বাবা মারা যাওয়ার পর তার স্মৃতি হিসেবে আমি তেমন কিছু মনে করতে পারি না, তবে তার রাগত ঈষৎ লাল চোখ মনে পড়ে; সেই চোখের গড়নটার কথা মনে করতে পারি না। মা বলতো ‘তোর চোখ তোর তিনটে বোনের কারো মতো না হয়ে হয়েছে অবিকল তোর বাপের মতো।’ বাপের মতো মানে কেমন তা অবশ্য আমি কখনো পরখ করে দেখিনি বা সোজা কথায় বললে দেখার আগ্রহ আমার কোনোদিন তৈরি হয়নি। সত্যি বলতে কী বাবার মুখোমুখি আমি হতাম না তার ভয়ে। বাবা আমাকে মাঝে মধ্যে মাঠে তার কাজের সাহায্য কারার জন্য ডাকতো, আমি গিয়েছি দু-একবার, নানা ছলছুতোয় আমি যেতাম না। বাবা মারধর করতো না তবে শাসাতো, ভয় দেখাতো, দু-একবার খুব ভয় পেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছি। সারাদিন পর ফিরে মা’র সহায়তায় বাবার সামনে গিয়েছি ভয়ে ভয়ে। ততক্ষণে বাবার লাল চোখের আগুন নিভে গেছে, বাবা তখন রঞ্জনা বা সাহারা আপার সঙ্গে গান ধরেছে – এই কি গো শেষ দান, বিরহ দিয়ে গেলে।

এখন মনে করি, আমি কোনো সংকোচ ছাড়া বলতে পারি আমি তার একজন অধম সন্তান, যে কৃষকবাবা আমার জানামতে কোনো অন্যায় করেনি কোনোদিন, তার সন্তান আমি সারাদিন অপকর্ম আর নানা আনন্দ-মচ্ছব করে ঘুরি। আমি স্মরণ করি, বাবার একমাত্র স্মৃতি তার হারকিউলিস সাইকেল। এখন আমি জাপানি ইয়ামাহা ১২৫ চালাতে গিয়ে বাবার রং ঝলসে যাওয়া ধূসর চেহারার হারকিউলিস সাইকেলটার কথা মনে করি; তার সামনের চাকায় কোনো মাডগার্ড থাকতো না, চেইনের ওপর কোনো ঢাকনা থাকতো না, প্যাডেলে প্লাস্টিকের যে-আবরণ থাকার কথা, তার পরিবর্তে থাকতো একটা রড এবং তার মাথায় থাকতো একটা নাট, যাতে পা আটকে থাকতো। মাঝে মাঝে বাবার পা নাটের সঙ্গে লেগে রক্তাক্ত হতে দেখতাম, বাবা উঠানের জবার পাতা ডান হাতের চার আঙুল দিয়ে রগড়ে পায়ের পাতায় লাগিয়ে দিত, তবে নাট বা রড পরিবর্তন বা সাইকেল মেরামত করতে দেখিনি কোনোদিন। বাড়ির ডানপাশে চার ঘর চাচাতো ভাইয়ের উঠান পেরিয়ে বিলের দিকে দক্ষিণ দিকের বেশ চওড়া পথ দিয়ে আমি বাবাকে ফাঁকি দিয়ে সাইকেল চালাতে যেতাম, যখন  প্রায়  প্রত্যহ বাবা দুপুরের ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তো। বড় জামগাছে ঘুঘু বা আতাগাছে শ্যামা পাখি ডাকলেও বাবার ঘুম ভেঙে যায় আর বাবা চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তোলে; সবাই ভয়ে ভয়ে থাকে, কেউ ওই সময় গল্প পর্যন্ত করে না, সাহারা আপা আর মা মিলে নিমাই না আশার বই পড়ে। রঞ্জনা আপা সম্ভবত কোনো কিছু না করতে পেরে পাড়া বেড়াতে যায়, বই পড়া ওর ধাতে সয় না।

আমি জানি আমি একটু পরে খেলতে যাবো, তার আগে গোয়ালঘর থেকে সাইকেলটা চুরি করে বের করে খোলা প্যাডেলে উঠোন দিয়ে দু-এক পাক দিতে হবে। রঞ্জনা আপার সহায়তায় আমি এইটুকু  শিখেছি, সে আর শেখায় না। বলে, ‘দ্যাক তোর পিচুনে পিচুনে আমি আর সুময় নষ্ট করতি পারবো না, যে শেকে সে একদিনির মদ্যি শেকে, তুই যা পারিস তাই কর।’ অগত্যা আমি খোল প্যাডেল মারতে  মারতে সিটের ওপর বসার চেষ্টা যেদিন শুরু করলাম সেইদিনই সোজা দক্ষিণ দিকে বিলের দিকে যাওয়ার সময় এবড়ো-খেবড়ো ইটের রাস্তায় ঠিক মতো চালাতে না পেরে ডানে দেদার বক্স চাচার বাড়ির দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে পড়লে সাইকেলটা আমার ঘাড়ের ওপর পড়ে; আমি কয়েক মিনিট অজ্ঞান হয়ে আবার উঠে দেখি জনাচারেক বিটকেলে ছেলে, মানে রহিম, সবুর, করিম আর পান্নু, আমার দিকে দাঁত বের করে একযোগে হাসতে থাকে। ওরা সাইকেলটা তোলে, একবার মজা দেখাতে বেল বাজায়, তবে জোর হয় না। আমার ঘাড় ছুলে যায়, নাকে ব্যথা পাই, কপালে রক্ত চিকচিক করে, তবে কাঁদি না।

