অমিয় চক্রবর্তীর চিঠি : নরেশ গুহকে

পূর্বলেখ ও টীকা : ভূঁইয়া ইকবাল

পত্র ২৬

 

THE INSTITUTE FOR ADVANCED STUDY

PRINCETON, NEW JERSEY

19th March 1951


স্নেহাস্পদেষু

নরেশ,

তোমার কাছে ৫০ টাকা পৌঁছবার কথা – Lloyds Bankকে বলেছি পাঠাতে। একটা অত্যন্ত গভীর এবং আত্মীয় জীবনের পরম দায়িত্বের সঙ্গে তোমাকে জড়াতে চাই। তুমি যদি ঐ টাকা দিয়ে একবার পুরী ঘুরে আসো তাহলে আমাদের অশেষ উপকার হয়। আমার পিতা ও মাতা দুজনেই জীবনের শেষ কয়েক বৎসর পুরীতে বাস করেন ও ঐখানেই তাঁদের মৃত্যু হয় তুমি তা জানো – আমাদের জীবনের চিরন্তন পবিত্র সংসর্গ ঐ জায়গা এবং ‘আরুণি’ বাড়ির সঙ্গে জড়িত। বাধ্য হয়ে ‘আরুণি’ বাড়ি আমরা বিদেশে আসবার সময় বিক্রি করি কিন্তু পিতামাতার কাগজপত্র, বহু বই, বাসন ইত্যাদি বাক্সে বন্দী হয়ে এবং ইতস্তত প্রক্ষিপ্ত হয়ে ‘‘আরুণি’’র সংলগ্ন একটা ঘরে পড়ে আছে। সম্প্রতি আমার পিতার বন্ধু এবং আমাদের পরিবারের বিশেষ সহায় শ্রীযুক্ত অবিনাশ বন্দ্যোপাধ্যায় (ঠিকানা : – ‘‘Ambica Asram” Armstrong Road, Puri), আমাদের জানিয়েছেন যে বইগুলি কীটদষ্ট হয়ে প্রায় যাবার দশা,  কাগজপত্রও একেবারে নষ্ট হবার মতো। বাসনপত্র তিনি আমাদের হয়ে বিক্রি ক’রে দিচ্ছেন কিন্তু বই কাগজ ও অন্যান্য খুচরো জিনিস সব একবার শেষ বারের মতো দেখা দরকার। তুমি যদি গিয়ে দুটো কাজ করো তাহলে আমাদের পরিবারের কল্যাণ হয়। প্রথম হচ্ছে বাবা-মার ডায়েরি, চিঠিপত্র, রচনাদি যেন কারো চোখে না পড়ে – তুমি অবিনাশবাবুর সাহায্যে সেগুলি পোড়াবার ব্যবস্থা করো এবং পোড়ানো হয়েছে তা স্বচক্ষে দেখে এসো। দ্বিতীয় হচ্ছে বই। বুঝতে পারো এ বিষয়ে আমার কত গভীর মায়া। অনেকগুলি বই out of print এবং বাকি অনেক বই খুবই মূল্যবান। আমার জীবনে কী হয় কে জানে, হৈমন্তীর ও আমার ইচ্ছা এই যে রক্ষণীয় বই সব শেষ পর্যন্ত সেমন্তীর কাছে যাবে – আর তো কিছু স্মারক এবং পিতৃধন রেখে যেতে পারব না। এ বিষয়ে বাছাই কাজে সম্পূর্ণ তোমার উপর নির্ভর করতে পারি। যেসব বইয়ের রাখবার মতো দশা নয়, সেগুলি হয় পুরীর কোনো লাইব্রেরিতে বা কলকাতায় যেখানে ইচ্ছা তুমি দান করো। যদি কিছু বই বা কাগজপত্র ধ্বংসাবস্থা সত্ত্বেও বিশ্বভারতীর কাজে লাগে তাহলে পুলিনবাবুকে ব’লে তা সমর্পণ করো। কিছু অন্যান্য জিনিস যা আছে যেমন handicrafts, পর্দা ইত্যাদি – তার সঙ্গে   হৈমন্তীর বহু স্মৃতি জড়িত, সে তা ফিরে পেতে চায়। সেগুলি কাউকে দিয়ে ঝাড়িয়ে (অবিনাশবাবু লোক দেবেন) কোনো একটি বাক্সে ভর্তি করে দিয়ো। রাখবার মতো বই এবং রাখবার মতো ঐরকম খুচরো জিনিষ স্বতন্ত্র দুই বড়ো বাক্সে পুরে কলকাতায় Insured Railway Goods-এ পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা কোরো। যদি যতীনবাবু (শ্রীযুক্ত যতীন্দ্রনাথ তালুকদার মহাশয়ের) পরামর্শ নাও তো কোনো একটা জায়গায় বাক্স দুটো বৎসর খানেক ফেলে রাখবার ব্যবস্থা হয়, তুমিও এ বিষয়ে পরামর্শ দিতে পারবে। যদি অন্য উপায় না থাকে তাহলে পুলিনবাবুর শরণাপন্ন হতে চাই। বিশ্বভারতীর কোনো গুদাম ঘরে রেখে দেওয়া যায়। অবশ্য ভালো লোহার বাক্সে বন্ধ ক’রে, – নাহলে পোকায় ইঁদুরে যত ধ্বংস করেছে তা বাড়বে বই কমবে না।

যদি দরকার হয় একবার নয় দুবার তুমি সপ্তাহান্তে পুরী যেয়ো –  যা খরচ দরকার হয় আমরা অকাতরে তা ব্যয় করব বলাই বাহুল্য। কত গভীর পারিবারিক দায়িত্ব এই ব্যাপারের সঙ্গে যুক্ত তা তোমাকে আর কী বলব – দূর দেশ থেকে পিতৃঋণ মাতৃঋণ তাও শোধ করতে পারছি না। কিন্তু তাঁদের নিভৃত কাগজপত্র চতুর্দিকে ছড়িয়ে নষ্ট হলে এবং লোকের হাতে পড়লে আমাদের দুঃখ পাপের অন্ত থাকবে না।

