অঞ্জনের ছবি

শাহীন আখতার

 

লোকেশনে

মুন্সিগঞ্জের আবদুল্লাহপুর-ইদ্রাকপুর-রিকাবিবাজার, তারপর মানিকগঞ্জের বেহুথা-তেওতা ঘোরাঘুরি শেষে ঠিক হলো ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মেঘমল্লারের (তখনো নাম ‘রেইনকোট’) শুটিং হবে। সেট তৈরির কাজ চলছে। আমি অঞ্জনের মুখে গল্প শুনি। স্ক্রিপ্টের সঙ্গে মিলিয়ে কিছু টুকরা-টাকরা দৃশ্যও চোখে ভাসে। কিন্তু মনটা পড়ে থাকে কম্পিউটারে, ময়ূর সিংহাসন উপন্যাস তখন শেষাবস্থায় – গড়াপেটা চলছে। ছেঁড়া ছেঁড়া প্যারা জুড়ে যেতে হচ্ছে সমাপ্তির দিকে। এই ক্রিটিক্যাল সময়ে বম্বে থেকে সিনেমাটোগ্রাফার সুধীর পালসানে হাজির। মনে আছে, রাতে খেতে বসে আমি পাদ্রি মানরিকের আরাকান ভ্রমণবৃত্তান্ত একনাগাড়ে বলে যাচ্ছিলাম। হয়তো অভয় দিচ্ছিলাম নিজেকে – আমি আমার জায়গায় আছি, সারিবদ্ধ কালো পিঁপড়ার মতো বাক্য বা শব্দবন্ধের মাঝখানে আপাদমস্তক জড়িয়ে-মড়িয়ে।

পরদিন সুধীরকে নিয়ে আমরা ময়মনসিংহের ট্রেনে উঠে বসি। পৌঁছে মনে হলো, আগে কেন এখানে আসিনি। এমন সজল-সবুজ, মায়াময় পরিবেশে একাত্তরের বিয়োগান্ত কাহিনি দৃশ্যায়িত হবে, তিনদিনের অঝোর বর্ষণ কান্না হয়ে ঝরবে – বুকটা খুব ভার ভার ঠেকছিল।

অনেকদিনের পরিত্যক্ত একটি কোয়ার্টারে আসমা-নুরুল হুদার সংসার সাজানো হচ্ছে। জানালার গরাদ, দরজার খড়খড়ি ও দেয়ালের চুনকাম সেরে কাঠমিস্ত্রি-রাজমিস্ত্রি বিদায় হয়েছেন। সুইচবোর্ড, সিলিং ফ্যান মান্ধাতা আমলের বলে রক্ষা। ওখানে হাত দিতে হয়নি। কিন্তু সদ্য রং-মারা দেয়াল আর বাউন্ডারির পাতাবাহারের হেজ তো গ্লো করছে। আর্ট ডিরেক্টর ঢাকায় ফিরে গেছেন। ক্যামেরার ফ্রেমে চলে আসতে পারে এমন কিছু পাতাবাহারের গাছ তখন তখন উপড়ে ফেলা হলো। অফহোয়াইট দেয়াল জায়গায় জায়গায় ঘষে পূর্বাবস্থায় ফেরানোর চেষ্টা চললো খানিক। সিনেমার কাহিনি তো ঘোর বর্ষা মৌসুমের। দেয়ালে কি শ্যাওলা থাকবে না, নিদেন বৃষ্টির পানির কালশিটে দাগ! পানিকচু, কলাগাছের ঝাড় উপড়ে এনে পোঁতা হয়েছে কিচেন গার্ডেনে। বাড়ির সামনেটা ন্যাড়ান্যাড়া লাগছিল বলে একটা দশাসই আপেল-বরইগাছ (সবুজ কচকচে আপেলাকৃতির বরই) লাগিয়েছে জানালার ধারে।                যে-জানালা দিয়ে সেলাই মেশিন চালাতে চালাতে আসমা দেখবে – খেয়া পারাপারের মাঝি ভিজতে ভিজতে আসছে। ট্যাঁকে লুকোনো মিন্টুর হাতচিঠি। তখনো বরইপাতা মলিন, রোদের তাপে কচুপাতাগুলো কুঁচকে আছে।

আগেভাগে সবকটা সম্ভাব্য শুটিংস্পট সিনেমাটোগ্রাফারের দেখা প্রয়োজন। প্রায় পাঁচ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। সিএনজি ভাড়া করা হলো। সঙ্গে ভার্চুয়াল ম্যাপ। সিনেমার কলেজ-প্রিন্সিপালের কক্ষ, শিক্ষকদের কমনরুম – তার জন্য উঁচু সিলিংয়ের বড় বড় জানালার সবচেয়ে পুরনো ছাইরঙা দালান ‘করিম ভবন’ বেছে নেওয়া হয়েছে। নুরুল হুদার কলেজে যাওয়া-আসার পথে পড়বে জ্যামিতিক নকশার কংক্রিটের বেইলি ব্রিজ। ক্যাম্পাসের পুরনো এক প্রাইমারি স্কুলে আর্মি ক্যাম্প। আস্তরখসা, ছাতলাপড়া দেয়াল। চেয়ার-টেবিল-বেঞ্চির অবস্থা তথৈবচ। স্কুল বন্ধ থাকায় বারান্দার পিলারে ছাগল বাঁধা হয়েছে। আমরা পচা পাতা আর কর্দমাক্ত নালা ডিঙিয়ে পেছনে আসি। একটা পরিত্যক্ত ডাস্টবিনে ছা-পোনাসহ বিড়ালের সংসার। সুধীর এক লাফে জায়গাটা পেরিয়ে যায়। বিড়ালে ওর অ্যালার্জি, দেখামাত্র গায়ে লাল লাল র‌্যাশ ওঠে। তার মানে বিড়াল-পরিবার উৎখাতের ঘণ্টা বাজলো। এবং তা হয়তো শুটিংয়ের আগেই।

দুপুর নাগাদ আমরা সিএনজি করে চৌরাস্তার দিকে যাচ্ছি। রোজার দিন বলে জববারের মোড়ের সবকটা খাবার দোকানের ঝাঁপ নামানো। কাছেই তেরপলের পর্দা ঝুলিয়ে চা-বিস্কুট বিক্রি হচ্ছে। ‘দেয়ালে পোস্টার চাই, ইয়ার। স্বাধীনতার দাবি-সংবলিত পোস্টার থাকবে না!’ সুধীরের আবদার শুনে সবার মাথায় হাত। বলে কী, যুদ্ধের দিনে দেয়ালে পোস্টার! তোপ দেগে উড়িয়ে দিত না! পতাকা ওড়ানোর দায়ে কত লোককে প্রাণ দিতে হয়েছে তখন। ভিনদেশি সিনেমাটোগ্রাফার তো কী, তাকেও একাত্তরের যুদ্ধ-পরিস্থিতির তালিম নিতে হবে। তাই ডে-লাইটে মুক্তিযোদ্ধাদের রেললাইন রেকি করার দৃশ্যগ্রহণের প্রস্তাবটাও খারিজ হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে।

রেললাইনে পা দিলে গা ছমছম করে। তাই ঢালের নুড়িপাথর ভেঙে হাঁটছি। দুপাশে ঘন সবুজ বনানী। গাছপালা ঝাঁপিয়ে পড়ায় পথটাকে মনে হয় অন্তহীন সবুজ টানেল। এ সুড়ঙ্গপথে গড়গড়িয়ে পাকসেনার গোলা-বারুদবোঝাই ট্রেন ঢুকবে। (তখনকার মরচে-রঙা রেলের বগি পাওয়া দুষ্কর। তাই ট্রেনের আইডিয়াটা বাদ দিতে হয়। পরে কম্পিউটার গ্রাফিকসের মাধ্যমে মুছে ফেলা হয় ‘ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশন’ লেখা সাইন। সিনেমায় মুক্তিযোদ্ধাদের চলাচলের কাঠের স্লিপার-সংবলিত রেললাইনটুকু অনেক খোঁজাখুঁজির পর পাওয়া গিয়েছিল।)

সেদিনের স্পট ভিজিট তখনো শেষ হয়নি। সিএনজি ধুলা উড়িয়ে খোলা মাঠে পড়ে। দিগন্তে জমাট সবুজ গ্রাম। বাতাসে দোলানো কচি সবুজ ধানক্ষেত। তখনো ধানে পাক ধরেনি। আমাদের বাহন থামে টিনে ছাওয়া সাদা-ধূসর দেয়ালের একঠেরে একটা বাড়ির সামনে, যা সিনেমায় টর্চার সেল। আড়ায় দড়ি দিয়ে হাত বাঁধা, আর্মির অত্যাচারে জর্জরিত সাত্তার মৃধা গড়ানো তেলের ড্রামে দাঁড়িয়ে কোনোক্রমে ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করছেন। ‘বলে দেন না ভাই, এ-যন্ত্রণা আর সহ্য হয় না।’ কী বলবে নুরুল হুদা, তখনো জানা যায় না। খাড়া করা লোহার খাটের ফ্রেমে তার হাত দুটি ক্রুশবিদ্ধের ভঙ্গিতে বাঁধা যেন।

নামেই শস্যভান্ডার। সিনেমার টর্চারসেলটা আসলে মাঝখানে ছেঁচা মুলিবাঁশের পার্টিশান দেওয়া বীজ-সারের গুদামঘর। সামনের বাঁধানো উঠানে বীজধান শুকানো হয় হয়তো। ঘরের অবস্থা যাচ্ছেতাই। ইঁদুর-চাকচিকার উৎকট গন্ধ আর ধুলোতে ভরা। তার মধ্যে সেট, ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল, লাইটিং নিয়ে জল্পনা-কল্পনা শুরু হলে আমি সিএনজিতে এসে বসি। ধানগাছের ডগা ছুঁয়ে সাপের মতো কিলবিলিয়ে বাতাস বইছে। মাঠ-জুড়ে রৌদ্র-ছায়ার লুকোচুরি। আমার কাছাকাছি ঘন হয়ে দাঁড়ানো বেশ কজন কৌতূহলী মানুষ। বুঝতে পারছিল, এখানে কিছু একটা হতে যাচ্ছে – লোহার শেকল টেনে আমিনের জমি জরিপ-টরিপ জাতীয় কিছু। নির্বিকার শুধু গাছে-বাঁধা গরুটি – ফোঁস-ফোঁস করে রাস্তার ধারের কাঁটা বেছে ঘাস খেয়ে যাচ্ছে।

এ-পথে যানবাহনের যান্ত্রিক কোলাহল নেই। পাখিরা গান গাইছে। মিলিটারি জিপ যখন বন্দি নুরুল হুদাদের নিয়ে সশব্দে হাজির হবে, গান বন্ধ হয়ে যাবে। টর্চারসেল থেকে সাত্তার মৃধাকে বের করার সময়, আমি ভাবি, দরজাটা অল্প সময়ের জন্য খোলা হবে। নুরুল হুদা শেষবারের মতো দেখতে পাবেন – ধানক্ষেতে বাতাসের হিল্লোল, পাখির উড়ে বসা টেলিগ্রাফের তার, দূরে দিগন্তঘেরা ঘন সবুজ গ্রাম, মেঘভারাবনত মেটেরঙা আকাশ। দুনিয়ার সঙ্গে এই তার শেষ সংযোগ।

ফিরতি পথে ট্রেনের জানালায় কনুই চেপে ভাবছিলাম – লেখালেখি তো নিরাকারের আরাধনা। অথচ সিনেমা দেখো – চলমান দৃশ্যে, বর্ণে-শব্দে কত জমজমাট! প্রেক্ষাগৃহের আলো জ্বলে উঠলে গুঞ্জন শুরু হয়। কুৎসা-প্রশস্তি সবই নগদানগদ। বই ছাপিয়ে গালে হাত দিয়ে বসে থাকার মতো প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে হয় না। ট্রেনের শব্দ ছাপিয়ে আমার কানে তখন মেঘমল্লারের আলাপ। চারদিন পর শুটিং শুরু হবে। তখন স্বল্প সময়ের জন্য হলেও আসতে হবে এখানে।

 

শুটিংয়ের কমেডি-পর্ব

পরদিন শুটিং। রাত ১০টা নাগাদ যখন ফিশারিজ ডিপার্টমেন্টের তিনতলা ডরমিটরিতে পৌঁছি, মনে হলো বিয়েবাড়ি। ফটকের মুখে বিশাল ডাইনিং হল। ভেতরে মাছবাজারের মতো হইচই। হ্যাজাক বাতির শাঁ-শাঁ আওয়াজ। পান মুখে সিগারেট ফোঁকার জায়গার তালাশে বেরিয়ে আসে কয়েকজন। সবাই প্রায় অচেনা। পুরো বিল্ডিংটা ফিল্ম ইউনিট ভাড়া নিয়েছে। ইউনিটের সদস্যসংখ্যা ষাট-সত্তর। জারার (ছবিতে শিশুশিল্পী সুধা) বাবাকে দেখলাম, ছেলেকে কাঁধে ফেলে করিডরে পায়চারি করছেন। মা মেয়েকে খাওয়াতে ব্যস্ত। জারাদের ঘর সম্ভবত দোতলায়। আমি আর অপর্ণা ব্যাগ-ব্যাগেজ নিয়ে তেতলায় উঠে যাই। নায়িকার আগমনে পেছনে কানাকানি, মৃদু ফিসফাস।

অতিরিক্ত বৃষ্টির জন্য হয়তো গাছে-ঢাকা, ফাঁকা-ফাঁকা দালানকোঠার ক্যাম্পাসে রাতে শীত পড়ে। কম্বল মুড়ে ঘুমাতে হয়। ভোরে অঞ্জনের সঙ্গে যখন স্পটে যাই (নুরুল হুদার কোয়ার্টার), তখন দরজায় কেওয়ার তোলা। সারারাত কাজ করে যে যেখানে পারে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। ঘরে আর ঢোকা হয় না। দরজা থেকে দেখি – শোবার ঘরে পুরনো নকশাদার মেহগনি কাঠের পালঙ্ক পাতা হয়েছে। পালঙ্কের পাশে ড্রেসিং টেবিল, জানালা ঘেঁষে কাঠের আলনা। কুলঙ্গিতে আমার শখের রেহেলে লাল গিলাফের কোরান শরিফ। তখন বারান্দার বেঞ্চি থেকে একজন তড়িঘড়ি উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে বাথরুমে ঢুকে যায়। আমি একপাক ঘুরে বাড়ির পেছন দিকটায় আসি। আড়াআড়ি কাপড় শুকানোর তার ঝুলানো হয়েছে। আসমার কিচেন গার্ডেনের কচুগাছগুলো নতুন পাতাসমেত দিব্যি বাড়বাড়ন্ত হয়ে উঠেছে। বাইরের দরজার মুখের বরইগাছের কুঁড়ি মেলা দেখে অবাকই হতে হয়। এ কি মাটির গুণ, না অঝোর বৃষ্টির?

সকাল ৯টা-১০টার মধ্যে ডরমিটরি সুনসান। আমি আরেক কাপ চা চেয়ে নিয়ে বারান্দায় আসি। এমন ফলন্ত হরীতকী গাছ আগে দেখিনি। পাখির ডাকও কত বিচিত্র! খালের পাড় দিয়ে ঝমঝমিয়ে একটা লোকাল ট্রেন চলে গেলে আমি শুটিং দেখতে যাওয়ার জন্য তৈরি হই।

প্রথম দিন বলেই হয়তো ডিরেক্টর-সিনেমাটোগ্রাফারের মতে – কোনো কিছুই ঠিকমতন হচ্ছে না। ধমকা-ধমকিতে সহকারী নবিশদল আরো নার্ভাস। একজনকে ডাকলে চারজন ছুটে আসে। মেঝেতে পায়ের ছাপ পড়েছে তো ফের মোছো। ক্ল্যাপ দিতে গিয়ে হাতের কাঁপাকাঁপি, হিসাবে গন্ডগোল। ‘কিপ কোয়াইট’ বলার পর ব্যাটারিচালিত রিকশার শব্দ চলে এলো। একাত্তর সালে কি ব্যাটারিতে রিকশা চলতো বা নৌকায় ছিল শ্যালো ইঞ্জিন? রাস্তার ট্রাফিক ঠেকানোর যেমন লোক রয়েছে, নদীর পাড়েও তাই। একটা দৃশ্যেই টেক নম্বর হু-হু করে বাড়ছে – ছয়-সাত-আট। একাধিকবার শট দিতে হলে অভিজ্ঞ নটেরা গজগজ করেন। টিভি নাটকে একবারেই কেল্লাফতে, এখানে বারবার তোপ দাগা হচ্ছে কেন?

কাঁঠাল হাতে আসমা ঘরে ঢুকবে, সুধীর ফ্রেম ফিক্সড করে ক্যামেরার ট্রাইপয়েড ধরে দাঁড়িয়ে আছে, আঙিনা থেকে মেঘের ছায়া সরে না। রোদ উঠলো তো আসমার হাঁটা হলো ধীরগতির। কখনো-বা দ্রুত। ওদিকে উবু হয়ে কাগজে ছবি অাঁকতে অাঁকতে সুধা ক্লান্ত হয়ে বিড়ালের মতো শুয়ে পড়েছে। অলস ভঙ্গিতে বেণিটা টেনে নিচ্ছে সামনে। বাহ্, এমন স্বাভাবিক ভঙ্গিই তো চাই! ডিরেক্টরের প্রশংসা শুনে ছোট্ট করে হেসে মাথা নাড়ে জারা। ও যেন অভিনয় করে না। ক্যামেরার কথাও ভুলে যায়।

এই রোদ এই বৃষ্টি – বর্ষাকালের আকাশের মতোই জগাখিচুড়ি অবস্থা সেটের। সিগন্যাল পাঠানোর পরও ছাদের ওপর রেইনমেশিনের লোকগুলো কী করছে? সাড়াশব্দ নেই! মই বেয়ে উঠে দেখা গেল – ওপরটা গাঁজার ধোঁয়ায় ধোঁয়াক্কার। তারপর বৃষ্টিবর্ষণ শুরু হলো তো থামার নাম নেই। ডাকলে সাত আসমান থেকেও সাড়া মেলে, গঞ্জিকা সেবকদল এমনই বধির। তার ওপর গন্ধে গন্ধে নেশার আমেজও ছড়িয়ে পড়ছে।

প্রচুর সংলাপ, ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল চেঞ্জ করাসহ বেশকিছু কারণে ভেতরের উঠানে আসমার কাপড় মেলা আর নুরুল হুদার খেউরি করার দৃশ্যটি নিতে দিনের অর্ধেক বেলা গড়িয়ে যায়। বারবার টেক নিতে হচ্ছিল। ছাদের বর্ষণ কাপড় শুকানোর তার থেকে ঝরে নিঃশেষ হয়ে যায় পরেরবার টেক নেওয়ার আগে। তখন তারে তেল দিয়ে পানির ফোঁটা ধরে রাখার তরিকা বাতলায় সুধীর। সেটি জানালার গরাদে বৃষ্টির ফোঁটা ধরে রাখার বেলায়ও মানা হয়েছিল। বাবা নিখোঁজ হয়ে গেলে সুধা তখন আত্মনির্ভর। একা ভাত খেয়ে জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালে। জামায় হাত মুছে জানালার ধারে যায় পানি ছানতে। প্যাকআপের পর ডিরেক্টর-সিনেমাটোগ্রাফারের ক্লান্ত মুখে প্রসনণ হাসি, পরস্পরকে প্রবোধ দিচ্ছে – নববই মিনিটের ছবি তিরিশ দিন শুটিং হবে। গড়ে তিন মিনিট। ঘাবড়াবার কী আছে!

সিনেমাহলে দর্শকের খামতি হলেও শুটিং দেখার লোকের অভাব হয় না। এফডিসির গেটে হামেশাই তাই উপচেপড়া ভিড়। সিক্ত-বসনা নায়িকার নৃত্য বা রাংতা-মোড়া তলোয়ার নিয়ে খলনায়ক-নায়কের তুমুল ফাইট – সে যা-ই হোক। পুলিশের ডান্ডার বাড়ি তো কী, টিকিট কাটতে তো হচ্ছে না। বা পুরু মেকআপ আর ঝলমলে পোশাকের পারলৌকিক প্রাণীগুলো তখন রক্তমাংসের মানুষও বটে। কম্পমান পর্দার ছায়া-ছবি নয়। মেঘমল্লারের সেটে এমন মারদাঙ্গা দর্শকের দেখা মেলেনি। দু-চারজন ঘরের বউ, স্কুল-কলেজ ফেরত ছাত্রছাত্রী ঘুরেফিরে চলে যেত। হয়তো আটপৌঢ়ে পোশাকের অপর্ণাকে ওদের চেয়েও বেহাল মনে হয়েছে। লুঙ্গি-গেঞ্জির শহীদুজ্জামান সেলিম চেহারা-সুরতে ঘরের লোকের চেয়ে এমন কী। (যদিও সেলিমই ফিল্ম ইউনিটের একমাত্র ব্যক্তি, যার কাছে অটোগ্রাফ হান্টাররা ভিড় করেছিল) আমার দুদিনের দেখা শুটিং-পর্বে একবার শুধু এর ব্যত্যয় ঘটে। বেডরুমে রঙিন চেকের মশারি খাটাতে সে কী হুলস্থুল! পাড়ার  কচি-বয়সী মৌলবি সাহেবরাও হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। ভিড়ের চাপে বেঞ্চির পায়া ভেঙে কয়েকজন ভূপাত। সুধাকে আসমা-নুরুল হুদার মাঝখানে শুইয়ে দিতে ভিড়টা কখন যেন পাতলা হতে হতে নাই হয়ে গেল। তারপর তো আসমা মশারি তুলে জানালার ধারে দাঁড়ায়। বাইরে অঝোর বৃষ্টি। বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে মেশিনগানের গুলির শব্দ আসছে। আসমা ভাবছে মিন্টুর কথা। একাত্তরের ছাবিবশ বা সাতাশ মার্চ হবে। আম্মার কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। তখন বৃষ্টি ছিল না। বসন্তের বাতাসে দূরাগত গুলির আওয়াজ। খবর আসছে – ঢাকা শহর মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছে খানসেনারা। আম্মার ভাইবোনেরা ঢাকায়। জানালার শিক ধরা আম্মার চাপাকান্না, বিছানায় শুয়ে ঘুম-জড়ানো গলায় আববা সান্ত্বনা দিচ্ছেন। অজানা আতঙ্কে আমাদের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, যুদ্ধ তো ঢাকায়, আম্মা বিছানায় ফিরলেই ভয়ডর দূর হয়ে যাবে।

 

বাসার ছাদে কবুতরের মৃত্যু

বার্ড-ফ্লুর খবর তখন সংবাদপত্রে। ছাদে টং-উপচানো কবুতর। আগে সবই ছিল নির্ভেজাল গিরিবাজ। আশপাশের বাড়ি থেকে খাবার লোভে এসে যখন থাকতে শুরু করে, তখন নানা জাতের কবুতরে ভরে যেতে থাকে ছাদটা। একটা ছাইবর্ণের বিলাতি জালালি এমন হৃষ্টপুষ্ট ছিল যে, প্রায় হাঁসের মতো। এর ডানার ঝাপটে ধুলা উড়তো। গোলা কবুতর তো অগুনতি। বারো খোপে জায়গা হচ্ছিল না। সন্ধ্যা হলে মারামারি। অপেক্ষাকৃত দুর্বল বা অনাহূতেরা কার্নিশে, পানির ট্যাংকির ওপর আশ্রয় নেয়। ছোটবেলায় আমার নানা কিসিমের পোষ্য ছিল। ওদের মৃত্যুশোক কম বয়সে সইতে হয়েছে। নিজের একটা স্থায়ী ঠাঁই পেতে অনেকগুলো বছর গোজার হয়ে যায়। তাই ওদিকে আর স্নেহের হাত বাড়ানো হয়নি। ছাদে কবুতর পোষা অঞ্জনের খেয়াল। কাছিম-রঙিন মাছের ওপর        পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে কবুতরে এসে ঠেকেছে। ঘুম ভেঙে জানালার শার্সিতে, কার্নিশে ওদের কোমল ডানার ঝাপট, আহ্লাদী ডাক শুনতে বেশ ভালোই লাগতো। ময়মনসিংহ থেকে ফেরার পর মনে হলো, বড় অসময়ে আমি ওদের দেখভালের দায়িত্ব পেয়েছি। মড়ক লেগে ছাদ উজাড় হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন সকালে মৃত্যুদৃশ্য – একাধিক কবুতর ডানা ছড়িয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। চাচাতো বোনের ছেলে সবুজকে ফোন করলাম। ও পেশায় পুলিশ। পালে কবুতর। শমন পেয়ে ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় বাজারের ব্যাগে করে অনেকগুলো শিশি নিয়ে হাজির। ভিটামিন-সি, হজমের ওষুধ, অ্যান্টিবায়োটিক, পেইনকিলার – সবই লিকুইড। খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে। খাবার পানিতে একেকবার মেপে পাঁচ-ছ ফোঁটা। যারা অতিশয় রোগাক্রান্ত-দুর্বল, ওদের ড্রপারে করে মুখে ওষুধ দিতে হবে সরাসরি। এরকম একটাকে জুতার বাক্সে ভরে ঘরে নিয়ে এলাম। ব্যবস্থাপত্র দিয়ে পুলিশের ইউনিফর্মধারী পাখি-চিকিৎসক হোন্ডা হাঁকিয়ে তো চলে গেল। বাকি রাত আমি উঠে উঠে দেখি, জুতার বাক্সে পাখিটা বহালতবিয়তে আছে কিনা। বারকতক ড্রপারে করে ওষুধও খাইয়েছি। শেষবার মনে হলো, ঠোঁটের কশ বেয়ে তা গড়িয়ে পড়ছে। হয়তো অ্যান্টিবায়োটিকের ধকলে কাহিল। পেইনকিলারও তো আসলে কিলার – গুপ্তহত্যাকারী। সকালে জুতার বাক্স খুলে দেখি পাখিটা ঠান্ডা-নিথর, পাথরের মতো শক্ত হয়ে আছে। এরপর রাতে ঘুম ভেঙে মনে হতো – পাখির কান্না শুনছি। চার্জলাইট হাতে ছাদে উঠে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকতাম। দিনে গুলতি হাতে কাক তাড়ানো। জরাগ্রস্ত কবুতরগুলোকে কিছুতেই কাকের ভোজ্য হতে দেওয়া যাবে না।

এসব মৃত্যুসংবাদ শোনার অবস্থায় নেই অঞ্জন। মাঝেসাঝে ময়মনসিংহ থেকে প্রপস নিতে লোক আসে। কখনো চেক কেটে দিতে হয়। এদিকে কবুতরের তালাফি চলতে থাকলো। রোজকার খাবার গম-ভুট্টা-বাজরা-চাল-ডালের মিশ্রণে ওষুধ ঢেলে               সকাল-সন্ধ্যা পরিবেশন। প্রেসক্রিপশন মোতাবেক প্রতিবার ছোট গামলার পানিতে কয়েক ফোঁটা ভিটামিন-সি। বড় সমস্যা মুমূর্ষুদের ড্রপারে ওষুধ গেলানো। আঙুলে ঠোকর মারে, ডানা নেড়ে নোংরা পানি ছিটায়। এরকম ধস্তাধস্তি চলাকালে অসম্ভব পেটে ব্যথা আর হাড়-কাঁপানো জ্বরে একরাতে ঘুম ভাঙে। নির্ঘাত বার্ড-ফ্লু। আমি যন্ত্রণার চেয়ে ভয়ে অস্থির। পরদিন জ্বর কমার পর সবুজকে ফোন করতে বললো – ‘আন্টি, আপনার বার্ড-ফ্লুই হইছে। তবে মাইল্ড।’

বলে কী? এ না হলে পুলিশ! অন্যেরা হেসেই খুন।

ড্রপারে ওষুধ গিলে মুমূর্ষুর সেরে ওঠা দেখতে পাওয়া যে কত আনন্দের! অফিস থেকে ফিরে আমি ছাদে চলে যাই। হাতে গুলতি না থাকলেও আমাকে দেখে কাকেরা পালায়। সদ্য রোগমুক্ত কবুতরগুলো কৃতজ্ঞতায় পায়ে-পায়ে ঘোরে। হাতের তালু পেতে দিলে গোলাপি পায়ে বেয়ে বেয়ে কোলে উঠে বসে। বাঁচার আনন্দে আদুরে গলায় ডাক ছাড়ে। একটা জাত গিরিবাজের ওড়ার প্রচেষ্টা ছিল খুব করুণ। ডানা মেলে দিয়ে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে পারকিনসন্স রোগীর মতো কাঁপতো। আমি ঘরে ফিরে কম্পিউটারের সামনে স্থির হয়ে বসি। কাতিব তখন আরাকানের কাদাজলে খাবি খাচ্ছে। বাঁদি মোহনের তখনো খোঁজ নেই। মনিটর স্ক্রল ডাউন করি। কিছুতেই লেখার অগ্রগতির হিসাব মেলাতে পারি না। ছাদের দোলনায় দোল খেতে-খেতে দেখতে ভালো লাগে – কবুতরের খোপগুলো আবার সরব হয়ে উঠছে। আগের মতো মারামারি, জায়গা দখলের লড়াই। ঠোঁটে করে কুটো টেনে খোপে তুলছে। ডিম পাড়া,                           বাচ্চা-ফোটানোর আয়োজন। শুটিং শেষে অঞ্জন ফিরে এলে আমাকেও জায়গা ছেড়ে দিতে হবে।