স্বল্পায়তন সীমায় কবিতার চলাচল

এমরান কবির নানামুখী লেখালেখির সুবাদে পাঠকের কাছে পরিচিত। এ-পর্যন্ত তাঁর তিনটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম কবিতার বই কী সুন্দর মিথ্যেগুলো। তারপর পালকভরা সূর্যাস্ত এবং পাখির ঠোঁটে দাগ। সাম্প্রতিক কবিতার বই আমাকে হত্যার পর জেগে ওঠে চাঁদের শহর। এক ফর্মার একটি বই। মাত্র এগারোটি কবিতা রয়েছে এতে। কবিতাগুলির ভাব, ভাষা ও বৈচিত্র্যের চমৎকার উপস্থাপনে পাঠক মুগ্ধ হবেন। এমরান কবিরের কবিতার মনোযোগী পাঠকরা লক্ষ করবেন, তাঁর কবিতায় রয়েছে নানা বিষয়ের সমাহার। তিনি কবিতায় ঐতিহ্য বজায় রাখেন, লুকিয়ে রাখেন নানা রূপকল্প ও গল্পকথা, ছড়িয়ে রাখেন দর্শনের প্রভাব। তবে তা দম-আটকানো নয়, পাঠককে বিব্রতও করে না।

নানামুখী শব্দের সমাহার ঘটে তাঁর কবিতায়। সেখানে তিনি যেমন ছন্দের ব্যবহার করেন, তেমনি ছন্দহীনতাকেও কাজে লাগান। রূপকল্পেরও নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। তবে তা কখনোই রোমান্টিকতাকে উপেক্ষা করে নয়।

আমাকে হত্যার পর জেগে ওঠে চাঁদের

শহর-এর কবিতাগুলিতে যতিচিহ্নের আধিক্য কম। এমরান পাঠককেই সুযোগ দেন নিজের সুবিধামতো বিরতি নিতে, কবিতার অর্থ ও অনর্থ কিংবা হৃদকথন উদ্ধারে।

`সবুজ সবুজ ঢেউয়ের মাঝে/ নীল টুকটুক নীল/ নীলে নীলে ঝিলের মাঝে/ জোসনা-ভেজা তিল/ তিলের ভেতর বিলের ভেতর/ গোলাপমাখা কুঁড়ি/ কুঁড়ির বেশে সর্বনাশে/ আমরা দু’জন উড়ি।’ (‘বাসর-তিন’)

এমরান কবিরের প্রধান বৈশিষ্ট্য আবেগের সঙ্গে রূপকল্প ও চিত্রকল্পের মিথস্ক্রিয়া। তাঁর কবিতায় নেই শিথিল পঙ্ক্তিবিন্যাস বা অসংলগ্নতা। কবিতার ভাব বিন্যাসে যে পরম্পরার কথা বলা হয় এবং পরিণতির জন্য যে-গতির কথা বলা হয়, তা এমরান  কবিরের কবিতায় যথার্থভাবে উপস্থাপিত হতে দেখা যায়। যে-উৎসাহ নিয়ে তিনি লিখতে শুরু করেন, ভাবের সেই সাযুজ্য ধরে রাখেন।

তাঁর কবিতায় রূপকল্প ও চিত্রকল্পের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় কোনো কিছু বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। তিনি অবিচল থাকেন বর্ণনায়। একদম শুরুতে, তাঁর কবিতায় যেভাবে অপ্রচলিত শব্দের দেখা মিলত, সে-পথ থেকেও তিনি সরে এসেছেন।    

`সহস্র বছর আগে, এই দিনে/ তুমি আমি নিলাম চিনে/ আকাশে আকাশে পাতাবাহারের রঙ,/ পাখি উড়ে হাওয়ার সাথে/ রাতে রাতে সজল জোনাক/ বহুদূর হাঁটার পর/ জীবনের তুমুল অবসর/ তখন/ এই সব কলরব গান শোনাক।’ (‘বাসর-এক’)

এমরান কবিরের কবিতা সব সময়ই নাগরিক ও আধুনিক। মিশ্রছন্দের ভঙ্গিকে রপ্ত করেও তিনি সতর্কতার সঙ্গে সৃজনশীলতার আশ্রয় খোঁজেন।

`সমুদ্রের পাশে গিয়ে দাঁড়াই/ কেন যে এত নীল!/ অথচ সরাইখানার পাশে যে কাশবন থাকে/ তারাও বিষয়টি জানে/ কেবল আমার কাছেই তা নীলবর্ণ পাখির মতো পরিহাস/ দেখি আমি/ ভাবি আমি/ যা কিছু নীল, তা থেকে জন্ম নিচ্ছে কিছু চন্দ্রবিন্দু/ যা কিছু ঘুড়ি, তা থেকে জন্ম নিচ্ছে কিছু মেঘ/ যা কিছু মেঘ, তা থেকে জন্ম নিচ্ছে কিছু নদী/ ছাতার ভেতরে মেঘ চলে যায়/ বৃষ্টি চলে যাচ্ছে, চলে যায়

নেট-দুনিয়ায়/ অজস্র উড়াল শেষ, দেখো,/ একেকটি মানুষ কীভাবে নীল হয়ে যায় …’ (‘সমুদ্রে একদিন’)

আলোচ্য বইয়ে এমরান কবিরের প্রধান অভীষ্ট ছন্দ। তবে ছন্দের ভাবনা এক্ষেত্রে স্থিতিশীল নয়। মাত্র এক ফর্মার ভেতরে পয়ার এবং অক্ষরবৃত্তকে প্রাধান্য দিলেও তিনি মিশ্রছন্দের রূপও দেখিয়েছেন। অন্ত্যমিল দেওয়ার ক্ষেত্রেও দেখিয়েছেন নৈপুণ্য।  আছে স্বরবৃত্ত ছন্দের কবিতা। সেখানেও তিনি স্বচ্ছন্দ।