স্বর্ণবোয়াল : হারজিত অদ্বৈত নৈসর্গিক ঐক্যে বাঁধা

সেলিম আল দীনের স্বর্ণবোয়াল নাটকটি সম্প্রতি বাংলাদেশের দুটি বিশ^বিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষক ও নাট্যনির্দেশক নির্মাণ করেছেন। তাঁরা হলেন – জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. ইউসুফ হাসান অর্ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. সুদীপ চক্রবর্তী। একই টেক্সটের দুটো প্রযোজনার উপস্থাপনরীতি কাছাকাছি হলেও তাদের ভেতর বৈচিত্র্য রয়েছে। নাট্যলক্ষ্যগত ভিন্নতাও রয়েছে। দুটিই এরিনা মঞ্চে বাংলানাট্যরীতির আলেখ্যে উপস্থাপিত। তারপরও দর্শন, আখ্যানবিন্যাস, শিল্পচিন্তা, চরিত্রনির্মাণ, পোশাক ও সংগীতে ভিন্ন বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। এই লেখাটিতে স্বর্ণবোয়াল নাটকের দুটি প্রযোজনার ওপর ভিত্তি করে বাংলা নাট্যদর্শন, নাট্যবৃত্ত, নাট্য প্রযোজনার মনস্তত্ত্ব, আখ্যান, উপস্থাপনরীতি, মঞ্চ, অভিনয়, চরিত্র, আলো, শিল্পমূল্য, উপযোগিতাসহ নাট্যীয় নানা উপকরণ নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হবে।

প্রাচীনকালে বাঙালি মেছো জাতি নামেও পরিচিত ছিল। অথচ মাছ শিকার নিয়ে বাংলা সাহিত্যে উল্লেখ করার মতো কোনো সাহিত্যকর্ম নেই। ইউরোপে মাছ শিকার-নির্ভর সাহিত্য আছে। মার্কিন লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের দ্য ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সি এক মাছ শিকারিকে নিয়ে লেখা। এটি হাভানার উপসাগরে প্রবীণ সান্তিয়াগোর মাছ শিকারের সংগ্রামের কাহিনি। হৃদয়স্পর্শী বর্ণনার এ-উপন্যাসে কখনো মনে হয় – নায়ক আসলে কে? সান্তিয়াগো, নাকি সমুদ্র?  বাংলাদেশ সমুদ্র-উপকূলবর্তী ভূভাগ হওয়ায় বাঙালির মৎস্য শিকারের ঐতিহ্য অনেক পুরনো, কিন্তু আমাদের সাহিত্যে মাছ শিকার-কেন্দ্রিকতা বা এ সংক্রান্ত দার্শনিকবোধ প্রাধান্য পায়নি। সম্ভবত সেলিম আল দীনের স্বর্ণবোয়াল নাটকই প্রথম মৎস্যশিকার-নির্ভর সাহিত্যকর্ম। সেলিম আল দীন এ-নাটকে বাঙালি সংস্কৃতি ও বাঙালির জীবন দর্শনের উদ্ভাসন ঘটিয়েছেন। নাটকটির শেষে এসে শিকার আর শিকারি কেউ কাউকে যেন হারিয়ে দিতে চায় না। বাঙালির সাধনায় হারজিতের উপস্থিতির এ এক চিরায়ত রূপ। সেলিম আল দীন এ-নাটকে মেছো বাঙালির জীবনদর্শন খুঁজে ফিরেছেন। নাটকটি ২০০৭ সালে প্রকাশিত হয়। সম্প্রতি লন্ডনের গোল্ডস্মিথস ইউনিভার্সিটির থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স বিভাগের মাস্টার্স পাঠ্যসূচিতে নাটকটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

