অবিস্মরণীয় লঘুতা : ফ্রঁসোয়াজ সাগঁ

আনা ইসলাম

তেষট্টি বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল একটি গ্রন্থ, যা বদলে দিয়েছিল এক তরুণীর জীবন। নাম ফ্রাঁসোয়াজ সাগঁ, বয়স আঠারো। ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত বোঁজর থ্রিসতেস (Bonjour Tristesse), বাংলায় ‘শুভদিন দুঃখ’। প্রথম লেখা উপন্যাসের অভাবনীয় সফলতা দিয়ে সাহিত্যজগতে প্রবেশ তাঁর। কবি পল এলুয়ারের কবিতা থেকে শিরোনামটি নেওয়া।

উপন্যাসে এক স্কুলপড়ুয়া টিনএজ মেয়ের গ্রীষ্মকালীন রোমান্সের গল্প, যা প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফরাসি সমাজে প্রশংসা, বিতর্ক, স্ক্যান্ডাল হয়েছে। শব্দসংখ্যা তিরিশ হাজারের মধ্যে। আলোড়ন তোলা এ-গ্রন্থের গল্প বলছে সেসিল। সতেরো বছরের টিনএজ মেয়ে। গ্রীষ্মকালীন ছুটি কাটাতে গেছে দক্ষিণ ফ্রান্সের কোত দ্য আজুর (Cote d’Azur) সঙ্গে; আছেন বিপত্নীক বাবা এবং তার তরুণী বান্ধবী। ছুটিতে সেসিলের নিজের সেন্টিমেন্টাল অ্যাডভেঞ্চার ক্রমশ রোমান্সে রূপ নেয়, সুদর্শন এক আইনের ছাত্রের সঙ্গে। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে একজন বয়স্ক মহিলা, যিনি সেসিলের মায়ের বন্ধু, তার আগমনে ইচ্ছাপূরণে বিঘ্ন ঘটায়। প্রথমেই মায়ের বান্ধবী মহিলা কর্তব্য পালনে তৎপর হন। দায়িত্ববোধের অংশ হিসেবে সেসিলকে রোমান্স বন্ধ করে বাড়িতে থাকার নির্দেশ দেন এবং স্কুলের পড়া শেষ করার আদেশ দেন। একপর্যায়ে মহিলা এবং বাবা প্রেমে পড়েন। তাদের বিয়ে ঠেকাতে কন্যা নানাবিধ কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়। বাবার তরুণী বান্ধবীর সঙ্গে নিজের ছেলেবন্ধুর সম্পর্কের ভান করে, যাতে তাদের প্রণয় ঈর্ষার উদ্রেক করে এবং জটিল পরিস্থিতির কারণে বাবা ও মহিলার সম্পর্ক পরিণতি লাভ না করে। প্রকাশের পর উপন্যাসটি রাতারাতি প্রশংসা এবং সমালোচনায় ফ্রাঁসোয়াজ সাগঁ নামটি বিখ্যাত হয়ে যায়। আবার যেসব নিয়ম বা সংকেত দৈনন্দিন জীবনকে শাসন করছে, অভ্যস্ত অভ্যাসবহির্ভূত এ-সম্পর্ক তুমুল সমালোচিতও হয়েছে। অল্পবয়সী একটি মেয়ের যৌনতার বিষয়টিও তৎকালীন ফরাসি সামাজিক রীতি-অভ্যাসের বিপরীত বলে নিন্দিতও হয়েছে।

জন্মেছিলেন বুর্জোয়া পরিবারে। লট ভ্যালির এক শহর কাজারকে। সাগঁর প্রকৃত নাম ছিল ফ্রাঁসোয়াজ কোয়ারেজ। তাঁদের প্যারিসের অভিজাত এলাকায় একটি অ্যাপার্টমেন্টও ছিল। বাবা পিয়্যের কোয়ারেজ বিত্তশালী ব্যবসায়ী আর মা মারি গৃহিণী। তাঁদের তিন সন্তানের মধ্যে কনিষ্ঠ ফ্রাঁসোয়াজ। বাড়িতে আদর করে ডাকা হতো কিকি। স্কুলের নিয়মরীতি ভঙ্গকারী হিসেবে একনিষ্ঠ। সাগঁর এক বন্ধুর দৃষ্টিতে – সে ছিল সবসময় বারো বছরের। সে যা চাইত, তাই করত।

ছোটবেলাতেই বই পড়ার ঝোঁক ছিল। মাত্র তিন বা চার বছর বয়সে বই নিয়ে চেয়ারে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতেন তিনি। আর প্রতিবার মাকে প্রশ্ন করতেন শান্তভাবে – বইটা কি তার জন্য? মাও বলতেন – হ্যাঁ, হ্যাঁ তুমি পড়তে পারো। তিনি বিশ্বাস করতেন, ব্যক্তির প্রেমের চেয়েও সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা অনেক মহৎ। একটু বড় হলে নিজেকে আবিষ্কারের লগ্নে চারটি বই-ই তাঁর জীবন। এগুলো চেতনা ও কর্মে গভীর রেখাপাত করেছিল তাঁর। তেরো বছর বয়সে অঁদ্রে জিদের লে নুবিচ্যুর তেরেস্থ, চোদ্দোতে কাম্যুর লো অম রেভলতে, ষোলো বছর বয়সে র্যাঁবোর লে ইলিউমিনাশিও এবং কয়েক মাস পর প্রম্নসেত্মর আলবারটিন দিসপারু পড়েছেন তিনি।

১৯৫৩ সালের গরমের ছুটিটা পরিবারের সঙ্গে নিছক অবকাশযাপন ছিল না। উদ্দেশ্য বাকালোরিয়া পরীক্ষার (উচ্চ মাধ্যমিক) প্রস্ত্ততির জন্য পড়াশোনা। কিন্তু প্রত্যাশামতো লেখাপড়া হয়নি। যদিও তিনি পরীক্ষায় পাশ করে অক্টোবরে সরবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সরবোর্নে পড়াকালে দিনের অনেকটা সময় কাছের ক্যাফেতে সময় কাটানো নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হয়। ক্যাফেতে বসে লিখতেন একটি নীল খাতায়। আর সন্ধ্যায় যেতেন সাঁ-জারমা-দ্য প্রেতে বান্ধবী ফ্লোরন্সের সঙ্গে দেখা করতে। লেখক এবং সংস্কৃতিমন্ত্রী অঁদ্রে মার্লোর কন্যা ছিলেন ফ্লোরন্স। হাতখরচের অর্থ দিয়ে শুনতে যেতেন বিখ্যাত আমেরিকান জাজ ক্লারিনেটিস্ট সিডনি বিসেত – ‘থিয়েটার দ্য ভিউ কল্ম বিয়েতে’।

প্রথম উপন্যাসের সফলতা আর খ্যাতির অল্প পরেই পারি রিভিউ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন ইচ্ছার কথা – আমার তীব্র কাঙক্ষা ছিল লেখার। অবসর সময়ে দলবেঁধে অবকাশে না গিয়ে প্যারিসে বসে উপন্যাস লেখার। সেটা আমার কাছে বিশাল অ্যাডভেঞ্চার।

মাত্র বারো বছর বয়সে নিজের লেখা উপন্যাস প্রকাশের জন্য পাঠিয়েছিলেন তিনি বিখ্যাত প্রকাশক পিয়্যের লাজারেফকে। বলা বাহুল্য, তা প্রকাশিত হয়নি।

তাঁর আত্মজীবনী সাগেঁর প্রকাশনা সংস্থা ‘মারক্যুর দ্য ফ্রঁস’। বইতে জানিয়েছেন সেই বিশেষ দিনটির কথা চু ক্লদ লামিকে। ১৯৫৪ সালে যে-দিনটিতে নিজের লেখা উপন্যাস প্রকাশকের কাছে পাঠিয়েছিলেন। প্রকাশক রনে জুলিয়ার। তাঁকে একটি ফরম পূরণ করতে দেওয়া হয়। পূরণ করা শেষে ফ্রাঁসোয়াজ জানতে চান – কতদিনের মধ্যে উত্তর পাব? পরে কিছু না বলেই চলে যান স্বভাবে অস্থির, বন্য ফ্রাঁসোয়াজ। আর সম্পাদক মাত্র একবারই বিরতিহীন পাণ্ডুলিপি পড়ে মোহিত, আলোড়িত।

ফ্রাঁসোয়াজ পাণ্ডুলিপি জমা দিয়েছিলেন ৬ জানুয়ারি। আর ঠিক এগারো দিন পর ১৭ জানুয়ারি তাঁকে ডাকা হয়। টেলিফোনে জানানো হয় বেলা ১১টায় দেখা করতে যাওয়ার জন্য। বাড়ি থেকে জানানো হয় মাদ-মোয়াজেল ঘুমাচ্ছে। দুটোর পর করেন। পরে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পিছিয়ে বিকেল পাঁচটায় করা হয়।

প্রকাশক জানতে চান – আপনার বাবা-মা বইটা পড়েছেন?

