অমিয়ভূষণের মহিষকুড়ার উপকথা : সাব-অলটার্ন তত্ত্বের আলোকে

মিশরের শ্রেষ্ঠ পিরামিড-নির্মাতা সম্রাট খুফু নাকি প্রতিদিন তাঁর ছেলেদের নিজের সিংহাসনের পাশে বসিয়ে পুরনো জাদুকরদের সম্পর্কে একটি গল্প শোনাতে বলতেন। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র খাফ্রি – যাঁর রাজত্বকাল প্রায় চার হাজার নয়শো খ্রিষ্টপূর্বাব্দেরও আগে বলে জানা যায় – একবার এই সূত্রে একটি গল্প বলেছিলেন। খাফ্রির বলা সেই গল্পই নাকি পৃথিবীর আদিমতম গল্পের একমাত্র প্রামাণিক উৎস। এরপর পৃথিবী প্রায় কয়েক লক্ষ-কোটিবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে ফেলেছে। মানব সভ্যতার মানচিত্র বদলেছে বহুবার। সভ্যতার পর সভ্যতায় সময়ের তালে আলো জ্বলেছে-নিভেছে। মান বদলেছে নিরক্ষরেখারও। তবু আজো মানুষর গল্প বলা বা গল্প শোনার তাগিদ হারায়নি একটুও। মানুষের গল্প বলার এই তাগিদকে শিল্পরীতিতে বেঁধে প্রথম সাহিত্যের রূপ পেতে দেখা গিয়েছিল পাশ্চাত্যে। সময়ের দাবিতে এই গল্প বলার ফর্ম নিয়ে বিভিন্নজনের মধ্যে চলেছে নানা গবেষণা। সেই থেকেই পাশ্চাত্য সাহিত্যিকদের হাত ধরে প্রথম জন্ম নেয় নভেল। পাশ্চাত্য এই শিল্পরীতিকে অনুসরণ করে বাংলায় উপন্যাস রচনার কাজে প্রথম এগিয়ে এসেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। দুর্গেশনন্দিনীর হাত ধরে ১৮৬৫ সালে বাংলা উপন্যাসের যে টালমাটাল পায়ে পথচলা শুরু হয়েছিল তা অনেকটাই পরিণতি পায় বিষবৃক্ষক্ষ (১৮৭২)।

রবীন্দ্রযুগ অতিক্রম করে মানিক-তারাশঙ্কর-বিভূতি-শরদিন্দুর হাত ধরে পূর্ণ বলিষ্ঠতায় নির্ণীত হয়েছে বাংলা উপন্যাসের দিকরেখা। এরই মাঝে বিভিন্ন ঔপন্যাসিক উপন্যাসের নতুন নতুন ফর্ম নিয়ে গবেষণা করে গেছেন নিরন্তর। একসময় চরিত্রের তুলনায় বাস্তব জীবনের প্রতিফলন ঘটানোই ছিল উপন্যাসের মূলে। সময়ের তালে শুধুমাত্র জীবন-বর্ণনার একমুখী উদ্দেশ্যের পরিবর্তে প্রাধান্য পেয়েছে চরিত্র। চরিত্রদের ভাবনাকে লিখিতের রূপ দেওয়াই উঠে এসেছে উপন্যাসের মূলে। এরপর বিভিন্ন দেশ তাদের সমাজজীবনে মিশে থাকা বিভিন্ন কাহিনিকে তুলে ধরতে থাকল উপন্যাসে। তৈরি হতে শুরু করল নানা তত্ত্ব ও সংজ্ঞা। রুশ বিপস্নবকে কেন্দ্র করে গোর্কির হাত ধরে জন্ম নিল সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ সংবলিত উপন্যাস। কাফকাদের লেখনীতে ভর করে ইতোমধ্যে চেতনাপ্রবাহের রীতি মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল উপন্যাসের। আফ্রিকার ঔপন্যাসিকেরা যোগ করলেন লোকগাথা ও রূপকথাকে। মার্কেজ লাতিন আমেরিকার উপন্যাসে নিয়ে এলেন ম্যাজিক রিয়ালিজম। যুগে যুগে বিভিন্ন দেশের ঔপন্যাসিকেরা তাঁদের বাস্তব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে কল্পনার রঙে রাঙিয়ে তুলেছেন তাঁদের উপন্যাসগুলোকে। ঔপন্যাসিক মূলত মানব-অসিত্মত্বের অকপট সত্যসন্ধানী। ঔপন্যাসিক তাঁর কল্পনায় যে-রীতিই ব্যবহার করুন না কেন, উপন্যাসকে আবশ্যিকভাবে হয়ে উঠতেই হয় বাস্তব সত্যতার দলিল। উপন্যাসের মতো সত্যগ্রাহ্যতার দায় কবিতা বা নাটকের থাকে না। মানুষের জীবনে প্রতিদিন ঘটে যাওয়া নানা বিষয়ের সাপেক্ষে ঔপন্যাসিক তাঁর কল্পনায় পাঠককে এমনভাবে মজিয়ে রাখতে চেষ্টা করেন যাতে উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্র আমাদের সত্য বলে মনে হয়। জীবনের না-পারা বা
হতে-চাওয়ার সুপ্ত বাসনার প্রতিফলন পাঠকের মনে প্রতিবিম্বিত করাতেই একজন ঔপন্যাসিকের সার্থকতা।

