অনুবাদেও অসাধারণ

সনৎকুমার সাহা

অবাক হয়েছি খুব। কিন্তু, না। এটি তাঁর প্রথম অনুবাদ নয়। অন্তত একটি ছাপাও হয়েছে। গল্প, উপন্যাস বা কবিতার সংকলন নয়, তা নাটক। এবং পূর্ণাঙ্গ। মূল লেখক জর্জ শেহাদে – লেবানিজ। এর বেশি কিছু জানি না। বিশেষ করে, কোন ভাষায় লেখা। এটুকু অবশ্য আন্দাজ করি, হাসান আজিজুল হক রূপান্তর ঘটিয়েছেন ইংরেজি থেকে। প্রায় চার দশক আগে। তাগিদটা কিন্তু এসেছিল যেমন তাঁর নিজের ভেতর থেকে, তেমনটি বাইরে থেকেও। তখন সেনাশাসনের, প্রত্যক্ষক্ষ, পরে প্রচ্ছন্নে, ‘একুশ আইন’। বিশ্ববিদ্যালয়েও তার প্রভাব প্রকট। সোজাসুজি প্রতিবাদ বারণ। হাসান আজিজুল হক, নাজিম মাহ্মুদ, আলী আনোয়ার, এবং তাঁদের মতো আরো কেউ কেউ খুঁজলেন বিকল্প পথ। একটি নির্দোষ নাট্যচর্চা। তা বিদেশি হলেই ভালো, আমাদের নাম-গন্ধ সেসবে নেই। অথচ বলার কথা সমান্তরাল উঠে আসে ঠিক। শুধু একটা নয়, অনেক অন্যায় ও অসংগতির দিকে চোখ ও মন, দুই-ই ফেরানো যায়। তবে পেছনে কোনো গোপন সংহতি ছিল না। প্রত্যেকে নিজের মতো ভেবেছেন। নাটক করতে ও করাতে গিয়ে একত্র হয়েছেন। এভাবে নিজেদের অজান্তেই, এবং প্রশাসনের নাকের ডগাতেও, তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক মঞ্চে তাঁদের কথা অভিনয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। পেছন ফিরে তাকিয়ে এদের যোগসূত্র এখন যেমন ধরা পড়ে, তখন তেমন আলাদা আলাদা বোঝা যায়নি। হয়তো ভালোই হয়েছে। প্রশাসনের কোপানল এদিকে পড়েনি।

তখন নাজিম মাহ্মুদ জুলিয়াস হে-র একটি নাটক (এরও মূল নাম বা ভাষা আজ মনে নেই) বাংলায় পুরোপুরি রূপান্তর ঘটিয়ে ও মহড়ার সময় প্রয়োজনমতো বাড়িয়ে-কমিয়ে খাড়া করলেন এক যে ছিল ঘোড়া (বিকল্প নাম, উজির ঘোড়ার গপপো)। অভিনয়ে এই তিন মহারথী ছাড়াও ছিলেন আরো বেশ কজন শিক্ষক। নারী ভূমিকায় বিশেষ করে মনে পড়ছে শহীদ হবিবর রহমান-কন্যা রুনু, নাজিম মাহ্মুদ-তনয়া রিআ, রসায়নের অধ্যাপক জিলস্নুর রহিমের মেয়ে পুতুল ও ওই সময়ে তরুণ অধ্যাপক, এখন নামি চিমত্মাবিদ শহীদুল ইসলাম-ভার্যা পলি। রুনুর স্বামী রাজ্জাক ছিলেন কনিষ্ঠ অধ্যাপকদের একজন। তিনিও অভিনয়ে ছিলেন। কবছর পর এই দম্পতি শাসক চক্রের রক্তচক্ষু এড়াতে দেশত্যাগে বাধ্য হন। ডক্টর রাজ্জাক পরিবার প্রথমে আমেরিকা হয়ে এখন অস্ট্রেলিয়ায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাবনা জাগানো নাট্যচর্চায় এঁরাই ছিলেন তখন নিউক্লিয়াস। অবশ্য আরো একজনের নাম উলেস্নখ না করলেই নয়। তিনি রাজ্জাকের ছোটভাই, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উদীয়মান শিক্ষক জাহেদুল হক টুক। এখন নেই। অকালপ্রয়াত। এঁদের চারপাশে জড়ো হয়েছিলেন উৎসাহী আরো একঝাঁক শিক্ষক। কিছু ছাত্রছাত্রীও। তবে সব উদ্যোগেই থিঙ্কট্যাঙ্ক ছিলেন প্রথম তিনজন। পরিচালনা বেশিরভাগ আলী আনোয়ার বা হাসান আজিজুল হকের। নাজিম মাহ্মুদও ছিলেন তেমন কোনো কোনোটির। তবে এই ত্রিরত্নই ছিলেন একত্রে সব নাটকের গুরু। অভিনয়েও। হাসানের বৈশিষ্ট্য ছিল নাটকের সংলাপ মুখস্থ না করা। প্রয়োজনমতো নিজেই বানিয়ে বানিয়ে কথা ঢুকিয়ে দেওয়া। এক যে ছিল ঘোড়ার প্রদর্শনীতে উপাচার্য মহোদয় প্রধান অতিথি। সবজামত্মা ভাব নিয়ে বসে আছেন সামনে। হাসান অবলীলায় ‘মিথ্যাচার্য’ শব্দটি সংলাপের ভেতর ঢুকিয়ে দিলেন। হুল যেখানে ফোটার ঠিকই ফুটল। নীরবে হজম করা ছাড়া ভুক্তভোগীর কিছুই করার ছিল না।

