অবিশ্বাসের পিনিস

সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম

বৃষ্টিতে গোছানোর কাজ আগাতে চায় না। পায়ের তলায় প্যাচপেচে কাদায় গোড়ালি বসে, মাটির চুলার নিচ থেকে পানি উঠে। গত কদিনে প্রায় মাইল দশ ভেঙে একেবারে ধানক্ষেতের শেষে বসতভিটের শুরুতে এসেছে নদী, থেকে-থেকেই নামছে নয়নশ্রীর জমি। বর্ষার শুরুতে এবার নাই হয়ে গেল পাশের আলাদী গ্রামটা। আর একটা বানে নামবে এখানকার ভিটেমাটি, ঠিক এমন সময় ঘটনাটা ঘটল। খবর পেয়ে ঘরদোর খুলে নেওয়ার কাজ ফেলে নয়নশ্রীর মানুষ ঘোর সন্ধ্যার মুখে তারও চেয়ে বেশি অন্ধকার পানির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। নদী পাড়ের মানুষ আবেগি। সকালে টেঁটা-বলস্নম নিয়ে রাগের মাথায় যার প্রাণ সংহারে ছুটল সন্ধ্যায় তারই কাঁধে হাত রেখে পাড় ধরে গেল বেসুরো গলায় গানের কলি গুনগুন করে। তারা মুখে-মুখে ছড়া বানায় আর মাটি হারানোর সান্তবনা খোঁজে কল্পনায়। নীল জ্যোৎসণায় মাঝরাতে নদীতে ভাসা অলৌকিক পিনিসের গল্প করে। অবিশ্বাসী মানুষটাও হিজল গাছের নিচে বাঁশের বেঞ্চে

বসে সেই গল্প বারবার শোনে। খেতের আল ধরে চলতে-চলতে ছুটে-আসা বুনো বাতাসে নিজের অজামেত্ম তাকায় নদীর দিকে। সত্যি কি কেউ আছে! যদি দেখা যায়! খলখল করা জ্যোৎসণার ভেতর কত রকম নৌকা যায়-আসে, ছইয়ের ভেতরে কুপি জ্বলে। তারপর মানুষ ঘুমালে নদী জাগে, নৌকা কমে তখন দূর দিয়ে দু-একটা ছোট-বড় নৌকা যায় পানি কেটে-কেটে। অবিশ্বাসী বোঝার চেষ্টা করে ওর মধ্যে কোনোটা সেই পিনিস কিনা? কিন্তু আজ সন্ধ্যায় যারা জড়ো হয়েছে তাদের মধ্যে বিশ্বাস-অবিশ্বাস মিলেমিশে গেছে। পদ্মার ভাঙনের পাড়ে দাঁড়ানো মানুষরা শুনল জলের ঘূর্ণির ভেতর থেকে, সাঁই-সাঁই বাতাস কেটে শুরু হয়েছে সন্ধ্যার আজান। সেই শব্দ ইস্রাফিলের শিঙ্গায় ফুৎকারের কথা মনে করায়। এমন সময়েও আসেনি শুধু একজন। অবিশ্বাস্য পরাজয় আর অভিমানে নিজের ভেতর একা সাঁতরাচ্ছে, ডুবে মরছে বারবার সে।