খুব ঠেলেঠুলে এইচএসসি পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, আমি কীভাবে সুযোগ পেলাম জানি না, তবে ওয়েটিংয়ে থেকে শেষের দিকে যখন আমাকে ডাকা হলো ভর্তির জন্য, বাবাকে বললাম, বাবা রাজি হলো। বললো, ‘যা পারি করবো।’ হাজার দু-এক টাকা নিয়ে ভর্তি হয়ে ক্লাস করতে শুরু করলাম। বেলা চারটের সময় যশোর থেকে মহানন্দা ট্রেনে চেপে রওনা হয়ে রাত ৩টার দিকে নামলাম বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশনে। গ্রামের ছেলে মারুফভাই থাকতো হবিবুরের ১০৮নং রুমে, আগেও দুদিন ছিলাম ওর কাছে ভর্তি পরীক্ষার সময়। অন্যরা গণরুমে আছে। আমি বড় ভাইয়ের সুবাদে তার সঙ্গে ডাবলিং করে থাকার একটা অস্থায়ী বন্দোবস্ত হলো এবং বলা হলো খুব হলে এক মাস থাকতে পারবো। আমি হাঁটতে হাঁটতে ফিজিক্স বিল্ডিং পেরিয়ে ডানে মোড় নিয়ে পুরনো বটগাছ রেখে লাইব্রেরির পাশ কাটিয়ে শহীদুল্লাহ ভবনে যাই প্রতিদিন আর দু-একটা ক্লাস করে ফিরি। আনন্দ নামে একজন আমাকে চিনতে পারে প্রথম দিন থেকেই, সে নাম বলে, আমার পরিচয় নেয়, মিল হয়ে যায়। দুজনের অবস্থা একইরকম, ওরও বাবা বলেছে, যা দিয়েছি এই শেষ, এরপর নিজের চেষ্টায় পড়বি। হলের হলুদ পানি দিয়ে তৈরি পাতলা ডাল, অপরিপক্ব সিলভার কাপের চিকন খণ্ডিত অংশ মুলা আর পেঁপে দিয়ে তৈরি পাতলা ঝোল খেয়ে মাথায় তেমন বুদ্ধি খোলে না। আনন্দও থাকে এই হলের গণরুমে। বিকেলে স্টেশন বাজারে গিয়ে ওর সঙ্গে পুড়ি আর শিঙাড়া খাই। একদিন ও টাকা দেয়, একদিন আমি। হিসাব করে দেখেছি, এই টাকায় বড়জোর যাবে দুই মাস। ক্লাসে শিক্ষক পড়ান চর্যাপদের লাইন, হাঁড়িতে ভাত নাহি নিতি আবেশি। আমার মতো অবস্থা আর কী। থাকার চিন্তা, খাবার চিন্তা আর লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার চিন্তা করতে করতে আমাদের মাথায় অনেক বুদ্ধি বাড়ে চারপাশ থেকে। কমনরুমে তাশ-ক্যারম খেলার সময় দেখি ছাত্র ভাইয়েরা বেনসন হেজেজ সিগারেট খায় ঘনঘন। ধোঁয়ায় ঘর নতুন গন্ধে ভরে যায়। দেখি আনন্দও খাচ্ছে একদিন, আমি ওর কাছে গেলে আমার মুখেও ঢুকিয়ে দেয়, আমিও দিই এক টান। মুখে বলি, কেইসটা কী? সে আমাদের গাঁয়ের ভাষায় বলে, ‘পরে কবানি, আগে টান দে।’ বাবার বিড়ি দু-একবার লুকিয়ে খেয়েছি, খক্খক্ করে কাশি হয়েছে বলে ও-পথে আর যাইনি। এখন কাশি পেল না, তবে কোনো আলাদা আকর্ষণ পেলাম না। সে বলল, ‘জানিস এর দাম কত?’ আমি বলি, কী দরকার? তাকিয়ে দেখি সবার হাতে বেনসন সিগারেট। মাথা গরম হতে থাকে। আমি বের হয়ে আসি।

আমাকে আসতে দেখে সে বের হয়। আমরা হবিবুরের মাঠে বড় অর্জুন গাছের নিচে ঘাসের ওপর বসি। আনন্দ বলে, ‘একটা বেনসন ১১ টাকা, মানে আমাদের দুপুরের খাবারের সমান। তালি বোজ, ওরা প্যাকেটে প্যাকেট খাচ্চে, টাকা পায় কনতে?’ আমি বলি, ‘কনতে?’ ও বলে, ‘লাইনে গিলিই পাবি, তুইও পাবি। আমিও পাবো। আমি তো কতা দিচি, যা করতি হয় করবো। না হলি বাড়ি ফিরি যাতি হবে।’ আমি বলি, ‘কাজডা কী?’ সে বলে, ‘থাক আমার সাথে, সব জানতি পারবি। এখানে টাকা ওড়ে, শুধু খপ্ করি ধরতি হবে।’

