স্বপ্নবাজ – এই শব্দের সঙ্গে কি আগে কখনো পরিচয় ছিল আমাদের?
বাংলাভাষী আমরা স্বপ্নদেখা মানুষদের এতদিন চিনতাম স্বপ্নদ্রষ্টা, স্বপ্নাবিষ্ট, স্বপ্নময়ী, স্বাপ্নিক – এরকম শব্দের রকমফেরে। কিন্ত্ত বিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষদিকে এসে একটি শব্দের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে বাংলাভাষায়। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে তা তরুণদের কাছে খুবই পরিচিত আর প্রিয় হয়ে উঠেছে।
স্বপ্নবাজ হলো সেই শব্দ। স্বপ্নময় হয়ে ওঠা তরুণদের প্রিয় শব্দ। নিজেদের তারা স্বপ্নবাজ ভাবতে ভালোবাসে।
যাঁরা এই শব্দকে বাজারে এনে তুলেছেন, এ শব্দের বিকিকিনি করছেন, সেইসব সাহিত্যিক, শিল্পী কিংবা নাট্যজনের নাক নিশ্চয়ই বেশ খানিকটা উঁচু হয়েছে। একটা আহা-মরি তেলতেলে ভাবও জমেছে চোখেমুখে। ্লদিলাম একটাশ্- জাতীয় পরিতৃপ্তি তাঁদের উঁচু নাকের ডগায়। কিন্ত্ত নাক উঁচু হয়, নাক বড় হয়, রূপকথার সেই মিথ্যাবাদী বালকের। সে যত মিথ্যা বলে, ততই নাক তার বাড়তে থাকে একটু একটু করে।
আমাদের স্বপ্নের ফেরিওয়ালারা সেই মিথ্যাকে ফেরি করছেন। স্বপ্ন দেখাচ্ছেন, স্বপ্ন কেড়ে নিচ্ছেন। যতই দেখাচ্ছেন ততই নাক বড় হচ্ছে। চাঁদাবাজ চাঁদাবাজি করে, স্বপ্নবাজ স্বপ্নবাজি করে। দুয়ের মধ্যে খুব বেশি হেরফের নেই। হেরফের তৈরি হয়েছে শব্দের ফেরিওয়ালাদের গুণে। তারুণ্য তাই একবিংশ শতাব্দীতে স্বপ্নদ্রষ্টা নয়, স্বাপ্নিক নয় – নিছক এক স্বপ্নবাজে পরিণত হয়েছে; তবে তারা ভাবছে স্বপ্নবাজ হওয়ার মানে খুবই ভালো, খুবই ইতিবাচক; স্বপ্নবাজ হওয়া কি মুখের কথা?
দুই
এই স্বপ্নবাজ তারুণ্য কীভাবে দেখে এ-সমাজের বৈভিন্ন্যময় বাঙালিয়ানাকে? তার স্বপ্নের কত কাছে, কত দূরে বাংলাদেশ ও বাঙালিয়ানা?
শব্দ দিয়েই শুরু করা যাক। তারুণ্য কোনো না কোনোভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংলগ্ন। কিন্ত্ত ছাত্র বা ছাত্রীর চেয়ে ্লস্টুডেন্টশ্ শব্দটি তাদের কাছে অনেক বেশি প্রিয়। কেননা এতে লৈঙ্গিক অবস্থান অনুক্ত থাকে। বাংলায় ছাত্র বা ছাত্রী বললেই নাকি কেমন এক ছেলে-ছেলে মেয়ে-মেয়ে ঘ্রাণ ভেসে আসে তাদের অনেকের কাছে। একই কারণে অনেক বেশি গ্রহণীয় প্রেসিডেন্ট, এডিটর ইত্যাদি শব্দ। কেননা বাংলা শব্দ সভাপতি বা সভানেত্রী, সম্পাদক বা সম্পাদিকা ইত্যাদিতে জেন্ডার-বৈষম্যই প্রকট হয়ে ওঠে বলে মনে করে তারা। এদের একজনকে বলেছিলাম, কিন্ত্ত ওরা তো ্লহিশ্, ্লসিশ্, ্লহারশ্ শব্দ দিয়ে আগাপাশতলা জেন্ডার-বৈষম্য তৈরি করে রেখেছে। সে-তুলনায় তো
বাংলা অনেক সমৃদ্ধ। বাংলায় নারীপুরুষ-নির্বিশেষে সবার ক্ষেত্রেই সে এবং তার শব্দ প্রয়োগ করা হয়। বাংলাভাষা তো এসব শব্দব্যবহারের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিকে জেন্ডার-বৈষম্য থেকে পুরোপুরি মুক্ত করে দিয়েছে ( ব্যাকরণগত অর্থের)। আর ইংরেজি ভাষা ব্যক্তিকে জেন্ডার-বৈষম্যে আকীর্ণ করেছে। তাছাড়া ্লস্টুডেন্টশ্ শব্দের কথাই চিন্তা করা যাক। তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র, দাতা-দেশ ও গোষ্ঠীসমূহের কল্যাণে জেন্ডার-গবেষণার উর্বর ক্ষেত্র নারীশিক্ষা এখানে এখনো প্রবল প্রতিবন্ধকতার শিকার। শিক্ষাক্ষেত্রে জেন্ডার-বৈষম্য একেবারে মাইক্রো-লেভেল থেকে দেখার জন্যে তাই শিক্ষার্থীদের ছাত্র আর ছাত্রীতে ভাগ করার মধ্য দিয়ে বরং অনেক আগেই বাংলাভাষা নিজেকে আরো সমৃদ্ধ করেছে। নারী-পুরুষের সমানুপাতিক বিশ্লেষণের জন্যে সামাজিক বিজ্ঞানের পদ্ধতিগত দিক থেকে চিন্তা করতে গেলে এসব শব্দ বরং গবেষণার পরিধি অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। শব্দের অস্তিত্বই হয়ে উঠেছে গবেষণার একটি বড় সূত্র। ইংরেজি ভাষাভাষীরা তো সম্বোধনের রীতি কেবল ্লইউশ্তে সীমিত করার মধ্য দিয়ে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের মনস্তাত্ত্বিক দিককে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে। আর আমরা বাঙালিরা ্লআপনি, তুমি, তুই, তোর, তোমার, আপনারশ্ বলার মধ্য দিয়ে চমৎকার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাত্রা তৈরি করেছি। ফরাসিরা তো টেবিল-চেয়ার, কালি-কলমকেও নারী-পুরুষ বানায়। অথচ সেই ফরাসি ভাষা শেখার জন্যে তোমরা ছুটোছুটি কর। কেননা তা নাহলে ইউরোপের দরজা তোমাদের জন্যে বন্ধ হয়ে থাকবে। তা হলে?
এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। অবশ্য একটা গৎবাঁধা উত্তর রয়েছে – ্লএগুলো ব্যতিক্রমশ্।
ব্যতিক্রম – এই শব্দটি খুবই গুরুত্বপুর্ণ আজকের তারুণ্যের তন্ত্রীতে অনুরণিত সুর শুনবার জন্যে। এই তারুণ্য বিশেষত পাশ্চাত্যের সব ব্যতিক্রম, সব পিকিউলিয়ারিটি মেনে নিতে রাজি। কিন্ত্ত বাংলা ভাষার, বাঙালির ব্যতিক্রম আর পিকিউলিয়ারিটি মানতে একদম রাজি নয়। বাংলাভাষার ই আর ঈ, উ আর ঊ ভয়ানক বিরক্তিকর তাদের কাছে। এত নিয়ম মেনে বানান লেখা তাদের ধাতে সয় না। কিন্ত্ত ইংরেজি ভাষায় ই আর আই নিয়ে সারাদিন হয়রান হতে তাদের একটুও বাধে না। কী দরকার স-এর আগে পি বসিয়ে সাইকোলজি লেখার, সাইকোলোজি ঠিকই আছে। নিজের ভাষায় অধৈর্য ভীষণরকম আর অপর ভাষায় খুবই একাগ্র।
বোধহয় ছোট্ট এসব ঘটনা থেকেই মেপে ফেলা যায় এই তারুণ্যের গন্তব্য। প্রতিষ্ঠা, কেরিয়ার গড়ে তোলা, বিদেশের নির্ঝঞ্ঝাট জীবনযাপন, রোমান্টিক প্রেম ও যৌনতা – গন্তব্য কিংবা পরিধি তার এইটুকুই। নির্দোষ এই চাওয়া সম্পর্কে আপত্তি করার মতো কেউ রয়েছেন বলে মনে হয় না। তাছাড়া এমন নয়, এসব আকাঙ্ক্ষা আগে ছিল না। আগেও ছিল। কিন্ত্ত আপত্তির জায়গা এবং সমালোচনার পরিধি তৈরি হয়েছে সেই আগের আর এই এখনকার চাওয়াগুলো অর্জনের ধরন-ধারণ থেকে। আগে এসব আকাঙ্ক্ষা ছিল ্লআর সবকিছুশ্র সঙ্গে মিলেমিশে। কখনো তা সেই ্লআর সবকিছুশ্কে উপচে ওঠেনি। এইসব ্লআর সবশ্ মানে সমাজ আর পরিবার, দেশ আর সংগঠন, প্রতিবেশ আর পারিপাশির্বকতা, ব্যক্তিত্ব আর সমষ্টি। সে-জন্যেই তারুণ্য তখন নিজেকে নিয়ে কোনো সংগোপন স্বপ্নের ঘোড়সওয়ার হলেও নিজের অজান্তেই নিজের পাশে বসিয়ে নিতো চারপাশের মানুষ আর লোকালয়কে।
কিন্ত্ত এখন তারুণ্যকে আচ্ছন্ন করে রাখে সমষ্টি নয়, ব্যক্তি- নিছক এক ব্যক্তির সত্তা। ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠার প্রত্র্কিয়া থেকে বেরিয়ে এসেছে সে। তার প্রাণপণ প্রচেষ্টা সফল ব্যক্তি হয়ে ওঠার । গড়পড়তা মিডিওকারের খাতায় নাম লিখিয়ে সফলতা পাওয়ার জন্যে হামলে পড়েছে সে। রাষ্ট্রের কোনো অবকাঠামো এ ধরনের প্রতিষ্ঠা অর্জনের পথে যথেষ্ট হলেও, বিদেশ যাওয়াকেই যথাযথ মনে করে তারা। আরো যথাযথ মনে করে বিদেশেই রয়ে যাওয়াকে। কমিটেড কেউ দেশে ফিরে এলে তাকে নিয়ে আলোচনা হয়, সমীহের চোখে দেখা হয়, সরল বা ভালো মানুষ-জাতীয় বিশেষণে ডুবিয়ে দেওয়া হয়; কিন্ত্ত তাকে সামাজিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না, পথিকৃতের খাতায় তার নাম আসে না, তাকে এড়িয়ে চলা হয়, অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারে বসিয়ে দেওয়া হয়। এবং আড়ালে-আবডালে বলাবলি করা হয়, লোকটা আসলে বোকা। আঁতেল শব্দটি এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত বেশ ব্যবহার করতো তরুণরা। পড়ুয়া হলেই সে তরুণ বা তরুণীর গায়ে ছাপ মারা হতো আঁতেলের। কিন্ত্ত এই শব্দের ব্যবহার এখন একেবারেই কমে গেছে। আগের মতোই তাদের অনেকের হাতে থাকে মোটা মোটা বই, অনেকেই ভার্সিটির মাঠের মধ্যে গোল হয়ে বসে পড়াশুনো করে নিজেরা মিলে, কিন্ত সেসব বইয়ে আর পড়াশুনায় এমন কোনো কিছু থাকে না যে আঁতেল বলে উত্ত্যক্ত করা যাবে। মনোযোগী ছাত্ররা জানে, বি সি এস পরীক্ষার রেজাল্ট-শিটে নাম রাখার জন্যে অনেক শিক্ষার্থীই এখন মধুর ক্যান্টিনে ভিড় করে। অতএব প্রশাসন বা সরকারি কর্মকমিশনে যোগ দেয়ার আশা তারা বাদ দিয়েছে ভার্সিটি পার হওয়ার অনেক আগেই। বিদেশে