ঘরের দাওয়ায় ভেজা মাটির ওপর পা রেখে এক ঠায় বসে আছে সুখী। সকালেও সে গোছগাছে ব্যস্ত ছিল। গাছগুলোর জন্য মায়া হচ্ছিল কিন্তু সেসব ছাড়তে হবে অগত্যা ওপরের কয়েকটা টিন খুলে নেওয়ার কথা ভেবেছে। এখন প্রায় সন্ধ্যা শেষ হয়ে অন্ধকার জমছে দ্রুত। বাতাসের বেগ ঠাহর হয় না তবে মন্দ বোঝা যায়। যখন-তখন শুরু হলে এই অন্ধকারে নদীর ভেতরই ডুবে মরতে হবে তবু সে বসে রইল। নড়ল না, উঠল না, চেয়ারের ওপর গাঁট বেঁধে রাখা কাপড়ের পোঁটলাটা পড়ে গেল স্যাঁতসেঁতে মাটিতে কিন্তু সে ফিরেও তাকাল না। এতদিনের নিজের ঘরটা এক মুহূর্তে অপরিচিত হয়ে গেছে। মাশুকের ঘর সুখীর নিজের হয়েছে এই বর্ষায় বছর তিন হলো। অমত ছিল না বিয়েতে তবে একটা মানুষের সঙ্গে থাকার আগে কতটুকুই বা তাকে জানা যায় আর নিজে কি চাই তাই-বা কতটা স্পষ্ট হয় মানুষের নিজের কাছেই? উঠোনওয়ালা বড় টিনের ঘর, মাঠে ফসলের জমি। দেখতে-শুনতে নধর কার্তিক না হলেও খানিকটা ঝাঁকরা চুলের ভেতর থেকে যে বড়-বড় দুটো চোখ দেখা যায় তাতে বেশ ঢক আছে। কখনো-সখনো চলতি পথে খালি গলার গান শুনে বেশ লেগেছিল মানুষটাকে। নুরুদ্দিন কাজি বিয়ের প্রস্তাব বাপের সামনে তুললে কোনো সিদ্ধান্ত জানাতে পারেনি সুখী। অবশ্য কেই-বা তার মতামতের তোয়াক্কা করেছে?

– বিয়ের দিনেও ঝড়-বৃষ্টি ছিল। বউ নিয়ে আসার পর এই গ্রামের মানুষজন বলেছিল, মেঘ রাশির কন্যা, কপাইলা বউ পাইছে মাশুকে। মেহমানজন চলে যাওয়ার পর রাতে ঘরে ঢুকে নতুন মানুষ অবাক করে বলল। আচ্ছা বউ তোর গলায় গান আসে?

– না। কিন্তু আপনে ভালো গান শুনছি।

– মানুষের মুখে না নিজের কানে?

– শুনছি

– ও তাইলে তুই গান শুইনা আমার প্রেমে পড়ছিস।

– এহ বইয়া গেছে। প্রস্তাব কে পাঠাইছিল শুনি?

নতুন বউকে মাশুকের ভালো লাগে। কী সুন্দর কথার পর গুছিয়ে কথা বলে মেয়েটা। বউ তোরে দিয়া কবির গান করাব। ভালো ঝগড়া করতে পারবি।

সুখী চোখ বড় করে তাকিয়ে থাকে। এমন কথা সে বাপের জন্মে  শোনেনি। কোনো স্বামী তার স্ত্রীকে দিয়ে কবির গান করাতে চায়। তার ওপর ঘরে ঢুকেই এমন করে তুই-তুকারি করছে যেন কতদিনের পরিচয়। সুখী দ্রুত জবাব দেয়।

– আমি গান করতে যাব আর আপনি রান্না কইরা খাওয়াবেন?

– খাওয়াইলাম।

– আচ্ছা সত্যি কি আপনে এমন?

-কেমন আমি?

– বুঝতে পারতিছি না কেমন যেন তালগোল পাকায় যাইতেছে।

মাশুক হো-হো করে হেসে উঠে বলে ডরাইছস? মজা করছি। এমন বউরে কেউ বাড়ির বাইরে নেয়? আয় একটা গান শুনাই তোরে। ততক্ষণে গুঁড়ি-গুঁড়ি বৃষ্টি থেমে ফকফকা জ্যোৎস্না উঠেছে। মানুষটা সৌরবিদ্যুতে জ্বলতে থাকা বাতি নিভিয়ে দেয়। সুখী শিহরণে কাপড়টা ভালো করে জড়িয়ে বসে গায়ের সঙ্গে। কিন্তু নতুন মানুষ সেদিকে না যেয়ে উঠে ঘরের জানালা খুলে জ্যোৎস্না ঢুকতে দেয়। উঠোনে তখনো এখানে-ওখানে পানি জমে আছে। সেই পানির মধ্যে আকাশের নীল রঙা আলো থই-থই করছে। মানুষটা গান ধরে… নদীতে তুফান আইলে কূল ভাইসা যায়, দ্যাখা যায়। বুকের ভিতর তুফান আইলে মানুষ ভাইঙ্গা যায়, দেখানোর নাই উপায়… সুখী ততক্ষণে বিস্ময়ের চৌকাঠ পেরিয়েছে। বুঝতে পারে, মানুষটা অন্যরকম। প্রথম-প্রথম বেশ লাগত এসব খেয়াল। একদিন হঠাৎ দুপুরে এসেই বলে, আচ্ছা সুখী মাছ ধরছোস খালে কোনোদিন?

