অনুবাদ : নাজনীন সুলতানা নীতি
মার্ক জিরনডিন এতোদিন ধরে শহরের প্রকৌশল বিভাগের নথিপত্র শাখায় কাজ করছিলেন যে, এই শহরের প্রতিটি জায়গার অবস্থান, নাম, সড়ক বিভাজন থেকে শুরু করে সরু গলি, কানা গলি, সংকীর্ণ ঘুরতি পথের সবকিছু তার মন-মস্তিষ্কে একেবারে মানচিত্রের মতো আঁকা হয়ে গিয়েছিল। পুরো মন্ট্রিয়লে এতো জানাশোনার অধিকারী কেউ ছিল না; এমনকি একডজন পুলিশ এবং ট্যাক্সি ড্রাইভার মিলেও এই জায়গায় তাঁকে হারাতে পারতো না। তার মানে এই নয় যে, তিনি রাস্তাগুলোর নাম জাদুমন্ত্রের মতো বলে যেতে পারতেন। তবে অল্পবিস্তর যাতায়াত ছিল বলে রাস্তাগুলো স¤পর্কে বেশ ভালোভাবেই জানতেন তিনি। রাস্তাগুলোর অস্তিত্ব স¤পর্কে জানতেন, কোনটি কোথায় কোন অবস্থায় আছে সেটিও জানতেন। আর এটিই তাঁকে বিশেষজ্ঞ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। বলা চলে, নথিপত্র শাখার অবিসংবাদিত বিশেষজ্ঞে পরিণত হয়েছিলেন তিনি, যেখানে এ্যাশেট থেকে জোটিক পর্যন্ত সকল রাস্তার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমস্ত বিবরণ তালিকাভুক্ত থাকত। অভিজাত, প্রকৌশলী, পানির লাইন পরিদর্শকের মতো ব্যক্তিসহ সবাই যে-কোনো বিশেষ বা বিস্তারিত তথ্যের প্রয়োজনে তাড়াহুড়ো করে তাঁর কাছেই আসত। যতই তারা তাঁকে অধস্তন কেরানী হিসেবে তুচ্ছজ্ঞান করত না কেন, তাঁকে সবারই প্রয়োজন হতো।
মার্ক ওভেন স্ট্রিটের (শেরব্রুক ইস্ট থেকে সেন্ট ক্যাথরিনে উত্তর ও দক্ষিণ দিকে যা চলে গেছে) নিজের বাসা থেকে তাঁর অফিসকেই বেশি পছন্দ করতেন, যদিও সেখানে তাঁর কাজে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপক কিছু ছিল না, তবুও সেটি তাঁর পাশের ঘরের প্রতিবেশী আর বাড়িওয়ালার রোজকার চিৎকার-চেঁচামেচি আর শোরগোলের চেয়ে ভালো ছিল। একবার মার্ক তাঁর পাশের ভাড়াটিয়া লুইকে নিজের পদের গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সুফল মেলেনি। লুই ঠিকই মুখ বাঁকিয়ে বিদ্রƒপ করেছে তাঁকে।
‘তো ক্রেগ যদি ব্লিউরিতে ঢোকে আর ব্লিউরি যদি পার্ক হয়, তাতে কি এসে যায়? এতে উত্তেজনার তো কিছু নেই।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে, আমি আপনাকে দেখাচ্ছি’, মার্ক বললেন। ‘আগে বলুন তো, আপনি কোথায় থাকেন?’
‘আপনি কি পাগল? এই ওভেন স্ট্রিটেই তো থাকি! আর কোথায়?’ লুইয়ের জবাব।
‘সেটা আপনি কীভাবে জানলেন?’
‘আমি কীভাবে জানি মানে কী? আমি তো এখানেই থাকি। ভাড়া দিই এখানে, আমার চিঠিপত্র এখানেই তো আসে, নাকি?’
মার্ক ধৈর্যের সঙ্গে মাথা নাড়লেন। বললেন, ‘এর কোনোটিই তো প্রমাণ নয়। আপনি এখানে ওভেন স্ট্রিটে থাকেন, কারণ সেটাই আমার নথিপত্র শাখার সূত্র বলছে। আর পোস্ট অফিসও এই ঠিকানায় আপনাকে মেইল পাঠাচ্ছে, কারণ আমার কার্ড তালিকায় তাই আছে। কার্ডগুলো যদি এটি না বলে তাহলে আপনার অস্তিত্ব থাকবে না এবং এই ওভেন স্ট্রিটও থাকবে না। এটাই হচ্ছে আমলাতন্ত্রের জয়, বুঝলেন বন্ধু!’
