অক্ষয়কুমার বড়ালের কবিতায় বিজ্ঞানচেতনা

ভূমিকা
আমাদের চিরকেলে ধারণা, খানিকটা ঐতিহ্য সূত্রে, সাহিত্য ও বিজ্ঞান দুই মেরুর বিষয়। সাহিত্যে আছে কল্পনার আদিগন্ত ভূমি, অসম্ভবের সঙ্গে লাগাতার মিতালি, আর বিজ্ঞানের শাণিত ভূমিতে আছে যুক্তি ও প্রমাণের বিশ্বস্ততা। শিল্পের বিচারে সাহিত্যের কল্পনা যতই সমৃদ্ধির সূচক হয়ে উঠুক না কেন, তা ভালো সৃষ্টি নয়; যতক্ষণ পর্যন্ত তা মানুষের ‘অন্তরতম চেতনার’ রাগে রঞ্জিত হয়ে বেদনা, আশ্বাস ও সান্তবনায় উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।১ কলাকৈবল্যবাদীরা মনে করেন art for art’s sake; কিন্তু পেস্নটোর সৌন্দর্যজাত আনন্দ যে নির্মল আনন্দ তা তাঁরা কদাচিৎ ভেবেছেন। সক্রেটিস এ-সৌন্দর্যকে আলোর সঙ্গে তুলনা করেছিলেন, যা প্রত্যেক বস্ত্তর অন্তর্নিহিত সত্যকে প্রকাশ করে, এবং তাকে জানার শক্তি দেয়। সাহিত্যের সৌন্দর্য সৃষ্টি নন্দনতাত্ত্বিক বিষয়ের অধিগত। কিন্তু যেখানে জীবন অনুপস্থিত অর্থাৎ জীবনের সংবিৎ ও অনুরণন নেই, সেই সৃষ্টি কখনো সাহিত্যের ভালো সৃষ্টি নয়। ভারতীয় অলংকার শাস্ত্রের সংবিধান সাহিত্যদর্পণে বিশ্বনাথ কবিরাজ কলাকৈবল্যবাদীদের পাগল বলতে দ্বিধান্বিত হননি। আসলে সব উৎকৃষ্ট
কাব্য যে জীবনেরই সত্য সুন্দরের প্রতিরূপ – জীবন-দীপিকা, তা স্পষ্ট হয়ে যায় মোহিতলাল মজুমদারের ভাষ্যে। ‘কাব্য কল্পনামাত্র নয়’ আবার কল্পনাকে ত্যাগ করেও নয়।২ কিন্তু একজন কবি কল্পনাকে কতটুকু স্বাধীনতা দিতে পারেন, যা বাস্তবতাকে টপকে পাঠকের ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে যাবে না? নিত্যসত্যকে উপেক্ষা করে কবি কি বাঁচতে পারবেন কল্পনার বর্ণাঢ্য জগৎকে নিয়ে? কল্পনাকে কি
সত্যি উপেক্ষা করা সম্ভব? সম্ভব নয় বলে কবিতা লেখার ক্ষেত্রে কবিকে হতে হয় মৌলিক কল্পনাশক্তির অধিকারী, দ্বিতীয়ত প্রকাশশক্তিসম্পন্ন, তৃতীয়ত সে-বিষয়ে থাকতে হবে অভিজ্ঞতা ও অর্জিত জ্ঞান।৩ এ-বিষয়ে রবীন্দ্রভাষ্য যুক্ত হতে পারে। ১৯১৬ সালে লেখা একটি প্রবন্ধে তিনি বলেন যে, মানুষের মধ্যে অন্য যে-মানুষটি বসবাস করছে সে শারীরিক বা মানসিক প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে। এ মানুষটি কিন্তু মানুষের সব থেকে একটি মহান অংশ।৪ এতগুলো বিষয়ের সমন্বয়ে বাস্তববোধসম্মত বিষয়ের অবতারণা করতে হবে কবিকে। জীবনের মর্মমূল থেকে হৃৎস্পন্দন তুলে আনাই কিন্তু একজন কবির কাজ। ঠিক এ-দৃষ্টিকোণ থেকে উঠে আসে মানুষের জীবনসম্পৃক্ত উচ্চারণ : arts belong to the people। সমাজতান্ত্রিক চেতনার যোদ্ধা হিসেবে একজন লেনিনের এ প্রলেতারিয়েত চিন্তা দিগন্ত-উন্মোচক নিঃসন্দেহে। তবে টলস্টয় ও রম্যা রলাঁর দৃষ্টিও জনগণবহির্ভূত নয়।৫ কিন্তু আপন কল্পনাবলে সৃষ্ট জগৎ যতই মনোহর হোক না কেন, এবং কল্পনার মাহাত্ম্য যতই প্রমাণিত হোক না কেন, তার সঙ্গে থাকতে হবে ভাগবতী সৃষ্টির গভীরতর সামঞ্জস্য, না হলে সত্যের হানি হয়। ম্যাথু আরনল্ড যথার্থই বলেছেন, কাব্যে truth of substance যেমন থাকবে, তেমনি থাকবে high poetic seriousness এবং এই ‘seriousness’ আসে ‘absolute sincerity’ থেকে।৬
‘প্রকৃতিতে যা আছে, বা যা ঘটে, তা শিল্পকলা নয়, এবং সুন্দরও নয়। মার্কসের মতে, মানুষ প্রকৃতির একটি অংশ মাত্র হয়েও আত্মরক্ষা ও বিকাশের নিয়মে প্রকৃতির শক্তিকে মোকাবেলা করে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করছে, তার একাংশের নাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা, অন্য অংশের নাম শিল্পকলা।’৭ সে হিসেবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যাও সৌন্দর্যতত্ত্বের বিষয়। তবে একটি বিষয় ভুললে চলবে না যে, প্রযুক্তি, বিশেষত লোকপ্রযুক্তি বিকাশের পেছনে বৈজ্ঞানিক কোনো তত্ত্ব নেই; আছে ব্যবহারিক কর্মকুশলতা।৮ এভাবে লোকপ্রযুক্তির সাহায্যে মানুষ যখন ঝড়-ঝঞ্ঝা ও বজ্রপাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে শিখল তার পরপরই সে মেঘের সঙ্গে প্রিয়ার কালো চুলের তুলনা করার বিষয়টিও ভেবে দেখার সুযোগ পেল।৯ এভাবে বিজ্ঞান ও সাহিত্যের যে-মেলবন্ধন তৈরি হয়েছে তা হয়ে উঠেছে যুগপৎ শিল্পিত ও বিজ্ঞানমনস্কতায় ঋদ্ধ। এখানে আছে উদ্দেশ্য ও ইচ্ছার প্রাধান্য। অর্থাৎ কী উদ্দেশ্যে মানুষ কাজ করবে তার পদ্ধতি সম্পর্কে আগে থেকে ভেবে নেওয়া, অতঃপর মনস্থির করে ইচ্ছাকে সেভাবে নিয়ন্ত্রিত করা। রবীন্দ্রনাথ এ-ইচ্ছা ও উদ্দেশ্যের শক্তি সম্পর্কে বলেন :
মানুষ যে বিশ্বে জন্মেছে তাকে দুই দিক থেকে কেবলই সে আত্মসাৎ করার চেষ্টা করেছে, – ব্যবহারের দিক থেকে আর ভাবের দিক থেকে। আগুন যেখানে প্রচ্ছন্ন সেখানে মানুষ জ্বালল আগুন নিজের হাতে। আকাশের আলো যেখানে অগোচর, সেখানে সে বৈদ্যুতিক আলোকে প্রকাশ করল নিজের হাতে; প্রকৃতি আপনি যে ফলমূল ফসল বরাদ্দ করে দিয়েছে – তার অনিশ্চয়তা ও অসচ্ছলতা সে দূর করেছে নিজের লাঙলের চাষে। পর্বতে, অরণ্যে, গুহা-গহবরে সে বাস করতে পারতো, করেনি … পৃথিবীকে সে অযাচিত পেয়েছিল। কিন্তু সেই পৃথিবী তার ইচ্ছার সঙ্গে সম্পূর্ণ মিশ খায়নি, তাই আদিকাল থেকেই প্রাকৃতিক পৃথিবীকে মানব বুদ্ধি কৌশলে আপন ইচ্ছানুগত মানবিক পৃথিবী করে তুলেছে – সে জন্য তার কত কল বল, কত নির্মাণ নৈপুণ্য। এখানকার জলে স্থলে আকাশে পৃথিবীর সর্বত্র মানুষ আপন ইচ্ছাকে প্রসারিত করে দিচ্ছে। উপকরণ পাচ্ছে সেই পৃথিবীর কাছ থেকেই … এমনি করে দেশ দেশান্তরে পৃথিবী ক্রমশই অভিভূত হয়ে আত্মসমর্পণ করে আসছে মানুষের কাছে। মানুষের বিশ্বজয়ের এই একটা পালা বস্ত্তজগতে, ভাবজগতে তার আছে আর একটা পালা। ব্যবহারিক বিজ্ঞানে একদিকে তার জয় স্তম্ভ – আর একদিকে শিল্প সাহিত্যে।
তবু ‘বিজ্ঞান’ ও ‘কলা’ আজকের যুগে এসেও বিভক্ত আলাদা ধারায়। এ দুটি ধারায় চলছে সত্যকে অনুসন্ধানের চেষ্টা। ‘কলা জাগিয়ে তুলছে মানুষের হৃদয়ানুভূতি, তার সুকুমারবৃত্তি, সম্প্রসারিত করছে তার কল্পনার জগৎ। আর বিজ্ঞান কেবলই উন্মোচিত করছে রহস্যের নির্মোক, বাস্তবতার সঙ্গে পরিচিত করাচ্ছে মানুষকে, দিচ্ছে সাধারণের দৃষ্টিবহির্ভূত জগতের সংবাদ।’১০ বিজ্ঞান ও সাহিত্যের মধ্যে এমন করেই তৈরি হয়েছে ব্যবধান। একজন বিজ্ঞানী যেমন সাধারণত ধারণা রাখেন না শিল্প, সাহিত্য, ইতিহাস সম্পর্কে, তেমনি আর্টসে দক্ষ ব্যক্তির পক্ষে বিজ্ঞানের বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান না থাকাই স্বাভাবিক। আধুনিক যুগে বিজ্ঞানের অসম্ভব প্রসার সত্ত্বেও কলা ও বিজ্ঞানের মধ্যে জন্ম নিচ্ছে দুরকমের জীবন দর্শনের। কিন্তু ‘এ কথা তর্কাতীতভাবে প্রতিষ্ঠিত, জীবন ও জগৎ সংক্রান্ত সত্যে উপনীত হওয়ার একমাত্র অবলম্বন বিজ্ঞান’ হলেও, কবিতায় বিজ্ঞানমনস্কতা প্রযুক্ত হয়েছে তত্ত্বগত ও উপাদানগত দিক থেকে; কখনোবা কোনো বিষয়কে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার অনিবার্যতা থেকে।১১ তাছাড়া, বৈজ্ঞানিক সত্যগুলো জানার সঙ্গে সঙ্গে কবি তারই অনুগামী কল্পলোক মনে মনে রচনা করে নেন। এভাবে কবি অক্ষয়কুমার বড়ালের (১৮৬০-১৯১৯) কবিতায় বিজ্ঞানচেতনা কতখানি ঋদ্ধ হয়ে উঠেছে তা আলোচনা করা যেতে পারে।

কবিপরিচিতি, রচনাবলি ও রবীন্দ্রবিরোধিতা