যাওয়ার গড়প্রবণতা ভয়াবহ রকম ঊধর্বমুখী। পঞ্চাশ, ষাট এমনকি সত্তরের তারুণ্য দেশের বাইরে যেতো উচ্চশিক্ষার দীক্ষা নিয়ে প্রত্যাবর্তনের প্রত্যয় নিয়ে। এখন উচ্চশিক্ষা তো দূরের কথা, ওয়ার্কশপ বাগাতে পারলেই নিজেকে ধন্য মনে করে সে। কেননা ওয়ার্কশপে ভর করেই নিজেকে বিদেশে পাচার করার স্বপ্ন দেখে সে। সারাদিন আমেরিকা কিংবা পাশ্চাত্যকে গালিগালাজ করা তরুণটির হাতে ইমিগ্রেশন ধরিয়ে দিন, না-নেয়ার মতো তরুণ খুঁজে পাওয়া খুব কঠিনই হবে। এদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও তারুণ্যের একটি বড় অংশ চলে যাচ্ছে বিদেশের দিকে। এদের লক্ষ্য আমেরিকা, যুক্তরাজ্য আর কানাডা, নিদেনপক্ষে অস্ট্রেলিয়া। একটি সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, প্রতি বছর প্রায় দু হাজার উচ্চশিক্ষিত তরুণ আর তরুণী সীমান্ত আর আকাশ পাড়ি দিচ্ছে। বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সি এস ই) বিভাগ থেকেই নাকি প্রতি বছর ২৫/৩০ জন ছাত্রছাত্রী প্রকৌশলী আর প্রোগ্রামার হওয়ার পরে চলে যায় বিদেশে। আজকাল গড়ে উঠেছে এমন অনেক প্রতিষ্ঠান যারা বিভিন্ন ধরনের সহায়তা দিচ্ছে বিদেশগামী ছাত্রছাত্রীদের। এসব প্রতিষ্ঠানের কাজই হলো পরামর্শ দেয়া, ভিসা পেতে সাহায্য করা, তহবিল পাওয়ার পথ দেখিয়ে দেয়া। এদের কাছ থেকে পাওয়া বিভিন্ন তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, ব্রেইন ড্রেইনের তালিকার শীর্ষে রয়েছে বাণিজ্যসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারীরা। বিদেশগামী সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারীদের শতকরা ৭০ জনই নাকি এই ফ্যাকাল্টির। আর শতকরা ৩০ ভাগ বিজ্ঞান ফ্যাকাল্টির ডিগ্রিধারী কিংবা পেশাজীবী। তারা কি ফিরে আসবে? জানা নেই আমাদের। যেমন জানা নেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। বিদেশে পড়তে গেলে অনেক দেশের দূতাবাসে এখন আর এন ও সি (নো অবজেকশন সার্টিফিকেট) জমা দিতে হয় না। কোনো কোনো দেশের দূতাবাস এখনো এন ও সি চায়। এই পরিস্থিতিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঠিকঠাক বলতেও পারে না, লেখাপড়া করতে কতজন শিক্ষার্থী বিদেশ গেছে। তবে এন ও সি নিয়েছে এমন শিক্ষার্থীর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই বিদেশ যায় আরো উচ্চশিক্ষা নিতে।
যায়, তবে ফিরে আসে কী না সন্দেহ। স্টুডেন্ট ভিসার কাউন্সেলিং করে এরকম প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি না বললেও ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে যা বলে, তাতে তো তা-ই মনে হয়। তাছাড়া কিছু না বললেও তো বুঝে নেয়া যায় অনেক কিছু। সংবাদপত্রের এক রিপোর্টারের সঙ্গে কথা বলেছে এরকম একটি প্রতিষ্ঠান নোবেল অ্যাসোসিয়েট এজেন্সি। তাদের মাধ্যমে নাকি শুধু স্টুডেন্ট ভিসা নিয়েই বাইরে পাড়ি জমায় বছরে ৯০ থেকে ১০০ জন মাস্টার্স ডিগ্রিধারী। সি এ এস সি নামের এজেন্সির রেকর্ডে এদের সংখ্যা আরো বেশি, ১৫০ জন। এ তো কেবল দুটি এজেন্সি। এরকম এজেন্সি আছে দেশে কম করে হলেও ২৫। একটা গড় করুন নিজে নিজেই, দেখুন কতজন যাচ্ছে, কতজন আর দেশে ফেরার স্বপ্ন রাখে না। শুনে চমকে উঠতে হয়। এরা আর ফিরবে না। এরা আর কোনো দিন মানচিত্রের নিচে দাঁড়িয়ে গান গাইবে না, শুনবে না ্লআমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসিশ্। কেউ বলেন, কাজের জায়গা বের করে দাও, দেখবে, এরা দেশেই থিতু হয়ে বসেছে। আর যারা গেছে তারা ফিরবে কেন? বিদেশে লেখাপড়া করতে গিয়ে যত টাকা ইনভেস্ট করতে হয়, দেশে ফিরে তার কানাকড়িও তোলা যায় না, বেতন এখানে এতই সামান্য। আইটিতে ডিপ্লোমা-করা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এই অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। তাদের মতে, একজন প্রোগ্রামারের বেতন হওয়া উচিত কমপক্ষে ৩০ থেকে ৪০ হাজার। অথচ এই মরার দেশে বেতন পাওয়া যায় টেনেটুনে ৮ হাজারের মতো। তাও কাজের স্থায়িত্ব নেই। কেউ বলে, দেশের আইন-শৃঙ্খলার যা দশা হয়েছে তাতে কি আর দেশ বাসযোগ্য আছে?
একজন গল্প করে, তার এক কমবয়সী ভাগ্নে আছে, বাইরে লেখাপড়া করে দেশে এসে হোটেল আর ইন্টেরিওয়র ডেকোরেশনের দোকান দিয়েছিল। সে তো আর জানে না এ দেশের হিসাবকিতাব। ওয়াসার লোক এসে টাকা চায়, গ্যাসের লোক এসে টাকা চায়, ইলেকট্রিসিটির লোক এসে ্ললামসামশ্ চায়। নিরীহ সে বেচারি বলে, লামসাম দেবো কেন? যা বিল আসে সেটাই দেবো। এক মাস পরেই বিল আসে তার। কোনোটা ষাট হাজার, কোনোটা সত্তর, কোনোটা বাষট্টি। আয় বাবা, তোর ন্যায়নিষ্ঠ বিলের নিকুচি করি। সে বেচারা বিল দেখে দোকানপাট গুটিয়ে ফের চলে গেছে বিদেশে। যাবে না কেন, যেখানে পরিস্থিতি এইরকম? কিন্ত্ত এর সবটাই সত্যি নয়। কেননা এই তরুণরাই অবসরে ওয়ের্স্টান পড়তে ভালবাসে, যে ওয়েস্টার্নে সোনার লোভে আসা তস্করের দল নিজেদের মধ্যে গোলাগুলি করতে করতে এক সময় গড়ে তুলেছিল নিরুপদ্রব স্থায়ী বসতি। আসলে মিশ্র অর্থনৈতিক আর সাংস্কৃতিক সূচকগুলো তারুণ্যকে দাবড়ে বেড়াচ্ছে। সুস্থির হতে পারছে না তারা দেশের মৃত্তিকাতে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশকে ইতিহাসহীন করে ফেলার প্রবণতা। শিকড় খুঁজে না-পাওয়া তরুণ শিকড় গাড়তে মূল ছড়াচ্ছে বিদেশের মাটিতে।
তিন
ঢাকা কিংবা অন্য কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেলে একজন ছাত্র বা ছাত্রীকে মাসিক বেতন কত টাকা দিতে হয়? বিশ টাকা মাত্র । বিশ্ববিদ্যালয়ের কজন ছাত্র সিগারেট টানে, সে-পরিসংখ্যান জানা নেই আমাদের। তবে ভার্সিটির ধূমপায়ীরা বেশিরভাগই বেনসন অ্যান্ড হেজেস ব্রান্ডের সিগারেটে, যাদের হাতের অবস্থা একটু খারাপ তারা গোল্ডলিফ ব্রান্ডের সিগারেটে, অভ্যস্ত। প্রতিটি বি অ্যান্ড এইচের দাম চার টাকা, প্রতিটি গোল্ডলিফের দুই টাকা ্লমাত্রশ্। যারা সিগারেট টানেন না তাদেরও বেশিরভাগ চা অথবা কফিতে অভ্যস্ত। কনফেকশনারিতে খেতে অভ্যস্ত অসংখ্য ছেলেমেয়ে। অনেক ছেলেমেয়ে ক্লাস করতে করতে হঠাৎ শখ করে আইসত্র্কিম খাওয়ার জন্যে চলে যায় বনানীর কোনো আইসবারে, কেউ আবার আসল পিজার স্বাদ নিতে যায় গুলশানের দিকে। হ্যালবেরি, কুপারস, উইমপি ইত্যাদি ঘিরে হচ্ছে তারুণ্যের নতুন সংস্কৃতি। কেউ কেউ রাস্তার ধারে চায়ের দোকান থেকে চা পান করলেও, মধুর দোকানে বা হলের ক্যান্টিনে নাশতা সারলেও, এসব জায়গা খুব ভালো করেই চেনে, জানে এবং প্রয়োজনে চলাফেরাও করে। আর যারা এর বাইরে, তারা সত্যিই ব্যতিক্রম, ভিন্ন গ্রহের কেউ।
এরকম খরচ-করিয়ে ছাত্রছাত্রীরাই মাসিক বেতন বিশ টাকার জায়গায় ত্রিশ-চল্লিশ টাকা করতে গেলে প্রতিবাদ-প্রতিরোধে ফেটে পড়ে। নিজেরা অপচয়ে অভ্যস্ত হলেও, এ এক বিস্ময়কর ব্যাপার যে বেতন-প্রসঙ্গে তারা অধিকারসচেতন হয়ে ওঠেন । কীভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে এই আন্দোলনের চেতনাকে? একি এক প্রাকৃতিক উপযোজন? নাকি সংস্কৃতিকরণ? না সংমিশ্রণ? যে-কোনো সমাজতাত্ত্বিককে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও থতমত খেতে হবে। ভালো ছাত্ররা এখন আর আন্দোলনমুখী নয়, তার কারণও আছে; কিন্ত্ত তবু আন্দোলনের চেতনা সাংস্কৃতিক উপাঙ্গ হয়ে রয়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে। তাই ছাত্র-রাজনীতি অপছন্দ করলেও আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে একটুও বাধে না এদের। কেননা তারুণ্যের স্বপ্নে এখন অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িয়ে গেছে। এ তারুণ্যের স্বপ্ন ব্যক্তিগত অর্জনের, লড়াই ও আত্মপ্রতিষ্ঠার।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ঢাকা এবং ঢাকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের পক্ষেই সবচেয়ে বেশি সম্ভব হয় ছাত্রাবস্থাতেই বিভিন্ন কর্মসংস্থানমূলক ক্ষেত্রে জড়িয়ে পড়ার। তার জন্যে দরকারি প্রস্তুতি নিতে রাজি তারা এবং নিয়েও থাকে। তাই ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরিতে গিয়ে ইংরেজি, আলিয়স ফ্রঁসেজে গিয়ে ফরাসি বা গ্যেটে ইনস্টিটিউটে গিয়ে জর্মন ভাষা শিখতে কোনো আলস্য নেই একটি বড় অংশের। কেননা এসব ভাষাই নিয়ন্ত্রণ করছে ইউরোপ আর আমেরিকাকে, তা জানা রয়েছে তাদের। তারপরও একটি উল্লেখ্যযোগ্য অংশ পরীক্ষায় ফেল করছে ইংরেজিতে। অন্যসব ভার্সিটির ছাত্রছাত্রীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ-সুবিধা অনেক কম হলেও ছাত্রাবস্থাতেই বিভিন্ন কাজ করার প্রবণতা বাড়ছে, ক্ষেত্রও তৈরি করে নিচ্ছে নিজেরা মিলেই। ভবিষ্যৎ জীবনে সফল হওয়ার জন্যে ডেকোরেটিভ সব প্রফেশন আর কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ছে তারা। নিজেদের প্রদর্শন করছে, বিজ্ঞাপিত হচ্ছে। প্রয়োজন হলে যুক্তি দেখাচ্ছে, ্লঅমর্ত্য সেনের বাঙালি মেয়েও তো সিনেমায় অভিনয় করছে। সময় এখন কত পালটে গেছে জানেন?শ্ কিন্ত্ত এই যুক্তির আরো খানিকটা জানে না তারা। জানে না, অমর্ত্যের সেই মেয়ে নন্দনা সেনের লেখাপড়ার রেজাল্টও ভীষণ ভালো, পর্দার জীবন তার শুরু হয়েছে পাশ্চাত্যেই। কিন্ত্ত সিনেমা হাতে নেয় বেছে বেছে। ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে ভালো লাগলেও আগে চিত্রনাট্যটা চিন্তা করে দেখে। কেরিয়ার হিসেবে এগুলোকে আর তুচ্ছ মনে করা হয় না, এগুলো মানে চলচ্চিত্র-নির্মাণ, চলচ্চিত্রে অভিনয় কিংবা ছোটপর্দায় জড়িয়ে পড়া। এইসবে আগ্রহ না থাকলে ত্র্কিকেট রয়েছে তাদের জন্যে। এসবের সবই তারা করে গভীর মনে। এমনকি পড়াশুনার চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্ব আর আগ্রহ দিয়ে। এখন আর কবিতার বই হাতে নিয়ে কোনো ছাত্র ভাবতে রাজি নয় যে, ্লঅন্ধকারে গলির ধারে/ দাঁড়িয়ে ছিলাম অন্যমনে/ ভাবি তোমায় মুখ দেখাবো/ মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনেশ্। নিজেই সে বিজ্ঞাপন হয়ে উঠছে। এবং বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যা খুবই স্বাভাবিক-নিজের পড়াশুনোর বিষয়ের সঙ্গে এইসব কাজের কোনো সম্পর্ক নেই, ভবিষ্যতেও হবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। ভারি শিল্প আর মাঝারি শিল্প বা হালকা শিল্পের কথা জানা আছে আমাদের। আগে গড়ে তুলতে হয় ভারি শিল্প। না হলে টেকসই শিল্পও ধোপে টেকে না, বাইরের পণ্যে বাজার সয়লাব হয়ে যায়। আমাদেরও তাই হয়েছে। শক্তিশালী সাংস্কৃতিকবোধ গড়ে ওঠার আগেই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ছে বাইরের সংস্কৃতি। হজমের ক্ষমতা নেই, বদহজম হচ্ছে।
তবে একটা ব্যাপার বেশ ভালোভাবে ঘটেছে। প্রজন্ম-ব্যবধান বা জেনারেশন গ্যাপ দেখা দিচ্ছে বলে বছর দশেক আগেও জোরেশোরে আহাজারি করতে দেখা যেতো অনেক তরুণ-তরুণী আর বিজ্ঞ মানুষকে। সেই প্রজন্ম-ব্যবধান লোপাট হয়ে গেছে খুবই গোপনে। পিতা আর সন্তানের মধ্যে চিন্তাচেতনায় আর কোনো তফাৎ নেই। পিতা চিন্তা করে, ছেলে প্রতিষ্ঠিত হবে; ছেলেও ভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে, কেরিয়ার বিল্ডআপ করবে। পিতা চায়, ছেলে বিদেশ চলে যাক; সকালবেলা মর্নিংওয়াক করতে করতে বিদেশে থাকা ছেলেকে নিয়ে তিনি গল্প করবেন আরো সব জগার্সদের সঙ্গে, ছেলে টিকিট পাঠালে সামনের ্লসামারেশ্ বিদেশ যাবেন। ছেলেও চায়, এই অলক্ষুণে দেশ ছেড়ে চলে যেতে। তা যে-ভাবেই হোক না কেন । ভিসার জন্যে লাইনে দাঁড়িয়ে তার আর মনে পড়ে না, এ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সে কত
কম টিউশন ফি দিয়ে লেখাপড়া করেছে, তার মোট টিউশন ফি-র বড় অংশটিই এসেছে এ দেশের সাধারণ মানুষের ট্যাক্স থেকে। যে-দেশে সে যাচ্ছে সে দেশে এই পুরো টিউশন ফি তাকে নিজেকেই বইতে হতো। হিমশিম খেতে হতো তাকে, লেখাপড়া করাই দুষ্কর হতো তার।
আর এই তারুণ্যের রোমান্টিকতা? প্রেম কিংবা বিয়ে? সেখানে রয়েছে এক বিরাট ফাঁকি, ভয়ানক লুকোচুরি। বাল্যবিয়ে আমরা আইন করেই বন্ধ করেছি। খুব ভালো করেছি। কিন্ত্ত সামাজিকভাবে ফ্রি মিক্সিংকে বাঁকা চোখে দেখি। যৌনশিক্ষাকে পাঠ্যবইতে অন্তর্ভুক্ত করতে ভয়ানক অনীহা জাগে। বিয়ের আগে কারো যৌনসম্পর্ক হয়েছে জানলে মাথার ওপর মনে হয় আকাশ ভেঙে পড়েছে। তাহলে আগের সেই বাল্যবিয়ের বয়স থেকে এখনকার বৈধ বিয়ের বয়স – এই দীর্ঘ সময় তারুণ্য অতিক্রান্ত করবে কেমন করে? পাশ্চাত্য এই প্রশ্নের মীমাংসা করেছে বিয়ের আগের যৌনসম্পর্ক নিয়ে মাথা না-ঘামানোর সামাজিক মনস্তত্ত্ব গড়ে তুলে। কিন্ত্ত আমরা মাথা ঘামাই। আমরা বাল্যবিয়ে বাতিল করে ছেলেমেয়ের কাছাকাছি আসার পথকে অবৈধ করেছি, কিন্ত্ত ফ্রি মিক্সিংয়ের বৈধপথকে ধর্ম আর সামাজিকতার রশি দিয়ে বেঁধে রেখেছি। আর এই দোটানায় তারুণ্য হয় পাপবোধে ভুগছে, না-হয় বিকৃত হচ্ছে। বিয়ে নামের প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পা দেয়ার গড়পড়তা বয়স বেড়ে গেছে সেশনজ্যাম আর বেকারত্বের দোর্দ- প্রতাপের তোড়ে। মধ্যবিত্ত পরিবারের অথনৈতিক চাপ, বেতনের হার মিলিয়ে এই বয়স আরো বাড়ছে। তারপর তারুণ্য আক্রান্ত হচ্ছে প্রবল ভয়ে। যে ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করল সে ছেলেই ভয় পাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েকে বিয়ে করতে। ফ্রি মিক্সিং সম্পর্কে তার মনে সামাজিকতা থেকে জন্ম নেয়া আর বেড়ে ওঠা, ফুলেফেঁপে ওঠা পাপবোধ ও বিকৃতির প্রভাবে সে ছুটছে মফস্বলে, একেবারে আনকোরা মেয়ের খোঁজে। ্লযে সাপের চোখ নেই, কান নেইশ্, সেই সাপ নিয়ে আসতে। আর উচ্চশিক্ষা-নেয়া মেয়ে – বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াটাই যেন তার অন্যায় হয়েছে, চাকরি পেয়েও বর মেলে না তার। যা মেলে, তা পাতে ওঠে না। কম বয়সী, কম শিক্ষিত ছেলেকেও তার বিয়ে করা হয় না। হয়তো নিজের আপত্তি নেই। কিন্ত্ত ঘোরতর আপত্তি তুলে ফণা পাকায় পরিপাশর্ব।
চার
তারুণ্যের এই স্বপ্ন জন্ম নিচ্ছে কেমন করে? মৃত্যুই বা ঘটছে কেমন করে? কিংবা যদি বলি প্রবহমানতার কথা, সেই প্রবহমানতার শক্তিই বা লুকিয়ে আছে কোথায়?
তারুণ্যের এ স্বপ্নের অবয়র তৈরি করে দিচ্ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্রমবিকাশ। আমাদের সমাজের পিরামিড আকৃতির শ্রেণী বিন্যাস বদলে গেছে। মার্কিন মুল্লুককে সংঘাতমুক্ত করার জন্যে সমাজবিন্যাস-বিশেষজ্ঞ ডাল জোর দিয়েছিলেন মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্রমসম্প্রসারণের ওপর। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ যত বাড়বে, ততই নিম্নবিত্ত আর উচ্চবিত্তের বিভাজন-রেখা হারিয়ে যাবে; এ হলো এমন এক শ্রেণি যা নিজেকে বাঁচাতে চায় অপর দু শ্রেণিকেই বাঁচিয়ে রাখার মধ্য দিয়ে। ডালের স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। কেবল আমেরিকাতে নয়, পৃথিবীর অনেক দেশেই। বাংলাদেশে তারুণ্যের উৎস এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি। তার স্বপ্ন এক সময়ে গড়ে দিতো বই, নাটক আর সংগীত। এখন তৈরি করে স্যাটেলাইট চ্যানেল, ভিসিডি, ডিভিডি। কী বলব এদের? আমাদের তারুণ্যের শিক, তাওয়া আর আগুন? প্রথমে এ তারুণ্যকে মিডিয়ার এই শিকে বেঁধা হয়, তারপর তাওয়ায় ছেড়ে আগুনে ঝলসে পরিণত করা হয় আধুনিক তরুণ আর তরুণীতে। সংস্কৃতির সংজ্ঞাকে বিশ্বায়ন পালটে দিতে না পারলেও ঝলসে দিচ্ছে, এইসব তারই লক্ষণ। সংস্কৃতি দিয়ে সংস্কৃতি জয় করার কোনো প্রত্র্কিয়া নেই, তাই পরিবর্তন নয়, এক হাসজারু-মার্কা সংস্কৃতির পিঠে চড়ে বিশ্বজয় করতে বের হচ্ছে তারা সবাই। সংস্কৃতির অন্তর্নিহিত শক্তি নয়, প্রযুক্তিই এ-প্রত্র্কিয়ার বড় শক্তি। প্রযুক্তি সামনে দাঁড় করাচ্ছে ম্যাডোনাকে। ব্রিটনি স্পিয়ার্সকে। নিকোল কিডম্যানকে। জুলিয়া রবার্টস্কে। কিংবা টম ক্রুজদের। অনেক নামই বলা যাবে। কিন্ত্ত নেলসন ম্যান্ডেলা কারো আদর্শ নয়। আদর্শ নয় শিরিন এবাদি। এমনকি জেসি নরম্যানও হার মেনেছে ম্যাডোনার কাছে। কেননা গুণ নয়, সংখ্যাই বড়। ম্যাডোনার ভক্ত বেশি, অতএব তিনিই ভালো। সময় এতই খারাপ যে, ল্যাটিন আমেরিকার পপতারুণ্য শাকিরার সাক্ষাৎকার নেন গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ এবং এভাবে তিনি নিজের নামকে পৌঁছে দেন শাকিরার ভক্তকুলের কাছে। আমাদের দেশের ছোটপর্দার মুখগুলো যদি সাক্ষাৎকারে হাসান আজিজুল হকদের নাম বলেন, তবেই বোধহয় তাদের বই বিকোতে পারে, অবস্থা এতই বাজে।
এই এক দশকে আগেই আমরা দেখেছি যে, প্রযুক্তি সবকিছুকে কেন্দ্রীভূত করে, সোপানক্রম দৃঢ় করে। গত শতাব্দীর বিশের দশককে যদি মনে করি তাহলে দেখি, ওই সময়েও ছিল এক অভাবিত তথ্য-বিপ্লবের সময়। রেডিও, টেলিভিশন, সিনেমা আর মেগাফোনের উদ্ভব পালটে দিল ক্ষমতার বিন্যাস, সংস্কৃতির ধরন। কিন্ত্ত এসবই ছিল ক্ষমতা-কেন্দ্রীকরণের লক্ষণ। যে-কয়েকজন ব্যক্তি কিংবা যে-দল বা গোষ্ঠী এগুলো ব্যবহারের অধিকার পেতো সেই ব্যক্তি, দল কিংবা গোষ্ঠী সমাজের বাদবাকি অংশের ওপর মাতব্বরি করার ক্ষমতাও পেয়ে যেতো। সেজন্যে অভু্যুখান বা বিপ্লব হলে পরিকল্পনা থাকতো প্রথমেই রেডিও এবং টেলিভিশন কেন্দ্র দখল করার, টেলিফোন আর টেলিগ্রাফ বোর্ড হাতে নেয়ার। কিন্ত্ত একবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই যে তথ্য-বিপ্লবের ঝাপটা এসে লাগলো তারুণ্যের চোখেমুখে, তাতে দেখা যাচ্ছে কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণের কোনো বালাই নেই। থমাস ফ্রিডম্যান ঠিকই বলেছেন, ্লপ্রত্যেকেই সংশ্লিষ্ট, কিন্ত্ত কেউই নিয়ন্ত্রিত নয়শ্। পশ্চিমা স্যাটেলাইট চ্যানেল না হয় ভারতীয় স্যাটেলাইট চ্যানেল আমাদের সেই অনিয়ন্ত্রিত তারুণ্য গড়ে তুলছে। তরুণ চাইছে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে মস্তানি করতে, চাঁদাবাজি করতে, অপমান-উসুলের জন্যে খুন করতে। আর তরুণী চাইছে, এরকম এক তরুণ প্রেমিক যার মধ্যে ফিল্মের নায়কদের মতো নষ্টামি রয়েছে: কেননা ওইরকম নষ্টামি না থাকলে সে প্রেমিকা-প্রেমিকা ভাব নিয়ে ভালোমানুষ বানাবে কাকে! কিন্ত্ত ভালোমানুষ যে বানাতে পারছে না, উলটো এক সময়ে খুন হয়ে যাচ্ছে তা তো সংবাদপত্রের রিপোর্ট পড়লেই বোঝা যাচ্ছে। হাসান আজিজুল হককে একবার বলতে শুনেছিলাম, ওরা – মানে ওই নষ্ট তরুণগুলো – সিনেমার মধ্যে এমনভাবে ্লআমি নষ্ট হয়ে গেছিশ্ বলতে থাকে যে বুঝলে, শুনে মনে হয়, নষ্ট হওয়ার মতো সুখ আর কোনো কিছুতেই নেই।শ্ এই সুখ এখন তারুণ্যের ওপর ভর করেছে।
পাঁচ
তারপরও স্বপ্ন-তারুণ্যের শেষ হয় না। ধরন পালটে যায়, প্রকাশ পালটে যায়। ব্যক্তিগত অর্জনই বড় লক্ষ্য, কিন্ত সমষ্টি কখনো তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকে। সেই তারুণ্যেকে আমরা খুঁজে পাই নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে। শামসুন্নাহার হলে পুলিশি তা-বের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা সনির মৃত্যুর পর বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঘূর্ণি তোলা একেবারে নবিশ আন্দোলনকারী তারুণ্য সেই আবেগ ছড়িয়ে নিজেকে প্রকাশ করে। কিংবা অসুস্থ কাউকে ঘিরে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে তোলপাড় ওঠে, তারা তখন দর্শনীর বিনিময়ে প্রোগ্রাম করে, দিনরাতের তোয়াক্কা না করে ছুটোছুটি করে; ছবি আঁকে, সেই ছবি বিত্র্কি করে। পুরো একটি নাটক মঞ্চস্থ করে বসে টাকা তুলতে। সমষ্টির জন্যে সুপ্ত আবেগ তার হূদয় ফুঁড়ে এইভাবে হঠাৎ হঠাৎ বেরিয়ে আসে। একটি গাছের জীবনের জন্যে বেষ্টনী তৈরি করে তারা। যে-কোনো উপলক্ষে দ্বিধাহীনভাবে রক্ত দেয়ার লাইনে দাঁড়ায়। কেউ অ্যাডভেঞ্চার করতে দল বেঁধে দ্বীপ আর পাহাড়ে যায়, সুর্যোদয়-সূর্যাস্ত উৎসবে মাতে, পাখি দেখে। অনেকে আবার উত্তরাঞ্চলের মঙ্গার খবর শুনে, প্রচণ্ড শীত পড়ার খবর শুনে, দলেবলে খাদ্যদ্রব্য আর কাপড় নিয়ে ছুটে যায় সেখানে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বেড়েছে তাদের। আর তার কারণ যে কেবল পারিবারিক দৈন্য, তা কিন্ত নয়, বরং আত্মসম্মানজ্ঞান। কারো বোঝা হতে রাজি নয় সে। না পরিবারের, না অপর কারো। এসবই প্রবণতা, এসবই ঝোঁক তরুণ আর তরুণীর। আর এসবের মধ্য দিয়েই বোঝা যায় তারুণ্যের স্বপ্নের ক্যানভাস। সবচেয়ে বড় কথা, তারুণ্যেরও প্রয়োজন হয় এক বৃদ্ধের – প্রবীণ তারুণ্যের। সেই প্রবীণই তার তারুণ্য দিয়ে তরুণ তারুণ্যের চোখে তুলে দেয় পথের শেষের আকাশ। এমনতর মানুষের কথা ভাবলেই মনে হয় শওকত ওসমান কিংবা আহমদ শরীফের নাম। মুহম্মদ জাফর ইকবাল আর ইনাম আল হকদের মতো মানুষের নাম। তরুণ তারুণ্যকে খোঁজার আগে জরুরি বোধহয় সেরকম তারুণ্যের অনুসন্ধান।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.