নাহ, এয়ারপোর্টে কোনো অসুবিধা হয়নি। যদিও ঢাকা এয়ারপোর্টে সমস্যা হতে পারে – এরকম একটা আশঙ্কা মেজর আজমত শিরওয়ানীর ছিল। তবে পাসপোর্টের তথ্যে তিনি তো কোনো ‘মেজর’ নন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রাক্তন অফিসারও নন। স্রেফ ‘আজমত শিরওয়ানী’ নামে দুবাইয়ের এক ব্যবসায়ী। ফলে সমস্যা হওয়ার কথাও ছিল না। তবে ঢাকা এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশনে মেজর আজমত শিরওয়ানীর যে কোনো সমস্যা হয়নি তার মূল কারণ নামের আগে ‘মেজর’ নেই বলে নয়, কারণটা হচ্ছে যে-ইসলামি দলটা ওর করাচি থেকে দুবাই এবং দুবাই থেকে বাংলাদেশে আসার পুরো প্রক্রিয়াটা দেখভাল করেছিল, তাদের লোকজন রয়েছে এয়ারপোর্টে। পাকিস্তান ও বাংলাদেশ দু-দেশেই এই দলটা বেশ শক্তিশালী। যদিও ১৯৭১ সালে দলটা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, তবে ইসলামপন্থী এ-দলটার লোকজন বর্তমানে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নানা জায়গাতেই সুবিধাজনক নানা অবস্থানে রয়েছে। এ-দলের লোকজনকে মেজর শিরওয়ানী অবশ্য চেনেন সেই ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় থেকেই। বা আরো সঠিক বললে, ১৯৭০-এর নির্বাচনের সময় থেকেই। কারণ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্পেশাল ফোর্সের একজন অফিসার হিসেবে মেজর শিরওয়ানীর তখন পোস্টিং ছিল যশোর ক্যান্টনমেন্টে। কেবল চালাক-চতুর ও কিছুটা শক্ত ধাতুর অফিসারদেরই স্পেশাল ফোর্সে রাখা হতো। নির্বাচনের আগে মেজর শিরওয়ানীর কাজ ছিল যশোর অঞ্চলে ওই বিশেষ ইসলামি দলটাকে এবং অন্যান্য শেখ মুজিববিরোধী ইসলামপসন্দ দলগুলিকে, গোপনে অর্থ ও অন্যান্য সাহায্য দিয়ে সহায়তা করা, যাতে তারা নির্বাচনে শেখ মুজিবের দলের প্রার্থীদের হারিয়ে দিতে পারে। তবে ঘটনা তেমনটা হয়নি। নির্বাচনে ইসলামপসন্দ দলগুলি মোটেই ভালো করতে পারেনি। বরং তাদের ভরাডুবিই হয়েছিল। আর তারপর তো ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শেষে যুদ্ধই বেধে গেল।

১৯৭১-এর যুদ্ধের ওই নয় মাস মেজর শিরওয়ানীর পোস্টিং ছিল যশোরে। তবে ঠিক যশোর ক্যান্টনমেন্টে নয়, যশোর শহর ছাড়িয়ে ভারত সীমান্তের দিকে অনেকটা এগিয়ে নাভারন নামের একটা জায়গায়। যুদ্ধের দিনগুলিতে ওখানেই পাকা বাঙ্কার করে মেজর শিরওয়ানী এবং তাঁর পাঞ্জাবি কোম্পানিটা অবস্থান নিয়েছিল। মেজর শিরওয়ানী অবশ্য থাকতেন বাঙ্কারের পাশে  বড় একটা তাঁবুতে। নাভারনের ওপর দিয়ে গেছে ভারত সীমান্তে যাওয়ার যশোর রোড। যুদ্ধের দিনগুলিতে শান্তশিষ্ট নাভারন জায়গাটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, কারণ এপ্রিলের শুরু থেকেই এই যশোর রোড দিয়ে লক্ষ লক্ষ শরণার্থী তখন প্রাণের ভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে ভারতে চলে যাচ্ছে। প্রথমদিকে মেজর শিরওয়ানী এবং তাঁর পাঞ্জাবি সৈন্যদের জন্যে বিষয়টা ছিল খুবই বিরক্তিকর। প্রতিদিন এরকম