স্বপ্ন দেখবার আগে কী ঘটেছিল

আকাশের চাঁদটা অর্ধেক কাপড় কাচা সাবানের মতো। কালো পটে সাদা সাবানটা ভাসছে। রাত কত হয়েছে? বেশি তো হবার কথা নয়। শ্যামলী সিনেমা হল থেকে লোকজন বেরোচ্ছে ছবি দেখে। রাস্তার পশ্চিম পাশে ভিড়। আমি দাঁড়িয়ে আছি পুবপাশে। এখানে ভিড় নাই। তবে মোড়ের দোকানটার পাশেই দুটো রাস্তা, ইংরেজি ভি-র মতো দুটি দিকে গেছে বেঁকে। একটা রাস্তা গেছে সেলিনা আপার বাড়ির দিকে। সেলিনা আপা মানে আমাদের মায়াভরা বোন, কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। ডানপাশেরটা গেছে কবি শামসুর রাহমানের বাড়ির দিকে। শামসুর রাহমান মানে কবি শামসুর রাহমান। আমাদের রাহমানভাই। তাঁকে ভাই বলতে আমার সংকোচ হয়। আমার আববার সমান বয়সী তিনি। কবি বেলাল চৌধুরী শামসুর রাহমানকে ডাকেন ‘স্যার’ বলে। আমিও কি রাহমানভাইকে ‘স্যার’ ডাকব নাকি!

সেলিনা আপার বাড়ির দিকে যাওয়া ঠিক হবে না। ওইদিকে গলির মুখে দুটো কুকুর একটা ধাবন্ত রিকশার পেছনে তেড়ে যাচ্ছে। আমি কুকুর ভয় পাই। বরং কবি শামসুর রাহমানের কাছে যাই। এত রাতে আমাকে আসতে দেখে তিনি কী করবেন? ঢুকতে দেবেন। দরজা খুলবে কে? একটা কাজ করতে পারি। আমার কাঁধের ঝোলায় একটা বই আছে। অনন্য জীবনানন্দ। বাংলা অনুবাদ। ক্লিনটন বি সিলির আ পোয়েট অ্যাপার্ট বইটা বেরোলে আমি দুই কপি কিনেছিলাম বিজুর দোকান থেকে। মানে শাহবাগের পাঠক সমাবেশ থেকে। একটা কপি আমি শামসুর রাহমানের বাসায় গিয়ে তাঁর হাতে দিয়ে এসেছিলাম। শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের পাঠক সমাবেশের উলটোদিকেই একটা দোকানে খেজুরের গুড়ের সন্দেশ পাওয়া যেত। সেই সন্দেশ নিয়ে গিয়েছিলাম। রাহমানভাইয়ের পুত্রবধূ বলেছিলেন, আববার তো ডায়াবেটিস। শামসুর রাহমানের নাতনিদুটোর নাম খুব সুন্দর, দীপিতা আর নয়না। ওরা আমার মেয়ের সঙ্গে একই স্কুলে ছবি আঁকা শেখে।

আজকে এখন ওখানে গেলে কে দরজা খুলে দেবে? পুত্রবধূ টিয়া? নাকি নয়না-দীপিতা? তারা কত বড় হয়েছে। কতদিন শামসুর রাহমানের বাড়িতে যাই না। বাড়ির সামনে কি এখনো পুলিশ থাকে?

আমি গলিপথে হাঁটি।

আচ্ছা, শ্যামলী সিনেমা হলটা বড় রাস্তায় আছে তো। নাকি ওটা ভেঙে ফেলা হয়েছে। আমি ধন্দে পড়ি। তবু হাঁটি।

চৈত্রমাসের রাত। দখিনা বাতাস কি বইছে? মাথার ওপরে পাতা ঝরে পড়ছে। এটা কি তাহলে শীতকাল? না। চৈত্রমাস। বসস্তকাল। কদিন পরে পহেলা বৈশাখ আসবে। আমি শ্যামলীর গলি ধরে হাঁটছি। আকাশে আধাখানা চাঁদ। চাঁদটাকে আমার মনে হচ্ছে পাউরুটির মতো। জীবনানন্দ দাশ কি পাউরুটির কথা ভেবেছিলেন, নাকি হাতে বানানো গোলরুটির কথা?