– ধরছি না?

– কি ধরছোস, ইলশা মাছ? বলে নিজেই হো-হো করে হাসল।

– যান খালি আজাইরা কথা, খালে ইলশা আপনে ধরছেন।

– মজা করলাম। কি মাছ ধরছোস?

– বর্ষার পানি শুরু হইলে চিংড়ি আর বাম মাছে ছাল ছাড়াইতে কাদার ভেতর আসে না? সেই সময় হাত দিলেই মাছ পাওয়া যায়। আবার অল্প পানির ভেতর গামছা দিয়া পুডি ধরছি কত। একটা ছড়া কইতাম তখন আমরা, অলি ছলি গাঙের ছলি/ পুডি মাছে লইলরে/ বুইড়া বেডা তামুক খায়/ ফুটকি দিয়া নৈছা যায়।

– সুখীর মুখে ছড়া শুনে আমোদ পায় মাশুক।

কিন্তু সংসার শুধু শব্দ কথা তামাশায় চলে না। যত পুরনো হতে থাকল সুখীর হিসাব জ্ঞান বাড়ল কিন্তু যার সঙ্গে সেই হিসাব করবে সেই মানুষটা বদলাল না। কোনোকিছু নিয়ে বেশি কথা বললেই নদীর ঘাটে যেয়ে বসে থাকে। খদ্দের নেই তাও মাঝরাতে দোকান খুলে তাকিয়ে থাকে। অমন দেখলে সুখীও বিশেষ কিছু আর বলে না। তবু দিন খুব তো খারাপ যায়নি।  কাল রাতেও স্বাভাবিক ছিল সবকিছু। প্রতিদিনের মতো মাটির দিকে তাকিয়ে বাড়ি ফিরেছে কি যেন বিড়বিড় করতে-করতে। আচ্ছা আপনি কী দ্যাখেন মাটিতে?

– মাটি দেখি।

– এই রাত্রে বেলা প্রত্যেকদিন মাটি দেখার কী হইছে?

– জমিন গুনি। ঘাট থিকা নামার পর পাও গুনতে-গুনতে আসি আর মাপি, নদী কতটা কাছে আইছে।

সুখী অবাক হয় বটে তবে সঙ্গে-সঙ্গে মুখ ঘুরিয়ে আবার নিজের কাজে যায়। ইদানীং কেন যেন মনে হয় নিজের দায় এড়াতে এসব ভাবের কথা বলে। এমন সব মারেফতি কথায় মানুষজন মুগ্ধ হয়, সেই মুগ্ধতা উপভোগ করে। আসলে ভেতরটা ফাঁপা। কী একটা তাইরে নাইরে দোকান নদীর ঘাটে আগলে বসে থাকে। আর সারাদিন খালি
গাল-গল্প, গান-বাজনার ধান্দা। বাপের তালুক ছিল বলে গায়ে এমন বাতাস লাগিয়ে খেতে পারছে। কিন্তু রাজার ধনও তো ফুরায়। আর এই কি পুরুষ মানুষ! পুরুষের থাকবে নিজের নারী ও জমিনের দখলের ভাবনা অথচ এ কেমন মানুষ! শরীরে রাগ নাই, অন্ধকারে হাঁক নাই, কোনোদিন বাড়ি ফিরে জিজ্ঞেস পর্যন্ত করল না, কেউ এসেছিল কিনা? কোনোকিছু যত্ন না করলে কি তা নিজের থাকে? দু-একবার সুখী জানতেও চেয়েছে। আচ্ছা এই যে আমি সারাটা দিন খালি বাড়িতে থাকি, আপনে একটা খালি দোকানের অজুহাত দিয়া সারা দিন নদীর ঘাটে। কত কিছুই ত হইতে পারে।