বাংলা নাট্য-আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব সেলিম আল দীন (১৯৪৯-২০০৮) চাইতেন, উপনিবেশের জ্ঞানতত্ত্ব ইতিহাসকে প্রত্যাখ্যান করে হাজার বছরের ঐতিহ্যের ধারায় বিকশিত হোক, ঐতিহ্যবাহী নাট্যরীতিগুলি আধুনিকতায় উদ্ভাসিত হোক। সে পরিপ্রেক্ষিতে নিজের রচনায় ইউরোপীয় রীতিকে পরিত্যাগ করে কথাসরিৎসাগর কিংবা মঙ্গলনাট-পালার রীতি গ্রহণ করেছিলেন। তিনি নন্দনতাত্ত্বিক মূল্যবোধে বাংলা রীতিকে অদ্বৈতবাদী রূপের বলে তুলে ধরেছেন।

নৃত্য-গীত-বর্ণনা-সংলাপ যেখানে একাকার। সাহিত্যে উপনিবেশের জনরাকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। স্বর্ণবোয়াল নাটক সম্পর্কে সেলিম আল দীন বলেন, ‘ঐতিহ্যবাহী বাঙলা নাট্যমাত্রই উপাখ্যানের আঙ্গিক। … বাঙালির পাঁচালির ধারাটাকে আমরা আধুনিকের সমমানতায় পৌঁছে দিতে চাই বলে এর গঠনগত বিষয়টাকে গদ্যছদ্মবেশী কাব্যে এবং এর মানব ভাবনার আদর্শগত দিকটিকে আধুনিক কালের স্থলে বিন্যাস করতে চেয়েছি।’

স্বর্ণবোয়াল নাটকের আখ্যানভাগ জুড়ে আছে বেউলার বিলের পাশের মৎস্যজীবী জীবন। তিন গ্রামজুড়ে একটিই বিল। আর যমুনার শাখা চিরলি গাঙ। স্বর্ণবোয়াল কী একটা গল্প? স্বর্ণবোয়াল একটি কিংবদন্তি। ছাতিম গাছের সমান বয়স স্বর্ণবোয়ালের। এ-স্বর্ণবোয়াল তিরমনের দাদা জনম মাঝিকে বড়শিসহ ডুবিয়ে মেরেছিল চিরলির অতলে। তিরমন কিংবা খলিশা মাঝি বারবার মাছ ধরতে গিয়ে বড়শি বা জালে কোনো কিছু আটকা পড়লেই চিৎকার করে ওঠে ‘স্বর্ণবোয়াল’ বলে। নাটকে আছে খলিশা মাঝি। তার পিতা জনম মাঝিকে আমরা নাটকে পাই না। কিন্তু তার মাছ শিকারের কাহিনি শুনি। খলিশা মাঝি জাত মেছো। সেরা শিকারি। পানির স্রোতের গন্ধ শুঁকে সে বলে দিতে পারে মাছের গতিপথ। বেউলা বিলের কত রহস্যই তার জানা। খলিশা মাঝির ছেলে তিরমন। সেও জানে কীভাবে স্বর্ণবোয়াল শিকার করতে হয়। সে জানে সাঁঝমালাকে। কীভাবে স্বপ্নের সোনারঙা স্বর্ণবোয়াল ধরা দেয়। সাঁঝমালা একেস্বরা। কথা বলে না। একসময় সে সারাক্ষণ কথা বলত। এমনকি হাঁসের ঝাঁক কিংবা গরুদের সঙ্গেও। এখন শুধু হাসে। বাবা-মাহীন এ-মেয়েটিকে যেন ছাতার সুরক্ষা দিয়ে তিরমন পৌঁছে দিতে চায় দূর সুন্দরে। সাঁঝমালা যেন বোঝে স্বর্ণবোয়ালের রহস্য।