আমি দরজায় নক করি। একটা বছর-বারো বয়সের ছেলে দরজা খোলে। এ বোধহয় গৃহপরিচারক। রাহমানভাইয়ের সেবাযত্ন করে। তার গ্লুকমাক্ত চোখে আই-ড্রপ দিয়ে দেয়।

আমার হাতে অনন্য জীবনানন্দর বই। আমি বলি,  রাহমানভাই আছেন? এই বইটা তাঁকে দেওয়া দরকার। তিনি চেয়েছেন। তাই এনেছি।

মিথ্যা কথা বলি। শামসুর রাহমান আমার কাছে কোনোদিনও বই চাইবেন না। নিচতলার ড্রয়িংরুমের বাতি জ্বালানো হয়। তারপর গৃহপরিচারক ছেলেটা চলে যায়। তার গায়ে বার্সেলোনা লেখা টি-শার্ট। পেছনে লেখা মেসি।

সে চলে গেলে তার ছায়া মেঝেতে পড়ে থাকে। ছায়ার মধ্যে লেখা মেসি। কতক্ষণ একা একা বসে থাকা যায়। টিয়াভাবি কি নাই? দীপিতা? নয়না?

আমি নিজে উঠে গিয়ে ফ্যান ছাড়ি।

সোফায় সোজা হয়ে বসতে পারি না। পিঠে ব্যথা লাগে। কুশন টেনে পেছনে দিই। লম্বা টিউব লাইট। লাইটের ওপরে পোকা উড়ছে। একটা টিকটিকি দেয়ালে ওত পেতে আছে।

ফ্যানের শব্দটায় একটা ছন্দ আছে।

এইটা কী ছন্দ? মাত্রাবৃত্ত? অক্ষরবৃত্ত? স্বরবৃত্ত?

আর বসে থাকা যায় না। আমি সিঁড়ি বেয়ে দোতলার ঘরে যাই। ওই ঘরে শামসুর রাহমান থাকেন।

ছোট্ট শোবার ঘর। দেয়ালজোড়া বইয়ের র‌্যাক। বই আর বই। আমার বইটাও আমি দেখতে পাই। খোলা চিঠি সুন্দরের কাছে। দেখে খুশি হই।

বিছানা ফাঁকা।

একটা বই তুলে নিই বইয়ের র‌্যাক থেকে। ফ্রানৎস কাফকার ডায়েরি। সেটা খুলে দেখি শামসুর রাহমানের সাক্ষাৎকার।

কাফকার বইয়ে শামসুর রাহমানের সাক্ষাৎকার কেন, এটা নিয়ে আমার মনে প্রশ্ন জাগছে; কিন্তু আবার মনে হচ্ছে, এই প্রশ্ন সংগত নয়।

আমি পেছন ফিরে তাকাই। এককোণে একটা চেয়ার, একটা টেবিল, টেবিলের ওপরে একটা বিড়াল শোয়া। সাদাকালো বিড়াল।

আর চেয়ারে বসে উবু হয়ে লিখছেন শামসুর রাহমান। তার সামনে একটা টেবিল ল্যাম্প। সেই ল্যাম্পের আলোয় তাঁর চুল আর জুলফি সোনালি মনে হচ্ছে।

আমি চুপ করে থাকি। সৃষ্টির মুহূর্ত। আমার সবুর করা উচিত।

তিনি নিজেই একসময় ফিরে তাকান।

তারপর বলেন, কে, আনিস না?

আজকাল রাহমানভাই চোখে কম দেখেন। কথাও মনে রাখতে বোধহয় পারেন না।

আহা, কী সুন্দর দেখতে একটা মানুষ। বেলাল চৌধুরী বলেন, শামসুর রাহমান আমাদের সবচেয়ে সুদর্শন মানুষ, তিনি আমাদের প্রধান কবি, আমাদের প্রধান কবি সুদর্শনতম হবেন, এটাই স্বাভাবিক। বেলালভাই কী যে বলেন না।

শামসুর রাহমানের চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। পেছন থেকে আসা আলোয় তাঁর চুলের গোছাগুলোকে স্বর্ণতন্তুর মতো লাগছে।

আমি বলি, জি রাহমানভাই।

এত রাতে কেন এসেছেন?

শামসুর রাহমান সবাইকে আপনি করে বলেন।

আমি বলি, এমনি এসেছি রাহমানভাই। শ্যামলী সিনেমা হলের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবলাম, কোন গলিতে ঢুকব। শামসুর রাহমানের গলি, নাকি সেলিনা হোসেনের গলি। পরে ভাবলাম, আপনি রবার্ট ফ্রস্ট অনুবাদ করেছেন। যেই পথে কেউ যায় না, সেই পথে যাই।

আমার বাড়ির দিকে কেউ আসে না নাকি?