অক্ষয়কুমার জন্মেছিলেন ১৮৬০ সালে১২ কলকাতার চোরবাগানে শ্রীনাথ রায়ের গলিতে। বর্তমানে এ-গলিটির কোনো অস্তিত্ব না থাকলেও জন্মসাল নিয়ে আছে মতান্তর। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ও (১৮৯১-১৯৫২) একই কথা বলেছেন। অক্ষয়কুমার কনকাঞ্জলি (১২৯২ ব.) কাব্যে ‘অদৃষ্ট বালিকা’ কবিতার পাদটীকায় অদৃষ্ট বালিকার স্বরূপ ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে নিজেকে রবীন্দ্রনাথের বয়ঃকনিষ্ঠ বলে উলেস্নখ করেন : ‘জ্যেষ্ঠ কবিভ্রাতা শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ইঁহাকে অনন্ত দোসর বলেন।’ হেমেন্দ্রকুমার রায় (১৮৮৮-১৯৬৩) যাঁদের দেখেছি গ্রন্থে বলেন : ‘দেবেন্দ্রনাথ সেন বয়সে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে প্রায় পাঁচ বৎসর ও অক্ষয়কুমারের চেয়ে প্রায় দশ বৎসর বড় ছিলেন।’ (প্রথম খ-, বৈশাখ ১৩৫৭, পৃ ১২০)। বাঙ্গালীর গান (১৩১২) গ্রন্থে দুর্গাদাস লাহিড়ী (১৮৫৮-১৯৩২) জানিয়েছেন, ১২৭৩ সনের কার্তিক মাসে কলকাতার চোরবাগানে তাঁর জন্ম হয়। (পৃ ১০২৪)। দুর্গাদাস ছিলেন অনুসন্ধান পত্রিকার সম্পাদক। এই পত্রিকায় অক্ষয়কুমার নিয়মিত লেখালেখি করতেন। অক্ষয়কুমারের জন্মসাল ১২৭৩ সনের কার্তিক মাস অর্থাৎ ১৮৬৬ সালের অক্টোবর-নভেম্বর মাস ধরা হলেও ড. সুকুমার সেন অক্ষয়কুমারকে ‘রবীন্দ্র-পূর্ব কবি’ বলে উলেস্নখ করেন। অক্ষয়কুমার কবি হিসেবে ১৯১৫ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় মাতৃভাষা বাংলা (Bengali Composition) বিষয়ের পরীক্ষক ছিলেন। প্রধান পরীক্ষক ছিলেন দীনেশচন্দ্র সেন।১৩ তিনি ১৩২৬ সনের ৪ আষাঢ় (১৯ জুন ১৯১৯) বৃহস্পতিবার রাত ৯টা ১০ মিনিটে মাত্র ৫৩ বছর বয়সে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : প্রদীপ (গীতি-কবিতাবলী, ১২৯০), কনকাঞ্জলি (গীতিকাব্য, আশ্বিন ১২৯২), ভুল (গীতি-কবিতাবলী, ১২৯৪), শঙ্খ (গীতিকাব্য, ১৩১৭) ও এষা (গীতিকাব্য, ১৩১৯)। এছাড়া তিনি যথাক্রমে রাজকৃষ্ণ রায় ও গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী-লিখিত কবিতা (১২৯৪) ও অশ্রম্নকণা (১২৯৪) কবিতাগ্রন্থদুটি সম্পাদনা করেন। তিনি কবি ওমর খৈয়ামের অনুকরণে রচনা করেন ৮০টি রুবাই। পরন্তু, বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর প্রায় ৮৫টির মতো গান প্রকাশিত হয়।
তাঁর কবিতায় ইংরেজ কবি ব্রাউনিংয়ের প্রভাব থাকলেও তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো ছিলেন কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর (১৮৩৫-৯৪) ভাবশিষ্য। একসময় রবীন্দ্রনাথ, প্রিয়নাথ সেন (১৮৫৪-১৯১৬), অক্ষয় চৌধুরী (১৮৫০-৯৮) ও অক্ষয়কুমার বড়ালও বিহারীলালের কাছে যেতেন। সে-সুবাদে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর সদ্ভাব থাকলেও অসদ্ভাবও তৈরি হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত তাঁর সম্পাদিত বাংলা কাব্য পরিচয় (১৯৩৯) গ্রন্থে অক্ষয়কুমারের শঙ্খ কাব্যের ‘আহবান’ কবিতাটি সংকলন করেন। এছাড়া তাঁর একটি গান কাফি রাগে সুর করেন।১৪ তাঁর স্বরলিপিটি ১৩০২ সনের কার্তিক সংখ্যার ভারতী (পৃ ৪০১) পত্রিকায়, এবং পরে গানটি সরলা দেবীর (১৮৭২-১৯৪৫) শতগান গ্রন্থভুক্ত হয়।১৫
রবীন্দ্রনাথ তাঁকে প্রীতির চোখে দেখলেও অক্ষয়কুমার যে তাঁর প্রতি খুশি ছিলেন না, সে-প্রসঙ্গে হেমেন্দ্রকুমার যাঁদের দেখেছি গ্রন্থে লেখেন : ‘রবীন্দ্রনাথের উপরে তিনি মনে মনে খুশি ছিলেন না। এর কারণ অনুমান করা কঠিন নয়। তিনিও রবীন্দ্রনাথের সতীর্থ, একই গুরুর কাছে মক্স করেছেন, অথচ রবীন্দ্রনাথ তাঁকে কত পিছনে ফেলে এগিয়ে গেলেন।’ তিনি আরো লেখেন, ‘দেখ, রবিবাবু যে ভালো ভালো কবিতা লিখেছেন তাতে আর সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি এত বেশী বাজে কবিতাও লিখেছেন সাহিত্যের মধ্যে সেগুলির স্থান হবে না।’১৬ এভাবে অক্ষয় ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে সম্প্রীতি ও বিরোধের বাতাবরণ সৃষ্টি হয়েছিল। তবে অক্ষয়কুমারের কবিতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, রবীন্দ্রনাথের অনুকৃতি ও প্রভাব থাকলেও, তাঁর জন্মের সার্ধশতবর্ষ পরেও তিনি খুব কমই আলোচিত হয়েছেন। সেদিক থেকে তাঁর কবিতায় বিজ্ঞানচেতনার মতো একটি অনালোচিত প্রসঙ্গ আলোচনাসহ এ-প্রবন্ধে আমরা সার্ধশতবর্ষের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করছি।

বিজ্ঞানচেতনার পরম্পরা
অক্ষয়কুমারের কবিতায় প্রযুক্ত বিজ্ঞানচেতনা কি তাঁর স্বকপোল কল্পিত, না উনিশ শতকের রেনেসাঁসের ফল? এ-বিষয়ে বিশদ বলার অবকাশ নেই। তবে আমরা জানি মহাকবি কালিদাস কাব্যকথা প্রসঙ্গে মহাকাশ-পর্যবেক্ষণের বিষয় উলেস্নখ করেছিলেন। ভারতবর্ষে প্রাচীন জ্যোতিষীগণ আকাশে বিরাজমান গ্রহ, ঋক্ষ (রাশিচক্র), তার (নক্ষত্র) ও ধিষ্ণ্যকে (ধূমকেতু) চারভাগ করে ধ্রম্নব নক্ষত্রকে মনে করতেন কেন্দ্রবিন্দু। এছাড়া বায়ুমণ্ডল ও মহাকাশকে তাঁরা আবহ, প্রবহ, সংবহ ও পরিবহ নাম দিয়ে তার পার্থক্য বিচার করতেন।১৭ মহাভারতের কবি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ফলাফল জানাতে গিয়ে গ্রহ ও তারকাম-লের অবস্থিতি ও গতিপথের বর্ণনা দিয়েছেন। সূর্য যে নক্ষত্রচক্রে পরিভ্রমণশীল এ-তথ্য বহু কবির রচনায় সংক্রমিত হয়েছে। প্রাচ্যদেশে যখন জ্যোতির্বিজ্ঞানে এরকম চর্চার কথা জানা যায়, তখন পাশ্চাত্যের মার্লো ও শেক্সপিয়রও মহাকাশে নক্ষত্রের পরিভ্রমণসংগীত শুনেছেন।১৮ আর তখনকার দিনে বিষয়টি যথেষ্ট অগ্রসর হলেও একজন ভাস্করাচার্যের বিজ্ঞানভাবনায়, বিশেষ করে শূন্যের (০) আবিষ্কার ও পৃথিবীর আকার যে একটা কদবেলের মতো, এবং মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব ও ‘সমগ্র জড় পদার্থের আপীড়ন তত্ত্ব’ বিষয়টি নিউটনের জন্মের প্রায় পাঁচশো বছর আগে সিদ্ধান্ত করেছিলেন। বিজ্ঞানী লল্লাচার্যও পৃথিবীর গোলত্ব, আর ক্যালকুলাসের নিয়মগুলো আয়ত্ত করেছিলেন লঘুমানসের প্রণেতা মুঞ্জাল। যদিও তাঁর আগে খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর (৪৭৬) দিকে আর্যভট্ট সিদ্ধান্ত ও বীজগণিত গ্রন্থে বিষয়টি কষে রেখেছিলেন, কিন্তু আধুনিক রূপ দিতে পারেননি। এ ছাড়া, ঋষি গৌতম, কণাদ ও আচার্য প্রশস্তপাদ পদার্থবিদ্যার অনেক রহস্য উদ্ঘাটন করেন।১৯ ন্যায় ও বৈশেষিক দর্শন এ পৃথিবীকে আমরা যেভাবে দেখি, এ-দর্শন সেভাবেই গ্রহণ করা ছাড়া নিপুণ বৈজ্ঞানিকের মতো জড় পদার্থের সর্বনিম্ন স্তর যে অণু-পরমাণু, সে-বিষয়েও তাঁরা অনুসন্ধান করেন।২০ এঁরা আসলে ছিলেন প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞানী। পাশ্চাত্য বিজ্ঞানীদের অনেক আগে এঁদের জন্ম হলেও এঁরা ছিলেন আধুনিক বিজ্ঞানীদের মতোই অগ্রসর। তবে পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানী হিসেবে ডারউইন মূলত সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকের বৈজ্ঞানিক বিকাশের একটি পরিণত রূপ। কোপারনিকাস, কেপলার, গ্যালিলিও ও নিউটনের অবদানে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। শিলি, প্রিস্টলি, ল্যাভোয়সিয়ে, ভোল্টা, গ্যালিভিন, ফ্যারাডে প্রমুখ বিজ্ঞানীর অবদান পশ্চিম ইউরোপে, বিশেষ করে ইংল্যান্ডের মানুষের বৈষয়িক স্বাচ্ছন্দ্য ও উন্নতির পথ সৃষ্টি করে দেয়।২১ জেনেভোর ভূতত্ত্ববিদ ড্যা সসুরে ১৭৭৯ সালে প্রথম ‘ভূতত্ত্ব’ শব্দটি ব্যবহার করেন। স্কটিশ প–ত হাটন Uniformitarian Theory প্রচার করেন। তিনি বলেন :
আজকের ভূমণ্ডল একদিনের সৃষ্ট নয় এবং আকস্মিকভাবেও তার সৃষ্টি হয়নি; আজকের বিশ্ব লক্ষ লক্ষ বছরব্যাপী প্রাকৃতিক কার্যকারণ নিয়মের ক্রিয়াশীলতার এক পরিণত রূপ। এটি ছিল চিরাচরিত ধারণার বিপরীতে একটি অভিনব প্রত্যয়। পূর্বে মনে করা হতো, এ জগৎ ও জীবন এক বা একাধিক দিনে আকস্মিকভাবে এবং একই সূত্র হতে সৃষ্টি হয়েছিল। এরূপ ধারণায় জীবের রূপান্তরের প্রশণটি ছিল অবান্তর।২২