লাউগাছে পানি দিলে যেমন দ্রুত লকলক করে বাড়ে আমাদেরও তেমন দ্রুত উন্নতি হলো বছরখানেকের মধ্যে। তবে প্রথম দিনের কথা না বললেই নয়। আনন্দ আমাকে নিয়ে সেদিন খাতায় নাম লেখালো বলা যায়। শেরেবাংলা হলের পেছনে মানিকের দোকানের সামনে অনেকগুলো বেঞ্চে গোল হয়ে বড় ভাইয়েরা বসে আছে, মানিক সবার হাতে তখন চা দিচ্ছে, আর সবাই সিগারেট টানছে, ধোঁয়া ছাড়ছে এক-একজন  এক-একদিকে, একজন কলকের মতো করে সিগারেট ধরে টান দিয়ে চোখ লাল করে ফেলে আকাশের দিকে ছাড়ে ধোঁয়া। পরে শুনেছি বেশিরভাগ সিগারেটে গাঁজা ঢোকানো। পরিচয় পর্বে শুনলাম, সে-ই এখন সবচেয়ে বড় নেতা। দলের কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক সংস্কৃতি ও সাহিত্য সম্পাদক। মাদার বক্স হলে সে থাকে, তবে কোথায় রাত কাটায় জানে না সবাই। তার আকাশি রঙের পালসার টু হানড্রেড বাইকটা পেছনে মাজা বেঁকিয়ে উঠতি তরুণীর মতো দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে আনন্দ পরিচয় করিয়ে দিলো : ‘বস, এই হলো, রাকিব, আমার গ্রামের ছেলে।’ সে আমার দিকে ট্যারা চোখে তাকালো, চোখটা আসলে ট্যারা কি না আমি হলপ করে বলতে পারবো না, তবে, আমার মনে হলো এবং সে দুটো আঙুল ঠোঁটের কাছে নিয়ে সিটি বাজিয়ে বললো, ‘ওকে সব বুঝিয়ে বলেছিস তো?’ আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘লাইনে থাকতে হবে, ঠিক আছে? যখন যা বলবে বড়রা তাই করবে। কোনো ‘না’ চলবে না।’ সে একটা সিগারেট ছুড়ে দিলো আমার দিকে, উদ্বোধনী ধূমপান হিসেবে, আমি ক্রিকেটের অভ্যাসবশত ধরে ফেললাম। দলে আমার নাম যুক্ত হলো। গণরুমে থাকতে পারবো, খাওয়ার ব্যবস্থা হবে, অন্য খরচের ব্যবস্থা হবে – আনন্দ আগেই বলেছে। লেখাপড়ার বিষয়ে কোনো কথা হলো না।

বছরখানেকের মধ্যে আমিও বেশ শেয়ানা হয়ে উঠলাম লাইনে। নেতা মানে আমাদের গ্রুপের নেতার লেজে লেজে ঘুরি, ফাই-ফরমাশ খাটি আর যা বলে ‘ইয়েস বস’ বলি; এটাও আনন্দের শেখানো। মাদার বক্সে একটা সিটে আমার আর আনন্দের থাকার ব্যবস্থা হলো। ঠিক এগারোটা বাজলে মিছিলে যাই, মিছিলে আমি স্লোগান দিই, অন্যরা আমার কথার সঙ্গে একযোগে উত্তর  দেয়। বাংলার বিদ্যে দু-একটা কাজে লাগাই, ততদিনে ক্লাস বাদ হয়ে গেছে। কোনো ক্লাস না করেই সেকেন্ড ইয়ারের পরীক্ষা দিয়েছি। দলের ক্যাডারদের ডিজকলেজিয়েট হওয়া কোনো অপরাধ নয়। আনন্দের বিভাগে ওকে ধরেছিল চেয়ারম্যান, ওর বস সাব্বির ভাইয়া গিয়ে চেয়ারম্যানকে কী বলেছিল, সব ঠান্ডা হয়ে গেল। তবে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দিলেও আমরা পাশ করতে পারি না। নম্বর বেশি করে দেওয়ার কথাও বলেছে বসেরা, অনেক টিচার দেয়, তবে বেশ কিছু ঘাউড়া টিচার আছে যারা কোনো কথা শোনে না। আর পাশ করলে তো আমাদেরও লস, বেশিদিন তো নেতাগিরি বা ক্যাডারগিরি করতে পারবো না।

তো আমরা বেশ মজার জীবন কাটাতে থাকি, এইটা যে বিশ্ববিদ্যালয়, এইটা যে ছাত্রজীবন সেটা আমাদের কখনো মনে হয় না। আমরা সব করতে পারি, হলে ফ্রি খাওয়া, চিরকালের জন্য বাকি খাওয়া, চাঁদাবাজি থেকে টেন্ডারবাজি, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা, অস্ত্রবাজি, ভয়ভীতি দেখানো, মাতলামি করা সবই পারি, আর ভালোমানুষি বলে কোনো ছিঁচকাঁদুনে ব্যাপার আমাদের নেই। সেটা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়েছি। যা হোক, প্রতিদিন নানা কাজ থাকে। মিছিলের বাইরেও আরো অনেক কাজ। টাকা-পয়সা রোজগার করা যে কত সোজা সেটা আমরা বুঝে গেছি। আনন্দ, রাব্বি, ফজল, আবিদ, সোহাগ, জাহিদসহ আরো কজন মিলে আমরা একটা গ্রুপে থাকি, গ্রুপ লিডার এখন আনন্দ, আমি ওর সহকারী। মাদার বক্সে আরো চার-পাঁচটা গ্রুপ আছে, মাঝেমধ্যে হাতাহাতি হয় ভাগবাটোয়ারা নিয়ে  এবং পিস্তল, রামদা বের করে মহড়া দেওয়ার ব্যাপার ঘটে। এসব রপ্ত করতে কিছুদিন সময় নষ্ট করেছি, তবে অস্ত্র চালাতে সময় লাগেনি। ছোটবেলার তির-গুলতির প্র্যাকটিসটা কাজে লেগেছিল। নতুন ছাত্র বা একটু পুরনো ছাত্র হলে উঠতে চাইলেই আমরা রোজগারে নেমে পড়ি। কাউকে কাউকে দলে ডাকি, টোপ দিই, নতুন সদস্যদের  ফ্রি-খাটানো সুবিধে। তারা পাকা হয়ে ওঠার আগেই কাজে লাগাই ইচ্ছেমতো।

