অনন্য গদ্যের সুচারু সংকলন

পিয়াস মজিদ
রণেশ দাশগুপ্তের (১৯১২-৯৭) কুড়িতম প্রয়াণবার্ষিকীতে তাঁর নিকটজন মতিউর রহমানের সংগ্রহ, সংকলন ও সম্পাদনায় প্রকাশিত হলো যদিও হাওয়া উল্টোপাল্টা শীর্ষক গদ্যসংকলন। বাংলা একাডেমি এই বরেণ্য লেখক-বুদ্ধিজীবীর রচনাবলি প্রকাশ করছে, সাম্প্রতিক সময়ে বেরিয়েছে তাঁর অগ্রন্থিত রচনার সংকলনও, তবু আলোচ্য গ্রন্থের গুরুত্ব সবিশেষ।

‘একুশে ফেব্রম্নয়ারি’, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা’, ‘সাহিত্য-সংস্কৃতি’, ‘কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী’, ‘রাজনীতিক-বুদ্ধিজীবী’, ‘সমাজতন্ত্র’, ‘জেলখানার গল্প’ ও ‘অনুবাদ কবিতা’ শিরোনামে আট অধ্যায়ে বিন্যস্ত হয়েছে প্রায় পঞ্চাশটি রচনা, যেগুলো বিভিন্ন সময়ে সম্পাদক সংগ্রহ করেছেন কলকাতায় স্বেচ্ছানির্বাসিত সন্ত লেখক রণেশ দাশগুপ্তের কাছ থেকে। সম্পাদক মতিউর রহমানের সঙ্গে ১৯৬৩ সালে পরিচয়ের যে-সূত্রপাত তা পরবর্তী চৌত্রিশ বছর রণেশ দাশের বেঁচে থাকার কালে নিয়মিত ও অনিয়মিতভাবে অব্যাহত ছিল। তিনি যুক্ত ছিলেন আলো দিয়ে আলো জ্বালা, মুক্তিধারা এবং ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের কবিতা বইগুলোর প্রকাশনার সঙ্গে এবং হারিয়ে যাওয়া প্রবন্ধ-পা-ুলিপি অব্যাহত কবিতার জন্য এর রচনানেপথ্যে।

এখানে গুচ্ছিত প্রবন্ধসমুচ্চয়ের রচনা ও প্রকাশপর্বের ধারাক্রম বুঝতে মতিউর রহমানের নিম্নোক্ত বয়ানের শরণ নিতে হয় –

… দীর্ঘদিন বিরতিতে আবার রণেশদার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয় – সম্ভবত ১৯৮৬-র দিকে। ওই সময় আমার শারীরিক অসুস্থতার কারণে পাঁচ-ছয় বছর ধরে বেশ কয়েকবার চিকিৎসার জন্য কলকাতায় গিয়েছি। দীর্ঘ বিরতির পর রণেশদার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হয়। আগের মতোই তাঁর সঙ্গে সেই শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক ভাবনাচিন্তা নিয়ে অনেক কথা আর গভীর আলোচনা হয়েছে। অনেক সময় কাটিয়েছি একসঙ্গে।
এ-সময়ও তাঁর সান্নিধ্য পাওয়ার ফলে আমি নতুন করে অনেক পড়াশোনা, বই সংগ্রহ ও জানা-বোঝার পরিসর বাড়াতে সক্ষম হয়েছি। তিনি আমাকে তাঁর দুই বোনের বাসায় এবং পুরোনো বন্ধু ও লেখক কিরণ সেনগুপ্তের বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন।

আমি প্রতিবার রণেশদার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে বলে আসতাম, কলকাতায় আপনার যেখানে যে-লেখা বেরোবে, সেগুলোর একটি করে কপি রেখে দেবেন। আমি পরে এলে আপনার কাছ থেকে নিয়ে যাব। তবে কখনো কখনো আমাদের কোনো বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে কলকাতায় দেখা হলে তিনি তাঁদের হাতেও আমার জন্য তাঁর প্রকাশিত লেখা পাঠাতেন। এভাবে তিনি ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত অনেক লেখা আমাকে দিয়েছেন।