হাজার হাজার পাকিস্তানি নাগরিক শত্রুদেশ ইন্ডিয়ায় চলে যাচ্ছে এটা কাঁহাতক আর সহ্য করা যায়! তাই কখনো বা শরণার্থীদের ওপর ফাঁকা গুলি ছুড়ে, কখনো বা সরাসরি ব্রাশফায়ার করে তারা এ জনস্রোতকে থামাতে চেয়েছে। তাতে যে অনেক শরণার্থী প্রাণ হারাত তা নিয়ে মেজর শিরওয়ানীর বাহিনীর কোনো মাথাব্যথা ছিল না। কারণ ১৯৭১ সাল ছিল এমন এক সময় যখন কোনো মানুষকে গুলি করে মারলে পাকিস্তানি সৈন্যদের কাউকেই কোনো জবাবদিহি করার দরকার পড়ত না। কেবল বাঙ্কারের কাছে যেন দুর্গন্ধ না ছড়ায় তাই রাজাকারদের বলা ছিল ওই মৃতদেহগুলির পায়ে দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে যেন দূরের নদীতে ফেলে দিয়ে আসে। রাজাকাররা কাজটা নিষ্ঠাভরেই করত। একে তো পাকিস্তানি সৈন্যদের আদেশ তাদের কাছে ছিল প্রায় খোদার আদেশের মতোই পবিত্র ও শিরোধার্য। আর দ্বিতীয়ত, রাজাকাররা অচিরেই আবিষ্কার করল যে, সাদামাটা পোশাক পরিহিত হলেও ঠিকমতো খুঁজলে এই মৃত শরণার্থীদের অনেকেরই পরনের কাপড়-চোপড়ের ভেতরে টাকা-পয়সা, সোনা-দানা এসব মূল্যবান পাওয়া যায়। বড় অঙ্কের টাকা বা স্বর্ণের মতো দামি কিছু পেলে রাজাকারগুলির চোখ খুশিতে চকমক করে জ্বলে উঠত। অবশ্য কেবল মৃতদেহের শরীরের টাকা-পয়সা-সোনা নয়, জীবিত শরণার্থীদের শরীরেও খোঁজাখুঁজি করে তারা এসব লুটে নিত।

তবে অচিরেই তাদের আগ্রহ কেবল টাকা-পয়সার প্রতি নয়, শরণার্থী নারীদের শরীরের দিকেও বাড়তে শুরু করল। কারণ শরণার্থীদের মধ্যে প্রচুর যুবতী নারী থাকত। তাদের ধরতে পারলে সহজেই রাস্তার পাশের বাঁশঝাড়ে, বা কোনো ভাঙা দালানের আড়ালে নিয়ে, দলবেঁধে ধর্ষণ করা কঠিন কিছু ছিল না। হতভাগিনী অনেক নারী পরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বা কাঁদতে কাঁদতে মূল দলের সঙ্গে মিলতে রওনা দিত। বেশি অত্যাচারিত কিছু মেয়ে অবশ্য যৌন নির্যাতনের নৃশংসতায় বা অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে মারাও যেত। মৃত মেয়েদেরও ওভাবেই পায়ে দড়ি বেঁধে নদীতে ফেলে দেওয়া হতো। সুন্দরী মেয়ে হলে ধরার পর মেজর শিরওয়ানীর তাঁবুতে পাঠানো হতো। কম সুন্দরীদের পাঠানো হতো সৈন্যদের জন্যে বাঙ্কারে।

যদিও যুদ্ধ করাই কোনো সেনাবাহিনীর পেশা এবং শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্যেই এই বাহিনীটাকে সীমান্তের কাছের এই এলাকাটাতে পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু তখন তো ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে কোনো যুদ্ধ শুরু হয়নি। আর প্রথম দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের হামলাগুলিও ছিল বেশ অনিয়মিত ও দুর্বল। ফলে মেজর শিরওয়ানী এবং তাঁর বাহিনী যে যুদ্ধ করার বদলে লুটতরাজ ও ধর্ষণেই বেশি জড়িয়ে পড়ল তা হয়তো আশ্চর্যের কিছু ছিল না। বিশেষ করে যখন ওর বাহিনীর অধিকাংশ সৈন্য পাকিস্তানের যে-অঞ্চল থেকে এসেছিল সেখানে নারীদেহ মোটেই সহজলভ্য কিছু ছিল না। ফলে বাঙাল মুলুকে, বিশেষ করে অসহায় এসব শরণার্থীর মধ্যে এত নারী দেখে, সৈন্যরা যারপরনাই চমকিত ও খুশি হলো। আরো খুশি হলো যখন ওরা অচিরেই বুঝতে পারল যে, শরণার্থীদের মধ্যে অধিকাংশই হিন্দু, কাফের। আর কাফের নারীদের ধর্ষণ করার ব্যাপারে ধর্মেও তেমন বাধা-নিষেধ নেই। তাছাড়া এসব হিন্দু শরণার্থী পরিবার এতটাই অসহায় ছিল যে, তাদের মেয়েদের ধরলে কেউই তেমন বাধা দিত না। 