বিজ্ঞানচেতনার উন্মেষ না হলে মানুষ যে কুসংস্কারমুক্ত হতে পারবে না, এ-বোধ থেকে অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮২০-৮৬) পাঠশালায় ভূগোল ও বিজ্ঞান শিক্ষার প্রচলন করেন। এ-কথা সত্যি যে, খ্রিষ্টান মিশনারিরা এদেশে বিজ্ঞান বিষয়ে কৌতূহল উদ্রেক করেন। এবং ভাষার কৃত্রিমতা সত্ত্বেও মিশনারিরা গণিত, ভূগোল, শারীরবিদ্যা, রসায়ন ও পদার্থবিদ্যা বিষয়ে পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন।২৩ রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) ১৮২৩ সালে এদেশীয় মানুষকে গণিত, জড়বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, রসায়ন, শারীরতত্ত্ব ও অন্যান্য বিষয়ে শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে লর্ড আমহার্স্টের কাছে চিঠি লিখেছিলেন। এছাড়া এদেশে তরুণ ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত
সভা-সমিতিগুলো বিজ্ঞানচেতনা ও আধুনিক বিশ্বরহস্য বিষয়ে অবহিত হওয়ার উদ্দেশ্যে বিশেষ ভূমিকা রাখে।২৪ তখনকার দিনের দুজন চিন্তাবিদ ও গবেষকের মধ্যে হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ও নির্মাল্য আচার্য অক্ষয়কুমার দত্তকে ‘বিজ্ঞানী’ হিসেবে অভিহিত করেন। আসলে তিনি ছিলেন সজাগ বৈজ্ঞানিক মনের অধিকারী, যে-মন চিন্তা ও চর্চায় বৈজ্ঞানিক মননের ছাপ রাখেনি শুধু২৫, রচনা করেছিল উদ্ভিদবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কিত ৩২টি বিজ্ঞানবিষয়ক রচনা। এছাড়া বিজ্ঞানী হিসেবে উলেস্নখ করা যায় প–ত মধুসূদন গুপ্ত (জন্ম ১৮০০ সাল, মতান্তরে ১৮০৬ সাল, মৃত্যু ১৮৫৬) ও রাধানাথ শিকদারকে (১৮১৩-৭০)। রাধানাথ শিকদার ছিলেন একজন গণিতজ্ঞ, বৈজ্ঞানিক ও হিমালয়ের সর্বোচ্চশৃঙ্গের পরিমাপক। আর মধুসূদন গুপ্ত ১৮৩৬ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে সর্বপ্রথম শব ব্যবচ্ছেদ পরিচালক। এঁরা দুজন ছাড়া জাতীয়তাবোধ থেকে ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্সে’র প্রতিষ্ঠাতা ডা. মহেন্দ্রলাল সরকার (১৮৩৩-১৯০৪), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ডিএসসি রসিকলাল দত্ত
(১৮৪৪-১৯২৪), ভারতের প্রথম ডিএসসি অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় (১৮৫০-১৯১৫), প্রথম ভূ-বিজ্ঞানী প্রমথনাথ বসু (১৮৫৫-১৯৩৫) ও আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর (১৮৫৮-১৯৩৭) পরে যে মানুষটির নাম উঠে আসে তিনি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় (১৮৬১-১৯৪৪)। ভারতে প্রথম রসায়নবিষয়ক গবেষণাপত্রের রচয়িতা হিসেবে আলেকজান্ডার পেডলারের নাম উচ্চারিত হয়। তিনি ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক। অতঃপর প্রফুল্লচন্দ্র রায় ১৮৯৪ থেকে ১৯০৩ সালের মধ্যে একক গবেষণাপত্র রচনা করেন উনিশটি। ছাত্রদের সঙ্গে যৌথভাবে প্রকাশিত হয় আরো চল্লিশটি গবেষণাপত্র।২৬ এছাড়া তাঁর এ হিস্ট্রি অব হিন্দু কেমিস্ট্রি (১৯২০) গ্রন্থটি ফরাসিদেশীয় বিখ্যাত রসায়নবিদ, আরব ও সিরিয়ার বিজ্ঞান-ইতিহাসে প্রাজ্ঞ মার্সেলিন বার্থেলোর অনুপ্রেরণাসঞ্জাত। এ-গ্রন্থের দ্বিতীয় খ– ডা. ব্রজেন্দ্রনাথ শীল প্রাচীন হিন্দুদের ‘পরমাণু তত্ত্ব’ বিষয়ে একটি অধ্যায় রচনা করেন। পরে এ-লেখাটি পরিবর্ধিত ও সংশোধিত হয়ে Positive Scinces of the Ancient Hindus নামে একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।২৭ যখন পৃথিবীতে পরিবেশ ভাবনার উদ্ভবই হয়নি তখন, ১৮৯০ সালে, কয়েকজন বন্ধুর মধ্যে ডা. নীলরতন সরকার (১৮৬১-১৯৪৩), ডা. প্রাণকৃষ্ণ আচার্য (১৮৬১-১৯৩৬), রামব্রহ্ম সান্যাল (১৮৫০-১৯০৮), হেরম্বচন্দ্র মৈত্র (১৮৫৭-১৯৩৮) ও সুবোধচন্দ্র মহলানবিশকে (১৮৬৭-১৯৫৩) নিয়ে প্রফুল্লচন্দ্রের ‘ন্যাচার ক্লাব’ প্রতিষ্ঠা একটি বিস্ময়কর ঘটনা।২৮ রবীন্দ্রনাথ ১৯২৫ সালে পঞ্চবটী প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এ-আন্দোলনের পুনরাবৃত্তি করলে তাঁকে এ-আন্দোলনের পথিকৃৎ বলা হলেও এর সূত্রপাত হয়েছিল প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের হাতে।
আমরা একটু পেছন ফিরে তাকালে দেখতে পাব, খ্রিষ্টপূর্ব অধ্যায়টা সূক্ষ্ম দার্শনিকতার সমন্বয়ে বৈজ্ঞানিক মননে ঋদ্ধ। এ-সময়ে
উপনিষদে দেহ থেকে আত্মা বা স্থহূল থেকে সূক্ষ্ম পর্যন্ত, ধূলিকণা থেকে বায়বীয় মহাকাশ, এমনকি নক্ষত্রলোক পর্যন্ত সন্ধানী দৃষ্টিকে প্রসারিত করা হয়েছে। … বলা হয়েছে ব্রহ্মা–র সংখ্যা অপরিমিত, আবার এমনও বলা হয়েছে যে ব্রহ্মার দিনরাত্রি বা বহু কোটি বৎসরান্তে প্রলয়, তারপর নোতুন ক’রে সৃষ্টি।২৯
পৃথিবী সৃষ্টিতে মৎস্য, কূর্ম, বরাহ অবতারের মধ্যে অভিব্যক্তিবাদের ধারণা সুস্পষ্ট। প্রাচীন ঋষিগণ কোন রীতিতে প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করেন তা জানা না গেলেও তাঁরা সূর্য-গ্রহ-তারার অবস্থান সম্পর্কে একেবারে চুপ করে বসে থাকেননি। আজকের দিনে বিজ্ঞানের ইতিবৃত্তকারগণ দেখেছেন যে, সেদিন বৈশেষিক ও সাংখ্য দর্শনে সৃষ্টির মূলতত্ত্বগুলো যেভাবে বর্ণিত হয়েছে তা বিজ্ঞানসম্মত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বৈশেষিক দর্শনে মৌল থেকে যৌগের পৃথক গুণ ও ধর্মের কথা বলা হয়েছে। আর সাংখ্য দর্শনে স্থহূল ও সূক্ষ্মের বিভাগ বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তের প্রয়াস। আর নৈরাত্মবাদী বৌদ্ধ দর্শনে সাংখ্যের পঞ্চভূততত্ত্ব, এমনকি মন, বুদ্ধি, অহংকার বিষয়ে বহুকাল ধরে পর্যালোচনা হয়েছে। রোগ চিকিৎসার উদ্দেশ্যে রসায়নশাস্ত্রের উদ্ভব ও বিকাশ; আর ধর্ম-নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের প্রয়োজনে হয়েছে জ্যোতিষবিদ্যার চর্চা। খ্রিষ্টীয় দশম শতাব্দী পর্যন্ত বৌদ্ধবিহারগুলোতে চিকিৎসাশাস্ত্র, রসায়ন ও জ্যোতিষশাস্ত্রের পঠন-পাঠনের ঐতিহ্য ছিল। সুশ্রম্নত ও চরকের চিকিৎসাশাস্ত্রও খ্রিষ্টপূর্বকালের মৌল ও যৌগ পদার্থের যে-সংবাদ পাওয়া যায়, তার বিশদ পরিচয় বিধৃত হয়েছে উপনিষদে। পাশ্চাত্যে অর্থাৎ গ্রিসে এর কাছাকাছি সময়ে ডেমোক্রিটাস, হেরাক্লিটাস, আর্কিমিডিস ও পিথাগোরাসের মতো পদার্থতত্ত্ববিদ বা গণিত-জ্যোতির্বিদের আবির্ভাব হয়েছিল।৩০
বিখ্যাত বিজ্ঞানী মণি ভৌমিক রবীন্দ্রনাথের দুটো বাড়ির কথা বলেছেন, একটি উপনিষদ, অন্যটি বিজ্ঞান। এই বিজ্ঞানচর্চার সূত্র ধরে বারো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ লিখে ফেললেন ‘গ্রহগণ জীবের আবাসভূমি’। প্রবন্ধটি তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় ছাপাও হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানপ্রেম ও মনস্কতার উৎস তাঁর পরিবার। রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮১৭-১৯০৫) মধ্যে ঔপনিষদিক দীক্ষার সঙ্গে বৈজ্ঞানিক শিক্ষার হয়েছিল মহামিলন। রবীন্দ্রনাথের পাঁচ বছরের বড় স্বর্ণকুমারী (১৮৫৫-১৯৩২) ১৮৮২ সালে মাত্র ছাবিবশ বছর বয়সে লেখেন পৃথিবী নামক বিজ্ঞানের বই। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪৯-১৯২৫) বিজ্ঞানবিষয়ক প্রবন্ধের রচয়িতা হলেও সূক্ষ্ম তাত্ত্বিক বিজ্ঞান শিখবার সহজ উপায় নামে লেখেন একটি গ্রন্থ। বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ (১৮৪০-১৯২৬) ইউক্লিডের জ্যামিতির অসংগতি নিয়ে আলোচনা করেন এবং রচনা করেন ‘জ্যামিতির নতুন সংস্করণ’ নামে বিখ্যাত প্রবন্ধ।৩১
এ তো গেল একদিক। আর একদিকে একজন প্রাবন্ধিক ও কথাসাহিত্যিক হরিপদ দত্ত বিজ্ঞানের আবিষ্কারের ক্ষেত্রে ভারতবর্ষ সম্পর্কে বলেন যে, যদি ইউরোপীয় উপনিবেশ উপমহাদেশকে আবদ্ধ করে না রাখত তাহলে মোগল-অধীন বা স্বাধীন রাজ্যগুলোর মধ্যে যন্ত্রের আবিষ্কারের কারণে ভারত হতে পারত অগ্রগামী একটি দেশ। এ ছাড়া, এদেশের স্বর্ণকার, কর্মকারদের কাজ তো ইউরোপীয় কাজের নকল নয়। যুদ্ধের কামান, অগ্নিগোলার উদ্ভাবন সবই স্বমেধার ফল।৩২ আর, কাব্য রচয়িতা হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে মরমিয়া, ঔপনিষদিক, নয়া স্বদেশি আন্দোলনের বিরোধিতাকারী, জাতীয়তাবাদের ঘোর বিরোধী, যেভাবেই দেখতে চাই না কেন তিনি বস্ত্তত্যাগী তুরীয় বিলাসী নন, বরং তিনি ‘একালের একজন প্রবল মানবতাবাদী, এমন কি সমাজসাম্যবাদীও। আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণের আশ্রয়ে প্রগতিমূলক জাতীয়তাবাদী ও চিরনবীনতার পথিক এবং আধুনিক বিজ্ঞানের সত্য পর্যবেক্ষণে আস্থাবান হয়ে মহাকাশের সঙ্গে পৃথিবী সমন্বিত ক’রে নটরাজের লীলারঙ্গে সমর্পিত-চিত্ত।’৩৩
