কাজী রাফি
ব্রহ্মপুত্র, গাঙ্গেয় অববাহিকার উর্বর দ্বীপটির কাছে অভিপ্রয়াণ অভিলাষের অভিবাসী ছিল চিরকাল। আটশো বছর আগের এক নির্বীর্যকালে তেমনি কিছু ব্রাহ্মণের অভিপ্রয়াণ-প্রত্যাশী জীবনের বিন্যাস নিয়ে মঈন আহমেদের একেবারেই ভিন্নধাঁচের, ব্যতিক্রমী ভাষায় রচিত উপন্যাস বাদ্যি। ১৫৬ পৃষ্ঠার উপন্যাসটি শব্দের এক ভোজ বলা যায়। বাংলা ভাষা থেকে প্রায়বিস্মৃত অনেক শব্দের ব্যবহারে তিনি যে স্মৃতি-ব্যঞ্জনাকে ধারণ করে তৎকালীন সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মন্দির-সংস্কৃতি, বাংলায় বৌদ্ধধর্মের প্রচারিক কালসহ প্রাকৃতিক দৃশ্যকল্প এঁকেছেন তা এ-উপন্যাসের এক বড় শক্তি বটে। ভাষার পা-িত্য অবশ্যই প্রদর্শিত হয়েছে এখানে, তবে উপন্যাসের সব শর্ত প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সেটা করতে হলে হয়তো পরিসর বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল। লেখক কি এখানে তাড়াহুড়া করেছেন? মনে হয় তাই করেছেন। কারণ যাঁর ভাষার প্রতি এত দক্ষতা তিনি উপন্যাসের চরিত্র নির্মাণ এবং প্রেক্ষাপট বিস্তারে অনীহা দেখালেন কেন?
বাংলার মহাবীর্যবান রাজা আদিশূর (বিতর্কিত), কনৌজ থেকে পঞ্চ ব্রাহ্মণের আগমন, বিক্রমপুরের চর্যাপদের প্রবন্ধকার, অতীশ দীপঙ্কর, সম্রাট বল্লাল ও তাঁর পুত্র লক্ষ্মণ সেন এবং তাঁর দরবারের প্রধান কবি যিনি গীত গোবিন্দের রচয়িতা, সেই জয়দেব এসেছেন বাদ্যির আখ্যানে। ইতিহাসে জয়দেবের সেবিকা বা প্রিয়সঙ্গিনী পদ্মাবতীকে আমরা এখানে পাচ্ছি। মূলত পদ্মাবতী আর জয়দেবকে আবর্তিত করেই উপন্যাসের কাহিনি বিবৃত হয়েছে। ছয় বছর বয়সী পদ্মাবতীর সঙ্গে হার্দ সংগীতের মাদকতাপূর্ণ কণ্ঠের অধিকারী ব্রাহ্মণপুরুষ কীর্তনীয়ার বিয়ে। এরপর জ্ঞানান্বেষণে সদানন্দের সঙ্গে কীর্তনীয়ার প্রস্থান। মন্দির-সেবিকা শুক্লা আর চন্দ্রা-নাম্নী দুই নারীর সঙ্গে তাদের এক অন্ধকার রাতে নবদ্বীপের উদ্দেশে যাত্রা। সেখানে অপঘাতে কীর্তনীয়ার মৃত্যু। জয়দেবের গৃহত্যাগ এবং তার অনুসন্ধান এবং পদ্মাবতীর মিলন। তারপর ধর্মতত্ত্বের সঞ্চালন, সংসারধর্ম পালন ইত্যাদির পর্যায়ক্রম বর্ণনা এবং শেষে পদ্মাবতীর অন্তর্ধান। ইতিহাস এবং গল্পের বুননে তদ্ভব, তৎসম শব্দের সঙ্গে খাঁটি বাংলা শব্দের সমাহার। কোথাও ভিনদেশি শব্দ ব্যবহার হয়নি। ইতিপূর্বে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে আমার জানামতে শওকত আলীর প্রদোষে প্রাকৃতজন এই ভাষায় রচিত হয়েছে।