বাংলা সাহিত্য যুগে যুগে বিভিন্ন সাহিত্যিকের শিল্পরীতিতে বারবার সমৃদ্ধ হয়েছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছে বিভিন্ন তত্ত্ব নিয়েও। যে-সমস্ত সাহিত্যিক তাঁদের সৃষ্টিকে শুধু মনোরঞ্জন বা কাহিনি নির্মাণের আধার হিসেবে না দেখে বাংলা উপন্যাসকে পূর্ণ যুবতী করে তোলার লক্ষ্যে নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে গেছেন, অমিয়ভূষণ মজুমদার তাঁদের মধ্যে অন্যতম। পাঠক তৈরির লক্ষ্যে নয়, উত্তরীয় কাঁধে ফেলে সভা অলংকৃত করার মতো সস্তার জনপ্রিয়তায় নয়, বরং নিজস্ব ফর্মকে প্রয়োগের মধ্য দিয়ে নবত্ব তৈরির মধ্যেই তাঁর সাহিত্যজীবনের মূল্যায়ন সম্ভব।

অমিয়ভূষণের পাঠক নেই। আপাতকঠোর ও অপ্রিয় হলেও তা মিথ্যে নয়। অচলায়তনের পঞ্চকেরা যে একাই তাদের উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে এগিয়ে যায় তার উদাহরণ ইতিহাস আমাদের বারবার দিয়ে এসেছে। প্রচলিত পথে হেঁটে তাঁর উপন্যাস কোনোদিন বেস্ট সেলারের তকমা পায়নি। তাঁবেদারি করেনি কোনো নামজাদা পত্রিকারও। কলকাতার উপকূলে সাহিত্য সাধনার বিস্তর উপকরণের পরিবর্তে সুদূর উত্তরবঙ্গের কোচবিহারের মতো মফস্বলে বসেই চলেছিল তাঁর সমগ্র জীবনের বিচিত্র সাহিত্যসম্ভার তৈরির কাজ। তাঁর রচনায় এমন নতুন ভঙ্গি আছে, এমন বৈচিত্র্য আছে, ভাষা ব্যবহারে এমন বিস্ময় আছে যে মনোযোগী পাঠক ছাড়া তা আয়ত্ত করা অসম্ভব। পড়তে পড়তে গতি মন্থর হয়ে আসে, ফিরে যেতে হয় প্রাক্কথনে। অমিয়ভূষণ উপন্যাসের পাঠ নিয়েছিলেন বাডেন ব্রম্নকস ও ব্যাবিটের কাছ থেকে। ১৯৭৩ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নীরোজ বিশ্বাসকে তিনি বলেছিলেন – ‘উপন্যাস বলতে Boy meets a girl কখনো ভাবতেই পারি না।’

উপন্যাসের রীতিকে তিনি নিজের মতো করে নির্মাণ করেছিলেন। তাঁর উপন্যাস নিয়ে আলোচনার পূর্বে উপন্যাস বলতে তিনি যে-রীতিকে বিশেস্নষণ করেছিলেন সেই বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা তৈরি করা দরকার। লিখনে কি ঘটে প্রবন্ধ সংকলনের ‘উপন্যাস সম্বন্ধে’ পরিচ্ছেদে তিনি জানিয়েছেন, ‘প্রকৃতপক্ষে উপন্যাস পোর্টমেন্টো নয় যে তার মধ্যে একই সঙ্গে মায়ের চিঠি, ফুটো মোজা ও ইসেত্মহার পুরে আধুনিকতার গাড়িতে চড়া যাবে। উপন্যাস আমাদের কৌতূহল নিবারণ করে না এবং আমাদের অ্যাডোলেসেন্ট যৌনপ্রবৃত্তির
পরিতৃপ্তির উপায়ও নয়। উপন্যাস তত্ত্ব নয়। এবং বোধহয় সেজন্যই উপন্যাসের ভাষাও বাক্যের পর বাক্য বসানো নয়। উপন্যাস গল্প নয় যে গল্পটা পাঠকের মাথায় ঢুকেছে কি না তা জানলেই ভাষা সম্বন্ধে সব জানা হল। উপন্যাস ইনসেস্ট ইত্যাদির বর্ণনা নয় যে সাংবাদিক মাত্রেই ঔপন্যাসিক হয়ে যাবেন। ওদিকে আবার উপন্যাস ভাষাচর্চাও নয় যে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন বলেই শেষের কবিতা উপন্যাস হয়ে উঠবে। অন্যদিকে উপন্যাস বড় করে গল্প বলা নয় যে কেউ এ বিষয়েও চালাকি করে বলবে উপন্যাস বড় গল্পও বটে। উপন্যাসে, একজন বিলেতি রসিকের কথা এনে বলা যায়, গল্প থাকায় আমরা দুঃখিত, এবং গল্প যে রাখা হয় তা গল্প বলার উদ্দেশ্যে নয়, কোনটা আগে কোনটা পরে ঘটছে তা ধরিয়ে দিতে। উপন্যাস প্রকৃতপক্ষে একটা থিম যা আমাদের চোখের নিচে ফুটে ওঠে। একটা থিম যা হয়ে ওঠে। অর্থাৎ থিম নামে এক জীবন্ত বিষয়ের ভাব।’

