অক্ষর গল্পের বিন্যাস

দেবেশ রায়
সখী রঙ্গমালা
শাহীন আখতার

প্রথমা
ঢাকা, ২০১০

২৫০ টাকা

দিল্লি থেকে আমি ঢাকা গিয়েছিলাম। ঢাকা থেকে দিল্লিতে এসেছি। আমার স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য প্রায় দেড়মাস দিল্লিতে আমার ছেলের কাছে আছি। ডাক্তার অবিশ্যি এতদিনে বলেছেন, আমরা কলকাতা ফিরতে পারি। টিকিটের জন্য অপেক্ষা করছি। আমরা ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ কলকাতা ফিরব। সেই কারণেই চিঠিটিতে কলকাতার ঠিকানা দিলাম।
এই চিঠি লেখার কারণ আপনার সখী রঙ্গমালা উপন্যাসটি। নামপত্রে দেখছি বইটি বেরিয়েছে ২০১০-এর ফেব্র“য়ারিতে। অবাক লাগছে – এতটা সময়ের মধ্যে এই অসামান্য উপন্যাসটির কথা কানেও আসেনি, চোখেও পড়ে নি বইটি। আমি বাংলা বই কিনেই পড়ি। বাংলাদেশের বইপত্র যাঁরা আমাকে দেন তেমন মানুষজনও আমাকে খবার দেন নি, দোকানেও পাইনি। যদি ঢাকায় না যেতাম তাহলে বাংলার এই উল্লেখযোগ্য বইটির কথা আমার জানাই হতো না? ভেবে ভয় লাগছে।
আপনি যে একটি প্রচলিত লোককথাকে উপন্যাসের আকার দিচ্ছেন, সে-খবর মলাটে লেখা আছে। সে-খবর না জেনেই উপন্যাসটা অনেকটা পড়ে ফেলি। সেইপড়াতেই বুঝি লোককথার প্রাচীনতা আছে গল্পটিতে। পরে যখন সে-অনুমান সত্য জানলাম, আপনার  লেখার ক্ষমতা আমাকে মুগ্ধ করল।
প্রায় ৪০ বছর ধরে আমি বলে আসছি – বাংলার নিজস্ব আখ্যান নিহিত আছে বাংলার মঙ্গলকাব্যে, গ্রামজীবনের               কেচ্ছা-কাহিনিতে ও এরকম আরো সব সাহিত্যে। এগুলো প্রধানত মৌখিক। এ নিয়ে আমি বিস্তারিত লিখেওছি। কিন্তু এই বলা ও লেখার পক্ষে প্রমাণগুলো কোনো সময়ই খুব জবরদস্ত ছিল না। আবার নিজের লেখা গল্প-উপন্যাসগুলি এই বাংলাছাঁচে কতটা আকার পেয়েছে তা আমার পক্ষে বলা কঠিন। ও অনুচিতও। তাত্ত্বিক হিসেবে যা আমি বলছি, লেখক হিসেবে আমি তাই লিখছি – এমন প্রতিপাদ্য তত্ত্ব ও লেখা দুইয়ের পক্ষেই সর্বনাশা। দুই-ই পৃথকভাবে স্বতন্ত্র।
কিন্তু আমার তত্ত্বের সবচেয়ে বেশি উদাহরণ আমি পাচ্ছিলাম – বাংলাদেশের কম-বয়েসিদের গল্প-উপন্যাসে। কমবয়েসি বলতে বলছি যাঁদের বয়স খুব বেশি হলেও চল্লিশের সামান্য বেশি। এঁদের কারো-কারো লেখাতে একটা এপিক-লৌকিকতা বাংলাদেশের নিসর্গ, নানা ধরনের আঞ্চলিক ভাষা, প্রবাদ-কেচ্ছা মিলিয়ে আমি পড়তে পারছিলাম। কিন্তু এঁদের কারো-কারো সঙ্গে কথা বলে আন্দাজ হচ্ছিল – ওঁরা এঁটা জেনেবুঝে করছেন না। একটা অনিবার্য ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে এঁরা এই এপিক-লৌকিকতা গড়ে তুলছেন। সেই ঐতিহাসিক পরিস্থিতির অনিবার্যতা আমি আমার