এ-ব্যাপারে মেজর শিরওয়ানীর নিজের অবশ্য রুচিবোধ কিছুটা উন্নত  ছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন কমিশন্ড  অফিসার হিসেবে তিনি তো বেশি নিচে নামতে পারেন না। ফলে ওর সৈন্যরা ধরা পড়া মেয়েদের মধ্যে কেবল সুন্দরী ও তরুণী মেয়েদেরই মেজর শিরওয়ানীর তাঁবুতে পাঠাত। তবে নারীদেহের ব্যাপারে রুচির মান দেখাতে পারলেও টাকা-পয়সা, বিশেষ করে সোনার ব্যাপারে, মেজর শিরওয়ানী কোনো বাছবিচার করতেন না। সোনা দেখলে তাঁর যেন মাথা খারাপ হয়ে যেত। আর শরণার্থী নারীদের, এমনকি পুরুষদেরও, ভালোমতো সার্চ করলে কিছু-না-কিছু সোনা পাওয়া যেতই। তার তাঁবুর টেবিলটার ড্রয়ারে জমানো সেসব সোনা মাঝে মাঝে বের করে তিনি টেবিলের ওপর রেখে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতেন। দিনের সূর্যের আলোয় সোনার গহনাগুলি যখন চিকচিক করে উঠত, মেজর শিরওয়ানীর চোখ দুটোও যেন তখন খুশিতে জোনাকির মতো চকমক করে জ¦লে উঠত। গত দু-মাসে বেশ বড় রকম সোনাই পশ্চিম পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালীতে নিজ বাড়িতে পাঠিয়েছেন মেজর শিরওয়ানী। সেনাবাহিনীর নিজস্ব ডাকে পাঠানো সমস্যা হতে পারে ভেবে প্রথমবার সাধারণ পোস্ট অফিসের মাধ্যমে পাঠিয়েছিলেন। তবে দুশ্চিন্তায় ছিলেন কিছুটা। ঠিকমতো পৌঁছবে তো! মেজর শিরওয়ানী পরম খুশি ও নির্ভার হয়েছেন যখন জেনেছেন যে, সেসব সোনাই ওর পরিবারের কাছে যথাযথভাবে পৌঁছে গেছে। যশোর ক্যান্টনমেন্টের ব্রিগেড মেজর ছিল পাকিস্তানের কাকুল  সামরিক অ্যাকাডেমিতে মেজর শিরওয়ানীর ব্যাচমেট মেজর সিকান্দর বখ্ত। ওয়্যারলেসে মেজর সিকান্দর বখ্ত মাঝে মাঝে ঠাট্টা করে বলত : ‘শালে, তুমলোগ লুটেরা বন গ্যায়া!’ অবশ্য শুধু বন্ধু এক মেজরের বিদ্রূপ নয়, ক্যান্টনমেন্টের উচ্চপর্যায়ের অফিসারদের সভাতেও বিষয়টা আলোচিত হয়েছে। একবার তো ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হামিদ খান স্বয়ং এসে এক সভায় বলেছিলেন, সৈন্যরা যেন বাড়াবাড়ি না করে। এসব আলোচনার ফলে কোনো কোনো অঞ্চলে বা কোনো কোনো অফিসারের বাহিনীর ক্ষেত্রে লুট ও ধর্ষণ কিছুটা কমলেও সীমান্ত এলাকার নাভারনে মেজর শিরওয়ানীর পাঞ্জাবি কোম্পানিটার সৈন্যদলটার ক্ষেত্রে  তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। কারণ তাদের অধিনায়ক স্বয়ং এই লুটের ব্যাপারে এত আসক্ত ও  সোনাদানার  প্রতি তাঁর আকর্ষণ এতটাই তীব্র ছিল যে, তিনি নিজে তো তা বন্ধ করেনইনি, অন্যদেরও বাধা দেওয়ার কোনো তাগিদ বোধ করেননি।