খুব কষ্ট হলো একদিন, যা হওয়ার নিয়ম নেই। তিনতলায় প্রভোস্টের চিঠি নিয়ে একটা ছেলে, নাহিদ না কি যেন নাম, একটা সিটে উঠে পড়লো, আমরা শকুনের মতো চোখ নিয়ে ঘুরি আর এই শালা আমাদের ফাঁকি দিয়ে বিছানা, কাঁথা, বালিশ, হাফপ্যান্ট, ফুলপ্যান্ট নিয়ে কীভাবে ঢুকে পড়ে! তো রাত ন’টার দিকে বাচ্চু, আমি আর আনন্দ ওর রুমে গেলাম। বাচ্চু কোনো ভূমিকা না করে ছেলেটার বুকের পাঁজরে কেডসসহ লাথি মারলো, ছেলেটা খাটে বসে মনে হয় নীলক্ষেত থেকে কেনা একটা পুরনো বই পড়ছিল, চেয়ার তো নেই এখনো, সে ছিটকে পড়ে গেল মেঝেতে, আনন্দ ওর কাঁথা-কম্বল-বালিশের বড় পোঁটলাটাকে তুলে বারান্দা দিয়ে নিচে ফেলে দিলো। ছেলেটা হাউমাউ করে কান্না শুরু করলো, তার কান্না আর থামে না। প্রথমত সে ব্যথা পেয়েছে প্রচণ্ড, আর দ্বিতীয়ত লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার যে ক্ষীণ আশা সে করেছিল তা শেষ হচ্ছে ভেবে জোরে জোরে কাঁদতে থাকে। মুখে কী বলে তা ঠিক বোঝা যায় না। আমি এই প্রথম একটু বিচলিত হলাম। তার কথার সারমর্ম হলো, তোমরা কারা? আমি তো প্রভোস্ট স্যারকে বলে এখানে উঠেছি। আমি যদি হলে না থাকতে পারি, তাহলে আমার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে। আমি এখন কী করবো? তোমাদের তো কোনো ক্ষতি আমি করিনি। আনন্দ বলে, ‘তুই দলের সঙ্গে যোগাযোগ না করে, কেন প্রভোস্টের কাছে গিচিস, তোর নাড়িভুঁড়ি বের করে দেব, প্রভোস্ট তোর বাপ? সে কী করবে? আমরা হল চালাই, আমরা যা করবো তাই হবে।’ রুমে আর তিনজন ছাত্র দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধৈর্যসহকারে চুপচাপ আমাদের মামদোবাজি দেখছে, কোনো কথা বলার সাহস নেই, ওরা নিয়মিত চাঁদা দেয়। মেসের ভাড়া দিতে পারে না বলে এরা হলে থাকতে চায়, গরিব মানুষের ছেলে। তো আমাদের চাঁদা দিয়ে আর মিছিল করে, গালিগালাজ শুনে যারা থাকে তাদের অবস্থাও ভালো না। আনন্দ ছেলেটার পিঠে পিস্তল ঠেকায় বাঁ হাতে আর ডান হাতে জামার কলার ধরে বলে, তোর প্রভোস্ট কোনো বাল ছিঁড়তে পারবে না, চল, তোকে আজ আমি হলছাড়া করবো।

আমার কেন জানি একটুখানি অবৈধ মায়া হয়, এসেছি ওকে হলছাড়া করতে, অথচ মায়া চোখের কোণে উঁকি দিচ্ছে। আমি ওর বোবা চোখের দিকে তাকাই, কী কাতর সে-চোখ, লেখাপড়া শিখতে এসে কী বিপদ। আমি বললাম, ‘তোমার বাবা কী করে?’ সে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললো, ‘প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক।’ বাচ্চু হঠাৎ বলে, ‘তাইলে তো তোর টাকা আছে, মেসে গিয়ে থাক, কোনো ঝামেলা নেই।’ আমি বাচ্চুর দিকে তাকিয়ে বলি, ‘প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকের কত বেতন জানিস?’ সে বললো, ‘না।’ আমি বললাম, ‘তাইলে চুপ থাক।’ আনন্দ ছেলেটাকে তিনতলা থেকে ঠেলতে ঠেলতে নামিয়ে নিচে আমাদের গণপিটুনি রুমে নিয়ে এলো। এখানে পেটানোর নানা সরঞ্জাম থাকে। ক্রিকেটের ব্যাট থেকে লোহার রড, প্লায়ার্স, হাতুড়ি, কিছু আধলা ইট, গরানকাঠের চোলা, বেত – সব। আমি আনন্দকে বললাম, ‘ওকে ছাড় রে, শিক্ষকের সন্তান, আমরা পেটাবো, আল্লাহ মাফ করবে নারে।’ সে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তুই তো জানিস, কোনো অ্যাসাইনমেন্টে ফেল মারার হকিকত কী? তোর অবস্থাও তো কেরোসিন হয়ে যাবে!’ আমি বললাম, ‘যাক, তুই ওকে ছেড়ে দে।’ আনন্দ ওকে ছাড়লো, তবে আমার ওপর ক্ষিপ্ত হলো। ছেলেটা একটু অদ্ভুত আনন্দময় চোখে আমার দিকে তাকালো, আমি ঠিক বর্ণনা করতে পারবো না। তবে রাগী কোনো লোক যখন একটা কুকুরকে পেটাতে পেটাতে ক্লান্ত হয়ে ছেড়ে দেয়, তখন কুকুরটা লোকটাকে ধন্যবাদ দেওয়ার ভঙ্গিতে অসহায়ভাবে তাকায়; ছেলেটার ভাবখানা সেরকম মনে হলো।

