেশনে নামতেই কিছু রিকশাওয়ালা ছেঁকে ধরেছিল রানাকে। রানা আগে থেকেই খোঁজ নিয়ে এসেছিল। এখানে বেশি হোটেল নেই। স্টেশন থেকে পনেরো মিনিট হাঁটলেই একটা হোটেল আছে। সাধারণ মানের হোটেল। ফোনে কথা বলে নিয়েছে হোটেল ম্যানেজারের সঙ্গে। রানা ঠিক করেছে, রিকশা নেবে না। এটুকু পথ হেঁটেই চলে যাবে। কিন্তু রিকশাওয়ালাগুলি নাছোড়বান্দা। কিছুতেই ছাড়বে না। প্রথমে বলল তিরিশ টাকা। তারপর কুড়ি টাকা। রানা যত বলে ‘আমার রিকশা লাগবে না’। ওরা তত রানাকে বোঝায়, ‘অনেকটা দূর বাবু। রাস্তা ভালো নয়। অনেক জায়গায় তো আলোও নেই।’ একজন আবার বলল, ‘আমি আপনাকে কমেসমে নিয়ে যাব বাবু। পনেরো টাকা দেবেন।’
সে যেই এ-কথা বলেছে, পাশের রিকশাওয়ালাটা ছেলেটার সঙ্গে ঝগড়া শুরু করল। একজন ছেলেটার কলার চেপে ধরে মারমুখী হয়ে বলল, ‘কেন তুই এত কম পয়সায় নিয়ে যাবি বললি? তুই আমাদের ব্যবসা চৌপাট করে দিচ্ছিস। আজ শালা তোকে মেরেই ফেলব।’
অন্য রিকশাওয়ালাও রে রে করে তেড়ে এসেছে। অবস্থা বেগতিক দেখে রানা তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে রিকশাস্ট্যান্ড থেকে বেরিয়ে এলো। পেছনদিকে আর তাকাচ্ছে না। দ্রুত পায়ে এগিয়ে চলেছে। খানিকটা যাওয়ার পরই পেছন থেকে ক্যাঁচকোঁচ শব্দ। পেছন ফিরে রানা দেখল সেই ছেলেটা। ‘বাবু উঠে পড়ুন, আপনি পাঁচ টাকা দেবেন। সকাল থেকে দু-কাপ চা ছাড়া কিছু পেটে পড়েনি। চেপে পড়ুন বাবু।’
এবার রানার কেমন যেন মায়া হলো। আহারে, বেচারা। এত গালাগাল, মারধর খাওয়ার পরও চলে এসেছে। রানা উঠে পড়ল রিকশায়। দু-মিনিট যেতে না যেতেই হোটেল চলে এলো। রিকশা থেকে নেমে রানা পনেরো টাকাই দিলো ছেলেটাকে। ছেলেটা হাতজোড় করে মাথা নামিয়ে রানাকে বারবার নমস্কার করে চলে গেল। রানার মনের ভেতর অদ্ভুত এক আনন্দ হচ্ছে। কাউকে কিছু দিতে পারলে যেমন একটা হাওয়ায় ওড়া পেঁজা তুলোর মতো মিষ্টি মিষ্টি সন্তুষ্টিজনক আনন্দ হয়, ঠিক তেমন আনন্দ।
হোটেল ম্যানেজারের সঙ্গে নমস্কার বিনিময় করে রানা বলল, ‘আমি কাল ফোনে আপনার সঙ্গে কথা বলেছিলাম। ওই যে চারশো টাকার রুমটার কথা বলেছিলেন, ওটাতেই আমি থাকব।’
ম্যানেজার বলল, ‘ওটা এখন আর চারশো টাকায় আপনি পাবেন না। আপনাকে সাড়ে চারশো দিতে হবে।’
রানা রেগে গিয়ে বলল, ‘কাল রাতেই তো আপনি বললেন চারশো টাকা। একদিনে পঞ্চাশ টাকা বেড়ে গেল?’