সেদিনের ঘটনাটা মেজর শিরওয়ানীর আজো পরিষ্কার মনে আছে। ওর সৈন্যরা একটা শরণার্থী হিন্দু পরিবারকে সেদিন দুপুরে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে এসেছিল। বাবা, মা, দুই তরুণী মেয়ে ও এক কিশোর ছেলে। রাজাকারদের মাধ্যমে জেরা করে জানা গেল ওরা জাতে সাহা। পেশায় ব্যবসায়ী। বাড়ি ঝিনাইদহের হরিণাকুন্ডুতে। মেজর শিরওয়ানী ততদিনে জেনে গেছেন যে, বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে সাহারা মূলত ধনী ব্যবসায়ী এবং তাদের বেশ টাকা-পয়সা রয়েছে। কিন্তু পরিবারটার কাছে বেশি কিছু পাওয়া গেল না। অল্প কিছু নগদ টাকা আর মাত্র দুই ভরি সোনা। পরিবারটা হয়তো ততদিনে জেনে গেছে যে, বেশি টাকা ও সোনা সঙ্গে থাকলে পথে সেসব লুট হয়ে যেতে পারে। অল্প যা কিছু সঙ্গে রাখা হয়েছিল তা হয়তো এই উদ্দেশ্যে যে, পথে ধরা পড়লে পাকিস্তানি সৈন্য বা রাজাকারদের সেসব দিয়ে খুশি করে তারা হয়তো প্রাণে বেঁচে যেতে পারবে। তবে পরিবারটাকে ভালোমতো দেখে মেজর শিরওয়ানী বুঝতে পারছিলেন এরা পুরো সত্য বলছে না। বিশেষ করে পরিবারের প্রধান পুরুষ প্রৌঢ় অধীর সাহাকে তার বেশ চালাক লোক বলে মনে হলো এবং মনে হলো লোকটা যেন কিছু লুকোতে চাইছে।

ততদিন শরণার্থীরা ধরা পড়লে কী করণীয় তার একটা ছক পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দাঁড় করিয়ে ফেলেছে। হিন্দু হলে পুরুষগুলিকে গুলি করে মারা হবে। আর দলে যুবতী নারীরা থাকলে তাদের রেখে দেওয়া হবে এবং বাকিদের তাড়িয়ে দিয়ে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়া হবে। অধীর সাহার পরিবারের ক্ষেত্রে সেটাই ঘটতে চলেছিল। ক্যাম্পে এনে কিছুটা মারধর ও কিছুটা কান্নাকাটির পর সৈন্যরা যখন পরিবারটাকে মেজর শিরওয়ানীর সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন মেজর শিরওয়ানী হঠাৎই হুংকার দিয়ে বলে উঠলেন : ‘ঠ্যায়রো!’ সবাই থেমে পড়ল। মেজর শিরওয়ানী প্রৌঢ় অধীর সাহার কাছে এসে তাকে প্রচণ্ড জোরে এক থাপ্পড় মারলেন। অধীর সাহা প্রায় হুমড়ি খেয়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়লেন। বৃষ্টিভেজা মাঠটায় তখন ভরা কাদা। তার মধ্যেই গড়াগড়ি দিয়ে প্রবীণ অধীর সাহা কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকলেন, তাঁরা নির্দোষ। তাঁদের যেন ছেড়ে দেওয়া হয়! কিন্তু মেজর শিরওয়ানী কয়েক পা এগিয়ে এসে বেশ নাটকীয়ভাবে লোকটার বুকের ওপর ওর কাদামাখা বুটসহ এক পা তুলে দিলেন। কোমর থেকে রিভলভারটা বের করলেন। তারপর রিভলভারটা ক্লিক করে তাক করলেন অধীর সাহার মাথা বরাবর। পাশে দাঁড়ানো অধীর সাহার গোটা পরিবার ও অধীর সাহা নিজেও হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। কিন্তু মেজর শিরওয়ানী বেশ শীতল কণ্ঠে কিন্তু শক্তভাবে বললেন, ওদের ছেড়ে দেওয়া হবে যদি ওদের আসলেই আর কী কী সোনাদানা আছে তা তারা বলে দেয়। অধীর সাহা বাকরুদ্ধ হয়ে কাদার মধ্যে মুখ রেখে শুধু হু-হু করে কাঁদতে