এসব দিক বিবেচনা করে বলা যায়, অক্ষয়কুমার বড়ালের বিজ্ঞানচেতনা স্বকপোল কল্পিত ছিল না, ছিল প্রাচীনকালের বিজ্ঞান ভাবনা ও তাঁর জন্মের আগে বিভিন্ন পাঠশালা, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠিত বিজ্ঞানবিষয়ক গ্রন্থ এবং রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানচেতনার পরম্পরা। আমাদের অন্বিষ্ট কবি অক্ষয়কুমার বড়ালের কবিতায় বিভিন্ন মনীষী প্রেম, প্রকৃতি, নারী বিষয়ে কমবেশি আলোকপাত করলেও কবিতার ভেতরমহলে যে বিজ্ঞানভাবনা, বিশেষ করে অণু-পরমাণু প্রসঙ্গ, জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান বিভিন্নভাবে প্রযুক্ত হয়েছে, এবং এ-ভাবনার বৈগুণ্যে তিনি একজন বিজ্ঞানচেতনাসম্পন্ন কবি হিসেবে গণ্য হতে পারেন, সেরকম বিষয় আদৌ আলোচিত হয়নি। আমরা এ-প্রবন্ধে অক্ষয়কুমার বড়ালের বিভিন্ন কবিতায় প্রযুক্ত বিজ্ঞানচেতনার বিষয়টি জানতে চেষ্টা করব। তিনি লিখেছেন কম। রবীন্দ্রনাথের তুলনায় হয়তো কিছুই নয়। তবে শব্দ ও বিষয়-ভাবনায় বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থে বিজ্ঞানের প্রয়োগ সম্পর্কে যে-স্বমেধার পরিচয় দিয়েছেন, তা একটি সুন্দরতম সংযোজন। আমরা এ-নিবন্ধে অক্ষয়কুমারের বিজ্ঞানচেতনা সংশিস্নষ্ট কবিতার মধ্যে সীমিত থাকব।

অক্ষয়কুমারের কবিতায় বিজ্ঞানচেতনা
আধুনিক যুগে বিজ্ঞানের প্রসার সত্ত্বেও কলা ও বিজ্ঞানের ব্যবধানের ফলে জন্ম নিচ্ছে দুরকমের জীবন-দর্শন। তবে ‘এ কথা তর্কাতীতভাবে প্রতিষ্ঠিত জীবন ও জগৎ-সংক্রান্ত সত্যে উপনীত হওয়ার একমাত্র অবলম্বন বিজ্ঞান।’৩৪ কবিতায় বিজ্ঞানের উপস্থিতি কতখানি কাঙিক্ষত? কবিরা বিমূর্ত বৈভবে রচনা করেন ‘অহং-অনুবিদ্ধ অথচ অহং নিরপেক্ষ’ সত্তাকে৩৫ – সেখানে সত্যোপলব্ধির উপায় হিসেবে বিজ্ঞানের উপযোগিতা তেমন নাও অনুভূত হতে পারে। হয়তো বিজ্ঞানের সঙ্গে শিল্প, সাহিত্য, সংগীতের বিচ্ছিন্নতার জন্যে গতানুগতিক আবহাওয়া আমাদের এক বিশেষ অনুভূতিতে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। আমাদের কবিতায় বিজ্ঞান এলেও তা এসেছে তত্ত্ব ও উপাদান হিসেবে। কিন্তু পোস্টমডার্নিজমের এ-যুগে কবিতা ও বিজ্ঞান বিমিশ্রিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ ও অক্ষয়কুমারকে অতিক্রম করা সম্ভব না হলেও সাম্প্রতিককালের কবি অজয় রায়ের (জ ১৯৬৮) অটো ফিজিক্স কাব্যের প্রতিটি কবিতা বিজ্ঞানভাবনার অন্যরকম ঋদ্ধি। ম্যাজিক-রিয়ালিজমের অনুষঙ্গে অজয় রায়ের কবিতায় হকিং, আইনস্টাইন, নিউটন, সত্যেন বসু, গ্যালিলিও, ম্যাক্স প্লাঙ্ক, ডারউইন, ম্যাক্সওয়েল প্রমুখ বিজ্ঞানীর নামের সঙ্গে বিগব্যাং, বস্ন্যাকহোল, বোসন কণা, গ্রিনহাউস, স্টার ওয়ার, আপেক্ষক্ষক তত্ত্ব ও ক্লোন তত্ত্বের মতো বিষয় এলেও এ-কাব্যে উপস্থাপিত হয়েছে বিজ্ঞান, দর্শন, সমাজ, অর্থনীতি, জ্যামিতি, সাগর, পৃথিবী, মহাকাশ, এলিয়েন প্রভৃতি প্রসঙ্গ। আর আয়রনি, হিউমার ও স্যাটায়ারের প্রয়োগে নিম্নবর্গীয় চরিত্র হিসেবে দড়ামের উপস্থাপন একটি অভিনব সংযোজন।৩৬ এটিও আমাদের কম প্রাপ্তি নয়। বাংলা কাব্যধারায় সবার অলক্ষক্ষ্য বিজ্ঞানের এজাতীয় প্রয়োগ একটি মাইলস্টোন।
অক্ষয়কুমারের বিজ্ঞানচেতনার অনুষঙ্গে প্রথমে প্রদীপ কাব্যের কবিতাগুলো আলোচনা করা যেতে পারে। কাব্যটি যখন প্রকাশিত হয়, তখন অক্ষয়কুমারের বয়স ছিল সতেরো বছর। এ-বয়সে তাঁর কবিতায় ‘দুঃখবাদের বিষ অমৃতে পরিণত’ হয়েছে। তিনি ‘দুঃখদাবদগ্ধ’ হয়েও আস্তিক, বিশ্বাসী, বিধাতার মঙ্গল বিধানে তাঁর নির্ভরতার খামতি নেই। ঠিক এজন্যেই তাঁর ‘পেসিমিজম’ অনেকটা স্নিগ্ধ, শান্ত ও সংযত। আর তাঁর সৌন্দর্যবোধ, তা সে হোক বহিঃপ্রকৃতি ও অমত্মঃপ্রকৃতি, পাঠককে অনুভব ও উপভোগ করার সুযোগ করে দিয়েছে। তাঁর অন্তর্দৃষ্টি ও অনুভূতি অসাধারণ। এই আন্তরিকতা আছে বলেই তাঁর কবিতা আজো অমৃতের উৎস।
নারী তাঁর কবিতায় ভোগের সামগ্রী নয়। নারীকে তিনি দেবীর আসনে বসিয়ে ‘মানস-পুষ্পে অর্ঘ্য’ দিয়েছেন। এছাড়া একটি দুর্লভ বিষয় তাঁর কবিতায় বর্তমান, সেটি ‘মানবিকতা’। এ-প্রসঙ্গে সাহিত্য সম্পাদক সুরেশচন্দ্র সমাজপতি ‘প্রস্ত্ততি’ অংশে লিখেছেন :
অক্ষয়কুমার মানুষকে ভালবাসেন, মানবের সুখ দুঃখে তাঁহার প্রাণ হাসে, কাঁদে – তাঁহার কবিতা পড়িয়াই আমরা বুঝিতে পারি। এই জন্যই তাঁহার কবিতার ঝঙ্কারে আমাদের প্রাণের তন্ত্রী ঝঙ্কৃত হইয়া উঠে। তাঁহাকে এই বিপুল মানব-পরিবারের একজন, – নিতান্ত ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বলিয়াই মনে হয়; – চন্দ্রলোক-চারী, কমলবিলাসী কবি বলিয়া কল্পনা না করিয়াও, তাঁহার কবিতা আমরা সবর্বামত্মঃকরণে উপভোগ করিতে পারি। এইরূপ সমবেদনায় সমৃদ্ধ বলিয়াই তিনি বর্ত্তমান বহু হীনতা ও দীনতা অতিক্রম করিয়া, অণু হইতে বিরাট পর্য্যন্ত – আব্রহ্মস্তম্ব পর্য্যন্ত সবর্বত্র বাঞ্ছিতকে অনুভব করিয়াছেন। আর সেই অনুভূতির প্রসাদে তিনি ‘প্রদীপে’র স্নিগ্ধ আলোয় দেখাইয়াছেন, – মানবের অপূর্ণতা প্রেমে পূর্ণ হয়, এবং সৃষ্টির রহস্য দ্বৈতেই চরিতার্থ হইয়া থাকে।৩৭
তিনি অণু থেকে বিরাট পর্যন্ত ও আব্রহ্মস্তম্ভ পর্যন্ত তাঁর বাঞ্ছিতের যে-অনুভব করেন তাঁর মধ্যে একজন বিজ্ঞানচেতনাদীপ্ত কবির আবির্ভাব আমরা দেখতে পাই। কবির প্রদীপ কাব্যের ‘গীতি-কবিতা’ একটি অসাধারণ দৃষ্টান্ত। এ-কবিতায় ক্ষুদ্রত্বের মধ্যে যে বিশালতার বীজ লুকিয়ে আছে, তা নানা উপাদানের মাধ্যমে বলার চেষ্টা করেন। খুব সাধারণভাবে তিনি বলেন :
ক্ষুদ্র-বৃষ্টিকণা-বলে
সপ্ত পারাবার চলে;
ক্ষুদ্র বালুকায় গড়ে নিত্য মহাদেশ;
কথাটি বললেও, একজন অক্ষয়কুমার বড়ালের মধ্যে এ-অনুভূতির ব্যাপ্তি কি শুধু মহাদেশ গড়ার মধ্যে সীমিত হয়ে আছে? তিনি ষোলো-সতেরো বছর বয়সে অনুভব করেন বিশ্বসৃষ্টির মূলেই আছে অণু-পরমাণুর অস্তিত্ব। আমরা যদি বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে জগৎকে বুঝতে চাই, তাহলে দেখতে পাব, এবং বিজ্ঞান প্রমাণও করেছে যে, এক উৎস থেকে জগতের সবকিছুর সৃষ্টি; সেই উৎস যেমন সত্য, তেমনি সত্য এই জগৎ। বেদ ও উপনিষদের মতে, সমস্ত মহাবিশ্বের কণায় কণায় উপস্থিত সেই ‘উৎস’ – বিরাজমান সেই আদিসত্তা।৩৮ ঋষিগণ যাকে বলেছেন ‘ব্রহ্ম’। বিশ্বজুড়েই ব্রহ্ম প্রচ্ছন্ন সত্তা হিসেবে বিরাজমান। অর্থাৎ মহাবিশ্বের প্রতিটি কণায় আছে ব্রহ্মের উপস্থিতি। আর ব্রহ্ম শব্দের ধ্বনিগত অর্থ হলো সর্বব্যাপিতা এবং সকল বস্ত্তর মধ্যে বিদ্যমানতা। এ সুবাদে বলা যায়, সৃষ্টির মূলই যদি ব্রহ্ম হয়, তাহলে স্রষ্টাও ব্রহ্ম, উপাদানও ব্রহ্ম। অর্থাৎ ক্ষুদ্রতম থেকে স্থহূলে প্রসারিত হয় বলেই তো ‘ক্ষুদ্র-বৃষ্টিকণা’র মধ্যেই লুকিয়ে আছে সাত সমুদ্র। কবি ছোট্ট কয়টি শব্দজালে মহাসাগরের বিশালত্বকে বোঝালেও এর মধ্যে আছে বিজ্ঞানের উপস্থিতি। মৌল কণাগুলো অসংখ্য জলবিন্দুর মতো। একবার আছড়ে পড়লে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়; আবার মিশে যায় বিপুল জলরাশির মধ্যে। কবির এ-কবিতায়‘ক্ষুদ্র বনফুল’ থেকে শুরু করে ‘ক্ষুদ্র-উর্ম্মি’, ‘ক্ষুদ্র শুকতারা’, ‘ক্ষুদ্র স্বপন’, ‘ক্ষুদ্র-বৃষ্টিকণা’, ‘ক্ষুদ্র বালুকা’, ‘ক্ষুদ্র বিহগের সুর’, ‘ক্ষুদ্র মণি-কণিকা’, ‘ক্ষুদ্র মুকুতা’, ‘ক্ষুদ্র নাভি-শ্বাস’, ‘ক্ষুদ্র-কুশ-কাশ’, ‘ক্ষুদ্র নীহারিকা’ ইত্যাদি ‘ক্ষুদ্র’ শব্দের আড়ালে লুকিয়ে আছে জাগতিক প্রলয়, মহাবিশ্ব, মহাসাগর, মহাদেশ, চিরন্তন ভালো, স্বর্ণখনি, সাগরের মাধুরী, শ্বাস-প্রশ্বাস, অগ্নিদাহ ও মহাকাশের বিশাল ব্যাপ্তি। এই কবিতার এক স্থানে কবি বলেছেন :