সেসব সংগ্রহ থেকে কিছু প্রবন্ধ নিয়ে ১৯৮৮ সালে জ্ঞান প্রকাশনী থেকে আমাদের উদ্যোগে রণেশদার ‘মুক্তিধারা’ বইটি প্রকাশিত হয়। এরপর বেশ কয়েক বছর কলকাতায় যাওয়া হয়নি। তবে তাঁর জীবনের শেষ দিকে কয়েকবার দেখা হলে – ১৯৯৬ ও ১৯৯৭ সালে – আরও কিছু লেখা সংগ্রহ করি।

দীর্ঘ সময় ধরে সংগৃহীত রণেশদার লেখাগুলো নিয়ে পূর্ণাঙ্গ একটি বই প্রকাশের কথা ভেবেছি অনেক দিন। এত দিন সেভাবে সময় বের করতে পারিনি। সবশেষে বইটি বের হলো।

(সম্পাদকের কথা, পৃ ১৫-১৬)

সম্পাদক আক্ষেপ করেছেন এই বলে যে, রণেশদার জীবদ্দশায় অথবা ২০১২-তে তাঁর জন্মশতবার্ষিকীতে বইটি প্রকাশিত হলো না। তবে আমাদের স্বস্তি এই কারণে যে, দেরিতে হলেও এই অসাধারণ গদ্য-সংকলনটি যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রকাশ পেল; যেখানে লেখকের চিন্তা ও সৃষ্টিসমুদ্রের বিচিত্র কলেস্নাল একত্রে ধরা দেয়। এই বইয়ে তাঁর সাহিত্যানুভূতি, সমাজভাবনা, সংস্কৃতিচিন্তা, রাজনীতিক জিজ্ঞাসা, বুদ্ধিজীবীর কর্তব্য, সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন থেকে শুরু করে স্বরচিত গল্প এবং বিভিন্ন মহাদেশের অভিন্ন আত্মঐক্যের কবি – পারভেজ শাহেদী, পাবলো পিকাসো, এলিসাভেতা বাগ্রিয়ানা এবং আহমদ নদীম কাস্মীর একগুচ্ছ কবিতার প্রাণোচ্ছ্বল অনুবাদ স্থান পেয়েছে।

একুশ নিয়ে রচনা চারে একুশের ইতিহাস, অঙ্গীকার এবং একুশের সাহিত্যফসল আলোচনায় এসেছে। ‘বায়ান্নর অমর একুশে ফেব্রম্নয়ারির বিপস্নবী কালো পতাকায় কষ্টিপাথরে লেখার মতো আঁকা রয়েছে সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জববারের বুকের খুনে আঁকা পলাশমালা।’ – এমন অন্তরসুরভিমাখা প্রসত্মাবনায় রণেশ দাশগুপ্ত একুশের আভায় দেখেছেন মুনীর চৌধুরীর নাটক কবর (১৯৫৩) এবং আবদুল মতিনের ছোটগল্পগ্রন্থ কাস্তে (১৯৮৭)। আবদুল মতিনের পরিচয় লিখতে গিয়ে লেখক জানিয়ে দেন, গত শতকের চলিস্নশের দশকে আবদুল মতিনের সঙ্গী ছিলেন সরদার ফজলুল করিম, এ কে এম নাজমুল করিম, সৈয়দ নুরুদ্দিন, সানাউল হক, মুনীর চৌধুরী, রবি গুহ প্রমুখ। ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্ন এককের বদলে পরম্পরার সন্তান হিসেবে এভাবে বিবেচনা করেন রণেশ দাশগুপ্ত; তাই মুনীর চৌধুরীর কবর নাটকের ধারাবাহিকতায় একজন আবদুল মতিনের পক্ষে কাস্তে সিরিজের গল্প লেখা স্বাভাবিক বোধ হয় তাঁর কাছে। মানবমুক্তির অমত্মঃশীল আকাঙক্ষার একতাবোধ রণেশ দাশগুপ্তের অনুসন্ধিৎসার বিষয় হয়েছে এভাবে, একুশ যে মুক্তির অনন্ত

আলোকধারা। একুশকে তিনি সম্বোধন করেন ‘মহাবিদ্রোহ’ হিসেবে, দাবি তোলেন একুশকে নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের, যার মালিক হবে এদেশের জনগণ। বলছেন তিনি –

আমাদের সাংস্কৃতিক জগতের এই জরুরি কাজটি সম্বন্ধে প্রথম কথাই হলো এই, একুশে ফেব্রম্নয়ারি ১৯৫২কে  কেন্দ্র করে এবং তাতেই নিবদ্ধ রেখে এই চলচ্চিত্র তৈরি হবে। ১৮ থেকে ২৭ ফেব্রম্নয়ারির উত্তাল ঘটনাধারার মণিমালার মধ্যে গাঁথা হবে নিষেধাজ্ঞা ভাঙার রক্তাক্ত একুশে ফেব্রম্নয়ারিকে। এর লোক-মহাকাব্যিক নায়কেরা হবে ছাত্রজনতা ও ছাত্রজনতার প্রতিনিধি শহীদ সালাম বরকত রফিক শফিক জববার। এদের সহায় হিসেবে থাকবে বিরোধী নামে আখ্যাত রাজনৈতিক দলসমূহ। এরপরই আসবে সেই সাতটি দিনের কথা, যে দিনগুলোতে ঢাকায় ছাত্র-জনতার সমান্তরাল সরকার স্থাপিত হয়েছিল সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে। আজ যেখানে শহীদ মিনার গড়া হয়েছে, সেখানে কীভাবে ইটের মিনার গড়া হয়েছে, সেখানে কীভাবে ইটের মিনার গড়েছিল ছাত্রজনতা লড়াই করে সেই ঘটনা আসবে সঙ্গে সঙ্গে। কীভাবে আজিমপুরের কবরখানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল শহীদদের লাশ, তার চলন্ত চিত্র আসবে এর পাশাপাশি।

(পৃ ৩৫)

তাঁর এই প্রসত্মাব এখনো আলোর মুখ দেখেনি। আমরা আশা করি ২০২২-এ একুশের সাত দশক পূর্তির আগেই বাস্তবায়িত হবে একুশ-চেতনার সারথির এ-শুভস্বপ্নের।

‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা’ অধ্যায়ের রচনা চারে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইতিবৃত্ত থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মৌল অভীপ্সার বিবরণও তুলে ধরা হয়েছে। পাকিসত্মানি লেখক তারিক আলীর ক্যান্ পাকিসত্মান সারভাইভ, বেলাল মোহাম্মদের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এবং একাত্তরে কলকাতা থেকে মুক্তধারা-প্রকাশিত রক্তাক্ত বাংলা বইপত্রের সূত্র-প্রতিসূত্র ব্যবহার করে রণেশ দাশ বৃহৎ পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ঘাটন করেছেন বাংলাদেশের অনিবার্য স্বাধীনতার বাস্তবতা। এখানে আমরা দেখব তিনি সহজ সূত্র অবলম্বনে কোনো চটজলদি সিদ্ধান্তে না পৌঁছে, দশ দিক থেকে আলো ফেলেন মূল বিষয়প্রবাহে; ফলে তাঁর আবিষ্কারের পেছনে থাকে সর্বতোবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। স্বাধীনতার সাহিত্যকে তিনি নাগরিক ও লোকায়তের ভেদরেখাহীন দৃষ্টিতে দেখতে চান। শামসুর রাহমান ও রমেশ শীলকে এগিয়ে রাখেন তাঁদের ভিন্নধর্মী পদাবলির অভিন্ন অনুভবে, দুই প্রজন্মের কথাকার শওকত ওসমান এবং সেলিনা হোসেনের উপন্যাসকে তিনি সাম্প্রদায়িকতাভেদী গণতান্ত্রিক অভ্যুদয়ের অভিব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করেন। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে প্রত্যক্ষ করেন ফরাসি বিপস্নবের আভা। ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত গরিমা’ প্রবন্ধে সুফিয়া কামালের একাত্তরের ডায়েরি এবং আবদুল মতিনের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালি : বাংলাদেশ ১৯৭১-কে তিনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অন্যতর এবং অন্তর্ভেদী উন্মোচক হিসেবে দেখতে পান। প্রসঙ্গত বলতে চাই, এই প্রবন্ধে উলিস্নখিত সৈয়দ শামসুল হকের স্মৃতিমেধ (১৯৮৬) উপন্যাসটির নাম ভুলবশত স্মৃতিসৌধ হিসেবে মুদ্রিত হয়েছে। আশা করি নতুন সংস্করণে এই ভ্রান্তিটি সংশোধিত হবে।