না, আমার বাবার অন্য কাজ করার আছে। আর আমার মা সম্মতি দেবেন না।

অবশ্য বাবা-মা বই প্রকাশে সম্মতি দিলেও তাঁদের পারিবারিক পদবি ‘কোয়ারেজ’ বইয়ে ব্যবহারে নিষেধ করেন। তাঁদের অনুরোধে ফ্রাঁসোয়াজের নাম পরিবর্তন করতে হয়। মাত্র কয়েক মিনিট সময় দেওয়া হয়েছিল নাম পছন্দের জন্য। ফ্রাঁসোয়াজের চেতনা-পস্নাবিত করা একটি নাম। মাথায় ঘুরছে আ লা রঁসাস দ্য ত পারদ্যু (A la Recherche du temps perdu), বাংলায় হারানো সময়ের সন্ধানে। প্রিয় লেখক মার্সেল প্রম্নস্ত। আলবারটিন দিসপারুর মুগ্ধ পাঠক ফ্রাঁসোয়াজের অস্থিমজ্জায় ধ্বনিত হলো একটি নাম। প্রম্নসেত্মর সৃষ্টি একটি চরিত্র প্রিন্সেস সাগঁ। নিজের নামের সঙ্গে জুড়ে দেন সাগঁ।

ফ্রাঁসোয়াজের নিজেরও কোয়ারেজ পদবিটি পছন্দের ছিল না। ক্লাসে নাম ডাকার সময় যখন তাঁর নামটির আদ্যক্ষর কিউ (Q) আসত, সমস্ত ক্লাস হেসে উঠত। আর ফ্রাঁসোয়াজ তোতলাত। মৌখিকে তিনি ছিলেন বরাবরই খারাপ। বাকালোরিয়ায় প্রশ্ন করা হয়েছিল ম্যাকবেথ বিষয়ে। নার্ভাস ফ্রাঁসোয়াজ যথাযথ উত্তর দিতে গিয়ে তোতলাতে থাকেন। অথচ লেখায় পেয়েছিলেন বিশে সতেরো। পড়াশোনা তাঁর কাছে একঘেয়ে মনে হতো। ‘ennui’ – একঘেয়ে ক্লান্তিকর এক ধরনের সেন্টিমেন্ট যা এত প্রগাঢ় এবং তীব্র ঘৃণার চেয়েও। এই ‘ennui’ ফ্রাঁসোয়াজকে গ্রাস করলে, বলেছেন – কোনো ডিনারে নিজেকে অসুস্থ, ভঙ্গুর মনে হতো।

সরবোর্নে দুবছর অধ্যয়নকালে বেশিরভাগ সময়ই কাটিয়েছেন ক্যাফেতে। লেখাপড়ায় নিয়মিত ছিলেন না। ফলে ১৯৫৩ সালের জুন মাসে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন। পরিবারের সবাই ক্ষুব্ধ। সবাইকে শান্ত, খুশি এবং সন্তুষ্ট করতে হবে – এ-ভাবনা থেকে ওই বছরেরই আগস্টে বোঁজর থ্রিসতেস শেষ করেন। ক্যাফেতে বসে নীল খাতায় লেখা ফুটনোট ছিল উপন্যাস লেখার কুঁড়ি।

উপন্যাস লেখার আকাঙক্ষা তখন থেকেই। আর লিখতে শুরু করেছিলেন অনেকটা পরীক্ষামূলকভাবে। খুব মহান কোনো সৃষ্টি নয় বরং দেখতে চাচ্ছিলেন তাঁর যথেষ্ট ইচ্ছাশক্তি আছে কিনা; শেষ পর্যন্ত লেখা শেষ করার দু-তিন মাসের মধ্যে পাণ্ডুলিপি তৈরি করে জমা দেন প্রকাশকের দপ্তরে। শিরোনাম এবং তার পরেই নিচে টাইপ করে লিখেছিলেন জন্মতারিখ ২১ জুন, ১৯৩৫।

বইটি প্রকাশের মাসেই প্যারি ম্যাচ পত্রিকা তাঁকে ‘১৮ বছরের কোলেত’ (বিখ্যাত ফরাসি সাহিত্যিক কোলেত) বলে অভিহিত করে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পুরস্কৃত হন ‘প্রি দ্য ক্রিটিক’ (prix de critique)-এ। আলবেয়ার কামু লা পেস্টের (La Peste) জন্য এ-পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯৪৭ সালে। অভূতপূর্ব খ্যাতির সুষমা। নোবেল লরিয়েট ৬৮ বছর বয়সী ফ্রাঁসোয়াজ মারিয়াক সাগঁকে ডাকতেন ‘১৮ বছরে চার্মিং মনস্টার’ বলে। লো ফিগারো (Le Figaro) পত্রিকার প্রথম পাতায় লিখেছিলেন সাগঁ সম্পর্কে – উপন্যাসের প্রথম পৃষ্ঠাতেই তাঁর সৃজনশীল মেধা বিস্ফোরিত এবং তা তর্কাতীত। সাগঁকে মারিয়াক ‘চার্মিং মনস্টার’ ডাকলে তিনি চোখ বড় বড় করে উত্তর দিতেন – আপনি আমার বই পছন্দ করেন না। কারণ বইয়ে পাপের কোনো অস্তিত্ব নেই।

উপন্যাসের সাগঁকে প্রথম কিস্তিতে পঞ্চাশ হাজার ফ্রাঁঙ্ক দেওয়া হয়েছিল। অল্পবয়সী বলে চেক গ্রহণে বাধা ছিল। পরে তাঁর মা মেয়ের ঘরের ওয়ারড্রবের ড্রয়ারে একসঙ্গে এতগুলো ফ্রাঙ্কের সন্ধান পেলে, বাবা নির্দেশ দেন জানালা দিয়ে সব ফেলে দিতে। পরের দিন সকালটা ছিল একেবারে ভিন্নতর। আকস্মিক পরিবর্তন, জীবনের দিকবদল। অস্থির, অসহিষ্ণু সত্তা; বাবা-মায়ের বাড়ি ছেড়ে প্রিয় ভাই জ্যাকের সঙ্গে থাকতে যান। আর মাথায় তখন ইচ্ছার রঙিন প্রজাপতি।

– উৎসব, উৎসবযাপন করতে হবে।

যা কিছু উজ্জ্বল আলোকিত, উদ্দীপ্ত, উচ্চকিত, গতি, সমুদ্র, মধ্যরাত্রি – যা কিছু অন্ধকারাচ্ছন্ন, যা কিছু হারিয়েছেন সবকিছু পেতে চাইতেন তিনি। জীবনে
আয়োজনে-প্রয়োজনে সাগঁর উপলব্ধি ছিল ফকনারের দর্শনে – যে-সময়টাতে যাপন করছি, যা আমাদের বেঁচে থাকতে দিচ্ছে, তার চেয়ে মহৎ আর কিছু হতে পারে না।

বাবার কাজের সূত্রে থাকতেন ফ্রান্সের দক্ষিণপূর্ব লিও শহরে। পড়তেন ক্যাথলিক স্কুলে। মলিয়েরের আবক্ষ মূর্তিকে অসম্মান করার অভিযোগে তাঁকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়। তিনি ঈশ্বর বা প্রভুত্বে বিশ্বাসী ছিলেন না। বলা হয়, তাঁর উপন্যাস জন্ম দেওয়ার প্রথম চিহ্ন তাঁর এই আত্ম-ভাবনা।

আত্মমগ্ন আবর্তে জমে থাকা অনুভূতি ছোট ছোট অক্ষরে প্রাণ পেয়েছিল উপন্যাসের খসড়া খাতায়। দু-আঙুলে টাইপ করে যখন লিখতেন, কখনো ভাবেননি প্রম্নস্ত বা রাদিগে হবেন। রেঁম রাদিগে ছিলেন একজন ক্ষণজন্মা প্রতিভা; জন্ম ১৮ জুন, ১৯০৩-মৃত্যু ১২ ডিসেম্বর, ১৯২৯। জীবনে বেঁচে থাকার রসদ ছিল হাসি। প্রাণিত হতেন ইতিহাসে, যে-জীবনে তিনি থাকেননি তাকে জানার। অপার আনন্দ খুঁটে নিতেন উপন্যাস পাঠে। ফ্রাঁসোয়াজের পনেরো বছর বয়সে তাঁদের পরিবার প্যারিসে চলে আসে। বাড়িতে কখনো অতিরিক্ত শাসন করেননি বাবা-মা। সন্তানরা যা করতে চেয়েছে, তাই দিয়েছেন। শাসনের অনুশাসন ছিল না মাত্রা ছাড়া। তাঁর বাবা চাইতেন বাড়িতে সন্তানরা যেন ভদ্রসভ্য হয়ে থাকেন। পারিজিয়ান জীবনে তাঁদের আবাস ছিল প্যারিসের সতেরো এলাকার সুন্দর ফ্ল্যাটে। সময় কাটাতে
বাবা-মাযের আদরের কিকি যেতেন ফ্লোরন্স মার্লোর সঙ্গে চার্লি পার্কার শুনতে। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া কিকির বিনোদনের আদর্শ স্থান ছিল প্যারিসের ক্যাফে, বিস্ত্রোগুলো। আড্ডা, হুইস্কি, ধূমপান ছাড়াও মজা পেতেন – ছেলেদের ‘কী সুন্দরী’ মন্তব্য শুনতে।

১৯৫৩ সালের ডিসেম্বরে বাবাকে প্রথম উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি দেখান। ছোট মেয়ের লেখা প্রকাশের সম্মতি জানিয়ে স্বাক্ষর করে বলেছিলেন – তোমার জিনিস কেউ প্রকাশ করলে আমি অবাকই হবো।

পরের বছর বইটা প্রকাশিত হয়। তাঁর সফলতা এখন ফরাসি সাহিত্যের ইতিহাস। ১৯৫৪ সালের ৯ মের মধ্যে আট হাজার কপি বিক্রি হয়। সেপ্টেম্বর নাগাদ ৪৫ হাজার কপি। অক্টোবরে সংখ্যা পৌঁছয় এক লাখ এবং ডিসেম্বর মাসে দু-লাখ কপি।

নন্দিত এবং নিন্দিত হয়েছেন। সফলতার পাশে বইটি সম্পর্কে বিতর্কও হয়েছে জনমাধ্যমে। লো মঁদ (Le monde) পত্রিকার সাহিত্য-সমালোচক কবি ও ঔপন্যাসিক এমিল অ্যারিও সাগঁর প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করেছেন অনৈতিক বলে। আবার এক সমালোচক মতপ্রকাশ করেছেন – বোঁজর
থ্রিসতেস
বিদেশিদের চোখে ফরাসি তরুণীদের ইমেজে নেতিবাচক ছায়া ফেলবে।

আর ফ্রাঁসোয়াজ সাগঁ এজাতীয় মতামতের ব্যাখ্যা দিয়েছেন যুক্তিনির্ভর বিশ্লেষণে – ‘ক্যাথলিকশাসিত দেশে বিষয়টিই অচিন্তনীয় যে, সতেরো বা আঠারো বছরের অল্পবয়সী মেয়ে প্রেম ছাড়াই শারীরিক সম্পর্ক করছে একই বয়সী ছেলের সঙ্গে এবং তাঁর জন্য কোনো শাস্তি পেতে হয়নি।’

সমাজ-নির্ধারিত নৈতিকতার লক্ষ্মণরেখা সম্পর্কে তিরিশ বছর পর তিনি লিখেছিলেন – মানুষজন এ-ধারণাটা গ্রহণই করতে পারে না যে, একটি মেয়ে পাগলের মতো ছেলেটির প্রেমে পড়বে এবং গ্রীষ্মের শেষে সে অমত্মঃসত্ত্বা হবে না। ব্যাপারটাই তাঁদের কাছে অগ্রহণযোগ্য যে, অল্পবয়সী মেয়েটির অধিকার আছে নিজের দেহ নিজের ইচ্ছামতো ব্যবহারের এবং আনন্দ পেতে পারে কোনোরকম শাস্তি ছাড়াই।

এত স্ত্ততি, প্রশংসার সঙ্গে অর্থনৈতিক সফলতার পরও সাগঁর অনেক কিছু শেখার ছিল এবং তিনি খুব দ্রম্নত তা শিখছিলেন। সংবাদপত্র, ম্যাগাজিনে তাঁর উপন্যাস সম্পর্কে আলোচনা, রচনা প্রকাশিত হচ্ছে। আর এসব লেখার মধ্যে অপরিহার্য পরামর্শ থাকত – যে সত্যিকার অর্থে সেসিল হলো লেখিকা সাগঁ নিজেই। এ-সম্পর্কে সাগঁ পারি রিভিউ পত্রিকায় বলেছেন – আমি মানুষকে চিত্রিত করিনি। আমার কল্পনার চরিত্রগুলোতে বাস্তবতার আদল দিতে চেয়েছি। অন্য একজন সমালোচক মতপ্রকাশ করেছেন – হয়তো একজন বয়স্ক লেখক সম্ভবত বইটি লিখেছেন এবং টিনএজ এক মেয়ের নামে তা ছাপা হয়েছে। শুধু আলোড়ন তৈরির জন্য। পড়াশোনা বাদ। দুবছর সময় নিয়ে লিখলেন আ সারতা সুরির (Un Certain Sourire)। এবার বিশ বছরের সরবোর্নের এক ছাত্রী। সাগঁর বয়সের চেয়ে এক বছরের ছোট মেয়েটি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে প্রেমিকের চাচার সঙ্গে। ত্রিকোণ সম্পর্কের গল্প।

পঞ্চাশের দশকে ফ্রান্সের শিল্পসাহিত্য, চলচ্চিত্র ফ্যাশনের প্রতি সমীহ ও আকর্ষণ ছিল বিশ্বব্যাপী। হয়তো সেজন্যই ফ্রান্সের বেস্টসেলার গ্রন্থটি বিশ্বের অন্যান্য দেশেও সাড়া ফেলেছিল। দীক্ষেত এবং অদীক্ষেত পাঠকের মুগ্ধবোধ অর্জন করেছিল। ফরাসি বুর্জোয়া পরিবারের সমাজের অনালোকিত এক বাস্তব, ব্যক্তির সম্পর্ক ও জীবনের গল্প অনায়াসে বর্ণনা করেছেন সাগঁ। শুধু প্রাণহীন টেক্সট নয়, নিজের ভাবনা আর কল্পনার ঝলককে যুগলবন্দি করেছেন রচনায়। প্রকাশভঙ্গির গুণেই বইটি প্রকাশের পরের বছর বিশ্বের অন্যান্য দেশে বিক্রির শীর্ষ তালিকার মর্যাদা পায়। অনূদিত হয় ইংরেজি, জাপানিজ, হিব্রম্নসহ অন্যান্য ভাষায়।

ইংরেজি সংস্করণে বইটির অনুবাদ করেছিলেন ইরিন অ্যাশ। প্রকাশ করেন জন মুরারি। ১৯৫৫ সালে পেঙ্গুইনের পেপার ব্যাকসহ। পরে পেঙ্গুইনের নতুন সম্পাদক ২০১৩ সালে নতুন অনুবাদের জন্য গস্নাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরাসি সাহিত্যের প্রাক্তন অধ্যাপককে দেন। তিনি লক্ষ করেন, ইরিন অ্যাশের অনুবাদে ফ্রাঁসোয়াজের রচনার একশ বাক্যেরও বেশি বাদ গেছে। শারীরিক ঘনিষ্ঠতার অধ্যায়টিসহ নতুন অনুবাদে এজাতীয় ত্রম্নটিগুলো সংশোধন করা হয়। লেখক-জীবনে ৪০টির বেশি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন ফ্রাঁসোয়াজ। বিশটি উপন্যাস, তিন খণ্ডর ছোটগল্প সমগ্র, নয়টি নাটক, দুটি জীবনীগ্রন্থসহ অসংখ্য রচনা প্রকাশ করেছেন। বিষয় – ব্যক্তি, স্থান, বিভিন্ন জিনিস, যা তিনি ভালোবাসতেন।

যুদ্ধোত্তর বহুল প্রচারিত বইগুলোর মধ্যে একটি বোঁজর থ্রিসতেস। পরে তাঁর রচিত অন্যান্য বইও পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল এবং অনূদিত হয়েছিল বিভিন্ন ভাষায় – আ সারতা সুরির (Un certain Sourire ১৯৫৬), অ্যাইমে-ভূ-ব্রাম (Aimez vous Brahms ১৯৬০), লা শামাদ (La ehamade ১৯৬৬), লো গারদ দ্য কোর (Le garde du coeur ১৯৬৮), আম্পো দ্য ছোলাই দ্যান লো ফোয়াদ (Unpeu de soleil dans l’e©au froide ১৯৭১), লা ফাম ফারদে পারে (La femme farde©e parait ১৯৮৩), লে নুয়াজ ম্যারভাইয় (Leo nuages merueilleux ১৯৬২) এবং লো শিয়া কুঁশ (Le chien couchant ১৯৮০)।

প্রচারের তীব্র আলোতে সেলিব্রেটি। রেস্টুরেন্টে তাঁর উপস্থিতিতে কথা বন্ধ করে লোকজন ঘুরে তাকায়। দৃষ্টিতে সম্ভ্রম, বিখ্যাত লেখককে দেখার আকর্ষণ। সফলতা, সম্মানে আলোকিত নারী। বিত্ত-সামর্থ্য হাতের মুঠোয়। প্যারিসের লেফট ব্যাংকে অ্যাপার্টমেন্ট নেন। কিনে ফেলেন শক্তিশালী জাগুয়ার কনভার্টিবেল xk140। পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে বেড়েছে নতুন বন্ধু, অনুরাগীর সংখ্যা। জীবনের প্রতি মনোভাব ছিল ঋজু। ছিল সহজাত সাহস। নিজের অসংলগ্নতা বা অসংগতির পরেও অবিচল। লিবার্টি উইথ ডেঞ্জার (Libertty with danger) ছিল বেঁচে থাকার অনুষঙ্গ। প্রথম উপন্যাস লেখার তিন বছর পর উত্তর ফ্রান্সের রিসোর্ট শহর মিলি-লা ফরেতে (Milly-la Foret) নিজের কেনা এসটন-মারটিন গাড়ি ভয়াবহ দুর্ঘটনাকবলিত হয়। মৃত্যুকে দেখেছেন শিয়রে। মাথার খুলিতে ডাবল ফ্রাকচার। বুকের পাঁজর ভাঙা, তলপেটে আঘাতসহ দেহের বিভিন্ন অংশে জখম নিয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করেছেন। দীর্ঘ ছয় মাস থাকতে হয়েছে হাসপাতালে, পুরোপরি আরোগ্য লাভ করে সুস্থ হতে।

ছিলেন আনন্দের পূজারি। আনন্দময়ী। পোশাক, চলাফেরা, খালি পায়ে রেসিং কার চালিয়েছেন। সমুদ্র শহর সাঁ-থ্রপেজে। ছিল না নারী জন্মের কোনো দ্বিধা। একক স্পর্ধায় তিনি স্বতন্ত্র।

খ্যাতির সঙ্গে জীবনধারায় তারুণ্যের স্ফূর্তি, অনিয়ম ছিল সমান্তরালে। ভোর অবধি রাতের ক্লাবে সময় কাটানো, মদপান, জুয়াখেলা – বিলাসী যাপনে অমিতব্যয়ী। দুর্ঘটনায় শিয়রে মৃত্যুকে দেখেও ছিলেন অদমনীয়, ইচ্ছাতাড়িত। অপরিমেয় আনন্দধারায় জীবনে নিজের মতো করে সেলিব্রেশন করেছেন।

ফ্রাঁসোয়াজের জীবনকে দেখা, উপভোগ করার সূত্রটা ছিল ভিন্ন। দুর্ঘটনার পরও তাঁর স্পোর্টস কার চালানোতে ছিল তীব্র উদ্দীপনা। ১৯৮৫ সালে আভেক মো মেইয়র স্যুভেনির (Avec mon meilleur souvonir) লিখেছিলেন – ‘যার গতিতে রোমান্স নেই তার জীবনেও কোনো শিহরণ নেই।’ দিশাহীন বায়ুযানের মতো গভীর তীব্র গতিতে ছিল আকর্ষণ। অনুচ্চারিত অন্তরের কথা বলতেন লেখায়। বেঁচে থাকার প্রেরণা ছিল সাহিত্য। প্রথা ভেঙে নিজেকে দুরূহ জটিল যাপনে ভাসিয়ে দিয়েছেন। অভিজাত পরিবারে জন্মেছেন। কিন্তু ব্যবহারে, কর্মে, চিন্তনে মেকি মানসিকতার প্রলাপ ছিল না। তাঁর জীবন বহুবর্ণ, বহুমাত্রিক, বহু ঘটনার সমন্বয়।

ফ্রাঁসোয়াজের জীবনটা ছিল আপসহীন অভিযানের মতো। সমাজ-রাষ্ট্রের অনেক বঙ্কিমতা নিয়ে সোচ্চার, যুক্তি-নীতিতে আপসহীন। বারো বছর বয়সে একটি তথ্যচিত্র দেখেছিলেন নাজি ক্যাম্পের ওপর। তিনি সহ্য করতে পারেননি। ‘ইহুদি’ তকমা সেঁটে জাতিগত বৈষম্যের রোষে নির্বিচার পীড়ন, হত্যা ও অবদমন। ১৯৬০ সালে আলজেরিয়ার যুদ্ধ সম্পর্কে বিশদ অবগত হয়ে ল এক্সপ্রেস ( express) পত্রিকায় নির্যাতিত জামিলা বুপাশার মুক্তির জন্য লেখেন। পরে যেসব ফরাসি সৈন্য যুদ্ধ করতে অনিচ্ছুক তাদের সমর্থনে ভাই ফ্রাঙ্কসহ ১২১ জনের স্বাক্ষর সংগ্রহ করেন। এই ‘লা আপেল ১২১’ (L© appel de 121) ছিল একটি মানবিক দাবি। ফ্রাঁসিজ জন ছিলেন স্বাধীনতাকামী আলজেরিয়ার জনগণের সমর্থনে কাজ করে এমন একটি সংগঠনের প্রধান। তাঁর সঙ্গে পরিচয়ের পর সাগঁ নিজেকে যুক্ত করেন মুক্তিকামী যোদ্ধাদের সাহায্যে। দশ বছর পর আরেকটি স্বাক্ষর অভিযানে সোচ্চার হন। জীবনের সত্যকে সহজভাবে দেখার দর্পণে নারীদের গর্ভপাতের পক্ষে ৩৪৩ জনের স্বাক্ষরসহ জনমত গড়ে তোলেন। কাজ করেছেন জেনারেল দ্য গলের নির্বাচনের পক্ষে ১৯৬৪ সালে।

রাষ্ট্রপতি ফ্রাঁসোয়া মিতেরাঁর সঙ্গে আলাপ শুধু নয়, হার্দিক সম্পর্কের এক বিচিত্র সমঝোতা ছিল তাঁদের। রাজনীতি ও সাগঁ শুধু কোনো আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং তা ছিল এক নৈতিকতার বিষয়। ১৯৯৮ সালের জানুয়ারিতে ‘লিবেরাশিও’ এক স্মরণ (Hommage) সংখ্যা প্রকাশ করে অভিযুক্ত করছি (J©accuse) শিরোনামে, যাতে ১৯৬০ সালে আলজেরিয়ার যুদ্ধের বিরোধিতা করেছে এমন ১২১ জনের নাম প্রকাশিত হয়। কিন্তু সাগঁ ও তাঁর ভাই ফ্রাঙ্কের নাম না থাকায় তিনি সম্পাদককে চিঠি লেখেন। জানান ’৬০ সালে তাঁদের নাম সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলে কীভাবে হয়রানি এবং পুলিশি জেরার মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাঁদের। আলজেরিয়ায় ফরাসি রাষ্ট্রনীতির অবদমন নিয়ে তিনি ছিলেন স্পষ্টবাদী।

দার্শনিকের এক বিমগ্ন উদাসীনতা ছিল টমবয় ইমেজের অন্তরালে। একবার তদন্তকারী ম্যাজিস্ট্রেটকে বলেছিলেন – ‘এক গস্নাস তীব্র সোডা পানি গলাধঃকরণের অনুভূতি হয় যদি আমার, সেটা আমার নিজের সমস্যা।’ তাঁর দৃষ্টিতে রোমান্স নিরানন্দেরও হতে পারে। ১৯৮০ সালে স্বসময়ের ধারক কণ্ঠস্বর বলেছেন – আমার মনে হয় ভালোবাসা এক ধরনের অসুস্থতা। প্রমত্ততা। কখনো আমি তিন বা চার বছরের জন্য প্রমত্ত থাকি। কিন্তু কখনো তাঁর বেশি নই। আমি মনে করি মানুষ একসঙ্গে সুখী হতে পারে দীর্ঘ সময়ের জন্য, যা আমি বিশ্বাস করি তার থেকেও। তবে আমি মনে করি না তা চিরদিনের হতে পারে।

এক অনবদ্য বর্ণনা দিয়ে শুরু করেছিলেন প্রথম লেখা গ্রন্থ – A strange melancholy pervades me to which I hesitate to give the grave and beautiful name of sorrow. যদিও দুঃখ, বিষণ্ণতার মতো বিশেষণগুলো সাগঁর ব্যক্তিসত্তার জন্য বেমানান ছিল।

ফ্রাঁসোয়াজ সাগঁ মানে জীবনকে অবিরাম ভালোবাসা, অপরিমেয় ভালোবাসা। প্রথাগত সৌন্দর্যের ভাষাও বদলে দিয়েছেন তিনি। নিষ্পাপ মুখাবয়ব সোনালি ছোট চুলের গুচ্ছ। স্বভাবে উচ্ছল, নমনীয় সুন্দরী। তাঁর আবেদনময়ী ব্যক্তিত্বের দ্যুতি আভাগার্ডনারকেও প্রলুব্ধ করেছে।

সাগঁ রচনায় নারীর ভাবনা নিবিড় বুননে তুলে ধরতে পারতেন। তাঁর উপন্যাসগুলোতে নারীর প্রকৃতি, অনুভূতি এবং পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কের রসায়নের প্রতিক্রিয়াটা থাকত। নারীর আবেগ আর নিজস্ব নিভৃতি প্রকাশে অনবদ্য ছিলেন।

পল এলুয়ারের একটি কবিতার ইংরেজি অনুবাদ – Aging is a Process for your to organize your youth as you go through the years. কিন্তু ফ্রাঁসোয়াজ তাঁর তারুণ্যকে এলুয়ারের শব্দের মতো সুবিন্যস্ত করার দায় নেননি। হয়তো মেধা আর মননের দীপ্তি ও অস্থিরতা – অবিন্যাসই ছিল তাঁর অন্তর্গূঢ় বিন্যাস। ’৫৭ সালে গাড়ি দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হওয়ার পর থেকেই মরফিনে আসক্তি। মিলিতে দুর্ঘটনার পর জ্ঞান ফিরলে নিজেকে আবিষ্কার করেছিলেন হাসপাতালের শয্যায়। ব্যথানাশক পালফিয়াম ড্রাগের ওপর তাঁর নির্ভরতা এতটাই ছিল যে, তিনি হেরোইন নিতেন। ক্লান্তি দূর করতে নিতেন কোকেন। আর কাজ করতেন দিনের বেলায়। ব্যথানাশক মরফিন স্বস্তি দিলেও মরফিনই ছিল তাঁর শত্রম্ন। বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাশেষে মরফিন-আসক্তি কমে যায়। কিন্তু পরে বারবার তিনি সে-অভ্যাসে ফিরে গেছেন।

সৃষ্টিশীল লেখক, নারী সাগঁর চাইতেও মহৎ কিছুর ওপর দাঁড়িয়ে ছিল তাঁর জীবন, যে-জীবনযাপনের মধ্যে ‘গতি’ ছিল স্পৃহার ঐশ্বর্য। ব্রাদার্স কারামাজভের আলিওশার মতো জীবনের মানে খোঁজার চেয়ে বেশি দরকার জীবনকে ভালোবাসা। তাই নৈতিক-অনৈতিক স্বভাবের নানা বিচ্যুতি নিয়েও নিজের আশা-আকাঙক্ষাকে কুর্নিশ করেছেন বারবার।

নিয়ম না-মানা জীবনে সাগঁ বিতর্কিত হয়েছেন বহুবার। অভিযুক্ত হয়েছেন কর ফাঁকি ও ড্রাগ সেবনের দায়ে। ড্রাগের জন্য উপার্জিত অর্থের বিরাট অংক ব্যয় করেছেন অবলীলায়। একবার প্রিয় পোষ্য কুকুরটি তাঁর রুমাল শুঁকে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। ১৯৮৫ সালে ফরাসি রাষ্ট্রপতি ফ্রাঁসোয়া মিতেরাঁর সঙ্গে কম্পোডিয়া ভ্রমণকালে হেলিকপ্টারে ওভারডোজ কোকেন নিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। অবশ্য সে-যাত্রায় রক্ষা পান।

১৯৮৩ সালে দ্বিতীয়বারের মতো আদালতে অভিযুক্ত হন ড্রাগ সেবনের জন্য। আদালতে বিচারের আগে এক সাক্ষাৎকারে দিয়েছিলেন বিস্ফোরক বয়ান – ‘আমার অবিশ্বাস্য ভাগ্য, কারণ আমি যখন বড় হয়েছি, সে-সময়টাতে গর্ভনিরোধক পিল এসেছে। যখন আমার আঠারো, আমি অমত্মঃসত্ত্বা হওয়ার ভয়ে শঙ্কিত থাকতাম। তারপর তা এলো এবং প্রেম ছিল বন্ধনহীন এবং প্রায় তিরিশ বছর কোনো বিপর্যয় ছাড়াই। তারপর এইডস এলো।’

ঔপন্যাসিক সাগঁ এবং ব্যক্তি সাগঁকে নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে অনেক জীবনীগ্রন্থ। মারিদমিনিক লোলিএভ সাগঁর জীবনীতে লিখেছেন – পাঠকরা সত্যিই এক ধরনের একাত্মতা বোধ করত তাঁর সঙ্গে। টিনএজ থেকে নানি-দাদি সব বয়সীরা তাঁর লেখা পড়েছে।

ফ্রাঁসোয়াজ সাগঁর কয়েকটি উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র হয়েছে। তিনি নিজের লেখা নাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন। পরিচালনা করেছেন চলচ্চিত্র লে ফুজে বস্ন্যু (Leo Fougeres Bleus) ১৯৭৭ সালে।

উদিত সূর্যের মতো সম্ভাবনাময় সৃজনসত্তা। এক সময়ে তাঁকে ডাকা হতো ‘অর্ধেক জুডি গারলেন্ড, অর্ধেক স্কট কিটজারল্ড’। সৃষ্টির সফলতা এবং জনপ্রিয়তার প্রথম পর্বে তিনি নিউইয়র্কে গিয়েছিলেন। প্রথম উপন্যাস ইংরেজিতে অনূদিত হলে আমেরিকার বিশুদ্ধবাদীদের অনুভূতিতে আঘাত লাগে। যদিও প্রতিদিন দশজনের মতো অনুরাগী পাঠক নিউইয়র্কের হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকত, শুধু সাগঁকে দেখার জন্য। দর্শনার্থী অনুরাগীদের বইতে লিখে দিতেন – with all my sympathy. কয়েকদিন পর কেউ একজন তাঁকে বলেন এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে – ‘আমার সব সমবেদনা’ (avec mes condolence)।

হলিউডে চলচ্চিত্র জগতের কয়েকজনের সঙ্গে পরিচিত হন। তাঁদের মধ্যে ইনগ্রিড বার্গম্যানকে বোঁজর থ্রিসতেসে অভিনয়ের জন্য বলা হয়েছিল। কিন্তু ‘অনৈতিক’ বলে তিনি চরিত্রটি করতে চাননি। পরে অড্রে হেপবোর্ন ছবিটি করতে রাজি হন।

টেনেসি উইলিয়ামের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল আমেরিকাতেই। কি ওয়েস্টে হেমিংওয়ের বাড়িতে বিড়ালদের এক দৌড় প্রতিযোগিতায় সাগঁকে আমন্ত্রণ জানান টেনেসি উইলিয়াম। এই পরিচয় সূত্রেই তাঁদের বন্ধুত্ব, পরবর্তীকালে তা গভীর বন্ধুত্বে রূপ নেয়।

বিয়ে করেছিলেন বাইশ বছর বয়সে। ১৯৫৮ সালে গি শোলারকে। প্রকাশনাজগতের পোপ। উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। ফ্রাঁসোয়াজের চেয়ে বিশ বছরের বড়। বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন গাস্ত গালিমার, ইথিয়ের দ্য বকমরেল, আসেত প্রকাশনার প্রকাশকদের মতো বিশিষ্টজনরা। অনুষ্ঠান হয়েছিল বিখ্যাত ব্যক্তি প্রকাশক পিয়্যের লা জারেফের বাড়িতে (বারো বছর বয়সে প্রথম পাণ্ডুলিপি যাঁকে পাঠিয়েছিলেন ফ্রাঁসোয়াজ)। বিয়ের পরও ক্যাফে ক্লাবের নৈশজীবন। নিয়মিত বাইরে রাত কাটানো চলছিল। ধরাবাঁধা নিয়ন্ত্রিত জীবন তাঁর স্বভাববিরোধী। ফলে বিচ্ছেদ ‘অবশ্যম্ভাবী’ হয়ে পড়ে ১৯৬০ সালে। দুবছর পর আবার সম্পর্কে জড়িয়ে বিয়ে ১৯৬২ সালের ১০ জানুয়ারি। স্বামী বরার্ট ওয়েস্ট থফ আমেরিকার সিরামিক শিল্পী এবং ভাস্কর। তাঁর জীবন নিয়েই বই লেখা যায় – এমন মন্তব্য করেছিলেন বিখ্যাত সাহিত্য-সমালোচক ব্যারনার পিভো। রবার্টের জন্ম মিনেসোটায়। ১৬ বছর বয়সে জাল কাগজ তৈরি করে ইউএস বিমানবাহিনীতে যোগ দেন। দেখতে সুদর্শন। মধ্যমানের বুদ্ধিমত্তা, নজরকাড়া ব্যবহার। মিলিটারি সার্ভিস শেষ করেন আলাস্কায়। পরে তিনি যোগ দেন কানাডার আইস ব্যালে ট্রুপে। সেখান থেকে চলে যান মেক্সিকোতে পস্নাস্টিক আর্ট পড়তে। তিনি ফ্যাশন ফটোর মডেলও ছিলেন। একদিন স্থির করেন প্যারিস আসবেন দু-সপ্তাহের জন্য; কিন্তু তিনি আমৃত্যু প্যারিসেই থেকে যান।

ফ্রাঁসোয়াজ সাগঁর সম্পর্কে লিখতে গেলে তাঁর স্বামী রবার্টের প্রসঙ্গ অপরিহার্য। তাঁদের পরিচয়ের অধ্যায়টি গল্পের মতো। ফ্রান্সে আসার জাহাজে পরিচয় হয়েছিল অভিজাত তরুণ শার্লস দ্য রোহান শারোর সঙ্গে। দুজনের মধ্যে বন্ধুত্বের সূত্রপাত তখনই। রোহান ছিলেন ফ্রাঁসোয়াজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

পাওলা সা জুস্ট বলে এক ধনী ও সুন্দরীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল জোহানের। ব্যবসার কারণে দুজনে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন এবং মধুচন্দ্রিমার জন্য ফ্রাঁসোয়াজের নরমন্দির বাড়িতে আসেন। রোহানের সঙ্গে ছিলেন বন্ধু রবার্টও। নববিবাহিত দম্পতির মধ্যে মাঝেমধ্যে বিবাদ বা তুমুল ঝগড়ার উদ্গিরণ হলে উত্তেজিত দুজন ঘরে পেস্নট, জিনিসপত্র ছুড়তেন চতুর্দিকে। ফ্রাঁসোয়াজ আর বব (রবার্টের ডাকনাম) বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়তেন। চলে যেতেন বিচে বা জঙ্গলে ঘুরতে। তাঁদের প্রেম, প্রণয়ের শুরু নরমন্দিতেই।

দুজনে বিয়ে করেন ১৯৬২ সালের ১০ জানুয়ারি। তাঁদের পুত্র দনির জন্ম হয় ২৭ জুন প্যারিসের আমেরিকান হাসপাতালে। সন্তানের মা হওয়ার পর অসাধারণ এক অনুভূতি ব্যক্ত করেছিলেন – ‘আমি শাখাসহ একটি বৃক্ষ।’

দ্বিতীয় বিয়েও বিচ্ছেদের মধ্যে সমাপ্ত হয় ১৯৬৩ সালে। তবে দুজনের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্কটা টিকে ছিল। দুজনে একসঙ্গে থাকতেনও। এ-প্রসঙ্গে ফ্রাঁসোয়াজের কথা – ‘… কারণ আমি মনে করি বিবাহিত পুরুষের চাইতে অবিবাহিতরা বেশি সম্মোহক।’

সাগঁর একমাত্র পুত্র দনি স্মৃতিকথায় লিখেছেন – ‘খুব সুখী এবং প্রেমময় দম্পতির সন্তান হিসেবে তাঁর জন্ম। যাঁরা রাত্রিতে উদযাপন করতেন এবং দিনে ঘুমাতেন। মা-বাবার পরস্পরের বোঝাপড়াটা খুব ভালো ছিল ফলে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষেতে।’

অর্থ, বিত্ত, খ্যাতিপ্রাপ্তির পরও সৃষ্টিশীল মানুষের ব্যথাতীত অতৃপ্তি হয়তো থাকে। অন্যের কাছে নিজেকে অর্থবহ করা নয়, বরং সাগঁর ভেতরের জাগরণ ছিল ব্যথাতীত। প্রেম, দাম্পত্য, প্রণয় শব্দগুলো প্রথাসিদ্ধ সংজ্ঞায় আবদ্ধ ছিল না। তাই বিচ্ছেদের পর যেমন একত্রে থেকেছেন আবার দুজনেই নির্বিকারভাবে, নিজেদের পছন্দের জীবন বেছে নিয়েছেন। রবার্ট ফিরে যান পুরুষের কাছে আর ফ্রাঁসোয়াজ মহিলাদের কাছে বেশিরভাগ সময়।

ভাস্কর, অপেরাপ্রেমী রবার্ট ফ্রান্সে যখন এসেছিলেন জানতেন না কোনো ফরাসি শব্দ। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই ফরাসি ভাষার বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেন। ভাষার ব্যাকরণ, রীতির খুঁটিনাটি বিষয়গুলো বিশদ জানতেন অনেক ফরাসির তুলনায়। ভাস্কর্য চর্চা, অনুবাদ, মডেলিং ছিল তাঁর প্যাশন। বিখ্যাত ছিলেন তাঁর আভিজাত্য ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের জন্য। সুন্দর ব্যবহার আকৃষ্ট করত পুরুষদের। দুর্ভাগ্যবশত তিনি মারা যান তুলনামূলক অল্প বয়সে।

নির্মাণ আর ভাঙনের আশ্চর্য জীবন ছিল ফ্রাঁসোয়াজের। জীবনের ৪৪টি বছর ছিল কষ্টের, কঠিন দিনযাপন, ভঙ্গুর শরীর, লাঠি ছাড়া হাঁটতে পারতেন না। দুবার অভিযুক্ত হয়েছেন ড্রাগ সেবনের অপরাধে। কিন্তু তাঁর যুক্তি – ‘আমার অধিকার আছে নিজেকে হত্যা করার।’

নিজের চিরবিদায় সম্পর্কে ১৯৬৩ সালেই বলেছিলেন – ‘আমি আর তিরিশ বা চলিস্নশ বছর পর্যন্ত বাঁচব। তারপর স্যালুট।… চিরশান্তি’।

ফ্রাঁসোয়াজের নরমন্দির বাড়ি ক্রয়ের ঘটনাও সাগঁ মিথের একটা অংশ।

১৯৫৯ সাল, তিনি তখন বিখ্যাত লেখক, পাপ্পারাজিরা নিয়ম করে তাঁকে অনুসরণ করেন। বার্ষিক ছুটি কাটাতে যেতে অনীহা সমুদ্রসৈকত শর সাঁ-থ্রপেজে। কারণ খুব বেশি কোলাহলপূর্ণ স্থানীয় ও পর্যটকদের ভিড়ে। সাগঁর জন্য ক্লান্তিকর। তিনি অপেক্ষাকৃত শান্ত, নির্জন স্থান খুঁজছিলেন। তাঁর এক বন্ধু নরমন্দির গ্রামে পছন্দনীয় একটি বাড়ি ভাড়া নেন। ৮ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট – এক মাসের জন্য। কাছেই দোভিল শহর। ছুটি কাটানোর আদর্শ স্থান। ক্যাসিনো খুব দূরে নয় নরমন্দি থেকে। ফলে সাগঁ, তাঁর বন্ধু লেখক ব্যারনার ফ্রঙ্ক এবং নৃত্যশিল্পী জ্যাক শাবো রাতটা কাটাতেন ক্যাসিনোতে।

জুয়া খেলে প্রচুর অর্থ খুইয়েছেন পুরো মাসে। ছুটির শেষ দিনের রাতে সাগঁ জিতে যান ৮০ হাজার ফ্রাঙ্ক। সমস্ত অর্থ একত্র করে তিনজনে ভোরে বাড়ি ফেরেন মত্ত অবস্থায়। লঘুচিত্তে ঘুমিয়েও পড়েন।

বাড়ির মালিক কথামতো (৮ আগস্ট) সকালে আসেন বাড়ির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে। ফ্রাঁসোয়াজ ক্লান্ত ছিলেন। মালিকের সঙ্গে ঘুরে বাড়ি পরিদর্শনে অনীহা এবং অলসতাও। জিজ্ঞেস করেন, তিনি বাড়িটা বিক্রি করবেন কিনা। মহিলা ‘হ্যাঁ’ বলতেই সাগঁর প্রশ্ন – মূল্য কত? আশি হাজার ফ্রাঙ্ক।

আগের রাতে জেতা ফ্রাঙ্কগুলো মহিলাকে দেন। বাড়ি কেনা শেষ। তিনি আবার ঘুমাতে চলে যান। দিনটি ছিল অষ্টম মাসের অষ্টম দিন। সকাল আটটা এবং বাড়ির মূল্য আশি হাজার ফ্রাঙ্ক।

মায়ের স্মৃতিচারণ করে দনি লিখেছেন – ‘আমার মা ছিলেন খুব ভালো সঙ্গী। আমার সাহিত্য রুচিবোধ গড়ে দিয়েছিলেন তিনি। আমরা পিয়ানো শিখতাম একসঙ্গে, একসঙ্গে হাসতাম খুব। আমাদের সময়গুলো দারুণ কাটত।’

আসলে দনি জন্মের পর সন্তানের যত্ন করতে অসমর্থ ছিলেন আনাড়ি সাগঁ। ফলে প্রথম মাসটা মায়ের প্যারিসের বিশাল অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন। নানা-নানি শিশুদের ভালোবাসতেন। নাতিকে দেখাশোনার ভার সানন্দে নেন নানি। শারীরিক ধকল সামলে কিছুটা সামর্থ্য অর্জনের পর। পুরনো অভ্যাসে ফিরে যান সাগঁ আর স্বামী বব। রাতে ক্লাব, দিনে ঘুমানো। ছেলের গোটা শৈশবই কেটেছে নানাবাড়িতে। এমনকি গরমের ছুটিতেও ফিরে গেছেন নানার সঙ্গে, গ্রামের বাড়িতে।

মায়ের সঙ্গে যে-সময়টা বাড়িতে থাকতেন, পরিচারিকা দেখাশোনা করত। ব্রাজিলিয়ান এক দম্পতি কাজ করত। অস্কার তাঁকে গাড়িতে স্কুলে পৌঁছে দিত আর তেরিজা ব্রাজিলিয়ান সুস্বাদু খাবার রান্না করে খাওয়াত। স্কুলে দনি নানা ধরনের সমস্যা তৈরি করলে সাগঁ ববকে বলেন দায়িত্ব নিতে। যদিও বব নিজেও দায়িত্ব নিতে খুব অভিজ্ঞ ছিলেন না।

যে-কোনো ধরনের বৈষম্য তিনি ঘৃণা করতেন। একবার ছেলেকে নিয়ে ডিনারে গেছেন। রেস্তোরাঁর অচেনা মানুষজনের মধ্যে কেউ একজন ইহুদিবিদ্বেষী মন্তব্য করেন। সাগঁ উঠে ছেলের হাত ধরে বেরিয়ে আসেন কোনো কথা না বলে।

চিৎকার-অশালীন ঝগড়া অপছন্দ ছিল। রাস্তার ভিক্ষুকদের প্রায়ই সাহায্য করতেন। দারিদ্র্য একদম সহ্য করতে পারতেন না। মানুষকে এত বিশ্বাস করতেন। সেজন্য ভুগতে হয়েছে অনেক বেশি। বন্ধু নামের আড়ালে অসৎ, অবিশ্বস্ত, বিশ্বাসঘাতক ছিলেন কেউ কেউ।

অর্থ তাঁর মুঠো থেকে বেরিয়ে গেছে। প্রকাশকরা সমস্ত বিল পরিশোধ করতেন, প্রয়োজনীয় অর্থ দিতেন। বিলাসী যাপনে তাঁকে পরিবৃত করে রাখত পরজীবীরা, সাগঁর উদারতার সুযোগ নিত। বেশিরভাগ সময় তিনি পড়তেন, হাঁটতেন এবং স্বপ্ন বুনতেন। কাছের মার্কেটে ঘুরে পুরনো ধূসরিত ইম্প্রেশনিস্ট ছোট ছোট চিত্রকর্ম কিনতেন। বাড়িতে এসে ছেলেকে নিয়ে পরিষ্কার করে, তাতে অজানা শিল্পীর স্বাক্ষর খুঁজতেন। যদি অযত্নে পড়ে থাকা বা হারানো কোনো দুর্লভ সম্পদ পেয়ে যান এই ভেবে। তবে অনেক চিত্রকর্মই তিনি দিয়ে দিয়েছেন। এমনকি মূল্যবান। সাগঁ নিজে ভালোবাসতেন – সেসব শিল্পকর্মও অকাতরে দিয়েছেন। প্রকাশক টেলিফোন করে স্মরণ করিয়ে দিতেন অর্থ ফুরিয়ে যাচ্ছে। সাগঁ তখন নিজেকে সংযত করে নতুন গ্রন্থ রচনায় মন দিতেন। সাগঁ অলস ছিলেন না। তিনি জানতেন একটা সুন্দর আনন্দদায়ক অবকাশ কী করে কাটানো যায়।

সাহিত্যিক ফ্রাঁসোয়াজ সাগঁকে নিয়ে এ-লেখা মূলত তাঁর ব্যক্তিজীবনের খ-চিত্র। যিনি নিক্তিমাপা নীতিরীতিতে জীবন কাটাননি। সত্তর সালের শুরুতে সব বদলে যায়। পেগি রস, সুন্দরী, প্রাণবন্ত প্যাশন ডিজাইনার সাগঁর জীবনে আসেন। অবিরত উজ্জীবিত ও প্রভাবিত করেছেন তিনি সাগঁকে। সাগঁ তাঁকে ডাকতেন – আমার জীবনের ভালোবাসা এবং প্রায় বিশ বছর তাঁরা আনন্দময় সুখী জীবন কাটিয়েছেন। ভালো বন্ধু। প্রেমিকা। পরামর্শদাতা হিসেবে ছিলেন অসাধারণ। প্যাশন, সম্মান অনুরাগের এক চমৎকার বোধের সংমিশ্রণ ছিল দুজনের বোঝাপড়ায়।

আনন্দ-বেদনার যাবতীয় আস্বাদ তিনি মানুষের কাছ থেকেই পেয়েছেন। নারীদের ব্যাপারে তাঁর ভালোলাগা, অনুরাগ বা পক্ষপাতিত্ব সবারই জানা। পেগি এবং সাগঁ একই অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন। ছুটি কাটাতে যেতেন একসঙ্গে। পরস্পরের সম্পর্ক গোপন করার কোনো ভান তাঁদের ছিল না। এক আশ্চর্য নির্ভরশীলতা ছিল দুজনার। পেগি সম্মান করতেন সাগঁর একেবারে নিজস্ব ব্যক্তিগত পরিসরকে। রাষ্ট্রপতি মিতেরাঁ বা দার্শনিক জঁ পল সার্ত্রের সঙ্গে সাক্ষাতে গেলে সাগঁ, পেগিকে আমন্ত্রণ জানানো হতো না। পরস্পরের শ্রদ্ধা আর পরিমিতি বোধের জমিন ছিল মসৃণ।

পেগি ছিলেন সংসারের কর্ত্রী। বাড়ির সব কাজকর্ম দেখভাল করা ছাড়াও অর্থনৈতিক আয়-ব্যয়ের হিসাব অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পালন করতেন। প্রতারক, সুবিধাবাদী, ড্রাগডিলার এবং পরজীবী যারা সাগঁকে ঘিরে থাকতে চাইত তাদের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখতেন।

সাগঁর জীবনে পেগির প্রভাব এতটাই ছিল যে, কয়েকজন বিশ্বস্ত, নিষ্ঠাবান কাজের লোককে বিদায় করেছেন। যারা দীর্ঘদিন ধরে সাগঁর বাসায় ছিলেন। তাদের কেউ কেউ অভিযুক্ত করেছেন পেগিকে – কর্তৃত্বপরায়ণ মানসিকতার জন্য। কিন্তু সাগঁ স্বস্তিতে ছিলেন। সুখী ছিলেন পেগির সান্নিধ্যে।

ফ্যাশন ডিজাইনার পেগির পেশাগত উন্নতির জন্য তিনি অর্থ সাহায্য করেছেন। প্যারিসে লেপট ব্যাংকের খুব ফ্যাশনদুরস্ত এলাকায় একটি ফ্যাশন হাউস খুলেছিলেন পেগি। কিন্তু তাঁর প্রতিভা এবং ফ্যাশন বিষয়ে নান্দনিক ধারণা, সুরুচি থাকলেও ব্যবসা সম্পর্কে অনভিজ্ঞ ছিলেন। সাগঁ বহুবার নতুন কালেকশনের জন্য নির্দ্বিধায় অর্থ বিনিয়োগ করেছেন। পেগির দুর্ভাগ্য, কোম্পানি লোকসান দেয়।

১৯৯০ সালের শুরুতে ফ্রাঁসোয়াজের ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের মৃত্যু হয়। প্রিয় ভাই জ্যাক, তাঁর বাবা, প্রিয় বন্ধু জ্যাক শাজো। সবচেয়ে বেদনাদায়ক ছিল প্রেমিকা পেগির মৃত্যু। তাঁদের যুগলজীবনের অবসানে সাগঁ নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। পেগির অনুপস্থিতিতে প্রবল আত্মশূন্যতায় স্তিমিত তাঁর উদ্দীপনা বিপন্নসত্তা। তত্ত্বাবধানের অভাবে বেহিসেবি অর্থব্যয়; ঋণ বাড়তে থাকে কোকেন ব্যবহারের কারণে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাঁর সৃজনশীলতা। প্রকাশকরা ধৈর্য হারিয়েছেন। আয়কর বিভাগ থেকে বকেয়া পরিশোধের নির্দেশ এলেও তিনি অপারগ ছিলেন। রাষ্ট্রপতি মিতেরাঁ ছিলেন সাগঁর বন্ধু এবং সাহিত্যানুরাগী। বকেয়া আয়কর পরিশোধের বিষয়টি তিনি বহুবার স্থগিত করেছেন। ছেলে দনির কথা – একজন লেখক এবং সংস্কৃতিমনা নারীর মূল্য তিনি বুঝতেন এবং তাই চোখ বন্ধ রেখেছিলেন।

সাগঁর জীবন ঘটনায় ভরা। ব্যবসাসংক্রান্ত কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ে তাঁর নাম। অঁদ্রে গিলফি নামে এক ব্যক্তি সাগঁকে ব্যবহার করেন তেল ব্যবসা প্রসারে। রাষ্ট্রপতি মিতেরাঁর সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্কসূত্রে সাগঁকে বলেন উজবেকিস্তানে তেল ব্যবসার জন্য তাঁকে হস্তক্ষেপ করতে। বিনিময়ে সাগঁর নরমন্দির বাড়ি সংস্কারের জন্য অর্থ দেওয়ার প্রতিশ্রম্নতি দেন। সরল বিশ্বাসে রাষ্ট্রপতিকে চিঠি লেখেন তিনি। পরে প্রকাশিত হয় যে, ব্যবসায়ীর চুক্তি মিথ্যা ছিল। সাগঁকে কৌশলে কর পরিহারের জন্য অভিযুক্ত করা হয়।

১৯৯৫ সালে জ্যাক শিরাক রাষ্ট্রপতি থাকাকালে বকেয়া ঋণের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী একজন বিখ্যাত এবং সৃষ্টিশীল লেখকের বিষয়টি অবজ্ঞা করে সাগঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন। পরে সারকোজির শাসনকালে ২০০৭ সালে ছেলে দনি মায়ের বকেয়া কর পরিশোধের সমস্যা সমাধানে সফল হন। তিনি কর্তৃপক্ষকে ন্যায়সম্মত অর্থ প্রদানের ব্যবস্থা করেন।

ফ্রাঁসোয়াজ সাগঁর ছেলে মাকে নিয়ে একটি স্মৃতিকথা লিখেছেন ২০১২ সালে। সাগঁ এ ফিস (Sagan et Fils) অর্থাৎ সাগঁ এবং তাঁর ছেলে। বইয়ে বাবা-মায়ের প্রেম, পরিণয়, দাম্পত্য, তাঁর কৈশোর, স্বজনদের কথা ছাড়াও আছে মায়ের জীবনের নানা প্রসঙ্গ। তবে বইয়ে মায়ের জীবনের একেবারে শেষ সম্পর্কটি নিয়ে কোনো কথা উলেস্নখ করেননি। প্রকাশে বিরত থেকেছেন মায়ের জীবনে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে এমন অনেকের নাম। নিজের দেখা এবং বাহিত সময়কে ধরে তাঁর জীবনীগ্রন্থটি।

জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময়ে দেখা হয়েছিল ইনগ্রিড ম্যাক চুলামের সঙ্গে। সুদর্শনা, স্বর্ণকেশী ইনগ্রিডের স্বামী মেক্সিকান ইহুদি বিলিওনিয়ার। স্ত্রীর চেয়ে বয়সে অনেক বেশি। প্যারিসের অভিজাতপাড়ার বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন এবং স্বামী আর তাঁর অর্থসম্পদ ব্যবহার করে আগ্রাসী চাহিদা মেটাতেন। ইনগ্রিড সাগঁর প্রেমে পড়েন। দিনের অনেকটা সময় কাটাতেন একত্রে। স্বামীর মৃত্যুর পর সাগঁ যখন অসুস্থ কপর্দকশূন্য – ইনগ্রিড সাগঁর বাড়িতে চলে আসেন থাকতে। দুজনে মিলে কোকেন নিতেন। বলা যায় পরিকল্পিতভাবেই সাগঁকে সব বন্ধু-স্বজন এবং তাঁর ছেলে থেকে দূরে রেখে সম্পর্ক ও সান্নিধ্য বঞ্চিত করেছেন।

জীবনের দিক বদল। অস্টিওপোরসিস আর পেলভিক ফ্রাকচারে বেশিরভাগ সময় শয্যাশায়ী সাগঁ সম্পূর্ণরূপে ইনগ্রিডের ওপর নির্ভরশীল। আয়কর বিভাগ তাঁর নরমন্দির বাড়ি বাজেয়াপ্ত করে বিক্রির উদ্যোগ নিলে, ইনগ্রিড বাড়িটা কিনে নেন। সঙ্গে লেখকের সব মূল্যবান পাণ্ডুলিপি। ছেলে দনির আক্ষেপ – ‘মায়ের একটিও পাণ্ডুলিপি নেই আমার কাছে।’

মৃত্যুর পরও তিনি সম্মানিত, স্মরণীয়; গ্রহণীয় তাঁর রচনাবলি। সাগঁর জীবন নিয়ে অনেক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তাতে কেউ কেউ কল্পনা মিশিয়ে মনগড়া তথ্য যুক্ত করেছেন। ২০০৮ সালে প্রকাশিত মারি দমিনিক লোলিয়েভের বইতে আছে – সাগঁর সোয়েটার সিগারেট পোড়ায় শত ফুটো ছিল। মত্ত অবস্থায় ড্রাগ নিয়ে তিনি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। এ-জাতীয় বর্ণনাকে অসাড় দাবি করে দনি বলেন – ‘তাঁর মা নিখুঁত এবং মার্জিতভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতেন। এমনকি জীবনের শেষ বছরগুলোতে যখন অসুস্থ-ভঙ্গুর শরীর, সামনে বসা যে-কোনো ব্যক্তির প্রতি বিনয় এবং সম্মান দেখানো ছিল তাঁর শিষ্টাচার। তিনি কখনো অগোছালো ছিলেন না, প্রসাধন ছাড়া বের হতেন না। প্রায় তিরিশ বছরের বেশি তিনি ড্রিংক করেননি। প্যানক্রিয়াসের সংক্রমণ, যা ছিল তাঁর মৃত্যুর কারণ।’ সাগঁর ছেলে ২০০৯ সালে মায়ের নামে একটি সাহিত্য পুরস্কার প্রতিষ্ঠা করেন, যা প্রতিবছর দেওয়া হয়। মায়ের প্রিয় হোটেল লুতেশিয়ায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

হাসপাতালে শারীরিক জরার কাছে বিনীত আয়ুসীমা ফুরিয়ে আসছিল। শব্দবিন্যাসের এক আশ্চর্য সৃষ্টির ভুবন ভ্রমণ শেষ; খ্যাতি, সম্মানের পালক বুকে নিয়ে বিদায় নেন ফ্রাঁসোয়াজ সাগঁ, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০০৪ সালে মাত্র ঊনসত্তর বছর বয়সে।

দশ বছর বয়সে লিখে ফেলেছিলেন একটি নাটক আর মাত্র উনিশ বছর বয়সে দেখেন গেস্নারি, গৌরব যা তাঁকে কখনো পরিত্যাগ করেনি। তিনি হয়ে উঠেছিলেন মিথ। সমগ্র সাহিত্যকর্মের জন্য পেয়েছিলেন প্রি দ্য মনাকো (Prix de Monacco)। যদিও জীবনভর তাঁকে এক অস্বস্তি পীড়িত করেছে; তাই বলতেন প্রায়ই – ‘আমি প্রম্নস্ত নই। কখনোই প্রম্নস্ত হতে পারব না।’

স্বচ্ছতা আর সাহস ছিল জীবনশৈলীর চর্চায়। তাঁর রচনাবলির চেয়েও তিনি ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ, তাঁর রচিত চরিত্রগুলোর চেয়েও খ্যাতিমান। টেনেসি উইলিয়ামস, সার্ত্র, ফ্রাঁসোয়া মিতেরাঁ, ওমর শরিফ, আভা গার্ডনার, অবসন ওয়েলস বিশেষণযুক্ত নামগুলো ছিলেন সাগঁর সহযাত্রী, সহমর্মীর চেয়েও বেশি কিছু।

সংস্কারমুক্ত, স্বতঃস্ফূর্ত, দ্বিধাহীন আর মুক্তচেতনার ধারায় স্বতোৎসারিত তাঁর লেখনী। সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গীকারের জন্যও স্মরণীয় হয়ে থাকবেন – The law are made to be adopted to people & not the other way round. আক্ষেপ ছিল। তাই বলেছেন – ‘আমি অনুতপ্ত যে আমার কখনো সব বই পড়ার সময় হবে না, যে বইগুলো আমি পড়তে চাই।’

কিছু সাগঁর অনুরাগী, অগণিত পাঠক সময় করে তাঁর রচনা পড়বেন। r

 

 

তথ্যঋণ :

প্যারি ম্যাচ, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০০৪।

লিবেরাশিও, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০০৪।

পুত্র দনি ওয়েস্ট থফের স্মৃতিকথা।

পুনশ্চ : রচনার শিরোনাম প্যারি ম্যাচ পত্রিকার নিবন্ধ থেকে নেওয়া।