হুলিও কোর্তাসার : ল্যাটিন আমেরিকার বুমসাহিত্যের পুরোধা

আদনান সৈয়দ

মস্তিষ্কে মায়াজাল বিস্তার করে অলৌকিক রহস্যের বেড়াজালে পাঠককে নিয়ে নিত্য ডুবসাঁতার খেলতে ভালোবাসতেন হুলিও কোর্তাসার। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, কার্লোস ফুয়েন্তেস এবং মারিও ভার্গাস লিওসার মতো কোর্তাসারও ছিলেন ল্যাটিন আমেরিকার বুমসাহিত্যের এক অনন্য চমক।  মানুষের অদভুত মন, মস্তিষ্কে উৎসারিত বিভিন্ন জটিল আর অভিনব খেয়াল, অধিবাস্তবতা – সবকিছুই তাঁর গল্পের প্রতিপাদ্য বিষয়। সে-কারণেই কোর্তাসারকে তাঁর সমসাময়িক হোর্হে লুইস বোর্হেস, কার্লোস ফুয়েন্তেস, হোসে লাজামা লিমা, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের সঙ্গেই তুলনা করা হয়। বলা যায়, তিনি কাদা ও জলকে মিশিয়েছেন বাস্তবতা এবং কল্পনাকে ধারণ করে। সেইসঙ্গে ফরাসি দর্শন, মায়াবাস্তবতাকে আঁকড়ে ধরে বোর্হেসের মতো তিনিও ছিলেন একজন মানবতাবাদী চিন্তায় মগ্ন মানুষ। আর সে-কারণেই রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণের দিক থেকে কোর্তাসার ছিলেন আজীবন সাম্রাজ্যবাদীদের  বিরুদ্ধ-শ্রেণির লোক। সে-কারণেই তিনি জোরগলায় সমর্থন জানিয়েছেন কিউবার বিপ্লবকে, আলেন্দের চিলি অথবা মানবতাবাদীদের পক্ষ হয়ে নিকারাগুয়ার বিপ্লবকে।

লেখক কোর্তাসারের সম্পর্কে জানা যাক। কোর্তাসার আর্জেন্টিনার লেখক। বাবা-মা দুজনই আর্জেন্টিনিয়ান। জন্ম আগস্ট ২৬, ১৯১৪। তবে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে; কিন্তু চার বছর পর পরিবারের সঙ্গে পাকাপাকিভাবে চলে আসেন আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ারসে। তবে মা এবং ছোট বোনের সঙ্গে ছেলেবেলায় বেশিরভাগ সময় কাটে বুয়েন্স আয়ারস থেকে দূরে ব্যানফিল্ড নামে একটি গ্রামে। দর্শন এবং ভাষাতত্ত্বের ওপর পড়াশোনা করেছেন বুয়েন্স আয়ারস বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৬ পর্যন্ত ফরাসি সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন মেনডোজার কুইয়ো বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে তিনি স্বৈরাচার দোমিস্ক পেরোনের বিপক্ষাবলম্বন করেন এবং সে-কারণে জেলও খাটেন। জেল থেকে বের হয়ে কোর্তাসার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে দেন। ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত তিনি বুয়েন্স আয়ারসের একটি প্রকাশনা সংস্থার পরিচালক হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলেন। পরবর্তীকালে আইন ও ভাষাবিষয়ক পড়াশোনায় কৃতি অর্জন করে তিনি অনুবাদক হিসেবে তাঁর কর্ম বেছে নেন। ১৯৫১ সালে পেরনিস্টদের বিপক্ষে ঝান্ডা উড়িয়ে তিনি প্যারিস ভ্রমণ করেন, যেখানে মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ছিলেন। ১৯৫৩ সালে বিয়ে করেন ওরোরা বেরনারদেজকে। পরবর্তীকালে তাঁদের বিয়ে-বিচ্ছেদ ঘটে এবং কোর্তাসারের জীবন শুরু হয় ক্যারল ডানলপের সঙ্গে। ১৯৫২ সাল থেকে তিনি ইউনেস্কোর সঙ্গে অনুবাদক হিসেবে যুক্ত ছিলেন। রবিনসন ক্রুসো, এডগার অ্যালান পোর গল্পসংকলন স্প্যানিশ ভাষার অনুবাদক ছিলেন তিনি। বলা যায়, এই অনুবাদ-সাহিত্যও তাঁর নিজের গল্পের ওপর প্রচ্ছন্ন আধিপত্য বা প্রভাব বিস্তার করেছিল।