লুই মহাবিরক্তি নিয়ে চলে যাওয়ার আগে বিড়বিড়িয়ে বললেন, ‘এসব কথা বাড়িওয়ালাকে বলে দেখুন।’
মার্ক তার অবিসংবাদিত কাজ অব্যাহত রেখেছিলেন। এর মধ্যে তাঁর চল্লিশতম জন্মদিন এলো এবং কোনো রকম লক্ষণীয় কিছু হওয়া ছাড়া চলেও গেল। দিনের পর দিন এভাবে ঘটনাবিহীনভাবে কাটল। এক রাস্তার নতুন নামকরণ হলো, আরেকটা তৈরি হলো, তৃতীয়টি প্রশস্ত করা হলো। আর এই সবকিছুই নথিপত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা হলো। তারপর এমন কিছু ঘটল যা মার্ককে শুধু বিস্মিতই নয়, হতবিহ্বল, স্তম্ভিত করে দিলো, বলা চলে, পুরো নথিপত্র শাখার জগৎটাকেই একরকম ভিত্তিমূল ধরে কাঁপিয়ে দিলো।
এক আগস্টের বিকেলে, একটি ড্রয়ার পুরোপুরি খুলতে গিয়ে কোথায় যেন আটকে গেল। ভালো করে দেখতে গিয়ে মার্ক দেখলেন, ড্রয়ারের একদম পেছনে ওপর আর নিচের মাঝে একটি কার্ড আটকে আছে। মার্ক সেটিকে টেনে বের করলেন। দেখা গেল, এটি একটি পুরনো ইনডেক্স কার্ড, নোংরা এবং ছেঁড়া, তবে এখনো এর সুস্পষ্ট পাঠোদ্ধার করা সম্ভব। এতে রু দ্য লা বুতেই ভেত বা গ্রিন বটল স্ট্রিটের লেবেল লাগানো ছিল।
মার্ক অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তিনি এতো অদ্ভুত নামের জায়গা তো দূরের কথা, এ-জাতীয় নামের কোনো কিছুই কখনো শোনেননি। নিঃসন্দেহে আধুনিক ধারা অনুসারে এর অন্য কোনো নামকরণ হয়েছে। তিনি কার্ডে তালিকাভুক্ত বিবরণগুলো ভালো করে দেখে রাস্তার নামের মূল ফাইলগুলোতে এলোমেলোভাবে খুঁজতে শুরু করলেন। কিন্তু এই নামটা সেখানে ছিল না। তিনি ক্যাবিনেটের মধ্যে যত্নসহকারে সময় নিয়ে আবারো খুঁজলেন। সত্যিই এ-নামের কিছু ছিল না, একেবারে কিছুই নয়! আরো একবার তিনি কার্ডটি পরীক্ষা করলেন। একেবারে নির্ভুল। জায়গাটিতে নিয়মিত রাস্তা পরিদর্শনের সর্বশেষ তারিখটি ঠিক পনেরো বছর, পাঁচ মাস, চৌদ্দ দিন আগের।
এই অদ্ভুত সত্যটি বোমার মতো ফেটে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মার্ক আতঙ্ক নিয়ে কার্ডটি নামিয়ে রাখলেন। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আবারো নুয়ে পড়ে দেখতে লাগলেন সেটি।
এটি বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া একটি রাস্তা! পনেরো বছর এবং তারও বেশি সময় ধরে এটি মন্ট্রিয়লের প্রাণকেন্দ্রে বিদ্যমান ছিল। সিটি হল থেকে আধা মাইল দূরেও নয়, অথচ কেউ এর কথা জানত না। জলের মধ্যে একটি পাথর যেভাবে হারায় ঠিক সেভাবেই যেন এটি চোখের সামনে থেকে ছিটকে গিয়েছিল। অবচেতনে মার্ক কখনো কখনো এমন সম্ভাবনার কথা ভেবেছিলেন। শহরে কত অস্পষ্ট জায়গা, মোড় ঘোরানো সড়ক এমনকি মিশরের গোলকধাঁধার মতো জটিল রাস্তাও রয়েছে। তবে এভাবে একেবারে হারিয়ে যাওয়াটা সম্ভব নয়, অন্তত এই হাতে থাকা ত্রিকালজ্ঞ ফাইলের বেলায় এটি অস্বাভাবিকই বলতে হবে। অথচ সত্যিই এই রাস্তার কোনো হদিস নেই এখানে। অথচ শুধু এই কার্ডেই তা আছে। এবং এটি এক ডায়নামাইটের মতো। পুরো অফিসের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলতে এটুটুুই যথেষ্ট।
