অগস্ত্যযাত্রা

যার যে স্থানে জন্ম, সেই জন্মস্থানের মাটিতে মিশে যাওয়ার অন্তিম বাসনা অনেকেরই হয়। হার্টে প্রথমবার মৃদু ধাক্কা খেয়ে, আবারো বড় অ্যাটাকের আশংকায় আমিও স্বজনদের কাছে শেষ ইচ্ছেটি জানিয়ে রেখেছি। মরে গেলে পৈতৃক ভিটাতেই আমাকে কবর দিও। কার মরণ কোথায়, কখন এবং কীভাবে ঘটবে, কেউ ঠিক জানে না। কিন্তু এটুকু জানি, মরার পর লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সে দীর্ঘ কবরযাত্রা নিজের জন্য না হোক, জীবিত স্বজনদের জন্য আরামপ্রদ হবে না মোটেও। চাকরিতে অবসর নিয়ে শহরবাসের পালা তাই চুকিয়ে দিয়েছি। শেষজীবনটা কাটাতে চলে এসেছি গ্রামের বাড়িতে।

তা বলে মরার জন্য গ্রামে ফিরেছি, এমন ভাবলে ভুল হবে। এতটা মরণবাদী মানুষ আমি নই। নিজের কবরের জায়গাটা রোজ দেখি, কিন্তু স্বপ্নে কিংবা জাগরণে কল্পনায় সেখানে এক মিনিটও শুয়ে থাকার কথা ভাবি না। অনন্ত পরকালের আজাবভীতি নিয়ে কাতর নই মোটেও। বরং আজন্ম চেনা জন্মভূমিতে বাঁচার

সুখ-সুবিধার দিকগুলো ভেবেছি গ্রামে ফেরার আগে থেকেই। যতটা সম্ভব নিশ্চিত করেছি সব বন্দোবস্ত। বাড়ির সামনে পাকা রাস্তা। অসুখ-বিসুখে অ্যাম্বুলেন্সে শহরের হাসপাতালে যেতে লাগবে বড়জোর ঘণ্টাদেড়েক। বাড়িতে বিদ্যুৎ, ডিশ-টিভি, এমনকি ইন্টারনেটও এখন সহজলভ্য। শহরের সাপ্লাই পানির চেয়ে এখানকার মাটির গভীর থেকে মেশিনে টেনে তোলা পানি নিরাপদ ও সুস্বাদু মনে হয়। আর  বায়ুদূষণ ও শব্দদূষণ নেই বললেই চলে। তারপরও গ্রাম তো গ্রামেই পড়ে আছে। প্রবাসী সন্তান নিঃসঙ্গ পিতার শেষজীবনটা নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যে রাখতে বিদেশে নিজের সঙ্গে রাখার প্রস্তাব করেছিল। আমি কর্মব্যস্ত ছেলেমেয়েদের সংসারে বোঝা বাড়াতে চাইনি। নাগরিক জীবনের একাকিত্ব এড়াতে, আশ^স্ত করেছি তাদের, গ্রামে থাকলে বরং আমার নিঃসঙ্গতা কাটবে। নিজের জায়গাজমির চাষাবাদ দেখলেও ভালো লাগবে এবং জমিদারের মতো সেবাযতœ পাব অনেকের কাছেই।

শৈশবে আমার মোটা গড়ন ও আলসে স্বভাবের চালচলন দেখে জমিদার বলে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করত অনেকেই। ‘জমিদারের বাচ্চা’ বলে বহুবার গালও খেয়েছি মায়ের কাছে। বড় হয়ে কী হবো, কেউ জানতে চাইলে জমিদার হওয়ার ইচ্ছেটি প্রকাশ করতাম সগর্বে। সেই বয়সেও প্রান্তরের আইলঘেরা হাজারো জমি দেখে ইচ্ছে জাগত, আহা এগুলো যদি সব আমার হতো! গাঁয়ের সব চাষি-মজুর যদি প্রজার মতো আমার হুকুমে ওঠবস করত! কেন এক গ্রামীণ বালকের মনে এমন স্বৈরাচারী বাসনা খেলা করত, তার ব্যাখ্যা আজ দিতে পারব না। তবে বাল্যকালে এমন স্বপ্নসাধ যার মনে জাগত, বড় হয়ে তার একজন মন্ত্রী, আমলা কিংবা অগাধ অর্থবিত্ত এবং ভূসম্পত্তির মালিক, নিদেনপক্ষে দেশপ্রেমিক পাতিনেতা হলেও জীবনের ধারাবাহিকতা মানানসই হতো, কিন্তু বাস্তবে হয়েছি সরকারি কেরানি। সামান্য বেতনের চাকুরে হিসেবে কেটেছে ধরাবাঁধা জীবনের দীর্ঘ সময়। ছেলেমেয়ে দুটি স্বাবলম্বী হয়ে নিজস্ব সংসারে ঢুকেছে, এটাই বড় সান্ত¡না। রিটায়ার করে হাতে যে-পেনশন পাই, তা দিয়ে শহরে স্ত্রীশূন্য সংসারের নিঃসঙ্গ জীবনের স্বাধীনতা ভোগ করতে পারতাম। কিন্তু নাড়ির টান তো ছিলই, সেসঙ্গে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ভূসম্পত্তি ভোগদখলে রাখাটা উপভোগ্য মনে হয়েছে বেশি। এই স্বপ্ন ও দায়িত্ব চাকরিজীবনেও ছিল বলে গ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলাম। পৈতৃক সম্পত্তি ভাগাভাগির সময় বাড়ির সামনের পুকুরটা নিজের ভাগে রেখেছি। শেষ বয়সে কাজে লাগবে বলে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে পুকুরপাড়ে গাছও লাগিয়েছি।

গ্রামে আমার ভূসম্পত্তি বলতে পৈতৃক বাড়িভিটা এবং বাড়ির সামনের পুকুরটাই চোখে পড়ে আগে। এছাড়া আছে মাত্র বিঘাতিনেক কৃষিজমি। কিছুকালের মধ্যে সাড়ে তিন হাত জায়গা নিয়ে অনন্ত নিদ্রা দেবে যে, তার জন্য এ-পরিমাণ জায়গাজমি অবশ্য যথেষ্ট। গাঁয়ের লোকেরা, বিশেষ করে ভূমিহীন ও প্রায়-ভূমিহীন যারা, তাদের দৃষ্টিতে আমার বিষয়-সম্পদের পরিমাণ আরো অনেক বেশি। এ-কারণেই  বোধহয় শৈশবে নিজেকে জমিদার ভাবার খেয়ালটি অনেক সময় বাস্তব হওয়ার বিভ্রম জাগায়। গাঁয়ের রাস্তায় জমিদারের মতো হাঁটি। মাথার ওপরে মুক্ত আকাশ, বাতাসে ঢেউখেলানো ধানক্ষেতের

ধু-ধু প্রান্তর এবং গ্রামছাড়া গোটা নদীটাকেও নিজস্ব সম্পত্তি ভাবতেই-বা দোষ কী। ঢাকার রাস্তায় হাঁটার সময় কেউ ফিরেও তাকায় না, কিন্তু গাঁয়ের পথে হাঁটতে বেরোলেই চেনা-অচেনা বহুজনের সালাম পাই। খাতির জমানো কথা বলে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করে অনেকেই। আমিও দয়ালু জমিদারের মতো তাদের

বাপ-দাদার নাম এবং হালচাল জানতে কথাবার্তা বলি। ডায়াবেটিস কমাতে গাঁয়ের রাস্তায় দুবেলা হাঁটাচলা এবং নিজের পুকুরে ছিপ ফেলে বসে থাকা ছাড়া আমার করার মতো কাজও নেই।