– কী হইতে পারে, ডাকাইত? যা চায় সব দিয়া দিবি।

– সব ডাকাত একরকম হয় না। আশ্চর্য মানুষ আপনে।

মাশুক হাসতে-হাসতে বলে… বউ আমারে ভয় দেখাস?

– সেই ক্ষমতা আমার নাই। আপনি কত জ্ঞানী মানুষ। শুনলাম ওই পাড়ে নাকি বড় পস্নাস্টিকের কারখানা বানাইতেছে। কত মানুষ কাজে যাইতেছে। আপনি এই ছাতার দোকান তুইলা ফ্যাক্টরিতে কাম নিতে পারেন না?

– কে কইছে ফ্যাক্টরির কথা?

– আপনের বন্ধু আইছিল খবর নিতে।

– তাই ডাকাইতের ডর দেখাইলি? সুখী বেগম শোনেন, এই যে ফ্যাক্টরি হইতেছে এইটা নদীর মরণ। সাদা পানি কালো হবে, দুর্গন্ধ বাতাসে ছড়ায় পড়ব। যারা কাম করে তাদের শরীরে চামড়া পইচা উঠব।

– আপনি ত সব জাইনা বইসা আছেন।

– আরো শুনবি? নদীর পাড় ভাঙব।

– সে তো প্রতিবছরই কোনো না কোনো গ্রাম তলানোর খবর পাই। ফ্যাক্টরির দোষ দেন কেন?

– আমার দোস্ত তোর মাথাটা খাইছে। এসব ফ্যাক্টরি বানাইলে নদী বাঁচানো যায় না। আর শোন পানিরও রাগ আছে। সে প্রতিশোধ নিবে না?

– কী সব কথা আপনের? স্রোত বাড়লে বর্ষাকালে এমনি ভাঙন হয়।

– তোরে বোঝানো যায় না। পানির ভেতর যিনি আছেন তিনি মানবেন না।

– কে আছে পানির ভেতর?

– আছেন একজন। মেলা রাইতে সে পিনিস নিয়া বাইর হয়। দুনিয়ার সমস্ত পানির মালিক সে। আলস্নাহপাক তারে দায়িত্ব দিছেন।

– হ আর আপনেরে আইসা বলছে সেই খবর।

– বলছেই তো। সবাইরে তো কয় না। কয়জন বুঝে সেই কথা? এই যে নদীর ধারে বইসা থাকি, এমনি? তারে দেখতে ইচ্ছা করে। পাপী বান্দা আমি, ওপরওয়ালার সঙ্গে কোনোদিন দ্যাখা হইব কি না জানি না কিন্তু সেই তাঁর উছিলায় যদি স্রষ্টার রূপ দর্শন করা যায়।

– আপনি শরিয়ত-বেদাতি কথা কন। ধর্মে পয়গম্বর ছাড়া কাউরে মানা কিন্তু শিরক।

– বাপ-দাদার আমল থিকা তারও পূর্বপুরুষ কত কত কাল ধইরা যারা নদীর সঙ্গে বুইঝা আসতেছে, তুফানের ভেতর নৌকা নিয়া বাইর হইছে আবার নদীই তাগো বসতের মাটি দিছে, ফলমূলের গাছ দিছে, বাতাস দিয়া ভাসায় নিছে তারা ভাঙনের মুখে শিন্নি দিয়া মানত কইরা নদীর পথ ঠেকাইছে সেই বিশ্বাসের কোনো দাম নাই? আমি তো মানি পানির নিচে যে আছে তারে উনিই পাঠাইছেন উছিলা দিয়া।

সুখী অবিশ্বাস আর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে।

– তার নাম হজরত খোয়াইজ খিজির। তিনি পানির নিচে বইসা সব দেখতেছেন। তুই যদি হুদাই পানি নষ্ট করোস তাইলেও সে হিসাব রাখবে। রোজ হাশরের মাঠে পানি-পানি কইরা চিৎকার করবি কিন্তু পাবি না।

– টিউবওয়েলের পানির মধ্যেও আপনের খোয়াইজ খিজির আছে?