থাকলেন। নানা রকম শরণার্থী দেখে মেজর শিরওয়ানী এতদিনে এদের চরিত্র ভালোই বুঝে গেছেন। ফলে বিচলিত হলেন না। তারপর অধীর সাহা যাতে বুঝতে পারে এমন সহজ উর্দুতে বললেন, অধীর সাহা যদি দু-মিনিটের মধ্যে ওদের সোনাদানার খবর না দেন তাহলে তাকে এবং ওর কিশোর ছেলেটাকে এখনই গুলি করে মারা হবে। আর ওর মেয়ে দুটোকে সৈন্যদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। আর যদি অধীর সাহা সবকিছু সত্য বলেন তাহলে তাকে ও তার পরিবারকে এখনই ছেড়ে দেওয়া হবে। প্রায় দেড় মিনিট এক অদ্ভুত জমাট নীরবতা ঘিরে রইল চারদিকে। কেবল অধীর সাহার  বউ ও ছেলেমেয়েদের করুণ কান্নার শব্দ ছাড়া। তারপর হঠাৎ করে অধীর সাহা কাদা থেকে মুখ তুলে বলে উঠল, ‘ম্যায় বাতায়েঙ্গে স্যার!’ অধীর সাহাকে কাদা থেকে তুলে মেজর শিরওয়ানীর তাঁবুতে নিয়ে আসা হলো। সেখানে তাঁবুর ভেতরে মেজর শিরওয়ানীকে অধীর সাহা একান্তে কী বলেছিল যে আজ যুদ্ধ শেষের চার বছর পরেও মেজর শিরওয়ানী এত ঝুঁকি নিয়ে এই দেশটাতে আবার এসেছেন, যে-দেশের অনেক মানুষই তাঁকে চিনতে পারলে এখনই জ্যান্ত ছিঁড়ে ফেলবে! আর এদেশের রাষ্ট্র ও সরকারও তাঁকে জামাই আদর করবে না নিশ্চয়ই যদি তারা তাঁর এদেশে আবার আসার আসল কারণটা জানতে পারে। সেই দুপুরে মেজর শিরওয়ানীর তাঁবুতে অধীর সাহা প্রায় কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন যে, তাঁদের হরিণাকুন্ডুর বাড়ির পেছনের দেয়ালের ছয় ফুট উঁচুর প্রথম যে চারটে ইট, সেগুলি আসলে ইঁট নয়, ওখানে ওদের পরিবারের সাড়ে ছয়শো ভরি সোনা গোপনে রাখা আছে। চারপাশে মাটির প্রলেপ দিয়ে তার ওপর ইটের রং করে দেওয়া হয়েছে। বাইরে থেকে কিছুই বোঝা যায় না।

অধীর সাহা তাঁর বলা কথাটা সততার সঙ্গেই বলেছিলেন। জীবনে অনেক পোড়-খাওয়া মেজর শিরওয়ানী জানেন মানুষ কোনটা সত্য কথা বলছে আর কোন কথাটা অসত্য। অধীর সাহার কথাগুলি তিনি সত্য বলেই বুঝেছিলেন। গোপন এ-তথ্যটা বলে অধীর সাহা তাঁর কথা রেখেছিলেন। তবে মেজর শিরওয়ানী তাঁর নিজের বলা কথাটা রক্ষা করার তেমন প্রয়োজন বোধ করেননি। আসলে কোনো কাফেরকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি, বিশেষ করে ১৯৭১-এর যুদ্ধকালীন সেই বিশেষ দিনগুলিতে, রক্ষা করার কোনো বাধ্যবাধকতা আছে বলে মেজর শিরওয়ানীর মনে হয়নি। ফলে সেই রাতেই অধীর সাহা এবং তার কিশোর ছেলেটাকে নদীর পাড়ে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মারা হলো। আর মেয়ে দুটোকে তুলে দেওয়া হলো সৈন্যদের হাতে। ইদানীং নারীদেহের প্রতিও যেন মেজর শিরওয়ানী তেমন আকর্ষণ বোধ করতেন না। তাঁর সকল আগ্রহ যেন কেন্দ্রস্থ হয়েছিল কেবল সোনা সংগ্রহের নেশায়। তীব্র এক স্বর্ণতৃষায়। মেজর সাহেব তরুণী সুশ্রী মেয়ে দুটোকে নিজের তাঁবুতে একবারও না রেখে সরাসরি ওর বাহিনীর সৈন্যদের হাতে তুলে দিলেন দেখে সৈন্যরা যারপরনাই বিস্মিত ও খুশি হলো। তারপর মহাউৎসবে মেয়ে দুটোকে ধরে হইচই করতে করতে ওরা ওদের বাঙ্কারে নিয়ে গেল। আর ওদের প্রৌঢ়া মা’কে ছেড়ে দেওয়া হলো। মেজর শিরওয়ানী পরে শুনেছেন যে, অধীর সাহার প্রৌঢ়া বউটাকে নাকি বহুদিন নাভারনের বাজারে পাগলিনী হয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে।

