অমিয়ভূষণের প্রেম ও যৌনচেতনা

মোসাদ্দেক আহমেদ

অমিয়ভূষণ মজুমদার সূচনা থেকেই পাত্রপাত্রীর প্রেম ও যৌনচেতনায় সুস্পষ্ট সীমারেখা টেনেছেন। তাঁর বিবেচনায় ভাত ও মদ যেমন পৃথক, তেমনি প্রেম ও কেচ্ছাও ভিন্ন। প্রেম যদি আলো হয়, তবে কাম-অঙ্গার-পোড়া চারকোলের ছাই। প্রেমে চরিত্ররা যত জীবন্ত হতে পারে, বাস্তবের বিশ্বাস উৎপাদন করতে পারে, কেচ্ছায় তা বিপ্রতীপ, উপরন্তু তা বেয়াড়া অশ্লীল বলে অভিযোগও উঠতে পারে; বাড়তি কামাচারে পাত্রপাত্রীদের বিদেহ হওয়ার ঝুঁকি থাকে, এমনকি ব্যক্তির অসুস্থতা সমাজেও ছড়িয়ে পড়তে পারে ক্রমশ, যেমনটা পর্নোগ্রাফিতে। উপন্যাস কখনো অ্যাডলেসন্ট পরিতৃপ্তির উপায় নয়; সাহিত্যসত্যের এই অমূল্য জায়গায় কদাচ বিচ্যুত হননি বলেই তাঁর চরিত্ররা ডামি হয়নি, প্রাণের উত্তাপে ভরপুর।

তবে এ-কথা কবুল করা ভালো – নর-নারীর প্রেম ও কামচেতনাকে সর্বদাই তিনি মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন; তারা কীভাবে রি-অ্যাক্ট করে – সেটাও ছিল তাঁর নিবিড় পর্যবেক্ষণের বিষয়। এই দুইয়ের সংঘাত কখনো কখনো এত সুতীব্র হয়েছে যে, মনে হবে প্রেম এবার কেচ্ছার দাপটে কল্কেই পাবে না। তা ওই পর্যন্তই। সমগ্র অমিয়ভূষণেই যৌনচেতনা কখনো প্রেমের পরিবর্ত হয়ে ওঠেনি। আবার এটাও ঠিক, এই দুইয়ের মধ্যকার কানামাছি খেলাকে তিনি ভালোওবেসেছেন। তাসিলার মেয়রে তাসিলা ফরেস্ট ডিভিশনের ডিএফও বলিন বসু। অপরূপা স্ত্রী রিনি বসুকে মেয়রের বাংলোয় রেখে নুমপাই ফরেস্ট রেঞ্জ আবিষ্কারে যাওয়ার পর একরাতে হয় কী, একাকিনী রিনি বসুর ইশারামতো তরুণ দীর্ঘকায় মেয়র যখন বসের সুন্দরী স্ত্রীর গেলাসে মদ ঢেলে দেয়, পানরত প্রগলভ রমণী জীবনের গভীর তলের কথা টেনে আনে এবং একটুখানি মদ মেয়রের মুখে তুলে দিতে স্বচ্ছ গাউনপরা স্খলিতচরণা বেহেড রিনি বসু টালমাটাল হয়ে নেশার ঘোরে মেয়রের গায়ে ঢলে পড়তে উদ্যত – সে-কথাই পাঠকের বোধে পলকে সেই হিরণ্ময়-যৌনতাই জেগে ওঠে। কিংবা বিনোদিনীর রাভা আদিবাসীদের মিথ বা কিলাংনানি প্রথা এই, সম্পত্তি রক্ষার্থে শাশুড়ি চাইলে মৃত মেয়ের স্বামীকেও বিয়ে করতে পারে। অপ্রচলিত কিলাংনানি প্রথা বা মিথের সুযোগে শ্বশুরবাড়িতে দীর্ঘকাল বাদে ফেরা জামাই জনার্দন শাশুড়ির জমিজমা আধিয়ার বোজোর হাত থেকে বাঁচানোর আর কোনো পথ খোলা না-পেয়ে একরাতে শাশুড়ির ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করামাত্র যখন নিজস্ব ভাষায় বলে, ‘তো শোনেন, আজ থাকি আমি শোং তোমার মরৎ’, দরজায় পিঠ রেখে দাঁড়ানো জনার্দনকে শাশুড়ি আর ছেলেমানুষ ভাবতে পারে না। সেই ট্রেডমার্ক লুকোচুরি খেলার মোহনপ্রভাই ঝিলমিলিয়ে ওঠে। কিন্তু না, মেঘে-ঢাকা চাঁদের মতো ওই অপ্রতিরোধ্য যৌনতা বারংবার উঁকি দিলেও শেষমেশ স্নায়ুক্ষরা সংযমের জয় হয়। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, সাপ হয়ে অমিয়ভূষণ বারবার যৌনগন্ধী খেলা খেলেনই বা কেন, আবার ওঝা সেজে কামতপ্তবিষ নামাতেই বা যান কেন? এর উত্তর খুঁজতে হলে তাসিলার মেয়রের রিনি বসুর লেখা একটি চিঠির শরণ নেওয়া ভালো : স্ত্রীলোকদের মনের মধ্যে চকোলেট রঙের কী কালো রঙের একটা স্পট থাকে, যা দারুণ অভিকর্ষে পুরুষকে আত্মস্থ করে। রিনি বসুর চিঠির ভাষ্যমতে, ‘প্রেমের কবিতা, ঘরভাঙা, অসাধ্যপটীয়সিতা, সবই সেই কালো স্পটের ষড়যন্ত্র।’ চাঁদবেনেতেও সমার্থক বাক্যবন্ধ দেখতে পাওয়া যায়, ‘অথবা বধূরা, রমণীমাত্রই, কামের আশ্রয় হলেও তা তো কাব্যও।’ ফলে উৎপীড়ক কামের অপরপৃষ্ঠে কিছু নিটোলবাক্যও থাকে; সৃষ্টির স্বার্থে সংযতকরণের কিছু সঞ্জীবনীমন্ত্রেরও দরকার হয়। এতে আখেরে উপকৃত হয় পাত্রপাত্রীরা, লাভ করে দীর্ঘ পরমায়ু। এর অন্যথা হলে বিপর্যয় অবধারিত। যৌনবিষয় অহেতুক মুখ্য হয়ে উঠলে ফিরিঙ্গি ক্যাথারিন কেট, নয়নতারা, রিনি বসু, বিনোদিনী, চন্দ্রানি, কমরুন প্রমুখ চরিত্র বিদেহ হয়ে পড়ত, রক্ত-মাংসের স্ত্রীলোক না-হয়ে বরণ করে নিত নেহাত ডামির দুর্ভাগ্য। অমিয়ভূষণের ভাবনায় ‘শায়িতা নারীরা কামকলায় যত পটীয়সী হোক না কেন, উপন্যাসের বাস্তব বিশ্বাস উৎপাদনে তারা অক্ষম’ – এমন প্রতিফলন তাঁর উপন্যাসে ছড়িয়ে আছে আকসার। দুখিয়ার কুঠিতে একজন বারনারী কমলার বেলাতেও – ‘বহুসেবিকা সেইসব নারীর প্রেম এবং দেহ সমান বন্ধ্যা হওয়াই স্বাভাবিক।’ সমার্থক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর নিউ ক্যালকাটাতেও – ‘কিন্তু পাশের ঘরে রাজেন এবং তার চোখে ন্যুড এবং ন্যাকেডে পার্থক্য জীবন্তে ও মৃতে পার্থক্যের সমান।’ তবে এমনটি মনে করার কারণ নেই যে, যৌনতার ক্ষেত্রে তিনি শুচিবায়ুগ্রস্ত লেখক ছিলেন। একবার খেয়াল করুন তাঁর হলং মানসাই উপকথার কথা : খুনের মামলার দন্ডিত আসামি গজেন ঢালি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রামে ফিরে এসে হয় আরো যথেচ্ছচারী। তাকে ঘায়েল করে উঠতি যুবক ফালটু ও চন্দ্রানি উখুন্ডি থেকে আসামের উদ্বাস্ত্তশিবিরে পালিয়ে গিয়ে কুঁড়েঘরের আলাদা চাটাইয়ে বসবাস করতে-করতে চন্দানি যখন সরে এসে ফালটুর চাটাইয়ের ওপর যেয়ে তার গায়ে হাত রেখে বলে, ‘তুমি এমন ছোট থাকবা কেন্? আমার গায়ে হাত দেও… পারছোই তো। কাডে বউ বলে লিখাতে হইছে’, তখন তাঁকে শুচিবায়ুগ্রস্ত লেখক বলা ভীষণরকম অন্যায়। ‘তাঁতী বউ’ গল্পটি তো রীতিমতো এক দুঃসাহসিক আখ্যান যেখানে, যৌবন সমীকরণের সমস্ত ব্যাপ্তি তছনছ হয়ে গেছে, অথচ পঙ্কিলতা ছাপিয়ে তাঁতিবউয়ের পতি-ভালোবাসা জেগে উঠেছে লাল পদ্মের মতো। যতক্ষণ পর্যন্ত নর-নারীর সম্পর্কের মধ্যে প্রেমের আলো প্রজ্বলিত থাকছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনিও উদারহস্ত; পাপ-পুণ্যের অনেক তথাকথিত ধারণাকে তিনি ভেঙে দিয়েছেন কলমের এক তুড়িতে, –

১। সে জানে, পুরুষের কামনা কখনও কখনও একটা কোমল প্রার্থনার মতো। সুকুমার সুবেশ রাজকুমারের যদি তেমন নিঃশব্দ অনুরোধ – পরিচারিকা হাঁপাতে লাগল। আ, ছি, ছি-ছি, না…

২। কিন্তু নয়নতারা শয্যায় এলো। বলল, ‘বা, আমাকে বুঝি দেখবে না?’ শেজের আলোয় নয়নতারা ঝিকমিক করে হাসল… (রাজনগর)

৩। মোতিদির গড়নের সৌন্দর্য ফুটে আছে। হৈমন্তী অস্বীকার করবে কি করে মোতিদির সেই সোনালি রঙের শরীর সে উপাসনার দৃষ্টিতে দেখেছিল… (বিবিক্তা)

৪। দুই সুন্দর তরুণ নারীদেহ যেন দুটি আলোর মতো, দুটি নদীর সঙ্গমের মতো মিলিত হতে থাকে। এই সমকামী প্রেম যেন বিবিক্তার ওষুধ হতে পারে… (বিবিক্তা)

৫। আর ঠোঁটদুটোকে কিছুটা গোলালো করে চাউনিকে কিছুটা সংকীর্ণ আর নরম করলে যে কামনার আমন্ত্রণ হয় তা কমসংখ্যক পুরুষই প্রত্যাখ্যান করতে পারে… অবশ্য দুষ্টুমিভরা চোখে জিভের ডগা কাটলেও এমন একটা আকর্ষণ তৈরি হতে পারে যা কারো কারো পক্ষে কাটিয়ে ওঠা কঠিন। কিংবা ফিসফিস করে বলা দু-একটা কথারও তেমন জোর থাকে… (নিউ ক্যালকাটা)

৬। নাচ চলছিল। তার এক পর্যায়ে নর্তকীদের জানুর ঊর্ধবদেশ, এমনকি ঊরুর মধ্যভাগ চোখে পড়ল। চাঁদের অনুভব হল, বুঝি বা তারা উর্বরতা ভিক্ষা করছে… কন্যারা, যাদের হালকা শরীর, কূজনের মতো কথা বলে থাকে, কঞ্চুলীহীন শাটী পরার হেতু অর্ধপয়োধর নিয়ে ক্ষণে ক্ষণে লজ্জিতা, তারা যেন কাব্যই। (চাঁদবেনে)

তাহলে ধরে নেওয়া যেতে পারে – পুরুষটি যতবেলা ইভের অ্যাডাম, ততবেলা সম্পর্কের সুতো ছাড়তে তিনি যাকে বলে অমায়িক নাম্বার ওয়ান অর্থাৎ এই ফাঁকে তোমরা যা কিছু করো না বাপু, বাধা দিতে আমার বয়েই গেছে। হ্যাঁ, তোমাদের ইন্দ্রিয়-উদ্দীপনা দেখে চোখ টাটানোর মতো জেলাস আমি মোটেই নই। জেলাসি থাকলে কি কুমার টপাদারের সিস্টার নেলি হাসপাতাল ত্যাগের সময় ঢ্যাঙা সুকুমারের জুতোর ওপর দাঁড়িয়ে, তার কোমর জড়িয়ে ধরে, তার ঠোঁটদুটোকে নিজের আপেল-গন্ধী দুঠোঁটে পাক্কা এক মিনিটের জন্য ধরে ফেলতে পারে? তবে পুরুষসঙ্গীটি যদি ইভের অ্যাডাম হওয়ার পরিবর্তে ইভটিজার হয়ে ওঠে, তাহলেই তিনি কৃপাণহস্ত। তখন তুমি যে-ই হও না কেন, এমনকি তুমি যদি বিপ্লবের নাম করেও তিববতী রমণীকে ধর্ষণ করো, তাহলে তোমাকে ধর্ষক নামেই ডাকা হবে, কমিউনিস্ট হিসেবে নয় (দ্রষ্টব্য : সাইমিয়া ক্যাসিয়া)। আবার ‘শ্রীলতার দ্বীপ’ গল্পের সুব্রতবাবুর সংলাপ অনুসারে নদীর স্রোতের মতো মনের স্রোতেরও একটা পয়েন্ট অব নো রিটার্ন থাকে। সেখানে পৌঁছালে স্রোতের হিসাব মানতেই হয় অর্থাৎ তেমনভাবে দুটো মন পাশাপাশি চললে একসময় ওই স্রোতের হিসাবই মুখ্য হয়ে ওঠে; পরস্পরকে স্নিগ্ধ করাটা তেমন ব্যাপার থাকে না; অন্যথায় সদ্যবিবাহিত স্ত্রীর কাছে যাওয়াটাও অসভ্যতা হতে পারে; নজির হিসেবে মাকচক হরিণের ঊষাকে কোট করা যায়। ঊষা বললে, ‘কিন্তু এমন অসভ্য তুমি। লবগের কথা বলতেই বলছ, লাইফুন খোলার সময়ে ওটা খোলা যাইবে। দুই দিনের বউকে নিচের কাপড় খোলার কথা কেউ বলে?’ অথচ ঊষাই বিয়ের আগে দাদার বন্ধু প্রদ্যুম্নকে লুকিয়ে দেখেছিল এবং এতে সে মোটেই লজ্জিত নয়, ‘লজ্জার কী একখান ভালো চিত্র দেখতে?’ কথাটা পয়েন্ট অব নো রিটার্নই; চড়াই-উতরাই মাড়িয়ে দুটো মন যখন এক সমতলে এসে মেশে, তাতে কাব্যের ঝলকানি থাকেই, যেমনটি ঘটেছিল সোঁদালে; মোন্নাত বা মোদনাথ, যে-স্বপ্ন দেখেছিল সমাজবাদ প্রতিষ্ঠার, কিন্তু অতিবাম বিচ্যুতির কারণে যা অনেকটাই তখন রক্তলাল, পুলিশের তাড়া খেয়ে বনে পালালে হয় কী, মোন্নাতের সহৃদয়তার পরিচয় পেয়ে অরণ্যের কন্যা তিন্নি কেবল তাকে নিজের বাথানে আশ্রয় দেয় না কিংবা নিজের সঞ্চয় খরচ করে তার গুলিবিদ্ধ পায়ের চিকিৎসা করায় না, একসময় তাকে সুখী করতে, জীবনের সোয়াদ কী তা জানাতে কাছেও টেনেছিল। তাহলে এমন বলাই সংগত হয়, ছবির মডেল সম্পর্কে কিছু কথা লিখে চিত্রী যেভাবে রং দিয়ে ঢেকে দেন, যৌনতার ক্ষেত্রে তেমন একটা আড়াল রাখতেই পছন্দ করতেন তিনি।

তবে এই নয় যে, সাহিত্যিক হিসেবে অমিয়ভূষণ আদৌ সমাজ নামক তথাকথিত ধারণার প্রতি দায়বদ্ধ ছিলেন, তাঁর উচ্চারণ বরং আরো গভীরতাব্যঞ্জক ও সাহসী, ‘কারণ যে কোনো একটি মুহূর্তে সমাজ তৎকালে কতগুলো প্রতিষ্ঠিত ভ্যালুর সমষ্টিমাত্র। লেখক সেই ভ্যালুজকেই বদলাতে চাইবেন। নইলে তিনি লেখক কেন? লেখক যদি সমাজের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে চান, তবে তো সেই সময়ের status quo-র কাছেই দায়বদ্ধ থাকবেন…।’ আলোকসম্ভব কথামালাই বটে! পাত্রপাত্রীর চিন্তাপ্রবাহকে তিনি নানা মাত্রিকতায় যাচাই-বাছাই করে দেখতেই চরিত্রগুলোকে ফেলেছেন হৃদয়ঘটিত নানান পরীক্ষায়; কখনো মুক্ত পরিবেশে, কখনো-বা অবরুদ্ধ পরিস্থিতিতে। দুরকম প্রতিবেশেও ফলাফলের কিন্তু তেমন হেরফের হয়নি। এখানে নিরুদ্ধ প্রতিবেশ বলতে তাঁর কুশীলবদের কখনো স্বভূমি থেকে, কখনো-বা স্বগোত্র থেকে, নিজস্ব বিশ্বাস থেকে কিংবা স্বজীবন থেকে উৎখাত হওয়ার মতো ভয়াবহতাকেই বোঝানো হচ্ছে। মহিষকুড়ার উপকথায় কী দেখি? বনের মধ্যে বাউদিয়া দলপরিত্যক্ত কমরুনের সাক্ষাৎ পাওয়ার পর বাউদিয়াকন্যাকেই আপন করে নিয়েছিল আসফাক, যদিও তা স্থায়ী হয়নি; জাফরুল্লার খামারে মুনিষের চাকরি নেওয়ার পর কমরুনের ওপর অধিকার সে ধরে রাখতে পারেনি, ততদিনে কমরুন খামারমালিক জাফরুল্লার চতুর্থ বিবি। পরে জাফরুল্লার অনুপস্থিতিতে অনেকবারই কমরুনের দেখাশোনার ভার আসফাকের ওপর বর্তেছে, তখন যদিও পারস্পরিক আকর্ষণের হিলমিল খেলাটি পূর্বের রং ফিরে পায় না, কিংবা সমাজব্যবস্থার তলে চাপা পড়ে তা আপাত-ফ্যাকাশেই মনে হয়। তারপরও কথা থেকে যায়; পৌরুষহীন জাফরুল্লার চতুর্থ বিবি হওয়ার কয়েক মাস বাদে আসফাকের ঔরসে জন্ম নেওয়া সন্তানকে কমরুন পরে আসফাককে সম্মান করতেই শিখিয়েছে, মিঞাসাহেব বলে ডাকতে শিখিয়েছে; এ যেন হৃদয়স্রোতের খাতবদল; ফল্গুধারার মতো অন্তঃশীলে বয়ে চলা। হলং মানসাই উপকথাতেও সমকথা প্রযোজ্য। গডফাদার গজেন ঢালির হাতে নার্সকন্যা চন্দানি সম্ভ্রম হারিয়ে পালিয়ে যায় আরেক উদ্বাস্ত্ত শিবিরে; সেখানে গজেন ঢালির বিরুদ্ধে ফালটুকে প্রতিবাদমুখর করতে যা যা করার দরকার সবই করে চন্দানি; অনভিজ্ঞ ফালটুকে সাবালক করে তুলতে বলে, ‘ছোট থেকে কি লাভ, এবার বড় হও, আমাকে ছুঁয়ে বড় হয়ে যাও।’ যদিও তেমন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়, গডফাদার গজেন ঢালিদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করা কখনোই সোজা নয়; তারপরও ওই আলো জ্বালানোর ব্যাপারটা তো আর মিথ্যে হয়ে যায় না, বরং তা গুরুত্ববহই। কেন গুরুত্বের দাবিদার তা শোনা যাক খোদ লেখকের কণ্ঠে, ‘এই প্রথম এতখানি করে বলা হল – যে প্রেম দহনক্রিয়ার নয়, যাকে আলো বলা যেতে পারে, যদিও সে আলো নিয়ে আমরা কোনো গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবো কিনা তা আদৌ চন্তার বিষয় নয়। হয়তো আলোর স্বভাবই এই, নিছক উৎসবের জন্য আলো জ্বালালেও তা কোথাও না কোথাও অন্ধকার দূর করবেই। উৎসব থেকে অন্যত্র মন নেওয়ার অবসর যদি ঘটে, তখন আমরা পরিচিত বিষয়কে নতুন করে চিনতে পারবো এমন সম্ভাবনা থাকে।’

কান টানলে যেমন মাথা আসে, তেমনি কথা টানলে কথা; প্রসঙ্গটা মসলিনের যার উল্লেখ তাঁর অনেক উপন্যাসেই             রয়েছে। মসলিন শাড়ির কিংবদন্তিতুল্য সুখ্যাতির পেছনে এর আশ্চর্য গঠনশৈলী কি শেষকথা? ‘রাজনগর’ কি ‘নয়নতারা’ পড়তে-পড়তে নতুন ভাবনাও যে ঘাই মারে মাথায়। যে মসলিন শাড়ি ওজনে একখানা রেশমি রুমালের সমান এবং ভাঁজ খোলার পর যে-শাড়ি অদৃশ্যপ্রায় হয়ে পড়ে, সেখানে কি ধনবতী নারীদের দেহসৌষ্ঠব প্রদর্শনের বিষয়টি প্রকট হয়ে ওঠে না? তো হরেদরে সেই কথা, মসলিনের ভুবনজোড়া জনপ্রিয়তার মূলে যৌনচেতনাও একটি ফ্যাক্টর বটে। পক্ষে একাধিক প্রমাণ এই, নবাবের নাচনেওয়ালিদের পরিধেয় পেশোয়াজকে স্বচ্ছপ্রায় করে তুলতে যে মসলিনই ছিল শেষ ভরসা; তখন নাচে মশগুল ডানকানের উপলব্ধির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করা কঠিন, ‘এই ভারতবর্ষ। এলাচ লবঙ্গর দেশ, মসলিন ও সোনার দেশ, এই নাচের দেশ।… এই সোনার দেশে সবই প্রখর। প্রখর এর আকাশ, প্রখরা এর নারী।… মখমলের মতো মসৃণ উষ্ণস্পর্শ বলে আশা হয়। রানীর কণ্ঠের মালায় স্থান পাবার মতো ক্যাট্সআই পাথরে তৈরি চোখ, কী নরম, কী ভাস্বর সেই দৃষ্টি। কী অপূর্ব প্রাণনা, কী সর্বগ্রাসী নিথরা নেশা।’ মসলিনের কামচেতনা অস্বীকার করা আরো কঠিন হয়ে পড়ে, যখন তাঁর বিবিক্তায় ঢুকে পড়ি; অনেকদিন আগে অাঁকা ন্যুড ছবির ধুলো  অাঁচল দিয়ে ঝাড়তে গিয়ে শৌখিন চিত্রকর হৈমন্তীর যেই অন্যমনস্কতা কেটে যায়, সে বুঝতে পারে, ‘ছবিটা ঠিক ন্যুড নয়, শায়িতা এক মহিলার যার পরনে মসলিন।’ এরূপে যৌনচেতনা ও নারীভাবনা যেন পরস্পরের সহোদরা যদি মাঝখানে মসলিন রাখা যায়।

না, কথাটা ষোলো আনা ঠিক হচ্ছে না; ততক্ষণ পর্যন্তই তা সহোদরা যতক্ষণ পর্যন্ত প্রেমাবেগ নিয়ন্ত্রণ করে সঙ্গমভাবনাকে অর্থাৎ মনের মধ্যকার স্রোতধারাকে সেই অবধি চলতে দিতে হয় যাতে তা স্নিগ্ধকর পয়েন্ট অব নো রিটার্নকে ছোঁয়; এর অন্যথা মানেই সমূহ বিপর্যয়। সুখের কথা, তেমন বিপর্যয়ের কালিমা ভুলেও স্পর্শ করেনি অমিয়ভূষণের কথাসাহিত্যকে; স্ত্রীলোকের মনের ভেতরকার চকোলেটরঙা স্পটকে উলটেপালটে তিনি দেখেছেন সত্য, বিভিন্ন কৌণিক আলোয় তার ভাঙাগড়াও করেছেন, কিন্তু সম্প্রসারণের অভিমুখ সবসময় থেকেছে জীবনের দিকে; বলতে কী তাঁর লেখকসুলভ বাজি সেই হরিণটার দিকেই, যে-বাঘের থাবার নিচে আকাশছোঁয়া লাফ দিয়ে তৃপ্ত; যদিও           সে-ই শেষ লাফ, কিন্তু তাতে কী, সেই জীবনেচ্ছাকেই তিনি উৎকর্য মেনেছেন, নানা কৌশলে জীবনেচ্ছাকেই করেছেন পরিস্ফুট ও যুক্তিসিদ্ধ। এ-কারণেই অমিয়ভূষণের সোনালি পথ জীবনের পরিণতির এত কাছাকাছি যেতে পেরেছে!