এমন ব্যঙ্গ সুখীর কাছ থেকে আশা করেনি মাশুক। আহত হয়ে বউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তুই আসলে আমারে কোনোদিন বুঝোস নাই।

– কেমনে বুঝলেন?

– এই যে তামাশা করলি। বুঝলে অন্তত আমার মতো কইরা

আমার ভাবনা ভাবতি।

– আচ্ছা হইছে বাসি নাই এখন বলেন, আপনের খোয়াইজ খিজির আর কী কী করছে?

-সে কিছুই করে নাই, সে শুধু এক ফোঁটা পানিরও হিসাব রাখে। এইগুলা সবই বিশ্বাসের ব্যাপার। নদী ভাঙনের সময় আগে মুরবিবরা খোয়াইজ খিজিরের নামে মানত করত। অনেক জায়গায় কিন্তু সত্যি একেবারে পাড়ে আইসা আচমকা ভাঙন থাইমাও গেছে।

– ইহ দুনিয়া ভাইঙ্গা তোলপাড় হইলো আর উনি আছেন ওনার বিশ্বাস নিয়া।

– বিশ্বাসই তো সব বউ। এই যে এতটুকু দুইটা চোখ দিয়া কত বড়-বড় মাঠঘাট দ্যাখোস, আকাশ দ্যাখোস, কেমনে দ্যাখোস? তোর চোখ কি এইগুলার চেয়ে বড়?

– ঘরের ভেতর বান আইসা ভাসায় নিলে আর এইসব মারেফতি জ্ঞানে কাম হবে না।

– এইভাবে কথা কেন কস তুই? বলে ব্যথিত চোখে তাকিয়ে রইল মাশুক।

সুখীরও ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে দিনে-দিনে। সংসারে নতুন মুখ আসল না, মানুষটার খেয়ালিপনা কমল না। এখন ঘর-বাড়ি সব ভেসে যাওয়ার মুখেও সে আছে তার আকাশ-বাতাস ভাবনা নিয়া। সুখী একটু রাগ নিয়েই বলল –

– নদীর ভাব-গতি ভালো না। আপনি সময় থাকতে সব সরায় নেওয়ার ব্যবস্থা করেন।

– এই গ্রাম ভাঙব না।

– কেমনে বলেন এই কথা? আলাদীপুরা নাই হইয়া গেল চোখের সামনে, তাও বলেন?

– কই কারণ ওই গ্রামে একজনও ছিল না যে তারে বিশ্বাস করছে। বিশ্বাস কইরা কান্নাকাটি করছে।

– আপনে থাকেন আপনের বিশ্বাস নিয়া। আপনের দোস্তরে খবর দিছি ভ্যান ঠিক করার। মনোহরদি নিয়া তুলব যা-যা বাঁচানো যায়।

– তুই ঘরের মানুষ আমার বিশ্বাস নষ্ট করবি? আমি শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করব।

– কইলাম তো আপনের এত বিশ্বাস থাকলে বইসা-বইসাই আটকান ভাঙন। আপনেরে দিয়া যে কিছু হবে না, সেইটা আরো আগে বুঝলে ভালো হইত। মানুষের সঙ্গ থিকাও কিছু পরিবর্তন হয়। আপনের হয় নাই।

এই বাক্য শোনার সঙ্গে-সঙ্গে মাশুকের চেহারার রং বদলে গেল। সে বিশ্বাস করতে পারছে না, সুখী কবে ভেতরে-ভেতরে এমন পুরোদস্ত্তর সংসারী হয়ে গেছে? কে বানাল তাকে সংসারি? মাশুক চাপা গর্জনে বলল, কী বুঝাস তুই?

– আপনি দেখতেছেন না সবাই নিরাপদে যাইতেছে? বন্ধুরে দেইখা কিছু শিখেন। সে ফ্যাক্টরিতে কাম নিছে। ঘর-বাড়ি সরানোর কাজও শেষ।

– সুখী এই ঘরে সন্তানাদি নাই। কার জন্যে এত সংসারি হইছিস তুই? অন্যের গায়ের রঙিন কাপড়, ফ্যাক্টরির বেতনের মোবাইল ফোন দেইখা চোখে রং লাগছে? আমি খালি এই টিনের একটা ঘর নিয়া ভাবি না, ভাবি পুরা গ্রামটা নিয়া।

আপনি যাই বলেন, আমার ভাবনা আমার কাছে। কাউরে দেইখা যদি নিজের সংসার আগলাইতে ইচ্ছা হয় সেইটা অন্যায় না। যা ইচ্ছা ভাবেন আপনে। আমি সরানোর ব্যবস্থা করতেছি। দুপুরের দিকে তাদের আলাপ হওয়ার পরপরই চারপাশে অন্ধকার করে ভেঙেচুরে বাতাস শুরু হয়েছে, তারপরই বৃষ্টি। বৃষ্টিতে পানি জমল উঠানে। আশ্চর্য মানুষটা কেমন নির্বিকার বসে রইল বারান্দার খুঁটির সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে। কিছুক্ষণ পর উৎফুলস্ন হয়ে ডাকল সুখীকে। সুখী ততক্ষণে গোছানোর কাজ সারছে ঘরের ভেতর।

– সুখী দেখ-দেখ ব্যাঙ আইছে আম গাছটার নিচে, আর দ্যাখ ওই যে কলমি গাছের পাতার ডগায় একটা লাল ফড়িং বসছে। দেখতেছোস?

– দেখছি, তাতে কী হইল?

– এইসব হইলো এই গ্রাম ভাঙব না তার আলামত। মানুষ না বুঝলেও পশুপাখি টের পায়।

সুখীর রাগ এতক্ষণে সীমা ছাড়িয়েছে। সেই যে মানুষটা এক বিশ্বাস নিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে, গোছগাছের একটা কাজেও হাত দিলো না। রাগে কাঁপতে-কাঁপতে বলল, আপনি আসলে একটা স্বার্থপর মানুষ। নিজের সুখ ছাড়া কিছু বুঝেন না, গতরের কাম করতে আপনের ভালো লাগে না তাই এইসব ফাও কথা কইয়া সইরা থাকেন। যাওনের সময় দেখব আপনি কী করেন। কথা শেষ হওয়ার আগেই খবর এলো, মাশুকের বন্ধু দৌড়াতে-দৌড়াতে এসেছে নদীর খবর নিয়ে। পদ্মা একেবারে ধারে আইসা পড়ছে। যা-যা নেওয়ার এখুনি সব নিয়ে না সরলে আর কিছুই বাঁচানো যাবে না। সুখী, মাশুককে তাড়া দিতে-দিতে নিজেই দু-একটা জিনিস হাতে নিয়ে তুলতে চাইল দোস্ত। সেই জানাল দক্ষিণ দিকের বুড়ো হিজল গাছটার অর্ধেক শিকড় পানিতে চলে গেছে, অর্ধেকটা মাটির সঙ্গে। সুখীও এই খবরে দ্রুত জিনিসপত্রগুলোর ব্যবস্থা করতে চাইল। চালের টিনগুলো আর খোলার সময় পাওয়া গেল না, গরু দুটোর দড়ি খুলতে হবে, সব মাল ভ্যানে তুলতে হবে এদিকে আকাশ ছাইরঙা হয়ে গেছে। মাশুককে এবার অনুনয়ের সুরে বলল সুখী।

– আপনের দুইটা পায়ে ধরি আমি, ভাবের ভেতর থিকা বাইর হন দ্যাখেন সবাই যাইতেছে।

–  মাশুক এতক্ষণ সব দেখছিল এবার ঘোর লাগা কণ্ঠে বলল, সুখী একটু শিন্নি রানতে পারবি?

