স্বোপার্জিত পৃথিবী বাঁচুক

‘স্বোপার্জিত পৃথিবী’ নাম ধারণ করে অসামান্য একটি শিল্পকর্ম প্রদর্শনী হয়ে গেল সম্প্রতি। পরিবেশ ও পৃথিবীকে সুস্থ-সবল আনন্দময় রাখা চেষ্টা পৃথিবীজুড়ে সচেতন নাগরিকদের। সেই প্রচেষ্টায় যুক্ত হয়েছেন চট্টগ্রামে বসবাসকারী বাংলাদেশের শিল্পীরা। এই যুক্ততা অনিবার্য হয়ে ওঠে – উন্নয়নের নামে পাহাড়বেষ্টিত ঘন সবুজঘেরা সিআরবিতে বড় ধরনের একটি স্থাপনা গড়ার পরিকল্পনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ।

এ পরিবেশ-আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রামের একদল দৃশ্যশিল্পী গত সেপ্টেম্বরে একটি আর্ট ক্যাম্পের আয়োজন করেন। ক্যাম্প চলাকালে বৃক্ষবেষ্টিত ছায়াঘেরা সিআরবি চত্বরে শিল্পীদের সপ্তাহব্যাপী ছবি আঁকা ও পারফরম্যান্স শত শত নগরবাসী প্রত্যক্ষ এবং পরিবেশ সচেতনতায় তাঁরা একাত্মতা প্রকাশ করেন।

একুশজন শিল্পীর শিল্পকর্ম ও পারফরম্যান্স নিয়ে ঢাকার বেঙ্গল শিল্পালয়ের কামরুল হাসান প্রদর্শনালয়ে আয়োজিত ‘স্বোপার্জিত পৃথিবী’ শীর্ষক প্রদর্শনী সারাদেশের পরিবেশ সচেতন নাগরিকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। প্রদর্শনীর মাধ্যমে ও প্রচারমাধ্যমের কল্যাণে চট্টগ্রামের শিল্পীদের মনোবেদনার অনুরণন ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে নীরব প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা, সুস্থতার সঙ্গে নিজেদের বাঁচা ও অন্যদের রক্ষার অঙ্গীকার ব্যক্ত হয়েছে তাঁদের স্বকীয় শিল্পভাষা ও ভাবনায়।

এ-আয়োজনের অন্যতম উদ্যোক্তা ও অগ্রজ শিল্পী অলক রায়ের ভাষায় – একটি সূর্য, একটি চাঁদ, একটি আকাশ এবং একটি পৃথিবী – আমাদের একমাত্র বাসগৃহ, একে সজীব রাখতে আমরা কি সবাই এক হতে পারি না?

‘স্বোপার্জিত পৃথিবী’তে অংশগ্রহণকারী একুশজন শিল্পী হলেন – অলক রায়, নাজলী লায়লা মনসুর, খাজা কাইয়ুম, নিলুফার চামান, সঞ্জীব দত্ত, জাহেদ আলী চৌধুরী, জয়দেব রোয়াজা, সঞ্জয় কুমার দাস, সঞ্জীব বড়ুয়া, শতাব্দী সোম, শ্রীকান্ত আচার্য, সুব্রত দাশ, জয়নাল আবেদিন আজাদ, শারদ দাশ, জিহান করিম, রাসেল কান্তি দাশ, মামুর আহসান মাহতাব, সঞ্জয় সরকার অক্ষয়, এস এম রিয়াদ, মং মং সো ও জয়তু চাকমা।

প্রদর্শনালয়ে ঢুকেই এক অন্যরকম আমেজ পাওয়া গেল। দেয়ালে দেয়ালে ক্যানভাসে আঁকা চিত্রকর্ম ঝুলছে, পাশে কিংবা সামনেই ভাস্কর্য ও স্থাপনা দৃষ্টিনন্দিতভাবে রাখা হয়েছে। পাশাপাশি টিভি মনিটরে চলছে চট্টগ্রাম সিআরবিতে আর্ট ক্যাম্প চলাকালে শিল্পীদের পারফরম্যান্সের ধারণকৃত দৃশ্যাবলি। পরিবেশ রক্ষায় সৃজন-আকুতি দিয়ে মানুষের চেতনাকে নাড়া দিতে শিল্পীদের এ-আয়োজন দর্শককে আকৃষ্ট করেছে।