পল-অনুপল ’পরে
মহাকাল ক্রীড়া করে;
অণু-পরমাণু-স্তরে ব্রহ্মার চাতুরী।
মহাকাল নিরন্তর প্রবহমান। তার ক্ষুদ্রতম দিক বোঝাতে কবি ‘পল’, অর্থাৎ ২৪ সেকেন্ডের আরো ক্ষুদ্রতম অংশ, অনুপল অর্থাৎ আরো ক্ষুদ্র, কবিতায় অনুল্লিখিত ‘বিপল’ হলো এক পলের ষাটভাগের একভাগ। কিন্তু বিজ্ঞান এই পল-অনুপলকে আরো ক্ষুদ্রতম বিভাজন করেছে ন্যানো সেকেন্ডের দ্বারা। এই মহাকাল অনন্ত, অনাদি ও অখ- প্রবাহ, যার আছে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ – অনন্ত প্রবাহের তিনটি স্তর থাকলেও এর মধ্য দিয়ে কবি অণু-পরমাণুর স্তর৩৯ ছাড়িয়ে জগতের আদি ও পরম সত্তাকে ‘ব্রহ্মার চাতুরী’ বলে উলেস্নখ করেন। শুধু কি তাই? অণু-পরমাণুর স্তর পেরিয়ে কবি হার্দিক বিষয়ের প্রতিও আলোকপাত করেন। তিনি বলেন যে, হৃদয়টা কতখানি ভেঙে গেলে একবিন্দু অশ্রম্ন নির্গত হয় তার খোঁজ যেমন কেউ রাখে না, তেমনি ক্ষুদ্র নাভিশ্বাসের মধ্যেই যে আমাদের জীবনপ্রবাহ, বোধ করি, সে-কথা কেউ-ই বোঝার চেষ্টা করে না। আগুন তো নিহিত আছে ক্ষুদ্র-কুশ-কাশ-মূলের মধ্যে। আর মহাকাশে আছে শত শত পৃথিবীসদৃশ গ্রহ-উপগ্রহ – অসংখ্য নীহারিকার মধ্যে আবর্তিত হচ্ছে। তাই ক্ষুদ্রত্ব শুধু ক্ষুদ্রত্বের জন্যে নয়, বিশালত্বের পরিমাপজ্ঞাপক একক বিশেষ। অক্ষয়কুমারও যে জ্যোতির্বিজ্ঞানের চর্চা করেছিলেন তাঁর কবিতার পঙ্ক্তিমালাই তার বড় প্রমাণ। ‘গীতি-কবিতা’র ক্ষুদ্র শুকতারার মধ্যে ‘চির-ঊষা’ যেমন জেগে আছে, তেমনি ‘ক্ষুদ্র নীহারিকা-কোলে শত শত ধরা’ ও ‘তপন – বিশ্বের রাগ,/ বুকে কলঙ্কের দাগ;/ সদা নিষ্কলঙ্ক-রূপা চকিতা হ্লাদিনী’র মধ্যে মহাজাগতিক বিস্ময় ক্রিয়াশীল।
এ-কাব্যে ‘নারী-বন্দনা’ কবিতায় নারী সৌন্দর্য যেন ‘বিধাতার দৃষ্টি যথা জড়িত প্রকৃতি সনে,/ দেব-প্রাণ বেদ-গানে সাধা!’ বিশ্বের সৌন্দর্যের মেরুদ- নারী; তার কাছেই আছে বিশ্বের শৃঙ্খলা। সে-শৃঙ্খলার স্বরূপ হলো, ‘তপনের আকর্ষণে ঘুরে যথা গ্রহগণ,/ তালে তালে, গেয়ে সমস্বরে।’ নারী-সৌন্দর্য তেমনি একটি পরম্পরা। যার মধ্যে জ্যোতির্বিজ্ঞান অন্বিষ্ট হয়ে উঠেছে। যেমন :
তোমারি ও লাবণ্য-ধারায়
কালের মঙ্গল পরকাশ।
অস্পূর্ণ এ সংসারে তুমি পূর্ণতার দীপ্তি,
সান্ধ্য-মেঘে স্বর্গের আভাস!
‘অভেদ প্রভেদ’ কবিতায় নারীর অবস্থান এমনই তাৎপর্যপূর্ণ যে, পার্থিব সংসারেও ভিন্ন গতির দুটি মহাবলের সমন্বয় না হলে বিশ্বও চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যেত। কবির ভাষায় :
অভেদে প্রভেদ এই কিবা সুমঙ্গল!
এ সংসার-রণাঙ্গনে হেন দৃঢ়-আলিঙ্গনে
না মিলিলে ভিন্ন-গতি দুটী মহাবল, –
গ্রহ উপগ্রহ ল’য়ে বিশ্ব যেত চূর্ণ হ’য়ে,
বিধির সৃজন-কল্প হইত বিফল!
এ-কাব্যের ‘মানব-বন্দনা’ অন্যতম একটি শ্রেষ্ঠ কবিতা। এ-কবিতায় বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, নৃতত্ত্ব, সংস্কৃতি, ধর্ম প্রভৃতি বিষয় জড়ো হলেও বিজ্ঞান অনুপস্থিত নয়। মানুষ তার বুদ্ধিদীপ্ত তেজস্বিতায় ‘সপ্তসূর্য্য-শিখা’কে নিরীক্ষণ করেছে, শুনেছে মহাকাশে গ্রহের আবর্তনের শব্দ এবং মহাকালের কোলে যে অণু-পরমাণুর নিরন্তর খেলা চলছে, কবি তা তীব্রভাবে অনুভব করেছেন। তাঁর কবিতায় অণু-পরমাণু প্রসঙ্গ বারবার বিভিন্নভাবে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে উল্লিখিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে একটু জানা দরকার, প্রতিটি বস্ত্ত যদি অণু-পরমাণু দিয়ে গঠিত, তাহলে অণু-পরমাণু কী দিয়ে তৈরি? আসলে অণুর মধ্যে আছে একটি ‘পজিটিভলি চার্জড’ নিউক্লিয়াস বা পরমাণুকেন্দ্র। পরমাণুকেন্দ্রের মধ্যে বন্দি হয়ে আছে কিছু প্রোটন ও কিছু নিউট্রন। এদের ভারসাম্য রাখতে চারপাশে আছে কিছু নেগেটিভ তরিতাণু। আবার প্রোটন বা নিউট্রনের মধ্যে ঢুকলে দেখা যাবে সেখানেও রয়েছে ছোট ছোট কণিকা, যাদের বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয়েছে ‘কোয়ার্ক’।৪০ এতসব উপাদানে পূর্ণ যে অণু-পরমাণু, কবি তার গুরুত্ব অনুভব করেছিলেন বলেই তো কবিতায় বৃহত্তমের মধ্যে অসম্ভব সূক্ষ্মতায় অণু-পরমাণু প্রসঙ্গ টেনেছেন। যেমন, ‘সিন্ধু-মূলে জলবিন্দু, বিশ্ব-মূলে অণু’ প্রসঙ্গটি তাঁর কবিতায় উলেস্নখসাপেক্ষক্ষ বিশ্বসৃষ্টির আদিসত্তা বিষয়ে যে-ইঙ্গিত দিয়েছেন তার মধ্যেই তাঁর বিজ্ঞানচেতনার দিক প্রকাশিত হয়েছে। ক্ষুদিরাম দাসের বরাত দিয়ে বলা যায় :
আমরা তো ক্ষুদ্র জীব, মহাকাশে অতিবিরাটের আবির্ভাব ও বিলয়ের যে সত্য ব্যাপার আজ বিজ্ঞানের সহায়তায় প্রত্যক্ষ হচ্ছে তাতে দেখা যাচ্ছে পরমাণু মিলছে, পরমাণু বিভক্ত হচ্ছে, এক থেকে অন্যে বস্ত্ত থেকে শক্তিতে পরিবর্তন ঘটে চলেছে অহরহ। যেমন আবির্ভাবে, তেমনি তিরোধানে। বাইরে দৃশ্যতঃ যা বিরাট, অভ্যন্তরে সূক্ষ্মরূপে তার সত্তা পারমাণবিক। পরমাণু-রূপান্তরেই মহাবিশ্ব। সে রূপান্তরের বৈচিত্র্য যথেষ্ট, কিন্তু প্রক্রিয়ার ছেদ নেই কোথাও। … এই তো গেল একদিক, এর অন্যদিক হ’ল সৌন্দর্যের, রূপের।
আকাশের নীলিমা সেও রশ্মিশোষণ, রামধনুর বর্ণালী সেও সৌররশ্মির বিচিত্র তরঙ্গচৌম্বক প্রকৃতির প্রকাশ, ধরিত্রীতে পুষ্পপত্রের সমারোহ সেও পদার্থ ও রশ্মির ভৌতরাসায়নিক বিক্রিয়া। পারমাণবিক সংগঠন ও বিমিশ্রণই বস্ত্তর মূলতত্ত্ব।৪১
কবি উপলব্ধি করেছিলেন, মানুষ শুধু মানুষ নয়, তার বিচার-বুদ্ধি, ন্যায়-অন্যায়, শিল্প-সংস্কৃতি বোধসহ আছে দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক বোধ ও বোধি। এবং এটি যে বিবর্তনের ফল তার প্রকাশ হয়েছে এ-কবিতায়।
ল’য়ে সলাঙ্গুল দেহ, স্থহূলবুদ্ধি তুমি
জন্মিলে জগতে, –
অর্থাৎ বনমানুষ, বেবুন ও সাধারণ জাতের বানরের সঙ্গে মস্তিষ্ক, করোটির গঠন, আকার ও অনেক রকমের অসুখ হওয়ার সঙ্গে মানুষের মিল যে কাছাকাছি তা প্রমাণিত।৪২ বোধ করি, এরকম সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অক্ষয়কুমার ডারউইনের তত্ত্বকে প্রাধান্য দিয়েছেন। ১৮৫৯ সালে অর্থাৎ অক্ষয়কুমারের জন্মের আগে প্রকাশিত হয় ডারউইনের Origin of Species গ্রন্থটি। ডারউইনের জন্ম ১৮০৯ সালে। এ-বছরেই প্রকাশিত হয় ফ্রান্সের প্রকৃতিবিজ্ঞানী লামার্কের জৈব অভিব্যক্তি প্রক্রিয়াবিষয়ক Philosophic Zoologic গ্রন্থটি। ডারউইনের আগে ও সমসাময়িককালে একাধিক ব্যক্তি এ-ধরনের সিদ্ধান্ত করলেও ডারউইনই ছিলেন বিপস্নবাত্মক।৪৩ কেননা, তিনি বিষয়টি বলতে পেরেছিলেন। উনিশ শতকে অভিব্যক্তিবাদ বৈজ্ঞানিক মতবাদ হিসেবে প্রসিদ্ধি পেলেও প্রাচীন গ্রিসের দার্শনিক এম্পিডোক্সেস, ডেমোক্রাইটাস ও অ্যারিস্টটলের মধ্যেও এ-চিন্তা আভাসিত হয়েছিল।৪৪ তাঁদের মধ্যে ডেমোক্রাইটাস ভেবেছিলেন সৃষ্টির মূলেই আছে ‘অণু’র উপস্থিতি।
রবীন্দ্রনাথের ‘সমুদ্রের প্রতি’ ও ‘বসুন্ধরা’ কবিতায় আদিমকাল থেকে তৃণলতারূপে, এমনকি ধূলিরূপেও পৃথিবীর সঙ্গে প্রবল একাত্মতার অভিলাষ প্রকাশ পেয়েছে। আর ‘বসুন্ধরা’ কবিতায় ডারউইনের অভিব্যক্তিবাদ দুর্লভ নয়। একইভাবে অক্ষয়কুমারের ‘মানব-বন্দনা’ কবিতায়ও বিষয়টি উপস্থাপিত হয়েছে। মানুষ যে তার শক্তিমত্তার সাহায্যে অসম্ভব প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে পৃথিবীর আদিমতম অবস্থা থেকে বর্তমান সভ্যতার আলো জ্বালতে পেরেছে, ঠিক এজন্যে কবি মানুষের বন্দনাগান গেয়েছেন।
প্রবীণ সমাজ-পদে, আজি প্রৌঢ় আমি,
যুড়ি’ দুই কর,
নমি, হে বিবর্ত্ত-বুদ্ধি! বিদ্যুত-মোহন,
বজ্রমুষ্টিধর!