‘আরে মশাই, একদিনে বাড়েনি। আপনি তো রিকশা করে এলেন। ওই রিকশাওয়ালাকে আমায় কমিশন দিতে হবে।’
রানা অবাক হয়ে বলল, ‘মানে?’
লোকটা রানার দিকে না তাকিয়ে হাতের মোবাইলে চোখ রেখে গম্ভীর মুখে বলল, ‘এখানে এটাই নিয়ম। ওদের কমিশন না দিলে আমরা ব্যবসা চালাতে পারব না। আমি তো আপনাকে বলেছিলাম হাঁটা-দূরত্বে। আপনিই তো বাবুগিরি করে রিকশা নিয়ে এসেছেন। এখন আর আমার কিছু করার নেই।’
এবার আর রাগ নয়। রানার ব্রহ্মতালু জ্বলতে শুরু করেছে। রিকশাওয়ালা ছেলেটা এত বোকা বানাল তাকে! ইচ্ছে করছে এক্ষুনি এই হোটেল থেকে বেরিয়ে যেতে; কিন্তু রানা শুনেছে এই অজজায়গায় হোটেল বেশি নেই। তার ওপর শীতের রাত, সারাদিনের ক্লান্তি। রানা একমুখ বিরক্তি নিয়ে হোটেলের খাতায় সই করল। একটা ছেলে রুমের চাবি রানার হাতে দিয়ে বলল, ‘রাতের খাবার লাগবে তো?’
বিরক্তি আর ক্লান্তিতে রানার
খিদে-তৃষ্ণা সব উবে গেছে। গম্ভীর হয়ে বলল, ‘কিচ্ছু লাগবে না।’
হোটেলের রুমে ঢুকে পরিষ্কার বিছানা দেখে মনটা খানিকটা শান্ত হলো। বাথরুমে গিয়ে তাড়াতাড়ি চোখে-মুখে জল দিলো। বিছানাটা অমোঘ আকর্ষণে টানছে। পেটে খিদেও আছে। এই সময় কম্বলের ভেতর বসে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা গরম চা খেতে মন চাইছে রানার। কিন্তু হোটেলের কারো সঙ্গে কথা বলতেই ইচ্ছে করছে না। ব্যাগের ভেতর দুটো কেক রাখা ছিল। সেগুলিই গোগ্রাসে খেল। খাটের পাশের টুলে জল রেখে গেছে হোটেলের ছেলেটা। ঢকঢক করে অনেকটা জল গলায় ঢালল। বেশ ঠান্ডা জল। কিন্তু এত তেষ্টা পেয়েছে যে, না খেয়ে পারল না। ঠান্ডা জল পেটে যেতেই সারা শরীর কেঁপে উঠল রানার। হি-হি করে কাঁপতে কাঁপতে লাইট অফ করে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল। সারাদিনের নোংরা জামা-কাপড়। এত সুন্দর পরিষ্কার বিছানা। রানা কম্বলের ভেতর থেকেই এক এক করে জামা-কাপড় খুলে দূরে রাখা প্লাস্টিকের চেয়ারটাতে ছুড়ে রাখল। শুয়ে পড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই কম্বলের ওমে আর সারাদিনের ক্লান্তিতে তার দু-চোখজুড়ে ঘুম নেমে এলো।
চার
মাঝরাতে রানার কেন যেন মনে হলো এই ঘরে অন্য কেউ আছে। এমনিতেই ভূত-প্রেতে খুব একটা বিশ্বাস নেই তার। কম্বলের ভেতর থেকেই রানা একটা নিশ্বাসের শব্দ পাচ্ছে। হাতে রেডিয়েটর লাগানো ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত তিনটে। তার মানে সকাল হতে আর দেরি নেই। কলকাতায় তো এইসময় থেকেই রাস্তায় লোকজনের চলাচল শুরু হয়ে যায়। নিশ্বাসের শব্দ শোনার জন্য কান খাড়া করল রানা। হ্যাঁ অন্য কেউ আছে এই ঘরে। চোর নয়তো! একইভাবে নিঃসাড় হয়ে শুয়ে থেকে দু-মিনিট ভাবল রানা। সন্ধেবেলায় হোটেল