অবসরে নিজের পুকুরপাড়ে একা হলেই বরং আমার জমিদারি মেজাজ ও স্মৃতি-স্বপ্ন সঙ্গ দেয় বেশি। এতদঞ্চলে প্রকৃত জমিদারের এক পোড়োবাড়ির চিহ্ন ও মস্ত বড় একটি দিঘি রয়েছে। পোড়োবাড়ির ইটকাঠ উধাও হয়েছে বহু আগেই, কিন্তু নানা কিংবদন্তি নিয়ে জমিদারের দিঘিটা অক্ষত আছে এখনো। প্রতিবছর চৈত্রসংক্রান্তির মেলা বসে। সেই দিঘির পাকা ঘাটলায় বসে সময় কাটানোর স্মৃতি স্মরণে রেখে আমি পৈতৃক সম্পত্তি ভাগের সময় উর্বর ধানি জমির বদলে পুকুরটাকে নিজস্ব মালিকানায় রেখেছি। পুকুরটা সংস্কারের সময় পাকা ঘাট এবং পাড়ের নারিকেল গাছতলায় বেঞ্চি বানানোর কথা ভেবেছি। জমিদারির আয়-উন্নতি দেখলে করব অবশ্যই। আপাতত প্লাস্টিকের চেয়ার পেতে নিজ পুকুরপাড়ে বসে অবসর সময় কাটাই।

জমিদারদের নানারকম শিকারের নেশা থাকে। আশপাশে বন থাকলে বন্দুক নিয়ে হয়তো শিকারেও যেতাম। কিন্তু শৈশবে গাঁয়ে যেটুকু জায়জঙ্গল দেখেছি, এখন তার স্মৃতি-নিশানাও চোখে পড়ে না আর। মরা নদীটাতেও আসে না বিদেশি পাখির ঝাঁক। বাল্যকালে গাঁয়ের জেলে-চাষিদের মতো মাছ ধরার নেশা ছিল জমিদারের বাচ্চাটির। সেই নেশা চরিতার্থ করার জন্য এখন নিজের পুকুরের বাঁধা মাছ ধরতে ছিপ ফেলি। পানিতে ভাসমান বড়শির শলাটা নড়াচড়া করলে পানির তলে মাছদের খেলা দেখি। চাড়ে ঠোকর দিয়ে ফাতনা পানিতে ডুবিয়ে ফেললে হাতের টানে বড়শিগাঁথা হয়ে কেউ ওপরে উঠে এলে বড় আনন্দ হয়। একা মানুষ আমি, খাওয়ার জন্য পছন্দমতো একটা রুই, কাতলা কি বড় সাইজের সরপুঁটি হলেই চলে যায়। অনেক সময় তাই পোনামাছ তুলেও আরো বড় হওয়ার জন্য দোয়া করে তাদের ছেড়ে দিই।

জমিদারের মাছ শিকার দেখার জন্য পাড়াপড়শি অনেকেই পুকুরপাড়ে আসে। মাছ ও চাষাবাদ বিষয়ক কথাবার্তা বলে সঙ্গ দেয়। পুকুরে সবচেয়ে বেশি আসে উমেদ আলী ও তার পরিবারের ছোট-বড় সদস্যরা। কারণ আমার অবর্তমানে উমেদ আলী ও তার পরিবারই আগলে রেখেছিল পুকুরটা। কৈশোরে উমেদ এবং তার পিতাও ছিল আমাদের বাড়ির বাঁধা চাকর। নদীভাঙা নিঃস্ব মানুষ, পরের ক্ষেতে কামলা খাটা ছাড়া বাঁচার কোনো পথ ছিল না।

কৃষিকর্মে উমেদের নিষ্ঠা দেখে আমার মরহুম পিতাই তাকে নিজস্ব ঘর করার জন্য দুই শতক জমি দিয়েছে, সংসার করার জন্য বিয়েও করিয়েছে। কিন্তু এসব হচ্ছে ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগের ঘটনা। উমেদ এখন স্বাধীন ক্ষেতমজুর। পৈতৃক সম্পত্তি শরিকদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা হলে আমার ভাগের পুকুর-জমি সব উমেদকেই চাষাবাদ করতে দিয়েছি আমি। নিজের ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে রেখে ফসলের যে-ভাগ পাইনি, উমেদকে দায়িত্ব দেওয়ার পর তার চেয়ে বেশি পেয়েছি। ফলে তার প্রতি আস্থাও বেড়েছে আমার। শহর ছেড়ে গ্রামে স্থায়ী হওয়ায় উমেদ ও তার পরিবারই খুশি হয়েছে বেশি। আমার ঘরসংসারের কাজ নিয়মিত ওরাই সব করে দেয়, মনিবকে সেবা করতে তৎপর থাকে উমেদের গোটা পরিবার। কিন্তু উমেদের ছোট ছেলে ছক্কা একদিন পুকুরে আমার মাছ-শিকারে তার আপত্তি জানিয়ে বাপের সামনে বলে, ‘ও নানা, নিত্যিদিনে হামার দিঘির মাছ ধরেন কেন? এ-দিঘি হামরা তোমার কাছে আধি নিছি, মাছ বেচে দিয়া টাকা পামো।’

নিজের সামান্য জমিদারির নায়েব-গোমস্তা-নফর-প্রজা কিংবা ম্যানেজার-কেয়ারটেকার-বর্গাদার যাই বলা হোক – উমেদ আলীই আমার সব। আমার অবর্তমানে মাছচাষ কি ধানচাষে পুরো পরিবারকে খাটিয়েছে বলেই হয়তো ছক্কার এরকম অধিকার বোধ জাগাটা স্বাভাবিক। আমি কিছু মনে করি না, ঠাট্টা করে বলি, ‘তোর দিঘিতে মাছ পাইলে তোকেও এলা ভাগ দিম।’

কিন্তু উমেদ আলী ছেলেকে শাসন করতে তেড়ে আসে।

‘হারামজাদা, স্কুল যায়া খালি বেয়াদবি শিখতেছিস! তোর চৌদ্দগোষ্ঠী মামাদের খায়া মানুষ হইছে, তার মুখের ওপর কথা বলিস। তোর নানা মাছ ধরতে আসলে চুপচাপ বসি থাকবি, মাছের আদার বানায় দিবি, আর যখন যেটা হুকুম দেয়, পালন করবি।’

ছক্কার কথায় আমার মালিকানাবোধ মোটেও আহত হয়নি। বরং খুশি হয়ে বলি, ‘তুই আর তোর পরিবার এসব দেখেশুনে রেখেছিলি বলেই তো আজ পুকুরে ছিপ ফেলে মাছ ধরছি। এক কাজ কর, নতুন পোনা কিনে ছেড়ে দে, মাছের খাবারও কিনতে হবে।’

‘নতুন মাছ ছাড়ার আগে মাছ তুলে বেচতে হবে মামা। মাছ বড় হইলেই হিংসুক মানুষের চোখে পড়ে বেশি।’

জমিদারসুলভ হুকুম দিই, ‘এখন আমার টাকার দরকার নেই। আজ পর্যন্ত দু-তিন কেজি ওজনের রুই-কাতলা তুলতে পারলাম না একটাও। মাছকে খাবার দিয়ে আমি দিনে-রাতে পাহারা দিয়ে রাখতে পারব, তুই জমির আবাদ বাড়ানো যায় কীভাবে দেখ।’

‘আগে পুবপাড়ার রাস্তার ধারের জমিখানের সদগতি করেন মামা। আমি অনেক চেষ্টা করেও ওটাতে কিছু করতে পারি নাই, এবার দেখেন আপনি কী করা যায়।’