তুমি এ বিষয়ে আমাকে অবিলম্বে জানিয়ো। তোমার চিঠি পেলেই Lloyds Bankকে বলব আরো তোমাকে পাঠাতে। অবিনাশবাবুকে তোমার কথা লিখেছি – তুমিও তাঁকে একটি চিঠি লিখে জানিয়ো যে আমার কাছ থেকে খবর পেয়েছো। কবে তাঁর ওখানে যাবে তাও জানিয়ো। তিনি বৃদ্ধ, এবং জীবনান্ত দশায় উপস্থিত। তাই এখন সব দায়িত্ব শেষ করতে ইচ্ছুক। তোমাকে বিরক্ত করার জন্যে ক্ষমা চেয়ে তোমাকে  লজ্জা দেবো না। তুমি বহুদিন আমাদের পরিবারের সঙ্গে যুক্ত আছ, তোমাকে ঘরের ছেলে ব’লেই মনে করি।

আজ আর কোনো বিষয়ের অবতারণা করব না। – তোমাকে  পাঠানো কবিতা বুদ্ধদেববাবুর দপ্তরে পৌঁচেছে এতে খুসি হয়েছি – তাঁকে আরো তিনটে মার্কিনি কবিতা – অর্থাৎ মার্কিন পরিমন্ডলে রচিত – পাঠিয়েছি। জানিয়ো তোমার কেমন লাগল।

একটা নাটকীয় খসড়া-রচনায় মধ্যে মধ্যে হাত দিই – তার নামকরণ হয়েছে কিন্তু রচনা সম্পূর্ণ হয়নি – যদিও এটা অসম্পূর্ণ রচনার ছাঁদেই শেষ হবে। নাম হচ্ছে ‘রূপ সনাতনের পালা-বদল’। হঠাৎ তোমাদের কাছে একদিন উপস্থিত হবে। এখানে তুষারও পড়ছে, মধ্যে মধ্যে বসন্তের লাইলাক্ও ফুটছে – কিন্তু এখনও শীতের চক্র শেষ হয়নি। যুদ্ধবিগ্রহের চেয়ে বড়ো ঘটনা এই মাটির ঘরের চিরন্তন নবীন অভ্যুদয় এবং সমাপন। এর কোনো শেষ নেই। হৃদয়ের ফুলও ফুটবে ঝরবে, তার উপর সামরিকবৃন্দের কোনো অধিকার নেই। সেই মাটির ঘরেই জন্মেছি, সেইখানে মরেই অমর হব। স্নেহ জেনো।

তোমাদের

অমিয় চক্রবর্তী

 

পত্র ২৭

THE INSTITUTE FOR ADVANCED STUDY

PRINCETON, NEW JERSEY

12th April

1915

 

প্রিয়বরেষু

তোমার চিঠি পেয়ে খুব সুখী এবং আশ্বস্ত হলাম। পুরীর বইয়ের ব্যবস্থা তুমি করলে আমাদের আর ভাবনা থাকবে না। যা কিছু খরচ লাগে তুমি এই চিঠি দেখিয়ে অবিনাশবাবুর কাছ থেকে নিয়ো – কিছু জিনিষপত্র বিক্রির টাকা তাঁর কাছে আছে। যাতায়াতের ভাড়া পাঠানোর খরচ এবং যাবতীয় অন্য যা কিছু লাগে তুমি বিনাদ্বিধায় ওর কাছ থেকে নিয়ো। রাখবার যোগ্য বই এবং দুটারটে ঘরোয়া জিনিষ যা উদ্ধার হয় তা বাক্স করে তোমার flatএ কোথাও রাখো তো সব চেয়ে ভালো হয়। যতীনবাবুকে এখন বিরক্ত করতে চাই না। তা ছাড়া তাঁদের ওখানে ঠিকরকম জায়গার এবং সুবিধার অভাব। তোমার ওখানে না হলে অগত্যা পুলিনবাবুর অফিসে কোথাও রাখতে হয়। কিন্তু আপাতত তোমার ওখানে থাকলেই আমরা সব চেয়ে সুখী হই।

আমার নূতন কবিতা সংগ্রহ ক’রে শীঘ্রই air mailএ তোমাকে পাঠাবো – এইবার একটি নতুন লীরিক সংগ্রহ ছাপাতে চাই। অন্যান্য কবিতার  বইগুলি স্বতন্ত্র ছাপার চেয়ে সবগুলি একত্র ছাপালে কি খরচ কম হবে না? কোনো প্রকাশক কি স্বতন্ত্র বইগুলি বা একত্র সংগ্রহ ছাপাতে উৎসুক আছেন? তুমি সঠিক খবর নিয়ে আমাকে জানিয়ো। সারাজীবনের ফসল এখনই ধূলোয় হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে বিদায় নিতে চাই না – কালক্রমে একদিন সবই মিলিয়ে যাবে। কিন্তু যখন চাষ করেছি তখন ধানের গোলায় একবার জমা করা লেখকের দায়িত্ব। আমি কোন্ বাংলার-বাহির দূর বিদেশে আছি, তোমাদের সহায়তা না হলে উপায় নেই। প্রকাশকের শরণাপন্ন হতেই হয় – সব খরচ জোগানো লেখকের কর্ম নয়। ছাপিয়ে লাভের  আশাটা মরীচিকা – যদিও এসব দেশে কবিতা বিক্রি করেও লোকে বেঁচে থাকে – কিন্তু শুধুমাত্র বই ছাপানোতেও যদি লোকসান দিতে হয় তাহলে সেটা সমাজের দিক থেকে লেখকের প্রতি নির্মম দন্ড। তুমি এ বিষয়ে জানিয়ো। ‘‘অশমায়া’’ কথাটা বৈদিক – উপনিষদেও ব্যবহার হয়েছে – অর্থ : মৃগ-তৃষ্ণিকা  – মরীচিকা। যে-নূতন নাটকের খসড়া করেছি সেটা আলাদা। – গ্রীষ্মের বন্ধে আবার নিয়ে বসব এবং তোমার কাছে পাঠাব। কিন্তু উপস্থিত আমি নূতন ছোট কবিতার [অস্পষ্ট] ছাপাত ব্যস্ত। শীঘ্রই অনেক নূতন লেখা কবিতার পুঁথি পাবে। ‘‘কবিতা’’র মার্কিন সংখ্যা বেশ হয়েছে। বুদ্ধদেববাবুকে লিখ্ছি। তাঁর একটি সুন্দর চিঠি পেয়েছি। প্রীতি জেনো। পাতলা কাগজে আমার দুটা কবিতার একসেট প্রুফ (আমার কাছে রাখবার জন্যে)  air mailএ পাঠিয়ে দিয়ো। তোমার কাছে আমার কিছু টাকা থাকবে এই সব কাজের জন্যে। সঙ্গের cutting তোমাদের দেখা হলে যতীনবাবুকে চিঠিতে পাঠিয়ে দিয়ো।

 

তোমাদের

অমিয় চক্রবর্তী

 

এক

 

ওহায়ো

অমিয় চক্রবর্তী

 

মায়ামি সুন্দরী নদী দুচোখের ভাষা

নিয়ে চলো মায়ানীল জলে,

তরঙ্গে তরলে ছায়া মেঘ এনে দেয়

প্রাণের বন্যায় ভাসা, সন্ধ্যায় সোনালি

দূর যমুনার স্বপ্ন নামে; বালিতীরে

চলি ওহায়োর গ্রামে গ্রামে।

মোটরে চলার বাসা, চক্র রাত্রি দিনে

পথ চিনে উঁচু ঐ গির্জে ঘিরে জনপদ, বাকি,

সারি সারি চেয়ে দেখি : ভোরে তীর্থশেষে

হঠাৎ উঠেছে একি শুভ্র সিন্সিনাটি।

পুণ্য মাটি সহরের, আশ্চর্য সেখানে হাঁটি, মনে

বন্ধুর অচিন্ত্য আলো-লাগা,

কবে কার চরণের স্পর্শে-জাগা পুরোনো পাথর

গাছের মর্মরে শান্তি থরথর, পর্বতে উঁচু পথ,

সেইখানে প্রার্থনায় বহু কণ্ঠে যার কণ্ঠ ছিল

ঢং ঢং ঘণ্টা বাজে মনে হয় তাকে ফিরে চিনি\

 

 

দুই

 

বৈদান্তিক

অমিয় চক্রবর্তী

 

প্রকান্ড বন প্রকান্ড গাছ, –

বেরিয়ে এলেই নেই।

ভিতরে কত লক্ষ কথা, পাতা পাতায়, শাখা শাখায়

সবুজ অন্ধকার;

জোনাকি কীট, পাখী পালক, পেঁচার চোখ, বটের ঝুরি

ভিতরে কত আরো গভীরে জন্তু চলে, হল্দে পথ,

তীব্র ঝরে জ্যোৎস্না-হিম বুক-চিরিয়ে,

কী প্রকান্ড মেঘের ঝড় বৃষ্টি সেই আরণ্যক –

বেরিয়ে এলেই নেই।

ভিতরে কত মিষ্টি ফল, তীক্ষ্ণ স্বাদ, ফুলের তীর,

ইচ্ছে ভরা বুনো আঙুর, জামের শাঁস,

ভিতরে কত দ্রুতের ভয়, কখনো বেলা সময়হীন –

বেরিয়ে এলেই নেই।

চক্রবাল চোখে রেখেই বাহিরে চাই,

গায়ের ধোঁয়া একটু রেখা সন্ধ্যা হলে,

অমাসক্ত নদীর জলে সিক্ত মাটি

বিনা চাষের বুনো ধানের গুচ্ছে রয়,

এখানে সবই বিরলতার।

বুকের মধ্যে বাড়ি-যাবার

খুঁজে পাবার এখনো কোনো চিহ্ন নেই;

দৃষ্টি আছে।।

 

 

তিন

 

প্রত্যাবর্তন

অমিয় চক্রবর্তী

 

দুহাত বাড়িয়ে উড়ে-আসা

অন্ধকার সাঁৎরিয়ে প্লেন চলে শূন্য ঢেউএ দুলে

স্তরে স্তরে কালো হিম অনস্তির মধ্যে পথ কেটে;

তারি আমি সঙ্গঘাত্রী রাত্রির অতলে দেখি ডুবে,

মৃত্যুর তরঙ্গদল নীচে পাশে নিশ্বাসে নিশ্বাসে,

বুকে জ্বলে ঝকঝকে অভ্রান্ত প্রাণের ধক্ ধক্

লাল নীল যন্ত্র চাপ, ধমনীতে বৈদ্যুতী আবেগ

তেল আর তেজবিন্দু সমতা গরম বাষ্পে স্থির;

নেই নেই দৃষ্টি তবু দ্রষ্টা ধ্রুব চলেছে মানসে

ছক কেটে গতিজালে, জানে নীচে বাধা উচুনীচু,

স্তম্ভিত পাহাড় নদী অ-চাওয়া সহর ছেয়ে চলে

পথের আঙুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে; ডাঙা দূর বায়ু-হারা;

লাগে সাঁতারের মগ্ন উড়ো নেশা সমতা পূর্ণন;

যোগসঙ্কটের ক্ষণ ধৈর্য্যে ধ’রে পেরিয়ে আবেশ

স্পন্দিত আভার স্তম্ভে ঠেকে শেষে হঠাৎ শিকাগো

লক্ষ লক্ষ দৃষ্টি আলো সাদা বিন্দুজালে মরীচিকা

জমে ওঠে মানুষের বিস্তীর্ণ ইচ্ছায় সাহরিক;

অস্তিত্বের টানে ফের পুরোনো দাবির পৃথিবীতে

চাকা ছোঁয় পাত্থুরে উঠোন।।

 

 

পত্র ২৮

Middle Atlantic

1 June 1951

 

কল্যাণীয়েষু

[…] দূর যাত্রায় বেরিয়েছি, কিন্তু বেশি দিনের জন্যে নয়। প্রধানত জর্মানির বিভিন্ন [….] আমার পালা, পূর্ব পশ্চিম সীমান্তের সমস্যা ওদের জীবনে কীভাবে […] হয়ে উঠছে তাও বুঝতে চাই। প্রথমে কয়েকদিন অকসফোর্ডে ও লন্ডনে থাক্ব।

ভ্রমণবৃত্তান্ত মধ্যে মধ্যে পাঠাব কিন্তু ইতিমধ্যে তোমার কাছে পুরীর কথা পাড়তে চাই। তুমি কি আবার গিয়ে ব্যাপারটাকে শেষবারের মতো গুটিয়ে নিতে পেরেছ? অর্থাৎ যা পাঠাবার, যা দেবার, যা নূতন বাক্সে বন্দী করবার তার ব্যবস্থা হয়েছে? তুমি জানো তোমার উপর আমাদের কতখানি নির্ভর। যা-কিছু খরচ লাগবে অবিনাশবাবুর কাছে আমাদের যা টাকা আছে তার থেকে তিনি দেবেন, একটুও দ্বিধা কোরো না। তা ছাড়া আমি দেখলাম কিছু অর্থ তোমার কাছে থাকলে ভালো হয়, আমাদের তরফে মধ্যে মধ্যে খরচে লাগবে। লন্ডনে পৌঁছেই আমি পাঠিয়ে দেব।

পুরীর কথা আবার বলে নিই। ডায়েরি চিঠিপত্র নির্মম চিত্তে তুমি ধ্বংস কোরো – আর জায়গা জুড়ে লাভ নেই। বাকি তোমার পরামর্শমতো নূতন বাক্স নিয়ে তাতে রেখে কলকাতায় তোমার flatএ হলেই ভালো। যেখানে হয় ফেলে রেখো। এই শেষ সৎকার না হওয়া পর্যন্ত মন বড়ো অশান্ত হয়ে আছে।

তা ছাড়া দ্বিতীয় কথা, আমার নূতন কবিতা সংগ্রহ। আমার কবিতা সম্বন্ধে তোমার মায়াদয়া ঘোচেনি, এটা আমার কাছে আশ্চর্য ঘটনা। তুমি যদি ছাপ্বার ব্যবস্থা করো তাহলে আমি নিশ্চিন্ত হই। ছোটো একটি সুদৃশ্য পুঁথি – যে-কোনো প্রকাশক দুতিন মাসের মধ্যে ছাপতে প্রস্ত্তত তাঁকেই দিয়ো। যদি কেউ খরচের অন্তত আংশিক ভাগ নেন তাহলে অত্যন্ত সুখী ও কৃতজ্ঞ হই, তা না হলে সাধ্যমতো খরচে আমাকেই ছাপতে হবে, খুবই সাদাসিধে ভাবে। কীরকম খরচ লাগবে জানালে আমি অবিলম্বে কিছু অর্থ তোমাকে আগামী পাঠিয়ে দেব, তুমি আমাকে লিখো।

আমার মনে যা আছে তা এই : কবিতার বইয়ের নাম দেব ‘‘ছড়ানো মার্কিনি’’। এর প্রথম অংশে মার্কিন দেশে  ছড়ানো আমার মার্কিনি কবিতা থাকবে – দ্বিতীয় অংশে ভারতবর্ষে যে-কবিতা মাসিকে ছাপিয়েছি অথচ বইয়ে বেরোয় নি। মার্কিনি কবিতা আরো জমে উঠছে। শীঘ্রই তোমাকে কপি করে আরো গোটা ১০/১২ ছোটো নূতন কবিতা পাঠাব। ইতিমধ্যে ওখানে ‘‘কবিতা’’, ‘‘বৈশাখী’’ ইত্যাদি থেকে তুমি যদি আমার কবিতা সংগ্রহ করে রাখো। আমার যা মনে আছে তা লিখছি

১) পাঁচটা কবিতা – বাংলার দুর্ভিক্ষের সময়ে folderএ ছাপানো (‘‘অন্নদাতা’’ ইত্যাদি)

২) তিনটে কবিতা – (‘‘সন্দ্বীপ’ ইত্যাদি) রংমশাল প্রেসে  folder করে ছাপানো

৩) বোধিমন্দির – রামকৃষ্ণ মিশনের বাংলা বার্ষিকীতে ছাপা (আমি দেশ থেকে রওনা হবার পরেই বেরিয়েছি)

৪) ‘‘কবিতায়’’ প্রকাশিত ডায়েরি থেকে ৫/৬টা কবিতা, তুমি  চয়নের ভার নিয়ো, আমি শুধু ছোটো কবিতা কয়েকটা রাখতে চাই।

৫) ‘‘কেঁদেও পাবে না তাকে বর্ষার অজস্র জলধারে’’ কবিতা –  সেটা বেরিয়েছিল কোনো ছোটো পত্রিকায়, নাম মনে পড়ছে না, না পাও তো আমার কাছে কপি আছে।

৬) ‘‘উত্তর ভারতী’’ কবিতা – (প্রথম লাইন – ‘উদাত্ত কঠিন তোমার রাষ্ট্র পথ, উত্তর ভারতী’ -) কোথায় বেরিয়েছে আমার মনে পড়ছে না – বোধ হয় আমার কাছে কপি নেই।

৭) ‘‘প্রেম যুগে যুগে’’ কাব্য সংগ্রহে আমি একটি কবিতা দিয়েছিলাম সেটা বেরিয়ে থাকলে তার থেকে নিয়ো।

৮) ‘‘মানস-সরোবর’’ নামে কবিতা – কোন্ পত্রিকায় দিয়েছিলাম মনে পড়ছে না। এটা রাখা দরকার।

৯) ‘‘মাসিক বসুমতী’’তে প্রকাশিত ‘উজ্জ্বলা’ নামে ছোটো কবিতা।

১০) একটা রাত্রির কবিতা। ভোরে যাত্রাপথ ‘‘রঞ্জিত নিশান্ত রাঙা’ – লম্বা কবিতা, সেটা রাখতে চাই। কিন্তু প্রথম লাইনও মনে পড়ছে না, কোথায় বেরিয়েছিল তাও মনে নেই। কোথাও কপি থাকে তো তা কাগজের সমুদ্রে কোথায় তলিয়ে আছে – হয়তো Elgin Roadএ, নয়তো Harvard University [তে]।

আমার কবিতার অবস্থা তো দেখছ। এই বেলা নূতন ছোটো সংগ্রহ না করলে আর খোঁজই পাওয়া যাবে না। হঠাৎ আমার যদি জাহাজ ডোবে বা এরোপ্লেন থেকেই… মৃত্যু পেরিয়ে যাই তাহলে তো কথাই নেই! আর সত্যিই আমি [যত্ন?] সহকারে বাংলা ভাষার সেবা করেছি – এখনো নানা বাধা বিঘ্ন সত্ত্বেও সত্যরক্ষা করছি তার প্রমাণ তুমি পেয়েছ। আমার  কাব্যের দুএকজন পাঠক যদি কেউ থাকেন তাঁদের কাছ থেকে অপ্রকাশিত (বই আকারে) আমার কবিতার সন্ধান পেতে পারো – বেশির ভাগ তোমারই জানা থাকবে।

মার্কিনি অংশের জন্যে ভাবনা নেই – তোমাকে পাঠানো ‘‘ধান করো, ধান হবে’’ সেইটেই বইয়ের প্রথমে দিতে চাই; তা ছাড়া তোমাকে পাঠানো ‘‘গর্জন চক্রের পারে’’ এবং সম্প্রতি ‘‘কবিতায়’’ পাঠানো ৫টা কবিতা।

তোমার মন্তব্যের জন্যে উৎসুক হয়ে রইলাম।

তুমি আমার Editor হয়ে কবিতাগুলি সংগ্রহ ও ছাপাবার ভার নাও – এবং এজন্যে ব্যবসা সঙ্গত যে-দিক আছে তারও ব্যবস্থা হবে, যদিও সেটা জানি তোমার কাছে গৌণ। কিন্তু আমার একটু যে দায়িত্ব আছে তা পূরণ না হলে আমার মনে তৃপ্তি থাকবেনা। সে বিষয়ে শীঘ্রই জানতে পারবে – লন্ডনে পৌঁছেই ব্যবস্থা করব।

অনেক কাজের কথা হল। তাই হাওয়া বদলাবার জন্যে তোমার কাছে দুটো নতুন লীরিক কবিতা পাঠাই, মার্কিনি অংশে বসবে। য়ুরোপে আমার ঠিকানা – C/O American Express Co.

6 Haymarket

London, England

যেখানেই থাকি, তারা অবিলাসে পাঠিয়ে দেবে। তোমার কথা লিখো।

প্রীতি অভিবাদন জেনো।

 

তোমাদের

অমিয় চক্রবর্তী

 S/S EUROPA

 

শিল্প

তাতে এনে বসালেম বুক থেকে রোদ্দুরের সুতো,

নীহারিকা পাড় বোনা, বিদ্যুতি জরির উদ্ভবে :

তোমার পায়ের প্রান্তে লুটোবে যখন যাবে দ্রুত

প্রাণের বসন্ত দিনে কত কী উৎসবে।

কত তুলো, কত রং, কত মায়া, কত কল্পনায়

তোমার সে বেণারসি বোনা হয়;

তুমি তো জানোনা,

পরে শুধু আশ্চর্যের লগ্নে তুমি হও অন্যমনা।

 

যা দিয়েছি লাল সে তো প্রাণরক্ত, অন্য সে রক্তিমে;

অাঁচল সোনালি গাঢ় আমারি প্রেমের মুগ্ধ হিমে;

অঙ্গে কত স্পর্শভরা জড়ায় অস্পর্শ আলিম্পন

সাত-পাকে ঘোরে যবে তোমার জীবনে শুভক্ষণ;

মর্তে এসে মাঙ্গলিক রেখে যাই,

অনামী শিল্পের গায়ে বাসনার ধেয়ান মেশাই;

তাঁতির আঙুল জানে কত সুতো গেঁথে গেঁথে শেষে

প্রাণে প্রাণে কত দানে তোমায় অর্ঘের দান মেশে\

 

অমিয় চক্রবর্তী

Princeton

March 4

1951

S/S EUROPA

 

 

বিনিময়

 

তার বদলে পেলে –

সমস্ত ঐ স্তব্ধ পুকুর

নীল বাঁধানো স্বচ্ছ মুকুর

আলোয় ভরা জল –

ফুলে নোওয়ানো ছায়া ডালটা

বেগ্নি মেঘের ওড়া পালটা

ভরল হৃদয়তল –

একলা বুকে সবই মেলে।।

 

তার বদলে পেলে –

সাদা ভাবনা কিছুই-না-এর

খোলা রাস্তা ধূলো পায়ের,

কান্না-হারা হাওয়া –

চেনা কণ্ঠে ডাক্ল দূরে

সব হারানো এই দুপুরে

ফিরে কেউ-না-চাওয়া।

এও কি রেখে গেলে।।

 

অমিয় চক্রবর্তী

ন্যু হেভেন

কন্।

 

পত্র ২৯

Luxemburg

Sept 10 1951

 

প্রিয়বরেষু

নরেশ

য়ুরোপ-ভ্রমণ সারা করে আজ আমার সাম্প্রতিক মার্কিন আবাসের  দিকে ফিরছি। শীঘ্রই আকাশ-পক্ষ বিস্তার ক’রে অতলান্ত সমুদ্র পার হব। এই তিনমাসে ডেনমার্ক্ থেকে ভিয়েনা, প্যারিস, লন্ডন,  আম্স্টারডাম, জেনিভা এবং বহু জর্মান সহরে ও গ্রামে কাজে ও ভ্রমণে ঘোরাঘুরি করেছি। বহু দুঃখী জর্মানিতেই বেশির ভাগ সময় ছিলাম – বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিতে হয়েছে, তাদের জাতীয় জীবনের নানা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করেছি। বিচ্ছিন্ন, অধিকৃত এবং ডেমক্রাসির তাড়নায় পুনর্বার যুদ্ধায়জনের দিকে তাড়িত শঙ্কিত জর্মানির বেদনা খুবই অনুভব করলাম। কিন্তু আমার বিশ্বাস চিরন্তন জর্মানি আবার সংগীতে, সাহিত্যে, স্থাপত্যে এবং গভীর আধ্যাত্মিক জীবনের বিচিত্র প্রকাশে জয়ী হবে। নাট্সিজ্ম্-এর বিষ এবং সমতুল্য বর্বর ডেমক্রাটিক বোমা-ঘাতকদের ঘৃণ্য হন্যতার ফলে জর্মানির জীবন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়েছে, কিন্তু জাগরণের নিভৃত চিহ্ন সর্বত্র। ‘‘পূর্ব’’-জর্মানির সঙ্গে বিশেষ  পরিচয় হয়নি কিন্তু বার্লিনের সোভিয়েট অধিকৃত অঞ্চলে জুলাই মাসে এবং আগস্টে গিয়েছিলাম। অনেক বিষয়ে পূর্ব-অঞ্চলের অবস্থা ঢের ভালো, যদিও ‘‘সার্বিক’’ রাষ্ট্রতন্ত্রের totalitarian পুলিশ-গিরি সে-ও মস্ত এক বিপদ।

Lloyds Bank কি মাস দু-তিন আগে তোমাকে কিছু পাঠিয়েছিল? আমার নূতন কবিতার বই ছাপানোর বিষয়ে কিছু কি অগ্রসর হতে পারলে – মধ্যে তো গ্রীষ্মের ছুটির বাধা পড়ল। আমিও এ বিষয়ে মনোযোগ দিতে চাই – নূতন কবিতা কিছু জমেছে পরশু New York পৌঁছেই তোমাকে পাঠব। আমার ঠিকানা Institute For Advanced Study, Princeton, N.J. USA। হৈমন্তী আর সেমন্তী ভালো আছে – কালই তাদের কাছে উপস্থিত হব। তোমাদের খবর দিয়ো আর আমার প্রীতি নমস্কার জেনো।

তোমাদের

অমিয় চক্রবর্তী।

 

পত্র ৩০

Address : – Dept. of English

The University of Kansas

Lawrance, Kansas, USA

Nov. 2nd, 1957

 

প্রিয়বরেষু

নরেশ,

তোমার শারদীয় চিঠি পেলাম – বাংলাদেশের সব গ্লানি এবং নিরাশা উত্তীর্ণ হয়ে যে নীলাঞ্জন উত্তীর্ণ হয়ে পূজার ছুটিতে দেখা দেয় তারই অশ্রুত সানাই আমার কাছে পৌঁছল। একদিকে ভারতীয় সংসারের ভগ্নদশা দ্রুত বিপ্লবের দিকে চলেছে এবং সে বিপ্লবের কাল মোটেই শোভনীয় বা সহনীয় হবে না তাও জানি। অন্যদিকে একটি চিরন্তন মানবিক সহজতা এই দুঃখের স্বদেশেই নিয়ত জেগে আছে। বিদেশের চোখ দিয়ে সেই পরিব্যাপ্ত আত্মীয় জল স্থল লোকালয়কে বারে বারে প্রত্যক্ষ স্পর্শ করি। হঠাৎ মনে পড়ে যায় বাংলাদেশে সুগন্ধি সাদা ফুল কেয়ার গন্ধ, কারো বাড়িতে বিজয়াদশমীর উৎসবে ধূপ জ্বলছে। হাল্কা সাদা কাপড়জামা পরে স্বচ্ছন্দে যাওয়া আসা; একটি নিবিড় পরিচয়লোকে বিচরণ করা। তোমরা তারি মধ্যে আছ, আলাদা ক’রে দেখবার তেমন প্রয়োজন ঘটেনা, – যদিও মনের শিল্প দিয়ে আশ্চর্যতাকে তোমাদের সৃষ্টিশীল জীবনে নিশ্চয়ই নিয়ত ফিরে পাও – কিন্তু আমরা সাতসমুদ্রের পারে ঐ কলকাতা বা গাঁয়ের হাটে মাঠে চলাফেরা জীবনকে পরম জীবনের প্রতিচ্ছবির মতো দেখি। জানিনা আবার কবে সত্য সত্যই ঐ বাংলাজীবনের বাঙালি হ’য়ে, ঘুরব – আপাতত মার্কিনে পরবাসী এই বাঙালিত্বকে তোমাদের চিঠি পত্রের মধ্য দিয়ে এবং অন্তর্লীণ কল্পনার নিবিড়তায় আস্বাদন করা ছাড়া উপায় নেই। শীতকালের কলকাতায় অজস্র কৃষ্ণচূড়া আর সোনাঝুরির তেল দিয়ে ফুটপাতে হাঁটতে ইচ্ছে করে – কখনো মনে হয় গোলদিঘির ধার দিয়ে সিগ্নেট প্রেসের নতুন বইয়ের দোকান দেখে আসি। সদ্য ছাপা কোনো নতুন বাংলা বই পড়তে পড়তে অত্যন্ত ভিড়াক্রান্ত বাসে আধ ঘণ্টা কীভাবে কেটে গেল বুঝতেই পারব না। এদেশে চায়ের স্বাদ নেই, কেবল বাদামি গরম জল মাত্র। দার্জিলিংএর চা পাত্রে ঢেলে কলকাতার ঘরে গল্পের অবসর খোলা যেত, হয়তো বা পাশের একটা খাতা পেন্সিল হাতে নিয়ে একাকী গীতিকাব্য রচনার সঙ্গে সঙ্গে চায়ের বেলা কাটত। বাংলা গানের জন্যে যথার্থই ক্ষুধা জেগে থাকে, – দেশে ফেরার জন্যে ঐ একটা কারণই যথেষ্ট। যদিও গাইতে জানিনা এবং পশ্চিম জগতে ভারতীয় রাগরাগিণী শোনার সুযোগ দুর্লভ এমন কি অলভ্য বল্লেই চলে তবু দেবতার একটি প্রসঙ্গে আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কেউ জানেনা আমার মন ভারতীয় সঙ্গীতে কতদূর গভীর অভিষিক্ত – গানের পর গান, অথবা কোনো সময়ে বিভিন্ন রাগিণীর আলাপ দীর্ঘ প্রহর ধ’রে মনে মনে স্পষ্ট শুনতে পারি। রবীন্দ্রনাথের গান সুরে বাক্যে অভিন্ন হ’য়ে মনে সম্পূর্ণ অটুট ধরা দেয়; ট্রেনে চলতে, মার্কিন দ্রুত সহরের ভিড়ে বা এরোপ্লেনের অতন্দ্র আকাশবর্তী ক্ষণে কত যে গানের সুধা সমস্ত চৈতন্যকে ভরে তোলে তা কেউই জানে না। দীর্ঘকাল ধ’রে মনে মনে বাংলা কবিতা আবৃত্তির স্মরণসঞ্চিত দৈব দয়ায় আমি পেয়েছি – এই আমার দেশের সঙ্গে আরেকটি অচ্ছেদ্য স্বাধীন যোগসূত্র। সঙ্গে সঙ্গে চলমান মার্কিন জীবনতাও মিশ্রিত হয়, কিন্তু একটি বিশিষ্ট ধারা মনে বইতে থাকে যা নৈর্ব্যক্তিক  সর্বমানবীয় নয়, মিশ্রণ অত্যন্ত বিশেষভাবে বাঙালি। জন্মের মাটি আর মেঘের ছায়া অনন্তের অঙ্গাঙ্গীরূপে একই কালে জীবনে থেকে যায়; এর রহস্য কে কবে বোঝাবে ব’লো?

আমেরিকায় যে-বন্ধুত্ব, গৌরব এবং প্রতিষ্ঠা অজস্র হয়ে আমার বিদেশী জীবনে ঘটল তা বড়ো আশ্চর্য। দেশেও এমন অগাধ বিশ্বাস, সম্পূর্ণ সহযোগিতা, কর্মের পরিবর্তমান মুক্ত ক্ষেত্র ও ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আমার ভাগ্যে বছরের পর বছর দেখা দিত কিনা সন্দেহ। আর্থিক কারণেও আমাকে এদেশে বেঁধেছে। হয়তো এইভাবে বছর দুয়েক কাটবে, কে জানে দূর পশ্চিমের মহাসিন্ধুকূলেই হঠাৎ জীবন শেষ হবে কি না। এ নিয়ে খেদ করব না – যতদিন বিদেশে আছি চিন্তায় মননে দিন ভ’রে উঠুক্, নূতন জগতে ভারতবর্ষকে সর্বদাই নানাভাবে প্রচার করবার সুযোগ পাই, সামরিক বর্বর ছায়াবৃত আধুনিক কালে ষড়যন্ত্রবিরোধী ভারতী মানবধর্ম প্রকাশ করবার জন্যেও আমাদের বিদেশবাস প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে না গেলে বাংলা কথা বলব কী ক’রে? বাংলা কবিতা লেখবার পরিমন্ডল কোথায়? যেটুকু বাংলা বলি বা লিখি তাতে মন অতৃপ্ত থেকে যায়। আমার পক্ষে এইটে মস্ত এক শাস্তি।

গ্রীষ্মের তিন মাস জর্মানীতে বেশির ভাগ ছিলাম – তোমাকে চিঠি লিখেছিলাম পাওনি – ইংরেজি টাইপ করা সাধারণিক পাঁচটা চিঠি আশা করি প্রত্যেকটি পেয়েছ। বুদ্ধদেববাবুর কাছেও পাঠাতে বলে দিয়েছিলাম। American Friends Serviceকে আমি অত্যাচারিত য়ুরোপের বহুদুঃখী নানান্ সংবাদ ইত্যাদি চিঠির আকারে পাঠিয়েছিলাম। তার অনেক প্রসঙ্গ হয়ত তোমাদের কাছ থেকে বহু দূরে, কিন্তু গভীরতর মানবিক আশা-নিরাশার ঘটনার কাছেও নয়, দূরেও নয়, সবাই তারই মধ্যে সহজীবী। বাংলায় লিখলে এবং সময় থাকলে সম্পূর্ণ বইয়ের আকারে বিবিধ ঘটনা, নানা লোকজনের ছবিতে ভ’রে যথার্থ ভ্রমণকাহিনী গ’ড়ে তুলতাম। যেটুকু ভাবনায় ধরতে পেরেছি তা এই পত্রাবলীতে পাবে। ডেনমার্ক, হল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, সুইট্জরল্যান্ড, গ্রীসেও ছিলাম – ইংলন্ডে দুবার যেতে হয়েছিল। বাসে, মোটরে, ট্রেনে, এরোপ্লেনে য়ুরোপের বহু সহরে ও বিচিত্র রাষ্ট্রিক আবহাওয়ায় প্রবেশ করেছি। গ্রামের অতিথি হয়ে বাস করেছি, ছাত্র ও শিল্পী সমাজে দিন কাটিয়েছি। য়ুরোপের ভবিষ্যৎ খুবই অন্ধকার। ঐ অন্ধকারে সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রদীপ জ্বলে উঠছে অসীম দুঃখাভিহত জর্মানীতে – স্বদেশী বিদেশী এত পাপের বন্যা পেরিয়ে জর্মানীর নূতনেরা কূলে পৌঁচেছে এ বড়ো আশ্চর্য ঘটনা। অথচ ওদের সামনেও প্রচন্ড মরণপর্ব দ্রুত এগিয়ে আসছে। আরেকটি কোরিয়া বধের ভ্রাতৃঘাতক অভিনয় [।]  সঙ্গে সঙ্গে পুরোনো গির্জায়, অন্তরালবর্তী জ্ঞানের সাধনাক্ষেত্রে [,] সর্বহারা ছাত্রদের অটুট অধ্যবসায়ী জীবনে অপরাজিত শিল্প, ধ্যান, সাহিত্য ও কর্মের উদ্দীপনা সর্বত্র দেখে এলাম।