হতবুদ্ধি অবস্থায় মার্কের মনে পড়ল, কীভাবে তিনি প্রথমদিকে কাজ শুরু করার কিছু পরে, তাঁর বিভাগটি অন্য তলায় স্থানান্তরিত হয়েছিল। পুরনো ধারার নথিপত্রগুলো বাতিল করে সব কার্ড নতুন করে তৈরি করা হয়েছিল। নিশ্চয়ই সেই সময় গ্রিন বটল স্ট্রিটের কার্ডটি ওপরের এবং নিচের ড্রয়ারগুলির মধ্যে কোথাও আটকে ছিল। তিনি কার্ডটি নিজের পকেটে রেখে বাড়ি ফিরে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে বসলেন। সে-রাতে খুব বাজে ঘুম হলো তাঁর। ভয়াবহ সব দানবীয় চরিত্র তাঁর স্বপ্নে বারবার ঘুরেফিরে আসছিল। তাদের মধ্যে একটিতে দেখতে পেলেন, তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তা প্রকাণ্ড আকার নিয়ে উন্মাদের মতো আচরণ করছেন এবং তাঁকে একটি লাল গনগনে ফাইলিং কেবিনেটে জোর করে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন।
পরদিন তিনি মনস্থির করলেন। অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে বিকেল বেলাটা ছুটি নিয়ে কম্পিত বুকে সেই রাস্তার সন্ধানে রওনা হলেন। যদিও এই এলাকার অবস্থান সম্পর্কে তিনি ভালো করেই জানতেন, তবু মানসিক অস্থিরতার চাপে তিনি জায়গাটি দুবার অতিক্রম করে আবার ফিরে এলেন। দ্বিধাগ্রস্ত মার্ক চোখ বন্ধ করে স্মৃতিতে অঙ্কিত নির্ভুল মানচিত্রের ওপর ভরসা করে সরাসরি ঢোকার মুখের দিকে হাঁটতে থাকলেন। পথটি এতোই সংকীর্ণ যে, তিনি তাঁর প্রসারিত হাত দিয়ে পাশের দেয়ালগুলোকে ¯পর্শ করতে পারছিলেন। পথের ফুটপাত থেকে কয়েক ফুট দূরে একটি লম্বা শক্ত কাঠের কাঠামো দেখা গেল, যা রোদ-বৃষ্টির স্পর্শে অনেকটা ক্ষয়ে গিয়েছিল। মাঝখানে একটি সরল কাঠের দরজা। মার্ক দরজাটি খুলে ভেতরে প্রবেশ করলেন। তাঁর সামনেই ছিল গ্রিন বটল স্ট্রিট।
পুরো বিষয়টি সম্পূর্ণ বাস্তব আর নিশ্চিত করার মতো। পাথরে গাঁথা একটা পথ, দুপাশে তিনটি ছোট ছোট বাড়ি মিলে মোট ছয়টি বাড়ি, প্রতিটির সামনে ছোট্ট একটি বাগানও, যা লোহার বেষ্টনী দিয়ে আলাদা করা, যদিও পুরনো কোয়ার্টারগুলো ছাড়া এরকম লোহার বেষ্টনী অন্যসব জায়গা থেকে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। বাড়িগুলোতে নিবিড় যত্নের ছোঁয়া আর দেখাচ্ছিল অত্যন্ত পরিপাটি এবং প্রত্যেকটিতে ছিল নিবিড় যত্নের ছোঁয়া। পাথর বাঁধানো রাস্তাগুলোও যেন একটু আগেই কেউ পানি দিয়ে ধুয়ে গেছে। ছয়টি বাড়ি প্রাচীন গুদামগুলোর জানালাবিহীন ইটের দেয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল, যা রাস্তার একদম শেষ প্রান্ত পর্যন্ত যুক্ত হয়েছিল। মার্ক পুরো জায়গাটি একনজর দেখেই বুঝতে পারলেন কীভাবে এর এমন অদ্ভুত নাম হয়েছে। কেননা সত্যিই এলাকাটি ছিল হুবহু বোতল আকৃতির।