–  শিন্নি দিয়া কী আমার ফয়তা খাওয়াবেন আপনে? খাওয়ানোর মানুষও পাবেন না গ্রামে।

– থাক সুখী, অবিশ্বাসীর হাতের শিন্নিতে হবে না। চাল কোথায়?

– ঘরের চাইলে হয় না অন্তত দশ বাড়ির মুঠা চাউল লাগে।

– এখন আমার একলারটাতেই হবে।

মানুষটা নিজে ভিজে চুলো জ্বালাল কসরত করে। রান্না করল এক ঘরের চালের শিন্নি। সুখী ততক্ষণে বেশ কিছু জিনিসপত্র তুলে ফেলেছে। মাশুকের সেদিকে কোনো হুঁশ নেই। সে  কলাপাতা কেটে নিয়ে এলো। তারপর সেই পাতায় শিন্নি ঢেলে সুখীর সঙ্গে কোনো কথা না বলে চলে গেল নদীর ঘাটে। সুখী হতবাক হয়ে গেছে, তার ধারণা ছিল মানুষের প্রাণের মায়া সবচেয়ে কঠিন মায়া। গোছগাছে হাত না দিলেও শেষ মুহূর্তে মাশুক তার সঙ্গে ঠিকই ভ্যানে উঠবে। এদিকে বাতাসের আওয়াজ বাড়ছে, নারিকেল গাছগুলো দুলতে-দুলতে হেলে যাচ্ছে এমনকি এখান থেকেই নদীর ডাক শোনা যাচ্ছে। মানুষটা কিনা ঠিক এই মুহূর্তে সব ফেলে সেই নদীর দিকেই ছুটল। সুখী একবার জিনিসপত্রগুলোর দিকে তাকিয়ে ছুটল খেয়ালি মানুষটার পিছু-পিছু। কিছুদূর ডাকতে-ডাকতে হাঁপিয়ে ফিরে এসেছে। ভ্যানওয়ালার এতক্ষণ বসে থাকার সময় নাই। জিনিসপত্র নামিয়ে রেখে সে চলে গেছে। তখন থেকে সুখী ঘরের দরজার সামনে বসে আছে।

ঘাট থেকে এসে একজন খবর দিলো, মামি কি সর্বনাশ হইতেছে। এই বানের পানির ভেতর মামা হাতে যেন কি নিয়া নদীতে নাইমা গেছে। কত নিষেধ করেতেছে, সবাই সে থামে নাই। সুখী কিছুই বলল না। যেভাবে বসে ছিল সেভাবেই বসে রইল। ঘাট থেকে খবর নিয়ে যে এসেছিল সে অবাক হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে যেদিক থেকে এসেছিল আবার সেদিকে গেছে দৌড়ে। অন্ধকার জমাট বেঁধেছে তাও তো অনেকক্ষণ। নদীর পাড় থেকে মানুষজন দু-একজন করে ফিরছে। একজন এসে জানিয়ে গেল, ভাঙন থেমেছে। সেই বলল, কী আশ্চর্য, এইরমও হয়! গাছের গুঁড়িটা অর্ধেক হয়া ভাসতেছে। আকস্মিক নদীর বান সড়সড় কইরা নাইমা যাইতেছে ভাটার দিকে, কী মনে হইল জানেন ভাবি? মনে হইল বিশাল বড় একখান নৌকা যাইতে-যাইতে হঠাৎ মুখ ঘুরায়া নিল অন্যদিক, এমন জীবনেও দেখি নাই। কেমনে হইল এমন আশ্চর্য ঘটনা। নদীর গতিক দেইখা বিশ্বাস হয় এই যাত্রায় নয়নশ্রী মাফ পাইছে। তার মুখের দিকে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইল সুখী। মানুষটার কথা জিজ্ঞেস করার সাহস হচ্ছে না। ফিরলে তার কাছেই আসত তবু বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে মানুষটা এখনো আছে, হয়তো শুধু বিশ্বাসের ভেতর আছে। r