পাকা রাস্তার ধারে পুবপাড়ায় আমার একবিঘা জমি দীর্ঘদিন ধরে অনাবাদি পড়ে আছে। উমেদের মতো অভিজ্ঞ চাষি এটার বন্ধ্যত্ব ঘোচাতে পারিনি। অন্যত্র বর্গা দিয়েও কাজ হয়নি। জমিটা ঘেঁষে যেসব গেরস্ত-চাষির ঘরবাড়ি, তারাই ইচ্ছেমতো ব্যবহার করছে অনুপস্থিত মালিকের জমিটা। কেউ ফসল ফলিয়ে মাগনা খেলেও জমির মর্যাদা থাকত। শুধু গরুছাগল-হাঁসমুরগির চারণভূমি হলেও বলার কিছু ছিল না, কিন্তু পড়শিদের নানারকম অপব্যবহারে জমিটা আবর্জনার ভাগাড় ও এঁদো ডোবায় পরিণত হয়েছে। শুকনা মৌসুমে অবশ্য ধান, খড়বিচালি ও ভেজা কাপড় শুকায় অনেকে। গোবরের ঘুঁটে দেয় কেউবা। আরো যে কতরকম কাজে এবং অকাজেও জমিখানা ব্যবহার করে পুবপাড়ার মানুষ। নিজস্ব উঠান-জ্ঞানে এক বাড়ির বউকে পিঁড়ায় বসে চুলে তেল দিতেও দেখেছি। মাটির প্রয়োজন হলে নির্দ্বিধায় অনাবাদি জমিটা খুঁড়েই মাটি নেয় সবাই। ফলে দুটি গর্ত তৈরি হয়েছে। রাস্তায় ওঠার জন্য জমির ওপর দিয়ে শর্টকাট হাঁটে জমিপাড়ের বাসিন্দারা। গ্রামের চ্যাংড়ার দল অন্য জবরদখলকারীদের হঠিয়ে দিয়ে জমিটাকে খেলাধুলার মাঠ বানায়। সারাবছর শুকনো থাকলে ভুঁইখানা হয়তো তাদের স্থায়ী খেলার মাঠ হয়ে যেত। কিন্তু  ঘরগেরস্তালির ব্যবহৃত ময়লা পানির সঙ্গে বৃষ্টির পানি জমতে শুরু করলে জলমগ্ন হয়ে পড়ে পুরো ভুঁই। পানি বেরিয়ে যাওয়ার পথ নেই। ফলে টানা কয়েক মাসে এঁদো ডোবা হয়ে থাকে। গাঁয়ের চ্যাংড়াদের বদলে পড়শি বাড়ির হাঁসগুলো সাঁতার কাটে এ-সময়, ব্যাঙও লাফায়।

নানারকম অপব্যবহার সত্ত্বেও জমিসংলগ্ন পাকা রাস্তা ও বিদ্যুতের খুঁটি দাম বাড়িয়েছে জমিটার। চোখেও পড়ে সবার। গ্রামে আসার আগেই একাধিক ফোন পেয়েছিলাম আগ্রহী ক্রেতাদের কাছ থেকে। শক্তভাবে ‘না’ করে দিয়েছি সবাইকে গ্রামে এসে জমিখানাকে কাজে লাগাব বলেই।

পতিত জমিখানার দিকে তাকালে বাউল গান কানে বাজে আমার : হায়রে মানব জমিন রইল পতিত, আবাদ করলে ফলত সোনা। বালক বয়সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে এ-জমিতে পিতার লাগানো কালিজিরা কি অগ্নিমধু ধানের সুবাস পেয়েছি। মনে পড়ে, সরষেক্ষেত হয়ে জমিখানা অসংখ্য হলুদ ফোটালে একদিন মৌমাছিদের নাচ-গান দেখে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলাম যে, মৌমাছির হুল খেয়ে হুঁশ ফিরেছিল। যন্ত্রণায় কাঁদতেও শুরু করেছিলাম। এখন পাকা রাস্তা থেকে স্মৃতিবিজড়িত জমিটার দিকে তাকালে নাকে লাগে আবর্জনার দুর্গন্ধ, মনে জাগে জমিদার হিসেবে নিজের ক্ষুদ্রতা ও বিচ্ছিন্নতা বোধ। অন্যদিকে গ্রামের রূপান্তর ও উন্নতিটাও টের পাই নিজের বন্ধ্যা জমিখানা দেখতে এলে।

আগে জমির ধারে ছিল দুটিমাত্র খড়ো ঘরের গরিব গেরস্তবাড়ি। এখন ঘরবাড়ির সংখ্যা বেড়েছে এবং সব বাড়িতেই টিনের চাল। একটি বাড়িতে পাকাঘর এবং তার পাকা পায়খানা হয়েছে আমার জমির ওপরেই। গ্রামেও অপরিকল্পিত জনবসতি ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি আমার ফাঁকা জমিতে চাপ বাড়ায়নি শুধু, জবরদখলের ঘটনাও ঘটেছে নিঃসন্দেহে। অন্যদিকে রাস্তার এ-পাশের আবাদি জমিগুলোতে ধান, পাট, ভুট্টা, আলুসহ নানারকম হাইব্রিড ফসলের চাষবাস। আমার জমির সীমানা ঘেঁষে পড়শিরা যেসব গাছপালা লাগিয়েছে, সেগুলোর বাড়বাড়ন্ত চেহারা ভুঁইখানার বন্ধ্যত্ব প্রকট করে তুলেছে। গ্রামবাসী অপেক্ষা করছিল রাস্তার ধারের মূল্যবান জমি পুনরুদ্ধার ও সদ্ব্যবহারে আমি কী উদ্যোগ নিই দেখার জন্য।

জমির সীমানা বুঝে নিতে আমি একদিন চেয়ারম্যান, মেম্বার ও সরকারি আমিনকে ডেকে এনে সালিশ বসাই। পুবপাড়ার বাসিন্দাদের সঙ্গে যুদ্ধ শুরুর মতো উত্তেজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। না ডাকতেও জড়ো হয় গ্রামবাসী অনেকেই। আমিনের মাপ, সরকারি কাগজপত্র ও সালিশের গণ্যমান্যরাও সবাই আমার পক্ষে। প্রমাণ হয় জমির উত্তরে আমির ভিটা বেঁধে যে-পাকা বাড়ি করেছে, তাতে আমার প্রায় দেড় শতাংশ জমি দখল করেছে সে। দখলকৃত জমিতে নিজবাড়ির পায়খানা ও বেশকিছু কাঠগাছ লাগিয়েছে। অন্য একজন জমির সীমানায় বাঁশঝাড় করেছে, তার অনিচ্ছাসত্ত্বেও বেশকিছু বাঁশ আমার জমিতেও শিকড় ছড়িয়েছে। সালিশে জবরদখলকারী আমির অপরাধ স্বীকার করে কাকুতি-মিনতি করে, ‘চাচা বাহে, অন্যায় হয়েছে। আপনি যখনই কিছু করার জন্য জমিতে হাত দেবেন, আপনার মাটিতে লাগানো গাছপালা আমরা অবশ্যই কেটে ফেলব, পায়খানাও সরাব। আপনার জমি অবশ্যই বুঝিয়ে দেব।’

উমেদ আলী আমিনের মাপ অনুযায়ী জমির চার কোনায় কংক্রিটের পিলার বসিয়ে দেয়। জমিখানা কীভাবে কাজে লাগানো যায় ভাবছি। পরিচিত গ্রামবাসী নানারকম পরামর্শ দেয়। এ-জমিতে আবাদ মোটেও হবে না। চারদিকে সীমানা পাঁচিল তুলে মাটি ভরাট করান আগে। একটা রাইস মিল অথবা কাঠচেরাই মিল দেন। ভালো চলবে। কেউবা পরামর্শ দেয়, পোলট্রি ফার্ম দেন একটা। মুরগির বিষ্ঠা পুকুরে মাছের আদার হিসেবে কাজে লাগবে। কারো মতে, মার্কেট করে দোকান ভাড়া দিলেও দশ বিঘা জমির চেয়েও বেশি আয় হবে। লোকেরা হয়তো ভাবে, সারাজীবন চাকরি করে ব্যাংকে টাকার পাহাড় জমিয়েছি। তার ওপরে ছেলেমেয়েরা ভালো চাকরি করে, গাঁয়ে আমার মতো জমিদার উন্নতি না করলে আর কে করবে?

আমার জমি জবরদখলকারী আমির একদিন বাড়িতে নতুন প্রস্তাব নিয়ে আসে। ‘চাচা বাহে, আমি বলি কি, পুরনো বাড়িতে ভাইবেরাদারদের সঙ্গে কাজিয়া-কেচালের মধ্যে থাকতে যাবেন কেন? জমিটায় দেখার মতো একটা বাড়ি করেন। রাস্তা-হাঁটা লোকজন সবাই ঘাড় কাত করে দেখবে। ছেলেমেয়েরাও ছুটি কাটাতে

বাপ-দাদার ভিটায় বেড়াতে আসলে কয়টা দিন সুখে-শান্তিতে থাকতে পারবে। আর ভিটা করার জন্য বাইরের মাটি লাগবে না, অর্ধেক জমিতে ছোট পুকুর খোঁড়েন একটা। পুকুরের মাটিতে জমি ভরবে, আর ছোট পুকুরে পোনা চাষ করে বড় পুকুরে ছাড়বেন। আপনি শুধু ডিসিশন দেন, সব ঝক্কিঝামেলার কাম আমি করে দেব।’

বুঝতে দেরি হয় না, পতিত জমিটায় পুঁজি বিনিয়োগ করলে সহযোগিতা করে নগদ অর্থ রোজগার বা অন্য কোনো গোপন স্বার্থ হাসিলের ধান্ধা আমিরেরও। তবু সরাসরি জানতে চাই, ‘আমি নতুন বাড়ি-পুকুর করলে তোমার কী লাভ?’

‘আপনার মতো শিক্ষিত মানুষকে পড়শি হিসেবে পাব, মিলেমিশে থাকব, সেটাই হামার বড় লাভ চাচা। ওখানে বাড়ি করলে নানাভাবে আপনার সেবা করতে পারব।’

আমি সাফ জানিয়ে দিই, পুরনো বাড়িভিটা ছাড়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই আমার। আর পুঁজিপাট্টা নেই বলেই পৈতৃক সম্পত্তির ওপর নির্ভর করে শেষজীবনটা কোনোমতে কাটানোর জন্য গ্রামে এসেছি।

আমিরের মতো ধান্ধাবাজদের এড়িয়ে চললেও গ্রামবাসীর সঙ্গে মিলেমিশে থাকার ঐতিহ্য অস্বীকার করতে পারি না। সেই কৌম জীবনযাত্রার নিয়ম মেনে, নিকট-আত্মীয়ের মতো সবাই পরস্পরকে একটা না একটা সম্পর্ক ধরে ডাকে গ্রাম-সমাজে। উমেদ আলীর যেমন মামা, তেমনি আমিরের কী সূত্রে চাচা হয়েছি ঠিক জানি না। যারা চাচা, মামা কি ভাই ডাকে, তাদের মধ্যে কে আমাকে কাছে পেয়ে প্রকৃতই খুশি হয়, কার অন্তরে হিংসার বিষ, বোঝার চেষ্টা করি না। আমি আমার মতো থাকার চেষ্টা করি।

একদিন রাস্তা-হাঁটার সময় আমির চা খাওয়াতে জোর করে আমাকে বাড়িতে ধরে নিয়ে যায়। তার মতলবটা বোঝার কৌতূহল নিয়ে যাই। আমিরের বাপ আমার মরহুম পিতাকে নিজ বাপের চেয়েও বেশি ভক্তি করত এবং আমির বাল্যকালে নাতি হিসেবে আমার পিতার যথেষ্ট স্নেহ, এমনকি একবার কানমলাও খেয়েছে। এসব গল্প বলে আমির সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা বোঝাতে চায় হয়তো। যুবক বয়সে আমির দেড় লাখ টাকা খরচ করে কুয়েত গিয়েছিল। দশ বছর বিদেশ খেটে যে-টাকা এনেছে, সেই টাকায় পাকা বাড়ি আর একদোন জমি করতে পেরেছে মাত্র। পৈতৃক জমির ভাগ পেয়েছে মোটে দুই বিঘা। সামান্য জমিজমা চাষ করে সংসার চলে না বলে টুকটাক ব্যবসা করে।

বাড়িতে নিয়ে আমির আমাকে বাজার থেকে কিনে আনা মিষ্টি-শিঙাড়া খেতে দেয়। ডায়াবেটিসের দোহাই দিয়ে মিষ্টি এড়ালেও তার কিশোরী কন্যার আনা ডিমপোচের একটু এবং মিষ্টি চা খেতে হয়। মেয়েটি স্থানীয় হাইস্কুলে ক্লাস এইটে পড়ে। আমাকে ঠাট্টা করে বলে, ‘দাদা গ্রামে একা আছেন। ছেলেমেয়েরা বিদেশে, অসুখ-বিসুখ হইলে কে আপনার দেখাশোনা করবে? তারচেয়ে দেখি-শুনি একটা নতুন দাদি আনেন।’

‘বিয়ের জন্য এই বয়সে তোর মতো পাত্রী পাব কোথায় রে?’ ঠাট্টার জবাবে এরকম মশকরা করতে গিয়েও থেমে যাই। পরিবারটিকে কোনোভাবে প্রশ্রয় দিতে চাই না। আমার গাম্ভীর্য অগ্রাহ্য করে আমিরের স্ত্রী বলে, ‘চাচামিয়া, হামার আতিয়া মাঝেমধ্যে বাড়িতে গিয়া আপনার টুকটাক কাজ করে দিয়ে আসবে। রান্নাবাড়ির কাম হামার আতিয়া ভালোই পারে।’

‘না, না, তোমাদের কারো কোনো সাহায্য আর সেবাযতœ আমার দরকার হবে না। বাড়িতে ভাইয়ের পরিবার আছে, তাছাড়া উমেদ আলীর বউ-বাচ্চারাই রোজ আমার ঘরকান্নার কাজ সব করে দিয়ে যায়। কোনো অসুবিধা হয় না।’

‘গ্রামের সবাই জানে, উমেদ আলীর চৌদ্দগোষ্ঠী আপনাদেরটা খায়া-পরিয়া মানুষ হইছে। কিছুদিন আগে কামলা খাটিয়া দুইবেলা পেটের ভাত জোগাইতে পারে নাই। আর এখন সে আমার মতো ছোটখাটো গেরস্তকেও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। কথায় কয় না চাচা, কাঙালের ছাওয়া কম্বলে বইসে গোয়া কুটকুটায় মনে মনে হাসে। আপনার সম্পত্তি ভোগদখলের রাইট পায়া এত বাড়ছে হারামজাদা, কয়দিন বাদে সে আপনাকেও হুকুম দিয়া ওঠবস করাইবে।’

‘কী করব বলো, নিজে চাষাবাদ বুঝি না, উমেদের ওপর নির্ভর না করে উপায় কী?’

আমির সরাসরি প্রস্তাব দেয়, ‘আমাকে দায়িত্ব দেন চাচা। উমেদকে পুকুর ও জমি দিয়া আপনি যে-লাভ পাইছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি লাভ আমি আপনাকে দেব। আর এই পতিত ভুঁইয়ে আপনার যখন কিছু করার ইচ্ছে নাই, এই জমি বেচে দিয়া দোলায় ডবল আবাদি জমি আপনাকে আমি কিনে দেব। জমির ধান আর পুকুরের মাছ বেচে যা পাবেন, তা দিয়া গ্রামেও রাজার হালে চলবেন চাচা।’

আমির আমার পুরো জমিটাই দখলের মতলব এঁটেছে ভেবে সতর্ক হই। তবু সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকার নীতি মান্য করে বলি, ‘দেখি তোমার প্রস্তাবটা ভেবে দেখব। আচ্ছা, পাশের বাড়িগুলোই তো ভালো চিনি না, কোনটা কার বাড়ি চলো তো চেনায় দাও আমাকে।’

বিদায়ের আগে আমিরের কিশোরী কন্যার দিকেও তাকাই  আবার, ‘চলি রে আলেয়া না আতিয়া, আসব আবার, প্রয়োজন হইলে ডাকব তোকে।’

গ্রামে আসার পরও উমেদ আলীর বিকল্প খোঁজার কথা ভাবিনি। উমেদ অনুপস্থিত মালিককে জমিদারের মর্যাদা দিয়ে যেটুকু খাজনা দিয়েছে, তাতে নিজের ঠকা ও উমেদের সততা নিয়ে সন্দেহ জেগেছিল অবশ্যই। কারণ চাকরিজীবনে দেখেছি, শহরের অধিকাংশ সরকারি অফিসেই পিয়ন থেকে শীর্ষ কর্তা সুযোগ পেলেই দুর্নীতি করে। ব্যবসায়ীরা নিজের মুনাফা বাড়াতে খাদ্যে বিষ মেশাতেও দ্বিধা করে না। এমন এক দুর্নীতিগ্রস্ত দেশে জাতচাষি উমেদ আমার জমিতে দিনে-রাতে শ্রম দিয়ে মালিককে ঠকিয়ে যদি নিজের লাভের পরিমাণটা বাড়াতে চায়, খুব একটা অনৈতিক কাজ হয় কি? তরুণ বয়সে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় আস্থা ছিল। লাঙল যার জমি তার হওয়া উচিত মনে করতাম। দুনিয়াজুড়ে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ব্যর্থ হওয়ার পরও, অন্তত একজন ভূমি-শ্রমিক আমার ভূসম্পত্তি ব্যবহার করে ভালো আছে ভেবে এক ধরনের তৃপ্তি পেতাম।

কিন্তু গ্রামে এসে দেখছি সামান্য ক্ষেতমজুর হয়েও গাঁয়ের ক্ষুদ্র ও মাঝারি গেরস্তকেও এখন টেক্কা দিচ্ছে উমেদ। ঘরটা পাকা করেছে। দশ কেজি দুধেল বিদেশি গাই কিনেছে একটা, সেই গাভীর ঘাস আমার পুকুরপাড় থেকেই আসে। পুকুরে মাছ চাষ ছাড়াও পাড়ে নানারকম সবজি আবাদ করে নিজে খায়, বাজারেও বেচে। চাষাবাদের জন্য এখন নিজের হালগরু প্রয়োজন হয় না, পুঁজি থাকলেই হলো। আমার দুই বিঘা ছাড়াও অন্যদের দু-চার বিঘা জমি বর্গায় চাষাবাদ করার মতো পুঁজি হয়েছে উমেদের। দিন আনা-দিন খাওয়া কামলা এখন গেরস্তের মতো আবাদি ধানের ভাত খায়। তার ওপর কামলা খাটার পুরনো অভ্যাসটাও বজায় রেখেছে পুরোদমে। কারণ কামলাদের দাম বেড়েছে, পরের ক্ষেতে আট ঘণ্টা খাটলেই নগদে তিনশো টাকা হাতে আসে। ধান কাটামাড়াই মৌসুমে চুক্তির কামে একজন কামলা রোজ হাজার টাকাও আয় করে। তবে গ্রামবাসী সবারই সন্দেহ, নিজের কপাল ফেরানোর সোনার প্রদীপ পেয়েছে উমেদ আমার পুকুর ও জমি দেখাশোনার সুযোগটি পেয়ে। এ-সন্দেহ বোধহয় উমেদের নিজেরও, আমি ফিরে আসার পরই তাই প্রস্তাব দিয়েছে, ‘মামা, এতদিন ঢাকায় বসিয়া ফোনে হুকুম দিছেন। এবার পুকুরপাড়ে বসিয়া হুকুম দেবেন। লাভ-লোকসান নগদে বুঝে নেবেন, তা হইলে অন্তত বুঝতে পারবেন কৃষি কাম করিয়া টাকা করতে কতরকম চোদন খাইতে হয়।’

ওসব নোংরা জিনিস খাওয়ার শখ ও সময় নেই বলে উমেদকে আশ^স্ত করি, ‘আমি পুকুরে বসে ছিপ ফেলে শুধু মাছ ধরব, যা করার সব তুই করবি। এখন চিন্তা করে বল, রাস্তার ধারার বাঁজা ভুঁইখান কীভাবে মানুষ করা যায়। গ্রামের লোকজন যেসব বুদ্ধি দেয়, তাতে মনে হয় সবারই আমার টাকা খসানোর মতলব। সবার ধারণা, কোটি টাকা পুঁজি নিয়া গ্রামে ফিরেছি, কিন্তু তুই তো তোর জমিদারের আসল মুরোদ ভালোই জানিস।’

উমেদ আলী আসলে তার প্রস্তাব ভেবেচিন্তে রেখেছিল। জানায়, ‘বেশি পুঁজি না খাটালেও খরচ কিছু হবেই মামা। বাউন্ডারি ওয়াল না দেন, অন্তত বাঁশের বেড়া দিয়া জমিখান পজেশনে আনা দরকার। ওই জমিতে ধান কি তরিতরকারি কোনোটাই হবে না। বেড়া দিয়া, কিছুটা মাটি কাটায় গাছের বাগান করেন মামা।’

গাছ বলতে শৈশবের অতিচেনা আম-জাম, লিচু-কাঁঠালের কথাই মনে পড়ে। বন্ধ্যা জমিতে এরকম এক ফলবাগান কল্পনা করে গাঁয়ের দুষ্টু ছেলেদের মৌমাছির মতো উড়তে দেখে বলি, ‘রাস্তার ধারে ফলবাগান করে লাভ করা যাবে?’ ফলবাগান নয়, উমেদ আলী আসলে মেহগনি, বেলজিয়াম ও আকাশমণি গাছের বাগান করার কথা ভাবছে। উৎসাহ দিতে উমেদ আমার জমি দখল করে লাগানো আমিরের বেলজিয়াম গাছ কয়টি দেখিয়ে বলে, ‘বেচলে অন্তত দশ হাজার টাকা হবে।’ আমাকে মোবাইল ফোনের ক্যালকুলেটর বের করতে বলে হিসাব দেয়, ‘তিন হাত অন্তত পাঁচশো গাছ লাগানো যাবে। গাছের চারা মাটিতে শিকড় ছাড়লে কোনো কামলা খরচ হবে না। পাঁচ-সাত বছর প্রতিটি গাছ যদি পাঁচ হাজার করেও বেচেন, কত হবে? গাছ বেচেই ইনশাল্লাহ এ-জমিতে মিল-কারখানা করতে পারবেন।’

লাভ-ক্ষতির হিসাবের মধ্যে আমি ভাবি, নিজে যদি বেঁচে নাও থাকি, উত্তরাধিকারীরা গাছের বাগান থেকে সহজেই কিছু নগদ টাকার মালিক হতে পারবে। উমেদের প্রস্তাবটা সমর্থন করে গাঁয়ের অনেকেই। আমি বর্ষার পানি জমার আগেই গাছ লাগানোর হুকুম দিই।

অনেক বছর পর পতিত ভুঁইখানায় শুরু হয় বড় ধরনের কর্মযজ্ঞ। উমেদ আরো নয়জন সহকর্মী কামলা নিয়ে ভুঁইতে বসেই বাঁশ সাইজ করে। দা চোটানোর ও বাঁশ ফাটানোর আওয়াজে মুখর হয়ে ওঠে ভুঁইখানা। আমাদের বাড়িভিটার বাঁশঝাড়েও মেলা বাঁশ। কিন্তু ভাগাভাগিতে বাঁশঝাড় ও পুরনো বাগানের মালিক হয়েছে ছোটভাই। যেহেতু পুকুর আমি মাছ চাষের জন্য তাকে দিইনি, একটি বাঁশও সে দেবে না। বাঁশ কিনতেই চলে যায় সাড়ে ছয় হাজার টাকা। আমার জমির ওপরেও অনিচ্ছাতেও যার বাঁশঝাড় বেড়ে উঠেছে, মাপ অনুযায়ী জমি পুনর্দখলের জন্য নিজের জমির বাঁশও কিনে নিই তার কাছ থেকে। আমিরের বড় বেলজিয়াম গাছগুলো কেনার প্রস্তাব দিলে সে বলে, ‘টাকা দিতে হবে না চাচা, আরো বড় হোক, আপনার জমির গাছ আপনি কেটে নেবেন।’ আমিও ঠাট্টা করে বলি, ‘আমাকে দিতে হবে না, ও-কয়টা গাছ বেচে তোমার মেয়ের বিয়েতে খরচ করব।’

তিনদিনের মধ্যেই পুরো জমি বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা হয়ে যায়। এরপর কামলারা কোদাল-ডালি নিয়ে মাটি কাটার কাজ করে। ভুঁইয়ের গর্তের মাটি দিয়ে গাছ লাগানোর জায়গাটা উঁচু করা হয় খানিকটা। নার্সারি ঘুরে উমেদ চারটা ভ্যান বোঝাই করে নিয়ে আসে গাছের কচি চারা। কামলারা গাছের চারা রোপণের পর প্রতি গাছের সঙ্গে বাঁশের কাঠির ঠেক দেয়। সব মিলিয়ে ব্যয় হয় পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা, তা হোক। পতিত জমির চেহারা বদল এবং অবশেষে নিজের বাগান দেখে মুগ্ধ হই আমি।

গ্রামে এসে এই প্রথম পরিবেশ-উন্নয়ন ও উৎপাদনশীল একটা কাজ করার আনন্দ নিয়ে সকাল-বিকেল বাগানের পাশ দিয়েও পায়চারি করি। আর সময় কাটাতে যথারীতি পুকুরে ছিপ ফেলে বসে থাকি। দাদার আমলের একটা পিতলের হুঁকা পেয়েছিলাম বাড়িতে। সেই হুঁকাটায় নতুন পাইপও লাগিয়েছি। গাঁয়ের লোকসমাজে