ওপরে নীল আকাশ আর সূর্যের আলোয় উজ্জ্বল পাথরের রাস্তা ও বাগানগুলো মুহূর্তের জন্য হলেও মার্ককে এক মুহূর্তের শান্তি ও স্থিতির অনুভূতি দিলো। দৃশ্যটি এতো সুন্দর ছিল যে, মনে হচ্ছিল, যেন পঞ্চাশ বছর আগের ছাপা কোনো ছবি। তিনি তাঁর ডানদিকে প্রথম বাড়ির বাগানে দেখতে পেলেন আনুমানিক ষাট বছর বয়সী একজন ভদ্রমহিলা গোলাপ গাছে জল দিচ্ছেন। মার্ককে দেখে ভদ্রমহিলা এমন নিশ্চলের মতো তাকিয়ে রইলেন যে, তাঁর হাতে থাকা পানি দেওয়ার পাত্র থেকে তার অজান্তে পানি গড়িয়ে পড়তে থাকল।
মার্ক তাঁর দিকে টুপি খুলে সম্ভাষণের ভঙ্গিতে বললেন, ‘জি ম্যাডাম, আমি শহরের প্রকৌশল বিভাগ থেকে এসেছি।’
ভদ্রমহিলা সম্বিত ফিরে পেয়ে হাতের পানি দেওয়ার পাত্রটি মাটিতে নিমিয়ে রেখে বললেন, ‘তো শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেলেন তাহলে।’
একথা শোনার আগে পর্যন্ত মার্কের মোটামুটি দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, তিনি একটি নির্দোষ এবং হাস্যকর ত্রুটি ছাড়া আর তেমন কিছু করেননি। কিন্তু ভদ্রমহিলার কথায় সে-বিশ্বাস আকস্মিকভাবে উবে গেল। আসলেই তো এটি কোনো ভুল ছিল না।
মার্ক অনেকটা প্রাণহীন কণ্ঠে বললেন, ‘অনুগ্রহ করে আমাকে একটু খুলে বলুন।’
‘সে এক দারুণ গল্প।’ ভদ্রমহিলা বললেন, ‘অনেক বছর ধরেই গ্রিন বটল স্ট্রিটের ভাড়াটিয়ারা একে অপরের সঙ্গে খুব বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নিয়ে বসবাস করছিল। বাড়ির মালিক এখানেই এক ছোট্ট বাড়িতে থাকতেন। তো বাড়ির মালিক তাদের সঙ্গে এতোটাই জড়িয়ে গিয়েছিলেন যে, মৃত্যুর আগে বন্ধুত্বের স্মারক হিসেবে তিনি তাদের সবাইকে সামান্য অঙ্কের অর্থসহ নিজের সমুদয় সম্পত্তি দলিল করে দিয়ে যান। ‘আমরা ঠিকঠাক কর দিয়েছি এবং আমাদের সম্পত্তি সম্পর্কে নিয়মিত বিরতিতে নানা কর্তার প্রশ্নের জবাব দিয়েছি, সেইসঙ্গে বহুবিচিত্র সব ফরমও পূরণ করেছি। তারপর কিছুদিন গেলে আমাদের কাছে নোটিশ আসা বন্ধ হয়ে গেল, সুতরাং আমরাও আর কোনো কর পরিশোধ করিনি। কেউ আমাদের কোনো রকম বিরক্তও করে না; কিন্তু অনেক পরে আসলে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে, কোনোভাবে তারা আমাদের ভুলে গেছে।’
মার্ক মাথা নাড়িয়ে সায় দিলেন। অবশ্যই, গ্রিন বটল স্ট্রিট যদি শহরের জানাশোনা থেকে কোনোভাবে বাদ পড়ে যায় তবে কোনো পরিদর্শকই সেখানে যাবেন না, না কোনো আদমশুমারির লোকজন বা কর আদায়কারী যাবেন। সবাই খুশিমনে নির্ভুল ফাইলিং কেবিনেট যেখানে পাঠাবে, সেখানে যাবে। ভদ্রমহিলা বলতে থাকলেন, ‘তারপর মাইকেল ফ্লানাগান, যিনি চার নম্বরে থাকেন, খুব আকর্ষণীয় ব্যক্তি তিনি, তার সঙ্গে আপনার অবশ্যই সাক্ষাৎ করা উচিত – তো মি. ফ্লানাগান আমাদের ডেকে বললেন, যদি অলৌকিক কিছু ঘটেই থাকে তবে আমাদের উচিত তাতে সহায়তা করা এবং তা মেনে চলা। তিনিই পথচলতি পথচারী বা কর্মকর্তাদের এই এলাকায় যখন-তখন প্রবেশ থেকে বিরত রাখার জন্য ঢোকার মুখের দরজাটি তৈরি করেছিলেন। আমরাও এটি তালা দিয়ে রাখতাম। তবে এতোদিন হয়ে গেল কেউ এদিকে আসেনি। তাই আমরাও এখন মাথা ঘামাই না।’