না না। তবে…

চা খাবেন?

খাব। আমি বলি … রাহমানভাই হাঁক ছাড়েন, মুর্শিদকুলি খাঁ। এক কাপ চা।

আমি বলি, দুধ-চিনি ছাড়া।

রাহমানভাই বলেন, দুধ-চিনি ছাড়া?

আমি বলি, চায়ের পাতা না দিলেও চলবে।

রাহমানভাই হাসেন। কাপ দেবো তো?

আমি বলি, তা না দিলেও চলবে। শূন্যতায় তুমি শোকসভা

তিনি বলেন, আমার কবিতার বইয়ের নাম।

আমি বলি, হ্যাঁ। রাহমানভাই, আপনার বাসার সামনে পুলিশ ছিল। নাই কেন?

তিনি বলেন, আমি চলে যেতে বলেছি। শূন্যতার শোকসভায় যোগ দিতে ওরা চলে গেছে।

আমি বলি, আপনার নিরাপত্তা?

পুলিশ দিয়ে কি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়?

মুর্শিদকুলি খাঁ আসে। তার বুকে লেখা, বারসেলোনা। সে একটা শূন্য ট্রে এনেছে। আমাকে একটা অদৃশ্য চায়ের কাপ দেয়। আমি সেটা নিয়ে চুমুক দেবার ভান করি।

রাহমানভাই বলেন, এত রাতে কেন এসেছেন?

আপনি কেমন আছেন জানার জন্য।

ফোন করলেই পারতেন।

আজকাল কেউ ল্যান্ডফোন ব্যবহার করে না, রাহমানভাই। আপনার আগের নম্বরটা আমার মুখস্থ আছে। ৩১৩২১৬। এখনকারটা মনেও থাকে না। ৯৩৩১৩৪২?

আচ্ছা, কেন এসেছেন বলুন।

আমার একটা অসুখ হয়েছে রাহমানভাই। আমার কিছু ভালো লাগে না।

আপনি তো লেখক। এটা আপনার হবে। যার এই রোগ থাকবে না, সে কোনো শিল্পীই নয়।

রাহমানভাই, আমার কেমন যেন সব ফাঁকা ফাঁকা লাগে। আমার মনে হয়, একজন আততায়ী…

একজন আততায়ী?

আমাদের সবার পেছনে পেছনে ঘুরছে।

তা তো ঘুরছেই। আজরাইল ঘুরছে। সবার পেছনে। মৃত্যুদূত।

না, রাহমানভাই। সেরকম কিছু না।

তাহলে?

আমি লিখতে গেলে সে আমার পেছনে এসে দাঁড়ায়। তার নিশ্বাস আমার কাঁধের ওপরে পড়ে। তার নিশ্বাসে আমার চুল নড়ে। আমি আর লিখতে পারি না। রাহমানভাই, পরীক্ষার সময় যদি টিচার কোনো পরীক্ষার্থীর খাতার কাছে এসে দাঁড়ায়, তার যেমন অনুভূতি হতে পারে, আমারও সেই রকমের অনুভূতি হয়। আমি আর লিখতে পারি না।

রাহমানভাই নীরবে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর ঠোঁট নড়ছে। তাঁর চশমার কাচের নিচে চোখে যেন কী এক বেদনা ফুটে উঠছে।

তিনি মুখ খোলেন। বলেন, আমার বাসার সামনে পুলিশ নাই কেন, জিগ্যেস করেছিলেন না? এখন বুঝলেন। আমি এ-কারণেই পুলিশকে চলে যেতে বলেছি।

আমি বলি, রাহমানভাই, আপনি সুনীল গাঙুলির ওই কবিতাটা পড়েছেন। কবির মৃত্যু … লোরকা স্মরণে।

রাহমানভাই বলেন, এটা এতবার আবৃত্তি শুনতে হয়েছে যে, আমার আর পড়বার দরকার পড়েনি। ভালো কবিতা।

ওই কবিতার শেষ লাইনটা মনে আছে, রাহমানভাই?

কোন লাইন?

ওই যে বলেছিলুম কিনা, আমার হাত শেকলে বাঁধা থাকবে না?

তিনি হাসলেন। কবির মৃত্যুর পরে তার হাত শেকলমুক্ত হলো। আমারও কি তাই হলো? আমার মৃত্যুর পরে কি আমি মুক্ত হলাম?

আপনি তো মারা যান নাই রাহমানভাই।

আমি মারা যাই নাই।

না। আপনি তো কবি। কবির তো মৃত্যু হয় না।

ওটা তো কাব্যের কথা।

কবিতার চেয়ে সত্যভাষণ আর তো হয় না।

না। ওটাও কবিতার কথা। কথার কথা। আসলে মিথ্যাই কবিতা।

মানে? আমি বিস্মিত। একটু আহতও বুঝিবা।

তিনি বলেন, এই যে আমরা বলি, চাঁদের মতো মুখ। কারো মুখ কি চাঁদের মতো হয়। কিংবা ধরুন, বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি। বাংলার মুখ কোথায়? কিংবা ধরম্নন সোনার বাংলা? এগুলো কি কথার কথা নয়? তেমনি কবির মৃত্যু হয় না, এটাও একটা কথার কথা।

কিন্তু আপনার কবিতা তো বেঁচে আছে। বেঁচে থাকবে রাহমানভাই। এমন কোনো স্বাধীনতা দিবস এই দেশে আসবে, যেবার ‘স্বাধীনতা তুমি’ আর ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে হে স্বাধীনতা’ কবিতাদুটো আবৃত্তি হবে না।

হবে বলছেন … রাহমানভাই হাসলেন। আহা, আমাদের রাহমানভাই। তাঁর শিশুর মতো হাসি। রবীন্দ্রনাথ একেই বোধহয় বলেছিলেন, আরো কিছু হাসি শিশুমুখ পরে শিশিরের মতো রবে।

আমি একদিন রাহমানভাইকে বলেছিলাম, রবীন্দ্রনাথের কবিতা কত আধুনিক, দেখেন, ফুলের গন্ধ বন্ধুর মতো জড়ায়ে ধরিছে গলে … গন্ধ বন্ধুর মতো জড়ায়ে ধরে … তিনি বলেছিলেন, আপনি মুখস্থ রাখতে পারেন, আমার না কিছু মনে থাকে না…

আমি বললাম, অবশ্যই মনে রাখবে মানুষ আপনাকে। আপনার কবিতা এই দেশে চিরকাল পড়া হবে। ‘স্বাধীনতা তুমি রবিঠাকুরের অজর কবিতা অবিনাশী গান … যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা’।

রাহমানভাই, আপনার এই একটা লাইনের জন্য আপনার এই কবিতাটা চিরটাকাল আমাদের জন্য পাথেয় হয়ে থাকবে।

কোন লাইনটা?

এই ‘যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা।’ স্বাধীনতা মানে তো তাই। যেমন ইচ্ছে লিখব।

রাহমানভাই বললেন, আ ম্যান ইজ বর্ন ফ্রি, বাট এভরিহয়ার হি ইজ ইন চেইন…

মানে কী?

আমরা কেউই স্বাধীন না, আনিস।

তাহলে রাহমানভাই, তোমাকে পাওয়ার জন্যে হে স্বাধীনতা, আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?

আনিস…

জি রাহমানভাই।

আমার প্রিয় লেখক কে? জানেন?

আমার তো মনে হয় কাফকা।

ঠিকই বলেছেন। কাফকা আমার প্রিয়। কেন প্রিয় জানেন?

না রাহমানভাই।

অনুমান করেন।

কারণ কাফকায় আমরা ধাঁধার মধ্যে পড়ে যাই। আমরা একটা ক্যাসেলের মধ্যে, বেরোতে পারি না। যে অপরাধ আমরা করিনি, সেই অপরাধের জন্য আমাদের বিচার হচ্ছে। কিন্তু সেই বিচার শেষ হয় না। একদিন গ্রেগরি সামসা ঘুম থেকে উঠে দেখে, সে পরিণত হয়ে পড়েছে এক বিশাল পোকায়। তাই না। বলুন তো সামসা নামটা কোত্থেকে নিয়েছে?

জানি না রাহমানভাই।

শামসু থেকে।

কী বলেন!

হ্যাঁ। কাফকার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তিনি বলেছেন, সামসা হচ্ছে শামসুর রাহমান।

শামস মানে তো সূর্য, আমি বলি।

তিনি বলেন, কাফকা এসব কিছু মিন করেনি। আমার কথাই লিখেছে।

এইসব কী বলছেন, রাহমানভাই।

শোনেন, আমার কবিতা ভালো করে পড়বেন। খুব ভালো করে। তাহলে বুঝতে পারবেন। আপনারা আমার কবিতা ভালো করে পড়েন না। তাই বুঝতে পারেন না।

হবে হয়তো। এই দেশে কেউ তো আর কবিতা পড়েটড়ে না। আচ্ছা রাহমানভাই, এবার আপনি আমাকে বলেন, আমার যে-অসুখ হয়েছে, তা থেকে আমি পরিত্রাণ পাই কী করে। আপনি বলছেন, কাফকার বোধ আপনাকে তাড়িত করত, তারপরেও তো আপনি লিখে গেছেন। ক্রমাগত লিখে গেছেন। তা কী করে হয়?