হুঁকো-ডাব্বার চল উঠে গেছে, বিড়ি-সিগারেট টানে সবাই। কিন্তু আমি শখ করে পুকুরপাড়ে মাছ ধরতে বসে পুরনো আমলের হুঁকোয় তামাক খাই। উমেদের ছেলে ছক্কাই সব আয়োজন করে দেয়। বাপের মতোই করিতকর্মা ছেলে। বাগান করার সময় কোত্থেকে একটা শিউলি ফুলের চারা এনে আমার ঘরের জানালার নিচে লাগিয়েছে। ওর বাপকে কাজ করালেই টাকা দিতে হয়, কিন্তু ছক্কাকে পয়সা দিতে হয় না। মাঝেমধ্যে চকোলেট-কটকটি কিনে দিলেই মহাখুশি। আমার হুঁকা সাজিয়ে দিতেও সে বেজায় উৎসাহী। হুঁকোর গুড়গুড় ডাক নাকি তার খুবই ভালো লাগে, সেই ডাক শোনার জন্য অনিচ্ছাতেও দু-একবার  ধোঁয়া টেনেও দেখেছে সে।

একদিন ছক্কাকে নিয়ে মাছ শিকার ও হুঁকো টানার ডবল নেশায় পুকুরপাড়ে বুঁদ হয়ে বসে থাকার সময় এক পড়শি এসে খবরটা দেয়, ‘আপনার বাগানে ছাগল ঢুকে সব খেয়ে ফেলেছে জ্যাঠা। যান, দেখে আসেন।’

হুঁকো-ছিপ ফেলে আমি ছক্কাকে নিয়ে বাগানের দিকে ছুটতে থাকি। সবে গাছের চারাগুলো জমির রস টানতে শুরু করেছে, কচি পাতাও ছেড়েছে অনেকেই। যে-চারাগুলো বাঁচেনি, উমেদকে দিয়ে সেগুলোর স্থলে নতুন গাছ লাগিয়েছি। বাগানে পৌঁছে দেখি, ক্ষেতের ভেতরে ছোট-বড় মিলে পাঁচ-ছয়টি ছাগল। ঘাস তো নেই, কচি গাছগুলোর পাতা-ডাল-কা- খাওয়ার প্রতিযোগিতায় মেতেছে। আমার আগে ছক্কাই বাগানে নেমে ছাগলের পিছে দৌড়ায়। একটাকে ধরতে চায় তো অন্যরা সরে গিয়ে আরো ক্ষিপ্রতার সঙ্গে অন্য গাছগুলোর পাতা খায়। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক গাছ সাবাড় করে ফেলেছে।

আমি নিজে বেড়া ডিঙিয়ে ভেতরে ঢুকতে পারি না, কিন্তু নতুন বেড়া ভাঙল কীভাবে? পুবপাড়ার মানুষগুলোই বোধহয় জমির ওপর দিয়ে হাঁটাচলার প্রয়োজনে বেড়া ভেঙে ঢোকার পথ করেছে, সেই পথে ঢোকা ছাগলগুলোও নিশ্চয় এ-পাড়ার গেরস্তচাষিদের। আমিও ক্ষেতে ঢুকে ছাগল দাবড়াই। ছক্কা একটা ছোট ছাগলের বাচ্চা ধরেছে এর মধ্যে, আমাকে সেটা ধরতে দিয়ে বড়গুলোর পেছনে সে ছুটতে থাকে। আমি ছাগলের বাচ্চাকে বুকে চেপে ধরলে সে ম্যা ম্যা করে চেঁচায়। আমিও ছাগশিশুর চেয়েও জোরালো কণ্ঠে চেঁচামেচি করতে থাকি, ‘কার ছাগল এগুলো? কে আমার বাগান ধ্বংস করতে চায়, হ্যাঁ? কার এত বড় স্পর্ধা, হ্যাঁ?’

কা- দেখতে রাস্তার ধারে কয়েকজন পথচারী দাঁড়ায়। হাসিমুখে সহানুভূতি দেখায় একজন, ‘আহা রে গাছগুলা খাইল, গাছের ছালও খায় শালার ছাগল!’ পড়শিদের মধ্যে আমিরের বউ ও মেয়ে বেরিয়ে আসে। আমিরের বউ ঝগড়াটে কণ্ঠে চেঁচায়, ‘হায় আল্লাহ্ কে বেড়াখান ভাঙল!’ বড় খাসি দুটি তার, কিন্তু এই খাসি দুটি এত ভদ্র যে বাড়ির খুলি ছেড়ে আর কোথাও যায় না কখনো, কিন্তু আজ কোন ছাগলের বাচ্চা তাদেরকেও ফুসলে চাচার বাগানে এনেছে?

বাগানে হইচই পড়ায় ছাগলের মালিকরা এসেই তাদের ছাগল বের করে দেয়। ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে, আমি ছক্কাকে জরুরি তার বাপকে ডেকে আনতে বলি। উমেদ কোথাও মাটি কাটার কাম করতে গিয়েছিল, কাজ ফেলেই ছুটে আসে বাগানে। ঘুরে দেখে, অন্তত দুশোটি চারা এমনভাবে খেয়েছে, এগুলোর ভবিষ্যৎ অন্ধকার। বেড়াখানা বাঁধাছাদা করে চলে যায় সে। আর আমি পুবপাড়ার বাড়ির বাসিন্দাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাতর কণ্ঠে নিজের ক্ষতিটা বোঝাই। অনুরোধ করি আর যেন বেড়া ভেঙে তারা ভেতরে না ঢোকে। বাগানটা হলে বিশুদ্ধ অক্সিজেন পাবে সবাই, তখন ভেতর দিয়ে যত খুশি যাতায়াত করো, মালিক আপত্তি করবে না।

ছাগল-মালিকদের অনুনয়-বিনয় অরণ্যে রোদন হয়ে আমার কষ্ট বাড়ায়। কারণ দুদিন পরই আবার বেড়া ভাঙে, আবারো ছাগল ঢোকে বাগানে। আরো কচি গাছ ধ্বংস হয়। বাগানে ঢুকে মনে হয়, কিছু গাছের চারা কেউ যেন নিজ হাতে সযতেœ ভেঙে দিয়েছে। পুবপাড়ার মানুষ তাদের গৃহপালিত জন্তু-জানোয়ার ছাড়াও গাঁয়ের বানর চ্যাংড়াদেরও সন্দেহ হয়। ওদের খেলার মাঠটা বন্ধ করেছি বলে একজন আমার কাছে আফসোসও করেছিল। আমি ছেলেদের আশ^াস দিই, গাছগুলো বড় হলে বেড়া থাকবে না, বাগানে লুকোচুরি খেলতে পারবে। এখন বাগান ধ্বংস করতে যে-ছাগলই ঢুকুক, ধরে দিতে পারলে পুরস্কার পাবে তোমরা।

উমেদ আলী বলে, ‘মানুষ শয়তানই যদি বেড়া ভাঙিয়া গরু-ছাগল ঢোকায়, তাহলে কীভাবে আমি রক্ষা করব বাগান? আমি সিওর মামা, আমির হারামজাদাই করাচ্ছে। নিজের মায়ের পেটের ভাইয়ের যে সর্বনাশ করেছে, আপনার ক্ষতি করতে পারলে সে খুশিতে বগল বাজাবে।’

আমি আবারো আমিরের বাড়িতে যাই। আমির আমাকে টেনে নিয়ে দড়ি দিয়ে বাঁধা তার খাসি দুটি দেখিয়ে দেয়। একদিন মাত্র বাগানে ঢোকার অপরাধে চিরদিনের জন্য গলায় দড়ি পরিয়েছে তাদের।

‘তোমার ছাগল ঢোকেনি, তাহলে কোন ছাগলে বেড়া ভেঙে আমার এমন সর্বনাশ করছে?’

আমির জবাব দেয়, ‘ছাগল-গরু কি আমি একলাই পুষি চাচা? চারপায়াগুলানের চাইতে দুই পায়া ছাগলের সংখ্যা বেশি। গ্রামে ছিলেন না চাচা, তাই জানেন না মানুষ আর মানুষ নাই বাহে! মায়ের পেটের ভাইয়ের মুখও দেখতে ইচ্ছে করে না।’

আমি পুবপাড়ার বাসিন্দাদের শোনাতে কণ্ঠে বজ্রহুংকার তোলার চেষ্টা করি, ‘জানমালের হেফাজত করার জন্য আইন আছে, সরকার আছে। আমার যারা ক্ষতি করছে, তাদের অবশ্যই আমি জেলে ঢোকাব, কী মনে করেছ তোমরা আমাকে?’

আমির বলে, ‘আপনি গ্রামের চারপায়া দুইপায়া সব ছাগলকে জেলে ঢোকান চাচা, আমি আছি আপনার সঙ্গে।’

জমিটা পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছে। সমস্যাটা নিয়ে আলাপের জন্য আমি চেয়ারম্যানের কাছে যাই। বাজারে, ইউনিয়ন পরিষদ অফিসের সামনের চায়ের দোকানে পেয়ে যাই তাকে। সঙ্গে হাইস্কুলের হেডমাস্টার এবং সম্মানিত এক হাজি। আমাকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে চেয়ারম্যান চায়ের অর্ডার দেয়।

আমি বাগান ধ্বংসের কথা জানালে চেয়ারম্যান উপদেশ দেয়, ‘চাষাড়ি কাজ আর ছাগল-খেদানো কি আপনার কাজ? ঢাকায় থেকে ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছেন, এখন গ্রামে থেকে সমাজসেবামূলক কিছু করেন ভাই। একা মানুষ, কিছু একটা নিয়ে থাকলে আপনার সময়টা ভালো কাটবে।’

হাজি সাহেব নিজের চাষাবাদের তিক্ত অভিজ্ঞতার গল্প শুনিয়ে প্রস্তাব দেয়, ‘কার জন্য বাগান করবেন সরকারের বেটা? তার চেয়ে ওই জমি বেচে হজে যান, গ্রামে আল্লাহ্র ঘরটা বড় করে দেন, তাতেই বরং বেশি লাভ হবে।’

হেডমাস্টার বলে, ‘আপনার পতিত জমিটা দেখেছি ভাই। ওই জমিতে একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুল খুললেও ভালো চলবে। এলাকায় ভালো স্কুলের অভাব। স্কুল করলে আপনার সমাজসেবা হবে, নামও হবে।’

এসব মানুষের সঙ্গে সময় কাটানোর চেয়ে গাছপালার সঙ্গে একা থাকাটাও শ্রেয় মনে হয়। তবু বিনয়ের সঙ্গে বলি, ‘সমাজসেবা-জনসেবা করার জন্য আপনারাই যথেষ্ট। আমি প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ, আমাকে গাছপালা নিয়েই থাকতে দেন।’

গাছ লাগানোর পর কল্পনায় বন্ধ্যা ভুঁইখানায় সবুজ বনানী বহুবার প্রত্যক্ষ করেছি। রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় নিজের বাগানের বাতাসও গায়ে অনুভব করেছি। গাছগুলো অনুগত প্রজার মতো বাতাসে মাথা দুলিয়ে আমাকে কুর্নিশ করেছে যেন। বাগানে ছিন্নভিন্ন বৃক্ষশিশুর কংকাল দেখে তাই জেদ চেপে যায় আমার। উমেদকে টাকা দিয়ে আবারো গাছের চারা কিনে আনতে বলি। নতুন করে গাছ লাগানো হয়। উমেদ আলীর মাথায় নতুন আইডিয়া আসে, ‘পুবপাড়ার সীমানা বরাবর জমিতে একটা জোল খুঁড়লে কেমন হয় মামা? জোলের মাটি দিয়ে জমির গর্ত ভরবে, গরু-ছাগল লাফিয়ে আসতে পারবে না।’

প্রস্তাবটা পছন্দ হয় আমার। ‘নতুন করে কামলা-খরচ হবে তো, হোক। পরিখা খোঁড়ার কাম শুরু করে দে তুই।’

বাগানে পরিখা কাটার কাজ শেষ হতে না হতেই শুরু হয় বৃষ্টি। বর্ষা মৌসুম শুরু হতে এখনো বেশ দেরি, কিন্তু তার আগেই আকাশ ভেঙে এত বৃষ্টি ঝরতে থাকে যে, তিনদিনেই পরিখা-বাগান পানিতে সয়লাব হয়ে যায়। কোনোরকমে মাথা জাগিয়ে কিছু বৃক্ষশিশু তাদের বিপন্ন অস্তিত্ব ঘোষণা করছে। মাটিতে শিকড় ছড়ানোর সময় পায়নি বলে মাটিছাড়া হয়ে পানিতে ভাসছে অনেকেই। উমেদ আলী কপাল চাপড়ে ঘোষণা করে, ‘আপনার কপালটাই খারাপ মামা। আমি ভয় পাইতেছি, এরকম বৃষ্টি হইতে থাকলে পাছে পুকুরটাও উছলে যায়। একটা মাছও থাকবে না পুকুরে।’

জলবায়ুর পরিবর্তন যে গোটা বিশে^র এখন বড় সমস্যা, সেটা এতদিন খবরের কাগজ পড়ে জেনেছি। সমুদ্রপৃষ্ঠ উঁচু হচ্ছে। দেশের এক-তৃতীয়াংশ জলমগ্ন হবে। উদ্বাস্তু হবে কোটি কোটি মানুষ। গ্রামে এসেও টের পাচ্ছি, চিরন্তন ঋতুবৈচিত্র্যের ছন্দ বদল হচ্ছে। গ্রীষ্মকালে কুয়াশা, শীতবোধ, আবার শীতকালে গরম। বর্ষা মৌসুমে খরা, আবার অসময়ে অতিবর্ষণ। ছাগল ও হিংসুক পাড়াপড়শিদের দমন করার জন্য নানারকম হম্বিতম্বি করেছি, কিন্তু এরকম প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জন্য কাকে দায়ী করব? হতাশ হয়ে ঘরে বসে থাকি।

শখের বাগান আবার এঁদো ডোবা হলে লোকজন সান্ত¡না দিতে গিয়ে আমার হতাশা বাড়ায়। মাটি ফেলে জমিখান আরো উঁচু করা দরকার ছিল। উমেদের বুদ্ধিমতো কাজ করা উচিত হয় নাই। কারণ কামলার দাম সে ঠিকই পাইছে, কিন্তু কত টাকা পানিতে ফেললেন আপনি?

পাঁচদিন পর বৃষ্টি থামে। মেঘ কেটে গিয়ে আকাশে রোদ ওঠার পর উমেদ এক সকালে নতুন দুঃসংবাদ নিয়ে ঘরে আসে।

‘ও মামা জলদি আসেন পুকুরে। বাগান খেয়ে হারামজাদারা এবার আপনার পুকুরেও বিষ দিছে। রাইতে গ্যাস টেবলেট ছুড়ে মারছে কেউ। বড়-ছোট মাছ লাশের মতো ভাসি উঠতেছে পুকুরে।’

উমেদের কণ্ঠে আমার সর্বনাশ ধ্বনিত হতে থাকলে পুকুরপাড়ে ছুটে যাই। একা আমি নই, অভিনব দৃশ্য দেখতে পাড়াপড়শিরাও ছুটে আসে। পানির তলের অদৃশ্য মাছ পুকুরে ভেসে উঠেছে। পুকুরজুড়ে অসংখ্য ছোট-বড় মাছের সাদা শরীর। এখনো প্রাণ আছে যেগুলোর শরীরে, সেগুলোও পানিতে শেষবারের মতো সাঁতার কাটার চেষ্টা করছে।

উমেদ জানায়, ‘মামা এক্ষুনি মাঝি ডাকায় পুকুরে জাল নামানো দরকার। মরাজেতা সব মাছ তুলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাজারে বেচতে হবে। দেরি করলে এসব মরামাছ বেচাও যাবে না।’

‘যা ভালো বুঝিস কর।’

