স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী : স্বপ্ন সাধনা সংকট

বাংলাদেশ একটি স্বপ্নের নাম। বহু মানুষের স্বপ্নসাধনার ফসল এই বাংলাদেশ।

যদি প্রশ্ন ওঠে কার স্বপ্ন? তবে হাতের কাছে উত্তর মিলে যায়, সেইসব মানুষের যাঁরা এর জন্যে আন্দোলন চালিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধ করেছেন।

একটু গুছিয়ে বলা যায়, সেই বায়ান্ন থেকে যে ভাষার লড়াই, চুয়ান্নতে দ্বিজাতিতত্ত্বের রাজনীতির প্রত্যাখ্যান, বাষট্টির গণতান্ত্রিক শিক্ষার আন্দোলন, ছেষট্টির ছয়দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি, আটষট্টির সাংস্কৃতিক স্বাধিকারের সংগ্রাম, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের ঐতিহাসিক নির্বাচনী রায়, একাত্তরের অসহযোগ ও মুক্তিযুদ্ধ – এসবের ধারাবাহিকতায় এসেছে স্বাধীনতা, ঘটেছে স্বপ্নসাধের পূরণ। দীর্ঘ চব্বিশ বছরের বন্ধুর পথপরিক্রমায় কত মানুষ পথে নেমেছেন, পরস্পর কাঁধ মিলিয়েছেন, কারাবরণ করেছেন, নির্যাতন সয়েছেন, জীবন বিলিয়েছেন অকাতরে, তার কোনো হিসাব আছে?

বাংলাদেশ অযুত মানুষের দান। কিংবা বলা যায়, অসংখ্যের এক স্বপ্নময় নির্মাণ।

এই অসংখ্য অযুত জন কারা? কতজন?

ইতিহাসের যে চুম্বক-ছক এঁকেছি, কেবল কি এইসব ঐতিহাসিক মাইলফলকের নির্মাতা, অনুসারী ও নেতার অবদান এ-স্বাধীনতা? অথবা যেভাবে প্রায়ই উচ্চারিত হয় – একি শুধু সেই একাত্তরের দামাল মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরবময় সৃষ্টি? অথবা একি বারংবার উচ্চারিত সেই ত্রিশ লাখ শহিদের ত্যাগের ফসল? নাকি লক্ষ নারীর লাঞ্ছনার বিনিময়ে লব্ধ মহার্ঘ্য সম্পদ? কিংবা ধ্বংস ও হত্যার মুখে দেশান্তরী কোটি শরণার্থীর ত্যাগের ফসল? কেবল কি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, বর্তমান বাংলাদেশের সীমাভুক্ত স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকামী লড়াকু মানুষদের ধারাবাহিক যৌথ অর্জনের ফল?

দুই

প্রশ্ন আমাদের ইতিহাসের মুখোমুখি করে, আমাদের অব্যক্ত আবেগ ও স্বপ্নের স্ফূর্তিকে ভাবনায় চালিত করে। আমরা বলি, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এই বাংলার স্বাধীনতা এসেছে। পিঠোপিঠি অনুক্ত আবেগ হলো – এক আকাশ স্বপ্নের বিনিময়ে মিলেছে এমন স্বাধীনতা।

আবেগ অতল। স্বপ্ন অসীম। তাতে দানা বাঁধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। বাস্তবের মাটি ছুঁয়ে তথ্যনির্ভর ঘটনা-নির্যাসে তৈরি ইতিহাস কি পায় আবেগের তল, স্বপ্নের সীমা, চেতনার গভীরতা? সন্দেহে দুলে ওঠে মন, কারণ কীভাবে মাথা তোলে স্বার্থের ক্ষুধা, কীভাবে আবেগের অবাধ প্রবাহকে ব্যক্তি তার স্বার্থের গণ্ডিতে বাঁধে, কীভাবে স্বপ্নের অগাধ মুক্ত বিস্তার আর চেতনার সুস্পষ্ট প্রত্যয়কে বদ্ধমূল বিশ্বাস ও সংস্কার ক্রমে ক্ষয় করে, সে তো ইতিহাসের প্রত্যাঘাতে ভালোই জেনেছে মানুষ। বাস্তবকে এড়িয়ে চলা যায় না, যায়নি।

অথচ স্বাধীন বাংলাদেশ কেবল মুক্তিযোদ্ধা, সংগ্রামী রাজনীতিক, লড়াকু কর্মী, উদ্দীপ্ত তরুণ-তরুণী, সচেতন নাগরিকেরই আরাধ্য ছিল না; কেবল চুয়ান্ন হাজার বর্গমাইলেই সীমাবদ্ধ থাকেনি এ-আবেগ। যে-মানুষ জীবিকার সূত্রে পশ্চিম পাকিস্তানে বাস করছিলেন এই স্বপ্নের আবেশ আর যুদ্ধের তাত তাঁকেও স্পর্শ করেছিল। তাঁদের অধিকাংশের জীবন কেটেছে চরম উৎকণ্ঠায়। দুর্বহ বন্দিদশায়। অনেকেই স্বাধীনতার দুর্বার স্পৃহায় ঝুঁকি নিয়ে অনিশ্চিত পথ পাড়ি দিয়ে যোগ দিয়েছিলেন যুদ্ধে।  স্বাধীন দেশের স্বপ্নে এঁরাও কম তাড়িত ছিলেন না।