আমরা লেখাপড়া ছাড়া সব বিদ্যে শিখে ফেলেছি এটাও কম কথা নয়। বস্তুত আমাদের ক্যাডার বড় ভাই যারা আমাদের সারাক্ষণ নানা উপদেশ দেয়, তাদের কাছ থেকেও আমরা অনেক শিখেছি। প্রায় বারোশো একর জুড়ে বিশাল এই ক্যাম্পাসে আমরা রাজত্ব করি। আমরা বাঘের মতো অথবা সিংহের মতো ক্যাম্পাস পাহারা দিই, যা দু-একটা বিপথগামী বিরোধীপক্ষ ছিল তাদের এমন প্যাঁদানি দিয়েছি  যে কেউ আর টুঁ শব্দ করে না। তবে আমরা নিজেরা নিজেরা যখন কুরু-পাণ্ডবদের মতো মারামারি করি, তখন মাননীয় ভিসি মহোদয় আমাদের মাথা ঠান্ডা করার ব্যবস্থা করেন। অনেক ধৈর্য ধরার আহ্বান করেন, কীভাবে এই সময় টিকে থাকতে হবে সে-কথা খুব গুছিয়ে বলেন। কাজে কাজেই আমরা অনেক কিছু শিখি। শেখর নামে আমাদের এক বড় নেতা একবার আফসোস করে আমতলার জমায়েতে বললো, ‘আমাদের একটা দুঃখ থেকেই যাবে, আর সেটা আমরা কোনোদিন মেটাতে পারবো না।’  ফজল বলে, ‘গুরু, কিসের দুঃখ?’ নেতা বলে, ‘ধর, আমি এই সাত বছর ক্যাম্পাসে আছি, একটা মেয়ে কোনোদিন সজ্ঞানে আমার হাত ধরে হাঁটেনি, একটা প্রস্তাব পাইনি কোনোদিন। অথচ ক্যাম্পাসে প্রেমের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে, বোরকা পরা মেয়েদেরও একটা করে বয়ফ্রেন্ড আছে। আমাদের দিকে কেউ তাকায় না। হ্যাঁ, জোর করে, ভয় দেখিয়ে কয়েকজনকে বাইকের পিছনে তুলেছি, তবে কেউ মনের কথা বলেনি, ভালোবাসেনি।’ জব্বার নামে আর এক লিডার হো-হো করে হেসে ওঠে। সে বলে, ‘করবি মাস্তানি, আর মেয়েরা তোকে ভালোবাসবে, তোর পেটে বোমা ফেললেও তো একটা শব্দ বের হবে না। তোকে কেন মেয়েরা পছন্দ করবে, জোর করে প্রেম হয় না।’ আমরা ছোটরা আর কিছু বললাম না। এসব নিয়ে কখনো আলাপ হয় না। আজ প্রথম শুনলাম যে নেতাদের মনে অনেক দুঃখ। আমরা তো মনে করি, তারা বহাল তবিয়তে আছে। গাড়ি চালায়, সিঙ্গেল রুমে থাকে, ফ্রি খায়, আয় করে, বাড়িতে টাকা পাঠায়, সবাই নেতা নেতা করে সালাম করে, তাদের মনেও দুঃখ? বাচ্চু বাঁ-হাতের কনিষ্ঠা দিয়ে কান চুলকাতে চুলকাতে আমার দিকে এগিয়ে এসে নিচু স্বরে বলে, ‘হরিস কত?’ আনন্দ মিটমিট করে হাসে।

একটু মেঘ করলেই যে বৃষ্টি হবে এমন কপাল এ-অঞ্চলের মানুষের নেই। তবে সত্যি সত্যি গগন শিরীষের ওপর দিয়ে বারকয়েক ঝড়ের মতো হতেই সারা ক্যাম্পাসের আকাশ অন্ধকার হয়ে গেল। পাখিগুলো মেয়েদের হলের পুকুরের পাশের গাছপালা থেকে আকাশে পাক খেতে থাকলে আনন্দ খ্যাক খ্যাক করে ওঠে, ‘কি রে! বিষ্টি হবে নাকি?’ আমি বলি, ‘কী জানি হলিও হতি পারে।’ আমরা তখন ভিসির বাড়ির সামনে কালুর দোকানে লাল চায়ের অর্ডার দিয়ে বেঞ্চে বসে আছি। জাহিদ ওর বাজাজ বাইক নিয়ে ছুটতে ছুটতে এসে কড়া ব্রেক করে। আনন্দ বাঁ-কান উঁচু করে এক চোখ ট্যারা করে ওর দিকে তাকায়। মানে, কেইসটা কী? আমরা সারাদিন নানা ফন্দি-ফিকির করে আবু ভাইয়ের ক্যান্টিনে বাকি খেয়ে কেবল এসে বসলাম, ‘এখন সিগারেট ধরাব, চা খাবো।’ জাহিদ বলে, ‘শোন ঘটনা খারাপ। লতিফ হলের এপারে সাব্বির আর নাইম ভাইয়ার দুই গ্রুপের মধ্যে মারামারি শুরু হয়ে গেছে। শহীদ স্মৃতি হলের কন্ট্র্রাক্টরকে নাইম ভাইয়া পিটিয়ে রাস্তায় ফেলে দিয়েছিল। সাব্বির ভাইয়া এসে নাইম ভাইয়ের দিকে কোনো কথা না বলে শুট করে। নাইম ভাইয়ার বাঁ-হাতে গুলি লাগে। আমরা এখন কী করবো। ওখানে রক্তারক্তি অবস্থা। দশ-বারোজন আহত। নাইম ভাইয়া এখনো পড়ে আছে ড্রেনের পাশে, অ্যাম্বুলেন্স আসেনি এখনো।’ আনন্দ বলে, ‘আমাদের তো নাইম ভাইয়াকে সাহায্য করা উচিত, তবে গেলেই গুলির মুখে পড়বো।’ আমি বললাম, ‘যাই চল, দেখি, নাইম ভাইয়া আমাদের গ্রুপের নেতা। দেখতে হবে তো আমাদেরই।’