মতো করে বুঝেও নিচ্ছিলাম। ভারতীয় সাহিত্যের বৃহত্তর ছায়া থেকে বঞ্চিত, বৃহত্তর ইসলামি সাহিত্যের আরবি ঐতিহ্য থেকে বেরিয়ে-আসা, ইংরেজি ইত্যাদি বিদেশি সাহিত্য সম্পর্কে বাধ্যত অসম্পূর্ণ অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের লেখককে নিরুপায়ভাবে নিজের ইতিহাস-ভূগোলকে আশ্রয় করতে হয়েছে – হয়তো অগত্যাই, হয়তো এখনো আধোচেতনায় কিন্তু এমন শারীরিক নিরুপায়তা থেকেই সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ আকারের জন্ম হয়। আমার ধারণা, বাংলাদেশ গল্প-উপন্যাসে তেমনই এককটি রতœভাঁড়ারের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। আপনার এই উপন্যাসটি আবার সেই ধারণাই আরো শক্ত করল। আপনাকে কৃতজ্ঞতা না-জানিয়ে কোনো উপায় নেই। এখন সম্পূর্ণরকম বাংলা উপন্যাস পড়েছি বলে তো মনে করতে পারছি না। কেন সম্পূর্ণ, কেন বাংলা ও কেন উপন্যাস – এ-কথাটা হয়তো সামান্য ব্যাখ্যা করা উচিত।
সম্পূর্ণ বাংলা এই কারণে যে, উপন্যাসটিতে এমন কোনো পেছুটান কণামাত্র কাজ করে নি যে পাঠক সব শব্দ, বাক্য, ঘটনা বুঝবেন কী না। গল্পটি যে ভাষা-পরিস্থিতিতে ঘটছে, সেই ভাষা-পরিস্থিতি গল্পটির সঙ্গে এমনই একাকার যে, গল্পই তার ভাষার অর্থ স্থির করে দেয়। আমি এই ভাষা কখনো-সখনো শুনে থাকব তবে আমি এটা জানি না। অথচ গল্পটি পড়তে আমার অজ্ঞানতা কোথাও বাধা তো হয়ই নি, উলটো, গল্পই সেই শব্দ বা পদ বা প্রবাদ বা বচনকে জ্বলজ্বলে করে তুলেছে। ফলে, গল্পটিতে অতিরিক্ত একটি আবেগ এসেছে। এই ভাষা ব্যবহারে আপনার একটা অতিরিক্ত বাহাদুরি এই যে, আঞ্চলিক ভাষা অনেকটাই স্বরনির্ভর বা উচ্চারণনির্ভর (Intonation)।  আপনার সংলাপে বা বর্ণনায় সেই স্বর বা উচ্চারণ বা Intonation স্বরলিপির মতো উঠে এসেছে।
সম্পূর্ণ আঞ্চলিক ভাষায় ও আঞ্চলিক কোনো লোককথা নিয়ে এর আগে লেখা হয়েছে। যদ্দুর মনে পড়ছে, মনীশ ঘটকের একটি উপন্যাস আছে, কলখল নামে – পূর্ববঙ্গের ভাষায় লেখা। বা, চাঁদ বেনের গল্পের রকমফের ঘটিয়েছেন অমিয়ভূষণ মজুমদার। খুব হালে রামকুমার মুখোপাধ্যায় ধনপতি-খুল্লনা নিয়ে একটি উপন্যাস লিখেছেন।
এই লেখাগুলি থেকে আপনার লেখাটি মূলত আলাদা। আপনি কোনো আধুনিক রূপক আপনার প্রাচীন গল্পের ওপর আরোপ করেননি। গল্পের নিজস্বতা যদি তার সমস্ত বৈভব নিয়ে দেদীপ্যমান হয়ে ওঠে, তাহলে সেই আলোতে গল্পটি লেখার সময়টিও জাজ্বল্যমান হতে পারে। আপনি তেমন কাজটি করতে পেরেছেন।
কেন সম্পূর্ণ ও কেন বাংলা – এ দুটি বিষয়ে আমার যুক্তি যদি পরিষ্কার করে থাকি, তাহলে এখন বলা যায় – কেন এটি এতোটাই মৌলিক উপন্যাস।