ইসলামি দলটার ব্যবস্থাপনাটা ভালো। ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে নির্দেশমতো অপেক্ষায় থাকা মানুষটার দেখাও পেয়ে গেলেন মেজর শিরওয়ানী। একটা গাড়িরও ব্যবস্থা করে রেখেছে তারা। মেজর শিরওয়ানী অবশ্য ঢাকা শহরে থাকবেন না। একটা পাঁচ তারকা হোটেলে আজকের রাতটা কাটিয়ে কাল ভোরেই রওনা দেবেন ঝিনাইদহের দিকে। তাঁকে আশ্বস্ত করা হয়েছে যে, ঝিনাইদহে ইসলামি দলটার সংগঠন ভালো এবং তার কোনোই অসুবিধা হবে না। অবশ্য গোটা কাজটা কেবল ইসলামি আদর্শের অনুপ্রেরণায় হয়নি। করাচিতে ইসলামি দলটার প্রতিনিধিকে একটা বড় অঙ্কের ডলার দিতে হয়েছে মেজর শিরওয়ানীকে। তবে করাচি থেকে দুবাই, দুবাই থেকে ঢাকা এয়ারপোর্ট – এ পর্যন্ত সবকিছুই ঠিকঠাক চলেছে। ঝিনাইদহে অধীর সাহার পরিত্যক্ত বাড়িটা চেনে এমন লোকও খুঁজে পাওয়া গেছে। ফলে মেজর শিরওয়ানী বেশ আশ^স্ত বোধ করা শুরু করলেন। পরদিন দুপুরে মেজর শিরওয়ানীকে বহন করা গাড়িটা একসময় ঝিনাইদহ শহর অতিক্রম করে হরিণাকুন্ডু গ্রামটার দিকে এগিয়েও চলল।

কেবল একটা হিসাব মেজর শিরওয়ানী এবং তাঁর সঙ্গের লোকজন ঠিকমতো করে উঠতে পারেননি। তা হলো, হরিণাকুণ্ডু বাজারে প্রাক্তন মুক্তিযোদ্ধাদের একটা অফিস আছে। ছোট টিনের অফিস। সাইনবোর্ডটাও কিছুটা মলিন হয়ে গেছে। তবু প্রতিদিন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা অফিসটাতে আসেন। খবরের কাগজ পড়েন। নিজেদের মধ্যে নানা বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করেন। তো তাঁদের গ্রামে বাইরে থেকে আসা একটা সাদা গাড়ি ঢুকেছে এবং গাড়িটাতে ইসলামি দলটার দুজন কর্মী ও সানগ্লাস-পরা খুব লম্বা-ফর্সা একজন লোক রয়েছেন – এ-খবরটা তাঁরা শুনলেন। তাঁরা এও শুনলেন যে, গায়ের রং দেখে মনে হচ্ছে লোকটা পাঞ্জাবি এবং জানা গেল, পাঞ্জাবি লোকটাকে নিয়ে গাড়িটা অধীর সাহার পরিত্যক্ত বাড়িটার  দিকে এগোচ্ছে। বোঝা গেল, মুক্তিযুদ্ধ কয়েক বছর আগে শেষ হলেও এসব প্রাক্তন মুক্তিযোদ্ধার অনেকেই এখনো যুদ্ধের সময়কার রেকি করা ও বিশদভাবে তা রিপোর্টিং করার ট্রেনিংটা ভোলেননি। কৌতূহলবশত একে একে বেশ কজন মুক্তিযোদ্ধা অধীর সাহার পাড়াটার দিকে এগিয়ে গেলেন। মেজর শিরওয়ানীর গাড়িটা ততক্ষণে অধীর সাহার বাড়ির খুব কাছে চলে এসেছে। বাকি পথটা গাড়ি আর যাবে না। কারণ মাটির রাস্তায় হাঁটুসমান কাদা। মেজর শিরওয়ানী এবং তাঁর সঙ্গীরা তাই গাড়ি থেকে নেমে বাড়িটার দিকে হেঁটে যেতে থাকলেন। খবরটা পেয়ে গ্রাম থেকে ক্রমে আরো দু-তিনজন মুক্তিযোদ্ধা ও বেশকিছু গ্রামবাসী কৌতূহলভরে অধীর সাহার বাড়িটার কাছে এসে জড়ো হলেন। মেজর শিরওয়ানী তাঁর ছোট দলটা নিয়ে যখন অধীর সাহার বাড়ির সামনে পৌঁছলেন ততক্ষণে