যে-মানুষ দেশবিভাগের বলি, নাড়ির বন্ধন কেটে ছিটকে পড়েছিলেন দূরে, যার অনিচ্ছা অসহায়তাকে সেদিন তোয়াক্কা করেনি ইতিহাস, যার বুকে স্বদেশ অবিচ্ছিন্ন রক্তপাত ঘটানো এক গভীর ক্ষত, যার হৃদয়ে ইতিহাস যুগপৎ ব্যঙ্গ ও বেদনার হাহাকার তোলে তার স্মৃতিতে সত্তায় বেদনায় গড়া স্বপ্নের নাম স্বদেশ – হারানো স্বদেশ। সে যেখানে থাকুক, তার বাস্তবতায় আজ এদেশ যত অবাস্তব হোক, যত দূরের হোক, তবু স্মৃতি চিরজাগরূক। স্মৃতি যে সর্বংসহা। সব সয়ে মুখর করে তোলে স্বপ্ন। স্বপ্ন যে বড় সহজে তামাদি হয় না। বাংলাদেশ তারও স্বপ্নের দেশ।

শুধু তারই বা কেন বলি, যেখানে বাংলাভাষী ছিলেন একাত্তরে, তাঁরই হৃদয়ে বাংলাদেশ কাঁপন তুলেছিল। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম এবং দূর প্রবাসে যেখানে যে বাস্তবতায় ছিলেন, তাঁর অন্তর উৎকর্ণ হয়েছিল বাংলাদেশের হৃদয় হতে জননীর কোন বারতা এসে পৌঁছোয় তার জন্যে। তাঁর হৃদয়েও ধ্বনিত হয়েছিল জয় বাংলা, তাঁরও সমস্ত সত্তা আন্দোলিত হয়েছে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু নিনাদে। সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের আবেগ আর স্বপ্নে তাঁরাও তো আন্দোলিত হয়েছেন।

তাই বলি, বাংলাদেশ স্বপ্নের দেশ। বহুজনের বড় সাধের ধন। অপরিমেয় ভালোবাসা, পরম বেদনা, মহান জাগরণ-বীরত্ব-ত্যাগ, উৎকণ্ঠিত দীর্ঘ প্রতীক্ষা, অপ্রতিরোধ্য প্রত্যাশায় জন্ম এই দেশের। জন্মমুহূর্তে এতো মানবলগ্নতা এতো আন্তরিকতা যেন বাংলার চিরায়ত মানবতার বাণীরই জয়ধ্বনি তুলেছিল – এ যেন সেই বায়ান্ন থেকে একাত্তরের ধারাবাহিক তরঙ্গের তটরেখা।

তিন

স্বপ্ন তামাদি হয় না হয়তোবা, কিন্তু তেমন কারণ থাকলে ফিকে হয়ে আসে। উচ্ছ্বাসে টান পড়ে, আগ্রহে ভাটা। সেই আবেগে যখন ভাটার টান, পঁচাত্তর থেকে পঁচানব্বই পর্যন্ত রং তার ফিকে হয়ে এসেছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষ যখন খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে তখন নেতৃত্বে এলেন বঙ্গবন্ধুর দুহিতা, শেখ হাসিনা। তিনি নতুন যুগের নতুন মন্ত্র শোনালেন জাতিকে – বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের অর্থনৈতিক মুক্তির কর্মসূচি বাস্তবায়নে হাত দিলেন। ডাক দিলেন নতুন প্রযুক্তির নবতর বিপ্লবের – ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার। বাংলাদেশ অবকাঠামো, জ্বালানি, উৎপাদনে, সেবা-পরিষেবা এবং শিক্ষা-স্বাস্থ্যের উন্নয়নের পথে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে চলেছে।

উন্নয়নের এই অভিযাত্রা থেকেও আজ প্রশ্ন ওঠে, মুক্তিযুদ্ধ কি ইতিহাসের অধ্যায়মাত্র হয়ে গেল, হারিয়ে গেল তার প্রাণ ও প্রাণনশক্তি? অথচ একাত্তর ছিল ঝকঝকে অকপট সময়। খাঁটি সময়। মানুষের ভেতরকার খাঁটি মানুষটি ছাপিয়ে উঠেছিল বাহ্য দুর্বল মানুষটিকে ঝেড়ে ফেলে।