সময়ের ঘ্রাণকে ধারণ করা যে-কোনো গল্প-উপন্যাস ধারণ করতে লেখককে তাঁর অতীন্দ্রিয় সংবেদনশীলতা ব্যবহার করতে হয়। অতীত নস্টালজিয়াকে, ফেলে-আসা জীবনের স্মৃতিকে এবং ধারণকৃত সময়কে তীব্রভাবে উপলব্ধি না করলে সৃষ্টিকে শানিত করা যায় না। বাদ্যির বাক্যসমূহ এবং গল্পের মাঝে আমরা ইতিহাসের বাঁক এবং সেই সময়ের ঘ্রাণটুকু পাই। যেমন –
এইস্য নিদাঘ দিবসের মধ্যবেলায় বহির্দেশ থেকে দুজন পান্থ বাসুদেবের কুঞ্জে এসে উপস্থিত হলেন।
ঔপন্যাসিক গ্রন্থ-ভূমিকায় লিখেছেন, ‘আমি এই আখ্যান রচনা করতে গিয়ে তাঁদের সম্পর্কে বেশি কিছু জানতে পারিনি। তাই এখানে ইতিহাস থেকেও নেই।’ তাতে বরং ভালো হয়েছে। ইতিহাস আর তথ্যের ঝনঝনানির চেয়ে গল্প সৃষ্টিতে কল্পনার চমৎকারিত্বের মহত্ত্ব অনেক বেশি প্রয়োজন। সাহিত্য বোধ এবং রসের মেশাল। মঈন আহমেদ সেই বোধ এবং মানব-রসায়নকে নিজেই শুধু তাঁর কল্পনায় আস্বাদন করেননি, বরং তাঁর মাধুর্যপূর্ণ বর্ণনায় পাঠককেও সেই রসায়নে ডুব দিতে সহায়তা করেছেন। তাঁর বর্ণনায় আমরা সেই সময়ের পল্লি বাংলার রূপ নিজের চোখে একবার দেখে নিতে পারি –
এই হরিৎ ঘেরা ফুলে-ফলে-রসে-রূপে ভরা উচ্ছল শ্যামল ধরিত্রীর কোল, এই জল ছলছল নদী, এই প্রাণ দানকারী বায়ু – …
অথবা, যাত্রার পর শকটে বসে বহনকৃত ঢেঁকি পিষ্ট চালের অপুপ, ইক্ষুরসের গুড়, রোচনী ভর্তা আর মধুপর্ক দিয়ে আহার সারা হয়েছে। যাত্রায় কুত্রাপি
বিরাম নেওয়া হয়নি। পাছে নদী তটে পৌঁছাতে বিলম্ব হয়।
বাংলা থেকে প্রায় বিতাড়িত এবং বর্তমানে অপ্রচলিত একটা ভাষায় যে একটা উপন্যাস লেখা যেতে পারে তা তিনি প্রমাণ করলেন। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, কেন তিনি এমন করলেন? তিনি কি আটশো বছর আগের সেই সময়কে ধারণ করতে চেয়েছেন বলে সে-সময়ের ভাষার আঙ্গিক আনলেন? নাকি তিনি চান না, আমাদের ভাষার অতীতটুকু হারিয়ে যাক? তিনি কি ভাষাতাত্ত্বিকতাকে নৃতাত্ত্বিকতার সঙ্গে মেশাতে চেয়েছেন, নাকি ইতিহাসের খাজে ফেলে আসা কিছু অনুভবকে তাঁর হৃদয় দিয়ে এত উপলব্ধি করেছেন যে, তিনি এমন অপ্রচল ভাষার অভিসারী হয়েছেন? এর উত্তর স্পষ্টত লেখকের নিজের কাছেও আছে বলে আমার মনে হয় না। তবে যে অসাধারণ পরিপ্রেক্ষিতকে তিনি তাঁর উপন্যাসে ধারণ করলেন তা সাধারণ পাঠকের (গ্রন্থের মাঝে যাঁরা নন্দনতত্ত্ব খোঁজেন তারা নন, নিশ্চয়) বোধের বাইরে চলে গেল সেই অপ্রচলিত ভাষার কারণে। অনভ্যস্ততার ফোঁটায় কপাল চড়চড় করে। পাঠকও অনেক অপরিচিত শব্দের সমন্বয়ে গঠিত বাক্যগুলোর – তা যতই মাধুর্যপূর্ণ হোক; ঠিক রসাস্বাদন দূরে থাক গ্রহণ করতেই হিমশিম খান বলে অধিকাংশের কাছে এই উপন্যাস অপঠিতই থেকে যাবে। তাতে যে ঔপন্যাসিকের খুব ক্ষতি হলো তা নয়, বরং লাভ হলো আমাদের। ভাষার বহমানতা, ঋদ্ধতা আর বাঁক বদলের সংকেত ধারণ করায় গ্রন্থটি এক ডকুমেন্টারি হয়ে থাকল। আমাদের ভাষা থেকে যে-শব্দগুলো হারিয়ে যাচ্ছিল, সেই শব্দকে হারাতে না দেওয়ার জন্য উপন্যাসের লাইনে লাইনে গল্পকার যে মমত্ব আর ভালোবাসা ছড়ালেন, তা আমাদের অনেক বড় এক প্রাপ্তি হয়ে থাকল এবং তার জন্য মঈন আহমেদকে আমাদের অভিনন্দন।
উপন্যাসটি সীমাবদ্ধতার বাইরে নয়। শুরুর দিকে অতি-বিশেষণে জর্জরিত করা হয়েছে বাক্যকে। উপন্যাসে বিশেষত ব্রাহ্মণদের প্রশংসার ব্যাপকতাকে বোঝাতে গিয়ে বর্ণনার পরিবর্তে লেখক ‘মহাযজ্ঞ অনুষ্ঠান’, ‘মহাফটক’, ‘ঐন্দ্রজালিক ঐশ্বর্যসংবাদ’, ‘দ্বিজন্মা ব্রাহ্মণ’, ‘বিপুল বিপুল পাত্রসমূহ’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করেছেন। এমনকি ‘ব্যবস্থা’ শব্দটির আগেও তিনি ‘হৃষ্টপুষ্ট’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। সময়ের সচ্ছলতাকে, চরিত্রের শ্রেষ্ঠত্বকে যে-কোনো উপন্যাসেই শুধু গুণবাচক বিশেষণসমৃদ্ধ শব্দ দিয়ে প্রকাশ না করে তা গল্পের মাধ্যমে এবং চরিত্রকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সৃষ্টি করলেই ভালো হয়।
চরিত্রের চোখ দিয়ে দেখা দৃশ্যকল্প অথবা কোনো কর্মকে চরিত্রের মাধ্যমে বর্ণনা অথবা ফুটিয়ে তুললে উপন্যাস গতিময় হয়। বাদ্যির অনেক বর্ণনায় পরোক্ষতা রয়েছে। যা চরিত্রের মাধ্যমে সহজেই বর্ণনা করা যেত সেখানে লেখকের উপস্থিতি স্পষ্ট –
পদ্মাবতীর আয়ত দৈহিক গড়ন, কাঞ্চন বর্ণের লোমবিহীন মসৃণ কোমল ত্বকে যখন গৌধূলির স্বর্ণকিরণ পড়ে তৎকালে তার রূপ দেখে জীবন্ত সুবর্ণ মুদ্রার ন্যায় সকলেই তাকে নিজ অধিকারে নিতে প্রবৃত্তি হয়। ক্ষুদ্র নাসারন্ধ্রের টিকলো নাকোপরি শষ্প শীর্ষে শিশিরের মতো স্বেদ-বিন্দু দেখলে সোহাগ করতে বাসনার উদ্রেক হয়।
এই উপন্যাসের সবচেয়ে দুর্বল দিক অতি-বিশেষায়িত পদ্মাবতীর চরিত্র। লেখক নিজেই বলছেন, এই উপন্যাসে ইতিহাস থেকেও নেই। মানে পদ্মাবতীর চরিত্র চিত্রণে তাঁকে ইতিহাসের বাঁক অনুসরণ করার প্রয়োজন ছিল না। মাত্র ছয় বছরের এক শিশুর চরিত্রে ভারী ভারী কর্মের সমাহার, সংগীতচর্চা, জ্ঞান-অন্বেষণের প্রবল আকাক্সক্ষা,
পূজা-অর্চনার গুরুভার এবং প্রেমানুভূতির আবেশ অর্পণ করেও গল্পকার ক্ষান্ত হননি। তার সৌন্দর্যের কোরকে যৌবন এবং
যৌন-চেতনা পরিস্ফুটনের বর্ণনা ছাড়াও এই শিশু-বধূর জন্য কীর্তনীয়ার প্রাণ আনচান করা অনুভূতিকে ব্যক্ত করতে তিনি যে সযত্ন শব্দসম্ভার গুছিয়েছেন তা যুক্তিসম্মত নয় –
শুকতারা (পদ্মাবতীর মা) সর্বদাই সিন্দুর রঞ্জিত থাকেন। সেই শিক্ষাই পদ্মাবতীর মাঝে প্রতিফলিত। এতদ্ব্যতিত তার জ্ঞানে আছে পতির ভীতি। (!) আদি ব্রাহ্মণের বংশে জন্ম পদ্মাবতীর। সুতরাং কোনো হঠকারিতা নয়! এই সাবধান বাণী মায়ের কাছ থেকে নিতুই পেয়ে এসেছে সে। এই বাণীর শিকড় তার মর্মমূলে প্রোথিত।
পৃথিবীর আদিকাল থেকে অদ্যাবধি ছয় বছরের এক শিশু ফড়িঙের মতো উচ্ছল এবং ঝরনার মতো চঞ্চল। কীর্তনিয়ার মতো এক যুবক স্বামী হলেও তার সঙ্গে কীর্তন গাওয়া এই শিশু-চরিত্রের জন্য ঔপন্যাসিকের পক্ষ থেকে অর্পিত অত্যন্ত দুরূহ একটি কাজ! নবমবর্ষী পদ্মাবতীর সঙ্গে গানের ঋষির সংগীত মূর্ছনার মুহূর্তে তাকে সংগীতগুরু কর্তৃক মেনকা দেবী সম্বোধন ছাড়াও নিচের লাইনগুলো লেখকের অন্তরস্ত আবেগের স্ফূরণ –
কিন্তু এই যৌবনোদয় যুবতীর কণ্ঠে ধ্রুবকার কম্পিত স্বর তার অন্তকরণকে বিমোহিত করে দিল। সন্ন্যাসীর ধূম্র-ধুমল নয়ন বিস্ফারিত। সুরের মূর্ছনায় অধ্যাত্ম ঋষির তন্ময় দুনয়ন বেয়ে অশ্রুধারা ক্রমাগত বেয়ে সর্বংসহা ভূতলে টপ টপ ঝরে পড়ল … সন্ন্যাসী করদ্বয় সন্নিবেশিত করে প্রণামরত অবস্থায় বালিকার সামনে দ-ায়মান – যেন দেবীর বর প্রার্থনায় নিমগ্ন।
স্বামীর মৃত্যুদৃশ্য সহ্য করতে না পেরে পদ্মাবতীও এই ভুবনের মায়া ছেড়ে পাড়ি জমায় অন্যলোকে। উপন্যাস পরিসমাপ্তির দিকে যত অগ্রসর হয়েছে ততই তা গতিশীল এক ছন্দকে ধারণ করেছে –
এই দৃশ্য পদ্মাবতী সহ্য করতে পারল না। তরবারি সঞ্চালনের সাথে সাথে নিক্ষেপিত বজ্র বাক্য শ্রবণ করে পদ্মাবতী রাধাশ্যামের বিগ্রহের বেদিমূলে মূর্চ্ছিত হয়ে লুটিয়ে পড়ে। তৎক্ষণাৎ ওষ্ঠাগত প্রাণবায়ু তার দেহ থেকে নির্গত হয়ে ঊর্ধ্বলোকে পলায়ন করে। জয়দেব আঁধারে বুঝতেও পারলেন না, তাঁর প্রাণপ্রিয় অর্ধাঙ্গিনী তাঁকে ছেড়ে অনেক দূরে গমন করেছে। যত্রে গমন করলে মানুষরূপে প্রত্যর্পণ করতে এক লক্ষ সাতাশি হাজার বার যোনি ভ্রমণের আবশ্যক হয়।
সনাতন ধর্মের আঁতুড়ঘরের জন্ম-রহস্য পেরিয়ে একটা উপন্যাস ‘সময় প্রকাশনী’র বুকে চেপে আলোর মুখ দেখেছে। সেই উপন্যাসের বাকি পথপরিক্রমা নির্ধারণ করে দেবে ‘সময়’ নামক এক মহান যাযাবর এবং আমার ধারণা সেই যাযাবর এমনসব সঙ্গীকে তার রুক্ষ পথের সারথি করেন
যারা তার ঘামভেজা সোঁদা ঘ্রাণকে বুকের গভীরে লালন করে বড় মমতা আর ভালোবাসায়। মঈন আহমেদ সযতেœ সেই সময়-ঘ্রাণকে বুনে দিয়েছেন তাঁর উপন্যাসের অন্তরাত্মায়।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.