চরণে ঝটিকাগতি – ছুটিছ উধাও
দলি’ নীহারিকা!
উদ্দীপ্ত তেজসনেত্র – হেরিছ নির্ভয়ে
সপ্তসূর্য্য-শিখা!
গ্রহে গ্রহে আবর্ত্তন – গভীর নিনাদ
শুনিছ শ্রবণে!
দোলে মহাকাল-কোলে অণু পরমাণু
বুঝিছ স্পর্শনে!৪৫
চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা নিয়ে যে মহাকাশ, তারই প্রকাশ হয়েছে ‘কামে প্রেমে’ কবিতায়। পৃথিবীর যেমন চাঁদ-সূর্যের প্রয়োজন, তেমনি চন্দ্র-সূর্যেরও প্রয়োজন পৃথিবীর। মহাজাগতিক রহস্যের মধ্যে এরা যেন একে অপরের পরিপূরক। এটি জাগতিক। এটিই মহাজাগতিক। এই মহাজাগতিক বিষয় নিয়ে জোতির্বিজ্ঞান ও পদার্থবিজ্ঞানের পাঠ। কবি এ-কবিতায় বলেছেন :
বিস্মিত নয়নে,
ঢল-ঢল পূর্ণ শশী সুনীল আকাশে বসি’,
খুঁজিতেছে ধরণীর প্রতি অণু যেন –
এ পূর্ণ জগৎ-মাঝে অপূর্ণতা কেন!৪৬
এ-কাব্যে বিজ্ঞানের পরিভাষা হিসেবে প্রযুক্ত হয়েছে সহস্র তড়িৎ শিখা (‘শেষ’), গ্রহ-উপগ্রহে খেলা (‘জীবন-সংগ্রাম’), ক্ষুদ্র-মণি-কণা (‘কামে প্রেমে’), উল্কাসম (‘পুনর্মিলনে’), অনল-ধাতুস্রাব (‘প্রেম-গীতি’), শত সূর্য্য (‘আবাহন’) প্রভৃতি শব্দ। ভুল (১২৯৪ ব.) অক্ষয়কুমারের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ। প্রকাশিত হয়েছিল কলকাতার ‘পিপলস লাইব্রেরি’ থেকে। তখন পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ১২৯। এ-কাব্যে ৬৭টি কবিতা আছে। তার মধ্যে ৩২টি কবিতায় রচনার তারিখ দেখা যায়। এ-কাব্যে রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করা ‘উপহার’ কবিতাটির সংক্ষিপ্তরূপ ‘কবি’ শিরোনামে শঙ্খ কাব্যে স্থান পেয়েছে। এছাড়া ভুলের অনেক কবিতা আমূল পরিবর্তিত হয়ে প্রদীপ ও কনকাঞ্জলি কাব্যের নতুন সংস্করণে মুদ্রিত হয়েছে।৪৭ ‘উপহার’ কবিতা ছাড়া এ-কাব্যে ব্যক্তি প্রসঙ্গে তিনটি কবিতার মধ্যে৪৮ ‘রবীন্দ্রনাথ’ শিরোনামে আরো একটি কবিতা আছে। ‘উপহার’ কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের কাছে অক্ষয়কুমারের ঋণ স্বীকৃতিমূলক হলেও জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিষয়স্বরূপ ‘রবি, শশি, তারা, ব্যোম,/ শুক্র, শনি, বুধ, সোম’ ও ধূমকেতু এবং ব্রহ্মা–র পরমাণুর মহোল্লাসের
উলেস্নখ আছে। মহাকাশে পরমাণুর মহোল্লাসে ব্রহ্মা- ছেয়ে আছে। পরমাণু-বিজ্ঞানে প্রত্যয়ী কবি অনুভব করেন যে, নীহারিকা থেকে পৃথিবী ও মানুষ সবার মধ্যে আছে অণু-পরমাণুর ভৌতরাসায়নিক চাঞ্চল্য। রবীন্দ্রনাথের কাছে ঋণ স্বীকারোক্তিমূলক এ-কবিতায় কবি অনুভব করেন মহাকাশের গ্রহাণুপুঞ্জের আবর্তনের শব্দ।
রবি, শশি, তারা, ব্যোম,
শুক্র, শনি, বুধ, সোম,
ধূমকেতু মত খুঁজে – গ্রহে গ্রহে মরিয়া,
আজ, আহা, কত দূরে,
কত কল্প ফিরে-ঘুরে,
এক গ্রহে পৌঁছিয়াছি সুর-রেখা ধরিয়া!
ধূমকেতু মত খুঁজে – গ্রহে গ্রহে মরিয়া।
দেখিয়াছি মহাকাশে,
পরমাণু মহোল্লাসে
ব্রহ্মা- রেখেছে ছেয়ে, ছড়াইয়া আপনে।
দেখিতেছি এই দূরে –
কি সুর বাঁশীতে পুরে
সংসার রেখেছে ছেয়ে প্রেমে, গানে, স্বপনে।
জগৎ রেখেছে ছেয়ে, ছড়াইয়া আপনে।৪৯
দীর্ঘ বছর পরে ধূমকেতু একসময় দৃশ্যমান হয় বলে কবির ধারণা সে গ্রহে গ্রহে ঘুরে মরে। আসলে নভোবিজ্ঞানের প্রতিপাদ্য অনুসারে তাপশক্তিজাত পরমাণু-চঞ্চল শূন্যে নীহারিকা-বাষ্পের সংহতি তথা অভিকর্ষজাত কেন্দ্রীণ চাপের ফলে পারস্পরিক পার্থক্য ও বিঘূর্ণন। অযুত-নিযুত গ্যাসবাষ্প-ক্ষেত্রের পুঞ্জিত একত্রিত প্রতপ্ত অবস্থায় কেন্দ্রানুগ ও কেন্দ্রাতিগ আকর্ষণের সমতায় নানান নীহারিকা-অঞ্চলে অযুত-কোটি নক্ষত্রের উদ্ভব। ওইভাবেই সূর্য এবং সূর্যাকৃষ্ট গ্যাসবাষ্প-ধূলিকণার বিঘূর্ণিত অবস্থা থেকে গ্রহ-উপগ্রহ, পৃথিবী ও চাঁদের আবির্ভাব।৫০
এ-কাব্যের ‘উপক্রমণিকা’ কবিতায় বিজ্ঞানমনস্কতার পরিচয় পাওয়া যায়। পৃথিবী যেমন অনু-পরমাণু দ্বারা সৃষ্ট, এবং সেই সৃষ্টিরূপ পাষাণ বা বিশ্বকর্মার তিলোত্তমারূপ বিশ্ব বিন্দু বিনদু বারির আঘাতে সবার অলক্ষ্যে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, তেমনি মানুষের মনের মধ্যে সূচের আঘাতে অহর্নিশি জর্জরিত হচ্ছে। এ-অবস্থার কথা কেউ না বুঝলেও তা যে অন্য শক্তিতে রূপান্তরিত হতে পারে, সে-কথা কজন ভেবেছেন? কবি সে-কথা না বললেও অণু-পরমাণুর দ্বারা সৃষ্ট মহাবিশ্ব সৃষ্টির মত্ততায় নিরন্তর ঘুরছে। ন্যানো সময়ের মধ্যে কালরূপ মহাসিন্ধু ভীমতুফানে আছড়ে পড়ছে বেলাভূমিতে। এই ক্রিয়ার মধ্যে যে অব্যক্ত যন্ত্রণা আছে তা বিজ্ঞানমনস্ক কবি পৌরাণিক অনুষঙ্গে
পৃথিবীর ভারবাহী বাসুকীর প্রাণান্তকর অবস্থার সঙ্গে তুলনা করেছেন। মহাবিশ্ব সৃষ্টির মূলে আদিসত্তা হিসেবে অণু-পরমাণুর অবস্থানের কথা বলা হলেও মানুষের মধ্যেও অণু-পরমাণুর মতো আশা, মোহ, ভুল, ভালোবাসা তোলপাড় করছে। তার কোনো দৃশ্যমান প্রতিক্রিয়া না থাকলেও কোনো প্রকার কাতরতা নেই তা বলা যাবে না। এটি তুলিত হতে পারে ‘নাদ’-এর সঙ্গে। ‘নাদ’-এ স্পন্দন ও দীপ্তি থাকলেও সৃষ্টিহীন। প্রকৃত সৃষ্টির ঊর্ধ্বে অপ্রাকৃত সৃষ্টির অবস্থা। তন্ত্রশাস্ত্রমতে এই নাদ থেকে বিন্দুর সৃষ্টি। বিন্দু বিদীর্ণ হওয়ার সময় একটি অব্যক্ত ধ্বনি উত্থিত হয়। এই ধ্বনিই ‘শব্দব্রহ্ম’। অসম্ভব সূক্ষ্মতার সূচক এই ক্ষয়প্রাপ্তি যেন ভাঙাগড়ার মধ্যে অনিবার্য সৃষ্টির প্রেরণা – তা যেমন কবির, তেমনি মহাজগতেরও বটে। Black Hole একটি তারাকে গ্রাস করার সময় আলোকরশিম নির্গত হয়, ও সৃষ্টি হয় একটি Shock Wave। এই Energy হলো Dark Energy। মানুষের মনের মধ্যেও কত কী বিষয়ের তোলপাড় হচ্ছে। মানুষ ঠিক ঠিক করে তা বর্ণনা করতে পারলে সেই Potential Energy-র দ্বারা কত কত বিষয়ের সৃষ্টি হতে পারত, তার ঠিক-ঠিকানা নেই। এরকম একটি অনামিক অনুভূতির প্রকাশ দেখা যায় এ-কবিতার প্রথম পঙ্ক্তিতে। অতঃপর শেষ পঙ্ক্তিগুলোতে কবি যে-কথা বলেছেন তা দৈহিক অভিঘাত থেকে যাত্রা করে বিজ্ঞানের অন্দরমহলে নিভৃতে নিনাদ করে ওঠে।
কে বুঝিবে? – প্রাণে যার দিনরাত অনিবার
বিঁধিতেছে সূচি।
নাহি যার দীর্ঘ শ্বাস, অশ্রম্নজল, হা-হুতাশ
কে বুঝিবে কথা তার, মন-ভাঙা কুচি!
বিন্দু বিন্দু বারি-ঘায় পাষাণ ভাঙিয়া যায়,
এ কথা ত মান’।
ল’য়ে রূপ তিল তিল, বিশ্বকর্ম্মা নিরমিল
তিলোত্তমা জান’।
অণু পরমাণু ল’য়ে ঘুরিছে বিব্রত হ’য়ে
ব্রহ্মা- মহান্!
ল’য়ে পল বিন্দু বিন্দু ছুটে কাল-মহাসিন্ধু
কী ভীম তুফান!
বুঝিবে না তবে, ধীর, এ হৃদয়-বাসুকীর
প্রাণান্তক ভার?
অণু-পরমাণু-আশা, মোহ, ভুল, ভালবাসা,
প্রসারিছে – সঙ্কোচিছে যেথা অনিবার!৫১
শঙ্খ কাব্যটি কবির পঞ্চাশ বছর বয়সে সংকলিত ও প্রকাশিত। এ-কাব্য সম্পর্কে পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন যে, শঙ্খ একখ- অস্থিবিশেষ। সাগরে জলের মধ্যে তার অবস্থান। তার শ্রবণশক্তি নেই, জিহবাও স্থবির – অস্থিই তার সর্বস্ব। জীবদ্দশায় এই অস্থি নীরব, কিন্তু মৃত্যুতে সরব। তাঁর ভাষায় শোনা যাক –
যেদিন উহার কুক্ষক্ষগত জীবন অনন্ত জীবনে মিশিয়া যায়, সেই দিন হইতে উহা শব্দের-ধ্বনির-আরাবের আশ্রয়স্বরূপ হইয়া থাকে। একবার উহার মুখে মুখ মিলাইয়া ফুৎকার দিলে আজীবন-সঞ্চিত অনন্তের ধ্বনির-প্রতিধ্বনি উহা শুনাইয়া দেয়। চিরজীবন যে হাহাকারের মধ্যে থাকিয়া, যে অব্যাহত বিকট ভৈরবধ্বনির লীলার মধ্যে থাকিয়া, উহা নীরবে যে মঙ্গল ও অমঙ্গল শব্দের সংস্কার স্বীয় অস্থির স্তরে স্তরে লুকাইয়া রাখিয়াছে, যেন তাহাই নরনারীর অধরৌষ্ঠের সম্মেলনে আবার ফুটাইয়া তোলে। ইহাই শঙ্খ; যাহা মরিয়া জীবনের সুখসোহাগের প্রতিধ্বনি করে, যাহা শূন্যগর্ভ হইয়া অব্যক্ত শূন্যের অশরীরিণী বাণীর প্রতিধ্বনি করে, যাহা সাগরের শব্দমহিমার পরিচয় তোমাকে দিয়া দেয়, যাহা ইহকাল ও পরকালের মধ্যে শব্দের – নাদের বন্ধনীস্বরূপ, তাহাই শঙ্খ।৫২
এই ‘শব্দই ব্রহ্মার ওঙ্কার, পিনাকপাণির হুঙ্কার, শ্রীকৃষ্ণের বংশীরব।’ এই শব্দ সুখ ও অসুখের; পূর্বরাগ, অনুরাগ ও সম্ভোগের। আবার বিরহের হাহাকার, মৃত্যুর ভাষা, চিতার চটপটানি। মানবজীবনের সূতিকাগার থেকে বিবাহের ছাদনাতলায়ও বাজে, – বাজে মহাপ্রয়াণেও। এ যেন ‘অনন্তের ধ্বনি’। শিশুর জন্ম প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ একটি ছড়ায় পার্থিব সন্তানকে অপার্থিব বোধে মনের মধ্যে ‘ইচ্ছে হয়ে’ থাকার কথা বলেছেন। আর অক্ষয়কুমার বলেন যে, শিশুটি হৃদয়রূপ ব্রহ্মা– আকুল স্নেহের মধ্যে অণু-পরমাণুর মতো নিরন্তর ঘুরত; তাই-ই যেন এতদিন পরে দেহ ধরে পৃথিবীতে পদার্পণ করেছে। কবির ভাষায় :
কিংবা আজীবন এই হৃদয়-ব্রহ্মা–
যে আকুল স্নেহ –
অণু পরমাণুর মত ঘুরিত রে অবিরত,
ঘুরে’ ঘুরে’ এত পরে ধরেছে ও দেহ!
(শঙ্খ, ‘সদ্যোজাতা কন্যা’, পৃ ২৭-২৮)
বস্ত্তবিশ্ব যে অণু-পরমাণুর সূক্ষ্ম কারুকাজ তাতে সন্দেহ নেই। মানুষের দেহ অণু-পরমাণুর দ্বারা সৃষ্টি হলেও তার মধ্যে আছেপ্রেম, ভালোবাসা, ঘৃণা, আশা, অহংকার, ব্যর্থতা, মুগ্ধতা ইত্যাদি মানবীয় গুণ। অক্ষয়কুমারের বিজ্ঞানচেতনায় মানবীয় স্নেহের মধ্যে অণু-পরমাণুর মতো বোধকে প্রতিষ্ঠিত করা একটি অভিনব সংযোজন। শুধু তাই নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের আগমনকে, – যারা সূর্যালোকের মধ্যে লুকিয়ে আছে, তারাও একদিন জন্মলাভ করবে; যেমন বৃক্ষক্ষর আদি উৎস হিসেবে বীজের অবস্থান, তেমনি পৃথিবীর আদিসত্তা অণুকে ধারণ করে হবে এদের আগমন।
কিংবা ভবিষ্যৎ-গর্ভে আছে যত প্রাণ,
রে ঊষা-আলোক!
তোমারেই করে’ ভর, আসিতেছে তোমা পর –
বীজে যথা কল্পতরু, অণুতে ভূলোক।৫৩
‘প্রতিভার উদ্বোধন’ কবিতায় ‘প্রতিভা’ যেন একটি নিষ্কাম কামনার অভিব্যক্তি নয় শুধু, ‘আনন্দের পরমাণুকণা’ও। সৃষ্টির যে-আনন্দ তার মধ্যেও কবি পারমাণবিকতা দর্শন করেন। মানুষের অনুভূতির প্রকাশ কবিতা হলেও তার মধ্যে যে পারমাণবিক অনুভূতির সঞ্চার হতে পারে তা অক্ষয়কুমারের কবিতায় প্রথম উল্লিখিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের বিশাল সৃষ্টির মধ্যে এরকম প্রয়োগ দুর্নিরীক্ষ্য নয়। তবে অক্ষয়কুমারের বিজ্ঞানচেতনা আর রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানচেতনার মধ্যে বিস্তর ব্যবধান। যদিও উভয়ের কবিতায় বিজ্ঞানের প্রয়োগ কখনো পারিভাষিক শব্দের মধ্যে আটকে থাকেনি; বরং প্রসারিত হয়েছে কাব্যভাষার অনিন্দ্য মাধুরীতে। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় বিজ্ঞান যেন কবির হার্দিক স্পন্দনের রশ্মিজাল, মুগ্ধতার পরশ বুলিয়ে গেছে। অপরদিকে, অক্ষয়কুমারের সৃষ্টির মধ্যে বিজ্ঞানের ব্যবহারও সৌন্দর্যম–ত এবং অনেক নতুন বিষয়ের ব্যঞ্জনায় ঋদ্ধ হয়ে উঠেছে। এ-কবিতায় আরো একটি বিষয় অসম্ভব রকম প্রাধান্য পেয়েছে, সে জ্যোতির্বিজ্ঞান। কবির মনে হয়েছে মহাশূন্যের নীহারিকা-অঞ্চল অযুত-কোটি নক্ষত্র ও তার আলোকরশ্মিতে পূর্ণ। কবি এ-আলোর কিরণকে বলেছেন ‘সুকোমল তরল কিরণ’ এবং মহাকাশে সূর্যকে বেষ্টন করে যে-বিচিত্রবর্ণের গ্রহ-উপগ্রহ গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে ছুটে চলেছে কবি তাদের মধ্যে অনাহত ওঙ্কার-ঝঙ্কার শুনতে পান। এ-কবিতায় জ্যোতির্বিজ্ঞানের সঙ্গে পদার্থবিদ্যা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। কবির ভাষায় :
বিস্ময়-বিহবল মহাকবি
চাহিয়া আছেন অনিমিখে –
সমুখে ফুটিছে নব রবি,
তারকা ছুটিছে দশ দিকে!
মহাশূন্য পূর্ণ আজি
সুকোমল তরল কিরণে!
ঘুরে গ্রহ-উপগ্রহরাজি
দূরে – দূরে বিচিত্র-বরণে!
গ্রহ হ’তে গ্রহান্তরে ছুটে
ওঙ্কার-ঝঙ্কার অনাহত!
পঞ্চভূত উঠে ফুটে’ ফুটে’
রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শে কত!
ছন্দে বন্ধে যতি-গরিমায়
চলে কাল ললিত-চরণে!
অন্ধশক্তি পূর্ণ সুষমায়,
চেতনার প্রথম চুম্বনে!
নীলবাসে ঢাকি’ শ্যামদেহ
শশিকক্ষে ভ্রমে ধরা ধীরে;
কত শোভা, কত প্রেম-স্নেহ,
জলে স্থলে প্রাসাদে কুটীরে!৫৪
এষা একটি শোককাব্য। ১৩১৩ সালের ১৯ মাঘ তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুতে শোকাহত কবির নানামাত্রিক ভাবনা অভিব্যক্ত হয়েছে এ-কাব্যে। ১৯১২ সালে প্রকাশিত এ-কাব্যের পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ১৬৭। এ-কাব্যের তৃতীয় সংস্করণে বিপিনচন্দ্র পাল (১৮৫৮-১৯৩২) ‘পরিচয়’ শিরোনামের একটি প্রবন্ধে বলেন :
‘এষা’তেই তাঁহার রচনা-মাধুর্য্যের ও কবিত্বের পূর্ণ বিকাশ ও পরিণতি লক্ষিত হয়। পুত্র, কন্যা, স্বামী, স্ত্রী বা আত্মীয়-বিয়োগের ফলে বঙ্গসাহিত্য যে সমস্ত গদ্য ও পদ্য রচনা দ্বারা অলঙ্কৃত হইয়াছে, ‘এষা’ তাহাদের মধ্যে মুকুটমণি। কেননা, ‘এষা’ বাঙ্গালীর গার্হস্থ্যজীবনের একখানি আলেখ্যকে অত্যন্ত দক্ষতার সহিত কাব্যের শ্রেষ্ঠ রূপান্তরে পৌঁছাইয়া দিতে পারিয়াছে।
পত্নী-বিয়োগের আঘাত পাইয়া কবি-হৃদয়ে যে ভাবের প্রবল তরঙ্গ উঠিল, – তাহারই আঘাতে আঘাতে ‘এষা’র এক একটি কবিতার সৃষ্টি হইল। এই শোক মানব-হৃদয়ে অহরহ আঘাত করিতেছে, – কেহ নীরবে ইহাকে বক্ষক্ষ ধারণ করিয়া তুষাগ্নিদাহনে দগ্ধ হইতেছেন, কেহ বা ফুকারিয়া কাঁদিয়া উঠিয়া সে শোকের কতকটা লাঘব করিতেছেন। কিন্তু যিনি কবি, শোকের প্রচ- আঘাতে তাঁহার প্রাণে বাক্যস্ফূর্ত্তি হয়; তিনি এই নিদারুণ বিয়োগ-বেদনা ভাষার সাহায্যে ফুটাইয়া তুলিয়া ইহাকে সাধারণের গোচরীভূত করেন।
(এষা, সম্পাদকীয় ভূমিকা)
এ-কথার নিদর্শনস্বরূপ বলা যায়, ইংরেজ কবি টেনিসন বন্ধুর মৃত্যুতে শোকাহত হয়ে রচনা করেন In Memoriam কাব্যটি। বাংলা ভাষায়ও গদ্যে-পদ্যে রচিত হয়েছে অনেক শোককাব্য ও কবিতা।৫৫ কবিপত্নীর মৃত্যু হয়েছিল ১৯ মাঘ ১৩১৩ সনে। এ-কাব্যে ‘মৃত্যু’ নামক সপ্তমসংখ্যক কবিতায় কবি অনুভব করেন একজন মানুষের অনুপস্থিতির বেদনা। এ বেদনা পারিবারিক এবং নিতান্তই ব্যক্তিগত হলেও সবার বেদনায় পরিণত হয়েছে। একজন নেই বলে নন্দন-বন যেন শ্মশানে পরিণত হয়েছে। কবি বিশ্বাস করতে পারেন না এমনটি হতে পারে। মৃত্যুজনিত কারণে মানুষের শত বিপর্যয় হলেও কবির বিশ্বাস, পৃথিবী জড় পরমাণুর মতো অপরিবর্তিত আছে। প্রাণ হয়ে আছে বজ্রদগ্ধ।৫৬ কিন্তু পরমাণুর মধ্যে আছে নিরন্তর প্রবাহ। প্রবাহ আছে বলে মরণ যেমন হৃদয়ের সুখ-দুঃখ, কষ্ট প্রভৃতির স্নায়বিক পরিবর্তন ঘটায়, অনুরূপভাবে পরিবর্তন ঘটে বস্ত্তবিশ্বেরও। এ-কাব্যের ‘অশৌচ’ শিরোনামের সপ্তমসংখ্যক কবিতায় কবির মনে হয়েছে :
মনে হয়, – বসিয়া গম্ভীরে,
জগতের প্রতি শিরে শিরে
চালাইতে ছুরী;
ছিন্ন-ভিন্ন তন্ন-তন্ন করি’
প্রতি অণু-পরমাণু ধরি’
দেখি কি চাতুরী!
(এষা, পৃ ২২)
মৃত্যুজগতের মাঝখানে বসে মানুষের নানা রকম উত্থান-পতনের মধ্যে যে-পরিবর্তন সৃষ্টি করে, তা যেন যুগপৎ স্নায়বিক ও পারমাণবিক বিশ্বকে নাড়িয়ে দেওয়া। কবির জিজ্ঞাসা :
জীবনের এ শোক-বিস্বাদ –
শুধু কি জীবের অপরাধ,
জীবের নিয়তি?
এক দিন – কেহ একবার
করিবে না তোমার বিচার
হে অন্ধ-শকতি!
(এষা, পৃ ২২)
কবির বিশ্বাস : মহাকাশে কত কত গ্রহ, নক্ষত্র, উপগ্রহ বিদ্যমান; তার কোনোটিতে হয়তো তাঁর সহধর্মিণী অবস্থান করছেন। কবি মনে করেন, আত্মায় আত্মায় যেমন আলিঙ্গন হয়, তেমনি অণুতে অণুতেও হয় সম্মিলন। এভাবে জগৎ আবর্তিত হচ্ছে। এর মধ্যে যে মৃত্যু আমাদের জীবন খানখান করে দিচ্ছে, এটি একান্তভাবে জাগতিক। এ-প্রসঙ্গে কবির জিজ্ঞাসা :
সূর্য্য, গ্রহ, উপগ্রহ-দল,
সবে চলে তালে তালে; নীহারিকা বাঁধা জালে,
ধূমকেতু সময়ে উজ্জ্বল
ঘুরে ধরা নিজ কক্ষে, বর্ষ ষড়-ঋতু-বক্ষক্ষ
মরণ কি শুধু বিশৃঙ্খল?
এমনকি, প্রকৃতিতে ঝড়, ঝঞ্ঝা, তুষারপাত, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, ভূমিকম্প কিছুই অনিয়ম নয়। এর পেছনে কারণ আছেই। তার মধ্যে ‘মরণ’ এই কারণের বাইরে নয়। ‘বীজে তরু, ফুলে ফল, ফলে পুনঃ বীজদল’-এর মধ্যে সৃষ্টির ভারসাম্য রক্ষিত হয়। বস্ত্তত পাষাণ ও ধাতুর মধ্যে যেমন স্পন্দন আছে, তেমনি জীবনের মধ্যে আছে ‘জীবন-চঞ্চল অণুকণা’। কবির ভাষায় :
দেখিতেছি পাষাণে চেতনা,
শুনিতেছি ধাতু-মাঝে জীবন-স্পন্দন বাজে
জীবন-চঞ্চল অণুকণা।
স্থাবর, জঙ্গম, জীব, জল, স্থল, শূন্য, দিব,
ধূলি, বালু – তাহারি ব্যঞ্জনা।
(এষা, পৃ ২৭)
কবির বিজ্ঞানচেতনা আলাদা কোনো সত্তা নয়। তাঁর অণু-পরমাণু বিষয়ক ভাবনাও নয় কোনোক্রমে জীবনবিচ্যুত বিষয়। তাবৎ বস্ত্তবিশ্বের মধ্যে যেমন অণু-পরমাণুর নিত্য সঞ্চালন, অনুরূপভাবে মানুষের দেহাভ্যন্তরেও চলছে সুখ-দুঃখ, হাসি-আনন্দ, মৃত্যু-বীভৎসতা নিয়ে দেহাভ্যন্তরীণ বিস্ফোরণ। বস্ত্তবিশ্বের বিস্ফোরণ দৃশ্যমান, দেহাভ্যন্তরীণ বিস্ফোরণ অদৃশ্য। শুধু মর্মযাতনা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ভাষা আছে বলে, – সবার না হলেও, কারো কারো বিস্ফোরণ কিছুটা হলেও প্রকাশ পায়। এভাবে অক্ষয়কুমার বড়ালের কবিতায় বিজ্ঞানভাবনা নিজস্ব অনুভূতিতে অন্য মাত্রা পেয়েছে।

তথ্যসূত্র
১. মোহিতলাল মজুমদার, সাহিত্য-বিচার, কলকাতা, বিদ্যোদয় লাইব্রেরী প্রাইভেট লিমিটেড, ১৩৭৩, পৃ ৪৭।
২. তদেব, পৃ ৪৭।
৩. ক্ষুদিরাম দাস, রবীন্দ্র-কল্পনায় বিজ্ঞানের অধিকার, কলকাতা, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, ২য় মুদ্রণ ১৯৮৮, পৃ ৩৮-৩৯।
৪. সুহাস চট্টোপাধ্যায়-সম্পাদিত, মার্কসবাদ ও নন্দনতত্ত্ব, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, দ্বিতীয় মুদ্রণ ১৯৯০, পৃ ২৯।
৫. অন্নদাশঙ্কর রায়, আর্ট, কলকাতা, পুনশ্চ, ১৯৮৯, দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা। অন্নদাশঙ্কর রায় রবীন্দ্রনাথকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘Is Art too good to be human nature’s daily food?’ আর্ট কি এতই ভালো যে মানবপ্রকৃতির দৈনন্দিন পথ্য হতে পারে না? তিনি একটু ভেবে নিয়ে বললেন, ‘তা কী করে হবে? উচ্চতর গণিত কি সর্বজনবোধ্য? আগে সহজ গণিত শিখতে হবে।’
৬. মোহিতলাল মজুমদার, সাহিত্য-বিচার, পৃ ৪৭-৪৮।
৭. সুহাস চট্টোপাধ্যায়-সম্পাদিত, মার্কসবাদ ও নন্দনতত্ত্ব, পৃ ২৩।
৮. আবদুল্লাহ আল-মুতী, প্রযুক্তির বিকাশ ও বিস্তার, ঢাকা, বিজ্ঞান জিজ্ঞাসা, ১৯৮৭, পৃ ৬৮।
৯. সুহাস চট্টোপাধ্যায়-সম্পাদিত. মার্কসবাদ ও নন্দনতত্ত্ব, পৃ ২৩।
১০. আহমেদ হুমায়ুন, বিপরীত স্রোতে রবীন্দ্রনাথ, ঢাকা, নওরোজ কিতাবিস্তান, ১৩৮০, পৃ ১০।
১১. ১৮৭৭ সালে মঙ্গলগ্রহের ফোবস (Phobos) ও ডিমোস (Demos) নামে দুটো উপগ্রহের আবিষ্কার হলে টেনিসন ১৮৩১-৩২ সালের দিকে লেখা একটি কবিতার পঙ্ক্তি বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য নতুন করে লেখেন। প্রথমে লেখেন : She’s the snowy poles of moonless Mars, পরে লেখেন : She’s the snowy poles and moons of Mars. বর্তমানকালের ধারণা মঙ্গলগ্রহে কোনো বরফ নেই। তাই জনৈক সমালোচক মনে করেন বিজ্ঞানভিত্তিক প্রমাণের জন্য লেখা উচিত : She’s the snowless poles and moons of Mars. তদেব, পৃ ১৩।
১২. মানস মজুমদার, অক্ষয়কুমার বড়াল ও বাংলা সাহিত্য, কলকাতা, জ্যোতিশ্রী প্রকাশন, ১৯৮৩, পৃ ১-২।
১৩. তদেব, পৃ ২-৪।
১৪. বুঝতে নারি নারী কি চায়
কি চায় গো।
মাঝখানে ছেদ কইতে কথা
চাইতে চাইতে মুদে পাতা
হাসতে হাসতে কেঁদে ফেলে
আসতে কাছে ফিরে যায় \
১৫. মানস মজুমদার, পৃ ১৫।
১৬. উদ্ধৃত : তদেব, পৃ ১৬২।
১৭. ক্ষুদিরাম দাস, পৃ ৪।