তাই তো হবে। আপনাকে ক্রমাগতভাবে চেষ্টা করতে হবে আপনার কলমের গায়ে যে-শেকলটা বাঁধা তা ছিঁড়ে ফেলতে। কাফকার চরিত্ররাই তাই করত।

কিন্তু সফল তো হতে পারত না।

সফলতার পেছনে ছুটবেন না। কর্মফলের কথা ভেবে কাজ করবেন না। কাজটাই আসল। পথই আমাদের মোকাম। গন্তব্য নয়।

কিন্তু লিখতে যে পারছি না। কালি ও কলম থেকে হাসনাতভাই ফোন করেন। বলেন, গল্প দিন। কেমন করে গল্প লিখব রাহমানভাই।

হাসনাত কেমন আছেন?

ভালো আছেন রাহমানভাই।

ওকে আমার সালাম বলবেন।

বলব। রাহমানভাই, আচ্ছা আপনার কি মনে হয় না, আমরা সারাজীবন একটাও সত্যকথা লিখি না।

সত্য তো আপেক্ষিক। ধরুন জাপান সবচেয়ে পূর্বের দেশ। কিন্তু তার পুবে গেলে আরো একটা দেশ পাওয়া যাবে, যেটাকে আপনি হয়তো বলছেন পশ্চিমের দেশ।

তা ঠিক। সত্য আপেক্ষিক। কিন্তু মনের কথা যে বলতে পারি না, বানিয়ে বানিয়ে অন্য কথা বলি।

এই জন্য তো আমি কবিতা লিখি। কবিতা মানেই অন্য কথা বলা। আপনি টিএস এলিয়টের এই এসেটা পড়েছেন?

পড়েছি রাহমানভাই।

কবিরা আসলে বলে একটা আর মিন করে একটা।

এই জন্যই তো  প্লেটো তার আদর্শ রাষ্ট্র থেকে কবিদের নির্বাসিত করতে চেয়েছিলেন।

রাহমানভাই হাসলেন। আমাদের রাষ্ট্রে কবিরা আছেন। সেই জন্যই এই রাষ্ট্র আদর্শ রাষ্ট্র নয়…

কোনো রাষ্ট্রই আদর্শ রাষ্ট্র নয়। সবখানেই কবিরা আছেন। আমি বলি…

আসি রাহমানভাই। এখন অনেক রাত। একা একা ফিরব।

আচ্ছা। আপনাকে চা দিলো না?

দিয়েছে।

কই?

আপনি দেখলেন না? অদৃশ্য কাপে অদৃশ্য চা।

কবিতার চা।

হ্যাঁ। ছোটবেলায় খেলার সময় এইভাবে আমরা চা খেতাম। খেলা খেলা। ছেলেখেলা।

 

রাহমানভাই বললেন, চলেন, আপনাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।

আমি বলি, না না। আপনি কষ্ট করে কেন সিঁড়ি বাইবেন। দরকার হবে না। আমি একাই যাই।

তিনি বললেন, যখন আর কোনো কিছুই প্রকাশ করা যায় না, যখন কোনো কিছুই লেখা যায় না, তখনই সাহিত্য করার সময়, তখনই কবিতা লেখার সময়। আপনাকে লিখে যেতে হবে। মানুষের মৃত্যু হলে তবু মানব থেকে যাবে।

আমি বেরিয়ে আসি। গলিতে নামি। দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া। পাহারাদার টর্চলাইট দোলাতে দোলাতে বাঁশিতে ফুঁ দিচ্ছে।

হঠাৎ মনে হলো, রাহমানভাইয়ের সঙ্গে একটা সেলফি তোলা দরকার ছিল। কাউকেই তো বিশ্বাস করাতে পারব না যে, তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে।

বাসায় এসে পকেট থেকে চাবি বের করে দরজা খুলি। সবাই ঘুমিয়ে আছে। ঘুমন্ত স্ত্রীর পাশে চুপটি করে শুয়ে পড়ি। তারপর স্বপ্ন তারপর স্বপ্ন…