অন্তর্মুখীন অঙ্গীকারের এক উদ্ভিদবিজ্ঞানী

 

এক

দ্বিজেনদা, আমাদের সকলের প্রাণের দ্বিজেন শর্মাকে নিয়ে গুছিয়ে কিছু লেখা খুবই দুষ্কর। কত কথাই তো মনে পড়ে। পরিণত বয়সে চলে গেলেও কীর্তিমান মানুষের মৃত্যুকে সহজে মেনে নেওয়া যায় না। তাঁর রুচি-সংস্কৃতি, পঠন-পাঠনের ব্যাপ্তি, বিদ্যানুরাগ এবং জীবন-অভিজ্ঞতা কতই না বৈচিত্র্যময় এবং সমৃদ্ধ।

তিনি ঔদার্যগুণে এক মহান ব্যক্তি ছিলেন। নিরহংকার ও স্বভাবধর্মে স্নেহপ্রবণ ছিলেন তিনি। সর্বদা মানবের কল্যাণ-আকাঙ্ক্ষার ভাবনায় আলোড়িত; এমন একটি মানুষের সর্বতোমুখী ভাবনা-দেশচেতনা যখন তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে তখন তাঁকে জানা ও উপলব্ধি করা কবি বিষ্ণু দে-র ভাষায় ‘মনেরই’ জয়। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন উটকো বিলোড়নে স্পন্দিত না হয়ে শত শূন্যতা, দুঃখ ও কষ্টেও কেমন করে সুন্দর থাকা যায়।

বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট শিক্ষক ছিলেন তিনি। অন্যদিকে নানা অভিজ্ঞতাঋদ্ধ এবং বহু গ্রন্থের রচয়িতা, উদ্ভিদবিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদ। অগণিত শিক্ষার্থীকে দেশ-আত্মার মর্মবেদনা উপলব্ধির দীক্ষা দিয়েছেন। এই দীক্ষায় দীক্ষেত হয়ে বহু শিক্ষার্থী দেশের ও সমাজের প্রতি অঙ্গীকারের চেতনা নিয়ে নিজেদের গড়ে তুলছেন। তিনি প্রায় সত্তর বছর ধরে প্রকৃতির রমণীয়তা সম্পর্কে এ-দেশের অসচেতন মানুষকে সচেতন করার ব্রত নিয়ে কাজ করেছেন।

তাঁর প্রিয় বিষয় নিসর্গ ও বাগান চর্চা। এ-বিষয়কে উপজীব্য করে তিনি নিরন্তর লেখালেখি করেছেন। শ্যামলী নিসর্গচার্লস ডারউইন তাঁর দুটি অসাধারণ গ্রন্থ। এছাড়াও তাঁর রয়েছে অনেক গ্রন্থ, যা দীর্ঘদিনের সাহিত্য চর্চা ও সাধনার মধ্যে রচিত হয়েছে।

পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের ছিমছাম ঢাকা নিয়ে যখন স্মৃতিচারণ করতেন তাঁর কথায় আমরা উপলব্ধি করতাম প্রতিটি বৃক্ষ এবং এই শহর তাঁর কত না পরিচিত ছিল। সে-সময় বন্ধু ও সখা প্রাবন্ধিক আলী আনোয়ার এই ভ্রমণে তাঁর নিত্যসঙ্গী ছিলেন। হেঁটে বেড়াতেন তাঁরা। এই ভ্রমণ তাঁদের জীবন-অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। সাহিত্য, প্রকৃতি ও বিজ্ঞান তাঁদের আলোচনার বিষয় ছিল।

নিসর্গ ও বাগানের বিন্যাস যে প্রকৃতি রক্ষার মানবিক সৌন্দর্যের অভ্যর্থনায় খুবই প্রয়োজনীয় – এ ছিল দ্বিজেন শর্মার ভাবনার বিষয়। বিগত দুই যুগ ধরে সমাজে প্রকৃতি ধ্বংসের যে-যজ্ঞ চলছে তিনি এক্ষেত্রে প্রতিবাদী ভূমিকা নিয়ে জনগণকে সচেতন করে তুলতেন। প্রকৃতি মানবজীবনে কত প্রাণদায়ী ও সঞ্জীবনী শক্তি নিয়ে জীবনচর্যা ও সাধনাকে সমৃদ্ধ করে, এ-বোধ তিনি সঞ্চারিত করেছেন সমাজে।