ইতিহাসের এ এমন এক ঘটনা যা কিংবদন্তিকেও হার মানায়, যেটা গর্ব করে বলার বিষয়, নিছক তথ্যের চেয়ে অনেক বড়। কিংবদন্তির বাড়া। ঘরকুনো বাঙালি মাটি আঁকড়ে পড়ে পড়ে মার খেয়েছে চিরকাল – এতোদিন এটাই হয়ে উঠেছিল তার পরিচয়। কিন্তু একাত্তরে তার রূপান্তর ঘটেছিল, সেসব নিন্দা-দুর্নামের জবাব দিয়েছিল সেদিন।

আজ উন্নয়নের ব্যস্ততার মধ্যে আরেকবার স্মরণ করা দরকার কীভাবে একাত্তরে সেই দুর্নামের প্রত্যুত্তর দেওয়া হয়েছিল। একাত্তর বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমী বছর। বাঙালি জাতি হিসেবে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। কে যুক্ত ছিল না স্বাধীনতার এই লড়াইয়ে? যুদ্ধের আঁচ সবার গায়ে কোনো না কোনোভাবে লেগেছে। কারণ দিন যত গড়ায় একদিকে যুদ্ধের বিস্তার ঘটতে থাকে আর অন্যদিকে পরস্পরের জিজীবিষা মারণাস্ত্রের গোলারই মতো একটিমাত্র লক্ষ্যে একাগ্র হয়ে ওঠে – প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে বিজয় ছিনিয়ে আনা।

আমরা তো জানি বাঙালি যে-চেতনায় ভর করে ক্রমে স্বাধীনতার একক লক্ষ্যে উপনীত হয়েছিল তার সূচনা বায়ান্নয়, পূর্ণতা ছেষট্টিতে ছয়দফার আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর সাহসী নেতৃত্বে। ঊনসত্তরে বঙ্গবন্ধু ও দেশের মুক্তির লক্ষ্যে গণজাগরণ ও জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা, সত্তরের নির্বাচনে তার ভিত রচনা, তারপরেই লক্ষ্য অর্জনে প্রাণপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া।

একাত্তরে বাঙালির ঐক্যের বন্ধন  ও সম্মিলিত জাগরণের প্রেরণার মূল দুটি কারণ – দুই দশকের বৈষম্য ও বঞ্চনা, নিপীড়ন ও হতাশার সব বাধা ঠেলে গোটা জাতির মন জুড়ে জেগে ওঠা জলজ্ব্যান্ত স্বপ্ন – স্বাধীন স্বদেশ, যা তার কোনোকালে ছিল না; এবং দুই যুগের লড়াই-সংগ্রামে তৈরি হওয়া এক জেদ – অপশক্তির বিরুদ্ধে বিজয়, যে-কোনো মূল্যে – প্রাণের, লাখো প্রাণের, কোটি প্রাণের বিনিময়ে। এই ঐক্যের প্রেরণা ও উজ্জীবনের কাণ্ডারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।

বাস্তবে যত কঠিন ও রক্তাক্ত হোক না কেন বাঙালি মানসে এ-যুদ্ধ আত্মবিশ্বাস ও গৌরববোধের পুষ্টি দিয়েছে। মাটি কামড়ে ভিটে আগলে দারিদ্র্যে-অদৃষ্টে অভ্যস্ত গৃহী বাঙালির এ এক আশ্চর্য অভাবনীয় রূপান্তর।

সেদিক থেকে মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসের এক আশ্চর্য অবিস্মরণীয় ঘটনা। বঙ্গবন্ধু এক অত্যাশ্চর্য গণনায়ক।

চার

দ্বিজাতিতত্ত্বের ভ্রান্তি মোচন করে জিন্নাহ্ যতই আধুনিক রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন দেখুন না কেন তাঁকে হোঁচট খেতে হয়েছিল গোড়াতেই। ভাষা-সংস্কৃতির ফাঁদে পা দিয়ে তিনি যেন খুলে দিলেন প্যান্ডোরার বাক্স। জরুরি সব প্রশ্নের বান ছুটে এলো – নতুন দেশের জাতীয় সংস্কৃতির রূপ কী? কী তার উপাদান? তার গান, কাব্য, ছবি, লোকায়ত জীবন, সংস্কৃতি, আচার, ব্রত, পোশাক, কাহিনি, কিংবদন্তি, পুরাণ – কোথায়, কোনগুলো? কারা এসব ক্ষেত্রের নায়ক, মনীষী, মহামানব? সবক্ষেত্রে সীমা টানা যায় কি? মুসলমানে-হিন্দুতে ভারতে-পাকিস্তানে পার্থক্য কি সর্বাত্মক? ঢেউয়ের মতো প্রশ্নের পর প্রশ্ন আছড়ে পড়ে। দেখা গেল সদুত্তর নেই। নতুন রাষ্ট্র কেবল দ্বিজাতিতত্ত্বের আক্রমণ শানাতে কার্যকর, বিভাজনেই সিদ্ধ, কিন্তু গঠনকর্মে নয়।

পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের চিত্রকল্পের আরেকটি বয়ান হতে পারে এরকম – যেন ক্ষুধার্ত এক মাংসাশী প্রাণী তৃণভোজী এক বাছুরকে মরণকামড়ে ধরেছে। এদেশের পাটবেচা টাকায় সৌধ উঠেছে পশ্চিমে – তিন তিনটি রাজধানী গড়ে উঠেছিল। প্রতিরক্ষা থেকে স্বাস্থ্য, শিক্ষা থেকে সমবায় – সর্বত্রই দুই প্রদেশের বৈষম্য মুখব্যাদান করেছে। বাঙালির পিঠ দেয়ালে ঠেকেছে, শ্বাস ওষ্ঠাগত হয়েছে। স্বদেশের হাহাকারে সৃষ্ট জাগরণকে চাপা দিতে পাক-সরকারের দুঃশাসন একের পর এক আঘাত করেছে। তাতে বাঙালির জায়মান ঐক্য প্রসারিত ও সংহত হয়েছে আর প্রতিপক্ষকে মোকাবিলার শক্তি বেড়েছে। উত্তাল সময়ে মুজিবের সাহস, দেশ ও মানুষের জন্যে জান বাজি রেখে লড়াইয়ের অঙ্গীকার এতোটাই স্পষ্ট হয়েছিল যে, তিনিই বাঙালির অবিসংবাদী নেতা হয়ে উঠেছিলেন। এ শুধু উত্থান তো নয়, তারও চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা – তাঁর পথ ধরে এক বীর বাঙালি জাতির অভ্যুদয় ঘটল। এই হলো সেই অভাবনীয় রূপান্তরের সূচনা।

জনচিত্ত সেদিন মুজিবের হৃদয়ের সঙ্গে বাঁধা পড়েছিল। যতই ষড়যন্ত্র হোক, বাংলার মানুষ ততোদিনে সতর্ক, সম্মিলিত, সংগ্রামী। তারা জনতা। তারা মুহূর্তের আহ্বানে রাজপথ কাঁপাতে পারে। উর্দির অত্যাচারের তোয়াক্কা করে না, শাসকের চোখরাঙানিকে ভয় পায় না। তারা সযত্নে লালন করছে এক মহামূল্য স্বপ্ন। স্বাধীনতার কমে তার আর তুষ্টি নেই।

একাত্তরের সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পরে স্বাধীনতা-যুদ্ধ ছিল সময়ের ব্যাপারমাত্র – প্রথম গুলিটি কে ছোড়ে তার অপেক্ষা। মাংসাশী প্রাণী স্বভাবতই মরিয়া হয়ে সর্বাত্মক শক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়বে। পড়েছেও। নির্বিকারে স্বদন্ত ফুটিয়েছে। বেপরোয়া হত্যালীলায় মেতে উঠেছিল। কিন্তু ততোদিনে বাঙালির স্বপ্ন প্রত্যয়ে রূপ নিয়েছে, মনোবল তুঙ্গে, সেও ছটফট করছিল চূড়ান্ত বোঝাপড়ার জন্যে। কী আশ্চর্য! হত্যা নিপীড়ন ধ্বংসের মধ্যেও ত্যাগ ও বীরত্বের সৌকর্যে মুক্তিযুদ্ধ যেন এক উদ্যাপন। এ-যুদ্ধ বীরের জয়গাথায় সুন্দর, অসংখ্যের নীরব আত্মোৎসর্গে মহৎ, অযুত জনের ত্যাগে পবিত্র। মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। এক ব্যতিক্রমী অনন্য উৎসব।

পাঁচ

নয় মাসের পরে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলো। রক্তাক্ত অধ্যায়ের অবসান। পাকিস্তানের কালো নেকাব সরে গেছে। এবার দেশ স্বাধীন। স্বভাবতই আনন্দ, উৎসাহ, প্রত্যাশার জোয়ার সর্বত্র। যুদ্ধফেরত মুক্তিযোদ্ধা, স্বদেশ প্রত্যাগত শরণার্থী সবার মধ্যে প্রত্যাশা ও প্রত্যয়ের ছাপ। সেই প্রত্যয় ও প্রত্যাশার আবেগ নিয়ে ফিরলেন রাজনীতিক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী। কারো মধ্যে হয়তো গেরিলার রোমান্টিক বিপ্লবী চেতনার ছাপ, কেউ ব্যক্তিগত উচ্চাকাক্সক্ষার উত্তেজনায় টানটান। কেউ দেশের কাজে আত্মনিয়োগের জন্যে উদগ্রীব, অনেকে নতুন রাষ্ট্রের ক্ষমতার প্রসাদ নিতে তৎপর।

স্বাধীনতা স্বভাবতই সুযোগের সৃষ্টি করেছে, যেমন দেশের কাজের জন্যে, তেমনি ব্যক্তিগত আখের গোছানোর জন্যে। এই টগবগে সময়ে যেমন খুলে গিয়েছিল সম্ভাবনার অসীম দুয়ার তেমনি সর্বনাশের পিচ্ছিল পথও। বীরত্বের কেবল ত্যাগোদ্দীপ্ত পিঠই সত্য নয়, ভোগলিপ্সার অপর পিঠও বাস্তব।