‘ও! আমাদের অবশ্য নানারকম ছোট ছোট কাজ করতে হতো, যেমন ডাকঘর থেকে আমাদের চিঠিপত্র সংগ্রহ করা, যা কখনোই দরজায় পৌঁছে দেওয়া হতো না। এখন আমাদের বাইরের জগতে যেতে হয় শুধু খাবার আর পোশাক কেনার জন্য।’
‘তো এতোদিন ধরে এখানে আর কোনো পরিবর্তন হয়নি?’ মার্ক জিজ্ঞাসা করলেন।
‘হ্যাঁ, আমাদের দুই বন্ধু মারা গিয়েছিল এবং তাদের ঘরগুলো কিছুদিনের জন্য খালি পড়ে ছিল। তারপর জ্যাঁ ডেসেলিন – তিনি ছয় নম্বরে থাকেন এবং মাঝে মাঝে শহরে যান, তিনি মি. প্লনস্কি নামে এক বাস্তুহারা লোককে নিয়ে এলেন। মি. প্লনস্কি ভেসে বেড়াতে বেড়াতে এতো ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিলেন যে, এখানে সানন্দেই আমাদের সঙ্গে থেকে যান। ওদিকে তিন নম্বরে মিস হান্টার খুব অমায়িক এক মানুষকে নিয়ে এলেন, সম্ভবত তাঁর দূরসম্পর্কের আত্মীয়। তাঁরা দুজনেই কিন্তু এখানকার পরিস্থিতি খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছেন।’
‘জি, আর আপনার পরিচয় ম্যাডাম?’ মার্ক জানতে চাইলেন।
মিষ্টি হেসে ভদ্রমহিলা বললেন, ‘আমার নাম সারা ট্রুসডেল, এখানে বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে আছি। আশা করি আমার শেষ দিনগুলোও এখানেই কাটবে।’ তিনি ভুলে গিয়েছিলেন মার্ক তাঁর পকেটে যে-গ্রেনেডটি বহন করছিলেন সেটি তাঁদের ছোট্ট পৃথিবীকে টুকরো টুকরো করে দিতে পারে। এই গ্রিন বটল স্ট্রিটে আশ্রয় খুঁজে পাওয়ার আগে তাঁদের সবাই কোনো না কোনো সমস্যা, ব্যর্থতা বা ক্ষতির শিকার হয়েছিলেন। নিজের অসন্তুষ্টির জীবন নিয়ে সচেতন মার্ক এসব ভেবে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন। নিজের অজান্তেই পকেটে থাকা কার্ডটি আঙুল দিয়ে নাড়তে লাগলেন।
‘মি. প্লনস্কি এবং মি. ফ্লানাগান একে অপরকে খুব পছন্দ করেন’, মিস ট্রুসডেল বলতে থাকেন। ‘তাঁরা দুজনেই বেড়াতে পছন্দ করতেন এবং তাঁরা তাঁদের স্মৃতিময় অভিজ্ঞতাগুলো নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করেন। মিস হান্টার পিয়ানো বাজান এবং আমাদের জন্য কনসার্ট করেন। এছাড়া মি. হ্যাজার্ড এবং ডেসেলিন আছেন, তাঁরা দাবা খেলতে খুব পছন্দ করেন এবং মদ তৈরি করেন। আর নিজের কথা বলতে, আমার কাছে এই ফুলগুলো আছে আর আছে আমার বইপত্র। সবকিছু মিলিয়ে আমরা বেশ আনন্দেই আছি।’
মার্ক এবং মিস ট্রুসডেল দীর্ঘক্ষণ ঘরে ঢোকার সিঁড়িতে চুপ করে বসে রইলেন। ধীরে ধীরে আকাশের নীল রং কালো হয়ে গেল, সূর্যটাও বাঁদিকে গুদামের প্রাচীরের পেছনে অদৃশ্য হয়ে গেল।
‘আপনাকে দেখে আমার এক ভাগ্নের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে’, মিস ট্রুসডেল হঠাৎ বললেন। ‘ও খুব ভালো ছেলে ছিল। যুদ্ধের পর ইনফ্লুয়েঞ্জার মহামারিতে ও মারা যাওয়ার পর আমি ভীষণভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। জানেন! আমার পরিবারে এই একমাত্র আমিই শেষ ব্যক্তি হয়ে বেঁচে আছি।’