আসা যাক প্রদর্শনীর সৃজনকর্মের বিষয়ে। অংশগ্রহণকারী অন্যতম অগ্রজ শিল্পী নাজলী লায়লা মনসুর। তিনি ছবি আঁকেন পরাবাস্তব ধরনের গঠনবিন্যাসে। ‘আকাশলীনা’ শিরোনামে ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক মাধ্যমে তাঁর আঁকা চিত্রকর্ম সংবেদী এই বিষয়টির পক্ষে সার্থক এক সৃষ্টি! চিত্রপটের চারদিকে উঁচু উঁচু বৃক্ষের ঝাঁকড়া মাথার সমাহার। কেন্দ্রস্থলে সাদা মেঘের আল্পনার ভেতরে সবুজ ডুরে শাড়িপরা এক নারীর চিন্তাক্লিষ্ট অবয়ব। যেন প্রকৃতির আসন্ন বিপর্যয় নিয়ে উদ্বিগ্ন। শিল্পী তাঁর চিত্রকর্মের শিরোনামটি নিয়েছেন জীবনানন্দ দাশের কবিতা থেকে।

শিল্পী ও ভাস্কর অলক রায় তিনটি ক্যানভাসের পেছনের ফ্রেমে মৃৎপাত্র সন্নিবেশ করেছেন, প্রতীকীভাবে তিনি নিসর্গের বন্দনা করে পরিবেশ রক্ষার আবেদন রেখেছেন। আরেক অগ্রজ শিল্পী খাজা কাইয়ুমের চিত্রে গাছের ডাল ও পাতায় সবুজ বিস্তার রচনা করে পাখির নীড়ে শান্তিময় জীবনের  আশ্বাস খুঁজেছেন।

শিল্পী সঞ্জয় কুমার দাসের আঁকা ‘স্বপ্নসঙ্গী’ এমনই এক দৃষ্টিনন্দন ছবি যা আমাদের সুন্দর জীবন ও নিসর্গনাশের বৈপরীত্যের সঙ্গে আমাদের শুভ আকাক্সক্ষাগুলোকে তুলে ধরেছে বাস্তবতা ও স্বপ্নের মিশেলে।

শিল্পী রাসেল কান্তি দাস এঁকেছেন ‘মৃত্যুর পর নিশ্বাস’ শিরোনামে বাস্তবানুগ ধরনের অথচ প্রতীকী চিত্র। দেয়ালের ওপারে চলে যাওয়া মানুষটিকে ফ্রেমবদ্ধ রংহীন একটি গাছ তুলে দিতে চাইছে এপারে অক্সিজেনমাস্ক পরা একজন। আবার সাদা-কালচে রঙে সুব্রত দাসের আঁকা ‘হাড়হীন বৃক্ষের শিরদাঁড়া’ অন্ধকার সময়কে নির্দেশ করে। তদ্রƒপ শিল্পী সঞ্জীব বড়ুয়ার আঁকা কর্তিত ও রক্তাক্ত বৃক্ষসারির ঊর্ধ্বাংশে বহুতল ভবনবিশিষ্ট সবুজবিহীন নগরায়ণের বিপদকে তুলে ধরেছেন।

শিল্পী জাহেদ আলী চৌধুরীর ছবিতে আমরা প্রত্যক্ষ করি অঙ্কুরেই জীবনাশঙ্কায় পতিত চারাগাছ ও প্রতিবেশের অস্তিত্বসংকট। শিল্পী সঞ্জীব দত্ত ‘প্রকৃতিকে তাঁর নিজের মতো থাকতে দাও’ চিত্রে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশংকাকে নকশাকারে নিজের মতো করে দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করেছেন।

মূলত সাদা ক্যানভাসে-কালো ও লাল রঙের রেখায় শিল্পী শতাব্দী সোম এঁকেছেন ‘আমি ও প্রকৃতি’। একটি বৃক্ষকে দুদিক থেকে স্পর্শ করা দুজন অ্যাঞ্জেল মাটির দিকে নতমুখে নুয়ে আছেন। সহজ সামান্য কয়েকটি রেখার অসামান্য প্রয়োগ আমরা লক্ষ করলাম এতে। পাহাড়ি বাসিন্দা ও শিল্পী মং মং সো আলোছায়াঘেরা ভারী মায়াময় একটি বিরান পথের অদ্ভুত এক দৃশ্য এঁকেছেন! দেখে মনে হয়, এই পথ আর সবুজের ছায়া-মায়া যুগ যুগ ধরে টিকে থাক।

শিল্পী সঞ্জয় সরকার অক্ষয় বৃক্ষের ঊর্ধ্বাংশকে নিয়ে এর বহুরৈখিক চিত্রকর্ম করেছেন কালো ও লালবর্ণের চমৎকারিত্বে। শিল্পী জয়দেব রোয়াজা গাছের রাজ্য ও বৃক্ষসদৃশ মানব এঁকেছেন ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক রঙে। জয়তু চাকমা-উপস্থাপিত জোড় চিত্রপটে দেখা যাচ্ছে লালরঙের আবহে কর্তিত ডালপালাসহ বৃক্ষকে বিনাশ করতে আসছে যন্ত্রদানবসদৃশ গাড়ি। এমন আশঙ্কাই তো দেখা দিয়েছে সিআরবির সবুজে নতুন ভবন বানানোর পাঁয়তারায়।

শারদ দাশ দর্শকের সামনে আরো সরাসরি রূপে তাঁর আঁকা চিত্রে হাজির করেছেন – বৃক্ষকর্তনের প্রকৌশল, সাংবাদিকের ভিডিওধারণ আর খালি করা জায়গায় প্লট নম্বর।

জয়নাল আবেদিন আজাদ গাছের আদলে একটি মানবী প্রতিকৃতি এঁকেছেন। মামুর আহসান মাহতাব ময়লায় সয়লাব এক ভূদৃশ্য এঁকেছেন, যার অনতিদূরেই ইটভাটার পরিবেশ দূষণকারী ধোঁয়া গিলে খাচ্ছে মাঠের সবুজ।

অগ্রজ শিল্পী নিলুফার চামান এক্ষেত্রে আরো সম্পর্কিত প্রতীকের আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি করাতকলে ব্যবহৃত করাতকে রঞ্জিত করে গ্যালারিতে স্থাপন করেছেন।

জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশসহ ছোট অর্থনীতির অনেক দেশ পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। এর ওপর উন্নয়ন চাহিদায় সবুজ ধ্বংস করে ভবন, পথঘাট গড়ার সংস্কৃতি আমাদের ক্ষতি বাড়াচ্ছে। এসব বিষয়ে সুচিন্তিত পদক্ষেপ নিতে সরকার, পরিবেশবাদী ও বিবেকবানদের এগিয়ে আসতে হবে।

শিল্পীদের এই চেতনার পক্ষে দাঁড়িয়েছে বেঙ্গল শিল্পালয়, অন্যরকম একটি প্রদর্শনী আয়োজনের ভার নিয়ে। ধন্যবাদ তাঁদের এবং আয়োজক শিল্পীদের। আমি মনে করি, সব মিলে এ-প্রদর্শনী সচেতন মানুষের প্রশংসা কুড়িয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরপূর্তি উপলক্ষে ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগিতায় বেঙ্গল ফাউন্ডেশন-নিবেদিত পাঁচদিনব্যাপী ‘সৃজনে ও শেকড়ে’ অনুষ্ঠানমালার অংশ হিসেবে ‘স্বোপার্জিত পৃথিবী’ প্রদর্শনীর উদ্বোধন হয় ১৪ ডিসেম্বর ২০২১-এ। এক মনোজ্ঞ ও বিশ্লেষণধর্মী আলোচনার মধ্য দিয়ে এ আয়োজন সমাপ্ত হয় ২০২২ সালের ৪ জানুয়ারি।