মালেক মাঝি সমুদ্রভ্রমণ শেষে ফিরে আসে; ভালোবাসে নিজের সৎ বোন নুরুন্নাহারকে। নায়েবালির পালার পরতে পরতে তা যেন শোকে রূপ নেয়। নায়েবালি মাঝি ঘুরে বেড়ায়, যে স্বর্ণবোয়াল শিকার করবে, তার জন্য গীত রচনা করবে বলে। তিসি যেন মানুষরূপী শকুনের দেহক্ষত বয়ে নিয়ে বেড়ায়। তিরমন আর সাঁঝমালাা বিয়ের কান্না যেন বিলের জলে ভেসে বেড়ায়। প্রান্তিক এ-জীবনে আমরা সবাই তো স্বর্ণবোয়ালের পেছনে ছুটে মরছি। মিছে মায়ায়, মিছে আশায়। শিকার ও শিকারি যেখানে এক অদ্বৈত নিখিল সুরে গাঁথা।

সুদীপ চক্রবর্তী-নির্দেশিত স্বর্ণবোয়াল নাটকটি গত ১৮ই ফেব্রুয়ারি শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল মঞ্চে প্রদর্শিত হয়। প্রযোজনা করেছে থিয়েটেক্স। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সনদপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা গঠন করে নাট্যদল থিয়েটেক্স। থিয়েটেক্স ইতোমধ্যে কবর, দক্ষিণা সুন্দরী প্রভৃতি প্রযোজনা দিয়ে নাট্যাঙ্গনে আলোচিত হয়ে উঠেছে। এবার চতুর্থ প্রযোজনা হিসেবে বেছে নিয়েছে সেলিম আল দীনের স্বর্ণবোয়াল। এটি নির্মাণে আর্থিক সহায়তা করেছে ব্রিটিশ কাউন্সিল ও মঙ্গলদ্বীপ ফাউন্ডেশন। নাটকটির উপস্থাপনায় সুদীপ চক্রবর্তী আবহমান বাংলার নাট্যরীতিকে গ্রহণ করেছেন। চারদিকের দর্শকবেষ্টিত মঞ্চ। নানা ফোক উপকরণে বিন্যস্ত। ফোক মোটিভ নানাভাবে বিভক্ত। নাটকটি শুরু হয় নান্দীপাঠের মধ্য দিয়ে। প্রাচীন ভারতে নাটকের শুরুতে নান্দীপাঠ অবশ্যকরণীয় ছিল। প্রাচীন বাংলা অঞ্চলের নাট্যবৈশিষ্ট্যেও নাটকের শুরুতে বন্দনা যুক্ত থাকত। এ বন্দনা এক ধরনের ভূমিকা। মধ্যযুগের পালা-কীর্তন কিংবা পাঁচালি ধারাতেও বন্দনা যুক্ত থাকত। সেলিম আল দীন স্বর্ণবোয়াল নাটকেও নাট্যবন্দনা করেছেন। এ বন্দনায় বাল্মীকি, হোমার, ব্যাসদেব, ফেরদৌসী প্রমুখ মহান লেখকের ধারায় রচনা কামনা করে ঈশ^রের করুণা প্রার্থনা করেছেন। প্রকৃতি ও প্রাকৃতজনের ঘটনা এই কাব্যে অপূর্ব পদবন্ধে বিবৃত ও দৃশ্যমান করতে পারার জন্য ঐকান্তিকতা ব্যক্ত করেছেন। সুদীপ চক্রবর্তী-নির্দেশিত নাটকে মঞ্চে নাট্যবন্দনা পাঠ করেন অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর। প্রাচীন পাণ্ডুলিপির লেখরেখার মতো গ্রন্থ থেকে পাঠ করতে থাকেন। আর কোরিওগ্রাফির মাধ্যমে সে অনুভবের নৈর্ব্যক্তিক রূপ দৃশ্যগ্রাহ্য হয়ে উঠতে থাকে। অতঃপর বর্ণনা ও নৃত্যগীতের মধ্য দিয়ে নাটকের আখ্যানভাগে প্রবেশ।

অপরদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের নাটক ও  নাট্যতত্ত্ব বিভাগ শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রযোজনা করেছে স্বর্ণবোয়াল নাটকটি। নির্দেশনা দিয়েছেন বিভাগীয় শিক্ষক ইউসুফ হাসান অর্ক। এ প্রযোজনাটি প্রথমে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের নাটমঞ্চে প্রদর্শিত হয়। তারপর গত ২০শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল মঞ্চে প্রদর্শিত হয়। এই বিশ^বিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন নাট্যকার সেলিম আল দীন। ফলে এ বিভাগের অধিকাংশ শিক্ষকই সেলিম আল দীনের সরাসরি ছাত্র। সেলিম আল দীনের নাট্যদর্শনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত। নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ঐতিহ্যবাহী নাট্যধারার চর্চাকে আদর্শ মনে করে আসছে। এ বিভাগ নানা প্রযোজনা নিয়ে প্রতিনিয়ত দর্শকের সামনে দাঁড়াচ্ছে। এবার চূড়ান্ত বর্ষের শিক্ষার্থীদের প্রযোজনা এ-নাটক। নাটকটি শুরু হয় মাছ শিকারের আবহের মধ্য দিয়ে। এটি এরিনা মঞ্চের মতো হলেও তিনদিকে দর্শক বসা। একপাশে কালো পর্দায় মাছের নানা প্রতীক। মঞ্চটিই যেন মাছ শিকারের জলাভূমিতে রূপান্তরিত হয়ে উঠেছিল। তারপর বন্দনা-নৃত্য ও গীত, কোরিওগ্রাফির মধ্য দিয়ে নাটকের শুরু হয়। এ-নাটকে এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে ফোক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়নি। এখানে দৃশ্যের পরম্পরায় ফুটে উঠেছে নিকারি বা জেলেকেন্দ্রিক বিস্তীর্ণ পটভূমি। এখানে বাস্তব জীবনের রূপ-রং, মানবিকতা, প্রেম, রূপ-আঁধারের খেলা। স্বর্ণবোয়াল নাটক জলবাসের কিংবদন্তি। জনম মাঝিকে জীবন দিতে হয়েছিল এই জলবাসের কারণে।

– বাজান। গাঁথছি রে। স্বর্ণবোয়াল।

– ও বাজান, এ যে সোনাবরণ স্বর্ণবোয়াল। বিশাল। বিশাল। হা হা হা।

ততক্ষণে ডিঙা নৌকাটা বেউলা বিলের মধ্যভাগ থেকে খালের দিকে যাত্রা শুরু করেছে। অদৃশ্য কোনো শক্তির টানে।

– স্বর্ণবোয়াল বাজান। লিঙ্কত কাকা কয়াছিলেন এই বোয়ালের কিস্সা। এই পইলা দেখলাম তারে। হায় মুর্শিদ।

– বাজান কোই চলছ।

– আলো কইরা আছে পানির তল। সোনার বরণ বাজান। সে ই টানতাছে।

– হা হা। জয় মুর্শিদ। তবে কোই সে নিবে আমারে। নে নে। দেখি শক্তি তোর। হা হা হা।

সে হাসি ভোর দিগন্তে উড়াল পাখির ডানা পেয়ে যায়।

তিরমনের দাদা খলিশা মাঝির বাবা জনম মাঝি ফিরে আসেনি। পরে ছিপ বড়শি পাওয়া গিয়েছিল ভাটিতে। স্বর্ণবোয়াল তাকে টেনে নিয়ে গেছে পাতালের কোন রহস্যের দেশে কে জানে। সে-কথাই যুগ যুগ ধরে ভাসে নিকারিপাড়ার মানুষের মুখে মুখে।