‘লস রেস’ (১৯৪৯) কোর্তাসার প্রথমদিকের উদ্ভট কল্পনার মিশেলে এক অনবদ্য বর্ণনাময় গদ্যকবিতা। গ্রিক উপকথার চরিত্রকে সম্বল করে এক গোলকধাঁধা ধূম্রজাল বিস্তার ছিল তাঁর ‘লস রেসে’র মূল প্রতিপাদ্য। ১৯৫১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ছোট গল্পসংকলন বেস্তিয়ারিয়ো। সে-সংকলনে স্থান পায় ‘কাসা তোমাদো’ অর্থাৎ ‘বাড়ি দখল’ গল্পটি। এ-গল্পে দেখা যায়, মধ্যবয়সী ভাই ও বোন হঠাৎ আবিষ্কার করলেন যে, তাদের বাড়িটির কর্তৃত্ব অন্য কারো হাতে চলে গেছে। গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় লুইস বোর্হেস-সম্পাদিত সাহিত্যপত্রিকা লস কেনালেস ডে বুয়েন্স আয়ারসে। উল্লেখ্য, বোর্হেসের বোন গল্পটির প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছিলেন। তবে এ-কথা সত্য, বোর্হেস বরাবরই কোর্তাসারের ছোটগল্পের প্রশংসা করলেও তাঁর উপন্যাসের তেমন কোনো গুণগান করেননি। বরং বোর্হেসের ভাষায়, ‘প্রতিটি পৃষ্ঠায় তিনি তাঁর লেখার মূল অংশকে এতো শক্তভাবে প্রাধান্য দিয়েছেন যে, কখনো কখনো মনে হয়েছে, এটি কল্পনার সঙ্গে যুদ্ধের এক ক্লান্তিকর অভিজ্ঞতা, তাই নয় কি?’

এবার ‘কাসা তোমাদা’ গল্পে একছত্র ঘুরে আসা যাক। বলা নিষ্প্রয়োজন যে, ‘কাসা তোমাদা’কে কোর্তাসার একটি গতানুগতিক গল্প বলা যেতে পারে। কোর্তাসার গল্পের বুনন এবং কাহিনিবিন্যাস সাধারণত এমনটাই হয়ে থাকে। গল্পের শুরুটা হয় বাস্তব দুনিয়ার  মাল-মশলাকে উপজীব্য করে, এর শেষ হয় কল্পনার রংতুলিতে আঁকা এক অদ্ভুত জগৎকে অবলম্বন করে। গল্পটির শেষদিকে দেখা যায়, একজন নারী ধীরে ধীরে বুঝতে পারেন যে, তাদের বাড়িটি বেদখল হয়ে গেছে। বাড়িটির কর্তৃত্ব অন্য কারো হাতে। তিনি অনুভব করলেন এবং মনের আয়নায় একটি বাঘকে দেখতে পেলেন। যে-বাঘ তার বীরত্ব দেখিয়ে গোটা বাড়িটার চারপাশে ঘুরছে। কোর্তাসারের অন্যান্য গল্পসংকলনগুলো হলো ফিনালে ডে হুয়েগো (১৯৫৬), লাস আরামাস সিক্রেটাস (১৯৫৯), তোদোস লস ফুয়েগোস এল ফুয়েগো (১৯৬৬), ওকটায়েডরো (১৯৭৪) এবং আরগুয়েন কে আনডানা পোর আয়ি (১৯৭৭)। উল্লেখ্য, কোর্তাসারের লাস আরামাস সিক্রেটস গল্পসংকলন থেকে ‘লাস বাবাস ডেল ডিয়াবলো’ গল্পটি অবলম্বনে ১৯৬৬ সালে মাইকেল অ্যাঞ্জেলো এনতোনিয়নি ব্লো আপ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।