এই তো কিছুদিন আগে যখন বহু অর্থব্যয়ে বিদেশি বৃক্ষ দিয়ে বিমানবন্দর সড়কের শোভাবর্ধন করা হচ্ছিল তখন জর্জর শরীর নিয়ে তিনি লেখনী ধারণ করেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, শ্যামল নিসর্গের এই বাংলায় এত ঐতিহ্যমণ্ডত অসংখ্য বৃক্ষ থাকা সত্ত্বেও কেন বহু অর্থের বিনিময়ে বিদেশি বৃক্ষ দিয়ে শহরকে সজ্জিত করা হচ্ছে। এ কোনোভাবেই দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার সহায়ক নয়।

তিনি মনে করতেন, বৃক্ষরোপণও একটি বিজ্ঞান – এতে যেমন বিজ্ঞান আছে, তেমনি নন্দনতত্ত্বও আছে, তেমনি পরিবেশ-চেতনা আছে; অনেক কিছু মিলিতভাবে আছে। সেজন্য বৃক্ষরোপণের জন্য একটা নির্দিষ্ট কমিটি থাকা দরকার, তাদের আলোচনা করা দরকার, প্রজাতি নির্ধারণ করা দরকার, সেগুলো যাতে লাগানো ও রক্ষা করা যায় তার তদারকি দরকার এবং সর্বোপরি দরকার যাঁরা এ-কাজে নিয়োজিত আছেন, প্রকৃতির প্রতি তাঁদের ভালোবাসা। যান্ত্রিকভাবে এসব কাজ সম্পন্ন হয় না। সেজন্যেই বোধকরি নটর ডেম কলেজের উদ্যানটি বহু ভাবনাপ্রসূত ও দৃষ্টিনন্দন।

তাঁকে ঘিরে প্রকৃতিবিদ ও নিসর্গপ্রেমীদের যে-বৃত্ত গড়ে উঠেছিল তাঁদের তিনি নানাভাবে নিসর্গচেতনায় উদ্বুদ্ধ করতেন। রমনা উদ্যানসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে তিনি তাঁদের নিয়ে গাছ চেনাতেন।

ব্রিটিশ রাজত্বকালে যে-নিসর্গবিদ রমনা উদ্যানটি গড়ে তুলেছিলেন দ্বিজেন শর্মার ছিল তাঁর প্রতি অপরিসীম অনুরাগ। এছাড়া বৃহত্তর ওয়ারী এলাকায় প্রতিষ্ঠিত বলধা গার্ডেনের আধিকারিক শত বিরূপতার মধ্যেও এই বাগানটি রক্ষা করেছেন। তাঁর প্রতিও তিনি ছিলেন সশ্রদ্ধ।

দ্বিজেন শর্মাই বোধকরি বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট উদ্ভিদবিজ্ঞানী, যিনি পরিবেশ রক্ষার প্রয়োজন এবং প্রকৃতি ধ্বংসের ভয়াবহতা সম্পর্কেও সমাজকে, বিশেষত নবীন প্রজন্মকে, অবহিত করেছেন।

দ্বিজেন শর্মার আগ্রহ বিজ্ঞানচর্চায়ও। বিজ্ঞানবিষয়ক প্রবন্ধাবলিকেও তিনি পাঠকের জন্য করে তুলেছিলেন বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিবাদী।

তাঁর কৈশোর অতিবাহিত হয়েছে ব্রিটিশ-ভারতে। ওই সময়ের রাজনৈতিক উত্থান-পতন তিনি দেখেছেন। প্রত্যক্ষ করেছেন ওই সময়ে অমিত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাম রাজনীতির বিচ্যুতি। এই বিচ্যুতি তাঁকে বেদনাহত করলেও সমগ্র জীবন বাম রাজনীতির প্রতি তাঁর প্রবল শ্রদ্ধা ছিল।