যুদ্ধের শেষ বাঁশি যখন বেজেছে তখন কারো যুদ্ধের নেশা মাত্র লেগেছে, কেউ দু-একটি অভিযানে অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতায় শিহরিত, কেউ শত্রু নিধনের এই অভিনব যজ্ঞে অকস্মাৎ জড়িয়ে ব্যক্তিত্বে জয়ের এক তীব্র ঝোঁক নিয়ে ফিরেছেন, কেউ প্রশিক্ষণ শেষ না হতেই যুদ্ধে যবনিকা পড়তে দেখে বুকে একরাশ অতৃপ্তি নিয়ে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন। কেউবা অস্ত্রের এবং সাহসী অভিযানের বহুতর গূঢ় ব্যঞ্জনায় বেপরোয়া হতে চেয়েছেন। রাজনীতিকদের মধ্যে অনেকেই কী পেলেন ও কী পেতে পারেন তার হিসাব মেলাতে ও কৌশল উদ্ঘাটনে ব্যস্ত হয়েছেন। আমলা ও সামরিক-কর্তাদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা, অবরুদ্ধ দেশে পাকিস্তান সরকারকে সেবাদান এবং পাকিস্তান-প্রত্যাগত – এই তিনটি উপভাগ তৈরি হয়। পঁচাত্তরের নির্মম হত্যাযজ্ঞের পরে রাজনীতির চাকা ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হলো। সমাজে বিরাজমান স্বার্থের দ্বন্দ্ব, ভাবনাচিন্তার ফারাক, পরিস্থিতি ও অবস্থানের বৈপরীত্যকে কাজে লাগিয়ে দেশকে আবার পরাজিত পাকিস্তানপন্থী রাজনীতির ধারার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা অনেকাংশে সফল হলো। রাষ্ট্র বা ক্ষমতাসীন রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতা-প্রণোদনায় ক্রমে সমাজের সব স্তরে এই বিভাজনের বিষ ছড়িয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস সময়ের বিচারে অত্যন্ত স্বল্প সময় হলেও তার মধ্যেই গল্প করার মতো এতো ঘটনা ঘটেছে যে, নিজের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি তৈরির লক্ষ্যে বাস্তবের ওপর রং চড়ানো অনেকের অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। জাঁক করে নিজের কথা বলার এই সুযোগ অনেকেই ছাড়েননি। তাতে আদর্শের অঙ্গীকার ভুলে অনেকেই বিভাজনের ঘোলাজলে মাছ শিকার করেছেন, কেউবা সেই চোরাবালিতে ডুবেছেন।

ছয়

এ-বাস্তবতায় সত্তরের নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণে বঙ্গবন্ধুর আজীবনের সাধনার তোয়াক্কা করেননি অনেকেই। কেবল বঙ্গবন্ধু তো নয়, জাতির তারুণ্য, শিল্পী-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী-পেশাজীবী এবং মুক্তিযোদ্ধাসহ বিরাট জনগোষ্ঠীর অঙ্গীকার ও আশাবাদকে অস্বীকার করা হলো। মুক্তিযুদ্ধে সৃষ্ট ঐক্য ও ত্যাগের বাতাবরণ ছিন্ন করে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থ উদ্ধারে অনেকেই তৎপর থাকলেন। তারুণ্যের দেশব্রতের তীব্র আবেগে কেউবা অ্যাডভেঞ্চারের রাজনীতিতে জড়িয়ে নতুন সংকট তৈরি করলেন।

বঙ্গবন্ধু সবই টের পেয়েছিলেন, বিভিন্ন ভাষণে তাঁর ক্ষোভ, হতাশা প্রকাশ পেয়েছে। এ-সময় ক্ষুব্ধ নেতা অনেককে মন্ত্রিসভা ও দল থেকে বহিষ্কার করলেন, খেদোক্তি করে বললেন, ‘চাটার দল সব খেয়ে নিচ্ছে’, মরিয়া হয়ে চেষ্টা করলেন দলের বাইরে সৎ ও যোগ্য লোক খুঁজতে, আবার বিরুদ্ধ-শক্তিকে ধমক ও হুমকিও দিলেন লালঘোড়া দাবড়ানোর কথা বলে, চাপের মুখে পড়ে শক্ত হাতে বৈরিতা দমনে রক্ষীবাহিনী নামালেন, সংবিধান সংশোধন করে বিশেষ ক্ষমতা আইন জারি করে কঠোর হলেন, এমনকি শেষ রক্ষার আশায় সাময়িক লক্ষ্য নিয়ে হলেও সর্বদলীয় শাসন প্রবর্তন করতে চাইলেন।

যে শ্রেয়বোধ, যে উচ্চ মানবতাবোধে বলীয়ান এক জাতির আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল একাত্তরে এই কঠিন সময়ে তাকে এবার মনে হলো একেবারেই বিভ্রান্ত। ঐক্যের ভিত এবং আবহ তছনছ হয়ে গেছে। সন্দেহ অবিশ্বাস স্বার্থপরতা মাথাচাড়া দিয়েছে। হতাশার সুর গুঞ্জরিত হয়েছে, সমালোচনা ও খেদোক্তিতে বাতাস ভারী হয়েছে, ক্রমে সমালোচনার সুর হয়েছে শানিত।

বিভ্রান্ত বিভক্ত মানুষ বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাকে প্রত্যাশিত সাড়া কি দিলো? বাকশালের মূল শিরদাঁড়া আওয়ামী লীগও বা এই বিপ্লবী কাজের জন্যে কতটা প্রস্তুত ছিল সেদিন? ঐক্যের বীজ অঙ্কুরিত না হতেই, নতুন আশার আলো মানুষের অন্তরে পৌঁছানোর আগেই, প্রত্যয়ের ভিত রচনার পূর্বেই ষড়যন্ত্রকারীদের প্রত্যাঘাত এলো জাতির জন্যে চরম দণ্ড নিয়ে। ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ প্রত্যুষে সেনাবাহিনীর কিছু ষড়যন্ত্রীর হাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলেন। যেসব বীরের শৌর্যে দেশ স্বাধীন হয়েছে তারা নেপথ্যে চলে গেল, চক্রান্তকারী ও গুপ্তঘাতক খলনায়কেরা নায়কের আসন নিল।

একাত্তর যে উচ্চগ্রামে বেঁধে দিয়েছিল বাংলাদেশের কক্ষপথ, সেই কক্ষ থেকে চ্যুত হয়ে বাঙালি নিক্ষিপ্ত হলো জটিল কুটিল ঘূর্ণাবর্তে। তারই রেশ চলেছে নব্বইয়ের গণজাগরণ পেরিয়ে ১৯৯৫ পর্যন্ত।

সাত

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর প্রথমে যেন শুরু হয় মাৎস্যন্যায়। ক্ষমতা জবরদখলের চক্রান্ত এবং খুনোখুনি। কিন্তু ক্রমে বোঝা গেল, এই পট-পরিবর্তনের পেছনে একটা রাজনৈতিক প্রকল্প রয়েছে। সেটি বাস্তবায়নের হাল ধরলেন জিয়াউর রহমান। তিনি বঙ্গবন্ধু ও জেলহত্যাকারীদের নিরাপদে দেশত্যাগে সাহায্য করেছেন এবং পরে তাদের বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসে সম্মানজনক চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেছেন। দু-বছর না ঘুরতেই তিনি বিচারপতি সায়েমকে সরিয়ে স্বয়ং রাষ্ট্রপতির পদ দখল করেন।

জিয়া রাজনীতিতে পাকিস্তানপন্থী দালাল ও ঘাতকদের পুনর্বাসিত করলেন। জামায়াতে ইসলামীর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেন। নিজে আওয়ামী লীগকে মুখ্য প্রতিপক্ষ ধরে নিয়ে প্রত্যাখ্যাত পাকিস্তানপন্থী ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের রাজনীতি গ্রহণ করলেন।

এর পরবর্তী ঘটনাবলির পেছনে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিকল্পনা, এবং নতুন বাস্তবতায় সৃষ্ট সুযোগগুলোর কার্যকর ভূমিকা ছিল।  প্রথমত, যে অসাম্প্রদায়িক উদার মানবতাবাদী গণতান্ত্রিক রাজনীতি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ভূষণ ছিল তা রাজনীতির বৃহত্তর অঙ্গনে কথ্য-লিখিত ভাষ্যে প্রকাশ পেলেও গণমানুষের অন্তরের বিশ্বাস ও চিন্তার জগতে পৌঁছাতে পারেনি। ফলে সত্তরের দশকে যখন আরব ভূখণ্ড ও উত্তর আফ্রিকার তেলসমৃদ্ধ মুসলমানপ্রধান দেশগুলোতে উন্নয়নের জোয়ার এলো, সেখানে যখন এদেশের নিম্নবর্গের বিপুল শ্রমজীবী এবং মধ্যবিত্ত পেশাজীবীর কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়, তখন তারা ইসলামের পবিত্র ভূমি ও আরব বিশ্বের মুসলিম জীবনধারা ও সংস্কৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পায়। তারা একে মুসলিম আভিজাত্য ও স্বাজাত্যের পরিচয় জ্ঞানে সমাজকে আরবিকরণের দিকে ঝুঁকেছে – এই ধারা তখন থেকে আজো বহমান। দ্বিতীয়ত, তাদের এই ঝোঁক খুবই কাজে লেগেছে একাত্তরের পরাজিত ধর্মান্ধ পাকিস্তানপন্থীদের শক্তি ও প্রভাব বৃদ্ধিতে। এরা প্রায় সকলেই আগে থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের নানা সংস্থার সহায়তা পেত। এই ধারার প্রতি পক্ষপাত জানিয়ে জিয়া রাষ্ট্রের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক পরিচয়ের পরিবর্তন ঘটাতে শুরু করেন। পরবর্তী সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করে এই পরিচয়কে পোক্ত করলেন। তৃতীয়ত, পরবর্তীকালে তালেবান-আইএস ও অন্যান্য ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান ও তৎপরতা, ওয়ান-ইলেভেনের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের ইরাক-লিবিয়া আক্রমণ, তাদের আফগানিস্তান ও ফিলিস্তিন এবং মধ্যপ্রাচ্য নীতি ও এসব অঞ্চলে গৃহীত পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায় মুসলমানপ্রধান দেশে ইসলামি রক্ষণশীল রাজনীতির প্রতি সংহতিবোধ এবং কখনো এর জঙ্গি আক্রমণাত্মক প্রতিক্রিয়ার প্রতি সহানুভূতি তৈরি হয়েছে।