বাড়িটার কাছে গ্রামবাসীর ছোটখাটো একটা জটলা হয়ে গেছে। একতলা দালান বাড়িটা এক নজর দেখেই মেজর শিরওয়ানী বুঝতে পারলেন যে, অধীর সাহা তাঁর বর্ণনায় কিছু ভুল বলেননি। কারণ গত চার বছর ধরে এ-বাড়িটা ও ভেতরের দেয়ালটার কথা তো মনে মনে কম ভাবেননি মেজর শিরওয়ানী! সাড়ে ছয়শো ভরি সোনা! সে তো সহজ কথা নয়। বিশেষ করে এমন এক মানুষের জন্যে যার কাছে জীবনে সোনাই সব। এখন এই ভিড় কাটিয়ে কেবল বাড়িটার ভেতরে ঢোকার ব্যাপার মাত্র। কিন্তু বোঝা গেল কাজটা তেমন সহজ হবে না। কারণ মেজর শিরওয়ানী তাদের কাছে অপরিচিত হলেও তার সঙ্গে ঝিনাইদহ থেকে আসা ইসলামি দলটার নেতা ও কর্মীটাকে প্রাক্তন মুক্তিযোদ্ধাদের এই দলটা বিলক্ষণ চেনেন। ওই দুজন মেজর শিরওয়ানী সম্পর্কে  জনতাকে বোঝাতে চাইল যে, তিনি দুবাইয়ের একজন ব্যবসায়ী। অধীর সাহার পরিত্যক্ত বাড়িটা তিনি কিনতে চান। এখন ভেতরে গিয়ে সবকিছু একবার স্বচক্ষে দেখে নিতে চান। বাড়িটা তো খালিই পড়ে আছে।

কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ একজন  সামনে এগিয়ে এসে বললেন যে, অধীর সাহা বেঁচে নেই। তাঁর আত্মীয়স্বজনও কেউ আর এদেশে থাকেন না। কিন্তু অধীর সাহা ও তার পরিবার আমাদের মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হয়েছেন। একজন শহিদ পরিবারের পরিত্যক্ত সম্পত্তি কিনতে হলে আপনাদের সরকারি অনুমতি লাগবে। আপনাদের কী সেরকম কোনো অনুমতি আছে? সরকারি অনুমতি!

মেজর শিরওয়ানী জানতেন বাংলাদেশে এসে সোনাগুলো সংগ্রহ করার কাজটা খুব সহজ হবে না। তাই অনেক রকম বাধার কথাই তিনি মনে মনে ভেবে রেখেছিলেন। চিরকালের অভ্যাসমতো পকেটে একটা গুলিভরা রিভলভারও রেখেছিলেন। কিন্তু সরকার? সরকারি অনুমতি? স্বাধীন বাংলাদেশ যে এখন একটা আলাদা রাষ্ট্র, তার যে নিজস্ব কিছু নিয়মনীতি আছে – এই দিকটা তিনি আগে ততটা ভাবেননি। ওর পক্ষ থেকে ইসলামি দলটার লোক দুজন গ্রামবাসীকে কিছু বলার চেষ্টা করল। কিন্তু বোঝা গেল গ্রামের লোকজন তাতে সন্তষ্ট নন। তারা আরো জানতে চায়। বাংলা ভাষাটা না জানার দুঃখটা প্রবল হলো মেজর শিরওয়ানীর। প্রায় সাড়ে তিন বছর এদেশে চাকরি করেছেন। ভাষাটা কিছুটা শিখতেই পারতেন! তবু উর্দুতে ও ভাঙা ভাঙা বাংলায় তিনি বলতে চাইলেন, বাংলাদেশকে তিনি খুব ভালোবাসেন। এত সবুজ, এত গাছপালা, মানুষজনের মন এত নরম। তাই এদেশে তিনি একটা বাড়ি কিনতে চান। পরিচিত একজনের কাছ থেকে অধীর সাহার বাড়িটার খবর জানতে পেরে তিনি এখন দুবাই থেকে সরাসরি চলে এসেছেন বাড়িটা একবার সরেজমিনে দেখতে এবং সম্ভব হলে এবারেই কিনে নিতে। কিন্তু বোঝা গেল মেজর শিরওয়ানীর কথাগুলি গ্রামবাসীর কাছে, বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপটার কাছে, তেমন গ্রহণযোগ্য হলো না। আসলে বাঙালিরা বহু বছর আগেই উর্দু ভাষায় কেউ কিছু বললে সেটা বিশ্বাস করার অভ্যাসটা হারিয়ে ফেলেছে। ফলে মেজর শিরওয়ানীর কথাটা তাদের কাছে তেমন গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। বরং