মালিকের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডার কথা মনে পড়েই মেজাজটা আবার খিঁচড়ে উঠল। এক ঝটকায় কম্বল থেকে হাত বের করে মাথার কাছের সুইচটা অন করল। এক ঝলক শ্বেতশুভ্র আলোতে সমস্ত ঘর জেগে উঠল। রানা ভালো করে কিছু দেখার আগেই কে যেন দৌড়ে এসে আলোটা নিভিয়ে দিলো। না, শুধু আলো নেভায়নি। সঙ্গে সঙ্গে জ্বালিয়ে দিয়েছে নীলাভ নাইট ল্যাম্প। সেই হালকা নীল আলোয় রানা দেখল একটা নারীমূর্তি। দু-হাত জোড় করে মেয়েটা ফিসফিস করে বলছে – ‘দয়া করে আলো জ্বলাবেন না। আমাকে বাঁচান।’
রানা কী করবে বুঝতে পারছে না। ঘটনার আকস্মিকতায় ওর মাথা কাজ করছে না। কম্বল ছেড়ে বের হতে গিয়েই খেয়াল হলো জন্মমুহূর্তের পোশাকে রয়েছে সে। মেয়েটার দিকে ভালো করে তাকাতেই রানা দেখল, রানার ছুড়ে ফেলা জামাটা গায়ে দিয়ে আছে মেয়েটা। রানাকে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেয়েটা বলল, ‘এটা এখানে ছিল। খুব ঠান্ডা লাগছিল, তাই পরে ফেলেছি।’
রানা দেখল, শুধু জামা নয়। মেয়েটা রানার প্যান্টটাও পরে নিয়েছে।
‘একটু খাটে বসব। মেঝেতে খুব ঠান্ডা লাগছে।’
রানা কম্বলটায় নিজেকে জড়িয়ে একটু সরে বসল। মেয়েটা রানার পায়ের দিকে জড়সড় হয়ে বসে পড়ল।
আপনি কে? কথাটা জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে রানা বুঝতে পারল, গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না। একবার গলা খাঁকারি দেওয়ার চেষ্টা করতে মেয়েটা বলল, ‘আস্তে। ওরা শুনতে পাবে। আমি ছায়া। এই হোটেলে কাজ দেওয়ার নাম করে পাড়ার এক কাকু আমায় দুদিন আগে নিয়ে আসে। ঠিকই ছিলাম। সারাদিন। হাউস কিপিংয়ের কাজ করতাম। এক বুড়ি মাসিমা আমায় কী কী কাজ করতে হবে বুঝিয়ে দিয়েছিল। রাতে ওই মাসিমার কাছেই শুয়েছিলাম। ঘুমিয়েও পড়েছিলাম। হঠাৎ কিসের যেন আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায়। চোখ মেলে দেখি দুটো ধুমসোমতো লোক আমার বিছানায়। মাসিমাও ঘরে নেই। বিপদ বুঝে এক ঝটকায় বিছানা থেকে নেমেই দৌড় লাগাই। হোটেলের সব দরজায় ধাক্কা দিচ্ছিলাম। আপনার দরজায় ধাক্কা দিতেই দেখলাম খুলে গেল। ঢুকেই ছিটকিনি দিয়ে দিয়েছি। লোক দুটো বাইরে আমায় খোঁজাখুঁজি করছে। দয়া করে আমায় বের করে দেবেন না।’
নীলাভ আলোটা এখন অনেকটা চোখ সওয়া হয়ে গেছে রানার। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে সে বুঝল, মেয়েটা যুবতী। কথাবার্তা শুনে খুব একটা গ্রাম্য বলে মনে হলো না। তবে এখন সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে গ্রাম আর শহরের মেয়েদের আলাদা করা যায় না। মেয়েটার কপালে একটা চকমকে টিপ। মেয়েটা কি বিবাহিত?