‘সাহিত্য-সংস্কৃতি’ অধ্যায়ে তিনি উপমহাদেশের ‘সাহিত্যের অগ্নিপরীক্ষা’ বলে আখ্যা দিয়েছেন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামকে। বিশেষত উর্দুসাহিত্যে অসাম্প্রদায়িকতার অগ্নিশপথ যে প্রবল ধ্বনিতে উচ্চারিত হয়েছে – তাকে লেখক তথ্যে ও তত্ত্বে আবিষ্কার-প্রয়াসী।

‘আধুনিক বাংলা কবিতার প্রগতিতে বাংলাদেশের ধারা’ প্রবন্ধে তিনি আহমদ রফিক, মহাদেব সাহা, হুমায়ুন কবির, নিয়ামত হোসেন প্রমুখ কবির কবিতাসূত্রে এদেশের এক মৌল কবিতাধারা ব্যাখ্যা করেছেন, যেখানে মানবমুক্তির কলরব ভাষা পায় কবির নির্জন অক্ষরে। কবিতার পর্যালোচনায়ও লেখক বিচিত্রসব সূত্রের শরণ নিয়ে উদ্দিষ্ট বক্তব্যকে পূর্ণতা দেন। যেমন এই প্রবন্ধে ১৯৭১ সালে প্রকাশিত তিনটি সংকলন, বিষ্ণু দে-সম্পাদিত বাংলাদেশের কবিতা : এক স্তবক, রফিকুল ইসলাম-সম্পাদিত আধুনিক বাংলা কবিতা এবং দুর্গাদাস সরকার ও সনাতন কবিয়াল-সম্পাদিত গ্রাম থেকে সংগ্রামের সূত্র ব্যবহার করেছেন। ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম-সোচ্চার বাংলায়’ প্রবন্ধটি কেবল এই বইয়ের নয়, আমাদের সামগ্রিক প্রবন্ধসাহিত্যেও একটি ব্যতিক্রমী সংযোজন। এই প্রবন্ধের পরিসরে লেখক পার্বত্য অঞ্চলের কবিতা, নাটক, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, রূপকথা-লোককাহিনি-কিংবদন্তির এক প্রামাণ্য তালিকা প্রণয়ন করেছেন যা বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাহিত্যগবেষণায় জরুরি উপাদান হিসেবে কাজ করবে নিঃসন্দেহে।

‘কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী’ অধ্যায়ে রবীন্দ্রনাথ, রোমা রঁলা, টমাস মান, রমেশ শীল, পিকাসো, আর্নেস্ট টলার, আনা আখমাতোভা, চার্লি চ্যাপলিন, নজরুল, নেরুদা, সোমেন চন্দ, সুকান্ত, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, শামসুর রাহমান আলোচিত-পর্যালোচিত হয়েছেন প্রগতি সাহিত্যের পুরনো কাঠামো ভেদ করে। রণেশ দাশগুপ্তের অন্বিষ্ট মানববাদ। এই মানববাদের ছিটেফোঁটা তিনি যেখানে
দর্শন করেছেন তাকেই বিবেচনা করেছেন গ্রহণীয় সম্পদরূপে। এ যেমন তাঁর রবীন্দ্রভাবনা –

তিনি যেমন অবমাননাকর পরিস্থিতিতে বরাবর সাংঘাতিকভাবে বিক্ষুব্ধ হয়েছেন, তেমনি বরাবরই নিঃস্ব ও রিক্তদের অবধারিত উত্থানের ওপর ভরসা রেখেছেন। লালন ফকির এবং সাধারণভাবে বাউলদের মানবতাবাদী সংগীতের বিদ্রোহী দিকটাকে রবীন্দ্রনাথ যে একটি বিপস্নবী মাত্রায় স্থাপন করেছেন, তার মূলে রয়েছে শ্রমজীবী জনগণের প্রতি প্রত্যাশা, ভরসা।

(পৃ ৯৬)

জার্মান কথাকার টমাস মানের আলোচনা প্রসঙ্গে রণেশ দাশগুপ্তের লেখায় অবধারিতভাবে চলে আসেন বাংলার চিত্রকর জয়নুল আবেদিন। এই তো শিল্প-সাহিত্যের অনিবার্য আন্তর্জাতিকতা –