দ্বিজেন শর্মা বেদনাহতচিত্তে দেশভাগ দেখেছেন; পাকিস্তানি শাসনের পীড়ন ও শোষণ দেখেছেন। মর্মঘাতী-ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা লাখ লাখ মানুষের হৃদয় বিদীর্ণ করেছে – এ প্রত্যক্ষ করেছেন এবং বাস্ত্তচ্যুত মানুষের আর্তনাদ তিনি শুনেছেন। প্রথার শাসন ওই সময়ে কেমন করে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশকে খর্ব করেছে এবং সমাজজীবনে যুক্তি ও মানবিক-চেতনা কীভাবে অপসৃত হয়েছে সে-ও দেখেছেন। আবার গণজাগরণের মধ্য দিয়ে একটি অঞ্চলের মানসে বাঙালির স্বরূপ কতভাবে উজ্জীবিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের যে-পথ নির্মাণ করেছে এ-ও দেখেছেন। এই প্রত্যক্ষণ তাঁকে করে তুলেছে জীবনাভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ, সজীব ও প্রাণবন্ত। যখন অন্ধকার গ্রাস করে সমাজজীবন কিংবা যুক্তি এবং মানবিক কল্যাণবহির্ভূত বোধে আচ্ছন্ন হয়ে যায় সমাজ, আমরা বিমূঢ় ও বিষণ্ণবোধ করি। অভিজ্ঞতায় দেখি তিনি এতটুকুও হতাশ হন না। কোথায় যেন এক অন্তহীন শক্তি, অঙ্গীকার ও বিশ্বাস নিয়ে এই সংকট অতিক্রমের জন্য তিনি সাহস পান।

মস্কো বিশ্ববিদ্যালয় লুলুম্বায় অধ্যয়নরত কয়েকজনকে তিনি খুবই স্নেহ করতেন। তাঁদের জন্য তাঁর দ্বার ছিল সর্বদা অবারিত। এছাড়া বাংলাদেশ থেকে যেসব প্রতিনিধি মস্কো যেতেন নানা কর্মে ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ে তাঁদের তিনি আপ্যায়ন করতেন।

তাঁর সঙ্গে প্রথম কখন, কীভাবে আলাপ হয়েছিল মনে পড়ে না। তবে আমরা জানতাম এই মানুষটির নিসর্গপ্রেম কত সূক্ষ্ম। নটর ডেম কলেজের বাগান বিন্যাসে কত পরিশ্রম করে একটি চরিত্র সৃষ্টি করেছিলেন। চিন্তাপ্রসূত ভাবনায় বৃক্ষসজ্জাও যে কত দৃষ্টিনন্দন হতে পারে, এই বিদ্যায়তনের বাগানটি দেখলে তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য হয়ে ওঠে।

তিনি যখন মস্কো প্রগতি প্রকাশনায় চলে যান চাকরি নিয়ে তখন থেকে তাঁর সঙ্গে নিবিড় এক সখ্যের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মস্কোতে থাকাকালীন (১৯৭৪-৯২) তাঁর লেখা অধিকাংশ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে ‘সংবাদ সাময়িকী’তে। আমি তখন ‘সংবাদ সাময়িকী’র সম্পাদক। নিরন্তর তাগিদের ফলে ওই সময় তাঁর প্রিয় বিষয় নিসর্গ বাগান পরিচর্যা এবং পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে যেসব বিরল বৃক্ষ ঢাকায় ছিল, যা নাগরিকদের হৃদয় ও মন হরণ করত, তা নিয়ে তিনি অজস্র প্রবন্ধ লেখেন। বিজ্ঞানেরও নানা প্রসঙ্গ তাঁর লেখালেখিতে প্রণিধানযোগ্য হয়ে উঠেছে তখন। বিশেষ করে ওই সময় স্মৃতির তাড়না থেকে রচিত কত না প্রবন্ধ আমাদের উজ্জীবিত করেছে। সৃজনশীল বন্ধুর ও আত্মজনের সৃজন-উৎকর্ষ নিয়ে, ভাবনা নিয়ে এবং অর্জন নিয়ে তিনি ওই সময় অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন। কোনো কোনো বই পাঠের অভিজ্ঞতার কথাও বলেছেন। তাঁর পঠন-পাঠন এবং সাহিত্যে ও বিজ্ঞানে তাঁর অনুরাগ যে কত তীক্ষ্ণ ছিল, এসব প্রবন্ধে তা ধরা আছে। কোনো বাগান, বৃক্ষকে বিষয় করেও তিনি লিখেছেন। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের বৃক্ষশোভিত ঢাকা যে কত পরিচ্ছন্ন ছিল, বৃক্ষের শোভায় কত মনোগ্রাহী শহর হয়ে উঠেছিল – সে কথাও লিখেছেন। ঢাকা ছিল তখন একান্ত পরিম-লের চেনা শহর। প্রতিটি ধূলিকণা এবং বৃক্ষ আপনজনের মতো হয়ে উঠেছিল। এ চেনা শহর কখন যে অচেনা হয়ে গেল সে-কথাও বলেছেন তিনি। যথাযথ পরিকল্পনার অভাবে স্থাপত্যে, ভবন নির্মাণে, সৌন্দর্যহীনতায় বৃক্ষ পরিচর্যার অভাবে এ-শহর আকস্মিকই এক নৈরাজ্যময় শহরে পরিণত হলো – এ নিয়ে তাঁর দুঃখ ও কষ্টের কথাও বলেছেন। অথচ পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে এই শহরের যে-চরিত্র গড়ে উঠেছিল তা থেকে কতভাবেই না প্রেরণা সঞ্চয় ও রস গ্রহণ করা যেত। শহরের কোনো কোনো অনুষঙ্গ তাঁকে গভীরভাবে টেনে নিত স্মৃতির অন্দরমহলে – এসব লেখায় তা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। তিনি বোধকরি প্রথম কথাসাহিত্যিক মাহমুদুল হকের দেশভাগভিত্তিক উপন্যাস কালো বরফ প্রকাশের অব্যবহিত পরেই গ্রন্থটিকে অসামান্য বলে উলেস্নখ করেছিলেন। এই গ্রন্থের নায়ককে বাংলা উপন্যাসে একজন উলেস্নখযোগ্য আউটসাইডারও তখন বলেন তিনি। দেশত্যাগের উন্মূল বোধ এই নায়ককে তাড়া করে সর্বদা। প্রেমে, অপ্রেমে এবং দৈনন্দিনতায় নায়ক শিকড়হীন বোধ নিয়ে অচরিতার্থতার বেদনায় কেবলই খোঁজে আপন সত্তা। জীবনদৃষ্টির গভীরতায় এমন বিশ্লেষণ দ্বিজেন শর্মার পক্ষেই সম্ভব হয়। এসব প্রবন্ধ আমি পেতাম মস্কো থেকে। ওই সময়ে আমার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ আরো নিবিড় হয়ে ওঠে, যখন আমি প্রতি বৃহস্পতিবারের ‘সংবাদ সাময়িকী’ নিয়মিত মস্কো পাঠাতে শুরু করি। দ্বিজেন শর্মা ২০০০ সালে এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে এই যোগসূত্রের কথা উলেস্নখ করে বলেছেন, ওই সময়ে বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গে এবং বিশেষত সাম্প্রতিক ধারার সাহিত্যের সঙ্গে ‘সংবাদ সাময়িকী’ তাঁকে সজীব ও প্রাণবন্ত করে রেখেছিল।

 

দুই

দ্বিজেন শর্মা সত্তর বছর ধরে প্রকৃতির রমণীয়তা সম্পর্কে পাঠকের অভিজ্ঞতার দিগন্ত প্রসারিত করার ব্রত নিয়ে কাজ করেছেন। বিশেষজ্ঞের মতো বাগানের বিন্যাস কেমন হবে এ নিয়ে নিরন্তন পাঠককে সজাগ করেছেন। আমরা উপলব্ধি করি, প্রকৃতির উজ্জীবনের সঙ্গে মানবকল্যাণ নিহিত এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য প্রকৃতি চর্চা কতই না প্রয়োজনীয়।

দেবী শর্মার, তাঁর জীবনসঙ্গিনী, কিছুদিন আগের একটি মন্তব্য আমাদের মনে গেঁথে যায় এবং দ্বিজেন শর্মার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য খুবই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তিনি বলেছেন, ‘বন-জঙ্গল থেকে আনেন দুর্লভ ও বিপন্ন প্রজাতির গাছগাছালি, লাগান বাংলা একাডেমি, শিশু একাডেমি চত্বরে ও রমনা পার্কে। শুনেছি, আমার শ্বশুরমশায়েরও এমন নেশা ছিল, গাছপালা লাগাতেন পথেঘাটে, অন্যের বাড়ি। আপাতত এসব নিয়ে ভালোই আছেন দ্বিজেন শর্মা।’

