সিঁড়ি দিয়ে দ্রুতবেগে নামছে ও, এগারো ধাপের একটা সিঁড়িতে দুবার পা। দশতলা থেকে নামতে বড়জোর এক মিনিট। হাতের মুঠোয় শুধু দুটো ফোন নম্বর, বাঁশপাতা কাগজে লেখা। পালাতে হবে তাকে, এক্ষুনি! পেছনে ধাবমান-গিন্নি দুই সিঁড়ি দ্রুততার সঙ্গেই নেমেছিল, এককালে সেও কম খেলোয়াড় ছিল না যে! কিন্তু সাম্প্রতিক হার্টের ব্যামো, কোমরের হাড় ক্ষয় তাকে থামাল। মাথাটা কাজ করল দ্রুতই, তাই রক্ষা। ফিরে ইন্টারকমে ফোন দিয়ে তাকে আটকাতে বলল।

বেরিয়ে যাওয়ার শেষ মুহূর্তে ইয়াং গার্ড হাত ধরল ঝড়ের বেগে। এই তো সুযোগ, যেমন খুশি ধরা যায়, টিপে, চেপে কিংবা কামপরশে। অনুভব করার আগেই সে কামড়ে দিলো, খামচে দিলো; কিন্তু ছুটতে পারল না।

লিফটে চড়ে দশতলায় উঠে সে সাবলীল, যেন কিছুই হয়নি। কে পালাচ্ছিল, কোথায় পালাচ্ছিল কিচ্ছুটি জানে না। ধাবমান-গিন্নি একটা চড় দিতে গিয়ে হাত নামিয়ে নিল, বেচারার অভ্যাস কম মারধরের আর মেরেই কী হবে। বস্ত্তত এই পরিস্থিতিতে সক্কলেই বেচারা। কেউ ধরা খেয়ে, কেউ ধরতে পেরে!  যদি ধরতে না পারত তো কী হতো! মামলা, বস্ন্যাকমেইল! কত কত উদাহরণ একটা একটা করে বাড়ির কর্তা লাত্থি দেওয়ার মতো করে সামনে ফেলছে গিন্নির। গিন্নি তো এখনো হাঁপাচ্ছে ঘটনার আকস্মিকতায়, উদাহরণের আক্রমণ হৃদয়ঙ্গম করতে পারছে না মোটেই। এবার শীতকালটা মধ্য জানুয়ারিতেই থমকে গেছে, মরুকগে! তো গিন্নি ঘামছে। আর সে, পলায়নপর সাহারা বাথরুমে ঢুকলে তিনজন গিয়ে হামলে পড়ে। খবরদার দরজা আটকাবে না, আবার কা- বাঁধাবে। যুবতী সাহারা বলে, পায়খানা করব। গিন্নি বলে, দরজা খুলে কর, গন্ধ আসুক!

আগমন মাত্র দুই মাস। এরই মধ্যে ছেলের জন্য কত কী গুছিয়েছে। রঙিন চশমা, ক্যাটবেরি, পিস্তল। আশ্চর্য এই যে, পালাবার সময় এগুলো নেয়নি, এমনকি ফেলে যাচ্ছিল নিজের কাপড়চোপড়ও! সাতদিন আগে গাজীপুর রিসোর্টে বেড়াতে নিয়ে গেছে সাহারাকে, পারিবারিক শ্রান্তিবিনোদনে। প্রতিবেলা বারোশো টাকার বুফেতে খেতে খেতে যত না, তারচেয়ে বেশি দেখে দেখে! ও পাগলপ্রায়, গিন্নি আরো ঠেসে ঠেসে দেয়, থালা দিয়ে আবার পাঠায়, এবার তোমার যা পছন্দ থালা ভরে নিয়ে আসো। আহ্, খেয়ে শেষ করতে পারে না, গিন্নি আত্মতৃপ্তি নিয়ে বলে, যা হোক সাহারাই শুধু খেয়ে উসুল করেছে কিছুটা!

এতো ভালোবাসা আর আজই পালাচ্ছে! কী, সমস্যা কী!

– কোনো সমস্যা নাই খালাম্মা। আপনে তো ভালোই বাসেন! মাথা কেমন করল!

কর্তার মেজাজ কিছুতেই নামে না, বলে, তুই তো হারায় গিয়া আমাদের সবাইরে জেলে নিয়া ঢুকাতি!  তোর কাছে তো টাকাও নাই রংপুর কেমনে যেতি, রাস্তা থেকেই তো ধরে নিয়ে যেত কেউ! নিয়ে কিডনি বেঁচে দিত! কিংবা তোকেই বেচে দিত!

–  ফোন দিতাম!

– আসতে তো একদিন লাগে ভূরুঙ্গামারি, পাটেশ্বরী থেকে! কই থাকতি রাতে!

– জানি না!

– জানি না বললে তো হবে না, নাকি কারো বাসা চিনিস! সেখানে যেতিস!

হঠাৎ গিন্নির পা চেপে ধরে, খালাম্মা আমার মাথা খারাপ হইয়া গেছে। আমার ছেলে, ছেলের জন্য আসছি কিন্তু ছেলেরে ছাড়া আর থাকতে পারি না! ও খালাম্মা গো, দুই মাস দেখি না ময়নারে, আমারে পাঠায় দেন! ময়না রে, বাপ আমার! কেমন আছো সোনার ময়না!

– তুমি তো রোজ কথা বলো ফোনে!

– কাইল বলি নাই খালাম্মা! ঘুম থেকে উইঠা আমার মাথা খারাপ হইয়া গেছে!

ফোনে কথা বলার সময় সাহারা বলে, মা ময়নারে বিস্কুট কিন্যা দিও, দুধ কিন্যা দিও, ময়না একটু বড় হইছে মা?

ওদিক থেকে বলে – কোনো সমস্যা নাই, ময়না ভালা আছে, তুই চিন্তা করিছ না। বিস্কুট কিন্যা দিছে তোর বাবায়।

বেতন পাঠিয়ে গত মাসে ফোন দেয়, মা সাত হাজার ট্যাকা দিয়া দুই-তিন শতক জমি কটে নাও, সামনের মাসের সাত হাজার দিয়া আরো জমি নিবা, ভাতের ব্যবস্থা আগে মা!

যেদিন এলো, চোখের কোণে খুশির ঝিলিক, রাতে ঘুমাতে যাবার সময় বলে, খালা নাপা হবে? গিন্নি ভয় পেয়ে বলে, ক্যান কি হইছে? জ্বর আসছে নাকি!

বুক ফুলে উঠেছে, জামা ভিজা, দুধ চোঁয়াচ্ছে।

– কাইল বিকাল থেইকা খায় না ময়নায়!

গিন্নি বোকার মতো তাকিয়ে থাকে। দেড় বছরের বাচ্চার মাকে রাখা ঠিক হলো কি! দালাল সাত হাজার নিয়ে সকালেই চলে গেছে, আল্লাহ ভরসা!

সকালে উঠেও জ্বর, বুক শক্ত হয়ে আছে, ব্যথায় টনটন।

এসব কথা কারো সঙ্গে আলাপ করা যায় না, সংসার খুব বিশ্রী জায়গা। খাদে পড়লে কেন, সেই কৈফিয়ত দিতে দিতেই  জেরবার, টেনে তোলা স্বপ্ন! প্রথমেই বুদ্ধির ঢেঁকি বলে নির্বুদ্ধিতার একশ একটা উদাহরণ থাবড়া দিয়ে সামনে ফেলবে। তারপর নিরাবলম্ব বিকট হতাশার হা, বাক্যবাণ উপর্যুপরি! তো চুপ থাকো।

– যাও গোসলখানায় গিয়ে টিপে ফেলে দাও।

খেতে বসলে খেতে পারে না, জ্বর নাকি পুত্রবেদনা! নাকি আরো কিছু!

দুদিন পর বলে, খালা, ধৈর্য না ধরলে কি ফল পাওয়া চলে! চিন্তা কইরেন না, সব ঠিক হয়ে যাবে।

ও টের পেয়েছে লতাকে, মানে ওর দালালকে ফোন দেওয়ার চিন্তাভাবনা চলছে, একে নিয়ে ভালো একটা মেয়ে দাও, ওকে দিয়ে হবে না। এত্তগুলা টাকা নিয়া কী দিয়া গেলা!

 

 

দুই

দশ-বারো দিনের মধ্যে মোটামুটি নিজেকে গুছিয়ে ফেলে ও। খুশি হয় একটু গল্প করতে পেলে, টেলিভিশনের সামান্য নেশা। এমন জোরালো নয়, হলে হলো না হলে নাই। কিন্তু একদিন পর একদিন ফোন। ছোটভাই, মা আরো দুটো বোন, লাইন করে এক ঘণ্টা কথা তারপর ছেলে। – ময়না, ভাত খাইছ? বিস্কুট খাইছ? তুমি কাইন্দ  না বাবা, আমি অনেক বিস্কুট নিয়া আসব, চশমা আনব।

একই কথা পনেরোবার বলে, ওপাশ থেকে কোনো শব্দ নাই। ঘণ্টা শেষ করতে যাচ্ছে, গিন্নি তাড়া দেয়, শেষ কর। তখন বলে, মা, খালাম্মার মোবাইলে বেশি ট্যাকা নাই, পরশু আবার ফোন দিমুনে, ময়নারে দেইখো। ময়না যেন ঠান্ডা না লাগায়! শয়তানডায় ফোন দিলে ধরবা না, ময়নারে কিন্তু চুরি করতে চাইব, চোখে চোখে রাইখো মা।

সাহারা রংপুরের ভাষা বলে না, গিন্নি ভাবেন রক্ষা, বস্ত্তত সাহারা বিয়ের আগে পাঁচ বছর মোহাম্মদপুরে কাজ করে গেছে। ঢাকাবাসীর মতো তারও মিশ্র এক ভাষা।

পরের মাসে সাত হাজার টাকা বিকাশ করেই ফোন, মা এই ট্যাকা দিয়া দুই-তিন শতাংশ জমি কটে নিবা, আগে ভাতের ব্যবস্থা মা! ময়না কেমন আছে? আমার কতা কয়! ময়নারে দাও … বাবা ভাত খাইছ? বাবা হরলিকস খাইছ …

 

 

তিন

রান্নাঘরে বিছানা করে ঘুমায় সাহারা। ঘরে পানি সিদ্ধ করার উষ্ণতা। কাঁথার নিচে গিয়ে কী যে আরাম, কে বলে শীতকাল মরণকাল! শীতকাল এলেই দাদি সুদূরের পানে চোখ মেলে বলত, এই শীতে বাঁচন নাই লো! কিন্তু বুড়ি বেঁচে যায় বছরের পর বছর। শীত, অনাদর কি খাদ্যহীনতা তার আশি বছর বাঁচায় কোনো প্রতিবন্ধকতা হয় না। তারপর মরল শীতেই, কঠিন কুয়াশা, সারাদিন সূর্য নাই। উনুনের আগুনের ওপর শাড়ি উঁচিয়ে পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে থাকে অশস্নীল। ভাঙাচুরা একটা দেহে শুধু একপ্রস্থ ময়লাঘোলা নীলশাড়ি। দিনে তিনবার তো বটেই। তারপর যা হওয়ার হলো, পুড়ে গেল! সদর হাসপাতালে কে নেবে তাকে! মলম মাখিয়ে ফেলে রাখল মাটিতে, মানে বিচালির ওপর কাঁথার বিছানায়। পাঁচদিন পর চেতন এলো, সবাই ভাবল বেঁচে গেল বুঝি! দশদিন পর কবিরাজের দেওয়া এক বোতল মালিশের অর্ধেক ব্যবহার না করেই বুড়ি মরল।

সেই কালেই কাজের জায়গা থেকে ডান হাতের তিনটা আঙুল হারিয়ে বাপ ভর্তি হলো হাসপাতালে। রক্তক্ষরণ জীবন কেড়ে নিতে নিতে মাফ করে দিয়েছে বটে; কিন্তু সংসার অচল হয়ে পড়ল। তিন তিনটা কন্যার পর ঘর আলো করে যে-ছেলেটা এসেছিল, সে এখন সারাদিন খেতে চায়। ভালোমন্দ খেতে চায়। মাদ্রাসায় যায়। তাকে জুতা কিনে দাও, জামা কিনে দাও। শীতকালে জাম্পার কিনে দাও।

শুভাকাঙক্ষীর বেশে একজন এলো। ঠিক, একজন কমলে মন্দ কী! কিছু সাতপাঁচ ভাবার সময় নেই তো। পরের দিনই বিয়ে হয়ে গেল একখানা লাল শাড়িতে।

সাহারা এসে জুটল লাল মিয়ার ঘরে। তিন তিনটা বউ তাকে ছেড়ে গেছে। বড়টার শুধু এক ছেলে ইব্রাহিম, সেও মায়ের কাছেই থাকে। ইব্রাহিম আসে মাঝে মাঝে, পথের ধারে বাড়ি বলে, তাও বাপ না থাকলে। বয়স সাহারার সমান। বলে, মা তোর বাপ-মা এই হারামির লগে বিয়া দিলো!

– বিয়াটিয়ায় কারো হাত আছে বাপ!

– তোর বাপও হারামি নাকি!

– না রে বাপ, আমার কপাল খারাপ!

ইব্রাহিমের মা-ই কেবল ঘর করেছে ছয় বছর, বাকিরা দু-চার মাস করে। সন্তান হওয়ার আগেই ভেগেছে।

লাল কাজে যায় রান্নাঘরে তালা দিয়ে। আর কঠিন নির্দেশ, কারো ঘরে গেলে পিটিয়ে হাড়মাস এক করবে।

শুধু এক ঝলক জঙ্গল ঘরের সামনে তারপরই বড় রাস্তা, পেছন ফিরলে ভাসুর-দেবরদের ঘর, যাওয়া নিষেধ।

বাপ যৌতুক দিয়েছিল একটা গাভী। তার জন্য ঘাস কাটতে যেতে পারবে বড় রাস্তা পেরিয়ে। বড় রাস্তার নামায় পানির বগলে হয়ে থাকা কচকচে নধর ঘাস, সঙ্গে হেলেঞ্চার বন্যতা।

রান্নাঘরের অর্ধেকটায় গরু, অর্ধেকটায় চুলাচাক্কি। দরজা অবশ্য দুটো, বুদ্ধি আছে বলতে হয়। একটা দিয়ে রান্নাঘর, একটা দিয়ে গরুর ঘর! স্বামী কাজে গেলে সারাদিন ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়ে থাকে ঘরে। সকাল সকাল গরুর ঘাস কেটে আনে, দুপুরের পর শক্তি থাকে না বলে। অভ্যাসবশত শাক তোলে কিন্তু বাড়ি আনে না, এনে কী করবে! ঘরে চাল আছে কিন্তু চুলা নাই যে! সন্ধ্যায় ফেরে টাটকা মানুষ লাল মিয়া, বোঝাই যায় খেয়েদেয়ে এসেছে। সঙ্গে না বাজার, না কিছু। ঘরে ঢুকে বলে, গরুডারে কেমন দুর্বল দুর্বল দেহি। ওই মাগি, সারাদিন ঘুম গেছিস না!

– পাকঘর খোলেন, ভাত রাঁধি! মইরা যাইতেছি ক্ষুদায়!

– এত খাই খাই ক্যা! পানি খায়া ঘুমা, সকালে রান্ধিস!

বোকা ভীতু সাহারা, আগের দুজন যা পারল সে তা পারল না। মানে ভেগে যেতে পারল না।

ইব্রাহিম কাজ পেয়েছে সদ্য, তাই এখন কম আসে। আগে ঘনঘন আসত, এসেই বলত, চইলা যা মা। বাপ তো খাটাস, ভুল করিস না! এখন বলে, যাহ, সর্বনাশ কইরা ফিললি মা! এইবার মর!

এক হালি কলা নিয়ে ফিরছিল, রাগে ছুড়ে ফেলে দিয়ে হাঁটা  দেয় গোঁয়ারের মতো।

সর্বনাশই তো, পোয়াতি যে সে! ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়ে থাকে ঘরে। ঘাস কাটতে যেতে কষ্ট হয়। কখনো কখনো নালার পাশে বসে ঘাসের কচি ডগা চিবিয়ে খেয়ে খেয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটায়। তারপর নামা থেকে ঘাসের আঁটি নিয়ে উঠতে গিয়ে গায়ে বল পায়  যেন!

রাতে রান্না করতে দেয় চাল। দুজনে খেয়ে যে-কয়টা ভাত থাকে তা যত্নে শিকায় তুলে রাখে আর সারারাত স্বপন দেখে পরদিন সে ভাতকয়টা খেয়ে ঘাস কাটতে যাবে।

কিন্তু পরদিন পেঁয়াজ-মরিচ ঢলে ঢলে পান্তা খায় লাল মিয়া। সাহারার পক্ষে এ-দৃশ্য সহ্য করা কঠিন। রান্নাঘরে চুলার সামনে বসে থাকে। আকাশে  চৈত্রের মেঘ, বৃষ্টি এলে ভালো হবে। ব্যাটা থাকবে, ভাত রাঁধতে বলবে, দয়া হলে নিজেই যাবে ঘাস কাটতে।

মেঘটা যাবতীয় আয়োজন করে ঠান্ডা বাতাস বইয়ে কেটে পড়ে। দিগন্তে সোনালি আলো ঝিলমিলায়, হা খোদা একটু বৃষ্টি চাইলাম!

কাজে যাওয়ার সময় হঠাৎ একটা কা- করে বসে সাহারা। বলে, এক মুঠ চাইল দিয়া পাকঘরডা খুইলা দিয়া জান, পেটেরটা না খাইতে পাইয়া বিকালে কাবু হইয়া যায়, লড়াচড়া বন্দ কইরা দেয়, দিয়া যান, আপনের পায়ে পড়ি …। বলেই সে পায়ে পড়ে যায়। এক লাথিতে রান্নাঘরের ঘরের পাটখড়ির বেড়ায় গিয়ে পড়ে, পচা বেড়া ভেঙে শরীরের অর্ধেকটা ভেতরে সেঁধিয়ে যায়।

রান্নাঘর তালা দেওয়া হলে কি হবে, বেড়া তো ভাঙা! লাল মিয়া চলে গেলে সে উঠে দাঁড়ায়, না তেমন ব্যথা লাগে নাই। গরুর জন্য ঘাস কেটে আনার সময় নিজের জন্য আনে কয় গোছা লকলকে হেলেঞ্চা শাক।

ভাত রাঁধে, বেশি করে কাঁচা ঝাল দিয়ে রাঁধে শাক। বাইরে ঝাঁ-ঝাঁ রোদ চৈত্রের। ঘরের কাছে আমগাছের নিচে কুড়িয়ে পাওয়া আমের কুশি কয়টা নুনমরিচ দিয়ে মাখায়। গোসলশেষে পিড়া পেতে খেতে বসে। আমের কুশি কয়টা মুখে পুড়ে চিবায় মনের আনন্দে, সে ভাত খাবে যে! পাতে ভাত বাড়তে সুগন্ধে আমোদিত সারাঘর। শাক সবটুকু নিয়ে ফেলে পাতে, কোনো চিহ্ন রাখা যাবে না। প্রথম গাল মুখে পুরে নিজে নিজেই বলে, অমরিত। কষ্ট করে উঠে গিয়ে এক ছিটে লবণ আনে, ভাতে ছিটায়, এবার আরো অমৃত! ভাতের গাল মুখে পুড়ে চোখ বুজে থাকে, আহা কত হাজার বছর পর সে ভাত খাচ্ছে!

অর্ধেক খাওয়া হতেই শরীর কেমন করে ওঠে। পেটের ভেতর একটা বলক দেওয়া ব্যথা। ওপর থেকে নিচে। না, সময় তো হয় নাই! তবু ভাত ফেলে সটান দাঁড়িয়ে যায়। লাল বলেছে, বাচ্চা হওয়ার সময় কাউরে ডাকবি না, একা বিয়াবি। হই-হল্লা করে মানুষ ডাকলে খবর আছে তোর! তো কিছুই তো জোগাড় নাই। সবাইকে পিঠ দিয়ে লাল বাড়ি করেছে, চিৎকার করলেও কেউ টের পাবে না। আর লালের সঙ্গে সব ভাইয়ের সম্পর্ক ভয়ংকর খারাপ হওয়ায় যাতায়াত বন্ধ। দু-একটা বউ যদিও সাহারার সঙ্গে কখনো কথা বলে, সে কালেভদ্রে পথেঘাটে। নখ-কাটার বেস্নডটা রাখে হাতের কাছে, ধোয়া পুরনো ফাটা দুইটা কামিজ আর এক গামলা পানি।

সব রইল হাতের কাছে। ভাতের বাসন আবার টেনে নিল কাছে। ব্যথা চলছে, খাওয়াও চলছে। খাও সাহারা, না খাইলে বিয়াবা কেমনে, শক্তি পাবা কই! সাহারা গোগ্রাসে ভাত খায়, খেতে কেমন লাগছে ও বলতে পারবে না, তবে মজা আর লাগছে না। কপালের  ঘাম নামছে গাল বেয়ে গলায়। তরল গড়াচ্ছে পাজামা ভেদ করে দুই থোড়ার নিচে, পানি না রক্ত ও দেখছে না। ভাত খেয়েই চলেছে। ভাতের হাঁড়ি পরিষ্কার, শাকের চিহ্ন উধাও। লাল কিচ্ছু টের পাবে না! হাত ধোয় চৌকির নিচে। পানি খায়।

ব্যথা বাড়ছে। বাইরে ঠা-ঠা রোদ। আঃ আঃ আঃ চলছে, ক্রমশ শব্দ বাড়ছে। না, কেউ শুনতে পায় না। চলল ঘণ্টা ধরে। চৌকির পায়া ধরে যখন সর্বশক্তি নিয়োগ করল তখন বেরিয়ে এলো সে। নাড়ি কাটল, নিজেকে মুক্ত করল ফুল থেকে। বাচ্চার কান্না শুনে এবার ছুটে এলো দু-এক নারী।

– ওরে আবাগীর বিটি ডাকলি না লো!

– ডাকাইত দেহি …

যা হোক, লালকে বলে, বেটাছৌল চাইছিলেন, তাই দিলাম। মিইয়ে হলে নিবেন না কইছিলেন কিন্তু।

এ-সবে লালের কী এসে-যায়! ছেলে তো তার একখান আছে, নিমক হারাম, হারামির হারামি!

তিনদিনের দিন গরুর ঘাস কাটতে পাঠায়। গরুটা কি না খায়ে মরবে! সাহারা অসম্মতি জানায়, সাতদিনই হইল না!

গালাগাল করে লাল কাজে যায়। রাগে-দুঃখে বাচ্চাকে একা ঘরে রেখে যায় ঘাস কাটতে। হুড়োহুড়ি করে কেটে দ্রুত উঠে আসে বড় রাস্তায়, তিনদিনের ছেলে একা ঘরে! তারপর আর হাঁটতে পারে না। পথ থেকে কে যেন ধরে ধরে বাড়ি আনে। রক্তে ভেসে যায় মাটির মেঝে। এই সময় এসে হাজির হয় সাহারার মা-বোন-ভাই, মোট চারজন। অনেকটা পথ, বাসে, নসিমনে আর হেঁটে এসেছে। এসে দেখে ফুটফুটে চাঁদের মতো এক ছেলে বিছানা আলো করে ঘুমাচ্ছে। আর সাহারা মারা যাচ্ছে রক্তে ভেসে। কোনো মানুষ নাই পাশে। সাহারা একবার শুধু মাথা তুলে বলে, মা আমারে বাঁচাও।

মেয়েমানুষ তো মরে না! সাহারাও বেঁচে গেল, তিনদিন হাসপাতালে পাঁচ ব্যাগ রক্ত নিয়ে। মাসখানেক পর লাল আসে নিতে, তার খুব রান্নাবান্নার কষ্ট। সাহারার কি স্বামীর ঘরে ফেরার ইচ্ছা নাই!

না, ইচ্ছা তার একদমই নাই! এখানে ঘুম থেকে উঠলেই মা কালিজিরা আর গরম ভাত দেয়, কোনো দিন থানকুনির ঝোল। নিজেদের মুখের গ্রাস মেয়ের মুখে তুলে দিয়ে খুশি তারা। মুখে না বললেও জানে একটা খারাপ বিয়ের খেসারত দিচ্ছে, আরো দিতে হবে।

গরু বিক্রি করে দিয়েছিল লাল, পালার কষ্টে। তাতে কী, সাহারাকে এমনি এমনি ভাত খাওয়াবে নাকি! লাল আবার কিস্তি তোলে, গরু কেনে বড় একটা। কুচকুচা কালো গরুটা দেখলে ভয় লাগে সাহারার। যা রোজগার করে তা দিয়ে কিস্তি টানে। চাল, নুন ছাড়া আর কিছুই কেনে না। আবার গরুর ঘাস কাটতে যায় ছেলেকে চৌকির পায়ার সঙ্গে ওড়না দিয়ে বেঁধে। ক্ষুধা আর ক্লান্তি নিত্যসঙ্গী।

ছেলের জন্য সে যত সংসার আঁকড়ে ধরতে চায় লাল ততো মেরে আলগা করে দেয়। তারপর একদিন গরুর ঘাস না কাটার দায়ে মেরে কান ছিঁড়ে রুপার দুল নিয়ে নেয়। বাপের বাড়ির ওই একজোড়া জিনিসই বিয়ের। রক্তে গা ভিজে যায়। লাল বলে, খাইতে বলে পাস না! এত রক্ত কই থেকে আসে। লাল কাজে বেরুলে ছেলে কোলে বেরিয়ে আসে বড় রাস্তায়, অনেক হয়েছে!

 

 

চার

সকালে পালাতে চেয়েছে, এখন দুপুর। বাড়িতে ফোন করা হচ্ছে, কেউ ধরে না। বাঁশপাতা কাগজ হাতে নিয়ে বসে আছে গিন্নির পায়ের কাছে। যেন এই কাগজের নম্বরগুলাই সাচ্চা, খালারগুলো ভুয়া! যতবার ফোন করে গিন্নি, ততবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে সে।

একটা মোবাইল বন্ধ আরেকটা ধরে না।

বিকেল নাগাদ ফোনে পাওয়া গেল কিন্তু দু-একদিনের মধ্যে বাপ আসতে পারবে না, তার সকাল থেকে ডায়রিয়া।

সন্ধ্যা নাগাদ ভূতে পাকড়াও করল সাহারাকে। আবোলতাবোল বকছে, দুপুরে ভাতও খায়নি। যত বলা হতে থাকল কাল আমরাই তোমাকে নিয়ে যাব। সে তত, ওরে ময়না রে, বাপধন, আমারে যে নিয়া যায় গাব গাছে রে – বলে চিৎকার। ঘুমের ওষুধ দেওয়া হলে খানিক ঘুমিয়ে উঠেই শুরু করে, ওরে বাপ আমার, ময়না আমার, তোর বাপ আইলে যাইস না বাপ, ওই যে গরু, গরুরে রে এ এ এ …

সারারাত ওকে নিয়ে বসে থাকে। একটু ঘুমায়, জেগে আবার বিলাপ। মানইজ্জতের ব্যাপার; ফ্ল্যাটবাসা, কে কী ভেবে বসে!

ভোরবেলা তাকে নিয়ে রংপুরের গাড়ি ধরলেন বাড়ির কর্তা। তার আগেই সাহারা ছাড়া বাসার সবার জানা হয়ে গেছে ময়নাকে গতকাল ভোরে ওর বাপ নিয়ে গেছে জোর করে। ছেলেকে সে দেবে না, চেয়ারম্যান তার পক্ষে। বলে গেছে ট্যাকায় বাপ ডাকে!

সাহারার বাপ এখন নাতির জন্য লোকের দ্বারে দ্বারে, ডায়রিয়া-কলেরা কিছুই হয়নি।

শুধু বিস্ময়, সাহারা কীভাবে টের পেল তার ছেলের অপহরণ!