আলী আনোয়ার হ্যারল্ড পিন্টারের ডাম্ব ওয়েটারের অনুবাদ করলেন। নাম দিলেন অনিকেত বেদনা। এটাও অভিনীত হলো। হাসান হলেন ডাম্ব ওয়েটার। নাটকের পুরো সময় এক ঘণ্টা দু-হাতে ট্রে সাজিয়ে নিয়ে একটু কুঁজো হয়ে একভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন। অভিনয় শুধু একটু একটু করে, বোঝা যায় না, এমন, ৪৫ ডিগ্রি ঘোরা। তার টেনস্যনটা দর্শকদের সহ্যের সীমা ছাড়ায়। ওইটিই বোঝাতে চাওয়া। আমাদের বাস্তবতার সঙ্গে সমীকরণ আমরা অনুভব করি। আলী আনোয়ারের আর একটা নাটক পরবাসী। এটাও এখানে মঞ্চ-সফল। এছাড়া উৎপল দত্তের ফেরারি ফৌজটিনের তলোয়ারও তাঁরা করেছিলেন। সবই পরোক্ষক্ষ নিজেদের অবস্থা বোঝানো। কথাগুলো বলা, হাসানের জর্জ শেহাদের নাটক থেকে তার বাংলা রূপান্তর চন্দর কোথায় লেখার ও প্রযোজনার প্রেক্ষিতটা, কিছুটা হলেও চেনাতে। অভিনয়ে হাসানই চন্দর হয়েছিলেন। কিছু কিছু দৃশ্য এখনো চোখে লেগে আছে। এখানে যত নাটক তখন তাঁরা লিখেছেন, তার ভেতরে এটিই শুধু মুদ্রিত হয়ে প্রকাশনার মুখ দেখেছে। অন্যগুলোরও যোগ্যতা কম ছিল না। একদিক থেকে সময়ের দলিলও বটে। সত্য কথা, এসবই ছিল শৌখিন উদ্যোগ। কিন্তু আগে-পরে দেশে-বিদেশে কিছু ভালো নাটক দেখার যে-সুযোগ পেয়েছি, তা থেকে এই ধারণা করতে পারি যে, মঞ্চের ও আলোর কলাকৌশলে এখানে ওইসব প্রযোজনায় অনেক ঘাটতি থাকলেও রচনাগুণে ও অভিনয়ে আমাদের প্রতিভাবানদের যোগ্যতা কারো চেয়ে কম ছিল না। নাজিম মাহ্মুদ ও হাসান আজিজুল হকের, এবং, রুনু ও রিআর অভিনয়-কুশলতা ছিল অসামান্যের ভেতরেও অসামান্য।

হাসান আর কোনো নাটক লিখেছেন কি না জানি না। এই চন্দর কোথায়তে কিন্তু মনে হয়েছে, তাঁর নিজের ভাবনা-প্রতিভারও প্রতিফলন ঘটেছে। আর, নাটকের পরিবেশ সবটাই হাসানের আপন অঙ্গনের। এ যে অনূদিত, মনেই হয় না। তবু এতদিন তাঁর এই একটি অনুবাদের সঙ্গেই আমার পরিচয় ছিল। তাঁর যে-কোনো মৌলিক রচনার পাশে তাঁকে বিন্দুমাত্র বেমানান মনে হয়নি। এবার পেলাম দ্বিতীয়টি। এখন তার কথা। এটা বলার জন্যেই এতটা ভণিতা। হয়তো ধান ভানতে শিবের গাজন গাওয়া। কিন্তু মনে হয়েছে, গাজনটাও উত্তম। ধান ভানায় একটু-আধটু উৎসাহ যদি জোগায়, তবে ক্ষতি কী?

দুই

আগে থেকে জানতাম, হেমিংওয়ে হাসান আজিজুল হকের প্রিয় লেখক। যখন কলেজে পড়েন, তখন থেকেই। তবে এ-ও দেখেছি, সেই ১৯৬০-এ সমকালে যখন তাঁর ‘শকুন’ গল্প বেরোল, এবং সঙ্গে সঙ্গেই সবার নজর কাড়ল, তখন তাতে হেমিংওয়ের প্রভাব প্রত্যক্ষক্ষ এতটুকু নেই। প্রচ্ছন্নে থাকলে তার হদিশ কেবল হাসান-ই দিতে পারেন। তারপর থেকে এ-পর্যন্ত তাঁর কথাসাহিত্যের পুরোটাই ‘তাঁর’। অনুবাদ চন্দর কোথায়-এরও। কিছু কিছু সংকট বা অনুভব আছে, যা বাস্তবের যোগসূত্রে সার্বজনীন। তার উৎস খোঁজাতেও হাসান নিজের জগতেই চোখ রেখেছেন। কী করে বাঁচি, কীভাবে বাঁচব, এসবের উত্তর খোঁজায় বাইরের চিমত্মাবিদদের শরণ অবশ্য তিনি নিয়েছেন। তবে সেসব তত্ত্বের ধারাবাহিকতা তাঁর প্রেক্ষণে কার্যকর ও কল্যাণকর মনে হলে তা মাথায় রেখে। মোটকথা, তিনি বাংলা ভাষায় বাঙালি জীবনে সংযোগ ও সংঘাতের বৃত্ত থেকে বাইরে পা ফেলেননি। ওই বৃত্তে বাইরের যুক্তি-তর্ক-সিদ্ধান্ত যদি ঢোকে, তবে তা ভেতরের শর্ত মেনেই। তারপরও তাঁর লেখা যদি বাইরের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, তবে তার মূলে আছে তাঁর অকৃত্রিম মানব সত্যের অন্বেষণ, যা প্রতিধ্বনি তুলতে পারে সবখানেই। এবং তোলে।

এই প্রক্রিয়ায় হেমিংওয়ে কোথাও সরাসরি ঢুকেছেন বলে আমার জানা নেই। রচনাশৈলীতে হেমিংওয়ের ভাষায় বাহুল্য বর্জনে প্রায় শূন্যমার্গী হয়ে পড়া (প্রায়, কিন্তু যা একেবারে অপরিহার্য, তা বাদ দিয়ে নয়) হাসানের রচনায় উৎসাহ পেয়েছে বলে মনে হয়নি। কথোপকথনের ভাষায় তিনি
যেন, মনে হয়েছে, কোথাও কোথাও স্টাইনবেকের সমগোত্রীয়। এটা স্টাইনবেক না পড়েও সম্ভব। কারণ, বাংলার নিজস্ব কথাসাহিত্যের ধারায় শৈলজানন্দ ও তারাশঙ্কর তার শক্ত ভিত সমসময়েই গড়ে দিয়েছিলেন। হাসানে তা যেন আরো অকৃত্রিম-জীবনঘনিষ্ঠ। কিন্তু গণমানুষের জনপ্রিয়তা (Populism) পেতে নির্বোধ লোকজ সংস্কারের পূর্ণাঙ্গ আয়োজনে তিনি বিন্দুমাত্র উৎসাহ দেখাননি। এখানে তাঁর নৈর্ব্যক্তিক দার্শনিক মন তাঁকে পথ দেখিয়েছে। তা ভিড়কে এড়িয়ে যায় না। ভিড়কে সামনে টানে। তবে চন্দর কোথায় বই হয়ে ছেপে বেরোনোর পরেও দেশে আর কোথাও এর মঞ্চায়ন কেন ঘটে না, আমি বুঝতে পারি না। আমরা তো চেতনাতেও সমৃদ্ধ হয়ে সামনে এগোতে চাই।

সাহিত্যাঙ্গনে হেমিংওয়ের (১৮৯৯- ১৯৬০) আবির্ভাব প্রথম মহাযুদ্ধ পেরিয়ে, অভিজ্ঞতায় মিশেছে তাঁর স্পেনের গৃহযুদ্ধসমেত একাধিক সমরাঙ্গনে জীবনের আকাঙক্ষা, অসারতা ও মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করার তাৎক্ষণিক অভিঘাত। এদের মিলিত-মিশ্রিত ছাপ স্থায়ী হয় তাঁর চেতনায়। অনেক অক্ষয় রচনার প্রেক্ষাপট রচনা করে তারা। লেখায় যদিও আবেগ থাকে প্রায়শই অমত্মঃশীলা। কাহিনি নির্মাণে শৃঙ্খলা তাঁর প্রবাদতুল্য। ছোট ছোট বাক্যের সামষ্টিক বিন্যাস পাঠক-ভাবনায় জাগিয়ে তোলে অব্যক্তের বিশাল বিস্তার। এবং এখানে তাঁর কণ্ঠস্বর মৃদু; প্রকাশমান করে তা পরোক্ষানুভূতি। নির্লিপ্ততা প্রায় অব্যয়-আবছা রেখায় ধরা দেয়। মুছে যায় না। অবশ্যম্ভাবী থেকে যায়।

পাশ্চাত্যে তাঁর পূর্বসূরি, – সমসাময়িকও – কাফ্কা, প্রম্নস্ত, জেম্স জয়েস বা ফক্নার। অভিজ্ঞতার বিস্তারপথ প্রত্যক্ষক্ষ সবার প্রায় এক। কিন্তু সাড়া দেন তাঁরা নানা দিক থেকে নানাভাবে। কাফ্কার মনোজগতে স্থায়ী আসন গাড়ে ওল্ড টেস্টামেন্টের জিহোভা-অদৃশ্য একাধিপতি, নিষ্ঠুর, নির্মম। সংগতিহীন, অকারণ, মানুষের করুণাহীন নিয়তি। কেউ পরিণত হয় গুবরে পোকায়; কেউ-বা অন্তহীন অব্যাখ্যেয় বিচারের মুখোমুখি; আবার আর কারো সামনে দুর্গের প্রবেশদ্বার, যেখানে আজীবন অনলস চেষ্টাতেও তার ঢোকা অসম্ভব। প্রম্নস্ত, জেম্স জয়েস ও ফক্নার, তিনজনই করেন ব্যক্তির অবিরাম চেতনা-প্রবাহের অনুসরণ, যাতে ঘটনার যৌক্তিক সংগতি টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে গিয়ে মনোজগতে একাকার অন্তহীন ভাসমান। প্রাচীন মহাকাব্যের গড়নও হয়তো এমন। তবে প্রবাহ সেখানে ব্যক্তি নয়, সমষ্টিচৈতন্যের। হেমিংওয়ের কাল ব্যক্তির বিপন্নতার সমাধানহীন অসহায়তাকেই প্রকট করে দেখায়। তবে তিনি অকারণ বিভীষিকার কা-জ্ঞানহীন উৎসারণ দেখান না। শান্ত-নির্লিপ্ততায় যৌক্তিক পরম্পরা মেনেই তাঁর কাহিনি বুনে চলেন। পাঠক মনোজগতে কিন্তু নিশ্চিন্ত থাকে না। থাকতে পারে না। কোনো এক অস্ফুট দায়ভার তার ওপর বর্তায়। সে তাকে ঝেড়ে ফেলতে পারে না। এমনটি ঘটে তাঁর উপন্যাস পড়ে। ছোটগল্প পড়েও। বিফলতাই অনিবার্য। তবে স্বপ্ন দেখার সম্ভাবনার দু-একটা ফোকর বোধহয় খোলা থাকে ভরসা পাবার জন্যে, তা অবশ্য যথেষ্ট নয়।

প্রাক-প্রথম-মহাযুদ্ধ পর্বে পাশ্চাত্য কথাসাহিত্যে য়োরোপীয়, বিশেষ করে রুশ ও ফরাসি, প্রতিভাই ছিল বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও শ্রদ্ধেয়। ইংরেজিতে ডিকেন্স হয়তো জনপ্রিয় ছিলেন বেশি। কিন্তু মননশীলতায় বা জীবনবোধের গভীরতায় য়োরোপীয় মূল ভূখণ্ডেরসৃষ্টিকলাই অধিকতর সমীহ আদায় করেছে। কিন্তু তিরিশের দশক থেকে হেমিংওয়ের রচনাশৈলী, নির্লিপ্ততার আড়ালে জীবনের আকুতি, এগুলো য়োরোপে, বিশেষ করে ফরাসি ও স্প্যানিশ কথাসাহিত্যে অনুপেক্ষণীয় ছাপ ফেলতে থাকে। এটা তারাই আজো শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করে। ক্যামুর উপন্যাস, দ্য আউটসাইডার বা দ্য ফল, ছোটগল্প সংকলন, দ্য একজাইল অ্যান্ড দ্য কিংডমের বেশকটি, সার্ত্রর ইন্টিমেসি গল্প সংকলনেরও, হেমিংওয়ের বাহুল্য, এমনকি অলংকার-বর্জিত টান টান নিরাবেগ গদ্য মনে করিয়ে দেয়। পাঠক-চৈতন্যে ভূমিকম্প ঘটে তাতেই।

বাংলা কথাসাহিত্যের ঐতিহ্যে কিন্তু ওয়াল্টার স্কট, ডিকেন্স ও মপাসাঁর প্রভাব প্রবল। সৃষ্টিশীল প্রতিভা অবশ্য প্রত্যেক কথাশিল্পীর নিজস্ব। এই ধারাতে, যদিও সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে, আসেন আজ হাসান আজিজুল হক। অবশ্যই তিনি প্রাচীন কারো মতো নন। এবং তাঁর সমকালে বিশ্বসাহিত্যের অনেক মহারথীও তাঁর মনে সাড়া জাগায়। কিন্তু সবকিছু আত্মস্থ করে যে-শৈলী তিনি নির্মাণ করেন, তাতে আর কারো অধিকার জন্মে না। সে কেবল তাঁর নিজের। রূপকল্পনা, উপমা, বহিঃপ্রকৃতিতে মানবপ্রকৃতির প্রতিফলন বা পরিপূরকতা দেখা এগুলোর ধারা আগে থেকে থাকলেও তিনি এসবের নবায়ন ঘটান, মানব-সমুদয়ের কর্মকাণ্ডেরসঙ্গে তাদের যুক্ত করেন। নব নব সৃষ্টির স্বাদ আনেন। এ থেকে এটা মনে করা অনুচিত হবে, তাঁর সব সৃষ্টি সমজাতীয়। অবশ্যই তা নয়। কিন্তু সৃষ্টিকলায় যেসব ‘উপায়’ তিনি প্রয়োগ করেন, তাদের চেহারা পুরোপুরি বদলে গেলেও অবলম্বন হিসেবে, প্রত্যক্ষক্ষর স্বরূপ উদ্ঘাটনে সহায়ক হিসেবে, অথবা বক্তব্যের পরোক্ষ ইঙ্গিত স্পষ্টতর করায় তারা থাকে। এখানেই হেমিংওয়ের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব অসেতু-সম্ভব। এটা যে-কেউ বুঝতে পারবেন আমৃত্য-আজীবনদ্য ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সি একসঙ্গে খুঁটিয়ে পড়লে। দুটোতেই আছে নিয়তির কাছে মানবভাগ্যের অবশ্যম্ভাবী পরাজয়ের কাহিনি। কিন্তু হেমিংওয়ের নিরাবেগ উচ্চারণ হাসানে নেই, আবার হাসানের সামগ্রে্যর সজীব-সকর্মক প্রেক্ষাপট হেমিংওয়েতে অনুপস্থিত। দুজন দুমেরুর লেখক, তারপরও হাসান এখন হেমিংওয়ের অনুবাদ করলেন। এবং তা মূলের বিষয়ে ও মেজাজে পুরোপুরি একাত্ম থেকে। অনুবাদ নিজেই তা চেনায়। যে-কেউ পরখ করে, দেখতে পারেন।

 

অনূদিত পাঁচটি গল্প আছে এই বইটিতে। হেমিংওয়ের সবচেয়ে বিখ্যাত গল্পের একটি, ‘কিলিমানজারোর বরফপুঞ্জ’ (The Snows of Kilimanjaro)। তাকে নিয়ে গল্প পাঁচটি পরপর এরকম : ১. ব্রিজের ধারের বৃদ্ধ, ২. একটি পরিচ্ছন্ন আলো ঝকঝকে জায়গা, ৩. কিলিমানজারোর বরফপুঞ্জ, ৪. একটি মহৎ সিংহের উপাখ্যান, ৫. শ্বেতহসত্মীর মতো দেখতে পাহাড়গুলো। সব মিলিয়ে নাম, কিলিমানজারোর বরফপুঞ্জ ও অন্যান্য গল্প। প্রকাশনায় বেঙ্গল পাবলিকেশন্স, ঢাকা-২০১৭।

পনেরো বছর বয়স থেকে হেমিংওয়ের প্রত্যক্ষ যুদ্ধের অভিজ্ঞতা। তিনি দেখেছেন আক্রান্ত-বিধ্বস্ত এলাকা থেকে কীভাবে অসহায়-সর্বস্বান্ত মানুষ পালায়। দেখেছেন শূন্যতায় মানুষের শেষ বিন্দু আকাঙক্ষার-বা-আকুতির তুচ্ছ বাস্তবতা। প্রথম গল্পে পাই তারই মিতবাক নমুনা। এ-রকম পলায়নপর মানবস্রোতে এক অবসন্ন বৃদ্ধ সাঁকোর ধার পর্যন্ত এসে আর চলতে পারে না। তার চিমত্মা তখন আর কিছু নিয়ে নয়, তার পোষা অন্যান্য জীবজন্তুর সঙ্গে প্রধানত পায়রাগুলো নিয়ে, যাদের খাঁচার ঝাঁপ সে খুলে দিয়েছে। সে ভাবে, তবুও কি ওরা উড়ে যেতে পারবে? হেমিংওয়ে দেখেন, এবং দেখান, মানুষের সত্তায় মূল বিন্দুতে আকাঙক্ষাকণা কত অকল্পনীয় ক্ষুদ্র, কিন্তু বাস্তব। এই আকাঙক্ষাটুকুও যখন মুছে যায়, তখন শূন্যই বাস্তবের পরিণাম। দ্বিতীয় গল্পে এটাই হেমিংওয়ের বলার বিষয়। এখানে প্রসঙ্গক্রমে আছে কফিহাউসের দুই বেয়ারার কথোপকথনে একজনের একটুকরো ভাবনার ছবি। হাসানের অনুবাদে ‘… মানুষ মাত্রই কিছুই নয়। … সে শুধু এই জানে এটা শূন্য, কিছুই না। জানে যে, যারা ‘কিছুই নয়’-এর মধ্যে আছে তারা জানে, আমার ভেতরটা ‘কিছুই না’। ‘কিছুই না’ তোমার নাম, তোমার সাম্রাজ্য। ‘কিছুই না’ তোমার ইচ্ছা। তোমার ‘কিছুই না’ শূন্যতার মধ্যে শূন্যতা। শূন্যতাই তোমার রাজ্য। তুমি শূন্যতায় পরিণত হবে, শূন্যতারই ভেতরে। …।’ এই বোধোদয় যদি ঘটে, এবং স্থায়ী হয়, তবে কোনো মায়া বা মোহ আর জীবনকে তাড়িত করে না। জীবন-ও না-জীবনে সমীকরণ ঘটে, যার অন্যতম যৌক্তিক পরিণাম, আত্মহনন। অতএব, বিষাদ-ব্যাধি হেমিংওয়ের স্বেচ্ছামৃত্যুর কোনো কারণ নয়। কারণ তাঁর এই চূড়ান্ত আত্মজ্ঞান, যা থাকা-না-থাকার তফাৎ ঘোচায়। তৃতীয়টি The Snows of Kilimanjaro-র অনুবাদ। হেমিংওয়ের অন্যতম সেরা গল্প। এবং এত বেশি আলোচিত যে, বাড়তি কিছু যোগ করা নিষ্প্রয়োজন। শুধু তারিফ করি অনুবাদের। মূলের যথার্থ বাংলা প্রতিলিপি। দেহে, এবং, বোধে। হেমিংওয়ের যথার্থ অনুরণনই আমাদের মর্ম স্পর্শ করে। এবং এখানেও সেই একই নির্লিপ্ত কণ্ঠস্বর।

‘একটি মহৎ সিংহের উপাখ্যান’ Parable যেন। বিদ্যাসাগরের ‘কথামালা’ মনে পড়ে? সেই গোত্রের। তবে হিংসা-অহিংসা উভয় সংকটের যে বুদ্ধিদীপ্ত উপস্থাপন, তা আমাদের সময়ের বাস্তবতাকেও অস্থিমজ্জায় চেনায়। শুধু গল্প হিসেবেই আকর্ষণীয় নয়, আমাদের ভাবতেও বাধ্য করে। অবশ্য তার আগ্রহের জায়গাটা যদি আগে থেকে তৈরি থাকে।

‘শ্বেতহসত্মীর মতো দেখতে পাহাড়গুলো’ – এই সংকলনের শেষ গল্প। এটিও, আমার মনে হয়, হেমিংওয়ের সৃষ্টিতে অন্যতম সেরা। পাহাড়গুলো সাদা হাতির মতো। বোঝা যায়, সাদা হাতি একটা প্রতীক। যেমন প্রতীক কিলিমানজারোর Snows। মনে ভেসে ওঠে এই বার্তা, ওরা মেলে না, কিন্তু মেলার সম্ভাবনা একেবারে শূন্য নয়। স্পেনের এক রেলস্টেশনে ট্রেনের-অপেক্ষারত একজোড়া যুবক-যুবতী। যুবক মার্কিন, যুবতী স্প্যানিশ। প্রেক্ষাপটে অনুমান, যুবক নবাগত। কত হোটেলে তারা রাত কাটিয়েছে, তার উলেস্নখ আছে একবার। তাতেই যেন ইঙ্গিত জটিলতার। স্টেশনের রেস্টুরেন্টে দুজন। কথোপকথনে ঝাঁঝ নেই এতটুকু। ভালোবাসার আবেগও নেই। কিন্তু উদ্বেগ আছে। ফয়সালার তাগিদ আছে ছেলেটির দিক থেকে। মেয়েটি কোনো উৎসাহ দেখায় না। শুধু জানতে চায়, সব কিছু কি আগের মতো থাকবে? ইতিবাচক জবাব পায়। কিন্তু তাতে তার ভাবান্তর হয় না। ছেলেটি আবার বোঝাতে শুরু করলে সে একই রকম ঠান্ডা গলায় বলে, ‘ – দয়া করে কথা বলা বন্ধ করবে?’ ছেলেটি তবু লেগে থাকে। আরো যোগ করে ‘ – অবশ্য কোনো কিছুতেই আমার কিছু এসে যায় না।’ এই যে মমত্বহীন, দায়বোধহীন ক্ষণত্ব, ওই নির্লিপ্ত উচ্চারণে সেটিই উন্মোচিত হয়। প্রতিক্রিয়ায় মেয়েটি বলল, ‘আমি কিন্তু এবার চেঁচাব।’ তারপরও ট্রেন ধরতে পানশালা থেকে বেরোনোর সময় ছেলেটির প্রশ্নের জবাবে জানায়, ‘আমার কিছুই হয়নি। আমি বেশ ভালো বোধ করছি।’ পেতে চাইতাম, কিন্তু পাই না। যা পাই, তা কী জানি না। – সাদা হাতি মর্মে গেঁথে যায়। তাদের। যাঁরা পড়েন, তাঁদেরও।

এখানে যে-পাঁচটি গল্প নিয়ে বলা, তা সবই হাসান আজিজুল হকের অনুবাদে পড়ে। কিন্তু মনে হয়, যেন মূল হেমিংওয়েই পড়ছি। একই রকম কাটা কাটা ছোট ছোট কথা। ভারী শব্দ নেই বললেই চলে। বৈরাগ্য নয়, নির্লিপ্ততা, অসার জীবনের শেষপ্রামেত্ম তুচ্ছ আকিঞ্চন, মাত্র কটি রেখার দাগে প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষক্ষর সংযোগের বা সংযোগহীনতার মৌলিক বাস্তবতা অক্ষয় করে তোলা, সম্পূর্ণ নিরলংকার, নিরহংকার, নির্বিকার, – তাতেই সামনে দাঁড়ায় যা প্রকৃত, তা-ই, আশা নয়, নৈরাশ্য নয়,
সম্যকসমাধি যেন, এসবই যথাযথ ফোটে হাসানের দক্ষ পরিচালনায় তাঁর নিজস্ব ভাষায়।

কিন্তু কেন? হাসানের ভাবনার জগৎ ও সৃষ্টিকলা তো এমন নয়। ভাষার ঐশ্বর্য তাঁকে চেনায়। সেই সঙ্গে এক সামগ্রে্যর প্রেক্ষাপট। লক্ষ্যও। এসবই হেমিংওয়ের বিপরীত মেরুর। তাঁর প্রিয় লেখক হওয়া সত্ত্বেও। আমরা জানি, ক্যামু The Rebel লিখেছেন। The Myth of Sisyphus-ও। তাতে শেষকথা, One should imagine Sisyphus happy। হেমিংওয়ের কাপালিক চোখে happiness ধরা পড়ে না। তাতে তাঁর কিছু আসে-যায় না। কোনো ব্যক্তির ভাগ্যচক্রে চূড়ান্ত বিচারে তা জমাও পড়ে না। ‘মৃত্যুই ধ্রম্নব সখা’ বিকল্প কিছু নেই। হেমিংওয়ে এই অদৃষ্টলিপি পড়েন। আপসহীন নিষ্ঠায় তাকে আত্মস্থ করেন। তাঁর লেখার সততা বিন্দুমাত্র মস্নান হয় না।

কিন্তু অন্য একটা দৃষ্টিকোণও আছে। জীবনানন্দের এক অমোঘ উচ্চারণ, ‘মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়’। বাঁচার প্রেরণা কিন্তু এই মানব প্রবাহে মিশে যেতে পারা। এটুকু ভাবা, ‘আমি যে গান গেয়েছিলেম।’ সেইটুকুই জীবনের অঞ্জলি। অর্থময়তাও সেখানে। ওই প্রবাহের চলমানতায়। আজ পর্যন্ত হাসানের লেখা পড়ে মনে হয়েছে – কোথাও কোথাও অসম্ভব তেতো স্বাদের হলেও – তিনিও এই ধারাকেই যতটুকু পারেন অর্থবহ করতে চান। তা হলে হেমিংওয়েতে অধ্যবসায় কেন?

যদি শৈলী নিয়ে, বিষয়-ভাবনার ব্যাপ্তি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা মাত্র এই অনুশীলনের পেছনে কাজ করে থাকে, তবে আমরা অবশ্যই তাঁর কাছ থেকে অভিনব কিছু পাওয়ার আশায় অপেক্ষা করে থাকব। কিন্তু তাঁর ভাবনাচিমত্মাও যদি হেমিংওয়েমুখো হয়, তবে কি আমাদের হতাশায় প্রমাদ গোনা ছাড়া আর কিছু করার থাকবে? অথবা, যদি ১৮০ ডিগ্রি উলটো-মুখো হন – ফররুখ আহমদ বা আল মাহমুদের মতো – তবে?

সব কিছু বাদ দিয়ে আপাতত এই অনুবাদের কথায় ফিরে আসি। হাসান আজিজুল হক দেখালেন, চন্দর কোথায়-এর পর এতে তিনি লেগে না থাকলেও প্রতিভায় তাঁর এতটুকু মরচে ধরেনি। বরং তা আরো উজ্জ্বল হয়েছে। মেধার নিষ্কাম প্রকাশ বাধা পায়নি। মনের মিল থাক-বা-না-থাক, তাঁর শৈলী এখানে মূলকে এমনভাবে অনুসরণ করেছে যে, তা প্রতিধ্বনিমাত্র, এটা একমুহূর্তের জন্যেও মনে হয়নি। মৌলিক রচনার সব গুণ অক্ষুণ্ণ আছে, আবার পুরোটাতেই হেমিংওয়ের স্বাদ। মেজাজে, বাক-ভঙ্গিমাতে, বাক-সংযমেও। অনুবাদেও হাসান অসাধারণ।