আমরা গিয়ে দেখি পুলিশ চারদিক দিয়ে জায়গাটা ঘিরে ধরেছে। নীল একটা গাড়িতে প্রক্টর স্যারকে দেখা গেল। সবাইকে গোলাগুলি বন্ধ করতে বললেন তিনি। আমাদের অবাক করে দিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে সবাই থেমে গেল। আমরা বাঁচলাম আপাতত। আনন্দ আজিজকে বলে, ‘তাইলে বখরা কম-বেশি নিয়েই তো গণ্ডগোল, না?’ সে বলে, ‘ওসব বড়দের খাবার, আমাদের যা দেয় তাই নিয়ে চলি। তবে তোর অনুমান ঠিক। না হলে কন্ট্রাক্টর কেন গুলি খাবে।’

যা হোক আবার ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে ঘুরি। বাবা-মা’র সঙ্গে বিস্তর মিছে কথা বলি, লেখাপড়া না করে দলীয় ক্যাডার হয়েছি এবং বেশ মজায় আছি, সেটা তো বলতে পারি না। এতটুকু লজ্জা অন্তত এখনো আছে। তো আনন্দ রাহি নামে এক মেয়ের প্রেমে পড়ে এরই মধ্যে, সে ক্যাডার পরিচয় দিয়েছে কি না জানি না। তবে সে মেয়েটার পিছু পিছু, পাশাপাশি ও হাত ধরাধরি করে ঘোরে, মেয়েটা ওর সঙ্গে কীভাবে ঘোরে আমি ভাবি। এমনিতেই ক্যাম্পাসে প্রেম নতুনভাবে বিকশিত হয়েছে বলা যায়, প্রচুর জুটি প্রকাশ্যে প্রেম নিবেদন করে এবং বেশ কাছাকাছি থাকে। আমরা দৃশ্যত তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি। এরই মধ্যে আনন্দ কেমন করে জড়িয়ে গেল। মেয়েটা ওর সম্পর্কে জানে বলে মনে হয় না। তবে আনন্দ যে এটা করবে তার লক্ষণ ওর মধ্যে আমি কখনো টের পাইনি। এটা এখন খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। আমরা অবসরে নানা জায়গায় আনাগোনা করেছি আনন্দের সঙ্গে। ক্যাম্পাসে যেখানে জুটিরা একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে বা দাঁড়ায়, একটু আড়াল পেলে চুমুটুমু খায় বা আলিঙ্গন করে, আমরা সেখানে একটু দৃষ্টি বুলাই। আনন্দের কথামতো দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাই। সে-সময় আমরা ক্যাডারের বেশে যাই না, বাইক রেখে যাই। ধরো, তুতবাগান বা ইবলিশ চত্বর বা বধ্যভূমির আশপাশ দিয়ে, কিংবা সিনেট ভবনের পেছন দিকে আমরা ঘুরি। আনন্দ সব জায়গা চেনে, সন্ধের সময় বা একটু পরে জুটিরা খুব উসখুস করে আর আমরা সেসব দেখি, উপলব্ধি করি। নতুন জুটি দেখলে বিশেষত লজ্জা পাওয়া বা প্রথম বিধ্বস্ত হওয়া মেয়েদের দেখলে আমরা বুঝতে পারি। আমাদের পাকা অভিজ্ঞতা হয়। অন্ধকারে প্রাচীরের আড়ালে বা গাছের আড়ালে জুটিরা যে কাণ্ড করে, তাও আমরা দেখি। বোরকা পরা মেয়েরাও এগিয়ে যাচ্ছে সমানতালে। একটা ছেলে একদিন সহকারী প্রক্টরের তাড়া খেয়ে গার্লফ্রেন্ডের বোরকার মধ্যে ঢুকে পড়লে মহা হইচই শুরু হয়। তবে কেউ কেউ লজ্জা পায়, প্রক্টরিয়াল বডির টিচাররা একটা গাড়ি নিয়ে জুটিদের পেছনে জোঁকের মতো লেগে থাকে, তারাও আমাদের মতো মানসিক রোগী হয়ে গেল কি না জানতে চাইলে আনন্দ খেঁকশিয়ালের মতো হাসে, ‘তুই তো ঠিক ধরেছিস রে।’

অবশ্য আমরা যখন ছুটি পাই বসদের কাছ থেকে, তখন দিনের বেলায়ও সারা ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করি। বিকেলের দিকে এক একটা মেয়ে এক একটা ছেলের বাইকের পেছনে বসে তাকে জাপটে ধরে আর ছেলেটা খুব জোরে বাইক চালায়, মেয়েটার ওড়না বাতাসে তীব্রবেগে পাক খায়, জিগজ্যাগ মটর চালাতে চালাতে তারা কোথায় অদৃশ্য হয়ে যায়, কেউ জানে না, স্বয়ং প্রক্টরও না। বাইক কোম্পানি এদের জন্যই বাইক তৈরি করেছে কি না জানি না, তবে ছেলের সিটের চেয়ে মেয়ের সিটটা প্রায় দশ ইঞ্চি উঁচু, সে কাত হয়ে লেপ্টে থাকে বয়ফ্রেন্ডের গায়ে। কেউ আবার দুদিকে পা দিয়ে দুই হাত দিয়ে ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে। তসলিমা দেশে থাকলে এখন আর আফসোস করতেন না, মেয়েরা কত আনন্দের সঙ্গে ছেলেদের পেছনে ছেলেদের মতো বসছে। গরিব জুটিরা, যাদের মোটর বাইক নেই, তারা বাইসাইকেল চালিয়ে ঘোরে। ছেলেটা মেয়েটাকে সামনে লোহার রডের ওপর বসায়, আর একটু সুখানুভব পায়। তাদের সংখ্যা অবশ্য কম। বস্তুত ক্যাম্পাসে জুটি ছাড়া যারা আছে তারা হতভাগা। এই যৌবনে বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ে তারা প্রেম করতে পারে না, প্রেমবঞ্চিতদের একটা সমিতিও আছে। তারা একটা দিবস ঠিক করেছে, মাঝে মাঝে একটা বড় ব্যানার নিয়ে মিছিল করে। আর ভিসির বাসভবনের সামনের রাস্তায় সেটা বাঁশের সঙ্গে লটকে রাখে। আমরা ক্যাডার হলেও তো মানুষ, যুবক মানুষ, রক্ত-মাংসের মানুষ। আনন্দ প্রতিদিন আফসোস করে, সে বলে, ‘আমার জীবনের লক্ষ্য এখন একটাই।’ আমি বললাম, ‘কী?’ সে বলে, ‘আমার বাইকের পেছনে আমার গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে ঘুরবো। আমার আর কিছু দরকার নেই।’ সে যে আনন্দের কথা মুখে বলছে না সেটা তো বুঝতে আমার বাকি থাকে না। পুরুষ হয়ে আমিও তো তা চাই; কিন্তু আমি বলতে পারি না, ও পারছে। আমি শুধু বললাম, ‘তোর তো গার্লফ্রেন্ড নেই রে।’ সে বলে, ‘নেই তো, বানাবো।’ আমি ভ্রু-কুঁচকে তাকালে সে বলে, ‘হাসছিস না, তোকে বানিয়ে দেখাবো।’

আমরা দলীয় ক্যাডারে পরিণত হয়েছি তাতে আমাদের বেঁচে থাকার একটা ব্যবস্থা হয়েছে এবং এ নিয়ে আমাদের খুব হা-পিত্যেস নেই। তবে মাঝে মাঝে দু-একজন ভালো ছাত্রের সঙ্গে আলাপের পর মন খারাপ হয়ে যায়। যারা অনেক লেখাপড়া করে সোনার মেডেল পায় ভিসির কাছ থেকে, শিক্ষক হিসেবে চাকরিতে যোগ দেয়। দেশের বাইরে চলে যায় আরো লেখাপড়া করতে। আমাদের চেয়ে পাঁচ বছরের বড় ক্যাডার জামাল ভাই ক্যাম্পাসে একটা অফিসার হওয়ার চেষ্টা করেন বহুদিন, ফ্যা ফ্যা করে ঘুরতেন প্রশাসনের লোকদের পেছন পেছন। শেষ পর্যন্ত দলীয় বিবেচনায় তিনি একটা হলের পিয়ন হয়েছেন। আমাদের হলের গেটে সেদিন দেখা হলেই মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে গেলেন, তবে একটু পরে আবার সামনাসামনি পড়লে আর পালাতে পারলেন না। জামালভাইকে আমি খুব কাছে থেকে চিনতাম। আমাকে চা খাওয়াতে খাওয়াতে বলেন, ‘এখনো পথ আছে রাকিব, এই সব বাদ দাও। আমিও বড় ক্যাডার ছিলাম, দেখছ এখন আমার কী অবস্থা। দু-একজন লুটপাট, চুরি-চামারি করে কিছু অর্থকড়ি নিয়ে হয়তো কিছু একটা করবে, আর বেশিরভাগের অবস্থা হবে আমার মতো। আর তোমার যদি লেখাপড়া না থাকে এই বড় বড় নেতা তোমার সঙ্গে কুকুরের মতো ব্যবহার করবে, আর সরকার পাল্টে গেলে তো গুলি খেয়ে মরবে, কোনো সন্দেহ নেই।’ আমি জামালভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি, মুখটা রাগে না ক্ষোভে থমথম করছে। আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। স্টেডিয়ামের গা-ঘেঁষে ইট বিছানো রাস্তা দিয়ে আবু ভাইয়ের পুরনো ক্যান্টিনের পাশ দিয়ে উদ্ভিন্নের মতো হাঁটতে থাকি। মন আমার আগে খারাপ হতো, অনেকদিন ভোঁতা ছিলাম, আজ আবার খুব কান্না পেল। মায়ের কথা মনে হলো, মাকে সব মিথ্যা কথা বলবো কীভাবে। আনন্দ নাকি সব বলেছে, আমি বলতে পারিনি। বাবা শুনলে হয়তো হার্টফেল করবে। আমি বলেছি, ‘আমি টিউশনি করে খরচ চালাই।’ যারা ক্যাডার হয়ে গর্ব করে বলে বেড়ায়, তারা অবশ্য আনন্দে থাকে সব সময়। আমি পারছি না। আমতলায় বাইকটা রেখে বেদিতে বসে থাকি। আলতাফ নামে ছেলেটা এক কাপ চা দেয়। চেনে ভালো করেই। প্রচুর চিনি দিয়ে চা খাই ফেনসিডিলের নেশা হওয়ার পর। সিগারেট একটা ধরাই। আনন্দ গেল কোথায়? চায়ে চুমুক দিতেই দেখি, সে শিস বাজাতে বাজাতে এদিকে আসছে। ওর বাইকটা লাইব্রেরির পেছনে রাখা।

আমার ইয়ামাহা ১২৫ বাইকটা আমার ঠিক পেছনে ছিল, আমি প্লাস্টিকের চেয়ারটা ঘুরিয়ে নিয়ে বাইকটার দিকে গভীরভাবে তাকাই। আনন্দ বলে, ‘তোর কী হয়েছে? মন খারাপ? কেন খারাপ?’ আমি বলি, ‘মন খারাপ আমাদের কেন হবে?’ সে বলে, ‘হেঁয়ালি বাদ দে। খারাপ হয়ে গেছি ঠিক আছে, তাই বলে বন্ধুর মুখের দিকে তাকালে বুঝতে পারবো না যে সে মন খারাপ করে আছে।’ বলি, ‘বাবার একটা সাইকেল ছিল, হারকিউলিস কোম্পানির। খুব পুরনো আর হাড়জিরজিরে, বেশিরভাগ জিনিস নষ্ট তবু খুব ভালো চলতো, আমি ছোটবেলায় ওইটা দিয়েই সাইকেল চালানো শিখেছি। বাবাকে ফাঁকি দিয়ে শিখে ফেলেছিলাম, পরে অবশ্য বাবা আর কিছু বলতো না, আজ বাবার সাইকেলটার কথা খুব মনে পড়ছে। এই বিনা টাকায় পাওয়া, কোথা থেকে লুট করা এই সাইকেলটা বাবার সাইকেলের ধারেকাছেও না। তবু সেটা সম্পদ। বাবা নানা কাজ করতো সাইকেল চালিয়ে, পুরো সংসারের কাজ, আর আমরা কী করছি? আমরা তো নেতাদের দাস, স্পার্টাকাস, হাত-পা বাঁধা। এখুনি কোনো নেতা ডাক দিলে আমরা কুত্তার মতো হাঁপাতে হাঁপাতে লেজ তুলে দৌড় দেব। জানতে চাইবো না কেন দৌড় দিতে হবে।’ আনন্দ আমার দিকে তাকায়, আলতাফ ছেলেটা আরো দু-কাপ চা দেয়, আনন্দ সিগারেট ধরায়। আমি ধরাই না। সে বলে, ‘তোর ধারণা আমি এসব জানি না, উপলব্ধি করি না, তাই না? আসলে না বুঝে থাকার ভান করি, সবাই করে না। আমিও প্রায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি; কিন্তু মাঝে মাঝে তোর মতো অবস্থা হয়, তোকে বলি না, বললে তুই যদি মন খারাপ করিস।’ আমি ওর দিকে ভালো করে দেখি, উস্কোখুস্কো লম্বা চুলে সে একটা গাডার লাগিয়েছে, চোখের কোণে নেশার জন্য কালো দাগ, একটা ফাটা ছাইরঙের জিন্সের প্যান্ট পরে আছে, আর হাঁটু ভাঁজ করার কারণে পিস্তলের ওপরের অংশ বেরিয়ে এসেছে পকেট থেকে। আমি আমার পিস্তলের ওপর একবার হাত বোলালাম। কাউকে খুন করার কাজে এই জিনিস কখনো ব্যবহার করিনি, এখন মনে হচ্ছে নিজেকে খুন করার কাজে ব্যবহার করবো।

চা শেষ হওয়ার আগেই কিসমত নামে নতুন এক নেতা ফোন করে আনন্দকে। ঢাকার এক নেতা আসছে, তাকে এয়ারপোর্ট থেকে এসকর্ট করে আনার জন্য একশ মোটর বাইকে করে তিনশোজনকে যেতে হবে  এবং এক্ষুনি। আমি বললাম, ‘আমি যাবো না।’ আনন্দ বললো, ‘দ্যাখ, এই তো আমাদের জীবন, তোকে বাইক দিয়েছে তো এইসব করতে।’ আমি বলি, ‘আমি ওই মূর্খ লম্পট নেতার জন্য যাবো না। ওকে আনতে আমি বিমানবন্দরে যাবো না।’ আনন্দ বলে, ‘তুই কি জানিস তুই কী বলছিস?’ আমি বলি, ‘খুব ভালো করেই জানি, আমার সব বন্ধ হবে, বহিষ্কার হবো দল থেকে, আমাকে সবাই মিলে পেটাবে, তবু আমি যাবো না। তুই আমার বাইক নিয়ে যা, কাউকে চালাতে বল। আমি এই বাইক আর চালাবো না।’ আনন্দ বলে, ‘তোর কী হলো, আমার কথা শোন, চল, মটর স্টার্ট দে। বস ফোন করবে আবার।’

আমার ঠিক কী হলো জানি না, বহুদিন পর বাবার রাগত চোখদুটো দেখতে পেলাম। আমার দিকে তাকিয়ে আছে স্থিরভাবে। মুখে কী যেন বলছে, আমি শুধু খোকা, খোকা, শুনতে পেলাম। আবার দেখলাম বাবা, হারকিউলিস নিয়ে বাড়ি ফিরছে, বাজারের ব্যাগটা হারকিউলিস থেকে নামাচ্ছে মা, আমাদের  চার ভাইবোনের জন্য ছোট ছোট কাগজের ঠোঙায় মুড়ি আর হাতে ভাজা চানাচুর। একটু পরে সবাই বারান্দায় বসে খাবো। আনন্দ আমাকে ঠেলা দিলে আমি চমকে উঠি। আমি আস্তে আস্তে বাইকের দিকে এগিয়ে যাই, তেলের ট্যাংকির ছিপি খুলি, একটু পিছিয়ে এসে পকেট থেকে ম্যাচ বের করে আগুন ধরিয়ে ছুড়ে মারি বাইকের ওপর। পরপর দুবার দুটো শলাকা ছুড়ে দিতেই দপ করে আগুন জ্বলে ওঠে। আনন্দ আমার সঙ্গে পারে না। আমার গায়ে অসুরের শক্তি এখন। আনন্দ আমাকে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। মনে করেছে আমি আগুনের দিকে যাবো।

আমরা দুজন বাইকটাকে পুড়ে যেতে দেখি। পেছন দিকে অজস্র লোকজন জড়ো হয়। বড় দু-একজন নেতার মুখও দেখতে পাই। তবে আপাতত কেউ আমাদের কিছু বলে না। বাইকটা সম্পূর্ণ পুড়ে গিয়ে কঙ্কালটা খাড়া হয়ে থাকে। ঠিক বাবার হারকিউলিসের মতো, পুনর্জন্ম হয়েছে যেন।

আমি সেদিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকি।