একই দেহে একাধিক সত্তা ধারণ করতেন আবুল হাসনাত। তিনি ছিলেন সম্পাদক, কবি, প্রাবন্ধিক, চিত্রসমালোচক ও সংস্কৃতি-সংগঠক, যদিও একসময় তাঁর সম্পাদক পরিচিতি প্রধান হয়ে উঠলে বাকি সত্তাগুলি কিছুটা আড়ালে চলে যায়। তিনি কবিতা লিখতেন মাহমুদ আল জামান নামে। সংস্কৃতি-সংগঠক হিসেবে তাঁর কাজকর্ম অনেকটাই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে, যদিও ষাট-সত্তরের দশকে তিনি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জাগরণে বিশাল এক ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁর সাহিত্যচর্চায় কখনো কোনো বিরতি ছিল না, যদিও তা চলেছে নীরবে-নিভৃতে।
ষাটের দশক থেকেই মাহমুদ আল জামান কবিতা লিখে গেছেন এবং তাঁর এই কাব্যচর্চা জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। মৃত্যুর আগে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর তিনটি কাব্যগ্রন্থ – কোনো একদিন ভুবন ডাঙায়, ভুবন ডাঙার মেঘ ও নধর কালো বেড়াল এবং নির্বাচিত কবিতা। মৃত্যুর পর ২০২১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর সকল কবিতার সংকলন কবিতাসমগ্র। এই গ্রন্থে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থগুলির কবিতাসহ অপ্রকাশিত-অগ্রন্থিত বেশ কিছু কবিতাও রয়েছে।
কবিতাসমগ্রে ক্রমানুসারে সংকলিত কাব্যগ্রন্থগুলির কবিতায় মাহমুদ আল জামানের ভাবনার প্রসার, একটি পর্যায় থেকে অন্য একটি পর্যায়ে তাঁর কবিতার মোড়-ফেরা, এর শৈল্পিক ও আঙ্গিকগত পরিবর্তন সুস্পষ্ট। কবিতার নান্দনিকতা বা শিল্পসুষমার পাশাপাশি ভাবনাজগতে এর অভিঘাত এবং তৎসঙ্গে রাজনৈতিক চিন্তা ও সমাজদর্শনের এক অন্তরঙ্গ বিন্যাসে সক্রিয় ছিলেন মাহমুদ আল জামান। অন্যদিকে তাঁর কবিতায় প্রবল হয়ে ধরা দেয় ব্যক্তিমানুষের সংকট-প্রেম-অপ্রেম, কষ্ট-বিষণ্নতা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির নানা সমীকরণ।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন, স্বাধীন দেশের নানা সংকট, সম্ভাবনা, আশা-নিরাশার হাহাকার মাহমুদ আল জামানের কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নৃশংস আক্রমণ, মানুষের আর্তি, সব হারানোর বেদনার পাশাপাশি স্বাধীনতা অর্জনের অনন্য প্রাপ্তির আনন্দ ফুটে উঠেছে তাঁর উচ্চারণে –
গ্রাম পুড়ে গেল দাউদাউ
আমি অনুভব করেছি
জেগে ছিল দু’একটি বিক্ষত নারী।
বলেছে শুধু তুমি আসো, স্বাধীনতা তুমি কতদূরে?
(‘অদ্ভুত অর্কিড’, পৃ ৫৩)
নগরে বেড়ে-ওঠা কবির হৃদয়জুড়ে শুধু শহর নয়, বরং সমগ্র বাংলাদেশ উপস্থিত। তাঁর ভুবনডাঙায় এদেশের বর্তমান-ভবিষ্যৎ, এর সম্ভাবনা ও সৌন্দর্যের যে বর্ণনা উঠে এসেছে তাতে বোঝা যায়, তিনি শহর বা গ্রামের মধ্যে বিভাজক রেখা টেনে না দিয়ে বরং একটি সম্পূর্ণ চিত্রকল্প রচনায় স্থির ছিলেন। এদেশের উর্বর পলিমাটির সঙ্গে বর্ণহীন শহরের মিশেলে বাংলাদেশ মূর্ত হয় তাঁর কবিতায়।
যত কিছু হোক থেকে যাবে উর্বর পলিমাটি
এই ঘরদুয়ার, ধুলোমাখা সংসারের লণ্ডভণ্ড ছবি
কোনো কোনো আড়াল করা যুদ্ধ জয়ের উজ্জ্বল স্মৃতি
এমনকি উপুড় করা মানুষের দুঃখের বিস্তৃত ভূমি।
*** ***
যত কিছু হোক থেকে যাবে শূন্য হৃদয় ভরে
নিঃসঙ্গ আকাশের উজ্জ্বল ছায়া, বর্ণহীন শহরে
বৃষ্টির মায়া, ভয়াল ঝড়ের সর্বনাশা আক্রোশে …
(‘যত কিছু হোক থেকে যাবে’, পৃ ৬৩)
ছাত্রজীবনে আবুল হাসনাত মার্কসবাদে আস্থা রাখেন, বাম ধারার রাজনীতির আদর্শ ধরে অগ্রসর হয়ে বাংলার কৃষক-শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের জীবন পরিবর্তনে মাঠে নামেন। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে তিনি আরো বিস্তৃত পরিসরে তাঁর আদর্শ বাস্তবায়নে সক্রিয় হলেন। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হয়ে তিনি বুঝলেন, যেসব স্বপ্ন ও আশা বুকে নিয়ে তিনি নয় মাস সংগ্রাম করেছেন, তার বেশিরভাগই পূরণ হবার নয়। স্বাধীন দেশে অন্যায়-অবিচারের কালো ছায়া বিস্তারে আশাহত কবি খুঁজেছেন মুখোশের পেছনের মানুষগুলিকে। কালো বেড়ালের রূপকে আততায়ীর আনাগোনা, অশুভ সংকেতকে তুলে ধরেছেন তিনি। বলতে চেয়েছেন, যে আশা নিয়ে স্বাধীন দেশের পথচলা শুরু হয়েছিল, তা ভেঙে গেছে কালো বেড়ালের নখরাঘাতে। শিক্ষা-সংস্কৃতি-শিল্প সর্বত্র থাবা মেলা এই কালো বেড়ালের কাছে যেন অসহায় আত্মসমর্পিত এদেশের মানুষ।
মুখোশে মুখ ঢেকে যখন
কেড়ে নাও সবকিছু
… … …
ও বেড়াল, নধর কালো বেড়াল
কেড়ে নাও সবকিছু,
পাঁজি-পুঁথি, দলিল-দস্তাবেজ, ভূ-দৃশ্য, পিতা প্রতিকৃতি
রৌদ্রের ছায়া কেড়ে নাও
তুমি তো বলদর্পী,
শক্তিমান
কেউ কিছু বলবে না, কেউ কিছু বলবে না
(‘কালো বেড়াল’, পৃ ১৬৭)
বাস্তবতার শেকলে বাঁধা কবির মনে কখনো কখনো কি উঁকি দিয়ে যায় হারানো প্রেম, ভালোবাসার স্মৃতি – এ প্রশ্নের উদ্রেক করে ‘সবিতা হালদার’। একাধিক কবিতায় সবিতা হালদারের উপস্থিতি পাঠককে ভাবায় – এই নারী কি কবির কোনো হারানো প্রেম? নাকি শুধুই তাঁর প্রেম-অপ্রেমের এক প্রতীকী রূপ? মাহমুদ আল জামানের কবিতায় এক ভিন্ন মাত্রা ফুটে ওঠে সবিতা-কথনে। নিজেকে যে কবি এক নৈর্ব্যক্তিক অবস্থানে রেখে সমাজ-ইতিহাস-সমকাল-দর্শনের কাজটি করে গেছেন, তিনি সেই অবস্থান থেকে বেরিয়ে একজন সপ্রাণ মানুষ ও প্রেমিক হিসেবে আবির্ভূত হন। কিন্তু তাঁর কবিতা কোথাও সংরক্ত নয়, নারীদেহ নিয়ে এক দূরবর্তী নির্লিপ্ততাও কবিতাগুলিতে দৃশ্যমান। এ-প্রেম কি আদর্শিক, নাকি জীবনের সংঘাতে, ওই নারীর ‘চলে যাওয়া’, ‘হারিয়ে যাওয়া’ বা অবহেলার অভিঘাতে উচ্ছ্বাসবর্জিত, নিষ্কাম – এমন প্রশ্ন থেকেই যায়। উত্তর আসুক বা না-ই আসুক, হৃদয়ে বড় বেশি বাজে ‘আমি খুঁজে চলেছি সবিতা হালদারের স্তব্ধ স্মৃতি’ পঙ্ক্তিটি।
তাঁর মনে বড়ো বেশি বেজেছে দেশ-হারানো মানুষের কষ্ট, চলে যাওয়া বন্ধু-স্বজনের হাহাকার, প্রতিনিয়ত নিজের ঠিকানা খুঁজে ফেরা মানুষের আর্তি। সাতচল্লিশের দেশভাগ কি একাত্তরের উদ্বাস্তু জীবন, দেশ স্বাধীনের পর বিশেষ জনগোষ্ঠীকে চাপে ফেলে বাস্তুচ্যুত করা – এসব বিষয়ও তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে দীর্ঘশ^াসের মতো।
রক্তক্ষরণে ভিটা ছেড়ে যেতে যেতে
কেমন শূন্য হয়ে গেল সুধারাণী
স্বর্গের উজ্জ্বলতা হারিয়ে
উদ্বাস্তু কলোনির আশ্রয়ে
এখন সে একা
না, হত্যার জন্য কেউ অস্ত্রের খাপ খোলেনি
শুধু বলেছে তুমি পালাও
আর শূন্য হও; শূন্য হও
(‘যেতে যেতে’, পৃ ১২৭)