এ-গল্পের প্রতিটি অক্ষরে গল্প। কারো মনে হতে পারে সেই গল্পগুলির ভিতরে তেমন পরিষ্কার কোনো বাঁধন নেই। এখন মনে হওয়াটা আমাদের পাঠের বদভ্যাস। আপনার গল্প-বলায় সেই বদভ্যাসের কোনো প্রশ্রয় নেই। যদি এমন হতো যে, এ-ব্যাপারে রাতের তারাগুলি হাউইবাতির মতো চঞ্চল হয়ে উঠেছে, তাহলে এই গল্পটাকে চেনা যেত। ঠিক তেমনই জ্বলন্ত বিস্ফোরণমালা – গল্প জ্বালাতে-জ্বালাতে ফুটোতে-ফুটোতে আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে যায়।
আমাকে যেটা অবাক করেছে – এতো বড় একটি আপসহীন সম্পূর্ণ উপন্যাস আপনি লিখলেন কী করে? আরো লিখুন। আরো লিখুন।
বইয়ের শেষে ‘কৃতজ্ঞতা’ অংশটি আমার ভালো লাগেনি। শিল্পকর্মে কারো কাছে কোনো ঋণ থাকে না। এতে বরং এমন ভুল ধারণা তৈরি হয় যে, বুঝি ঠিকঠাক বইপত্তর বন্ধুবান্ধব গার্জেন জুটলেই এমন একটা লেখা সম্ভব। শিল্পকর্ম শেষ পর্যন্ত তো একজনেরই সৃষ্টি আর তার একটাই কাজ – একটি সুন্দর তৈরি করা। সুন্দর কি পরামর্শ বা পরিশ্রমজাত? নাকি ধ্যানজাত?
এই সময়ই লেখা, আরেকটি উপন্যাসের কথা মনে পড়ে গেল। সালমা বানীর গোলাপি মঞ্জিল। আপনার এই গল্পটির উলটোদিকে তার গতি। আধুনিককালের এক হঠাৎ-নবাব রাজনৈতিক নেতার ছেলের সুন্নত উৎসব তৈরি হচ্ছে পুরনো কালের এক নবাবের পুত্রের সুন্নত উৎসবের নকলে। ইতিহাসের সেই উৎসবটিকে আধুনিকের অনুকরণীয় করে তুলতে দিগি¦জয়ী অধ্যাপককে দিয়ে মাস্তানরা নতুন করে হিস্ট্রি লেখাচ্ছেন। সেই বইটি কি আপনি পড়েছেন? আপনার বইটি পড়তে-পড়তে আমার বারবার মনে হচ্ছিল – এই দুটি বই পাশাপাশি রেখে সবচেয়ে ভালো প্রমাণ করা যায় – বাংলাদেশের লেখকরা গল্প-উপন্যাসে কী কাণ্ডটাই না করছেন।
এ নিয়ে একটা প্রবন্ধ লেখার ইচ্ছে নাড়াচাড়া করছি। কিন্তু নিষ্পত্তি করতে পারছি না। যদি পশ্চিমবঙ্গের কোনো কাগজে লিখি, তাহলে এখানকার পাঠকরা এসব কথা পরীক্ষা করতে পারবেন না। কারণ বই পাবেন না। যদি বাংলাদেশের কোনো কাগজে লিখি, তাহলে বাংলাদেশের লেখক ও বিবেচক পাঠকদের ভাবনাচিন্তার বিষয় হতে পারে বটে; কিন্তু আমি তো বাংলাদেশের লোক নই, তাই তাঁদের কোনো উপকারচিন্তাও একটা সীমানার পর আমার অধিকার-বহির্ভূত। যদি ইংরেজিতে লিখি, তাহলে বড় একটা পাঠকসমাজকে এখন একটা ঘটনা জানানো যাবে বটে।
সবচেয়ে ভালো হয়, আপনারা নিজেরা যদি লেখেন।
তাহলে রচনার সঙ্গে তত্ত্বজিজ্ঞাসার একটা জায়গা তৈরি হয়। সেটা খুবই দরকার – আপনাদের পক্ষে।
আপনি যদি আমার এই চিঠিটি বাংলাদেশের কোনো কাগজে প্রকাশ করেন – আমার আপত্তি তো দূরের কথা, খুব ভালো লাগবে।
আপনার আরো নতুন লেখার আশায় থাকব।