মার্ক মনে করতে পারছিলেন না সবশেষ কার সঙ্গে তাঁর এতো সরল আন্তরিক যোগাযোগ হয়েছিল। বয়স্ক ভদ্রমহিলাটির জন্য তাঁর হৃদয় উষ্ণ হয়ে উঠল। অস্পষ্টভাবে এক নৈতিক তাগিদ অনুভব করছিলেন তিনি। অতঃপর তিনি পকেট থেকে কার্ডটি বের করলেন। বললেন, ‘গতকাল আমি ফাইলিং কেবিনেটে এটি পেয়েছি। অন্য কেউ এ-সম্পর্কে এখনো কিছু জানে না। তবে জানাজানি হলে বিষয়টি নিয়ে বিরাট কেলেঙ্কারি বেধে যেতে পারে এবং আপনারা সবাই সীমাহীন দুর্ভোগের মুখোমুখি হবেন। সংবাদপত্রের সাংবাদিকদের প্রশ্ন, কর আদায়কারীর ঝঞ্ঝাট …।’
মার্কের নিজের জীর্ণ ঘরটির কথা মনে পড়ল, মনে পড়ল তার বাড়িওয়ালি আর ঝগড়াটে প্রতিবেশীদেরকে। তিনি ধীরে ধীরে বললেন, ‘ভাবছিলাম, আমি তো ভাড়াটিয়া হিসেবে খুব একটা খারাপ নই, তাই …’
‘ওহ হ্যাঁ’, আগ্রহ নিয়ে সামনে তাকিয়ে মিস ট্রুসডেল বললেন, ‘আপনি আমার বাড়ির ওপরের তলায় থাকতে পারেন। আমার এখানে এতো জায়গা যে আমি বুঝে উঠতে পারি না কী করব এ দিয়ে। আমি নিশ্চিত, এটি আপনার জন্য উপযোগীই হবে। এখুনি একবার দেখে নেওয়া উচিত আপনার।’
নথিপত্রের কেরানীর কাজ করা মার্ক জিরনডিনের মন ততোক্ষণে তৈরি হয়ে গিয়েছিল। অবজ্ঞার ভঙ্গিতে তিনি হাতের কার্ডটি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে পানি দেওয়ার পাত্রটিতে ফেলে দিলেন। এই গ্রিন বটল স্ট্রিট চিরকাল সকলের অগোচরেই থাকুবে, অন্তত তিনি তাই মনে করেন।
লেখক-পরিচিতি
‘হারিয়ে যাওয়া রাস্তা’ ‘দ্য স্ট্রিট দ্যাট গট মিসলেইড’ গল্পের অনুবাদ। গল্পটির লেখক প্যাট্রিক ওয়াডিংটন (১৯১২-৭৩) একজন ইংরেজ, এবং ফ্রিল্যান্সার লেখক ছিলেন। তিনি চল্লিশের দশকে সিবিসি রেডিওতে কাজ করতেন। ফার্স্ট কন্ট্যাক্ট এবং অন্যান্য স্বল্প বাজেটের মন্ট্রিয়ল থেকে প্রকাশিত কবিতা ম্যাগাজিনের কাজে তিনি নিয়মিত কবিতাসভায় অংশগ্রহণ করতেন। মন্ট্রিয়ল সাহিত্যজগতে সুপরিচিত মুখ ছিলেন তিনি। তাঁর স্ত্রী মারিয়াম ওয়াডিংটন কানাডার একজন প্রথিতযশা কবি ছিলেন। প্যাট্রিক ওয়াডিংটন অনেকটা আকস্মিকভাবে খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত এই গল্পটির জন্য। গল্পটি এখনো অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং অসংখ্য ভাষায় অনূদিত হয়েছে। মজার বিষয় হলো, গল্পটি মন্ট্রিয়লের আলবেয়ার গ্যারাঁড নামে একজন নগর প্রশাসন কর্মকর্তার সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল। ১৯৪৯ সালের দিকে ওয়াডিংটন মন্ট্রিয়ল স্ট্যান্ডার্ডে-এর জন্য গ্যারাঁডের সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন। এর সাত বছর পর গল্পটির মূল রূপরেখা
তৈরি হয়।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.