রাজনীতি-সচেতন কবি মাহমুদ আল জামান একটি ধারার সঙ্গে একসময় সরাসরি, পরবর্তীকালে পরোক্ষভাবে, যুক্ত ছিলেন। কিন্তু কোনো একচক্ষু নীতিকে সমর্থন করেননি কখনো। সরাসরি প্রতিবাদ জানাতে না পারলে মৌন প্রতিবাদ করেছেন। অন্যায়-অবিচার, শোষণ সেটা যে দল বা যারাই করুক না কেন, তাদের প্রতি সুতীব্র প্রতিবাদ উঠে এসেছে তাঁর কবিতায়। পাশাপাশি যে সাধারণ মানুষ সবসময়ই ভুক্তভোগী তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন দ্ব্যর্থহীনভাবে। দাঙ্গা-হাঙ্গামা-হত্যার মতো অমানবিক ঘটনা তাঁকে ব্যথিত করেছে।
বার্ন ইউনিটের আর্ত হাহাকারে, দগ্ধ
মুখমণ্ডল, শিশুর ব্যান্ডেজ
যখন স্বপ্ন ভেঙে দিয়ে যায়
আমি মৃত্যু হলেও দেশি মানুষ মানব হয়ে যায়।
*** *** ***
মানবের আর্তনাদ আর হাহাকার এখন চতুর্দিকে
তুমি যাও, দুঃখবিলাসিনী
তুমি যাও বনেজঙ্গলে
তুমি যাও বার্ন ইউনিট থেকে।
(‘স্বপ্ন ভেঙে যায়’, পৃ ২১৮)
মাহমুদ আল জামানের কবিতায় দীর্ঘশ^াসের পাশাপাশি রোমান্টিক ভাবনার সমাবেশ ঘটেছে। এই সুরে ভর করে কবি এগিয়ে চলেন কবিতার ভুবনে। তবে সবকিছুর ওপরে তাঁর মনে অটুট থাকে একটি লাল-সবুজের মানচিত্র, যেন তাঁর কাক্সিক্ষত স্বপ্নদেশ ভুবনডাঙার দেখা মেলে। তিনি বিশ^াস করতেন, যত কিছুই হোক না কেন বাংলাদেশ টিকে থাকবে মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতি নিয়ে –
যত কিছু হোক থেকে যাবে উর্বর পলিমাটি!
যুদ্ধ জয়ের অমøান স্মৃতি।
(‘যত কিছু হোক থেকে যাবে’, পৃ ৬৩)
আমৃত্যু কবিতায় সমর্পিত ছিলেন মাহমুদ আল জামান। ২০২০ সালে কোভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণে সারা বিশে^ দুর্যোগ দেখা দেয়। অগণিত প্রাণ ঝরে পড়ে এই ভাইরাসের আক্রমণে। সেই সময় আমরা হারিয়েছি অনেক প্রথিতযশা ব্যক্তিত্বকে। মাহমুদ আল জামানও করোনা-অতিমারিকালে গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। সবার প্রত্যাশা ছিল, তিনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন। কিন্তু তাঁর মনে কি অন্য কোনো সুর বেজেছিল? তিনি কি বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁর সময় ফুরিয়ে আসছে? হয়তো পেরেছিলেন। হাসপাতালের বেডে শুয়ে লেখা তাঁর জীবনের শেষ কবিতায় সেই সুরই ধ্বনিত হয়েছিল –
আমার রোদ্দুর ঢেকে যাচ্ছে
কালো মেঘে
হায় ছায়াবৃতা দাও, আমাকে দাও
সজীব সবুজ উজ্জ্বলতা
ঘুম নেই চোখে, তাকিয়ে থাকি
অক্সিজেনের মিটারে
(‘শেষ লেখা’, পৃ ২৭১)
সুন্দর মুদ্রণ পরিপাট্যের গ্রন্থ কবিতাসমগ্র। কিন্তু এতে কিছু ঘাটতি রয়ে গেছে। বইটিতে একটি ‘ভূমিকা’র সংযোজন প্রয়োজন ছিল। তাহলে অনেক পাঠক মাহমুদ আল জামানের কবি পরিচিত, তাঁর কবিতার বিষয়-আশয় এবং কবি হিসেবে তাঁর কাল পরিক্রমার একটি পরিচয় পেত। তাছাড়া আলাদা আলাদা কবিতা গ্রন্থগুলির প্রকাশকাল, অগ্রন্থিত কবিতাগুলির প্রকাশকাল এবং কোন সাহিত্য সাময়িকী বা জার্নালে সেগুলির প্রথম প্রকাশ, সেসব তথ্য সংযোজন করা প্রয়োজন ছিল। তবে এসব ঘাটতি বাদ দিলে বইটিকে অনবদ্যই বলা যায়।
আবুল হাসনাত, অর্থাৎ কবি মাহমুদ আল জামান, ১৯৪৫ সালের ১৭ই জুলাই পুরান ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। ২০০৪ সাল থেকে আমৃত্যু তিনি কালি ও কলম সম্পাদনা করেছেন। ২০২০ সালের ১লা নভেম্বর পরলোকগমন করেন এই নিরলস সাহিত্যকর্মী এবং কবিতাপ্রাণ নিভৃতচারী মানুষটি।