স্বভাবতই এর প্রভাব পড়ল রাজনীতিতে। সমাজের এই ব্যাপক গুণগত পরিবর্তনে ক্ষমতায় ফিরতে  মরিয়া গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তির পক্ষে এর সঙ্গে আপস ছাড়া এগোনো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। এর আরো কারণ হলো সমাজে মুক্তচিন্তা ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চায়ও এ সময়ে ভাটা  নেমে এসেছিল। নব্বইয়ের নির্বাচনে পরাজয়ের পর থেকে আওয়ামী লীগেও দু-ধরনের পরিবর্তন লক্ষ করা গেল – ১. রাজনীতিতে ব্যাপক হারে ধর্মের ব্যবহার, ২. পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে সৃষ্ট নব্য ধনীদের উত্থান ও প্রভাব-প্রতিপত্তির উৎস নিয়ে সমাজের প্রশ্ন ও বিতর্ককে গুরুত্ব না দিয়ে নির্বাচনে জেতার সম্ভাব্যতাকেই প্রাধান্য দিয়ে তাদের দলে টানা ও গুরুত্ব প্রদান।

এই সময়েই আবার বিশ্বায়ন, বেসরকারি খাতের বিকাশ, বৈশ্বিক বাণিজ্যের প্রসার সমাজের ছক পরিবর্তনের সূচনা করে। ক্রমে ইংরেজি শিক্ষার গুরুত্ব, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও তার প্রভাবে জীবনধারার পরিবর্তন এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগের সুযোগ দ্রুত বেড়েছে। এর পরপর সাম্প্রতিক তথ্যপ্রযুক্তির অভিঘাত এবং কথিত চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ঢেউ এসে যুগপৎ বহু চ্যালেঞ্জ ও অপার সম্ভাবনা ও সুযোগের দ্বার খুলে দিয়েছে। রূপান্তরের এই প্রবণতার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার ও চেতনার সমন্বয় ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছে রাজনীতি, ফলে যেসব কথা সংবিধানে চার মূলনীতি ও মুখবন্ধে উল্লিখিত হয়েছে সমাজ তা থেকে অনেকাংশে সরে এলো – মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা অনেকটাই ফাঁকা বুলিতে পর্যবসিত হলো। এটা বাস্তব যে, বর্তমান সময়ে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন দৃষ্টিগোচরভাবেই ত্বরান্বিত হয়েছে, কিন্তু এও সত্য যে, এ-সময়ে গণতন্ত্র সংকুচিত হয়েছে। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের এক নতুন মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদিকে প্রতিবেশী ভারত ও চীন আঞ্চলিক ও বিশ্বশক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার প্রতিযোগিতায় ও প্রাক্কালে বাংলাদেশের মতো প্রতিবেশীদের সঙ্গেই পেতে চায়। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কঠোর সক্রিয় অবস্থান, মধ্যপন্থী ইসলামি দল ছাড়াও আরো ডানের ধর্মীয় দলের সঙ্গে বৈরিতার অবসান, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের আস্থা ধরে রাখা, নব্য ধনীদের প্রশ্রয় দিয়ে হলেও পাশে রাখতে পারা, বেসামরিক আমলাদের তুষ্ট করে সমর্থন আদায় এবং সর্বোপরি অবশেষে এবং প্রচুর বাধা ডিঙিয়ে সামরিক বাহিনীর সমর্থন পাওয়ায় আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতার বিচারে আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির রাজনীতিতে যতোটা ছিল আওয়ামী লীগ বিরোধিতা ততোটা ছিল না নিজস্ব বিকল্প যুগোপযোগী আদর্শ ও কর্মসূচি। আর ক্ষমতার গর্ভে জন্ম নেওয়া দলটি কখনো তার ত্যাগী কর্মী বাহিনীসহ শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তুলতে পারেনি।

বলতেই হবে, এতো সবের মধ্যে উন্নয়নের কাজ থেমে নেই। নানা সূচকের অগ্রগতিও চমৎকার, বর্তমান মন্দার কালেও রেমিট্যান্স এখনো তেমন কমেনি, বরং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে, করোনায় কাজ হারানো উপার্জন-কমা মানুষের সংখ্যা এবং নিত্যপণ্যের মূল্য বাড়লেও দেশে খাদ্যাভাবের কথা শোনা যায়নি। ধীরে ধীরে ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম অনিশ্চয়তার প্রভাব জনমানসে পড়বে; কিন্তু তার দায় ঠিক সরকারের ওপর চাপানো যাবে না। এটা বৈশ্বিক বিষয় এবং এ প্রধানত প্রায় অজানা অণুজীবের দুষ্কর্ম। তবে উদ্বেগজনক পর্যায়ে বেড়েই চলেছে দুর্নীতি ও নারী-শিশু নির্যাতন, পাশাপাশি উদ্বেগের বিষয় হয়ে রয়েছে বৈষম্য, সুশাসনের অভাব, মানবাধিকার ও সিডো সনদসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চার্টার বাস্তবায়নে শৈথিল্য। দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতি ও নতুন কর্মসংস্থান নিয়ে যেমন দুর্ভাবনা আছে, তেমনি ব্যাংকিংসহ আর্থিক খাতের অনিয়মও উপেক্ষণীয় নয়।

আট

এ-আলোচনা শেষ করা যায় এই বলে যে, উন্নয়ন ও অগ্রগতি সত্ত্বেও রাজনীতি বা শাসনকাজ এবং অর্থনীতি দু-ক্ষেত্রেই কাঠামোগত দুর্বলতা কাটছে না, কাটানোর কার্যকর উদ্যোগ-আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। এটা মারাত্মক উদ্বেগের বিষয়। উপযুক্ত সংগঠনের অভাব এবং গণমানুষের মধ্যে ন্যূনতম চাহিদায় সন্তুষ্টির অভ্যাস বা রাজনৈতিক চেতনার ঘাটতির কারণে সমাজ থেকে উপযুক্ত মাত্রায় প্রতিকারের উদ্যোগ হয়তো সহজে আসবে না, কিন্তু অন্য কোনো মহলের অপ্রত্যাশিত আঘাত বা বড় প্রাকৃতিক-দুর্যোগে কিংবা চলমান করোনায় বিশ্ব অর্থনীতি মন্দায় পড়লে তা থেকে উত্তরণ আমাদের জন্যেও কঠিন হবে। যুক্তরাষ্ট্রের বিগত নির্বাচনকালীন ঘটনাবলি থেকে একটি বিপরীত চিত্র তুলে ধরা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা কত বেশি তা ওয়াকিবহাল মহল জানেন, তিনি ডেমোক্র্যাটদের বিজয় ঠেকাতে সর্বোচ্চ ও সর্বাত্মক তৎপরতা চালিয়েছেন; কিন্তু মাত্র সপ্তাহ তিনেকের মতো ধোঁয়াশা সৃষ্টির বেশি আর কিছুই করতে পারেননি, কারণ তাদের প্রশাসনিক ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীন, শক্তিশালী ও কার্যকর। এর পেছনে রয়েছে আইন ও ঐতিহ্যের চর্চা এবং এর প্রতি আনুগত্য ও শ্রদ্ধা।

পশ্চিমের এ-অর্জন রাতারাতি ঘটেনি, ধীরেই হয়েছে, কয়েক শতাব্দী জুড়ে। কিন্তু আমাদের এখানে এ-প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এটুকু কি বলা যাবে? এমন দুর্বল সমাজে আইনগত ও প্রশাসনিক কাঠামোর দুর্বলতার মধ্যে আইনের চেয়ে ক্ষমতা, ব্যবস্থার চেয়ে ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ। এর প্রতিফল হিসেবে সমাজে ক্ষমতাধর ব্যক্তি এবং তাদের ঘিরে অন্ধশক্তির উত্থান ঘটে চলেছে, বাড়ছে দুর্নীতি ও অপরাধ, সুশাসন ও মানবাধিকার অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে, সৎ মানুষের আকাল বাড়ছে, দক্ষ মানুষও ভোগান্তি এড়াতে পারছেন না। ক্ষমতার মধুচক্র নিষ্ক্রিয় করতেই হবে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে দেশ একবার অরাজক অবস্থা দেখেছে। সে ছিল সদ্য স্বাধীন দেশ, তখনকার প্রেক্ষাপটে সেটাই ছিল স্বাভাবিক, কিন্তু তার প্রায় অর্ধশত বছর পরেও যে একই দুর্বলতা ও অনিশ্চয়তা থেকে গেলে – সেটা হবে দুর্ভাগ্যজনক। আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, সচেতন নাগরিকদের জন্যে দেশ গড়ার কাজ এখনো শেষ হয়নি – সেটা যেন সবার মনে থাকে। ফলে আজকের দিনের উপযোগী রাজনীতি, তার সহোদর প্রগতিপন্থী সংস্কৃতি এবং মানবিক ধারার সমাজ গড়ার চ্যালেঞ্জ নবপ্রজন্মকে নিতে হবে – তাদের পথ দেখাতেও নেতৃত্ব দিতে হবে মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞ অগ্রসর মানুষদেরই।