আখ্যানভাগের দৃশ্য রূপায়ণে দুটো প্রযোজনার মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ ও শিল্পবোধ কাজ করেছে। মাছ শিকারের দৃশ্যগুলি দুটো প্রযোজনায় নাটকের ভিন্ন অর্থ তৈরি করেছে। সাঁঝমালা ও তিরমন ইউসুফ হাসান অর্কের প্রযোজনায় অত্যন্ত স্পর্শকাতরতায় উপস্থাপিত হয়েছে। এ চরিত্রদ্বয়ে ইউসুফ হাসান অর্কের নির্দেশনায় প্রাধান্য পেয়েছে প্রেমের সৌন্দর্য আর সুদীপ চক্রবর্তীর নাটকে প্রতিভাত হয়েছে শারীরিক ব্যাকুলতা। সাঁঝমালাকে খুঁজে পাওয়ার পর তিরমন যখন দেখে সোনা ব্যাঙের যুগল দৃশ্য, তখন এক আবেগী সৌন্দর্যে তিরমন ও সাঁঝমালা বিভোর হয়ে পড়ে। থিয়েটেক্সের মঞ্চে – তিরমন ও সাঁঝমালা চোখে চোখে বিনিময়ে কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। নৃত্য-গীত ও আবেগীয় আঁধারে বৃষ্টিধারা-আকাশ, শরীরের সঙ্গে শরীর। আবেগিক এক পর্যায়ে কথক বলে ওঠে – ‘তিরমন মাছ শিকারির হাত – ধাবমান চিতলের পেটের ভেতর তীক্ষè টেঁটা দিয়েছে বিঁধিয়ে।’ সাঁঝমালা ও তিরমনের মিলনের এ-দৃশ্য যেন দর্শককে আন্দোলিত করে তোলে। অপরদিকে ইউসুফ হাসান অর্কের নির্মাণে সাঁঝমালার গায়ের লাল রং যেন আলাদা জ্যোতি ছড়ায়। ঘনিষ্ঠ দুজন তখন। আলো-সংগীতের অনবদ্যতায় যেন আবেগ-প্রেম-সৌন্দর্য এক সুরে ধরা দেয়। শৃঙ্গার ও নৃত্যের বিভিন্ন স্থির ভঙ্গিমায় যেন রূপকল্প শিল্পকুশলে ফুটে ওঠে। শেষে তিরমন নিজেকে অপরাধী মনে করলে সাঁঝমালা যেন বলতে চায় – কী ভালা তুমি। তখন যেন শিল্পসৌকর্যের অনন্যতায় প্রেমের সৌন্দর্য রূপলাভ করে। সাঁঝমালা এক রহস্যময় চরিত্র।

বাবা-মা ওলাওঠায় যেদিন মারা যায়, সেদিন থেকেই সে বোবা হয়ে গেছে। কারো সঙ্গে কথা বলে না। স্বর্ণবোয়ালকে সে যেন জানে। তিরমনকেও স্বর্ণবোয়াল শিকারে উদ্বুদ্ধ করতে চায়। তিরমনের সঙ্গে বিয়ের কথা হলেই সে পেঁটরা নিয়ে তার ঘরে চলে যেতে চায়। নাটকজুড়েই নিকারিদের জীবনসংগ্রাম, স্বর্ণবোয়ালের কিংবদন্তি আর সাঁঝমালা-তিরমনের আবেগ – 

– জুনি পোকা ধইরা দিমু।

– হি হি হি।

– তবে … গাছের আঠায় বনের লতায় জোনাক আটকায়া একখান মালা পরায়ে দেই তরে। জ¦লবে গলায় মিটমিট।

– হি হি হি হি হি।

– তুই কি তবে সংসারে বান্ধা পড়বি না। এই যে বাঁইচা আছস, এই যে সোন্দর শাড়িখান, চুলে গন্ধতেলের সুবাস, হাতে মালতির ফুল আর কিছু চাই না তর।

– হি হি হি হি।

– সেই স্বর্ণবোয়ালের কথা যদি সত্য হয়, যদি আমি তারে শিকার করতে পারি, তবে কি তুই আমার ঘরে আসবি।

– আমি তরে বিয়া কইরা বান্ধুম ঘর। সেরা মাছ শিকার কইরা সেরা মাঝির নাম কুড়ামু। কামরাঙা হার পরামু তোর গলায় রে সাঁঝমালা।