নীল ভুঁইয়া (১৯৫৫), গড়াশ্রীখ- (১৯৫৭), দুখিয়ার চিঠি (১৯৫৯), নির্বাস (১৯৫৯), উদ্বাস্ত্ত (১৯৬২), রাজনগর (১৯৩১), ফ্রাইডে আইল্যান্ড অথবা নরমাংস ভক্ষণ এবং তাহার পর (১৯৮৮), তাসিলার মেয়ে (২০০৭, মরণোত্তর প্রকাশ), চাঁদবেনেসহ (১৯৯৩)আরো অসংখ্য উপন্যাস তাঁর সৃষ্টিতালিকাকে সমৃদ্ধ করেছে দীর্ঘ অর্ধশতক ধরে। মহিষকুড়ার উপকথা (১৯৮১) ও মধু সাধুখাঁ (১৯৮৮) এই তালিকায় নিঃসন্দেহে দুটি উলেস্নখযোগ্য সংযোজন।

উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮০ সালে শারদীয় পরিচয় পত্রিকায়। ১৯৮১ সালে ‘রক্তকরবী’ প্রকাশনা উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে। অমিয়ভূষণের অন্যান্য উপন্যাসের ভিড়ে মহিষকুড়ার উপকথার উলেস্নখযোগ্যতা হলো – উপন্যাসটি লেখকের পরিচিত ছকের বাইরে বেরিয়ে পাঠকের কাছে অনেকটাই সুখপাঠ্য ও বোধগম্যতার প্রশংসা অর্জন করতে পেরেছিল। উপন্যাসটির ভাষা এক গভীর রহস্যলোকে বিচরণ করলেও সৃষ্টি করেছে এক ভীষণ চমৎকারিত্ব। কাহিনি-নির্মাণের ভঙ্গি পাঠককে বরং গভীর মনোযোগীই করে তোলে। আরণ্যকে বিভূতিভূষণ, হাঁসুলী বাঁকের উপকথায় তারাশঙ্কর, পদ্মানদীর মাঝিতে মানিক, ঢোঁড়াই চরিত মানসে সতীনাথ ভাদুড়ী, তিতাস একটি নদীর নামে অদ্বৈত মলস্নবর্মণ, গঙ্গায় সমরেশ বসু, অরণ্যের অধিকারে মহাশ্বেতা নিম্নবর্গ সমাজের কথা যেভাবে তুলে এনেছিলেন সেই ধারাকেই সমৃদ্ধ করেছে এই মহিষকুড়ার উপকথা উপন্যাসটি। হয়তো এই সাহিত্য ধারার দ–ই ভর করে পরবর্তীকালে রচিত হয় সম্পূর্ণভাবে নিম্নবিত্ত মানুষের ইতিহাসকে কেন্দ্র করে লেখা অভিজিৎ সেনের বহু চণ্ডালের হাঁড় কিংবা শুভংকর গুহের বিয়োর উপন্যাস দুটি।

পথের পাঁচালী চলচ্চিত্রটির একেবারে সূচনায় সত্যজিৎ কয়েক সেকেন্ডের যে নির্বাক water spectacle নির্মাণ করেছিলেন ঠিক সেই চরম বাস্তবতায় উপন্যাসটির কাহিনি বিসত্মৃত। উপন্যাসের মূল ঘটনাপ্রবাহে অনেকটা যেন যামিনী রায়ের মতো ভিন্ন অবয়ব অংকনের চতুরতায় তিনি প্রলেপ লাগিয়ে গেছেন প্রতিটি চরিত্রে। প্রতিটি চরিত্র উপন্যাসে স্বচ্ছন্দে বিচরণ করেছে চরিত্রের পূর্ণ ব্যাপ্তির লক্ষ্যে নয় বরং ঘটনার অমোঘ প্রয়োজনেই। অমিয়ভূষণ উপলব্ধি করতে পেরেই বলেছিলেন, ‘উপন্যাসের দায় তাকে বাস্তবের বিশ্বাস উৎপাদন করতে হয়।’

ভারতে নিম্নবর্গদের নিয়ে আলোচনা শুরু হয় মূলত গৌতম ভদ্র, রণজিৎ গুহ, দীপেশ চক্রবর্তীদের হাত ধরে। পাশ্চাত্যে যা সাব-অলটার্ন তত্ত্ব নামে পরিচিত। মার্কসবাদে বিশ্বাসী ইতালীয় তাত্ত্বিক আমেত্মানিয় গ্রামসি কারাগারের নোটবই গ্রন্থটিতে প্রথম সাব-অলটার্ন শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। ১৯৮৩ সালে এটি একটি বিশেষ তত্ত্বের মর্যাদা পায়। সুতরাং এই তত্ত্ব আলোচনার প্রায় দু-বছর আগেই অমিয়ভূষণ লিখে ফেলেছেন সাব-অলটার্ন বা নিম্নবর্গদের জীবনকথা নিয়ে মহিষকুড়ার উপকথা উপন্যাসটি। শুধু একমাতৃক তত্ত্বের নিরিখে এই উপন্যাসকে বিচার করা সম্ভব নয় একেবারেই, তবু বহুমুখী ভাবনার আলোকে সাব-অলটার্ন তত্ত্বটিই সবচেয়ে ভাস্বর।

উপন্যাসটির সূচনাবাক্যই পাঠকের মনে উপন্যাসটির ঘটনাস্থল সম্পর্কে স্পষ্ট-প্রাঞ্জল ধারণার জন্ম দেয়। ‘আমাদের এই গল্পটা মহিষকুড়া নামে এক নগণ্য গ্রামকে কেন্দ্র করে। আকাশ থেকে দেখলে মনে হয়, বিসত্মীর্ণ সবুজ-সাগরে একটা বিচ্ছিন্ন ছোট দ্বীপ।’ এই বিচ্ছিন্নতাই গ্রামটির মূল সম্পদ-কাহিনির আধার। মানচিত্র তন্নতন্ন করে দেখলেও হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না এই গ্রামটির অবস্থান। ঔপন্যাসিকের কল্পনাগুণে গ্রামটি কাল্পনিক হলেও তার সত্যতার যেন বিন্দুমাত্র স্খলন ঘটে না। মহিষকুড়ার অবস্থান বর্ণনা সহজেই এই ইঙ্গিত দেয় যে, মহিষকুড়া আসলে কোচবিহার কিংবা আলিপুরদুয়ারের বিসত্মীর্ণ অরণ্য, পর্বত, নদী-পরিবেষ্টিত অঞ্চলেরই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। মহিষকুড়া এতটাই বিচ্ছিন্ন দীপের মতো যে এখানে ‘বনের হিংস্র জন্তুদের দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, পিকনিকের আবহাওয়ায় নৃতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করা যেতে পারে, কারণ মনে হতে থাকে এরা বোধহয় বনে পথ হারিয়ে যাওয়া এক মানবগোষ্ঠীর বংশধর, যারা এই বিচ্ছিন্নতাকে চোখের মণির মতো রক্ষা করে।’

মহাশ্বেতা তাঁর অরণ্যের অধিকারে যেভাবে অরণ্যকে বিশেস্নষণ করেছিলেন অমিয়ভূষণের বিশেস্নষণী ভঙ্গিমা সেই তুলনায় পৃথক। অমিয়ভূষণ তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে এক বিশেষ দর্শনের দ্বারা নিজেকে জারিত করেছেন। ‘ট্রমা’ শব্দটি তাঁর আলোচনায় ফিরে ফিরে এসেছে। অরণ্যকে তিনি অবচেতন মনের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। মহিষকুড়ার গ্রামটি তাঁর কাছে অনেকটা অস্ফুট আবেগের মতো। কতগুলো ক্ষুদ্র উপকথার সমন্বয়ে এই উপন্যাসটির কায়া নির্মিত হয়েছে। একটি যেমন পূর্ণবয়স্ক মোষকে কেন্দ্র করে। উপন্যাসের শুরুতেই এই প্রথম উপকথাটি বর্ণনা করবে ‘জাফরুলস্না ব্যাপারী’র খামারে মোষের দুধ দোয়ানোর কাজে যুক্ত ‘চাউটিয়া বর্মন’। উপকথাটির শ্রোতা আসফাক। আসফাকও চাউটিয়া, সোভানদের মতোই ব্যাপারীর কর্মী। ভোটমারি থেকে একজন তার মাদি মোষকে জাফরুলস্নার খামারে নিয়ে এসেছিল পুরুষ মোষের সঙ্গে সঙ্গম করানোর জন্যে। খামারে থাকা দুটো মোষের মধ্যে প্রবীণ মোষটির জন্মবৃত্তান্ত প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছিল এই উপকথা। ব্যাপারীর ভূমিদাস আসফাকই উপন্যাসটির মূল চরিত্র। তাকে ঘিরেও একটি উপকথার বর্ণনা রয়েছে উপন্যাসে। উপন্যাসটিতে ‘আসফাক’ চরিত্রটির সঙ্গে চীনের উপন্যাস-রীতির বিশেষ মিল পাওয়া যায়। চিনুয়া আচেবে চীনের উপন্যাসে যে ‘হ্যালুসিনেশনে’র ধারা নির্মাণ করলেন তারই প্রত্যক্ষ প্রতিফলন আসফাক। সেও হ্যালুসিনেশনের শিকার। জাফরুলস্নাকে সে পছন্দ করে না তবুও সে তার জন্য জীবনদায়ী ওষুধ আনতে কয়েক মাইল পথ হেঁটে শহরে যায়। পথ হারিয়ে তার সঙ্গে যা যা ঘটে এবং তার পরবর্তী প্রতিক্রিয়া যা সমগ্র উপন্যাসে তার চরিত্রের সঙ্গে মিলেমিশে থাকে, সেই সমস্ত ঘটনা হ্যালুসিনেশনের প্রভাবকেই চিহ্নিত করে।

মহিষকুড়া গ্রামে জাফরুলস্না সামন্ত প্রভুদের প্রতিনিধি একটি চরিত্র। ১৯০৬ সালে গোর্কি মা উপন্যাসে যেমন সামন্তদের সঙ্গে দাসদের সম্পর্কের কথা তুলে ধরেছিলেন সেই আবহাওয়াই যেন ফিরে এলো জাফরুলস্না এবং তাকে ঘিরে থাকা ভূমিদাস আসফাকসহ অন্যান্য চরিত্রের মধ্য দিয়ে। সামন্ত শ্রেণির অপর একজন প্রতিনিধি ‘বুধাই রায়’। যার কারণে বাবার মৃত্যুর পর আসফাককে ঘর ছাড়তে হয়। সাব-অলটার্ন বা নিম্নবর্গদের জীবনকথায় শোষকের শোষণযন্ত্র সর্বদা সুরক্ষিতই থাকে। ভারতের ইতিহাসে সাব-অলটার্নরা জীবনের সবকিছুকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়ে নিজেদের সংস্কৃতি, ধর্ম, বিশ্বাসে নির্ভর করে বেঁচে থাকাতেই আনন্দ অনুভব করে। আর সে কারণেই হয়তো জাফরুলস্না ‘কমরুণ’কে সহজেই গ্রহণ করতে পারে – আসফাকের সঙ্গী হওয়া সত্ত্বেও। কমরুণকে ঘিরেও বেশ কয়েকটি উপকথা উপন্যাসটিতে প্রচলিত। কমরুণ ছিল একসময়ে আসফাকের ‘বাউদিয়া’ প্রেমিকা। কমরুণের স্বামীর মৃত্যু হয় বসন্ত রোগে। কমরুণের সঙ্গে তারপর ঘটনাচক্রে পরিচয় ও প্রণয়ের সম্পর্ক হয় আসফাকের।

উপন্যাসটিতে অরণ্যচ্ছেদনের যে প্রসঙ্গ আসে তাতে মিশে থাকে ১৯৭৬ সালে তাত্ত্বিক রূপ পাওয়া ইকো-নভেলের। ভিন্ন পাঠকৃতির এই উপন্যাসে লেখকের ভাষা প্রয়োগ একটি বিশেষ দিক। ভাষা ব্যবহারে তিনি অধিক জটিল শব্দ যেমন ব্যবহার করেননি, তেমনি স্থানীয় ভাষারীতির প্রয়োগকে অহেতুক ও অমূলকও করে তোলেননি। প্রতিটি চরিত্র তাদের নিজস্ব ভাষা ব্যবহার করেছে অতি সাবধানতায়, পাঠকের প্রতিক্রিয়ার কথা মাথায় রেখে।

উপন্যাসের ভাষা সম্পর্কে লেখক জানিয়েছেন, সেখানে তো তারা একেবারে কোচবিহারের ভাষায় কথা বলতে পারত, কিন্তু ডায়ালগকে মিনিমাম রাখা হয়েছে। আমি যদি ওখানকার ভাষা ব্যবহার করতাম, আর সেটা সহজেই করতে পারতাম, সবাই বুঝবে না। আমার কমিউনিকেশন ইনকমপ্লিট থাকবে, কোচবিহারের বাইরে কেউ বুঝবে না। … তাহলে এ পথে গাইড করবে কে? গাইড করবে আমার কম্পোজিশন। It must be logical to the composition; আমি ডায়ালগ ঠিক ততটুকুই দেব, যতটুকু আমার কম্পোজিশনকে হার্ট করে না। যেমন, ‘ব্যাপারী ঘরত নাই’, ‘জানং’, ‘কুমর’, ‘কী খুবসুরত তোক দেখায়’, ‘মুই খানেক ভাবি নেং’, ‘তুই কেনে আসলু’, কিংবা ‘রাইতত’ ইত্যাদি। সংলাপের সহজতায় এই স্থানীয় শব্দগুলো বিরক্তির কারণ না হয়ে বরং উপন্যাসটিকে পাঠকের কাছে যৌবনবতী নারীর লজ্জাবনত দৃষ্টির মতোই আকর্ষণীয় করে তোলে।

নিম্নবর্গ মানুষের জীবনকথা বর্ণনাকে ঔপন্যাসিক এমন বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন যে তাদের চাহিদা, বেঁচে থাকার লড়াই, জমির দাবি, ক্ষুধার দাবি সমস্তই আজো যেন প্রাসঙ্গিক। যা কিছু কালকে অতিক্রম করতে পারে, তা-ই তো প্রকৃত সাহিত্যের উপাদান। সেই নিরিখে মহিষকুড়ার প্রাসঙ্গিকতাও চিরন্তনী। কাফকার উপন্যাসরীতি বারবার ফিরে এসেছে অমিয়ভূষণের লেখায়। মহিষকুড়ার উপকথাতেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। ঔপন্যাসিক হাকিমের চরিত্রটির সঙ্গে তাই ঢিবি খোবলানো মোরগ ও আসফাকের চরিত্রের সঙ্গে ঝুঁটি ফুলিয়ে ঘুরে-বেড়ানো মোরগের তুলনা করেন। সাধারণ মানুষের দাবিকে যেমন রুশ বিপস্নবের প্রাককালে শাসক গুরুত্ব দিত না, শাসকের শোষণ বজায় থাকতো সমানভাবেই – ঠিক সেই সত্যের আলোকেই উদ্ভাসিত উপন্যাসটির শেষাংশ। আসফাক তাই দ্বারিঘরের সামনে এসে দেখে চাকর, ‘আধিয়া’র, গ্রামের মানুষের ভিড়ের মধ্যে একটা প্রকা- গাড়ি। … আর ঠিক সেই সময়েই সাত্তারের মুখে সে শুনতে পায় জাফরুলস্না পঞ্চায়েত প্রধান হয়েছে। গ্রামে আসা হাকিম আশ্বাস দিয়েছিল ‘গ্রামে আর, জমি জিরাৎ নিয়ে অন্যায় থাকবে না’। সেই বিশ্বাসে ভর করেই আসফাক হাকিমের কাছে ব্যাপারীর নামে নালিশ করেছিল। আর আজ সেই ব্যাপারীই গ্রামের সম্পূর্ণ ক্ষমতার মূলে। সাব-অলটার্ন বা নিম্নবর্গদের জীবনকথা এভাবেই গুমরে মরে। তাদের বিচার পরিহাসেরই নামান্তর মাত্র। আসলে মানব সভ্যতার ইতিহাসে ক্ষমতাবানদের সঙ্গে নিম্নবর্গদের এই সম্পর্ক গা-সওয়া, স্বাভাবিক। কাম্য না হলেও সমাজে এর আজো কোনো প্রতিকার নেই। সে-কারণেই হয়তো মরিচঝাঁপির মতো অমানবিক ঘটনার পরেও ক্ষমতার গতিতে নিশ্চিন্ত মনে সেই খলনায়কেরাই বসে থাকতে পারে। আসফাক তাই মনে মনে বলে, ‘সব জমিই কারো-না-কারো। … যেমন বন আর বনের নয়, তাও অন্য একজনের।’

উপন্যাসটির মধ্যে মিশে আছে ‘Ecocriticism’-এর   প্রভাব। প্রচ্ছন্ন হলেও তা সময়ের দাবিতে উলেস্নখযোগ্য। ১৯৭৮ সালে উইলিয়াম রুখার্ট পরিবেশের সঙ্গে সাহিত্যের যোগসূত্র
দেখিয়ে এই তত্ত্বটি তুলে ধরেছিলেন। The Ecocriticism Reader-এর লেখক চেরিল গস্নটফেলটির বহু আগেই বিভূতিভূষণ লিখে ফেলেছিলেন আরণ্যক। তাঁর বহু বছর পরে হলেও অমিয়ভূষণ যখন মহিষকুড়ার উপকথায় অরণ্যকে কেন্দ্র করে মানব  সভ্যতার আস্ফালনের কথা বলেন তখন তত্ত্বগত আলোচনায় ‘Ecocriticism’-এর স্পটলাইটেই তাকে আলোকিত করা অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। তত্ত্বকথা অনুসারেই উপন্যাসে দেখা যায় সভ্যতার অগ্রগতি কেমন করে বিনষ্ট করে দিচ্ছে প্রকৃতি, অরণ্যসম্পদ। মহিষকুড়ার গভীর অরণ্য কেটে ব্যাপারীর কয়েকশো বিঘা তামাক চাষের উপযুক্ত জমি তৈরি, বাথানের মহিষ ছাড়া বন্য মহিষের বিলুপ্ত হয়ে আসা অরণ্যের উপকরণের ওপর মানুষের হস্তক্ষেপকেই নির্দেশিত করে।

লেখকের ভাষায়, ‘লোহার শিকল পরানোর মতো কালো পিচের রাস্তা-সড়ক দিয়ে আমরা অরণ্যকে বেঁধে ফেলেছি। … যেদিন অরণ্যকে মানুষের লোভ গ্রাস করতে শুরু করেছে, সেদিন লাঙল শুধু মানুষের অগ্রগতির চিহ্ন না হয়ে আগ্রাসনের চিহ্ন হয়ে উঠেছে। অরণ্য হ্রাস পেয়েছে, সেখানে জেলা জন্ম নিয়েছে। সরকারি নির্দেশে যেটুকু অরণ্যসম্পদ ধরে রাখা আছে, তার নাম দেওয়া হয়েছে রিজার্ভ ফরেস্ট।’ মহিষকুড়া নামটির মধ্যেই রয়েছে প্রকৃতির উপকরণের এক গভীর যোগ। মহিষদের বিচরণভূমি থেকেই এ-অঞ্চলের নাম হয় মহিষকুড়া। কিছু দূরে দূরেই নিজেদের চারণভূমির মধ্যেই প্রায় তিরিশটির মতো মোষ এই অঞ্চলে ঘুরে বেড়াত। কোনো কোনো দলে থাকত শতাধিক মোষও। কিন্তু মানুষের আস্ফালনেই সমস্ত মোষ বিলুপ্ত হয়ে যায়। ‘সেই মোষগুলি … কোথায় গেল, কেউ জানে না।’

উপন্যাস সময়ের দাবি মেনে তার রীতিনীতি স্বমহিমাতেই বদলাতে থাকে। তবে সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা কী করে নিম্নবর্গের স্বাধীনতা, চেতনা, মননকে গ্রাস করে নেয় সেই চিত্রই হয়তো ঔপন্যাসিক তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। নিম্নবর্গদের সমস্ত প্রতিবাদ মনে মনেই ঘটে। প্রকাশের সাহস বা ক্ষমতা কোনোটিই তাদের নেই। তাই আসফাক, ব্যাপারীর বিরুদ্ধে মনে মনে যুদ্ধে নেমেই শান্তি পায়। ‘তো ব্যাপারী তোমাকে থাপ্পড় মারছেন, দশ বিঘা ভূঁই দিচ্ছেন, মুইও চাষ দেং নাই। মুই ওষুধ আনং নাই। তোমরাও না মারেন। তামাম শুধ।’ ঔপন্যাসিক নিম্নবর্গের দিন বদল না দেখালেও সচেতনভাবেই তাকে ইঙ্গিতে রেখে উপন্যাসের সমাপ্তি ঘটিয়েছেন। উপন্যাসের বাহ্যজগৎ লেখকের কল্পনায় এমনভাবে পাঠকের সামনে উঠে এসেছে যে তার বিশেস্নষণ বিভিন্নজনের কাছে বিভিন্ন রকম। বিশ্বের সমস্ত ক্ষমতার মূল উৎসে যে অর্থ আর এই অর্থের দ্বারাই যে মানব সভ্যতা চালিত তাকে অমিয়ভূষণের মতো এমন করে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন খুব কম লেখকই। উদ্দেশ্যের সফলতায়, উদ্দিষ্ট বার্তা প্রদানে তাই মহিষকুড়ার উপকথা ঔপন্যাসিকের উপন্যাসজীবনে অন্যতম পালক সংযোজনের উপাদান।

 