‘ভেনিসে মৃত্যু’ উপন্যাসে যৌনতা ধিক্কার দেওয়ার জন্যই যেন তিনি কলেরা মহামারির যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা যেন কয়েকটা তুলির আঁচড়ে জয়নুল আবেদিনের সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের ধ্বংসের ছবি।

(পৃ ১০৫)

লোককবি রমেশ শীলকে তিনি দেখে উঠেন ‘বিপস্নবী লোকচৈতন্যের ভাণ্ডারি কবিয়াল’ হিসেবে। গণমুক্তির ময়দানে রংতুলি নিয়ে পথে নামেন শিল্পী, তাই তিনি রণেশ দাশগুপ্তের চোখে ‘কমরেড পাবলো পিকাসো’।

কবি-শিল্পীকে বুঝতে হলে তাঁকে নিয়ে কথার কাকলি বুননের চেয়ে বেশি প্রয়োজন তাঁর সৃষ্টির উদাহরণ সামনে রাখা। রণেশ দাশগুপ্ত তাই তাঁর আলোচ্য কবি-লেখকের মূল রচনার প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি সমাবেত করেন, কখনো অনুবাদ-সমেত। কবি আনা আখমাতোভার কবিতা ‘সাহসে’র এমত পঙ্ক্তিগুলো যেন পাঠকের ভেতরও সঞ্চার করে যায় সাহসী প্রণোদনা –

আমরা জানি আমাদের ভাগ্য

ঢালাই হয়েছে বিপর্যয়ের মধ্যেই

এবং আমরা আজ ইতিহাসের নির্মাতা।

সাহসের প্রহরেরা অবশেষে ধ্বনিত রণিত এবং সাহস আর কোনো দিনই আমাদের ছেড়ে যাচ্ছে না।

(পৃ ১৪৮)

চার্লি চ্যাপলিনের আত্মজীবনী নিয়ে লিখতে গিয়ে যখন তিনি বলেন ‘চিন্তাও ছিল তাঁর কাজেরই অংশ। বেকার হলেই তিনি বিপন্ন বোধ করতেন।’ তখন আমরা উপলব্ধি করি রণেশ দাশগুপ্তের নিজের কথাও; যিনি ছিলেন এক অনলস চিন্তাসক্রিয় মানুষ।

নজরুলের ধর্মনিরপেক্ষ মানস অন্বেষণে তিনি শওকত ওসমানের গদ্যগ্রন্থ মুসলিম মানসের রূপান্তরের সহযোগ নেন; দেখেন নজরুলের ধর্মনিরপেক্ষতা কোনো আকস্মিকের খেলা নয়, বরং এদেশের সাম্যবাদী, মানবতান্ত্রিক লোকায়ত পরম্পরারই অনিবার্য পরিণতি। নেরুদার কাব্যজিজ্ঞাসায় ইলিয়া এরেনবুর্গের সূত্রে তার পটভূমিরূপে আবিষ্কার করেন চিলির  লোককাব্য ও চারণভঙ্গি, স্পেনের মুক্তিসংগ্রাম, হুইটম্যান ও মায়াকোভস্কির কোমলতা ও ক্রোধ এবং ফরাসি কবি বোদলেয়ারের চোরাগোপ্তা প্রভাব। অতঃপর তাঁর নেরুদা আমাদের কাছে উদ্ভাসিত হয় এমন উপলব্ধিতে ‘এই বিশ্বে যেখানেই মানবের মুক্তির ধ্বনি, সেখানেই নেরুদার কবিতার বাণী।’

কথাশিল্পী সোমেন চন্দকে তিনি অভিহিত করেন ‘বাংলা ছোটগল্পের সুকান্ত’ হিসেবে। আবার কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যকে নিয়ে তাঁর মত ও মন্তব্য সনাতনি সমাজতন্ত্রীদের মতো নয়। তিনি তাঁর কবিতাকে ‘ভবিষ্যৎবাদী আধুনিকতা’র প্রত্যয়ে খুঁজে পান। বিপস্নবী মানবতাবাদী উর্দুকবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের কবিতা আলোচনা করতে গিয়ে আধুনিক কাব্যের সঙ্গে জনযোগাযোগের সমস্যা প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে। ফয়েজের সূত্র ধরে বাংলা কবিতার গণস্বর আবিষ্কৃত হয় এমন অপূর্ব আলকেমিতে –

বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের পর আধুনিক কবিরা জনগণের সঙ্গে সঙ্গে চলেছেন আধুনিক রীতির কবিতা নিয়ে। যেখানেই বিচ্ছেদ ঘটেছে, সেখানেই কবিতার তার ছিঁড়েছে। যখনই সংযোগ হয়েছে প্রত্যক্ষ প্রতি মুহূর্তের গণ-অভিজ্ঞতার সঙ্গে কবিতার, তখনই ঝমঝম করে বেজে উঠেছে হাজার তারের বীণা।

(পৃ ২১০)

‘শামসুর রাহমান : এত ভালোবাসা ঘৃণা রক্তধারা প্রত্যয় বিদ্রোহ প্রজ্ঞা সহজিয়া সাধনা’ প্রবন্ধটি এ-যাবত প্রকাশিত রাহমানের কবিতা-সম্পর্কিত আলোচনাগুলোর মধ্যে ব্যতিক্রমী গুরুত্বের দাবি রাখে, যেখানে প্রাবন্ধিক ব্যক্তি কবির নিজস্ব প্রসূণকে একটি জনগোষ্ঠীর যূথস্বরের মধ্যে জ্বলজ্বলে দেখতে পান –

শামসুর রাহমান গভীরভাবে বরাবর সচেতন থেকেছেন, শ্রমিকের শার্টের ঘেমোগন্ধই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সুরভিতে রূপান্তরিত হয়। শামসুর রাহমান যেভাবে দয়িতাকে দেখেছেন এবং পেরেছেন তার অন্তর ও বাইরের বৈভবে সাজিয়ে ভুবনমোহিনী করে, তেমনি পুরান ঢাকার মহল্লার বাসিন্দাদের ভিত্তি করেই যে বায়ান্নর ধর্মনিরপেক্ষ গণঅভ্যুত্থান ঘটেছিল, সে কথাটা মনে রেখেছেন। এদের কোনো গাঁটছড়াকে আমরা ছাড়াতে চাই না, এদেরই ছড়াতে চাই।

(পৃ ২২০)

‘রাজনীতিক-বুদ্ধিজীবী’ পর্বে ভিয়েতনামের বিপস্নবী হো চি মিন কীভাবে বরিত হয়েছেন বাংলার কবিদের কাছে, তাঁর প্রামাণ্যরূপ গ্রথিত হয়েছে। আমরা রণেশ দাশগুপ্তের সূত্রে জানতে পারি, প্রায় পঞ্চাশ বছর পূর্বে প্রকাশিত শস্যের ভিতর রৌদ্রে এবং হো চি মিনের উদ্দেশে নিবেদিত কবিতা শীর্ষক সংকলন প্রকাশের তথ্য যা বিপস্নব ও বিপস্নবীর পূর্বকথিত সেই আন্তর্জাতিকতাবাদেরই জোরাল স্মারক।

উর্দু কবি পারভেজ শাহেদী রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষে ‘বন্দী গান’ শীর্ষক কবিতায় যেভাবে রবীন্দ্রনাথের আত্মাকে সম্বোধন করেন তাও সে আন্তর্জাতিকতাবাদেরই লক্ষণ –

কিন্তু হে ঠাকুর মনে রেখো তোমার

প্রশস্তিবাণীও রাজনীতি

যেমন লোভ ও লালসার বরপুত্রদের

ফুলের ডালিতেও রাজনীতি।

তোমার গানের তাঁবু যে দড়ি দিয়ে

মটির সঙ্গে বাঁধা

তাকে ওরা কেটে দেয়

পৃথিবীর ধুলার সঙ্গে তোমার

সম্পর্কটাকে

ওরা মহাশূন্যে ছুড়ে দেয়।

তোমার গানের মাটির মর্ম থেকে ওরা

মুখ ফিরিয়ে নেয়

তোমার ঘরোয়া আলাপে ওরা অধরা

রং চড়ায়

ওরা অপার্থিব রং চড়ায় বর্ণ ও গন্ধের

মেঠো পৃথিবীতে।

(পৃ ২৫৬)

