অন্যলোক

জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত

ভূলোক

 

এই চন্দ্রাতপে কোন সুখ আসে না। রাত্রির প্রথম প্রহরে অসংখ্য বিবর্ণ আলো আকাশের কোলে ফুটে থাকে। তখন কেবল ঘষা কাচের গায়ে অতিকায় অট্টালিকার সারি কি দূরে জ্বলে নেভে টাওয়ারের আলো। নিচে আরো দূরে নিশ্চয়ই বৃক্ষরাজি দিনমানে স্পষ্ট; কিন্তু তখন কেবল অন্ধকারের স্তূপ। এবং অকস্মাৎ ছড়ানো হলুদের সহস্র বিন্দু মুছে গেলে ফুটে ওঠে যে ঘোলাটে জ্যোৎস্না তাতে কোনো সুগন্ধ পবন ভাসে না।

আমি অস্থির পায়ে সারাদিন সবকটি ঘরের দরজা পার হই, জানালার সামনে দাঁড়াই, কখনো দ্রুতপায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচেও নেমে যাই। বিকেলের দিকে একবার সদর দরজা পার হয়ে ভাঙা দালানের ইটেভরা রাস্তা কি সিমেন্ট-বালির স্তূপ মাড়িয়ে দূরেও চলে যাই। কিন্তু প্রখর গ্রীষ্মের দহন দূরে যেতে দেয় না। ভেজা শরীরে আবার ফিরে আসি। একবার রিকশা নিয়ে চারপাশে সাবধানে চোখ মেলে কাঁচাবাজারের দিকেও গেছিলাম; কিন্তু সেখানে অধিকাংশ ঝুড়ি ওলটানো। রাস্তার পাশে দীনহীন ছোট পসারি দুটি-একটি পাল্লা খুলে রেখেছে মাত্র – বলা যায় না কোন্ দিক থেকে ছুটে আসবে তূণীরাশ্রিত গরল।

সহৃদয় বান্ধবকুল টেলিফোনে খবর নেন মাঝে মাঝে। অকুতোভয় অসমসাহসী কেউ নন। এমনকি প্রকৃতই সাংবাদিক সুহৃদকে টেনে নামিয়ে ‘সংবাদপত্র’ লেখা স্কুটারটিতে পেট্রোল ঢালা হয়েছিল।

ইহলোক

পূর্বাহ্নে যথাসাধ্য চেষ্টা ছিল সামনের পাঁচদিন যেন অনাহারে না কাটে। কিন্তু তারপর কী করা। এই মধ্যরাত্রিতে ম্লান জ্যোৎস্নায় কী করি। দ্বাদশবর্ষীয় পুত্রটি কখনো টেলিভিশনের সামনে বসে থাকে, কখনো ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখে। তার মা কখনো তাকে নিয়ে বসে তার পড়ার টেবিলে, কখনো বিছানায় ওঠাবসা করে। কখনো ঘুমোয়। আমার ঘুমও আসে না।

পুত্রটি মেধাবী নিঃসন্দেহে, গল্পকল্পে বিশ্বাসী, অথচ ক্লাসের খাতায় কি স্কুলের পরীক্ষায় বোঝা যায় না। দিনরাত্রির অধিকাংশ কাটে তার টেলিভিশন কি কম্পিউটারের সামনে। নানা কথা বলি তাকে, বোঝাই। এমন বুদ্ধিমান, অসাধ্য কিছু নয় তার। চুপ করে থাকে। একান্ত অসহ্য হলে ক্রিকেটের ব্যাট হাতে নিয়ে রাস্তায় নামে। দুপুরের রৌদ্রে ক্বচিৎ রিকশা চলে গেলে কি পড়ন্ত দুপুরে তারই মতো কয়েকজনের সঙ্গে ব্যাট-বলে রাস্তা কাঁপানোর চেষ্টা করে। তারপর আবার ঘরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দেয় কি বাইরের ঘরে বসে টেলিভিশনের সামনে।

দিনের বেলায় আমি ও তার মা চেষ্টা করেছিলাম দূরে যাওয়ার। ছেলেটিকে সামনের রাস্তায় আরো কজনের সঙ্গে খেলায় ব্যস্ত দেখে পাড়ার পরিচিত রিকশায় উঠে বসেছিলাম দুজনে। চারপাশে নজর রেখে সন্ত্রস্ত আমরা পৌঁছেছিলাম দূর-গন্তব্যে দ্রুতই বলা যায় – কোনো দুর্ঘটনা ছাড়া। বান্ধব-সন্নিধানে প্রায়প্রফুল্ল দ্বিপ্রহরের শেষদিকে ছেলেটির টেলিফোনে ঘরে ফিরতে হয়েছিল দ্রুত। লম্বায় আমাকে ছাড়াবে বুঝি সে আর কিছুকাল পরেই, তবুও সে বড়ো সরল। শিশুর মতোই। রাস্তায় কারো সঙ্গে অশান্তি সৃষ্টি করার মতো সে নয়। তাই অমন ঘটনার কথা শুনে দ্রুত রিকশায় উঠে বসেছিলাম আমরা। ফিরতি পথ এবারে অনেক দীর্ঘ ছিল।

ঘরে ফিরে সব শুনে ক্রোধে কাঁপা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। সামনের বাসার অসমবয়সী দুর্বিনয়ী, যেন সন্ত্রাসী, বেতনভোগী গাড়িচালকের অভাবনীয় ব্যবহার নির্বাক করে দেয়। এ কী সম্ভব! সে ছেলেটিকে মেরেছে। ভিন্ন বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে সব কথা তার মনিবকে বলেছিলাম। যে-ছেলেকে ক্বচিৎ শক্ত কথা বলি আমরা, তার গায়ে হাত তোলার সাহস হয় কী করে ওই গাড়ির ড্রাইভারের। যদিও মনিবের কথায় আমাদের কাছে ক্ষমা চেয়েছিল সেই দুর্বৃত্ত – নেহাত অনিচ্ছার সঙ্গে, না চাইলেও কিছু করার ছিল না।

সেই দুপুরের পর থেকে আর কোথাও যাইনি। বিকেলে পাড়ার রাস্তায় খানিকক্ষণ ঘুরে বেড়াই। অনেক রাত পর্যন্ত টেলিভিশনের সামনে কেটেছিল গতকাল কিন্তু আজ রাত্রিতে কী করা!

তার মা ছেলেটির সঙ্গী হবে বলে বুঝি জার্মান কুলজির কুকুরশাবক এনে দিয়েছিল একটি। এখন দু-বছর বয়সের জার্মান  সারমেয় সর্বদাই ছেলেটির সঙ্গে খুনসুটি করতে চায়। অনেক নিষেধ করা সত্ত্বেও সে কুকুরটিকে নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি কমায় না। অ্যালার্জি অ্যাজমা জাতীয় নানা উপসর্গ বাড়ে কুকুরের সংস্পর্শে। মহাবিরক্ত হয়ে মাঝে মাঝে ছেলেটিকে এবং প্রায়শ কুকুরটিকে গালাগাল করি। অথচ ছেলেটির একাকিত্বের কথা ভেবে কুকুরটিকে ছেড়েও দিতে পারি না। সে তাকে স্নোয়ী বলে ডাকে, আমি বলি শুধু কুকুর। সেটিও তার ক্রোধের কারণ।

দুপুরের পর থেকে ছেলেটি আর বাইরে যায়নি। ঘরের দরজা বন্ধ তার। সন্ধ্যায় বিক্ষিপ্ত মন কোনোমতে কুকুরটির ঘর নোংরা করার অপরাধ মেনে নিতে পারেনি। আমি তাকে ছু্&&ঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম বারান্দায়। ‘মরেও যেতে পারতো’ এই যুক্তিতে আমার সঙ্গে কথাকাটাকাটির পরে সন্তান তার ঘরের দরজা বন্ধ করেছিল। অনেক ডাকাডাকির পরে একবার খাবার টেবিলে এসে বসেছিল মাত্র।

আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘কেউ কিছু বলেছে রাস্তায়? কিছু করেছো?’ না, কেউ কিছু বলেনি, কিছুই করেনি সে। সেই ড্রাইভার ও তার কিশোর মনিবপুত্রের সঙ্গে কথা বলে বুঝি, আমার ছেলেটি ভিন্ন জল-হাওয়ায় বড়ো হওয়ার ফলে, ভিন্ন সাংস্কৃতিক আবহাওয়ার সঙ্গে অধিক পরিচিত হওয়ার সূত্রে এমন কিছু শব্দাবলি, কথাবার্তা রপ্ত করেছে, যা এই সমাজে যথেষ্ট পরিচিত নয়, গ্রাহ্যও নয়। সে জানে না রাস্তায় যারা খেলে তাদের কথা। তাদের সঙ্গে গল্পও জমে না তার – ইউএফও, মিনোটর, কি ডার্ক ভেডারের গল্প তার স্কুলে হয়তো চলে কিন্তু পাড়ায় নয়।

ছেলেটি বুদ্ধিমান, কল্পনাপ্রবণ অথচ বিজ্ঞানমনস্ক – এই আমি জানি। নানা সময়ে পরিচয় পেয়েছি তার। প্রত্যুৎপন্নমতি, নিঃসন্দেহে। এসব কারণে সন্তানটিকে নিয়ে আমাদের কিছু গর্বও ছিল। কখনো-কখনো নানা প্রসঙ্গ আলোচনাকালে তার বয়সের ব্যাপারটি গ্রাহ্যও করতাম না আমরা। তার মা বলেন, জাগতিক ব্যাপারে ছেলেটি প্রায় শিশুসমান, সরল, অথচ বিজ্ঞান কি স্বয়ংক্রিয়তা বিষয়ে প্রায় পেশাদারের ব্যুৎপত্তি।

টেলিভিশনের সামনে থেকে উঠে দেখি দূরের অধিকাংশ জানালার আলোই নেভানো। কোন জানালার কাচে ছায়া পড়ে না। বাড়ির সামনের পথে কোন শব্দ নেই। জানালায় ম্লান জ্যোৎস্নার চাঁদ। খোলা দরজা দিয়ে বেরুলে দেখি ছেলেটির ঘরের দরজা  বন্ধ। নিচ দিয়ে আলোর সরলরেখা। এত রাত্রি পর্যন্ত তার জেগে থাকার কথা নয় – তা না-ই থাকুক আগামী আরো দুদিন স্কুলে যাওয়া। যদিও জানি সন্ধ্যায় অসময়ের ঘুম তাকেও জাগিয়ে রাখতে পারে।

বেশ শব্দ করেই দরজা খুলি তার ঘরের। ‘অনেক রাত হয়েছে, শুয়ে পড়’ বলে তার খাটের দিকে তাকিয়ে দেখি সেখানে কেউ নেই। রাতে শুতে যাওয়ার আগে খানিকক্ষণ বইপড়া তার অভ্যাস। মূলত সায়েন্স ফিকশন কী হরর হলেও জোর করে আমি নিজের পছন্দমতো ক্ল্যাসিক্স ঢুকিয়ে দিই মাঝে মাঝে।

সে কি বাথরুমে গেছে? দরজার বাইরে বাঁপাশে বাথরুমের দরজা বন্ধ, ভেতরে কোনো আলো নেই। তবুও খুলে দেখি, কেউ নেই। আমাদের ঘরের বাথরুমও দেখি – না সেখানেও নেই। হলওয়ে পার হলে আরেকটি ঘরের সঙ্গের বাথরুমটিতেও নয়। তাহলে? অস্ফুটে ডাকি তার নাম ধরে। আরো একবার এ-ঘর ও-ঘর  বাথরুমকটি খুঁজে দেখি, না নেই। উৎকণ্ঠা, উদ্বেগে শরীরে স্বেদকণা ফুটেছে, স্পষ্ট বুঝি। তার মাকে একবার ডেকে তোলার কথা ভাবি; কিন্তু তাকে উতলা করার আগে আরো একবার বাইরের দরজার দিকে গেলে দেখি দরজাটি কেবল ভেজানো। দ্রুত বাইরে যাই – কেউ সেখানে নেই। আবার ডাকি তাকে এবং রুদ্ধশ্বাসে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে আসি। ছাদের দরজা খোলা। মরা জ্যোৎস্নার চাঁদ তখন আকাশের নিচে নেমে যাচ্ছে। আমি তার নাম নিয়ে এপাশে-ওপাশে ছুটে যেতে থাকি। সিঁড়িঘরের দুপাশে ছাদ, রেলিংয়ের এক জায়গায় বাঁকও আছে। দ্রুত পায়ে সেখানে গিয়ে দেখি সে কুকুরটিকে সামনে নিয়ে বসে আছে।

মুহূর্তে সমস্ত শরীর শিথিল হয়ে আসে। নিশ্চিন্ত বোধ যেন ম্লান জ্যোৎস্নাকেও উজ্জ্বল করে। দূরে-কাছের নানাতল ভবনের ছায়া একের পর এক স্পষ্ট হয়। আমি তার কাছে গিয়ে হাত ধরি, ‘এ কী অসভ্যতা, এতো রাতে তুমি একা ছাদে। এতো সাহস তোমার।’ সে কেবল নিঃশব্দে বেরিয়ে এসেছে তা-ই নয়, কুকুরটিকেও সঙ্গে নিয়ে এসেছে, আমি টেরও পাইনি। রাগ এজন্যে আরো বেশি হয়।

হাত ধরে তাকে টেনে তোলার চেষ্টা করি। না, সে উঠবে না। চোখ তুলে তাকায় সে কেবল এবং সেই চোখের দৃষ্টি আমি বুঝি না। ক্রোধ কি বিষাদ কিছু দেখা যায় না। শূন্যদৃষ্টি যেন।

এই গভীর রাত্রিতে ছ’তলা দালানের ছাদে পিতাপুত্র আমরা কেবল। আবছা আলোয় দেখা যাচ্ছে কাপড় মেলে দেওয়ার দড়ি। টেলিভিশনের কেবল কি টেলিফোনের তার। কিছু ইটকাঠও ছড়ানো। দূরে তাকালে অনেক ফ্ল্যাটবাড়ির বারান্দায় আলো জ্বালানো দেখা যায়। উঁচু টাওয়ারের মাথায় আলোর জ্বলানেভা দেখে কেমন অস্বস্তি হতে থাকে, অবোধ্য যন্ত্রণাও মনে হয় শরীরে। আমি তার হাত ধরে আবার টানি, ‘ঘরে চলো।’

‘না, তার আগে তুমি বলো স্নোয়ীকে মেরেছ কেন?’ ওঠে না সে।

বড়ো অবাক হই। ওই কুকুরের জন্যে এতো রাগ!

‘তুমি কি পাগল, এই জন্যে কেউ রাগ করে? এতো রাতে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে? চলো ঘরে।’

‘না’ জেদ যেন তার গলায়। ‘তুমি স্নোয়ীর কাছে মাফ চাও।’

এবারে হেসে ফেলি, ‘যথেষ্ট হয়েছে, এবারে ওঠো।’

‘না’ বলে সে দ্রুত উঠে সিঁড়িঘরের দরজা পেরিয়ে নামতে শুরু করে, স্নোয়ীও চারপায়ে একটি লাফ দিয়ে তার পিছু নেয়। তারা দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে।

‘থাম, থাম, পড়ে যাবি।’ পড়ে যাওয়ার ভয় যদিও আমারই বেশি তবুও আমি তার পেছনে নামতে নামতে ডাকাডাকি করি। অন্যসব দরজার আড়ালে যারা আছে তারা যেন উঠে না-আসে তাই  বেশি শব্দও করা যায় না। এক অসহ্য ক্রোধ, বিরক্তিতে শরীর কাঁপায় যেন। ‘দাঁড়াও তোমাকে পাই একবার।’

আমি যখন তিনতলার সিঁড়ি দিয়ে নামছি, তখন সে প্রায় নিচে পৌঁছে গেছে। আমি জানি একতলায়, দালানের সদর দরজায়   পাহারা আছে। এই সময়ে পুত্রের পেছনে দৌড়তে থাকা পিতা ও একটি কুকুর তাকে কী পরিমাণ বিস্মিত করবে খেয়ালে না এনেই আমি কোনোমতে দোতলায় নেমে দেখি সে দাঁড়িয়ে আছে, কুকুরটি তার পায়ের কাছে। আমার দ্রুত শ্বাস পড়ছে। সিঁড়ির  রেলিং ধরে শ্বাস নিতে থাকি। সে কাছে আসে, আমায় নিশ্বাস নিতে দেখে, সে জানে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে কষ্ট হয় আমার – তারপর দোতলায় লিফটের সামনে গিয়ে বোতাম টিপে দেয়। আমি কিছু বলবো বলে শক্ত করে তার হাত ধরতে গিয়ে দেখি তার চোখে জল।

লিফটের দরজা খুললে আমরা উঠে আসি। কুকুরটিও। আর কিছু বলি না তাকে। চারতলায় দরজা খুললে বেরিয়ে আসি। দেখি আমাদের ফ্ল্যাটের দরজা খোলা। দ্রুত বেরোনোর মুখে দরজা টেনে দিতেও ভুলে গেছি।

ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করি। তারপর বারান্দার দরজা খুলে কুকুরটিকে তার জায়গায় পাঠিয়ে দিই। ছেলেটি ততক্ষণে নিজের ঘরে ঢুকে গেছে। পিছু পিছু গিয়ে দেখি বসে আছে বিছানার ওপরে।

আমি বলি, ‘শুয়ে পড়ো।’

মাথা নাড়ে সে, ‘ঘুম আসে না।’ আমি তার সামনে গিয়ে মাথায় হাত রাখি। মুখ নিচু করেই বলে সে, ‘কালকে আমরা বাইরে যেতে পারবো?’

আমি এক মুহূর্ত ভাবি, ‘কোথায় যেতে চাও?’

‘সারিদের বাসায়।’ আমি জানতাম ওই কথাই বলবে সে। শহরের অন্য মাথায় সারিদের বাসা। কী বলি তাকে?

অনেক ভেবে গলা পরিষ্কার করি। তাকে শুইয়ে দিতে দিতে বলি, ‘অনেক দূর, বাবা। রিকশা করে হয়তো যাওয়া যায় কিন্তু কে জানে কোথায় কী হয়। ইট-পাথর ছুঁড়ে মারতে পারে। ককটেল  বোমাও তো আছে তাদের। দেখেছো তো সেদিন কাগজে রিকশা পুড়িয়ে দিয়েছে, রিকশাওয়ালার হাত বোমায় উড়ে গেছে।’

তাকে শুইয়ে গায়ে চাদর টেনে দিই। বাতি নেভাতে নেভাতে বলি, ‘দেখা যাক কাল কী রকম দাঁড়ায়।’

তার ঘরের দরজা টেনে নিজের ঘরে ফিরে আসি। ছেলেকে নিয়ে রিকশা করে অতোদূর যাওয়া ঠিক হবে না স্পষ্ট বুঝি। তবুও ভাবি, একবার চেষ্টা করে দেখবো কালকে। তখনই মনে পড়ে, শুধু কাল নয়, পরশু দিনও বটে। তার পরের দিনও সম্ভবত বাইরে যাওয়া যাবে না। তার পরদিনও কি?

মনোলোক

‘বাবা, দ্যাখো রফিকের বাড়ি।’ কণ্ঠস্বর তার এমনই ছিল যে সেই মুহূর্তে ওই কথায় সাড়া দিই না। একটু পরই যখন ‘রফিকের বাড়ি’ আবার কানে বাজে তখন তার দিকে ফিরে তাকাই। বলি, ‘রফিকের বাড়ি মানে? কোথায়?’ মেয়েটি গাড়ির পেছনে কাচের দিকে নির্দেশ করে মুখ ফিরিয়ে বলে, ‘ওই যে, ওখানে।’ ততক্ষণে অনেকদূর চলে এসেছি।

অভাবী গ্রামীণ রমণীর সন্তান রফিক। গৃহকর্মে নিপুণা ও পরম বিশ্বাসী বলে মায়ের সঙ্গে তার দশ বছর বয়েসি ছেলেটিকেও থাকতে দিয়েছেন গৃহকর্ত্রী। এবং দুঃখী পরিবারটির উপকারচিন্তায় তাকে স্কুলেও ভর্তি করে দিয়েছেন।

 

আমার কন্যাটি রফিকের চেয়ে বয়সে ছোট হলেও ক্লাসের পড়ায় এগিয়ে আছে। আর ইংরেজি স্কুলে পড়ে, সে-কারণেও রফিককে শিষ্যের মতোই দেখে সে। কখনো-কখনো ঘরের কাজে হাত লাগানো, আমার ছোটখাটো ফরমায়েশ খাটা, স্কুলে যাওয়া কি স্কুলের পড়া তৈরি করার বাইরে রফিক তাই তার গুরুর আদেশ পালনে সর্বদা আগ্রহী। এবং গুরুও উদারহস্তে এজন্য পুরস্কৃত করেন। তার বিকল বৈদ্যুতিক খেলনা কি প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া রঙের কৌটা, ছোট হয়ে যাওয়া ক্রেয়ন, রঙিন পেনসিল, এমনকি কয়েকটি পৃষ্ঠাসহ তার ড্রয়িংয়ের খাতাটিও অকাতরে রফিককে দিয়ে দেন তিনি।

ওইসব কাগজে নানা রঙের ছোট ছোট রঙিন চক ব্যবহার করে রফিক ছবি আঁকে। শিষ্যের কৃতিত্বে মুগ্ধ কন্যাটি মাঝে মাঝে সেই সব সৃষ্টি মাকে দেখায়। কখনো-কখনো আমাকেও। অবশ্য ‘কাজী নজরুল ইসলাম’-পরিচয়ে চিহ্নিত মানবমুখের আদলটির মাথার চুলে লাল রং এবং জামার সবুজ রং আমি মেনে নিইনি। অন্তত জামাটি হলুদ রঙের হলেও চলতো। কন্যা লজ্জিতমুখে স্বীকার করেছিল, চুলের জন্য কালো আর জামার জন্যে হলুদ রঙের অভাব ছিল রফিকের।

স্কুলের ড্রয়িং ক্লাসেও রফিকের অঙ্কন-পারদর্শিতার কথা প্রচার হয়েছিল সম্ভবত। এ-কারণে গভীর মনোযোগের সঙ্গে গুরুর তত্ত্বাবধানে তাকে মাঝে মাঝে চিত্রাঙ্কনে ব্যস্ত থাকতে দেখেছি। কিছুদিন আগে মেয়েটি তার শিষ্যের একটি ছবি আমার সামনে ধরে বলেছিল, ‘দ্যাখো বাবা কী সুন্দর বাড়ি।’ একমাত্রিক প্রাসাদোপম বাড়িটির পেছনের পুকুরটি বাড়ির ঠিক ছাদের ওপরে আঁকা, জলের রং লাল, দোতলা বরাবর আঁকা বাগানের সব ফুলই হয় সবুজ, না হয় কালো, জানালার চাইতে দরজা ছোট – সম্ভবত ঘরের মধ্যে খাট-পালঙ্ক কি টেলিভিশন সেট দেখানোর জন্য। আমি অন্য কাজে ব্যস্ত তাই বলেছিলাম, ‘তা ভালোই তো।’ শুনে কন্যা কিঞ্চিৎ দুঃখিত মুখে বলেছিল, ‘কিন্তু ওর ছবি ক্লাসের দেয়ালে টাঙ্গায়নি জানো?’ তারপর একটু থেমে বলেছিল, ‘রং নাকি ঠিক হয়নি – সব রং ছিল না সে তো ওর দোষ নয়।’ সেই শুরু। তারপর মাঝে মাঝেই সে দেয়ালের ক্যালেন্ডারে কি ছবির বইয়ে আঁকা বাড়ি দেখলেই বলত, রফিকের বাড়ি। এমনকি গ্রীষ্মের ছুটিতে যখন তাকে নিয়ে আর্ট মিউজিয়ামে গিয়েছিলাম সেখানেও স্টুয়ার্ট ডেভিসের একমাত্রিক টাইমস স্কোয়ার দেখিয়ে সে বলেছিল, ‘বাবা দ্যাখো, রফিকের বাড়ি।’ এই হচ্ছে রফিকের বাড়ির ইতিবৃত্ত।

সেদিন অভিজাতপাড়ার মধ্য দিয়ে আসার সময়ে দেশবরেণ্য ধনকুবেরের নানা রং-মেলানো প্রায় অলৌকিক বাড়িটিকে সে সম্ভবত ‘রফিকের বাড়ি’ বলে চিহ্নিত করেছিল।

রফিকের হাত ইদানীং আরো পাকা হয়েছে। কখনো-কখনো এখানে-সেখানে আঁকা তার দু-একটি ছবি দেখতে পাই। কন্যাটির পড়ার টেবিলেও। মূল্যায়নের জন্যে দেওয়া হয়েছে চিত্র-সমালোচককে বুঝি। বিষয়বস্ত্ততে বৈচিত্র্য এসেছে। নানা পশু, পাখি, মায় বাড়ির পোষা জার্মান স্পিৎজ স্নোয়ী পর্যন্ত। সাদা রঙের সারমেয়ের গায়ে হালকা বাদামি ছোপ বোঝাতে গাঢ় লাল রঙের ব্যবহার নিঃসন্দেহে দৃষ্টিহারী। রং ছিল না, তা বুঝি।

কয়েকদিন আগে রফিক স্কুল থেকে খুবই মন খারাপ করে ফিরেছিল। এমনকি গুরুদেবের নানা সান্ত্বনাও তার মন ভালো করতে পারেনি। এবারে ড্রয়িং স্যার যে কেবল তার কুক্কুটের ছবি দেয়ালে টাঙাতেই অস্বীকার করেছেন তাই নয়, ছবিটি নাকি একবার দেখেই তিনি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। মোরগই সম্ভবত। পৃষ্ঠাজোড়া ছবিটির প্রতি আধইঞ্চি অন্তর রং পালটেছে। বাঁ থেকে ডাইনে। ওপর থেকে নিচে। রং ব্যবহারে ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য। চোখদুটি কালো ও ঝুঁটিটি নীল। হলুদ ঠোঁট দেখাচ্ছে গাঢ় বেগুনি। মোটাতাজা শরীরে লাল-নীল-বাদামি লাঠির মতো পালক উড়ছে কিছু কিছু। মোটা লম্বা দুটি পায়ে দাঁড়ানো। টকটকে লাল রঙের পা। নখ সবকটিই কালো রঙের। সম্ভবত কালো দিয়ে রঙের ব্যবহার শুরু হয় বলে।

আমিও একবার দেখেই ছবিটাকে কফি টেবিলের ওপরে রেখে দিয়েছিলাম – টেবিলের নিচে খবরের কাগজের স্তূপের সঙ্গে রাখতে পারিনি। রফিকুন নবীর অত্যুজ্জ্বল, বিচিত্র বর্ণের বলদর্পী কুক্কুটকুলের চিত্রাবলি তখনো আমার চোখে স্পষ্ট ছিল বলেই সম্ভবত।

ছবিটি কয়েকদিন টেবিলে পড়ে ছিল। তারপর মুরগির ছবিই তো, কোথায় গেল কেউ আর মনে রাখেনি। রফিক দু-একবার খোঁজাখুঁজি করেছিল। তার গুরুদেবও। পরে খুঁজে না পেয়ে দুজনেরই দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে, মুরগিটি উড়ে গেছে। হোক তা কাগজে আঁকা ছবি কিন্তু যখন সেটি পৃথিবীর সব রং দিয়ে আঁকা  হয়, সমস্ত ভালোবাসার সঙ্গে, জীবন আসে সেখানে। পরের যুক্তিসমূহ আমিই তাদের জুগিয়েছিলাম মুরগি উড়ে যাওয়ার               কথা শুনে।

আমাদের সামনের বাড়িতে প্রাণিবিদ্যার এক অধ্যাপক বাস করেন। কিছুকাল আগে অবসর নিয়ে এখন বাগানে ফুল-লতাপাতার পরিচর্যায় সময় কাটে তাঁর। প্রাণিবিদ্যা ও পুষ্পবিদ্যা খুব কাছাকাছি এজন্যেই সম্ভবত। আমি তাঁর কাছে রফিকের মুরগির গল্প করেছিলাম, নানা কথার মাঝে। অধ্যাপকের সারাজীবনের শখ ছিল এমন একটি প্রজাতি আবিষ্কার করা যা আগে কেউ করেনি। ওই রকম ঘটলে ওই প্রজাতিটির নামের সঙ্গে তাঁর নামও জুড়ে থাকতো। রফিকের মুরগির বিচিত্র বর্ণ ও চেহারার কথা শুনে অধ্যাপক আফসোস করে বলেছিলেন, ‘সত্যি সত্যিই যদি ওটি আমার বাগানে উড়ে আসত।’

স্ত্রীকে কথাটি আমি বলেছিলাম। তার মায়ের সঙ্গে গল্প করার মুহূর্তে মেয়েটি হয়তো সে-কথা শুনে থাকবে। এবং সেজন্যই রফিককে যখন সে বলে, মুরগিটি রাস্তা পেরিয়ে ওই সামনের বাগানে উড়ে গেছে। তখন আমি অবাক হইনি। তবুও তনয়াকে বলি, ‘এরকম হয় না। কাগজে আঁকা মুরগির ছবি কখনো জীবন পায় না।’ সে যে এ-কথা খুব অবিশ্বাস করে এমন নয়, তবুও বিশ্বাসের বাইরে কিছু নেই এ-কথা কে বলবে? অবশ্য আমিই তাকে ওই যুক্তি শেখাই তার মলিন মুখ দেখে।

‘তাই যদি হয়’, সে আমাকে বলে, ‘ধরো রফিকের মুরগি যদি সামনের বাড়িতে উড়ে গিয়েই থাকে তাহলে ওরা কী করবে? খেতে তো পারবে না।’ আমি স্বীকার করি ওই শতবর্ণের মুরগি কারো পক্ষেই হজম করা সম্ভব নয়।

‘তাহলে?’ তার যুক্তির মুখে পিছু হটে আমাকে বলতেই হয়               যে, আমি ঠিক জানি না। আর ভয়ে ভয়ে থাকি কখন সে বলে             বসবে ‘চলো বাবা ওই বাড়িতে গিয়ে খুঁজে দেখি রফিকের মুরগি আছে কি না।’

অধ্যাপককে আমি সে-কথা বললে তিনি প্রাণ খুলে হেসেছিলেন – অনেককাল পরে। তাঁরই মুখের কথা।

মাঝে মাঝেই তবু মেয়েটি জিজ্ঞাসা করে রফিকের মুরগি যে ওই বাড়িতে যায়নি তার প্রমাণ কী? আমি মানি যে, কোনো প্রমাণ নেই। বরং ওইরকম হওয়াই স্বাভাবিক। কেননা, মুরগিই তো। কতোদূর আর যেতে পারবে উড়ে?

মেয়েটির জন্ম বিদেশে। নার্সারি স্কুল, কিন্ডারগার্টেন পারও করেছে সে সেখানেই, ফলে জ্যাক অ্যান্ড দ্য বীনস্টক, রেড রাইডিং হুড কি সিন্ডারেলারা এখনো তার পিছু ছাড়েনি। মিকি ও মিনির প্রতি আকর্ষণ তখনো ক্ষীণ নয়। বিশেষত ওই দেশ ছাড়ার ঠিক আগে তাকে ডিজনিল্যান্ড নিয়ে যাওয়ায় সেটি বরং তীব্রই হয়েছে বলা যায়। কিন্তু ওই পর্যন্তই।

এই শহরে আমি তাকে কিছু দিতে পারি না। নিয়ে যাওয়ার মতো জায়গাও নেই। যা আছে, নিতান্ত মামুলি। তবুও মাঝে মাঝে সেখানেই নিয়ে যেতে চাই তাকে। স্কুলের বন্ধুবান্ধব সঙ্গে গেলে রাজিও হয়। ইদানীং তা-ও হয়ে ওঠে না। তার মা এবং আমার দুজনেরই কাজের চাপ। তাছাড়া হরতাল, অবরোধ, সমাবেশ, মিছিল ইত্যাকার কারণে রাস্তায় এত যানজট যে খুব সকালে কি গভীর রাত্রিতে ছাড়া রাস্তায় বেরোতেও ভালো লাগে না।

পরপর তিনদিন ঘরে বন্ধ হয়ে থাকার পরে প্রথম বন্ধের দিনেই তাকে বলি। ‘চলো আজ তোমাকে চিড়িয়াখানা দেখিয়ে আনবো।’ জানি স্যানডিয়েগোর চিড়িয়াখানা কি সী-ওয়ার্ল্ডের দৃশ্য যার চোখে ভাসে তার জন্য এটি কিছু নয়। তবুও তাকে চিড়িয়াখানার বিস্তার বোঝানোর জন্যে শহরের শেষ মাথায় সেই গাছপালা-মাঠ-জলাশয় ঘেরা জায়গাকে অভয়ারণ্য করে তুলি। আর আমার প্রস্তাব আকর্ষণীয় করার জন্য বলি, ‘রফিককেও সঙ্গে নিয়ে চলো আজ। সে তো কখনো যায়নি।’

মুহূর্তে খুশি হয়ে উঠেই নিভে যায় সে। ‘ও তো গাড়ি চড়তে পারে না বাবা। ওর নাকি মাথা ঘোরায়, চোখ বন্ধ করে বসে থাকে।’

রফিক প্রচন্ড আপত্তির সঙ্গে মাথা নাড়িয়ে বলে, ওরকম কখনো ঘটেনি, এবং ভবিষ্যতেও ঘটবে না।

কখনো বাঘের খাঁচার সামনে, কী হরিণের এলাকায় সময় কাটে খানিকটা। তারপরে এসে দাঁড়াই পাখির মেলায়। আপাতখোলা আকাশে রংবেরঙের পাখির ওড়াউড়ি দেখি। মাটিতে হেঁটে বেড়াচ্ছে বড়ো প্রজাতির কিছু পাখি, বুঝি ময়ূর। নানা রঙের আলপনা শরীরে নিয়ে নাচে তারা। কিছু পালক স্পষ্ট সোজা, দাঁড়ানো। মেঘের জন্যই কি পেখম মেলেছে? আর সেই কথা মনে আসতেই রফিকের মুরগির ছবি চোখে ভাসে। আমি অন্যমনস্ক তাকিয়ে আছি যখন, মেয়েটি আমার হাত ধরে নাড়া দেয়, ‘বাবা দ্যাখো রফিকের মুরগি।’ উত্তেজিত কণ্ঠস্বর তার। আমি যেন সম্বিৎ ফিরে পাই, ‘কোথায়! রফিকের মুরগি কোথায়?’

‘ওই যে ওইখানে,’ আঙুল তুলে দেখায় সে। আমি তার আঙুল বরাবর তাকাই। আর কী আশ্চর্য। তাই তো। ওই তো। ওই তো রফিকের মুরগি। না, ময়ূর নয়, রফিকের মুরগি। অবিকল ওই রকম।

‘রফিক, রফিক তোমার মুরগি। ঠিক যেমন ভেবেছিলাম, বাবার স্যার এনে রেখে গেছে মুরগিটা।’ রফিক তবুও এদিকে চোখ ফেরায় না। মুখে তার লজ্জার ছাপ। মুরগির শরীরে ঠিক জায়গায় ঠিক রংটি দিতে পারেনি এজন্যেই হয়তো!

 

দ্যুলোক

সূর্যালোকেও কোন সুখ আসে না। তবুও প্রভাতসূর্য আসার আগে ঘষা কাচের আকাশে, মাটি বরাবর, কিছু রং তো ভাসবেই।