সেই সহপাঠিনীকে আমি যেন এখনো দেখতে পাই। এমএ পরীক্ষার পরদিনই আচমকা মারা যায় আমাদের আরেক সহপাঠী – মেয়েটির প্রেমিক। কাশী মিত্র ঘাট তখনো জনবিরল, বন্ধুর দীর্ঘ শরীর পুড়ছে কাঠের চুলিস্নতে। আমরা বন্ধুরা বসে আছি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, বাতাসে ধোঁয়ার গন্ধ আর বিষাদ। গঙ্গার দিকে মুখ করে মেয়েটি দাঁড়িয়ে, প্রবল বাতাসে ফুলে উঠছে তার অফ হোয়াইট শাড়ি আর রুক্ষ চুল। কান্নায় পাক খেয়ে উঠছে সমস্ত শরীর, তারই মধ্যে ভূতগ্রসেত্মর মতো সে আবৃত্তি করে চলেছে কয়েকটা লাইন। বারবার :
নীরা, তুমি মন খারাপ করে আছো?
লক্ষ্মী মেয়ে, একবার চোখে চাও, আয়না দেখার মতো দেখাও
ও মুখের মঞ্জরি
নবীন জলের মতো কলহাস্যে একবার বলো দেখি ধাঁধার উত্তর।
– জানিস, কাল সন্ধ্যায় ও তখনো বেঁচে। আমাকে দেখেই ঝলমল করে উঠল। ইশারায় কাছে ডেকে বলল : ‘নীরা, তুমি মন খারাপ করে আছো?…’
আমাদের বন্ধুর গলায় হাহাকারের মতো জড়িয়ে যাচ্ছিল ওই শব্দগুলো : লক্ষ্মী মেয়ে, একবার চোখে চাও…।
শব্দের কী অমোঘ শক্তি! কী অমোঘ শক্তি তার থেকে জেগে ওঠা নীরার। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে যে-নীরা প্রেমের প্রতীক।
সত্যি বলতে, বাংলা ভাষার যে কী আশ্চর্য জাদু বিভূতিভূষণের পর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ই আমাদের তা ভালো করে টের পাইয়েছিলেন। আমাদের, মানে সে-সময়ের তরুণ প্রজন্মকে। তিনি যা লেখেন, তা-ই ভালো লাগে। নীললোহিতের কলমে, নিজের কলমে, সনাতন পাঠকের কলমে। সব সময় মনে হতো, আমরা কেউ পারি না কেন? মানুষের প্রেম, যৌবন, পাগলামি, প্রতিবাদ, যৌনতা – সবকিছু অবহেলায় ধরে রাখার এই যে অনায়াস দক্ষতা – কই আর কারো মধ্যে তো সেটা দেখি না! অথচ এমন তাঁর গদ্য, এমন তাঁর ছন্দ ভেঙে, মাত্রা বাড়িয়ে, নতুন পথ খুঁজে নেওয়া কবিতার চলন যে, কারো কারো মনে হতো এত সহজ – ও তো আমিও পারি! না, আমরা পারি না, আসলে কেউই পারেন না সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো লিখতে। এই সহজের সাধনার পথ যে কত দুর্গম, সে একমাত্র তাঁরাই বলতে পারবেন, যাঁরা পথের শেষের প্রবীণ সবুজ উপত্যকাটিতে পা রাখতে পেরেছেন। এক সাক্ষাৎকারে কমলকুমার মজুমদারের মন্তব্য তুলে, যা তিনিও বিশ্বাস করতেন, সুনীল বলছেন : ‘সাহিত্য হচ্ছে সরস্বতীর সঙ্গে সংলাপ। সুতরাং তার ভাষাটা আলাদা করতে হবে। এই পেঁচাপেঁচির ভাষাতে তা হয় না।’ আলাদা করতে হবে তো বুঝলাম। কিন্তু সে-কাজটা করে কে? সুনীল নিজেই লিখছেন : বাংলা ভাষা আমার মর্মে এমন গেঁথে গেছে যে, এই আবর্জনা ভরা, শত অসুবিধায় ভরা কলকাতা ছেড়ে কিছুতেই বেশিদিন দূরে থাকতে পারি না। কলকাতার অ্যামবিয়েন্স, তার স্বাদ, তার গন্ধ, তার শুঁড়িখানা, তার নিশিরাত – সবকিছু যেন চুম্বকের মতো টানত সুনীল আর তাঁর বন্ধু-বাহিনীকে। সেই আকর্ষণেরই পরিণাম, মধ্যরাতে শক্তির ফুটপাত বদল, পরিণাম, সুনীলের নিজের ঐতিহাসিক ‘আত্মপ্রকাশ’ পরিণাম, লিখতে লিখতে এমন অনাস্বাদিত উপত্যকায় পৌঁছে যাওয়া, যেখানে গেলে মানুষকে আর এই মলিন নশ্বর জগতের দিকে ফিরে তাকাতে হয় না।
কীভাবে তিনি তৈরি করে নিলেন নিজের কবিতার বা গদ্যের ভাষা? সুনীল তাঁর ব্যাখ্যা দিয়েছেন অতি চমৎকার। বলছেন : লিখতে লিখতে কোনো একটা জায়গায় এমন একটি শব্দ বা লাইন বা উপমা এসে যায় – সেটা কল্পনাতেও কোনোদিন ছিল না। সেই শব্দ বা উৎপ্রেক্ষার আকস্মিকতা তার দরজা ভেঙে ঢোকার মতো ভঙ্গি কবিকে আপস্নুত করে দেয়। সেই মুহূর্তে সেই কবি নিউটন বা আলেকজান্ডার ফ্লেমিংয়ের মতোন আবিষ্কারক এবং সুখী।
একবার তিনি অন্যমনস্কভাবে একটি গোলাপ ফুলের দিকে তাকিয়েছিলেন। গোলাপ নিয়ে রিল্কের ছোট কবিতাটার কথা মনে পড়ছিল। গোলাপ নিয়ে ভুবনজুড়ে এত লেখা হয়েছে – আর কী-ই বা লেখা যায়? হঠাৎ একটা লাইন মাথায় এসে গেল। ‘একটি গোলাপ ফুল গোলাপের মতো ফুটে আছে।’ সুনীল লিখছেন : ‘স্বীকার করতে বাধা নেই, লাইনটা লিখে আমি অসম্ভব খুশি।’ সুনীলের তখন মনে পড়েছিল কি না জানা নেই, জীবনানন্দের হাতে বেরিয়ে এসেছিল এমনই একটি লাইন : ‘আকাশ ছড়ায়ে আছে নীল হয়ে আকাশে-আকাশে।’ যে-লাইন দেখে জীবনানন্দকে ‘বড়ো কবি’ বলে চিনে নিতে দেরি হয়নি বুদ্ধদেব বসুর।
আসলে শব্দের এই স্থপতিরা কোনোকালেই জীবনকে উপভোগ করতে পারেন না। পৃথিবীকে সুন্দর করার কাজে তাঁরা স্বেচ্ছানিযুক্ত। এই ভার তাঁদের কেউ দেয়নি, তাঁরা নিজেরাই কাঁধে তুলে নিয়েছেন। সুনীল লিখছেন : দিবাবসানে সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়েও সে দেখে না সমুদ্রের রূপ। সে তখন মনে মনে আর একটি সমুদ্র গড়ে তোলায় ব্যস্ত। জীবন তাঁর কাছে রূপক জীবন, বাস্তব নয়।
কৃত্তিবাস পত্রিকা সম্পর্কে একটা কথা একবার রটে যায় যে, এই কাগজ হঠাৎ হঠাৎ বেরোয়। পথেঘাটে অনেক অচেনা মানুষ সুনীল অথবা তাঁর বন্ধুদের ডেকে জিজ্ঞাসা করতেন – কৃত্তিবাস কবে বেরোবে বলুন তো? পত্রিকার নাম দিয়েছিলেন ডি. কে – সিগনেট প্রেসের কিংবদন্তি পুরুষ দিলীপকুমার গুপ্ত। ঠিক করে দিয়েছিলেন, আদি কবির নামে পত্রিকার নাম, লিখবেন তরুণতম কবিরা। ১৯৫৩ সালের বর্ষাকালে প্রকাশিত হয় প্রথম সংখ্যা কৃত্তিবাস। সুনীলের বয়স তখন সবে উনিশ। কলেজের থার্ড ইয়ারের ছাত্র। সহযোগী দীপক মজুমদার আর আনন্দ বাগচী ওই অল্পবয়সে রীতিমতো নামডাকওয়ালা কবি। তিনজনের চেষ্টায় প্রথম সংখ্যা থেকে পত্রিকা ‘হিট’। ডি. কে-র সৌজন্যে প্রথম সংখ্যা থেকেই চেহারা তার এত সুন্দর যে, স্টল আলো করে দিলো। এ এমন এক অভিনব পত্রিকা, যার প্রচ্ছদেই লেখা থাকত তরুণতম কবিদের মুখপত্র। ফলে সে-সময়ে যাঁরা প্রতিষ্ঠিত কবি – জীবনানন্দ, অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ, বিষ্ণু দে – তাঁদের কারো কাছে কবিতা চাওয়ার প্রশ্ন নেই। বরং কোনো খ্যাতিমান কবি নিজে থেকে রচনা পাঠালে সবিনয়ে সেগুলো প্রত্যাখ্যান করা হতো।
বিপদ বাধল সাত-আট বছর পর। সুনীল, শক্তি, শঙ্খ, অলোকরঞ্জনরা তখন আর তত তরুণ নেই। পরের ধাপের তরুণ কবিদের লেখা প্রকাশ হচ্ছে। সকলে মিলে আলোচনা করে স্থির হলো, তাঁরা নিজেরাই যখন আর তরুণ নেই, সেক্ষেত্রে আগের কবিদেরই-বা বাদ দেওয়া হবে কোন যুক্তিতে। অতএব খুলে দেওয়া হোক দরজা। শুধু একটা ব্যাপারে স্থির থাকবে কৃত্তিবাস – সাহিত্য করতে গিয়ে কোনো রাজনৈতিক মতভেদ বা দলাদলিকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। ধীরে ধীরে একটা নিজস্ব লেখক-গোষ্ঠী গড়ে উঠলেও কৃত্তিবাস কিন্তু আগাগোড়াই দলাদলিশূন্য ভাবমূর্তিতে অটুট ছিল। যাঁরা লিখতেন তাঁদের কাছে কবিতা শুধু সৌন্দর্য সাধনা নয়, রূপকল্পের সন্ধান নয়, জীবনযাপনের সঙ্গেও আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। ছন্দের ঝোঁকও দেখা গেল মুখের ভাষার অনেক কাছাকাছি। ‘বিশুদ্ধ কবিতা’ বলে যে অলীক ভাবালু একটা জিনিস তখন চালু ছিল, তাকে অগ্রাহ্য করেছিলেন কৃত্তিবাসের কবিরা, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যাঁদের স্বাভাবিক নেতা। সুনীলদের কাছে কবিতা জিনিসটা আসলে ছিল প্রাণের চেয়েও একটু বেশি।
এ-কথা সত্যি, এমন প্রচুর গল্প-উপন্যাস লিখেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, যেগুলো না লিখলেই ভালো হতো। তাঁর বন্ধু-অনুগামী-শুভানুধ্যায়ীরা বলেন, কাউকে ‘না’ বলতে পারতেন না সুনীল। নিজের পরিকল্পনার লেখা ছাড়াও অসংখ্য পত্রপত্রিকায় একের পর এক লেখা দিতে হয়েছে সারাজীবন – গদ্যে এবং পদ্যে। অসামান্য গদ্য আর চুম্বকের মতো কাব্যভাষার অধিকারী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তা এমন আকাশস্পর্শী ছিল যে, তাঁর ওপর একরকম ঝাঁপিয়ে পড়ত বাংলার শহর ও জেলার পত্রপত্রিকা। একটি কবিতা-কণিকা বা একটি গদ্যচূর্ণ পেলেই তাঁরা খুশি। উপরোধে, সামান্য অর্থমূল্যে দ্রম্নত লিখে যাওয়া এসব গল্প বা ছোট উপন্যাস অনেক সময়ই উতরোয়নি। কিন্তু হলে কী হবে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নিজস্ব ‘সিগনেচার’ তার ছত্রে ছত্রে। বরং কবিতার ক্ষেত্রে সুনীল ছিলেন অনেক সংযত, সাবধানী। যা হোক, তা হোক করে বণ্টন করা কবিতা তাঁর বড় একটা নেই। এই সুনীলই একদিন লিখেছিলেন, ‘শুধু কবিতার জন্য আমি অমরত্ব তাচ্ছিল্য করেছি।’ সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় কথিত ‘কেটি’ – অর্থাৎ খালাসিটোলায় বসে কমলকুমার মজুমদার মাঝে মাঝে সুধোতেন, তা সুনীল, এবার তোমাদের দেশে ফলন কেমন? বুঝতে কারো বাকি থাকত না, ‘তোমাদের দেশে’ বলতে কোনো পত্রিকার পুজো সংখ্যার কথা তিনি বলছেন। কথার ভেতরে আরো একটু ঠেস গোঁজা থাকত হয়তো।
‘বহু-প্রসবা’ সুনীলের কলমকে এ-ও একরকম পরিহাসের কুর্নিশ।
দু-হাতে, মাঝে মাঝে হয়তো চার হাতে লিখে গেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। নিজের সৃষ্টির এই পাহাড়ের দিকে চেয়ে কখনো বোধহয় শিউরেও উঠতেন। একজন মাত্র লেখকের লেখা কোটি কোটি শব্দ! তবে কি তিনি রবীন্দ্রনাথের চেয়েও বেশি লিখেছেন? যদি লিখেও থাকেন -কী মূল্য আছে ছাপার অক্ষরে সেই বিপুল রচনা-সম্ভারের? কে পড়বে আগামী দিনে খ–র পর খ- গল্প-উপন্যাস আর গদ্যের সত্মূপ? সন্দীপন প্রায়ই একটা নৌকার কথা বলতেন। অমরত্বের যাত্রাপথে বাছা বাছা লেখকদের না-কি স্থান হবে সেই নৌকায়। পরে যদি ঠেলাঠেলি করে নতুন লেখকরা উঠে পড়েন, উঠবেনই, তবে টইটমু^র নৌকা থেকে চ্যাংদোলা করে দু-চারজনকে ফেলে দিতে হবে। বলা যায় না, নৌকার মাঝিও মাঝপথে গুপুস করে ডুবে যেতে পারেন। সুনীল যতই বলুন ‘কখনো আমি অমরত্বের সাধনা করিনি, অভিলাষীও নই, সে-যোগ্যতাও নেই’, কিন্তু জীবনের একটা পর্বে পৌঁছে দেখা গেল, তিনি দস্ত্তরমতো আটঘাট বেঁধে অমরত্বের সাধনাতেই নেমেছেন। অমর হবেন কিনা কোনো লেখকই সেসব বলতে পারেন না, কিন্তু সাধনা করতে দোষ কী। একে একে এলো পূর্ব-পশ্চিম, এলো প্রথম আলো, এলো দু-ভলিউম সেই সময়। বাঙালির সমাজ, বাঙালির অতীত, বাঙালির অন্তর্জীবন নিয়ে সুদীর্ঘ আলেখ্য। যেসব কাহিনিতে ধর্মীয় উন্মাদনার বিস্ফোরণ, সমসাময়িক ইতিহাস, ঊনবিংশ শতাব্দীর জীবিত মানুষের গদ্য-গাথা, সেই শতাব্দীরই শেষ পর্বে ত্রিপুরার রাজপরিবারের অন্যরকম রাজকাহিনি।
কিন্তু ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাস লিখতে গেলে কতটা মেশানো যায় কল্পনা? সমস্ত দায়িত্ববান লেখকের কাছেই এ বড় যন্ত্রণাদায়ক জিজ্ঞাসা। পাঠক পড়তে পড়তে ভাবতে পারেন এসব তথ্য বা অমুক চরিত্রটা উনি পেলেন কোথায়? শ্রীরামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ অথবা তরুণ রবীন্দ্রনাথ যেভাবে হাঁটাচলা করে বেড়াচ্ছেন উপন্যাসের খোলা বারান্দায়, সেগুলো কি ঠিক? নবীনকুমার কে? তাঁর প্রতিটি কর্মকা- বলে দিচ্ছে তিনি কালীপ্রসন্ন সিংহ ছাড়া কেউ নন, কিন্তু উপন্যাসে তাঁর নামটাই বদলে গেল! বদলে গেল তাঁর মৃত্যুর বিবরণ, নবীনকুমারের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের সম্পর্ক, তাঁদের কথাবার্তা, প্রণতি ও ভৎর্সনা। কিছু তথ্য লিখিত ইতিহাসে আছে। আবার অনেক কিছুই নেই।
প্রশ্নটা একেবারে মৌলিক। আমাদের এত কাছের সময়ের এসব ঐতিহাসিক চরিত্র পুনর্নির্মাণে কতটা স্বাধীনতা নিতে পারেন ঔপন্যাসিক? কতদূর পর্যন্ত এগোলে, কল্পনার বিচরণভূমিকে ঠিক কতখানি ছড়িয়ে দিলে সংঘর্ষ ঘটবে না ইতিহাস আর সাহিত্যে?
সুনীল এক ভূমিকায় লিখছেন : ‘তথ্য সংগ্রহ করতে করতে নেশা লেগে যায়। তথ্যের সন্ধানে আমি লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে পর্যন্ত হানা দিয়েছি কার্জন পেপারস দেখার জন্য।’ শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনে ইন্দিরা দেবীর হাতে লেখা খাতা দেখতে গিয়ে তাঁর চোখে পড়ল, বহু লাইন বারবার ঘষে ঘষে কাটা। এমনকি কোনো কোনো পৃষ্ঠার কিছু অংশ কাঁচি দিয়েও কাটা। এই খাতার ভিত্তিতেই পরবর্তীকালে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রাবলী – ‘যার সর্বাঙ্গ দিয়া রক্ত ঝরিতেছে।’ তথ্য আর ইতিহাসের অন্ধগলির মুখে পৌঁছে লেখক তবে কী করবেন? কতদূর ছড়াতে দেবেন কল্পনাকে, কে সেটা বলে দেবে?
সুনীল লিখেছেন : ‘যতদূর সম্ভব তথ্য আহরণ করে এঁদের জীবন্ত করার জন্য কল্পনাশ্রয়ী সংলাপ বহুল পরিমাণে ব্যবহার করতে আমি বাধ্য হয়েছি।… আমি মনে করি, লেখকের স্বাধীনতার সীমানা টানা উচিত নয়। কারণ, পাঠকের স্বাধীনতা প্রকৃতপক্ষে সীমাহীন।’
ধরা যাক, সেই সময়ের নবীনকুমার। আসলে ঐতিহাসিক চরিত্র কালীপ্রসন্ন সিংহের কয়েকটি কীর্তিকাহিনি ছাড়া ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানা যায় না – সুনীল বলছেন। এতদিন পর জানার উপায়ও নেই। তাই তাঁর ব্যাখ্যা : দুই চরিত্রের মধ্যে সাযুজ্য না খুঁজে নবীনকুমারকে সেই সময়ের প্রতীক হিসাবে গণ্য করাই সংগত হবে। উপন্যাসের প্রকৃত নায়ক যদি হয় সময়, নবীনকুমার তারই সঙ্গে জড়িয়ে-জাপটে থাকা এক রক্তমাংসের মানুষ।
এক সাক্ষাৎকারে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, মার্কসবাদীদের অভিযোগ, সেই সময় তরুণদের নষ্ট করবে। মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে কথাটা উড়িয়ে দেন সুনীল। তাঁর কথায় : ‘ওঁদের অ্যাটিচিউডটাই ফানি। এঁরা যখনই কোনো উপন্যাসে দৈহিক ভালোবাসার কথা দেখেন, তখনই ‘গেল গেল’ রব তোলেন। ওঁদের ঔদ্ধত্য আর বোকামি দেখে আমি বিস্মিত।’
বস্ত্ততই, সময়ভিত্তিক এই উপন্যাসগুলো নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে বারবার উত্ত্যক্ত করার চেষ্টা করেছে বাংলার মার্কসবাদী লবি। চেষ্টা করেছেন তাঁকে অপছন্দ করতেন এমন আরো কেউ কেউ। বিদ্যাসাগর, মাইকেল, দেবেন্দ্রনাথ, রামকৃষ্ণের মতো বিখ্যাত চরিত্রদের দুর্নাম দেওয়ার জন্যই নাকি উপন্যাসের সৃষ্টি – এমন কথাও বলা হয়েছে। সুনীল অবহেলায় পাশ কাটিয়ে গেছেন সব অভিযোগ। স্থিত থেকেছেন নিজের অভিজ্ঞতা আর কল্পনালব্ধ ভুবনে। কারণ ততদিনে তিনি জেনে গেছেন, অমরত্বের চাবি কার হাতে কখন এসে যায় বলা শক্ত। কিন্তু সাধারণ পাঠকের স্বতঃস্ফূর্ত আগ্রহ তাঁর সৃষ্টিকে এমন উচ্চতায় নিয়ে গেছে, যেখানে পৌঁছলে সংকীর্ণ অভিযোগের কাঁটা আর গায়ে ফোটে না। দুহাত বাড়িয়ে নিজেদের প্রিয় সাহিত্যিককে গ্রহণ করেছে আপামর শিক্ষেত বাঙালি। এরপর অমরত্ব এলো বা না-এলো, বয়েই গেল!
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.