১৯৮৬ সালে রাজনগর উপন্যাসের জন্য ‘সাহিত্য অকাদেমি’ পুরস্কার পাওয়ার পর প্রতিক্রিয়ায় অমিয়ভূষণ জানিয়েছিলেন, ‘আশির দশকের একজন উদীয়মান লেখক হিসেবে নতুন প্রজন্মের সামনে উপস্থিত হতে আমি কিছুটা বিব্রত বোধ করছিলাম।’ একটি সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘জীবন আমাকে জাগিয়ে রেখেছে এবং জগতে আমার ভালো লাগছে না। এই জাগরণে আমার বৃদ্ধি নেই … আমি ওই পারটিকুলার ধরনের এস্কেপ চাচ্ছি। মায়ের জঠরে যে এস্কেপ করেছিলাম জীবনকে ছোঁয়ার, জীবনকে আদিরূপে দেখবার, জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে যাওয়ার চেষ্টা … দর্শন জ্ঞানবিজ্ঞান ইত্যাদি দিয়ে তো নিজেকে জানা হলো না। সেসব দিয়ে যা জেনেছি তা আমাকে স্বসিত্ম দিচ্ছে না। সাহিত্য সৃষ্টির মূলে হয়তো অস্বসিত্ম থেকে দূরে যাওয়ার চেষ্টা।’ অমিয়ভূষণ তাঁর লেখনীর ক্যানভাসকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বহু বহু আগের সমাজের মাঝেও। অমিয়ভূষণের উপন্যাসের ভাষা এমন এক জীবনবোধে পূর্ণ যা দ্বান্দ্বিক সময়ের প্রতিনিধি রূপে ভাস্বর হয়ে ওঠে। বিরাট ও ব্যাপ্ত ক্যানভাসে আমাদের প্রাপ্তি তাঁর সাহিত্যসম্ভারের বিচিত্রগামিতা। নানা ঘটনার মিউজিয়ামে তিনি যে নতুন ধরনের প্রেমচেতনা সাহিত্যে নিয়ে এলেন তা পরীক্ষামূলক হলেও নিঃসন্দেহে বৈচিত্র্যপূর্ণ। রবীন্দ্রনাথের প্রচলিত গদ্যের ছককে ভেঙে ব্যক্তিচিমত্মার মুনশিয়ানায় এক বলিষ্ঠ সফিস্টিফিকেশন পেয়েছিল তাঁর প্রতিটি গদ্য। কাহিনির গুরুত্ব, উপন্যাসের প্রয়োজনীয়তাকে ছুড়ে ফেলেও শুধুমাত্র গদ্যশৈলীর অসাধারণ মণিকারির কাজের জন্য তাঁর সাহিত্যকে পাঠ করা যায়। অমিয়ভূষণের উপন্যাসের ভাষা, দ্বান্দ্বিক ও বহুমুখী যে ভাবনাকে তুলে ধরে তা কেবল নিজস্ব সময়-সমাজ-ইতিহাসের সঙ্গে নয়, বরং উপন্যাসের পরম্পরার সঙ্গেও ভীষণভাবে একাত্ম। ন্যারেশনই তাঁর ভাষা ব্যবহারের বিশেষ একটি ধরন, যেখানে প্রেক্ষাপটের নিরিখে ডিসকোর্স প্রাধান্য পায়নি। মহিষকুড়ার উপকথা উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রের উক্তি-উচ্চারণ প্রতিটি সংলাপে এমন একটি ভাষাকে পাঠকের সামনে পরিবেশন করা হয়েছে যা বাস্তবতার মাটিতে দাঁড়িয়েও যেন প্রচলিত বৃত্তের বাইরে তার অবস্থানকে সূচিত করে। তাঁর উপন্যাসের যে নির্দিষ্ট একটি argument আছে তা যেন অমত্মঃসলিলা। পদ্মা-ব্রহ্মপুত্রের বহতার মতো।

আসলে ভাষা পোশাকমাত্র। যেহেতু তাঁর কাছে গল্প বলাটা কোনোদিনই মুখ্য ছিল না, সেই নিরিখে তিনি গল্প বলার খাঁজে খাঁজে জীবন সম্পর্কে চরম সত্যতাকেই তুলে ধরেছিলেন। পরিশেষে বহু প্রচলিত প্রবাদ ‘মাছের তেলে মাছ ভাজা’র মতো অমিয়ভূষণের ভাষাকে ব্যবহার করেই তাঁর সাহিত্যের মূল্যায়ন করা সম্ভব, ‘একদিক দিয়ে আমার সাহিত্যকে উত্তরবঙ্গের সাহিত্য বলতে পারো, কারণ যে ল্যান্ডস্কেপ এবং তার যে মানুষগুলো আমার গল্প-উপন্যাসে, তার অধিকাংশ পাহাড় থেকে শুরু করে পদ্মাকে অবলম্বন করে। কিন্তু অন্যদিক দিয়ে যদি এসবই সমস্ত পৃথিবীর এবং সমস্ত মানুষের প্রতিভূ না হয়ে থাকে, তাহলে সাহিত্য লেখা হয়েছে কি?’