মাওলানা আবুল কালাম আজাদের দিনলিপিতে প্রাপ্ত সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সংগ্রামে তথ্যসূত্র থেকে শুরু করে অকালপ্রয়াত সাংবাদিক আহমেদুর রহমান-রচিত সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ইশতেহার ‘পূর্ব পাকিসত্মান রুখিয়া দাঁড়াও’ – রণেশ দাশগুপ্তের অনন্য বিশেস্নষণ-সংশেস্নষণে আমাদের কাছে ধরা দেয় ইতিহাসের অবিরাম ধারাবাহিকে।

‘সমাজতন্ত্র’ শীর্ষক অধ্যায়ের দশটি রচনার পাঠ সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপস্নবের শতবর্ষ পেরিয়ে সবিশেষ গুরুত্ববহ। এখানে দুনিয়া-কাঁপানো দশ দিনের ইতিবৃত্ত থেকে বাংলাদেশে বামপন্থি আন্দোলনের ইতিহাস উঠে এসেছে। আলোচিত হয়েছে রুশ বিপস্নবের প্রকৃতি ও গতিবিধি, ধর্মজিজ্ঞাসার আলোকে মার্কসীয় ভাবনা, সমাজতন্ত্রবিরোধী তৎপরতা এবং তবু ‘অব্যাহত অক্টোবর বিপস্নবে’র প্রাসঙ্গিকতা। তিনি সমাজতন্ত্রকে যান্ত্রিক ফ্রেমে না দেখে দেখতে চান মির্জা গালিবের কবিতার অক্ষরে –

পাথর কাটা ছেনি আর খন্তাই ফরহাদকে শিরিনের

সহমর্মী করেছিল

যে ধরনেরই হোক যার মধ্যে যে নৈপুণ্য থাকুক

সেটাই ভালো।

(পৃ ২৮৩)

আবার সোভিয়েত কবিতার বিকাশকে দেখতে পান প্রকৃতির সঙ্গে এমন নিবিড় অনুভবে –

সোভিয়েত কবিতার বিকাশে এই মায়াকোভস্কি, বস্নক, পাস্তেরনাক ও এসেনিনের লেখা হচ্ছে বৃক্ষর কা- স্বরূপ, যেমন অক্টোবর বিপস্নব হচ্ছে সোভিয়েত সমাজের কা-স্বরূপ।

(পৃ ৩০৬)

রণেশ দাশগুপ্তের সৃজনশীল সত্তার সন্ধান পাই সংকলনভুক্ত ‘জেলখানার গল্প’ এবং একগুচ্ছ কবিতার অনুবাদে। অনুবাদের সঙ্গে সংযুক্ত সম্পাদকের নোট বিভিন্ন দেশের মানবমুক্তিকামী কবিদের অন্তর-অবয়ব আবিষ্কারে বিশেষ সহায়ক। অর্ধশতাব্দী পূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি সংসদ-প্রকাশিত একুশের সংকলন বজ্রে বাজে বাঁশি থেকে সংগৃহীত আহমদ নদীম কাস্মীর লেখা ‘বসন্ত’ কবিতাটির উলেস্নখেই সমাপ্ত করতে চাই এই আলোচনা –

 

এত সুরভি যে দম আটকে আসে

এমন করেই এল এবার

বাঁধভাঙা বসন্ত।

 

মালঞ্চের কুসুমিত হাওয়া তো নয়

এ যেন আগুন জ্বলা,

বর্ণকে যদি অগ্নিশিখা বলি

গন্ধকে বলব স্ফুলিঙ্গ।

 

উদ্যানের পথে প্রলয়ের দীপ্তি

যেন যৌবনের লেলিহান দেহ।

কুঁড়ি তো নয়, একরাশি ফোস্কা

কিশলয়গুলি মঞ্জরিত

যেন সারি সারি দীপ।

 

এবার কুঞ্জকাননে

সমীরণও বইল এভাবেই।

এই বইয়ের সংকলক ও সম্পাদক মতিউর রহমানকে অজস্র ধন্যবাদ, সোনার কলম লেখক রণেশ দাশগুপ্তের অনন্য এই গদ্যগুচ্ছের এমন সুচারু সংকলন আমাদের উপহার দেওয়ার জন্য। এই হিম-নিশিথ পরিস্থিতিতে রণেশ দাশগুপ্তের রচনাসম্ভার আমাদের নিশ্চয় দেবে মুক্তিবসন্তের প্রেরণা অশেষ।