এ ছাড়া আমরা জানি যে, ‘দ্বিজেন শর্মা বড় হয়েছেন পাহাড়ি এলাকায়, ওখানকার নিসর্গ তাঁর অস্থিমজ্জায় – তেমন একটি শোভা সৃষ্টি করতে চাইতেন আমাদের সমতল বাংলায়, সেটা হয়ে উঠত না, যেজন্য এই উচাটন।’

 

তিন

দ্বিজেন শর্মা বেশ কিছুদিন ছিলেন মস্কোতে। ওই সময়ে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন সমাজতন্ত্রে মানবমুক্তির অভিযাত্রার নানা অনুষঙ্গ। ওই সময় রুশ সাহিত্য ও মানস সম্পর্কে অবলোকন খুবই উদ্দীপক হয়ে উঠেছিল তাঁর প্রত্যক্ষণে। একই সঙ্গে রুশিদের স্বাচ্ছন্দ্য, সুখ, সংস্কৃতি-চেতনা ও আন্তর্জাতিকতা বোধ তাঁকে মুগ্ধ করেছিল এবং রুশিদের অধ্যয়নপ্রীতি কত যে বৈচিত্র্যময় ছিল এবং বিষয়ের গভীরতাকে নানাভাবে তাঁদের জীবন ও মননকে সমৃদ্ধ করত – এ বিষয়ে দ্বিজেন শর্মার বহুমুখী অবলোকন রয়েছে। পরবর্তীকালে তিনি দেখেছেন সমাজতন্ত্র ভেঙে পড়ার ঘটনাবলি। মানবকল্যাণের জন্য ও মানবিক হওয়ার সাধনায় সমাজতন্ত্র এখনো যে কত প্রাসঙ্গিক জীবন-অভিজ্ঞতা দিয়ে এ-কথাও তিনি বলতে চেয়েছেন। সমাজতন্ত্রে তাঁর আস্থা ও প্রত্যয় যে কত প্রবল ছিল এবং রাশিয়া সমাজতন্ত্রের পতনের পরও মার্কসবাদ একটি আদর্শ হিসেবে তার প্রাসঙ্গিকতা যে হারায়নি সে-কথা তিনি বারংবার উলেস্নখ করেছেন। দু-একটি লেখনীতে এ-প্রসঙ্গে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিও বিধৃত হয়েছে।

আমার দৃঢ়বিশ্বাস, দ্বিজেন শর্মা উদ্ভিদবিজ্ঞান, বিজ্ঞানচেতনা, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা ও সমাজতন্ত্রের অভ্যুদয়, পতন ও সম্ভাবনা নিয়ে যে-কথা বলতে চেয়েছেন তার গুরুত্ব ও তাৎপর্য কম নয়।

 

চার

আমি এক বছর মস্কো ছিলাম। এই মস্কো শহর দ্বিজেনদারও প্রিয় শহর। সেজন্য দ্বিজেন শর্মা সম্পর্কে বলতে গিয়ে আমার মস্কো শহর প্রসঙ্গের অবতারণা। এই শহরের শিল্প-সাহিত্যের নানা প্রবণতা, অঙ্গীকার ধরা পড়েছিল আমাদের চোখে। প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম মস্কোর। বড়ই সযত্নলালিত বৃক্ষশোভিত এই শহরকে ভালো না বেসে পারা যায় না। জুন-জুলাই মাসে মস্কো শহর সবুজের সমারোহে নিবিড় সৌন্দর্যে মনকে ভরে দেয়, তা সত্যিকার অর্থে প্রাণ ও মনকে করে তোলে সজীব। আর তুষারপাত নিঃসঙ্গতায় হতাশায় ও আনন্দে এমন এক বোধে আচ্ছন্ন করে, যা জীবনের সম্পূর্ণতার সঙ্গে নিবিড় সংযোগ তৈরি করে আর আমিত্বের অন্তর্মূল ধরে টান দেয়। এ আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। আলাপচারিতায় দ্বিজেন শর্মাও এই কথাগুলো বলতেন।

সে-সময়ে রুশ তরুণ-তরুণীদের জন্য বিনোদনের নানা ধরনের ব্যবস্থা ছিল। বিনোদন শুধু সংস্কৃতি ভবনের সান্ধ্য আড্ডা, নাচ ও গানে সীমাবদ্ধ ছিল না। রেস্তোরাঁয় রাত্রিকালীন আহার আমাদের অনেকেরই জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠেছিল। শুধু যে তন্বী রুশি রমণীরা হৃদয়হরণ করেছিল সে-সময় তা-ই নয় – রুশ ব্যালে, থিয়েটার, সিনেমা, চিত্রশালা নিয়েও মেতে উঠেছিলাম সে-সময়ে। যে-কাজে পাঠানো হয়েছিল তা শিকেয় উঠেছিল। সারা হৃদয়-মন জুড়ে ছিল মস্কো থিয়েটার, তাগানকা নাট্যদল আর মায়োকোভস্কি স্কয়ারের সারি সারি নিরীক্ষাধর্মী থিয়েটার হল। কত ধরনের নাটক, চলচ্চিত্র, ব্যালে যে দেখেছি সে-সময় তা বলে শেষ করা যাবে না। বলশয় থিয়েটারে সোয়ান লেক ব্যালেই দেখেছি বেশ কয়েকবার। রুশ কমিউনিস্ট পার্টির আতিথ্যে দীর্ঘদিন অবস্থান করায় বলশয়ের প্রবেশপত্র পাওয়াও কোনো কঠিন কাজ ছিল না।

আর ছিল পুশকিন মিউজিয়াম, যেখানে পনেরো দিন বা এক মাস অন্তর ইউরোপের বিলোড়ন সৃষ্টিকারী সব চিত্রশিল্পীর মৌলিক কাজের প্রদর্শনী হতো। পিকাসো, মাতিস, শাগাল আর ভ্যান গঘের মৌলিক কাজ দেখবার সৌভাগ্য হয়েছিল। শীত ও গ্রীষ্ম উপেক্ষা করে শত শত মানুষ সেই প্রদর্শনী দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকত। বরফ পড়ছে তো পড়ছেই, তবু ভ্রূক্ষেপ নেই। এঁদের ধৈর্যের কাছে সে-সময় আমি ছিলাম প্রণত।

আর সে-সময়ে বইয়ের দোকানে বই কেনার জন্য দীর্ঘ আধমাইলের যে-লাইন দেখেছিলাম প্রথম দিন তা বিস্ময়ে আমাকে অভিভূত করেছিল।

চিত্রানুরাগী মানুষের এই লাইন দেখে আমার কেবলই মনে হতো, সাংস্কৃতিক অভিযাত্রা এবং রুচির বিকাশ কোন পর্যায়ে উপনীত হলে এমন হওয়া সম্ভব।

দ্বিজেনদাও মস্কো শহরের এবং সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের গুণগ্রাহী ছিলেন। আলাপচারিতা ও আড্ডায় এ প্রসঙ্গগুলো হৃদয়গ্রাহী ভঙ্গিতে আলোচনা হতো। তাঁর পরিচিত মস্কো শহর কখন যেন আমারও প্রিয় শহর হয়ে উঠেছিল।

সত্তর ও আশির দশকে আফ্রো-এশীয় গণসংহতি পরিষদ ও আফ্রো-এশীয় লেখক ইউনিয়নের সভা ও সেমিনারে যোগ দিতে কয়েকবার মস্কো যেতে হয়েছিল। একবার নভমিত্ম প্রেস এজেন্সির আমন্ত্রণে দৈনিক সংবাদ পত্রিকা আমাকে মস্কো প্রেরণ করেছিল সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেস সম্পর্কে সংবাদ সংগ্রহ করতে। ক্রেমলিনের প্রেস সেন্টারে বসে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেস দেখা ছিল বিরল এক অভিজ্ঞতা।

মস্কো পৌঁছেই ফোন করতাম দ্বিজেনদাকে। বলতেন, ‘চলে এসো; চেনো তো মেট্রো স্টেশন ইগোজাপাতনায়া। সেখান থেকে বেরিয়ে বাস। তারপর দুই স্টপ পরেই আমার আবাসন।’ খুবই পরিচ্ছন্ন ছিমছাম ছিল এ-আবাসিক এলাকা। দূরের উদার আকাশ নির্মেঘ এবং দিগন্তরেখা এক আরামবোধ এনে দেয় চোখে। কোলাহল নেই। চিনতে এতটুকু কষ্ট হতো না। মস্কো শহরে রাতবিরাতে বা নির্জন স্থানেও কোনো ধরনের কোনো দুর্ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়নি। রুশ কর্তৃপক্ষ সেই সময়ে অনুবাদ এবং অ্যাকাডেমিক কাজে নিযুক্তদের জন্য এই আবাসন গড়ে তুলেছিল। মাত্র পাঁচ কোপেক খরচ করে খুব সহজেই পৌঁছে যেতাম তাঁর গৃহে। প্রাচীন লিফটে উঠে বেল টিপলেই তিনি বেরিয়ে আসতেন। প্রাণের আবেগ ও হাসি দিয়ে অভ্যর্থনা জানাতেন। তারপর আড্ডা আর পানাহার চলত মধ্যরাত অবধি। আমাদের কথা শেষ হতো না। আসলে যে-কোনো শিল্প ও সাহিত্যের আড্ডার প্রাণধর্মিতা হলো কথার রেশ নিয়ে ফিরে যাওয়া এবং ভাবনার বৃত্তকে সম্প্রসারিত করা। দ্বিজেনদার সঙ্গে আড্ডা দিয়ে এই যে অর্জন হতো, তা সমৃদ্ধ করত আমার মানসভুবনকে। পার্টি আমলাতন্ত্রের প্রবল আধিপত্য ছিল সমাজে। এতদসত্ত্বেও সোভিয়েত রাশিয়ার অর্জন এবং সত্যিকার অর্থেই দারিদ্র্যবিমোচন কীভাবে সম্ভব হয়েছিল সে-কথা তিনি প্রায়ই বলতেন। মানুষ যে কতভাবে সমাজতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক চেতনায় নিজেদের সমৃদ্ধ করেছিল এবং আনন্দে থাকত এ আমরা তাঁর পর্যবেক্ষণ থেকে গভীরভাবে অনুভব করতাম।

সেই সময়ে দ্বিজেন শর্মা প্রগতি প্রকাশনায় কর্মরত। কাজ যত না করেন তার চেয়ে অধিক শিল্প-সাহিত্য নিয়ে আড্ডায় মেতে থাকতেন। ননী ভৌমিক, হায়াৎ মামুদ আর খালেদ চৌধুরী এই বুধম-লীর আড্ডা ও ভাববিনিময়ের শেষ ছিল না। সেজন্য আর্থিক ক্ষতি যে কীভাবে পুষিয়ে নিতেন, তা আজো ভেবে পাই না। প্রগতি প্রকাশনে যে বুধম-লীর বা নক্ষত্রম-লীর সমাবেশ হয়েছিল তার পুরোভাগে ছিলেন খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক ননী ভৌমিক। আড্ডায় যাঁর জুড়ি মেলা ভার। সঙ্গে থাকতেন বিশু দাশগুপ্ত আর অরুণ সোম। আমার যখন যাওয়া-আসা তখন এই নক্ষত্রম-লীচ্যুত হয়ে খালেদ চৌধুরী আর হায়াৎ মামুদ ঢাকায় এসে থিতু হয়েছেন। কিন্তু তাঁদের আড্ডার রেশ আর বোহেমিয়ান ধ্যানকে ধারণ করে দ্বিজেন শর্মা মস্কোয় অন্তহীন আড্ডা দিয়ে চলেছেন। আড্ডার অধিপতি বলতে তেমন কেউ নেই। তবু অন্তহীন আড্ডা চলছে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আর কখনো বাংলাদেশ সম্পর্কে জিজ্ঞাসু রুশি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে।

একবার তাঁর ফ্ল্যাটে পৌঁছে দেখি দ্বিজেনদা রান্নাঘরে, বাড়িতে কেউ নেই। জ্যান্ত মাছ কিনে এনেছেন আমার জন্য। গস্নাভস পরে মাছের আঁশ কুটছেন। একটু পরই রান্না বসিয়ে আড্ডা দিয়ে চলেছেন আমাদের সঙ্গে। কথা ফুরাত না। যদিও আমি আড্ডায় কথা বলতে পারঙ্গম নই, তবু দ্বিজেনদার কথা শুনতাম আগ্রহ নিয়ে, কত ধরনের বিষয়ে যে তিনি কথা বলতেন।

 

পাঁচ

দ্বিজেন শর্মা রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতিচেতনা, বৃক্ষভাবনা, সমবায়ভাবনা, হলকর্ষণ ও কৃষি উৎপাদন থেকে পাঠ গ্রহণ করে রাবীন্দ্রিক ধ্যান ও বিন্যাসেরও এক মুগ্ধ পাঠক ছিলেন। আজ থেকে শত বছর আগে রবীন্দ্রনাথ শামিত্মনিকেতনে প্রকৃতি নিয়ে যেভাবে সচেতন করে তুলতেন শিক্ষার্থীদের ও নবীন যুবকদের, এক্ষেত্রে দ্বিজেন শর্মা সর্বদা স্পন্দিত হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ বাঙালি জীবনের সংস্কৃতি ভাবনায়, জীবনচর্যায়, সাধনায় প্রধান অবলম্বন হয়ে প্রতিনিয়ত জীবনকে যেভাবে সমৃদ্ধ করছেন, এও তাঁর মননে প্রোথিত হয়ে ছিল।

দ্বিজেন শর্মা বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলন থেকে অদ্যাবধি বাঙালি সমাজজীবনের অসংগতি ও সংকটমোচনের জন্য যে-সংগ্রাম করেছেন, তা তাঁকে করে তুলেছে দেশের বিবেকবান এক অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। সমাজহিতৈষণা, গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল চেতনা, সুশীল বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও মনীষার ঔজ্জ্বল্যে তিনি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যে প্রাণসঞ্চার করেন, তা বাঙালি জাতির জীবনসাধনায় নবীন মাত্রা সঞ্চার করেছে।

গণতন্ত্র, শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ নির্মাণের যে-স্বপ্নকে তিনি লালন করেছিলেন কৈশোরে, সে-চেতনা তাঁর মধ্যে সর্বদা দেদীপ্যমান ছিল। সেজন্য জাতীয় যে-কোনো সংকটকালে ও মানুষের মঙ্গল-আকাঙ্ক্ষার যে-সংগ্রাম চলছে সমাজজীবনে, তাতেও তাঁর অংশগ্রহণ অগণিত নবীনকে উজ্জীবিত করছে। তাঁর এই বিরতিহীন কর্ম, সাহিত্যবোধ, সংস্কৃতিতে অনুরাগ, প্রকৃতি ও বিজ্ঞান চেতনা, বাঙালির মনন, বুদ্ধিবৃত্তি ও মনীষায় যুক্ত করছে সমাজকে উন্নত বোধে উজ্জীবন। এভাবেই কৃতবিদ্য এই মানুষটির অনন্য ব্যক্তিত্ব ও বহুমুখী কর্ম সুখী ও সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ নির্মাণে প্রাণিত করছে বাঙালি সমাজকে।

 

ছয়

এই যে আমাদের দ্বিজেনদা এবং অসামান্য উদ্ভিদবিজ্ঞানী দ্বিজেন শর্মা সম্পর্কে লিখতে বসে মানুষটির অর্জন এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কি আমি কিছু লিখতে পেরেছি? এই মানুষটির ব্যক্তিত্ব, সৃজনধর্ম বা স্বভাবমাধুর্য নিয়ে বিসত্মৃত লেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি এক্ষেত্রে দক্ষ নই। তিনি এত বছর ধরে এত বিসত্মৃত পরিসরে সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও নিসর্গচেতনা প্রসারে কাজ করে গেছেন, যা বর্ণনা করা সহজ নয়। দ্বিজেন শর্মার জন্ম ১৯২৯ সালে, সিলেটের মৌলভীবাজারের বড়লেখা থানার, শিমুলিয়া গ্রামে। r