ঔপন্যাস্যিক হিসেবে কোর্তাসারের প্রথম অভিষেক হয় লস প্রিমোসের (১৯৬০) মাধ্যমে, যখন লেখকের বয়স ছেচল্লিশ ছুঁইছুঁই। উপন্যাসটির মূল ঘটনা কিছু গ্রামের লোকজনকে নিয়ে যারা সম্প্রতি লটারিতে একটি অলৌকিক জাহাজ ভ্রমণের টিকিট জিতেছে। তবে কোর্তাসারের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের মধ্যে যেটির নাম সবার আগে আসে সেটি হলো রেওয়েলা (১৯৬৬)। উপন্যাসটির গাঁথুনি গতানুগতিক উপন্যাসের ধারা থেকে বিচ্যুত। লেখক এ-উপন্যাসে পাঠককেই সর্বতোভাবে গল্পের ধারাবাহিকতা রক্ষার সর্বময় কর্তৃত্ব দিয়ে রেখেছেন। উপন্যাসটিতে দেখা যায়, হোরাসিয়ো অলিভেইরা একজন লেখক, যিনি তার আশেপাশে কিছু ভবঘুরে বন্ধু দিয়ে সারাক্ষণ আচ্ছন্ন থাকেন। তার রক্ষিতা লা মাগার নিখোঁজ হওয়ার পর অলিভেইরা নিজ ভাগ্যকে ঝালাই করার জন্যে বুয়েন্স আয়ারস আসেন এবং ক্ষুণ্ণিবৃত্তির জন্যে কায়িক পরিশ্রমে জড়িয়ে পড়েন। বুয়েন্স আয়ারসে তার সঙ্গে পরিচয় হয় তারই ছেলেবেলার বন্ধু ট্রাভেলারের সঙ্গে, যার সহযোগিতায় তিনি তার নিজের জীবনের উন্মাদনার কারণগুলো উদ্ঘাটন করেন এবং এর সমাধানে পৌঁছান। পরবর্তীকালে দেখা যায়, অলিভেইরা কার্টেজিয়ানের যুক্তিবাদ দর্শনে আত্মস্থ হয়ে নতুন এক পৃথিবী গড়তে চান, যদিও তিনি কোনো অর্থেই কোনো কিছুতেই কৃতকার্য হতে পারেননি। চরিত্রের কল্পনা, বুনন, মায়াবাস্তবতা, কৌতুক – সব মিলিয়েই এ-উপন্যাস। তবে রেওয়েলা উপন্যাসটিকে একটি বৈপ্লবিক উপন্যাস আখ্যা দিলে খুব একটা বাড়িয়ে বলা হবে না। কারণ দেখা যায়, পরবর্তীকালে উপন্যাসটি স্প্যানিশ ঔপন্যাসিকদের চিন্তায় এবং চেতনে অনেক নতুন খোরাক দিতে সমর্থ হয়েছিল। চিলির ঔপন্যাসিক রবার্তো বোলারিও হয়তো সে-কারণেই সোজাসাপ্টা স্বীকার করেন, তার উপন্যাস দ্য সেভেচ ডিটেকটিভ প্রচ্ছন্নভাবে বোর্হেস এবং কোর্তাসারে প্রভাবে প্রভাবিত।

গল্প-উপন্যাস ছাড়াও কোর্তাসার কবিতা, নাটক এবং প্রবন্ধ লিখেছেন প্রচুর। তাঁর কবিতা অনেকটা তাঁর গদ্যের মতোই। প্রথাবিরুদ্ধ রীতি তিনি সবসময় সচেতনভাবেই তাঁর সাহিত্যে ব্যবহার করেছেন। জীবনের শেষদিকে তিনি এবং ক্যারল ডানলপ মিলে লেখেন দি অটোনাটস অব কসমোরুটস। এটি ছিল তাঁর প্যারিস থেকে মারসেইলে ভক্সওয়াগন মোটরে চড়ে এক ভ্রমণ অভিযানের কাহিনি। তিনি জাজ-সংগীতের ভক্ত ছিলেন। শুধু ভক্ত বললে ঠিক হবে না, তিনি নিজেও জাজ বাজাতেন। একই সঙ্গে তিনি বিভিন্নরকম যন্ত্রসংগীত নিয়ে খেলা করতে ভালোবসাতেন।

কিউবার সফল বিপ্লবের পর কোর্তাসার কিউবা ভ্রমণ করেছিলেন। ১৯৭৩ সালে তিনি আর্জেন্টিনা, পেরু, ইকুয়েডর ও চিলি ভ্রমণ করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়ে  এবং ১৯৮০ সালে নিউইয়র্কের বার্নার্ড কলেজে ভ্রাম্যমাণ শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৮১ সালে তাঁকে ফরাসি নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। তাঁর অর্জিত অনেক পুরস্কারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১৯৭৪ সালে লিবরো ডে মানুয়েলের জন্য মেদিসিস পুরস্কার। ১৯৮৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি দুরারোগ্য লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে প্যারিসে মারা যান কোর্তাসার। অবশ্য পরবর্তীকালে তাঁর বন্ধু ক্রিশ্চিয়ানা পেরি রোজির গ্রন্থ ইয়ো ই কোর্তাসার (২০০১) থেকে জানা যায়, তিনি লিউকোমিয়া নয়, এইডসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এ-বছর বিশ্বব্যাপী তাঁর জন্মশতবার্ষিকী পালন করা হচ্ছে। ল্যাটিন আমেরিকার বুমসাহিত্যের জনক কোর্তাসার কাজ ও কর্মকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি।