অন্য আনিসুজ্জামান : চিন্তাপথের অভিযাত্রী

বাংলা অনার্স পরীক্ষার কোনো এক উত্তরপত্রে আনিসুজ্জামান রবীন্দ্রনাথের কবিতার উদ্ধৃতি দেয়ার সময় ‘সর্বত্রগামী’র বদলে লিখেছিলেন ‘সর্বপথগামী’। পঙ্‌ক্তিনিচয় স্মরণ করা যায়, ‘আমার কবিতা, জানি আমি/ গেলেও বিচিত্রপথে হয় নাই সর্বত্রগামী।’ এই ভুলের জন্য মৃদু তিরস্কার আনিসুজ্জামানের প্রাপ্য হয়েছিল জগন্নাথ কলেজে তাঁর অসীম শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক অজিতকুমার গুহের কাছে। শিক্ষকেরও অপরিসীম প্রত্যাশা ছিল এই নবীন বিদ্যার্থীর কাছে, তাই আলাপ-প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন এই তথ্য, আর আনিসুজ্জামানও বুঝেছিলেন বহিরাগত পরীক্ষক হিসেবে উত্তরপত্র নিবিড়ভাবে পাঠ করেছিলেন গুণী ও স্নেহপ্রবণ শিক্ষক। তবে এই ভুলই বুঝি আজীবন ললাটে ধারণ করে চলেছেন আনিসুজ্জামান, অধ্যাপনা ও জ্ঞানচর্চা তাঁর কর্মক্ষেত্র হলেও তাঁকে জীবনে হতে হয়েছে সর্বপথগামী, অনেকটা স্বেচ্ছায়, তবে বহু ক্ষেত্রে অনিচ্ছায়, অপরের দাবি মেটাতে স্বভাবসুলভ শিষ্টাচার পালন করে।
এ-কারণে আনিসুজ্জামান সম্পর্কে কিছু লেখা কিংবা তাঁর কর্মের মূল্যায়ন খুব কঠিন হয়ে পড়ে। সর্বপথগামী তিনি, তবে সেখানেও ভালোবাসা ও কল্যাণবোধ সর্বদা তাঁকে তাড়িত করে ফিরেছে। দায়বদ্ধ বুদ্ধিজীবী তিনি কেবল নন, তার চেয়ে বেশি বুঝি দায়বদ্ধ মানুষ, আর তাই আপন বিচার-বিবেচনা থেকেই নিজেকে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন বিচিত্রগামিতার পথে। এর মূলে আছে তাঁর অন্তরের মানবিক ঐশ্বর্য, সেই দান যে কত মানুষ কতভাবে পেয়েছে তার হদিস কে করতে পারে। পাশাপাশি এই অনুযোগও আনিসুজ্জামানকে শুনতে হয়েছে, সর্বপথগামী হওয়ার কারণে জ্ঞানচর্চায় যে-ভূমিকা পালন কাম্য ছিল সেটা যথোপযুক্তভাবে করতে তিনি পারগ হননি, ফলে সমাজকে তিনি বঞ্চিতই করেছেন। তাঁর দীক্ষাগুরু অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের আক্ষেপের মধ্যে প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থতার বেদনাই আমরা শুনি, যখন তিনি আনিসুজ্জামান সম্পর্কে বলেছিলেন, তিনি সবই করছেন কেবল লেখাপড়াটা ছাড়া। কিন্তু এখন ফিরে তাকিয়ে মনে হয়, আমরা প্রাত্যহিকতার মধ্যে, সমাজের প্রতি দায়-মোচনের ক্ষেত্রে আনিসুজ্জামানের শুভকর ও ন্যায়নিষ্ঠ ভূমিকা নিয়ে যত আলোড়িত থেকেছি, সেই তুলনায় তাঁর জ্ঞান-সাধনার অবদান নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করিনি। মনে হতে পারে, তিনি আরো অনেক কিছু করতে পারতেন, তবে এই আক্ষেপের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় তিনি কতকিছু করেছেন সেই বিবেচনা। বাঙালির মননশীলতা প্রসারে তাঁর যে ভূমিকা, বাংলা গদ্য-বিচারের বাঁধাধরা গণ্ডি ছাপিয়ে তিনি যে নতুন বিস্তার বয়ে এনেছেন তা স্বীকৃতি পেয়েছে বটে, তবে এর গভীরতা ও বিচিত্রতা কেবল ভাষা-বিচারে নয়, সমাজেতিহাসের নিরিখে, তা খুব তলিয়ে দেখা হয়নি। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক বিদ্বৎসমাজে তাঁর বিচরণ পাশ্চাত্য চিন্তার আরোপিত বলয় ছাপিয়ে নতুন পথ-রচনার যে তাগিদ ও ইঙ্গিত প্রকাশ করেছে সেটাও অনেকাংশে আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে রয়ে গেছে। এখানে আনিসুজ্জামানের জ্ঞানভিত্তিক কর্মের দুটি দিক নিয়ে যৎকিঞ্চিৎ আলোচনা আমরা করবো, প্রত্যাশা থাকবে এর তাৎপর্য নিয়ে যোগ্য পণ্ডিতবর্গ আরো কাজ করবেন এবং জ্ঞানসাধক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মী হিসেবে আনিসুজ্জামানের অবদান তাতে যথাযথ স্বীকৃতি পাবে।

এক
বর্তমান আলোচনার প্রথম বিবেচ্য অবশ্যই বাংলা গদ্যের উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাসকে ঔপনিবেশিক চিন্তাজাত ধারণা ভেঙে নতুন বিস্তার দিতে আনিসুজ্জামানের অবদান। তিনি প্রচলিত পর্বভাগ থেকে আরো অতীতে নিয়ে গেছেন গদ্যের উদ্ভবকাল এবং বাংলার বাণিজ্যিক অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ততা থেকে উদ্ভূত ব্যবহারিক গদ্যের অনেক নমুনা তিনিই প্রথম সর্বসমক্ষে হাজির করলেন। আমরা সবাই জানি এর উৎস, কমনওয়েলথ অ্যাকাডেমিক ফেলোশিপ নিয়ে ১৯৭৪ সালে তিনি বিলেত গিয়েছিলেন, তাঁর কাজের বিষয় ছিল ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ অর্থাৎ ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ প্রতিষ্ঠার আগের বাংলা গদ্য নিয়ে তথ্যানুসন্ধান ও গবেষণা। তিনি নিজেই জানিয়েছেন, ব্যবহারিক এই গদ্যের ইঙ্গিত তিনি পেয়েছিলেন সুশীলকুমার দে-র হিস্ট্রি অব বেঙ্গলি লিটারেচার ইন দি নাইনটিন্থ সেঞ্চুরি বইয়ের পরিশিষ্ট অংশে। মূল গ্রন্থ নয়, পরিশিষ্ট যে তাঁর দৃষ্টি বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছে, এমন বক্তব্যে ডিটেলের প্রতি মনোযোগী গবেষক হিসেবে আনিসুজ্জামানের বিশিষ্টতাই আমাদের সামনে মেলে ধরে।
যাই হোক, বিলেতে আনিসুজ্জামান কাজ করেন প্রাচ্যবিদ্যাকেন্দ্র সোয়াসে, যেখানে বিশেষ কিছু মেলে না, ব্রিটিশ মিউজিয়মে কাজের সূত্রে খোঁজ করেন হেস্টিংসের ব্যক্তিগত কাগজপত্র, সেখানে পান এক বাংলা আবেদনপত্র, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালকদের কাছে কলকাতার বণিক সম্প্রদায়ের লেখা এই আরজি-পত্রের প্রেরক ‘বড় মানুষ ও সওদাগর ও আশরাফ ও ভদ্রলোক কলিকাতা শহরের বাসীগণ।’ তবে এর বাইরে আর বিশেষ কিছু মেলে না। এরপর তাঁর কাজ শুরু হয় ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে, সেখানে পরিবেশ ব্রিটিশ মিউজিয়মের মতো নৈর্ব্যক্তিক নয়, গবেষকরা মূলত ভারতীয় উপমহাদেশ ও প্রাচ্য নিয়ে কাজ করেন, তাঁরা এবং কর্মকর্তারা পরস্পরের সঙ্গে স্বচ্ছন্দ ও সৌহার্দ্য বোধ করেন, অনানুষ্ঠানিক ভাব-বিনিময় চলে সহজভাবে। এখানে বইপত্র-ক্যাটালগ ঘাঁটাঘাঁটির এক পর্যায়ে আনিসুজ্জামান জানতে চেয়েছিলেন উচ্চতর কর্মকর্তা মাইকেল ও’কিফের কাছে, তালিকার বাইরে কোনো বাংলা কাগজ, দলিল-দস্তাবেজ লাইব্রেরির কোথাও গচ্ছিত আছে কি না। কিফ জানালেন, কিছু আছে বলে তিনি শুনেছেন, তবে খোঁজ করতে হবে। এর কদিন পর তিনি লাইব্রেরির স্ট্যাকে নিয়ে গেলেন আনিসুজ্জামানকে, সেখানে একটা শেলফের একেবারে নিচের তাকে রয়েছে সুতোয় গাঁথা খাতার মতো বেশকিছু কাগজপত্র, যার মধ্যকার গোটা-দুই খাতা পড়ার ঘরে এনে দেখার ব্যবস্থা হলো। কাগজ পরখ করে আনিসুজ্জামান বুঝতে পারলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঢাকা ফ্যাক্টরির দৈনন্দিন চিঠিপত্রের সংগ্রহ এসব।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ঢাকা ফ্যাক্টরির মাধ্যমে বস্ত্রের যে ব্যবসা পরিচালনা করতো তার বিবরণ রয়েছে বিভিন্ন চিঠিপত্রে, দুশো বছরেরও অধিককাল যে-কাগজগুলো কেউ স্পর্শ করেনি, পাঠও নেয়নি। আনিসুজ্জামানের ভাষ্য,
ঢাকা কুঠি কাপড়ের ব্যবসা করতো। ঢাকা, ময়মনসিংহ ও ত্রিপুরার কয়েকটি জায়গায় ছিল কোম্পানির আড়ং। সেসব আড়ংয়ের গোমস্তারা তাঁতিদের ফরমাশ ও দাদন দিয়ে কাপড় তৈরি করিয়ে নিতো। ফরমাশ আসতো লন্ডন থেকে কলকাতায়, কলকাতা থেকে ঢাকায়, ঢাকা থেকে এসব আড়ংয়ে, আড়ং থেকে তাঁতিদের কাছে, তাঁতিরা কাপড় এনে দিলে তা যাচাই-বাছাই হয়ে উল্টো পথে লন্ডন পৌঁছাতো। চিঠিগুলো কুঠি ও আড়ংয়ের মধ্যে চালাচালি হয়েছিল। বাংলার অর্থনৈতিক ইতিহাসের একটা অধ্যায় স্পষ্ট হয় এসব চিঠিপত্রের সাহায্যে। এর ভাষা ও রীতিও উল্লেখযোগ্য।
শুরু হয় আনিসুজ্জামানের শ্রমসাধ্য কাজ, যেক্ষেত্রে তিনি কখনো পিছপা হননি, এবং সর্বদা ছিলেন অতীব যত্নশীল। তিনি ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরির জন্য বিবরণী-সমেত কাগজপত্রের তালিকা প্রস্তুত করতে লাগলেন। গ্রন্থাগারের রীতি অনুযায়ী খাতা ও কাগজপত্রে ডাক-নম্বর (কল নাম্বার) বসালেন, কাগজের মাপজোখ নিলেন, ধরন, প্রেরক ও প্রাপকের নাম-ধাম, পৃষ্ঠাসংখ্যা দিলেন। তারপর নিজের হাতে টাইপ করে বাইন্ডার লাগিয়ে সেই তালিকা জমা দিলেন লাইব্রেরি দফতরে, শিরোনাম দিলেন “A Handbook of Uncatalogued Bengali Manuscripts in the India Office Library and Records.”
১৯৭৪ সালের আগস্টে দেশে ফেরার বছর-দেড়েক পর আবারো ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরির পরিচালকের আমন্ত্রণ পেলেন আনিসুজ্জামান, ঢাকা কুঠির কাগজপত্রের যে-হ্যান্ডলিস্ট দ্রুততার সঙ্গে তিনি করে দিয়ে এসেছিলেন তার পূর্ণতাদানের আবশ্যকতা তারা অনুভব করেন এবং আনিসুজ্জামানের জন্য তিন মাস লন্ডনবাসের ব্যয় নির্বাহের ব্যবস্থা করতে পারবেন বলে জানান। এক্ষেত্রে বিমানযাত্রার ব্যবস্থা অধ্যাপকের নিজেকে করতে হবে। একদা যে-সাম্রাজ্যে সূর্য অস্তমিত হতো না তাদের আর্থিক সংগতি যে ক্রম-অস্তমান সেই পরিচয় পাওয়া যায় এমনি প্রস্তাবনায়। আনিসুজ্জামান তিন মাসের শ্রমসাধ্য কাজের জন্য কোনো পারিশ্রমিক পাবেন না, তদুপরি ঢাকা-লন্ডন-ঢাকা বিমানযাত্রার মাশুল তাঁকেই গুনতে হবে। এমন প্রস্তাবে অবশ্য আনিসুজ্জামানের বিচলিত বোধ করার কিছু ছিল না, বেগার শ্রমদানে বরাবরই তাঁর প্রবল আগ্রহ, এক্ষেত্রে তো বিশেষ দায়িত্ববান কাজ যথাযথভাবে সম্পাদনের সুযোগ তাঁর মিলবে।
ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে ঢাকা কুঠি পরিচালিত ঢাকা, ময়মনসিংহ ও ত্রিপুরার আটটি আড়ং এবং তাদের মারফত তাঁতিদের বুননের জন্য দাদন প্রদান ও বস্ত্রসংগ্রহ প্রক্রিয়া নিয়ে চিঠি চালাচালির তালিকা ও সার-সংক্ষেপ তৈরির সময় আনিসুজ্জামান ব্যবহারিক বাংলা গদ্যের বিকাশের পূর্ব-অজ্ঞাত রীতি ও শব্দ-সন্ধানের পাশাপাশি পাচ্ছিলেন বাংলার অর্থনৈতিক ইতিহাসের অনুপুঙ্খ বাস্তব পরিচয়। বাংলা সাহিত্য অধ্যয়নে সমাজ-ইতিহাস বিবেচনায় তিনি শুরু থেকেই দক্ষতার পরিচয় দিয়ে আসছিলেন, যার অনন্য প্রকাশ চব্বিশ বছরের যুবক আনিসুজ্জামানের পিএইচ.ডি অভিসন্দর্ভ মুসলিম-মানস ও বাংলা সাহিত্য। এবারো নিজের উপলব্ধিকে দু-ভাবে জাহির করতে পারছিলেন তিনি, একদিকে পুরনো বাংলা গদ্য, অন্যদিকে বাংলায় কোম্পানির বাণিজ্যের বাস্তব কর্মধারা। এ-যাত্রায় তিনি ১২ খণ্ড চিঠিপত্র তালিকাভুক্ত করে এসেছিলেন, তবে তাঁর মনে হয়েছিল আরো অন্তত তিন খণ্ড কোথাও হয়তো থাকবে।
এরপর ১৯৭৯ সালে ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরির নতুন পরিচালক আনিসুজ্জামানকে জানান যে, তাঁর অনুমান সঠিক, অনুরূপ আরো কিছু কাগজপত্র খুঁজে পাওয়া গেছে। তিনি যদি এসে তালিকা ও সার-সংক্ষেপ করে দিতে পারেন তবে কর্তৃপক্ষ বাধিত বোধ করবেন, উপরন্তু সব কাজ একসঙ্গে গ্রন্থাকারে প্রকাশ পাবে। এবারো লন্ডনে অবস্থানের জন্য ভাতা ছাড়া আর কিছু দিতে তারা অপারগ, ওই সামান্য অর্থে লন্ডনে বসবাস এবং বিমানযাত্রার ব্যবস্থা গবেষককেই করতে হবে। বলা বাহুল্য, সানন্দে সম্মতি জানালেন আনিসুজ্জামান। লন্ডনে আগেরবারের মতোই বন্ধু-সুহৃদ কারো সঙ্গে কিংবা কারো খালি ঘরে থাকা যাবে কম ভাড়ায়, বিবিসি বাংলা বিভাগের কাজে যদি কিছু উপরি আয় হয়, তবে সেটাও সহায়ক হবে, এসবই ছিল অধ্যাপকের বিবেচ্য। একজন নবীন ছাত্রও এমনি প্রস্তাবে সম্মত হবেন কি না সন্দেহ, তারপরও তৃতীয় দফার এই দায়িত্ব সানন্দে সম্পাদন করলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, বলা যেতে পারে প্রায় বিনা পারিশ্রমিকে, নিজ ব্যবস্থায় যাতায়াতের সংস্থান করে।
ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে তৃতীয় পর্বে যেসব কাগজপত্র নিয়ে আনিসুজ্জামান কাজ করেছেন সেটা দীর্ঘ। এই তালিকার ওপর চোখ বুুলালে এর মূল্য এবং কর্মপরিধি সম্পর্কে একটা ধারণা মিলবে। নিভৃতে-নীরবে আট মাসজুড়ে শ্রম ও মেধা নিবিষ্টতা নিয়ে আরব্ধ কাজ সম্পন্ন করেন আনিসুজ্জামান। পুরনো বাংলা লেখা পাঠ করা সহজসাধ্য ছিল না, তদুপরি ব্যবহারিক ভাষায় ছিল অনেক ফার্সি-আরবি ও হিন্দুস্তানি শব্দের ব্যবহার। সরাসরি ইংরেজিতে উঠে এসেছিল অনেক শব্দ যেমন, Amanat (জমা), Durkhast (দরখাস্ত), Fazil (উদ্বৃত্ত), Kistbundee (কিস্তি) ইত্যাদি, এমনকি ছিল Ruckumferr এবং Ferretted-এর মতো দুর্বোধ্য শব্দ।
প্রথমটি বুঝতে অবশ্য খুব বেগ পেতে হয় না, চিঠিপত্র পাঠ করে আনিসুজ্জামানের পক্ষে তা অনুধাবন কঠিন হয়নি, তবে Ferretted যে ‘ফেরৎ’ সেটা পরে তাঁর দ্বারাই শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছিল। এই রকমফের এবং ফেরৎ-এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে পূর্ববাংলার তাঁতিদের ফতুর করে দিতে পাশ্চাত্যের প্রতিনিধি শ্বেতাঙ্গ কর্মকর্তা তথা কুঠি বা Factory পরিচালকদের নিষ্ঠুর খেলা।
সপ্তদশ শতকে বাংলায় বাণিজ্যের জন্য বসতকারী ইংরেজদের যে বলা হতো Factor এবং তাদের বাণিজ্যঘাঁটিকে Factory সেটা এখনকার অর্থে বিবেচনা করা যাবে না। এখন আমরা ফ্যাক্টরি বলতে বুঝি কারখানা, যে-ভবনে যন্ত্রাদির সাহায্যে কাঁচামাল প্রক্রিয়া করে পণ্য উৎপাদিত হয়। তবে ঔপনিবেশিক বাণিজ্যের সূচনাকালে ফ্যাক্টরি বলতে বোঝাতো দূরদেশে স্থাপিত বাণিজ্যের ঘাঁটি। আর এই ঘাঁটি-পরিচালক শ্বেতাঙ্গ পরিচিত হয়েছিলেন ফ্যাক্টর হিসেবে, যিনি বাণিজ্য তথা কেনাবেচার মাধ্যমে নিয়োগকর্তার জন্য ফলাফল বয়ে আনবেন। এখন ফ্যাক্টর বলতে আর কোনো সজীব সত্তা বোঝায় না, নির্দিষ্ট করা হয় সেই উপাদান, যা ফল বয়ে আনতে পালন করে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা, যেমন আমরা দেখি গণিতে। ১৮৮৬ সালে কর্নেল হেনরি ইউল ইংরেজি-ভারতীয় কথ্য ও ব্যবহারিক শব্দের যে অভিধান প্রণয়ন করেন হবসন-জবসন শিরোনামে, সেখানে ফ্যাক্টরের অর্থ সবিস্তারে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ‘হবসন-জবসন’ শিরোনাম, অনেকের মনে হয়েছে ‘হায় হাসান, হায় হোসেন’ বিলাপ শ্রবণে বিভ্রম থেকে জাত। শব্দ, উৎস ও ব্যাখ্যা নিয়ে দীর্ঘকালের শ্রমসাধ্য কাজ যিনি করেছেন তাঁর ভাষাজ্ঞান এমন চটুল ভাবতে মন সায় দেয় না। বরং একে বলা যেতে পারে ‘হাবিজাবি’ অভিধান, মানুষের মুখের কথা এখানে এমনভাবে উঠে এসেছে যেসব শব্দ পণ্ডিতেরা তাঁদের কাজে গ্রাহ্য করবেন না। তো হবসন-জবসনে Factor-এর শব্দার্থ দেওয়া হয়েছে বাণিজ্য প্রতিনিধি, যিনি ফ্যাক্টরির নির্বাহী প্রধান। এরপর অভিধানে বলা হয়েছে কোম্পানির প্রশাসনিক কাঠামোর স্তরবিন্যাস সম্পর্কে, যার সর্বোচ্চ থেকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছেন অগ্রজ বণিক (সিনিয়র মার্চেন্ট), অনুজ বণিক (জুনিয়র মার্চেন্ট), ফ্যাক্টর এবং রাইটার। ১৭৭৫ সালের এক চিঠির উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে অভিধানে, সেখানে বলা হয়েছে, একজন শিক্ষানবিশ (অ্যাপ্রেন্টিস) যোগ্যভাবে পাঁচ বছর কাজ করার পর রাইটার হতে পারবেন এবং সম-বৎসর কার্যনির্বাহের পর হতে পারবেন ফ্যাক্টর। ফ্যাক্টর হিসেবে কার্যকাল পূরণের পর তিনি হতে পারবেন অনুজ বণিক এবং এরপর অগ্রজ বণিক। এই কর্মকর্তারা যথেষ্ট ফলাফল বয়ে আনতে পারছেন না কোম্পানির জন্য, এমন এক পত্রও উদ্ধৃত হয়েছে হবসন-জবসনে। লর্ড কর্নওয়ালিশ এই চিঠিতে খেদ করে বলেছেন, ‘আমাদের কাউন্সিল দরকার কেন, আর কেনই-বা আমরা জাহাজে করে সিনিয়র-জুনিয়র মার্চেন্ট, ফ্যাক্টর, রাইটার্সদের পাঠাব যৎসামান্য রাজস্ব তুলে আনতে। এটা আমার বোধগম্য নয়।’ এই একই ভুক্তিতে আরব সাগর তীর থেকে জাভা-বোর্নিয়া অবধি ইংরেজ ফ্যাক্টরির তালিকা প্রদত্ত হয়েছে। সেই তালিকা অতীব দীর্ঘ এবং এসব ফ্যাক্টরির সঙ্গে রয়েছে দেশাভ্যন্তরে আরো নানা কুঠি এবং আড়ংয়ের যোগাযোগ। এই গোটা ব্যবস্থা নিয়োজিত হয়েছিল জাহাজবোঝাই করে ইংলন্ডের জন্য সম্পদ বয়ে আনতে। সেই সম্পদ জোগাতে বাংলার তাঁতিদের কীভাবে নিংড়ে নিঃশেষ করেছে ইংরেজ ফ্যাক্টররা তার পরিচয় আনিসুজ্জামান পেয়েছেন ফ্যাক্টরি করেসপনডেন্সের তালিকাভুক্তি ও সার-সংক্ষেপ করার সময়। ফলে যেমন বাংলা গদ্যের ইতিহাসের নতুন বিস্তার তিনি ঘটিয়েছেন, পাশাপাশি বাংলার অর্থনৈতিক ইতিহাসে তিনি যোগ করেছেন নতুন মাত্রা। প্রথম দিকটি নিয়ে আলোচনা-প্রশংসা আনিসুজ্জামানের প্রাপ্য হলেও দ্বিতীয় বিষয়টি অনেকাংশে থেকে গেছে আড়ালে।
Factory Correspondence গ্রন্থে ১৭৮২ থেকে ১৮০০ সাল অবধি লেখা হাজারেরও বেশি বাংলা চিঠি ও তার সার-সংক্ষেপ পেশ করেছেন আনিসুজ্জামান। গ্রন্থের দীর্ঘ এক ভূমিকা তিনি রচনা করেছেন। শেষাবধি ১৯৮১ সালে প্রকাশিত গ্রন্থ সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, ‘এই বইয়ের প্রকাশ আমার জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা, এটি আমার অশেষ পরিশ্রমের ফসল।’ সোয়াসের বুলেটিনে এবং ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মডার্ন এশিয়ান স্টাডিজে অনুকূল সমালোচনা তাঁর জন্য প্রীতিকর হয়েছিল। তবে স্বদেশে এই বইয়ের আলোচনা বিশেষ লক্ষ্যগোচর হয়নি। প্রশংসিত তিনি হয়েছেন তাঁর কাজের জন্য, কিন্তু খুব তলিয়ে বিচার করা হয়নি এ-কাজের মাহাত্ম্য। যেটুকু আলোচনা গোচরে আসে তা কোম্পানির চিঠিপত্রের সুবাদে প্রাপ্ত পুরনো বাংলা গদ্য সম্পর্কে আনিসুজ্জামানের বাংলা সাহিত্য-ইতিহাসের নবপাঠ। কিন্তু এর আরেক বড় অবদান ঔপনিবেশিক শোষণের নবপাঠ অনেক কমই আলোচিত হয়েছে। ফ্যাক্টরি করেসপন্ডেন্স গ্রন্থে কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ তাঁতিদের ওপর কোম্পানি-আরোপিত শৃঙ্খলের সবিস্তার বিবরণ দিয়েছেন আনিসুজ্জামান। তাঁর ভূমিকা মূলত বন্ডেড উইভার্স বা দাসত্ব-বন্ধনে আটক বাংলার তাঁতিদের দুরবস্থা এবং এর কার্যকারণ মেলে ধরে। বাংলায় কোম্পানির শাসন তথা বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ড হওয়ার অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল বাণিজ্যের নামে সম্পদ পাচারের ধারা। আদিতে মোগল বাদশার কাছ থেকে ব্যবসার অনুমতি-লাভ ও বাণিজ্য-কুঠি তথা ফ্যাক্টরি স্থাপনার মধ্য দিয়ে যে-যাত্রা শুরু হয় বাংলায় তা দ্রুতই সংগঠিত রূপ নিতে থাকে। নবাব সিরাজউদ্দৌলার সৈন্যদের পরাভূত করার অনেক আগেই বাংলার পণ্য অর্থনীতিতে ইংরেজ তার আধিপত্য বিস্তার করেছিল। পলাশীযুদ্ধে বিজয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে যে বাড়তি সুবিধা এনে দিলো তার জোরে বাণিজ্যের ওপর তাদের অধিকার প্রায় একচেটিয়া হয়ে ওঠে। এই সময়ের বাস্তব তথ্য উঠে এসেছে আনিসুজ্জামানের গবেষণায়। তখন ঢাকা অঞ্চলেই ছিল প্রায় ২৫,০০০ তাঁতি এবং সুতা-কাটুনির কাজ করতো আনুমানিক ৮০,০০০ নারী। এর পেছনে ছিল কার্পাস চাষের খাত। সব মিলিয়ে যে বিশাল অর্থনীতি এবং তার দ্বারা সৃষ্ট উদ্বৃত্ত মূল্য, বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মার্কসীয় তাত্ত্বিক পল সুইজির অনুসরণে যাকে বলা যায় সামাজিক উদ্বৃত্ত, সেই সম্পদ আত্মসাৎকরণে কোম্পানি-অনুসৃত নীতি বিশেষভাবে দেখার রয়েছে। আনিসুজ্জামানের বর্ণনায়, ‘বিলেত থেকে ফরমায়েশ আসত কলকাতায়, সেখান থেকে ঢাকার মত কুঠিতে [যা আসলে ছিল ফ্যাক্টরি]। কুঠি আড়ং বা বস্ত্র-উৎপাদন কেন্দ্রে ফরমায়েশ পাঠাতেন জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারিতে, কখনো কখনো আরো পরে, তবে কাপড় চাইতেন অক্টোবরের মধ্যে। এ, বি, সি, ডি, ই, এফ – এই ছয় শ্রেণিতে কাপড় অন্তর্ভুক্ত হতো গুণের মানের উচ্চাবচের ভিত্তিতে। সি শ্রেণির কাপড়ের দামের ভিত্তিতে আগাম দিয়ে তাঁতিকে চুক্তিবদ্ধ করা হতো।’ এ-পর্যন্ত মনে হতে পারে পাশ্চাত্যের সুপরিচালিত কোম্পানি প্রাচ্যদেশের পণ্য-বাজারে সুসংগঠিতভাবে প্রবেশ করে বাণিজ্য পরিচালনা করছে এবং বাণিজ্য-কুঠি, তার কর্মকর্তা, হিসাবরক্ষণ-ব্যবস্থা, ব্যালেন্স-শিট সব মিলিয়ে বিশ্ববাজারে বাংলার পণ্য বয়ে নেওয়ার দায়িত্ব পালনে ব্রতী রয়েছে।
কিন্তু ফ্যাক্টরদের লক্ষ্য সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন এবং ফ্যাক্টরি পরিচালিত হতো সেই উদ্দেশ্যেই। এই প্রক্রিয়া ভালোভাবেই বুঝেছিলেন আনিসুজ্জামান, লিখেছিলেন, ‘সি শ্রেণির কাপড়ের দামের ভিত্তিতে আগাম দিয়ে তাঁতিকে চুক্তিবদ্ধ করা হতো। এমনও হতো যে, পূর্ববর্তী বছরের খেলাফ বাবদ আগামের সব টাকাই কোম্পানি রেখে দিতো। চুক্তিবদ্ধ তাঁতি অন্য কোনো কোম্পানি বা বেসরকারি ব্যবসায়ীর কাজ করতে পারতো না আইন মান্য করে। সাধ্যের চাইতে বেশি ফরমায়েশ নিতে তাঁতিকে বাধ্য করা হতো।’ এখানে কিঞ্চিৎ ব্যাখ্যা প্রয়োজন হতে পারে। বাংলায় ওলন্দাজ, পর্তুগিজ, ফরাসি, ইংরেজ, আর্মেনীয় নানা জাতির ব্যবসায়ীর আনাগোনা ছিল পশ্চিমি বাজারে এর পণ্যের চাহিদার কারণে; কিন্তু কোম্পানির একচ্ছত্র রাজনৈতিক আধিপত্য ব্যবহার করে, প্রয়োজনে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে অন্যদের বিচরণক্ষেত্র বিলোপ অথবা সংকুচিত করে দেয় ইংরেজরা। তারপরও ফ্রি ট্রেডার্স হিসেবে অভিহিত কেউ কেউ ছিল যাঁরা বাংলার বস্ত্র ব্যবসায় সক্রিয় হতে সচেষ্ট ছিল। যাকে বলা হচ্ছে আইন তা আসলে কোম্পানির রেগুলেশন, একের পর এক রেগুলেশন জারি করে ব্যবসায় একচেটিয়াত্ব আরোপ করে কোম্পানি। সেই বিধি মোতাবেক তাঁতি কেবল এক পক্ষের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে পারতো, একবার চুক্তিবদ্ধ হলে আর কারো কাছে পণ্য বিক্রির অধিকার তার থাকতো না। মনোপলাইজেশনের এ-এক পরাকাষ্ঠা। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল ম্যাক্সিমাইজেশন অব প্রফিট, সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন। সেটা নিশ্চিত করার জন্য ছিল ফ্যাক্টর ও আড়ংয়ের কর্তৃপক্ষ, অধস্তন কর্মচারী এবং বিধিব্যবস্থা। ফ্যাক্টরির সাহেব কর্মকর্তাদের তালিকা আগে দেওয়া হয়েছে, আড়ংয়ের দেশীয় কর্মচারীর ধারাক্রম পাওয়া যায় আনিসুজ্জামানের বয়ানে, এখানে ছিল গোমস্তা, সেরেস্তাদার, মোহরার, জমাদার, বরকন্দাজ, মকিম, তাগাদগার, বেয়ারার ইত্যাদি। আরো কিছু নাম-পরিচয়ে কর্মচারীর দেখা মেলে, যেমন আমিন, নায়েব-গোমস্তা, নায়েব ও তহবিলদার। কোম্পানির পেষণযন্ত্র সুচারুভাবে পরিচালনার জন্য এদের সবারই কাজ রয়েছে। মনে হতে পারে জমি পরিমাপকারী আমিন কোন কর্তব্য পালন করবেন আড়ংয়ে ফ্যাক্টরের হয়ে। ঋণের বোঝায় পিষ্ট তাঁতি যখন সর্বস্ব খুইয়ে বসবেন তখন ভিটেমাটি ক্রোক করার কাজে আমিন ও বরকন্দাজ পালন করেন চালকের ভূমিকা। আর শোষণ পাকাপোক্ত করতে ব্যবহৃত হয় রকমফের ও ফেরৎ-এর বিধান। আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘মকিমেরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে তাঁতিদের কাজ পর্যবেক্ষণ করতো এবং সত্য ও কাল্পনিক ত্রুটির জন্য অনেক সময়ে তাঁতের কাপড় নষ্ট করে দিতো। কাপড় দেয়ার পরে আড়ং-এ আদর্শ নমুনার সঙ্গে মিলিয়ে কাপড় শ্রেণিভুক্ত করা হতো, চূড়ান্ত বাছাই হতো কুঠিতে। বাছাইতে কোনো কাপড় নিম্ন শ্রেণিভুক্ত হলেই তাঁতির অনেক লোকসান হতো, আর সে-কাপড় যদি ‘ফেরৎ’ যেত, তাহলে তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়তো।’
বস্ত্র উৎপাদনের পর, হালের ভাষায় তার কোয়ালিটি কন্ট্রোল হতো ফ্যাক্টরি বা কুঠিতে, যেখানে তাঁতির উপস্থিত থাকার উপায় ছিল না, বিধানও ছিল না, মায় থাকতে পারতো তাঁর পক্ষের এক প্রতিনিধি। তাই এখানে রকমফের-এর ফাঁদে তাঁতি ব্যবস্থাগতভাবেই আটক হয়ে থাকতেন। ‘সি’ পর্যায়ের কাপড় হয়তো চিহ্নিত হতো ‘ডি’ হিসেবে, অর্থাৎ ঘটেছে ‘রকমফের’, সেই সাথে তাঁতির প্রাপ্য অর্থ পরিমাণে হ্রাস পেত বিপুলভাবে। অধিকন্তু আনীত বস্ত্রের এক উল্লেখযোগ্য অংশ চিহ্নিত হতো ‘ফেরৎ’ হিসেবে, তা গুণগত বিচারে গ্রহণযোগ্য নয়। এখানেই বিধি-বিধানের ইতি ঘটলে তাতে হয়তো তাঁতির জন্য কিছুটা সান্ত্বনা মিলতো। কিন্তু ‘ferreted’-এর বিধান অনুযায়ী সেই বস্ত্র ফ্যাক্টরি কিংবা আড়ংয়ে জমা থাকবে, যতদিন পর্যন্ত না তাঁতি বিকল্প বস্ত্র বয়ন করে সরবরাহ করবে। ‘ফেরৎ’ পর্যায়ের বস্ত্র ফেরত পাওয়ার বিশেষ উপায় ছিল না তাঁতির। যদি তিনি বিকল্প বস্ত্র সরবরাহের ব্যবস্থা করতে পারতেন তা হলেও কোম্পানির দাগা-চিহ্নিত সেই বস্ত্র বাজারে বিকোবার সুযোগ বিশেষ থাকতো না। কোম্পানির কাছে ঋণী হয়ে থাকা ছাড়া পরিশ্রমী তাঁতির আর কোনো উপায় ছিল না। ফলে যা হতো, আনিসুজ্জামানের ভাষায়, ‘কোম্পানির কাছে এরকম দেনা রেখে তাঁতির যাত্রা শুরু হতো নতুন বছরের। কখনো তাঁতির বিরুদ্ধে কামনা করে কোম্পানি ডিক্রি পেতেন; কিন্তু বাজেয়াপ্ত করার মতো কিছু পেতেন না। তাঁতি হয়তো কারারুদ্ধ হতো, ভিটেমাটি ছেড়ে পালাতো, পেশা বদলে ফেলতো। পলাতককে ধরে আনা হতো, অনেক সময় নিজেও সে ফিরে আসতো। ঋণী তাঁতির মরেও রেহাই হতো না, উত্তরাধিকারসূত্রে ঋণ বর্তাতো সাবালক ছেলের ওপরে আর পার্থিব সবকিছুর দখল নিয়ে যেতো কোম্পানি।’
ঐতিহাসিক আবদুল করিমের ঢাকাই মসলিন গ্রন্থের আলোচনা-সূত্রে নিজের কাজের উল্লেখপূর্বক এই কথাগুলো বলেছিলেন আনিসুজ্জামান, যেখানে কেবল বাংলার তাঁতিদের নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়ার বাস্তবতাই নয়, নিষ্পেষিত তাঁতিদের কান্নার স্বরও যেন ভেসে আসে সোয়া দুশো বছরের আগেকার চিঠিপত্রের নতুন পাঠগ্রহণের সুবাদে।
অতি সম্প্রতি, ২০১৯ সালে, প্রকাশিত হয়েছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইতিহাস বিষয়ক উইলিয়ম ডালরিম্পল-প্রণীত গ্রন্থ যেখানে রাজনৈতিক আধিপত্যের ওপর জোর পড়লেও অর্থনৈতিক শোষণ বড়ভাবে ফুটে উঠেছে। তাঁর গ্রন্থের নাম, The Anarchy; The East India Company, Corporate Violence and the Pillage of an Empire. সপ্তদশ শতকের গোড়ায়, কোম্পানি গঠনকালের বাস্তবতা তুলে ধরে তিনি লিখেছিলেন, “India then had a population of 150 million − about a fifth of the world’s total − and was producing about a quarter of global manufacturing; indeed, in many ways it was the world’s industrial powerhouse and the world’s leader in manufactured textiles.” কোম্পানি ভারতে তাদের ট্রেডিং পোস্ট তথা ফ্যাক্টরি স্থাপন শুরু করলে যেসব শ্বেতাঙ্গ দূরদেশে এমনি দায়িত্ব পালনে অগ্রসর হলো তাদের সম্পর্কে কোম্পানির এক চিঠির সূত্রে উইলিয়ম ডালরিম্পল লিখেছেন, “It is not uncommon to have them out of Newgate [Prison], as several have confessed. However those we can keep pretty much in order. But of late we have had some from [the lunatic asylum of] Bedlam.”
১৬০০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠার প্রায় একশ বছর পর আরেক ইংরেজ ফ্যাক্টর জোব চার্নক যখন কলকাতার পত্তন করেন সেই সময়ের বর্ণনায় উইলিয়ম ডালরিম্পল লিখেছিলেন,
Only one thing kept the settlement going. Bengal was ‘the finest and most fruitful country in the world’, according to French traveller Francois Bernier. It was ‘one of the richest most populous and best cultivated countries’, agreed the Scot Alexander Dow. With its myriad weavers- 25,000 in Dhaka alone – and unrivalled luxury textile production of silks and woven muslins of fabulous delicacy, it was by the end of seventeenth century Europe’s single most important supplier of goods in Asia and very much the wealthiest region of the Mughal Empire, the place where fortunes could most easily be made.
ভারত তথা বাংলার সম্পদ লুট করতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ থেকে বিরত থাকেনি। এই লুণ্ঠনের শিকার যেমন হয়েছে বাংলার নবাবজাদারা, তেমনি বাংলার চাষি-তাঁতি।
অচিরে সোনার বাংলা হয়ে উঠলো শ্মশান।
ফার্ডিনান্ড ব্রডেল The Wheels of Commerce গ্রন্থে লিখেছিলেন :
From now on India was enmeshed in the relentless destiny which would demote her from the proud ranks of the great producing and trading countries to the status of a colony, buying English products – even textiles – and providing raw materials, and this for almost two hundred years.
কোম্পানির সদর দফতরের কাগজপত্র ঘেঁটে এর রাজনৈতিক ইতিহাস তুলে ধরেছেন উইলিয়ম ডালরিম্পল, বিস্ময়করভাবে বহু নথিপত্র অধ্যয়ন করলেও, ইন্ডিয়া অফিস রেকর্ড সন্ধান করলেও আনিসুজ্জামানের Factory Correspondences থেকে গেছে তাঁর পাঠের বাইরে। সেই চিঠিপত্রের হদিস পেলে কোম্পানির বাণিজ্য নীতির শঠতা ও বাংলার তাঁতির দুর্ভোগের কিছু পরিচয় তিনি অন্তত দাখিল করতে পারতেন। তবে এখন আমরা আনিসুজ্জামান এবং উইলিয়ম ডালরিম্পল একত্রে পাঠ করতে পারি, তা হলে স্বচ্ছভাবে ফুটে উঠবে ঔপনিবেশিক বাস্তবতার চরম অমানবিক মাত্রা, আজকের বিশ্বকে বোঝার জন্য যা বিশেষ প্রাসঙ্গিক। এই নিরিখে প্রশ্ন তোলা যায় আনিসুজ্জামান যে-মাত্রায় সাহিত্য ও সমাজের ইতিহাস নিয়ে কাজ করেছেন, আমাদের আলোকিত ও ঋদ্ধ করেছেন, তা এখনো আমরা সম্যক উপলব্ধি করতে পেরেছি কি?

দুই
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পৃথিবীর পথে পা বাড়িয়েছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। এর আগে তিনি যে দেশের গণ্ডির বাইরে যাননি তা নয়, ১৯৫৬ সালে মুসলিম লীগ শাসনের অবসান-পরবর্তী উদার আবহে তিনি এশীয় লেখক সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়েছিলেন দিল্লি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উজ্জ্বল ছাত্র এবং উদীয়মান লেখক-বুদ্ধিজীবী হিসেবে এই সম্মেলনে যোগদান তাঁর জন্য ছিল আনন্দময় অভিজ্ঞতা। হুমায়ুন কবির এবং মুলকরাজ আনন্দ আহূত এই সম্মেলনে পশ্চিম বাংলা এবং ভারতীয় সাহিত্যের দিকপাল ব্যক্তিত্বরা ছাড়াও যোগ দিয়েছিলেন এশিয়ার নানা দেশের প্রতিনিধি। সবচেয়ে ফলপ্রদ অভিজ্ঞতা হয়েছিল ১৯৬৪ সালে ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়ে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে বৎসরকাল অবস্থান। ষাটের দশকের সেই সময়টাতে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ভারত ও বঙ্গবিদ্যাচর্চার এক প্রধান পীঠস্থান। এখানে অবস্থান ও অধ্যয়ন আনিসুজ্জামানকে অনেকভাবে সমৃদ্ধ করেছিল, যা তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় জুগিয়েছিল গভীরতা। দেশে ফেরার পর আনিসুজ্জামান জড়িয়ে পড়েন আইয়ুবী শাসনের বিরুদ্ধে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক সাহিত্যিক উদ্যোগের সাথে। ক্রমেই তিনি হয়ে উঠছিলেন, মার্কিনি ভাষায় যাকে বলা হয় ‘পাবলিক ইনটেলেকচুয়াল’।
সর্বপথগামী হওয়ার লক্ষণ এবার প্রকাশ্য হতে শুরু করেছিল। ষাটের দশকে বাঙালি চেতনা বিকাশে নানা ধরনের সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক উদ্যোগে আনিসুজ্জামান হয়ে ওঠেন অপরিহার্য ব্যক্তিত্ব। তাঁর কর্মের বৃত্তসংখ্যা বাড়ছিল, পরিধিও প্রসারিত হচ্ছিল। যখন যোগ দিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন কেবল অন্যতর বৃত্ত আলিঙ্গন করলেন তা নয়, তার বৃত্তসংখ্যা আরো বৃদ্ধি পেয়ে চললো।
এভাবে দেশ উপনীত হয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে, গণহত্যার সূচনা জাতিকে নিয়ে গেল সশস্ত্র প্রতিরোধের মুক্তিযুদ্ধে। আরো অনেকের সঙ্গে দেশত্যাগ করে আনিসুজ্জামান উপনীত হলেন কলকাতায় এবং মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে যুক্ততা, সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের প্রতিরোধ, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে বিদেশি বন্ধুদের সহায়ক কর্ম-পালন ইত্যাদি কত-না কাজেই তিনি যুক্ত হলেন। এহেন পরিস্থিতিতে অচ্যুতানন্দ সাহা ও চিত্ত সাহার প্রতি সাহায্যের হাত তিনি বাড়িয়ে দেন, ‘স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ’শুরু করে গ্রন্থের পুনর্মুদ্রণ ও নতুন গ্রন্থ প্রকাশের কাজ। মুসলিম-মানস ও বাংলা সাহিত্য যে মুক্তিযুদ্ধকালে কলকাতা থেকে পুনরায় প্রকাশিত হয়েছিল সেটা বুদ্ধিজীবীর ভূমিকার আরেক মাত্রা মেলে ধরে। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে আবার যোগাযোগ হয়। ড. মুশারফ হোসেন-স্বদেশ বসুর সুহৃদ অর্থনীতিবিদ ড্যানিয়েল থরনারের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল কলকাতাতেই। তদুপরি পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতীয় অধ্যাপক-বুদ্ধিজীবীরা তো ছিলেনই। আনিসুজ্জামানের বৃত্ত প্রসারিত হয় আরো নানাভাবে।
১৯৭১-পরবর্তী আত্মস্মৃতির নামকরণ করেছেন আনিসুজ্জামান বিপুলা পৃথিবী, সত্যিকার অর্থেই বাইরের বিশাল পৃথিবীর পথে পা বাড়িয়েছিলেন তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর। এই সুবাদে ১৯৭৩ সালে তাঁর পরিচয় আনোয়ার আবদেল-মালেকের সঙ্গে, প্যারিসের রাস্তায় কোনো এক রোডসাইড কাফেতে। সে-বছরই প্যারিসে আয়োজিত হয়েছিল ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অব ওরিয়েন্টালিস্ট সংস্থার দ্বিশতবার্ষিকী উপলক্ষে বিশ্ব-সম্মেলন। অধ্যাপক ড্যানিয়েল থরনার তখন সোরবোনের সংশ্লিষ্ট এক কেন্দ্রে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত, তিনিই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন আনিসুজ্জামানকে কলকাতায় পূর্ব-পরিচয়ের সূত্র ধরে। বাংলাদেশ থেকে আরো গিয়েছিলেন অধ্যাপক আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের পরিচালক ড. এম.এ. গফুর। ভারতীয় প্রতিনিধিদলে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ছিলেন ড. বরুণ দে, ড. অনিরুদ্ধ রায়, ড. হিতেশরঞ্জন সান্যাল, ড. কল্যাণকুমার দাশগুপ্ত ও নবনীতা দেবসেন। পাকিস্তান থেকে এসেছিলেন অধ্যাপক আহমদ হাসান দানি, দিল্লি থেকে রমিলা থাপার, মুনিস রাজা ও আরো কেউ কেউ। এত বড় সম্মেলনে থাকে সমান্তরাল অনেক অধিবেশন, সোরবোনের বেশ কটা ভবনজুড়ে চলে সভা, সবকিছুর হদিস করাও মুশকিল। একটি সেশনে সভাপতিত্ব করেছিলেন আনিসুজ্জামান। অবসর সময় সদলবলে ঘুরে দেখেছেন প্যারিস শহর, যা ছিল মনোরম অভিজ্ঞতা। এমনি সময়ে রাস্তার পাশে কফিপানরত আনোয়ার আবদেল-মালেকের সঙ্গে দেখা। বরুণ দে তাঁর পূর্ব-পরিচিত, তিনি সোৎসাহে তাঁকে ডাকলে বরুণ দে-ই সবার সঙ্গে আনোয়ারের পরিচয় করিয়ে দেন। মিশরের জাতীয়তাবাদী প্রগতিশীল আন্দোলনে আনোয়ার আবদেল-মালেকের ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, পরে জামাল আবদেল নাসের বামপন্থিদের দমন করতে শুরু করলে তিনি পালিয়ে আসেন প্যারিসে। এখানে সিএনআরএস শীর্ষক খ্যাতনামা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে তিনি কাজ করছেন গবেষণা-অধ্যাপক হিসেবে। আরব অঞ্চলের একজন অগ্রণী বুদ্ধিজীবী হিসেবে তিনি পরিচিত। আনিসুজ্জামানের সঙ্গে এই স্বল্পকালের আলাপ নিশ্চয় আনোয়ার আবদেল-মালেকের মনে বিশেষ রেখাপাত করেছিল এবং আনিসুজ্জামানকে তিনি স্মরণে রেখেছিলেন। পরে তাঁর কাজের সঙ্গে আনিসুজ্জামানকে তিনি নিবিড়ভাবে যুক্ত করেছিলেন এবং এক পর্যায়ে আনোয়ার আবদেল-মালেকের কাজের মূল সহায় হয়ে উঠেছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।
আনোয়ার আবদেল-মালেক এবং অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মধ্যে ভাবনার সাযুজ্যে যে নিবিড় মৈত্রী গড়ে ওঠে তা আনিসুজ্জামানকে কর্মের নতুন স্তরে নিয়ে যায়। কী তাঁদের চিন্তা এবং কিই-বা ছিল তাঁদের কাজ সেটা বলার আগে তৎকালীন বিশ্বের সারস্বত সমাজে প্রচলিত ভাবনার আগল ভেঙে যে-নতুন পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের ধারা উদ্গত হচ্ছিল সে-কথা সংক্ষেপে বলা যায়। এক্ষেত্রে এটা বেশ কৌতুকপ্রদ ঠেকে যে, আনোয়ার আবদেল-মালেক ও আনিসুজ্জামানের প্রথম সাক্ষাৎ ঘটেছিল প্যারিসের রোডসাইড কাফেতে। ইউরোপের কাফে-সংস্কৃতি প্রসঙ্গে আমার নিজেরও রয়েছে কৌতুককর অভিজ্ঞতা। আশির দশকে আন্তর্জাতিক থিয়েটার ইনস্টিটিউটের কমিউনিকেশন কমিটির সদস্য হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম বোনার ফেস্টিভ্যালে, পশ্চিম জার্মানির রাজধানী বনে। সেখানে তুরস্কের প্রতিনিধি খেদ প্রকাশ করে বলেছিলেন যে, ইউরোপীয়দের ধারণা রোডসাইড কাফে যেখানে শেষ সভ্যতারও সেটা প্রান্তবিন্দু, এর বাইরে সভ্যতা পৌঁছোয়নি। এই উক্তিতে প্রাচ্য সম্পর্কে ইউরোপকেন্দ্রিক আত্মতুষ্ট চিন্তাধারার ব্যঙ্গাত্মক সমালোচনা প্রকাশ পেয়েছিল। আনিসুজ্জামান এবং আনোয়ার আবদেল-মালেকের যৌথ তৎপরতা প্রাচ্য তথা মানবসভ্যতা সম্পর্কে ইউরোপকেন্দ্রিক বিদ্যাচর্চার জগদ্দল কাঠামো ভাঙবার লক্ষ্যেই পরিচালিত হয়েছিল। সেই বিচারে রোডসাইড কাফেতে তাঁদের সাক্ষাৎ আরেক মাহাত্ম্য বহন করে বইকি।
এখানে আনোয়ার আবদেল-মালেকের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাখিল করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। মিশরীয় অধ্যাপক ও বুদ্ধিজীবী আনোয়ার বয়সে আনিসুজ্জামানের চাইতে যথেষ্ট বড়, তাঁর জন্ম ১৯২০ সালে এবং আনিসুজ্জামানের ১৯৩৭। এডওয়ার্ড সাঈদের মতো আনোয়ারও কপটিক খ্রিষ্টান। পড়াশোনা করেছেন সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে, মিশরে জামাল আবদেল নাসেরের অভ্যুত্থানের ছিলেন সোৎসাহী সমর্থক, নিজে ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। পরে বামপন্থিদের সঙ্গে নাসেরের সম্পর্কের অবনতি হলে তিনি দেশত্যাগ করে ফ্রান্সের স্থায়ী বাসিন্দা হন। তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থে গভীর সামাজিক বিশ্লেষণের পরিচয় পাওয়া যায়। একদিকে তিনি আরববাদী, অন্যদিকে মিশরীয় সত্তা নিয়েও ভাবিত। মিশর ও আরবভূমির পরিবর্তন এবং মানুষের মুক্তি তাঁর ভাবনার প্রধান ক্ষেত্র ছিল। সেই অবস্থান থেকে তিনি ক্রমে তৃতীয় বিশ্বের জাগরণ এবং পাশ্চাত্য চিন্তার গণ্ডি ভেঙে প্রাচ্য-চিন্তার পরিপুষ্টি ও ভিন্নতা জোরদার করার দিকে ঝোঁকেন। তাঁর গ্রন্থাবলি চিন্তার এই বিবর্তন এবং নতুন বিশ্বজনীনতার বিকাশের প্রতি পক্ষপাত প্রকাশ করে। ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত তাঁর গ্রন্থ Orientalism in Crisis এই চিন্তার প্রকাশ ঘটায়। এই চিন্তাধারা সংহত রূপ নেয় এডওয়ার্ড সাঈদের ওরিয়েন্টালিজম গ্রন্থে (প্রকাশকাল ১৯৭৮), যেখানে ইউরোপের দৃষ্টিতে প্রাচ্যের নির্মাণ সমাজ, সাহিত্য ও বুদ্ধিচর্চার ইতিহাসের নিরিখে কঠোরভাবে সমালোচিত হয়। সাঈদের গ্রন্থ প্রকাশের দেড় দশকের আগে প্রকাশিত হয় আনোয়ার আবদেল-মালেকের বই। এ-কারণে আনোয়ার আবদেল-মালেককে ‘ওরিয়েন্টালিজম’ চিন্তাধারার পূর্বসূরি হিসেবে সম্মানিত করা হয়। আনোয়ার আবদেল-মালেক তাঁর পূর্বোক্ত গ্রন্থের সূচনায় উদ্ধৃত করেছিলেন বিজ্ঞানী সমাজচিন্তক জোসেফ নিডহ্যামের উক্তি, যা তাঁর নিজ চিন্তারই প্রতিধ্বনি বলা যায়। নিডহ্যাম বলেছিলেন, “It is indispensable to view Europe from the outside, to view the history of Europe as well as its successes, through the eyes of vast part of humanity, which is formed by the people of Asia and Africa.” বস্তুত, তৃতীয় বিশ্বের মুক্তি আন্দোলন নিয়ে আনোয়ার আবদেল-মালেক ছিলেন বিশেষভাবে আলোড়িত। এই আন্দোলন তথা জাগরণের তাত্ত্বিক ও দার্শনিক দিক নিয়ে আনোয়ার ছিলেন ভাবিত। অন্যদিকে সত্তরের সেই দশক অনেক ধরনের সম্ভাবনা ও সুযোগ মেলে ধরেছিল বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় ইউরোপীয় তথা পাশ্চাত্যের গণ্ডি থেকে বের হয়ে আসার। সেই সময়ে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা-অর্জনকারী বাংলাদেশের প্রতিনিধি তরুণ বুদ্ধিজীবী আনিসুজ্জামানের সঙ্গে হঠাৎ সাক্ষাৎ আনোয়ার আবদেল-মালেককে প্রীত করেছিল নিশ্চয়। আনিসুজ্জামানও তাঁর স্মৃতিভাষ্যে সংক্ষেপে বলেছেন, ‘আনোয়ার আবদেল-মালেকের সঙ্গে প্যারিসের ফুটপাতের কাফেতে সেদিন আমার বেশ ভাব হয়ে গেল এবং গত তিরিশ বছরে আমাদের মধ্যে একটা গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।’ আগামীতে কেউ যদি কখনো তৃতীয় বিশ্বের বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাধারার বিবর্তন ও শক্তিময়তা সন্ধান করে ফেরেন তবে আনোয়ার-আনিসুজ্জামান সম্পর্কসূত্র ও যৌথ প্রয়াস তাঁদের অনেক ভাবনার খোরাক জোগাতে পারে। আমরা এখানে উভয়ের কর্মধারা অনুসরণ করে তাঁদের দ্বারা সম্পাদিত Culture and Thought গ্রন্থবিষয়ে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করবো।
স্বল্পকালের সেই প্রথম সাক্ষাতের পর ১৯৭৪ সালে আনোয়ার আবদেল-মালেকের চিঠি পান আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক ইমানুয়েল ওয়ালেরস্টাইন কানাডার ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটিতে ‘ইনইকুয়ালিটি’ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করছেন। আনোয়ার আবদেল-মালেক চান আনিসুজ্জামান সেখানে যোগ দেন। তিনি যেতে পারবেন না, তবে নিশ্চিত জানেন সেখানে আনিসুজ্জামান অনেক চিন্তাশীল মানুষের সাক্ষাৎ পাবেন। আনিসুজ্জামান এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন, তাঁর মনে হয়েছিল, ‘এতদিন বামপন্থার সঙ্গে জড়িয়ে আছি, বিষয়টি আমার নয় বলতে দ্বিধা হয়। আবার বিষয়টি সম্পর্কে যেমন বিশেষ জ্ঞান থাকলে অ্যাকাডেমিক সেমিনারে অংশ নেওয়া যায়, তা আমার নেই। এটা ভেবেও সংকোচ হয়।’ যথারীতি ইমানুয়েল ওয়ালেরস্টাইনের আমন্ত্রণ এসে পৌঁছালো, আনিসুজ্জামানকে একটি অধিবেশনে ব্রাজিলের পণ্ডিতের উপস্থাপিত প্রবন্ধ নিয়ে আলোচনা করতে হবে। সম্মেলনে তাঁর আলোচনা শুনে বিশেষ প্রীত হয়েছিলেন প্রবীণ ভারতীয় সমাজতত্ত্ববিদ ‘সিক্স্ ভিলেজেস্ অব বেঙ্গল’ খ্যাত রামকৃষ্ণ মুখার্জি। তিনি আরো পরিচিত হয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার নির্বাসিত কবি ডেনিস ব্রুটাস এবং তিউনিসিয়ার অধ্যাপক মোহাম্মদ সালাহ্ সাফিয়ার সঙ্গে। ‘ওয়ার্লড সিস্টেম’ তত্ত্বের উদ্গাতা, সাম্রাজ্যবাদের কঠোর সমালোচক ইমানুয়েল ওয়ালেরস্টাইন পরে যোগ দিয়েছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফার্ডিনান্ড ব্রডেল সেন্টারে এবং দীর্ঘকাল এই সেন্টারের কাগজপত্র পাঠিয়েছিলেন আনিসুজ্জামানকে।
১৯৭৮ সালে দুটি পৃথক অথচ পারস্পরিক সম্পর্কিত ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করি। একটি ছিল আলোড়ন জাগানিয়া, অপরটি ঘটে কিছুটা নীরবে, তবে ততটা নিভৃতে নয়। প্রথমটি আমেরিকায় এডওয়ার্ড সাইদের ওরিয়েন্টালিজম গ্রন্থের প্রকাশ, দ্বিতীয়টি আনোয়ার আবদেল-মালেক কর্তৃক জাপানস্থ জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে মিলে Socio-Cultural Development Alternatives in a Changing World (SCA) শীর্ষক কয়েক বছরব্যাপী আন্তর্জাতিক ভাব-বিনিময়ের উদ্যোগ গ্রহণ। ইউনেস্কো সমর্থিত প্রকল্পের লক্ষ্য হিসেবে বলা হয়, “The SCA project has been launched with a view to reposting the problematique of alternatives in human and social evolution as of the wide array of visions of our world, through its interwoven circles of civilizational moulds, geo-cultural areas, formations and nations.” ভাষা খটমটে মনে হলেও এখানে উল্লিখিত ভাব-বর্গসমূহ তথা সভ্যতার বিস্তার, পারস্পরিক সংযুক্ত বিভিন্ন বৃত্ত এবং ভৌগোলিক সাংস্কৃতিক এলাকা, জাতি ও তার গঠন ইত্যাদি আনিসুজ্জামানের চিন্তাকর্মের অন্তর্গত এবং সাযুজ্যপূর্ণ বটে। প্রকল্পের ছিল দুটি দিক, একটি The Endogenous Intellectual Creativity (EIC) এবং অপরটি The Transformation of the World (TW)। সিএনআরএস-এর পক্ষ থেকে প্রকল্পের সমন্বয়ক ছিলেন আনোয়ার আবদেল-মালেক।
এটা বোধগম্য, এই উদ্যোগের পেছনে মুখ্য ভূমিকা ছিল আনোয়ার আবদেল-মালেকের। ওরিয়েন্টালিজমের ধারণা, কিংবা বলা যায় ওরিয়েন্ট-সম্পর্কিত পাশ্চাত্য-নির্মিত ধারণা পালটে বিকল্প প্রাচ্যের সত্যরূপ প্রতিষ্ঠার যে-তাগিদ নানাভাবে অনুভূত হচ্ছিল, আনোয়ার আবদেল-মালেক তারই এক বিশাল কর্ম-উদ্যোগের কাণ্ডারির ভূমিকা নেন। তৃতীয় বিশ্বে সমধরনের চিন্তার উদ্ভব হচ্ছিল নানা অঞ্চলে, বিভিন্ন চিন্তাসূত্রে। জ্ঞান ও ক্ষমতার সম্পর্কসূত্রের সন্ধান থেকে এই পরিবর্তন তথা পরিত্রাণের পথ খুঁজেছেন এডওয়ার্ড সাইদ এবং তাঁর রচনাসমূহ সেই সাক্ষ্য বহন করে। পাশ্চাত্যের বিশ্ব-বীক্ষণের তীব্র সমালোচক ফ্রান্জ ফ্যাননের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে এডওয়ার্ড সাইদ বলেছিলেন যে, এমন সমালোচনা সত্তে¡ও ফ্যানন এক্ষেত্রে পরিবর্তন আনয়নের কোনো রূপরেখা প্রদান করেননি। সমস্যার উৎস চিহ্নিত করে Freud and the Non-European গ্রন্থে তিনি লিখেছিলেন, “The gist of Fanon’s attack was to include the whole edifice of European humanism itself, which proved incapable of going beyond its own invidious limitation of vision. As Immanuel Wallerstein described so well, subsequent critics of Euro-centrism in the last four decades of the twentieth century furthered the attack by taking on Europe’s historiography, the claim of universalism, its definition of civilization.” আমরা বুঝতে পারি আনোয়ার আবদেল-মালেক, ইমানুয়েল ওয়ালেরস্টাইন, এডওয়ার্ড সাইদ বহন করছিলেন সমচিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি, যে-বৃত্তে আনিসুজ্জামানও যোগ দিলেন।
ফিরে তাকালে আমরা বুঝতে পারবো, এডওয়ার্ড সাইদ যে-যাত্রা সূচিত করেছিলেন ভাবাদর্শের ক্ষেত্রে, আনোয়ার আবদেল-মালেক সেটারই বাস্তব রূপকার হতে চেয়েছিলেন তাঁর আন্তঃমহাদেশীয় প্রকল্পের মাধ্যমে। এ কাজে সহায় হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন আনিসুজ্জামানকে এবং আন্তর্জাতিক ভাবজগতে পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় সংহতি গড়ার কাজে আনিসুজ্জামান নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন অশেষ শ্রম, নিষ্ঠা ও অনন্য মেধার সমন্বয় করে। স্থির হয়েছিল ১৯৭৮ সালের নভেম্বরে এশীয় আঞ্চলিক সিম্পোজিয়াম হবে জাপানে, ১৯৭৯ সালের নভেম্বরে ল্যাটিন আমেরিকার সিম্পোজিয়াম হবে মেক্সিকোতে, এরপর কুয়েতে ১৯৮১ সালের মার্চে আরব আঞ্চলিক সেমিনার আয়োজিত হবে। এছাড়া Transformation of the World পর্যায়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্মেলন হবে বেলগ্রেডে ১৯৭৯ সালে, অর্থনীতি ও সমাজ বিষয়ে মাদ্রিদে ১৯৮০ সালে এবং ‘সংস্কৃতি ও চিন্তাধারা’ বিষয়ে আলজিয়ার্সে ১৯৮১ সালে।
এটা অনুমেয়, আন্তর্জাতিক ভাবজগতে বড় রকম ছাপ ফেলতে উদ্যোগী হয়েছিলেন আনোয়ার আবদেল-মালেক এবং ইউনেস্কোর আওতায় এমন উদ্যোগ গ্রহণের অনুকূল পরিবেশও তখন বিরাজ করছিল। উত্তর-দক্ষিণ সংলাপ সেসময় জোরদার হয়েছে নতুন বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজনকে স্বীকৃতি দিয়ে। একই সাথে গণমাধ্যমে পশ্চিমি আধিপত্য ঘোচাতে শন ম্যাকব্রাইডের নেতৃত্বাধীন ইউনেস্কো কমিশন কাজ করছিল নতুন বিশ্ব গণসংযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে। এসব উদ্যোগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ইউনেস্কো ও জাতিসংঘের বিরুদ্ধে করে তুলেছিল মারমুখী। তারা ইউনেস্কোর তহবিলে অর্থ জোগান ক্রমে বন্ধ করে দিতে থাকে। অন্যদিকে আশির দশকের মধ্যভাগ থেকে সমাজতন্ত্রের অভ্যন্তরীণ সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং ঘনীভূত হতে থাকে অভাবিত নানা ধরনের সংকট। একদিকে চলছিল সমন্বিত বুদ্ধিবৃত্তিক প্রয়াসে নতুন চিন্তাধারার সংহতি রচনার চেষ্টা, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ক্রমেই এমত প্রয়াসকে আনুকূল্য জোগান থেকে বিরত হতে শুরু করেছিল।
তবে প্রকল্পের সূচনা হয়েছিল বড়ভাবেই। জাপানের সিম্পোজিয়াম (১৯৭৮) আনিসুজ্জামানের জন্য বিশেষ ফলপ্রদ হয়েছিল। ২২টি দেশের ৬৬ জন বিদ্বানের সঙ্গে তাঁর ভাববিনিময় ভালোভাবে ঘটেছিল, তিনি পেশ করেছিলেন প্রবন্ধ, সামাজিক পটভূমির সঙ্গে সৃজনশীলতার সম্পর্ক বিষয়ে। পরে মেক্সিকোর সম্মেলন তাঁর কাছে মনে হয়েছিল অনেকটা ঢিলেঢালা, ল্যাটিন চরিত্রের সঙ্গে কিছুটা মিল রেখেই বোধকরি। কুয়েতে আয়োজিত সিম্পোজিয়ামে (১৯৮১) আনিসুজ্জামান উপস্থাপন করেন প্রবন্ধ, অ্যান আউটসাইডার্স ভিউ অফ অ্যারাব এনডোজেনাস ইন্টেলেকচুয়াল ক্রিয়েটিভিটি। তিনি আরব সৃষ্টিশীলতায় শনাক্ত করেছিলেন তিনটি বৃত্ত, প্রথমত আঞ্চলিক, দ্বিতীয়ত ইসলামি এবং তৃতীয়ত বিশ্বের সঙ্গে যোগে আধুনিক। বোঝা যাচ্ছিল, সংস্কৃতির বহুত্ববাদে তাঁর আস্থা ক্রমে বাড়ছে এবং সত্তার একরূপত্ব নিয়ে তিনি আর সন্তুষ্ট নন। এই সূত্রে ১৯৮০ এবং ১৯৮১ সালে আনোয়ার আবদেল-মালেকের সহায়তায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় আকারে দুটি কর্মশালার আয়োজন করেন আনিসুজ্জামান, উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয় বা আঞ্চলিক সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা আরো প্রসারিত করা। কর্মশালার শিরোনাম ছিল : ক্রিয়েটিভিটি অ্যান্ড দি ইন্টিগ্রেশন অফ ট্রাডিশন্স অ্যান্ড মডার্ন অ্যাটিচুড্স। বাংলাদেশের বিদ্বৎজনের সমাবেশ ঘটেছিল এই আয়োজনে, অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককেও তিনি শরিক করতে পেরেছিলেন সম্মেলনে, উদ্বোধনী ভাষণ তিনিই দিয়েছিলেন।
১৯৮১ সালে আলজিয়ার্সে যে সিম্পোজিয়াম অনুষ্ঠিত হয় তার র‌্যাপোর্টিয়ার ছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, দায়িত্ব ছিল সম্মেলনের পর উপস্থাপিত প্রবন্ধসমূহ নিয়ে তিনি এবং আবদেল-মালেক গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি তৈরি করবেন। পরম যত্ন ও শ্রমদান করে খুব অল্প সময়ে এ-কাজ সম্পাদন করেন আনিসুজ্জামান। তিনি ভালোই বুঝেছিলেন দেশে বসে অখণ্ড মনোযোগ দিয়ে কাজ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে না, তাই প্রস্তাব করেছিলেন আলজিয়ার্স থেকে তিনি প্যারিস চলে যাবেন, সেখানে বসেই সেমিনারের প্রবন্ধসমূহ একই ধারায় সমন্বয় করে পরিবেশন ও বিষয়-বিন্যাস করবেন। আবদেল-মালেককে জানালেন, ‘আমার পারিশ্রমিকের অর্থটা প্যারিসে দিলে তা দিয়ে আমার থাকা-খাওয়া চলে যাবে। তিনি যেন তেমন ব্যবস্থা করেন। আনোয়ার খুবই খুশি হলেন, তবে তিনি নিশ্চয় আমাকে বেকুব ঠাওরালেন।’ বিদ্যা-সংক্রান্ত কাজে এমন বোকামির পরিচয় আনিসুজ্জামান অবশ্য জীবনভর দিয়ে এসেছেন।
প্যারিসে বসে সম্পাদনার কাজ সানন্দে সম্পন্ন করেন আনিসুজ্জামান। মূল কাজটি তাঁকেই করতে হয়, সেমিনারের প্রতিটি প্রবন্ধ পাঠ করে সংক্ষিপ্ত ভাষ্য তৈরি, বিভিন্ন অধিবেশনের সূচনায় সম্পাদকীয় মন্তব্য যোগ করা, দীর্ঘ এক ভূমিকা এবং সংক্ষিপ্ত উপসংহার রচনা। এসব এত সুচারুভাবে করেছেন যে, এই গ্রন্থ সম্পাদনার আদর্শ হিসেবে বিবেচ্য হতে পারে। পরে লন্ডনের ম্যাকমিলান প্রেস থেকে Culture and Thought নামে গ্রন্থটি প্রকাশ পায়। বই হাতে পেয়ে আনিসুজ্জামান বিলক্ষণ আনন্দিত হয়েছিলেন, লক্ষ করেছিলেন সম্পাদক হিসেবে আনিসুজ্জামানের নামটি আগে দিয়ে নিজের নাম আনোয়ার পরে রেখেছিলেন। এই সৌজন্য নিশ্চয় প্রীতিকর। আরেকটি পরিবর্তন করেছিলেন আনোয়ার আবদেল-মালেক, অবতারণা অংশে প্রকল্প-পরিচালক হিসেবে তাঁর বক্তব্যের বাছাই অংশ উদ্ধৃত করেছিলেন আনিসুজ্জামান, আনোয়ার সেখানে পুরোটাই জুড়ে দিয়েছিলেন। পরে The Transformation of the World Volume 3 হিসেবে প্রকাশিত গ্রন্থ দেখে আমি অবশ্য খুশি হতে পারিনি। ম্যাকমিলান বড় অযত্নে প্রকাশ করেছে এই বই। ভেতরে কাগজের মান ভালো নয়, মূল লেখা ছাপা হয়েছে এমন ছোট হরফে, যার পাঠগ্রহণ চোখের জন্য সুখকর নয়। প্রচ্ছদে ব্যবহৃত হয়েছে জার্মান মানচিত্রকর আরনো পিটার্সের অভিক্ষেপণে নতুন বিশ্ব-মানচিত্র। ইতিপূর্বে কৃত এবং বহুল প্রচারিত মারকেটরের মানচিত্রে দেশ-মহাদেশসমূহের অনুপাতে সমস্যা ছিল, সেই অভিক্ষেপণ ছিল ইউরোপকেন্দ্রিক, ফলে প্রতি দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলো যথাযথ অনুপাতে রূপ পায়নি। সেই মানচিত্রে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলো তুলনামূলকভাবে ছোট দেখায়। এই ত্রুটি সংশোধন করে পিটার্স যে নতুন মানচিত্র করেছিলেন, সেটা প্রচ্ছদে জুড়ে দিয়ে বিশেষ বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছিল। তবে রহস্যজনকভাবে বইয়ের কোথাও প্রচ্ছদশিল্পীর নাম দেওয়া হয়নি, বলা হয়নি কেন এমন মানচিত্র ব্যবহৃত হয়েছে, যা সচরাচর দেখা মানচিত্রের চাইতে ভিন্নতর। বলা যেতে পারে, জ্ঞান ও ক্ষমতার যে দাম্ভিকতা বিকাশ তার জের হিসেবে পাশ্চাত্যের সাবেকি চিন্তার প্রাধান্য এক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হয়েছে।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৯৮৩ সালে ক্যামব্রিজে আয়োজিত জিও-পলিটিক্যাল ভিশন্স্ অফ দি ওয়ার্ল্ড শীর্ষক সেমিনারে আনিসুজ্জামানের যোগদানের ব্যবস্থা করেছিলেন আনোয়ার আবদেল-মালেক। আনিসুজ্জামান তখন লন্ডনে ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে কাজ করছিলেন জেনেই আনোয়ার এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন এই সেমিনারের অন্যতম আয়োজক। সভার উদ্বোধনী বক্তা ছিলেন বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদ জোসেফ নিডহ্যাম, কয়েক খণ্ডে প্রণীত তাঁর Science and Civilization in China (১৯৫৪ থেকে প্রকাশিত), মানব-মনীষার অসামান্য নিদর্শন হিসেবে কীর্তিত। আনিসুজ্জামান স্মরণে রেখেছেন নিডহ্যামের ভাষণ, তিনি বলেছিলেন তাঁদের সময়কার গ্রন্থাগারের কথা, যেখানে ইউরোপ ও পৃথিবীর ইতিহাস স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত থাকতো, তা ছাড়া থাকতো অন্যান্য দেশের ইতিহাস বলে একটা অংশ। ইউরোপ ছাড়া পৃথিবীর বাকি অংশকে এইভাবে ব্রাত্য করে রাখার মধ্যে যে ইউরোপকেন্দ্রিক মনোভাব আছে, তার সমালোচনা করেছিলেন তিনি। এই সেমিনারেই যোগ দিয়েছিলেন তরুণ জার্মান মানচিত্রকর আরনো পিটারস, তাঁর উপস্থাপিত বিষয় ছিল, The Parity of Representation of Space and Time as Essential Promise for a Scientific View of the World. এভাবে আনোয়ার আবদেল-মালেকের সহযোগিতায় আনিসুজ্জামান পাশ্চাত্য অ্যাকাডেমিক চিন্তাবৃত্তে ইউরোপকেন্দ্রিকতার সমালোচনার বিভিন্ন ধারার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন।
তবে বিশ্বজনীন নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নতুন জ্ঞান প্রতিষ্ঠার আয়োজন বাস্তবে অস্বীকৃত হয় অচিরে। আশির দশকের দ্বিতীয়ার্ধে ফাটল দেখা দেয় সমাজতান্ত্রিক শিবিরে, ভেঙে পড়ে বার্লিন দেয়াল, বিলুপ্ত হয় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ঘিরে নতুন চিন্তার প্রসারক যে আয়োজন চলছিল সেসব আর কোনো গতি পায় না। তবে প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়াস ভেঙে পড়লেও চিন্তার প্রবাহ তো রুদ্ধ হয় না। নতুন পরিস্থিতিতে নতুনভাবে চলে মানুষের ভাবজগতের সংগ্রাম, আগের মতো সম্মিলিত আয়োজন আর ঘটে না, তবে অনেক নতুন বৃত্ত তৈরি হয়, চলে নতুন অনুসন্ধান, নতুন পথ খুঁজে নেওয়ার প্রয়াস।
নানা সেমিনার-সিম্পোজিয়াম উপলক্ষে আনিসুজ্জামানের বিদেশে যাতায়াত ঘটছিল, তবে এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার বিদ্বৎসমাজ মিলে যৌথভাবে চিন্তাধারার বিনিময়, সংশ্লেষণ ও বিচিত্রতার সন্ধান আর রইলো না। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয় আনিসুজ্জামানের বক্তৃতা-সংকলন Creativity, Reality and Identity, যে-গ্রন্থ তিনি উৎসর্গ করেছিলেন আনোয়ার আবদেল-মালেককে, লেখেন : In Friendship and Gratitude. আনিসুজ্জামান পুনরায় যখন প্যারিস গিয়েছিলেন ১৯৯৪ সালে প্রাচ্য ভাষা ইনস্টিটিউটে ফ্রাঁস ভট্টাচার্যের আমন্ত্রণে, সেবার ইনস্টিটিউটে বক্তৃতা দেওয়া ছাড়াও সোরবোনে বক্তৃতা দিয়েছিলেন সন্ত-জীবনী সিরিজে সপ্তদশ শতকের কবি সৈয়দ সুলতানের নবীবংশ সম্পর্কে। সিএনআরএসে বক্তৃতা দিয়েছিলেন বাংলাদেশের ধর্ম ও রাজনীতি বিষয়ে। পরপর দেওয়া এই দুই ভাষণ বুঝিয়ে দেয় আনিসুজ্জামানের চিন্তার ব্যাপ্তি, আবার উভয় বক্তৃতার মূলে আছে স্বরূপের সন্ধান। ফেরার আগে ছিল আনোয়ার আবদেল-মালেকের বাড়িতে বিদায়ী নৈশভোজ। তখনো তিনি সিএনআরএসে আছেন, তবে বিশ্বজনীন কর্মসূচি আর নেই, তাঁরও অবসর গ্রহণের সময় হয়ে এসেছে। পুরনো পৃথিবী বিদায় নিয়েছে বটে, তবে যে-নতুনের প্রত্যাশা ছিল পূর্বতন ঔপনিবেশিক বিশ্বে তার কোনো সম্ভাবনা আর লক্ষগোচর ছিল না। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতন এবং মার্কিনি নেতৃত্বে পশ্চিমি শক্তির একাধিপত্য বিশ্ব-পরিস্থিতি করে তুলেছিল আরো অস্থিতিশীল, সংঘাতময় ও সহিংস। ১৫ জুন ২০১২ প্যারিসে মৃত্যুবরণ করেন আনোয়ার আবদেল-মালেক। তাঁর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় মিশরে, সেখানে প্রবীণ বিদ্বৎজন, তাত্ত্বিক-অধ্যাপকদের পাশাপাশি বহু তরুণ সমবেত হয় তাঁর শেষকৃত্যানুষ্ঠানে। উত্তর-ঔপনিবেশিক পটভূমিকায় চিন্তার যে বিস্তার ও গভীরতা তিনি বয়ে এনেছিলেন, ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন বিশ্বময়, বিশেষভাবে তৃতীয় দুনিয়ায়, তার জের তত সহজে মুছে যাওয়ার নয়। বিশ্বে হানাহানি, সংঘাত, সহিংসতা যত বাড়বে, দার্শনিকতা ও চিন্তার গুরুত্বও তত জরুরি হয়ে উঠবে।
আনিসুজ্জামান এবং আনোয়ার আবদেল-মালেক তাঁদের সিম্পোজিয়াম-ভিত্তিক আলোচনাগ্রন্থ Culture and Thought-এর উপসংহার টেনেছিলেন যে-বক্তব্য দিয়ে তা পাঠকালে দেখা যাবে আশির দশকের গোড়ায় চিন্তার যৌথতা ও যুক্ততার ওপর গুরুত্বারোপ করে যে-প্রয়াস তাঁরা নিয়েছিলেন সেখানে বৈশ্বিক ঐক্য তাঁদের কাম্য হয়েছে, কিন্তু চিন্তার সমরূপত্ব তাঁরা চাননি। বরং তাঁরা চেয়েছেন অধিকতর সাম্যমূলক, অধিকতর সমৃদ্ধ এবং অধিকতর গণতান্ত্রিক বিশ্ব। এই চিন্তা যেমন আনোয়ারের, তেমনি আনিসুজ্জামানের। তাঁরা বলেছেন, এই সভার ভরকেন্দ্র ছিল,
Substantively and specifically, on the transformational processes − their nature, inner dialectics, external parameters, actors and forces involved on all sides − as a unified set of interwoven circles, whose exploration could, alone, give meaning to the contradiction and convergence, deeply ingrained differences and complementarity, and perhaps more so, to the disconcerting and disconnectedness of tempi, deeply rooted in the objective societal conditions of different units of analysis and action, as well as the different vision of the world at work in our time.
মনে হবে, তাঁরা বুঝি আজকের পৃথিবীর কথাই বলছেন, বহুত্বের মধ্যে সমন্বয় করে দেখছেন চিন্তার মুক্তিপথ।
এই চিন্তাদর্শন আনিসুজ্জামানকে আস্থাবান করেছে সংস্কৃতির বহুত্ববাদ বা বৈচিত্র্যে, যেকথা তিনি সুস্পষ্টভাবে উচ্চারণ করেন ১৯৯১ সালে কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটিতে প্রদত্ত ‘ইন্দিরা গান্ধী স্মারক বক্তৃতা’ প্রদানকালে। এই ভাষণ অনেক দিক দিয়ে উল্লেখযোগ্য, আনোয়ার আবদেল-মালেকের সঙ্গে মিলে বিশ্ব-পটভূমিকায় চিন্তাপথের অভিযাত্রী হওয়ার যে-প্রয়াস আনিসুজ্জামান নিয়েছিলেন এখানে তার নানা প্রতিফলন খুঁজে পাওয়া যায়। ইউরোপকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে তিনি বলেছেন, ‘এই প্রবল উচ্চমন্যতা এবং অন্যের সংস্কৃতি সম্পর্কে এই অবিমিশ্র অবজ্ঞা আরও স্থূল অভিব্যক্তি লাভ করে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় স্থাপিত ইউরোপীয় উপনিবেশের বহু স্থানে। … আশ্চর্য হবার কিছু নেই যে, আমেরিকায় বসতি-স্থাপনকারী ইউরোপীয়রা ইউকাতান, গুয়াতেমালা বা পেরুর চমৎকার সব সৌধরচনার কৃতিত্ব দান করেন ফিনিশীয়দের, মিশরীয়দের এবং স্থানীয় জনগণ ছাড়া আর যে-কোনো জনগোষ্ঠীকে।’
ইউরোপকেন্দ্রিকতার সমালোচনায় আনিসুজ্জামান উল্লেখ করেন মানচিত্রকর আরনো পিটারসের বক্তব্য, যাঁর সাক্ষাৎ তিনি পেয়েছিলেন ১৯৮৩ সালে ক্যামব্রিজের সেমিনারে। আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘চারশ বছর ধরে যথার্থ বলে পরিগণিত [মারকেটরের] এই মানচিত্র, পিটারসের মতে, ইউরোপকেন্দ্রিক। মারকেটরের প্রজেকশন ষোলো শতকের, অর্থাৎ ইউরোপের সম্প্রসারণের সময়ের ব্যাপার। তাই সেই মানচিত্রের কেন্দ্রে থাকবে ইউরোপ, এটা মোটেও আশ্চর্যের বিষয় নয়। কিন্তু সাম্রাজ্য হারাবার পরও ইউরোপের এই অসম প্রতিকৃতিতে কোনো রদবদল ঘটেনি।’
এই ভাষণে আনিসুজ্জামান সভ্যতার বিস্তার থেকে দেখেছেন সংস্কৃতি, জাতীয়তা ও বহুত্ববাদের বিষয়সমূহ। রাষ্ট্র ও জাতীয়তার মধ্যে একাধিক বৃত্ত তিনি শনাক্ত করেন, তাদের বুনট তৈরির প্রয়োজনীয়তা ও আধিপত্যবাদের সংকটের দিকে দৃষ্টি দেন। ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে তিনি যৌগিক সংস্কৃতির মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন ভাবের অবস্থান দেখতে পান। তারপরও তাঁর মনে হয়, ‘ঐক্যের চেতনা কখনো এক-সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ছিল না।’ আবার সমস্যার গভীরতাও তিনি চিহ্নিত করেন এবং বলেন, ‘গত পঞ্চাশ বছরে আমাদের অভিজ্ঞতা এই যে, সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে ঐক্য গড়ে তোলা সহজ – এক বা অন্য ধরনের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে তাই দেখা গেছে; কিন্তু পরবর্তীকালে সে ঐক্য রক্ষা করা দুরূহ – যেমন জাতিগঠনের প্রক্রিয়ায় কিবা বহুজাতিক রাষ্ট্রনির্মাণের প্রয়াসের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে।’ বেদনার সঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘নিজের দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা খুইয়ে আমি যেমন দুঃখিত, তেমনি ভারতে হিন্দুত্বের জাগরণে আমি ভীত।’
বিগত দশকগুলোতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে আনিসুজ্জামান যে-অভিজ্ঞতা আহরণ করেছিলেন, বিশেষভাবে আনোয়ার আবদেল-মালেকের সহযোগে, তার নির্যাস আমরা পাই‘সাংস্কৃতিক বহুত্ব’ বিষয়ক এই ভাষণে। সংস্কৃতির বিশিষ্টতার সঙ্গে সর্বজনীনতার দিকটি তিনি এখানে তুলে ধরেন। তাঁর মতে, সংস্কৃতির কারবার মানুষ ও তার জগৎ নিয়ে, তাই একই সঙ্গে তা বিশেষকে ও সর্বজনীনকে প্রকাশ না করে পারে না। এই দুইয়ের টানাপড়েন প্রসঙ্গে তিনি স্মরণ করেন সুহৃদ আবদেল-মালেকের উক্তি, ব্যাখ্যা করে বলেন :
ফ্রান্স-প্রবাসী মিশরীয় সমাজবিজ্ঞানী আনোয়ার আবদেল-মালেক মনে করেন যে, বর্তমান বিশ্বে চলছে জাতীয় ইতিহাসের গভীরে প্রোথিত সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের পুনর্জাগরণের পালা। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এতকাল লঘুকরণবাদ (রিডাকশনিজম) ও আধিপত্যবাদের হুমকি মোকাবিলা করার পর তাদের আপন বৈশিষ্ট্যের মাত্রা, তার ওপর জোর পড়েছে। কথাটা বিশদভাবে বোঝার চেষ্টা করা যাক।
সাংস্কৃতিক ইতিহাসে আধিপত্যবাদের স্বরূপ আমরা আগেই আলোচনা করেছি। আমরা এটাও বলেছি যে, প্রাধান্য লাভকারী সংস্কৃতিতে গৃহীত আদর্শের মানদণ্ডে ‘অপর’ সংস্কৃতিকে বিচার করার প্রবণতাও প্রায়শ লক্ষ করা গেছে। সংস্কৃতি সম্পর্কে লঘুকরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মূলে কার্যকর হচ্ছে এই মনোভাব। আবদেল-মালেক সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের তিনটি পরস্পর-সম্পর্কিত বৃত্তের কথা বলেছেন : জাতিগত, সংস্কৃতিগত ও সভ্যতাগত। তা হলে একথা বলা যায় যে, সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য নিশ্চল ও অপরিবর্তনীয় কিছু নয়। তা গতিশীল ও নানামাত্রিক। ভিন্ন ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ভিন্নমাত্রার সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করতে পারি। যেমন আমরা তামিল সংস্কৃতির কথা বলি, আবার ভারতীয় সংস্কৃতির কথা বলি, সেইসঙ্গে দক্ষিণ এশীয় বা এশীয় সংস্কৃতির কথাও বলি। অন্য কথায়, আলাদা আলাদা করে বৃক্ষগুলি চিহ্নিত করতে পারি, আবার বনানীর কথাও বলতে পারি।
ভারতে এবং বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক, জাতিগত, ধর্মীয় বৈচিত্র্য ধারণ কিংবা বহুত্ববাদী সমাজের গুরুত্ব সম্পর্কে উপলব্ধি ও প্রয়োগে ঘাটতি তাঁকে বিশেষভাবে পীড়িত করেছে। সংস্কৃতির সর্বজনীনতার ওপর তাঁর আস্থা, তবে তা সমরূপত্ব অর্জনের জন্য নয়। ভাষণের শেষে তিনি ফরাসি বিজ্ঞানী ও দার্শনিক পাসকালের উক্তি স্মরণ করেন : ‘যে-বহুত্ব ঐক্যে উপনীত হয় না, তা বিশৃঙ্খলা; যে-ঐক্য বহুত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়, তা জুলুম।’

তিন
আনিসুজ্জামান যখন কাজ করেছেন ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে, দুই শতাধিক বছরের আগেকার চিঠিপত্র পাঠ, তথ্য ও সারকথা লিপিবদ্ধ করার শ্রমে নিবেদিত হয়েছেন নিঃসঙ্গ সাধকের মতো, অতীত ইতিহাসের দূর অবস্থান থেকে দূরতর প্রান্তে পৌঁছে সবার জন্য তুলে আনছেন বাংলা গদ্যের আদিরূপ, পুনরুদ্ধারকৃত সেই লুপ্ত সম্পদ এখন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের অঙ্গাঙ্গী অংশ। একই কাজের সূত্রে তিনি তো কেবল গদ্যের সুলুকসন্ধান করেননি, ঔপনিবেশিক ক্ষমতার দাপটে বাংলার তাঁতিদের বিপর্যস্ত জীবনবাস্তবতাও তিনি অনুভব করেছিলেন নিবিড়ভাবে, সবার জন্য মেলে ধরেছেন সেই ছবি।
অতীতে অবগাহন করার সমান্তরালে আনিসুজ্জামান যে-কাজে ব্রতী হয়েছিলেন তা ছিল ভবিষ্যৎবাদী। আনোয়ার আবদেল-মালেকের সহযোগে চিন্তার বলয়ে পশ্চিমি আধিপত্য মোচনে তিনি প্রয়াসী হয়েছিলেন। তৃতীয় দুনিয়ার দুই বুদ্ধিজীবী সভ্যতার বৈচিত্র্য ও বিশিষ্টতার সমন্বয়ে নতুন পথানুসন্ধানে বিশ্বজনীন জ্ঞানসংগ্রামীদের সমবেত করার যে চেষ্টায় নিবেদিত ছিলেন সেটা ছিল ভবিষ্যতের দিগ্দর্শন। একদিকে বর্তমান থেকে আনিসুজ্জামান যাত্রা করেছিলেন অতীতের গভীরতায়, অন্যদিকে বর্তমান থেকে তিনি অভিযাত্রী হয়েছিলেন ভবিষ্যতের পথরচনায়। ঔপনিবেশিকতার স্বরূপ তিনি জেনেছিলেন একদিকে, অন্যদিকে ছিল ঔপনিবেশিকতার জের তথা আধিপত্যবাদের শক্ত অবস্থান, শৃঙ্খলের পরিচয় জেনে তিনি খুঁজেছিলেন মুক্তির পথরেখা। এভাবে একত্রে গাঁথা হয়ে যায় অতীত ও ভবিষ্যৎ। তবে পথের বাধা তো দুস্তর, নতুন নতুন সংকট আচ্ছন্ন করে এগোবার পথ, তারপরও চলে চিন্তাপথের অভিযান, যার অনন্য উদাহরণ আনিসুজ্জামানের দুই ধারার কাজ।
আনিসুজ্জামানের চিন্তাধারা তাই বহুদিক দিয়ে প্রাসঙ্গিক। যে-চিন্তন তিনি বয়ে এনেছেন বাঙালির ভাবজগতে তা আরো গভীর বিচার-বিশ্লেষণ দাবি করে। তিনি নানাভাবে বাঙালির মননশীলতায় সমৃদ্ধি জুগিয়েছেন, সেটা এক বিশাল পাওয়া। তিনি আন্তর্জাতিক পরিসরে চিন্তায় আধিপত্যবাদ মোচন করে বুদ্ধির মুক্তি সাধনে ব্রতী হয়েছিলেন, সেটাও এক বড় অর্জন। তবে এসবের বিচার-বিশ্লেষণ, পর্যালোচনা এবং তা থেকে শিক্ষাগ্রহণে আমরা যেন উদ্যোগী হই, সেটাই হবে কাম্য।