উমেদ তার অন্য কাজ ফেলে সাইকেল নিয়ে মাঝির সন্ধানে ছুটে যায়। দর্শকদের অনেকেই আমাকে সান্ত¡না দিতে গিয়ে নিরীহ মাছগুলোর হত্যাকারী শত্রুকে গালমন্দ করতে থাকে। আমির কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘চাচা, আমি বলি নাই, আপনার মতো গেরস্তের মাথায় কাঁঠাল ভাঙি খাইবে উমেদ? আমি সিওর, যাতে মাছ বেচতে বাধ্য হন সেজন্য বিষ উমেদই দিছে। থানায় গিয়া ওর নামে কেস দেন, পুলিশ অ্যারেস্ট করি রিমান্ডে নিলে সত্যি কথা কবুল করবে। ভালো মানুষ হইয়া গ্রামে টিকতে পারবেন না চাচা।’

সন্দেহের তালিকায় আমির, উমেদ ছাড়াও চেনা-অচেনা অনেকের মুখ দেখতে পাই। কিন্তু শত্রুর বিরুদ্ধে টুঁ-শব্দটি করার মতো ভাষা খুঁজে পাই না আর।

 

পতিত জমিতে শখের বাগান গাছশূন্য এবং পুুকুর মাছশূন্য হয়ে যাওয়ায় অসীম শূন্যতা আমাকেও গ্রাস করে নেয় যেন। রাস্তায় হাঁটতে গেলে বাগানের কচি গাছের মৃত শরীর পানিতে ভাসতে দেখি, পড়শি বাড়ির হাঁসেরা নেমে ঠোকর দেওয়ার মতো শামুক, ব্যাঙ খোঁজে হয়তো, আমি আর স্বপ্নেও নিজের জমিতে সবুজ বাগান কল্পনা করতে পারি না। বাগান দেখার ভয়ে ওদিকে হাঁটতেও যাই না। অবসরে পুকুরে ছিপ ফেলে বসে থাকার আনন্দ-নেশাটাও মরে গেছে যেন। পাড়ে গিয়ে দাঁড়ালে মনে হয় নিজ পুকুরের নিথর পানি অপেক্ষা করে আছে আমাকেই গিলে খাওয়ার জন্য। ঘরেই বেশিরভাগ সময় কাটাই আজকাল। শহরের ফ্ল্যাটবাসার একাকিত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য জন্মভূমির স্মৃতিস্বপ্নে মুক্তি খুঁজতাম। কিন্তু গ্রামে এসে নিজ বাসভূমে স্বজন-পড়শিদের মধ্যে থেকেও নিজেকে আরো একা এবং বিষণœ বোধকরি। প্রথম যৌবনে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে একদা বেঁচে থাকাটা অর্থহীন হয়ে পড়েছিল। শেষ বয়সে আমার এত বৃক্ষপ্রেম আর মৎস্যপ্রেম ব্যর্থ হওয়ায় বাঁচার আনন্দ আর কোথায় খুঁজব আমি? মনে হয় আমার ইহকাল নেই, পরকালও নেই, জীবিত থাকতেই অসীম এক কালো গহ্বরে বিলীন হয়ে যাচ্ছি।

ঘরে অবসর কাটানোর জন্য শহরের বাসার মতো সেলফ ভরা বই, টিভি, কম্পিউটার, ইন্টারনেট-ফোন সবই আছে। টিভির খবরে সরকারি ও বিরোধীদলীয় নেতারা নিজেদের জনগণের বন্ধু এবং পরস্পরকে দেশের শত্রু প্রমাণ করতে যেরকম চিল্লাহল্লা করে, শুনতে ইচ্ছে করে না আর। ঘরে বইয়ের সংগ্রহ বাড়িয়েছিলাম অবসরে নিজে পড়ব এবং গাঁয়ের ছেলেমেয়েদের পড়াব বলে। কিন্তু আজ পর্যন্ত একটি আগ্রহী পাঠকও খুঁজে পাইনি। এত বই দেখে ছক্কা একদিন প্রস্তাব দিয়েছিল, ‘পুরনো বইগুলা কটকটিঅলার কাছে দেন নানা, মেলা কটকটি দেবে।’ আমার অবর্তমানে প্রিয় বইগুলো একদিন ছক্কার কাক্সিক্ষত পরিণতি পাবে হয়তো। ঘরে খুব একা লাগলে ফোনটার দিকে তাকিয়ে থাকি। ইচ্ছে করলেই মুহূর্তে সন্তানদের সঙ্গে যুক্ত হতে পারি, কিন্তু নিজের হতাশা কি একাকিত্বের কথা বলে ওদের উদ্বেগ বাড়াতে ইচ্ছে করে না।

ঘরে টানা কয়েকদিন একা থাকলেও গ্রামবাসী কেউ খোঁজ নিতে আসে না। অবশ্য ঘরকান্নার কাজ করতে উমেদের স্ত্রী-সন্তানরা আসে নিয়মিত। আধা লিটার দুধ দেয় প্রতিদিন। দুধের দাম ও কাজের মজুরি হিসেবে উমেদের বউকেও কিছু টাকা দিই মাসে মাসে। উমেদের স্ত্রী আমাকে পিতার মতোই ভক্তি-শ্রদ্ধা ও

সেবা-শুশ্রƒষা দিতে তৎপর থাকে। আজ ঘর ঝাঁট দিতে গিয়ে সান্ত¡না দেয়, ‘মামার মনটা খুব খারাপ দেখি। কী করবেন, এ-গ্রামের মানুষের মনে খুব হিংসা। আপনার দয়ায় আমরা একটু করি খাই, হিংসাচোদা মানুষের তাও সহ্য হয় না।’

‘পুকুরে যারা বিষ দিছে, সেই বিষ হয়তো চুন দিয়ে দূর করা যাবে। কিন্তু তোদের মনের হিংসা-লোভ দূর করতে পারব আমি?’

উমেদের বউ ফ্যালফ্যাল করে তাকায় আমার দিকে। আমার মনে হয়, উমেদের পরিবারের সঙ্গে যে দেনা-পাওনার সম্পর্ক, তার মূলে কোনো মানবিক দয়া-মায়া নয়, নিহিত আছে হয়তো-বা কোনো হিংস্র বাসনা। এখন যদি লোভী উমেদের ওপর প্রতিশোধ নিতে তার বউকেও কঠিন শাস্তি দিতে চাই আমি, হয়তো নিঃশব্দে মেনে নেবে মেয়েটি। কিন্তু এমন প্রতিহিংসা কি অন্ধ লালসা অসুস্থ শরীরে সাড়া জাগায় না একটুও। দীর্ঘশ^াস ছেড়ে বলি, ‘আমার শরীরটা খারাপ লাগছে রে, তুই এখন যা।’

‘মামা, ছক্কার বাপকে ডাক্তার ডাকতে বলব কি?’

‘না, না, ডাক্তার লাগবে না। এমনি একা থাকতে ইচ্ছে করছে। তুই যা।’

উমেদের স্ত্রী চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর ঘরে আসে ছক্কা। বিনা নোটিসে যখন-তখন দরজা ধাক্কা দিয়ে ঘরে ঢোকার অধিকার একমাত্র তারই আছে। জানালার নিচে লাগানো তার ফুলগাছটি ছাগলে খেল কিনা কিংবা ফুল ফুটল কিনা, সেটা পরীক্ষা করতে আসে। আমার হুঁকা সাজিয়ে দিতে আসে। আবার কোনোদিন-বা নদীপাড়ে হাঁটতে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়, কারণ সেদিকে হাঁটতে গেলে বাজারের দোকানে চকোলেট কি জিলিপি কেনার সুযোগ আছে। কিন্তু আজ ঘরে ঢুকেই মস্ত সুখবর শোনায় ছক্কা।

‘ও নানা, তোমার দিঘির সউগ মাছ মরে নাই। এত বড় একটা বিরাট রুই মাছ বাগাড়া দিছে। বড়শিতে একটা তেলাপিয়া ধরিছো মুই, চলো নিজের চক্ষে দেখবেন।’

‘শরীরটা খারাপ লাগতেছে রে।’

‘মোর ঘাড়ত ভর দিয়া ওঠো তো নানা। তোমাকে পিঠিত করিয়াও নিয়া যাইতে পারিম মুই। চলো, হাচা না মিছা কথা, নিজের চক্ষে দেখতে পাইবেন।’

ছক্কা আমাকে টেনে তোলার চেষ্টা করে। আমি অনিচ্ছাতেও কৌতূহলী ছক্কার আনন্দে ভাগ বসাতে তার কাঁধে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াই, ‘চল তো দেখি।’