তাদের মধ্যে কেউ কেউ মেজর শিরওয়ানীর সঙ্গে আসা ইসলামি দলের ওই লোক দুজনের প্রতি কিছুটা ক্ষোভ প্রকাশ করতেও ছাড়লেন না যে,  তাদের কী রকম আক্কেল! সরকার বা চেয়ারম্যান-মেম্বারদের কোনো অনুমতি ছাড়াই, বা কাউকেই কিছু না জানিয়ে, তারা এক বিদেশিকে সরাসরি এক শহিদ পরিবারের বাড়ি কিনতে নিয়ে এসেছে। কিছুটা তর্ক-বিতর্কও হলো। মেজর শিরওয়ানী বুঝতে পারছিলেন অবস্থাটা ক্রমে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। কারণ এর মধ্যে গ্রামের আরো কিছু লোকজন এসে অধীর সাহার বাড়ির সামনে জড়ো হয়েছেন এবং তাঁদের ভঙ্গি যেন ক্রমশ উদ্ধত হয়ে উঠছে। এই পর্যায়ে মেজর শিরওয়ানী ওর শেষ অস্ত্রটা ছাড়লেন। তা হচ্ছে, গাড়ির পেছনের সিট থেকে ওর ব্রিফকেসটা বের করে আনলেন। সবার সামনেই সেটা খুললেন। ভেতরে থরে থরে সাজানো টাকার বান্ডিল। পাঁচশো টাকার একটা বান্ডিল হাতে তুলে নিয়ে মেজর শিরওয়ানী সমবেত জনতাকে বললেন, তাঁরা তাকে সহযোগিতা করলে এ-টাকাটা তিনি এ গ্রামের মসজিদটাতে দান করবেন। আর নেতারা চাইলে তাঁরা নিজেরাও টাকাটা রাখতে পারেন। জনতার মধ্যে একটা মৃদু গুঞ্জন শুরু হলো।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সিদ্দীক মাস্টার এতক্ষণ ভিড়ের মধ্যে নীরবে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কোনো কথা বলেননি। চুপচাপ সব দেখে ও শুনে যাচ্ছিলেন। সিদ্দিক মাস্টার অবশ্য কথা একটু কমই বলেন। কিন্তু যখন বলেন তখন সেটা খুব দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন এবং এলাকার লোকজন তাঁর কথাটাকেই যে-কোনো আলোচনার শেষ কথা বলে মনে করে। লম্বা মানুষ সিদ্দিক কমান্ডার কয়েক পা এগিয়ে এসে মেজর শিরওয়ানীর সামনে দাঁড়ালেন। দুজনের উচ্চতা প্রায় সমানই। তারপর আস্তে আস্তে, কিন্তু বেশ শক্ত গলায় সিদ্দিক মাস্টার মেজর শিরওয়ানীকে বললেন যে, তাদের কথা বিশ্বাসযোগ্য নয় এবং তাদের চালচলন রহস্যজনক। বড় রকম কোনো ঝামেলা এড়াতে চাইলে তাদের উচিত হবে এখনই গাড়ি নিয়ে এ-গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়া এবং যেখান থেকে এসেছেন সেখানে ফিরে যাওয়া। সিদ্দিক কমান্ডারের দৃঢ়চেতা কথাগুলি শুনে এবং তারপর সমবেত গ্রামবাসীর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে বুদ্ধিমান মেজর শিরওয়ানী বুঝলেন যে, তাঁর চার বছরের সকল জল্পনা-কল্পনা হয়তো বৃথাই যেতে চলেছে! তাঁকে ফিরেই যেতে হবে।

 সেদিন শেষ বিকেলে দেখা গেল মেজর শিরওয়ানীকে বহন করা গাড়িটা ঢাকার পথে ঝিনাইদহের দিকে এগিয়ে চলেছে। গাড়িটাকে কিছুটা ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। আর ভেতরে বসে মেজর শিরওয়ানী ভাবছিলেন, ভারতে যুদ্ধবন্দি থাকার দিনগুলিতে  পাতিয়ালা যুদ্ধবন্দি ক্যাম্পে তাঁর বন্ধু মেজর সিকান্দর বখত তাঁকে একদিন হয়তো ঠিক কথাটাই বলেছিল, ‘বাংলাদেশ আব দোসরা কান্ট্রি বন গিয়া দোস্ত। … তুম উওসব আইডিয়া ছোড় দো!’

Leave a Reply