সুদীপ চক্রবর্তীর নাটকে প্রধান চরিত্র মাছ – স্বর্ণবোয়াল। স্বর্ণবোয়াল চরিত্রে অভিনয় করেছেন অমিত চৌধুরী। এ নাটকে সাঁঝমালা অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার অধিকারী। সাঁঝমালা ও স্বর্ণবোয়াল এক সুতোয় বাঁধা। তিরমন যেন তারই সাধনায় লীন। বোয়ালটিকে যেন কূলের তিরতিরে জলে টেনে আনলে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে চারদিক। কিন্তু না, স্বর্ণবোয়াল ধরে নিয়ে যায় গগনধুলার প্রান্তরে। সুদীপ চক্রবর্তীর ভাবনায় হেমিংওয়ের প্রভাব বিদ্যমান। তিনি স্বর্ণবোয়ালকে যেন হেমিংওয়ের মতোই দেখতে চান। পালাকার নায়েবালির সেই উক্তি ‘হারজিৎ বলে কিছু নাই, সাধন থাকলে হারও লাগে না জিতও লাগে না।’ সুদীপ এ-নাটকের একজন শিল্পীর শিল্পজীবনের চরম আকাক্সক্ষাকেই খুঁঁজে ফিরতে চেয়েছেন।

ইউসুফ হাসান অর্কের নাটকে মানুষই প্রধান। যে-মানুষগুলি স্বর্ণবোয়াল ধরার খোয়াবে বিভোর। জাতিপরম্পরায় তিরমনের মনেও বুনে দিয়েছে সেই স্বর্ণবোয়ালের নেশা। তিরমন উপলব্ধি করে জীবনের অপ্রাপ্তি ও প্রাপ্তির হিসাব কতটা তুচ্ছ। অনুভব করে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির চিরন্তন গণিতে মানবসভ্যতার বয়ে চলা বোধিসত্ত। রূপক উপমার মানবসত্তার সীমানা পেরিয়ে স্বর্ণবোয়াল একটা চিরন্তনী রহস্য।

সুদীপ চক্রবর্তীর চরিত্র নির্মাণে সাঁঝমালা যতটা না বাস্তবিক তার চেয়ে বেশি কাল্পনিক। অপরদিকে ইউসুফ হাসান অর্কের সাঁঝমালা যেন জীবনগন্ধী। থিয়েটেক্সের সাঁঝমালা চরিত্রে অভিনয় করেছেন সায়মা আক্তার। অপরদিকে ইউসুফ হাসান অর্কের প্রযোজনায় সাঁঝমালা চরিত্রে অভিনয় করেছেন স্নেহা কওকাব। সায়মা আক্তারের গায়ে বিশেষ ধরনের কামিজ। তার ওপর কালো কাপড়। স্থান-কালহীন একটা সাজেস্টিক রূপ তাঁর পোশাকে। অপরদিকে স্নেহা কওকাবের উজ্জ্বল লাল রঙের শাড়ি টাইপের পোশাক। নৃগোষ্ঠী নারীরা যেমনটা পরিধান করে। ইউসুফ হাসান অর্কের প্রযোজনায় তিরমন চরিত্রে অভিনয় করেছেন কনোজ কান্তি রায়। গায়ে উজ্জ্বল রঙের লুঙ্গি ও কোমরে গামছা বাঁধা। আর থিয়েটেক্সের তিরমন চরিত্রে রুদ্র সাওজাল বিশেষ ধরনের পোশাক ও গায়ে আলাদা কাপড় জড়ানো।

সুদীপ চক্রবর্তীর নাটকে বর্ণনার সঙ্গে আছে চরিত্রাভিনয়।

স্থান-কাল অতটা গুরুত্ব নেই। বিশিষ্ট দুটো চরিত্র আনা হয়েছে। শুরুতে আসাদুজ্জামান নূর ও শেষে মঙ্গলবাক্যে ওয়াহিদা মল্লিক জলি। আর ইউসুফ হাসান অর্কের নাটক বাস্তববাদী; বর্ণনাত্মক অভিনয়রীতিতে বাস্তববাদী অভিনয়। স্থান-কাল গুরুত্ব পেলেও নানা জীবনাভিজ্ঞতার নির্যাস রয়েছে। শিক্ষার্থী অভিনেতাই অভিনয় করেছেন। সুদীপ চক্রবর্তীর নির্মাণে ফোকনির্ভর নৃত্যগীত, কোরিওগ্রাফি এবং কখনো কখনো চরিত্রাভিনয় প্রাধান্য পেয়েছে। আর ইউসুফ হাসানের নিদের্শনায় গীত-আখ্যান ও বর্ণনাত্মকরীতির সঙ্গে চরিত্রাভিনয়ের মিশেল রয়েছে। ইউরোপীয় নাট্যরীতির বৈশিষ্ট্যের মতো তা অনেকটা দ্বান্দ্বিক।

সুদীপ চক্রবর্তীর নাটকে নাট্যিক মুহূর্ত তৈরির চেয়ে ডিজাইন বা বিন্যাসটা বেশি চোখে পড়ে। মাছ বিক্রির দৃশ্যসহ নানা দৃশ্যেই ফোক মোটিফকে প্রাধান্য দিয়েছেন। বক্সসেট এবং সেটের নানা রকমের ব্যবহার হয়েছে। মাছগুলি কাগজে ছাপা। অপরদিকে ইউসুফ হাসান অর্ক বাস্তবের কাছাকাছি যেতে চেয়েছেন। সপ্রাণ নাট্য মূহূর্ত তৈরিতে তিনি বেশি তৎপর ছিলেন। মাছগুলি সাজেশনে উপস্থাপন করেছেন। বাস্তবতার সঙ্গে নৈর্ব্যক্তিক রূপকে প্রাধান্য দিয়েছেন। সুদীপ চক্রবর্তীর নাটকে শিকারের দৃশ্যগুলি অনবদ্য ও বিমোক্ষণ তৈরি হয়েছে। অপরদিকে ইউসুফ হাসান অর্ক ঐতিহ্যবাহী জীবনচিত্র রূপায়ণে তৎপর বলে মনে হয়েছে। শিকারের দৃশ্যগুলি কোরিওগ্রাফির মধ্য দিয়ে নান্দনিকতায় নির্মিত। কখনো কখনো প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে স্বর্ণবোয়াল আসলেই সত্যি কি না? তিরমনের বাবা খলিশা মাঝির সঙ্গে কথা হয় –

– তা তুই কী কস। স্বর্ণবোয়াল এটা গল্প  – সত্য কিছু না। আমি সূর্য-চন্দ্রের নাহান তোমারে বিশ^াস করি বাজান।

– মনে কর – গাভির সমান হেই চিতল মাছটার কথা। পুবে-পশ্চিমে কোনো গেরামে না জানে।

– হ বাজান। মাও এখন হেইনা মাছটার কিস্সা হুনায়। মাছটা দেখি নাই। তবে মা জননী কইছেন – ওই এক চিতল মাইরা তর বাপে ওই যে পালান  – তার বন্ধক ছুটাইছিল। আর দশ গেরামের লোক পায়ে হাঁইটা, কি ঘোড়ায় চইড়া দেখতে আসছিল মাছটা।

– হেমার ওপর দিয়া ছেমা পড়ে। এক বিরাট মাছ তার শিকারের অপূর্ব কৌশল আরেক মাছের আকার শিকার ভুলায়ে দেয়। আমার লাউয়ের ভিতর চিরল নদীর উজান ভাটি বাজান। আইজ মনে হইতাছে ওই তুচ্ছ মাছ চিতল গজার আধমণী কালিবাউশ  – কি গাভির হোমান চিতল। মনে হয় এই স্বর্ণবোয়াল  – এটাই মাছ আছে জগৎসংসারে।

– তা যে কেউ বিশ^াস করল না বাজান। ওই ছাতিম গাছের হোমান বয়স তোমার স্বর্ণবোয়ালের। আমার দাদা আর তুমি তার সাক্ষী। মাছটা তবে কত বড় জানি না।

নাটকের ভাষা আঞ্চলিক হলেও দর্শকদের বুঝতে কোনো সমস্যা হয়নি। দুটো নাটকই হয়েছে সংগীতনির্ভর। সুদীপ চক্রবর্তীর নাটকে ‘কোন গহীনে ফুটে চম্পা’ ফোক মিউজিক মূল সুর বা ধোঁয়ার মতোই ব্যবহৃত হয়েছে। অপরদিকে ইউসুফ হাসান অর্কের নাটকে দৃশ্য, আবেগ ও পরিবেশ বিন্যাসে সংগীত ও তার নিনাদ ব্যবহার হয়েছে। নির্দেশনা প্রসঙ্গে ইউসুফ হাসান অর্ক বলেন, ‘পথ মন্থনটাই যদি জীবন হয় তবে সে-পথটা কোন পথ! রবিঠাকুর বলেছেন সব পথই পথ, যে-পথ দিয়ে যাবেন ঠিক পৌঁছে যাবেন। যারা পৌঁছেছেন তাঁরা স্বর্ণখচিত ‘বোয়ালটা’কে নিশ্চিত দেখেছিলেন বলেই আমার বিশ^াস। যারা দেখে না, তারা দেখে নাই। এমনই এক অনুধাবনজাত বিশ^াস থেকে সেলিম আল দীনের স্বর্ণবোয়ালকে আমরা মন্থন করেছি। আমাদের প্রযোজনায় বাস্তব-বাস্তবতা, স্বপ্ন-স্বপ্নময়তা আমাদের নিমজ্জিত করেছে জীবন-সায়রের অতল গভীরে। সেখানে গীত, রূপকল্প, ভক্তি, প্রেম এক অভিনব নাট্যকল্পের উদ্ভাসনে আমাদের স্নান করায়।’

দুটো নাটকই আবহমান বাংলা নাট্যরীতির আলেখ্যে। ঐতিহ্যবাহী নাট্যরীতির ধারায় আধুনিক নাট্যভাবনার প্রয়োগ ঘটেছে নাটক দুটোতে। দুটো নাটকই নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যে প্রত্যুজ্জ্বল। ঐতিহ্যবাহী বাংলা অঞ্চলের নাটকের

নৃত্য-গীত-অভিনয়-গল্প নানা কিছু এক ঐকতানিক বন্ধনে একীভূত থাকে। দ্বান্দ্বিক পটবিন্যাসের চেয়ে জীবনের প্রাণই গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে। নাট্য প্রযোজনা দুটোই তাই।

সেলিম আল দীন বাঙালি মৎস্য জীবনসভ্যতার যে স্বরূপ খুঁজেছেন, বাঙালির নিজস্ব দার্শনিক ভঙ্গির যে অন্বেষণ করেছেন – দুটো নাটকের মধ্যেই তার অন্বেষণ আছে। গীত, গল্প, সংলাপ, অভিনয়ে অদ্বৈত দৃশ্যরূপের গভীরতায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। দুটো নাটকই বাংলা নাটকের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করে। সেলিম আল দীন চাইতেন, হাজার বছরের বাঙালির নাট্য ঐতিহ্যের বিকাশ ঘটুক। উপনিবেশের জ্ঞানতত্ত্বকে ফেলে দিয়ে নিজস্ব সুর ও স্বরে নিজস্ব নন্দনে জাগরণ ঘটুক। এ নাটক দুটো তার এক প্রচেষ্টা। নাটক দুটোর নিয়মিত প্রদর্শনী বাংলার নিজস্ব নাট্যধারাকেই আরো সুদৃঢ় করবে। আত্মপরিচয়ে উদ্ভাসিত করবে।