প্রথমে মেয়েটা আড়ষ্ট হয়ে বিছানায় বসলেও এখন আস্তে আস্তে কম্বলের ভেতর পা ঢোকানোর চেষ্টা করছে। বাইরে খুব ঠান্ডা। রানা নিজের নাক দিয়ে সেটা বুঝতে পারছে। নাকের ডগায় যেন কোনো সাড় নেই। মেয়েটি আবার বলল, ‘ভোর হতেই আমি চলে যাব। কেউ জানতে পারবে না। শুধু এই রাতটুকু।’
একটা যুবতী মেয়ে, একই কম্বলের নিচে। জীবনে এমন অনুভূতি এই প্রথম। মিষ্টি একটা সুবাসে রানার সারা শরীর রিমঝিম করছে। খুব ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করে যে, তার বাড়ি কোথায়? কিন্তু রানা দেখল, মেয়েটা গুটিসুটি মেরে পায়ের দিকে শুয়ে পড়েছে। রানা কী করবে বুঝতে পারছে না। শরীরের ঠান্ডা ভাবটা কেমন যেন কেটে যাচ্ছে। একটু একটু করে গরম হয়ে উঠছে শরীর। একটা মেয়ে এত কাছে থাকলে এমন সুখানুভূতি হয় রানা আজ প্রথম অনুভব করল। যতই নিজের মনকে বোঝাচ্ছে মেয়েটার দিকে তাকাবে না, ততই চোখ চলে যাচ্ছে সেদিকে। রানার দিকে পেছন ফিরে শুয়ে আছে মেয়েটা। মেয়েটাকে না ছুঁয়েও মনে হচ্ছে গোলাপের মতো নরম হবে মেয়েটার গালদুটো। এ এক অভূতপূর্ব অনুভব। জামাটা নয়, রানা যেন নিজেই লেপ্টে আছে মেয়েটার শরীরে। ছায়া একটু নড়েচড়ে উঠল। আহা! ঠান্ডায় কুঁকড়ে আছে। রানা পায়ের দিকের কম্বলটা ঠেলে দিলো। পা বেয়ে একটা উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছে রানার সারা শরীরে। অদ্ভুত এক ভালোলাগায় চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। অনেক অনেক না বলা কথা বলতে ইচ্ছে করছে আজ। কতদিন বাড়ির পাশের আমগাছে দুটো শালিককে পাশাপাশি বসে থাকতে দেখে রানা ভেবেছে, ওরা কোনো কথা না বলে চুপচাপ বসে থাকে কেন! আজ রানা বুঝতে পারছে। কথা নয়, শুধু পাশাপাশি বসাতেও অনেক কিছু পাওয়া যায়। একজনের নিশ্বাসের শব্দ অন্যজনের বুকে সুর তোলে। নিশ^াসের গরম হাওয়া অন্যকে উত্তপ্ত করে তোলে। আবেশে রানার দু-চোখ বুজে আসে। প্রজাপতির মতো ভেসে চলে এক মেঘমুলুক থেকে অন্য মেঘমুলুকে ঘুরে বেড়ায় রানা। তার শরীর আশ্লেষে অবশ হয়ে আসে।
হঠাৎ দরজায় ধুপ ধুপ আওয়াজ। কারা যেন ধাক্কা দিচ্ছে। না, রানা কিছুতেই ছায়াকে ওই রাক্ষসগুলির হাতে ছেড়ে দেবে না। কিছুতেই না। আবার দরজায় ধাক্কা। রানা উঠে আলো জ্বালাতে যাবে, দেখল সারা ঘর রোদের আলোয় ঝলমল করছে। আরে সকাল হয়ে গেছে। ছায়া কোথায় গেল? এই তো একটু আগেই এখানে শুয়ে ছিল! না কোথাও নেই। চেয়ারের ওপর তার জামা-প্যান্ট পড়ে আছে। বাইরে থেকে আবার দরজায় ধাক্কা। রানা কম্বল জড়িয়ে বিছানা থেকে নেমে একবার বাথরুমে উঁকি দিলো। না, সেখানেও কেউ নেই। এবার রানার ভয় করতে লাগল। বাইরে অনেক লোকের গলার আওয়াজ। রানা কী করবে বুঝতে পারছে না। দরজার আওয়াজ উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। কম্বল জড়িয়েই রানা ভয়ে ভয়ে দরজা খুলল। দরজা খুলতেই দেখল, হোটেল ম্যানেজার উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তার সঙ্গে আরো বেশ কয়েকজন।
‘কী মশাই? ঠিক আছেন তো?’
রানা আমতা আমতা করে বলল, ‘হ্যাঁ, মানে কী হয়েছে?’
‘আরে, ঘড়িতে কটা বাজে দেখেছেন? সাড়ে দশটা বাজে। চেক আউট করার সময় হয়ে গেছে। হোটেলের ছেলেরা দুবার এসে নক করে গেছে। আপনার মোবাইলে ফোন করছি, সেটাও সুইচড অফ বলছে। এই রুমের অন্য কাস্টমার চলে এসেছে। আপনাকে এক্ষুনি রুম খালি করতে হবে। বলিহারি ঘুম মশাই আপনার। সবাইকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন।’
হোটেল ম্যানেজারের কথায় সবাই হেসে উঠল। আশেপাশের রুম থেকে যারা উঁকিঝুঁকি মারছিল তারা কেউ কেউ হাসিতে যোগ দিলো। কেউ আবার বিরক্ত হয়ে জোর আওয়াজ করে দরজা বন্ধ করল।
রানা একটু ধাতস্থ হয়ে বলল, ‘পাঁচ মিনিটে আমি বেরিয়ে আসছি।’
এবার ম্যানেজার গম্ভীর হয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি করুন। তা না হলে আজকের রুমের চার্জ আপনাকে দিতে হবে।’
রানা দরজা বন্ধ করে ভেতরে এলো। এখন আর কিছু ভাবতে পারছে না। বাথরুমে ঢুকে তাড়াহুড়ো করে মুখে-চোখে জল দিলো। জামা-প্যান্ট পরল। যতই তাড়াহুড়ো করুক, মন কিন্তু খুঁজে যাচ্ছে রাতের ছায়াকে। কোথায় গেল মেয়েটা?
হোটেলের রুম থেকে বের হওয়ার আগে আর একবার বাথরুমে ঢুকল। আর ঢুকেই চমকে উঠল। আরে এটা কী?
আবার দরজায় কলিংবেলের আওয়াজ। রানা তাড়াতাড়ি জিনিসটা পকেটে নিয়ে বেরিয়ে এলো।
হোটেলের কাউন্টারে এসে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে রানা। যদি কোথাও ছায়াকে দেখা যায়। ও কি এই হোটেলেই আছে? নাকি এখান থেকে পালিয়ে যেতে পেরেছে? কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করা কি ঠিক হবে? কাকে জিজ্ঞাসা করা যায়?
রানাকে এদিক-ওদিক তাকাতে দেখে ম্যানেজার জিজ্ঞাসা করল, ‘কাকে খুঁজছেন মশাই?’
রানা অপ্রস্তুত হয়ে বলল, ‘না, তেমন কিছু নয়।’ তারপর গলা একটু নিচু করে বলল, ‘কাল রাতে হোটেলে কিছু হয়েছিল কি?’
ম্যানেজার একটু বাঁকা হেসে বলল, ‘হোটেলে কিছু হয়নি। তবে আপনার রুমে যে অনেক কিছু হয়েছিল তা আপনার সকালে কম্বল জড়ানো দেখেই বুঝেছি।’
রিসেপশনে অন্য আরো অনেক কাস্টমার ভিড় করেছে। এখন চেক আউটের সময়। রানা তাড়াতাড়ি হোটেল থেকে বেরিয়ে এলো।
পাঁচ
সমস্ত রাস্তা দু-পা হাঁটছে তো তিন পা পিছোচ্ছে রানা। বারবার ফিরে যাচ্ছে রাতের সেই মুহূর্তগুলিতে। মাথার মধ্যে ঘটনাগুলি ঘুরপাক খাচ্ছে। দুবার দুটো সাইকেলের সঙ্গে ধাক্কা খেতে খেতে বাঁচল। একজন তো মাতাল ভেবে গালাগাল দিয়ে বলল, ‘সকাল থেকেই চড়িয়ে বসে আছ বাবা?’
বাড়ি ফিরেও রানা কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে রইল। চলতে-ফিরতে, খেতে-ঘুমোতে খালি মনে পড়ছে ছায়ার কথা। কাউকে বলবে না, বলবে না করেও এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে বলেই ফেলল সব কথা। বন্ধুটি সব কথা শুনে গালাগাল দিয়ে বলল, ‘শালা কম্বলের নিচে ন্যাংটো হয়ে শুলে অমন অনেক ছায়াই স্বপ্নে আসে। ছায়া নয়, ওটা মোহিনী মায়া ছিল বাছাধন। কতবার বলেছি, বিয়ে হয়নি তো কী হয়েছে, আমার সঙ্গে বেপাড়ায় চল। শরীরের ক্ষিধে মেটা। তা নয়, উনি সতী-সাধ্বী পুরুষ হয়ে থাকবেন।’
রানা নিজেও বারবার মনকে বুঝিয়েছে, সত্যিই হয়তো সে স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু তার বুকপকেটে রাখা সেই কাচপোকার মতো চকচকে টিপটা! যখনই গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যায় রানার তখনই কাগজে মোড়া সেই টিপটা তাকে যেন কাছে ডাকে। কতদিন নাইট ল্যাম্পের আবছা আলোয় চকচকে টিপটার দিকে তাকিয়ে থেকেছে রানা। আঙুলের আলতো ছোঁয়ায় অনুভব করতে চেয়েছে সেই রাতের উষ্ণতা। নিজের অবাধ্য মনকে বোঝাতে বোঝাতে দিন মাস বছর কেটে গেছে। তবু এই মনপাখি বোঝে না। যখনই একা হয়েছে, মনে মনে কাউকে কাছে পেতে চেয়েছে, তখনই ছায়ার কথা মনে পড়েছে। কয়েকশো মাইল অতিক্রম করে বারবার ছুটে এসেছে এই প্রান্তিক শহরে। বুকে আশা নিয়ে বসে থেকেছে চায়ের দোকানে। কয়েক মিনিটের হাঁটাপথ পার হলেই সেই হোটেলটা। কিন্তু এইটুকু পথ কিছুতেই পার হতে পারেনি। আজ রানা মনে মনে সংকল্প করে এসেছে। যেভাবেই হোক সত্যটা আজ সে জানবেই। রানা আড়চোখে একবার চায়ের দোকানের কাস্টমারদের দিকে তাকাল। না, কেউ তাকাচ্ছে না তার দিকে। সকলের অগোচরে নিজের বুকপকেটে হাত দিতেই কে যেন কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, ‘বাইরে খুব ঠান্ডা। আপনার পাশে একটু বসব?’ রানার বুকের রক্ত ছলাৎ করে উঠল। শরীরের প্রতিটি শিরায় শিরায় যেন টগবগ করে একটা ঘোড়া ছুটে চলছে। বুক ভরে শ্বাস নিল রানা। তার সেই সুগভীর শ্বাসে জড়িয়ে আছে হারিয়ে যাওয়া একটি রাতের বর্ণ-গন্ধ-আবেশ। বুকের ভেতর দ্রিমি দ্রিমি মাদলের আওয়াজ। হোটেলের দিকে পা বাড়াতে গিয়ে রানা থমকাল। তারপর মুচকি হেসে এগিয়ে চলল স্টেশনের দিকে।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.