এখনও আমার ‘‘মার্কিনি’’ নামধেয় নূতন ক্ষুদ্র কাব্য সংগ্রহের কথা বলি। আমার বিশ্বাস ‘‘দূরযানীর’’ নূতন সংস্করণ এবং ‘‘মার্কিনি’’ দুটি স্বতন্ত্র বই আকারে এখন বেরোনো দরকার। প্রথমে ছাপতে চাই শেষের বই – গোটা পঁচিশ ত্রিশ লীরিক সংগ্রহ, সদ্য লেখা। শেষ পাঁচ বছর যা ছাপিয়েছি তার সন্ধান তোমার জানা আছে। বইয়ের শেষাংশ বাংলার দুর্ভিক্ষ কালে ছাপানো পাঁচটা কবিতা (folder আকারে পাঁচ খন্ড পর পর বেরিয়েছিল), আরেকটি folderএ ছাপা ‘‘সন্দ্বীপ’’ ও অন্য  কয়েকটি কবিতা (নোয়াখালি গৃহযুদ্ধের কালে রচিত) এবং কবিতার কবিতা সংগ্রহ। কবিতায় ছাপা ‘‘ডায়েরি’’র শুধুমাত্র ছোটো দুটো চারটে কবিতা ঐ অংশে দিতে চাই। তুমি বাছাই ক’রে পাঠালে আমি দেখে পরে ডাকে ফেরৎ দেব। এই সব ব্যাপারে যা-কিছু খরচ হয় তুমি ঐ দুশো টাকা থেকে দিয়ো। তাছাড়া (১) ‘‘বোধিমন্দির’’ কবিতা (২) ‘‘কৈলাশ’’ (৩) ‘‘উজ্জ্বলা’’ (‘‘বসুমতী’’তে প্রকাশিত) (৪) ‘‘প্রেম যুগে যুগে’’ নামক বইয়ে দেওয়া আমার কবিতা এবং অন্য কোনো কবিতা যা তোমার মনে হয় এই বইয়ে যেতে পারে। অজিতবাবুর বার্ষিকি, কবিতা ভবনের বার্ষিকি এবং অন্য পত্রিকা যেমন,  ‘‘চতুরঙ্গ’’, সংকেত ইত্যাদি একটু খুঁজে দেখতে হবে। বাদ বাকি সবই শেষ তিন বছরে কেবলমাত্র ‘‘কবিতা’’য় বেরিয়েছে।

তুমি আমার কাব্যের শেষরক্ষা-ব্যাপারে ভার নাও। আমার বিশেষ আকাঙ্ক্ষা সিগনেট প্রেসে এই ছোট্ট বই সুদৃশ্য অথচ সাদাসিধে আকারে বেরোয় – ছাপার আংশিক খরচ, ধরো ২০০/৩০০ টাকা আমি পাঠিয়ে দিতে পারি। তার পর বই বিক্রির সঙ্গে সঙ্গে হিসাব ঠিক ক’রে নেওয়া যাবে। কিন্তু যদি তা নিতান্তই না সম্ভব হয় তুমি অবিলম্বে অন্য তোমার চেনা কোনো জায়গায় চেষ্টা  কোরো, সিগনেট প্রেসে এ বিষয়ে পরামর্শ নিয়ো। দিলীপবাবু বলে দেবেন কোথায় ছাপানো চলবে। তিন মাসের মধ্যে, অর্থাৎ বড়োদিনের ছুটির পরেই বা আগে, এই ক্ষুদ্র ‘‘মার্কিনি’’ কাব্য পুঁথি হয়ে বাজারে বেরোয় এই আমার অনুরোধ।

সংসারে আমার দেবার যা আছে তা অতি সামান্য। বেঁচেছিলাম এবং দুটো চারটে বাংলা কবিতা লিখেছিলাম এই আমার পরিচয়। প্রবাসে ভ্রমণকালেও বাংলা কাব্যের কিছু সাধনা করেছিলাম এইটুকু আমার ক্ষুদ্রকায় নূতন সংগ্রহে জানিয়ে যেতে চাই। এই ইচ্ছেটুকুও যদি পূর্ণ না হয় তাহলে গভীর দুঃখে আমার পালা শেষ হবে।

তুমি সব কথা ভেবে দেখো এবং বন্ধুজনের সহযোগিতায় এই কর্মটুকুর ভার নিয়ো। এ বিষয়ে আমার আর কিছু বলবার নেই।

বিশ্বভারতীর কর্তৃপক্ষ দুচারজনকে তোমার বিষয়ে লিখেছিলাম – মনে হয়েছিল ওখানে অধ্যাপনা করলে হয়তো তুমি সুখী হবে। বিশ্বভারতীর পক্ষেও তোমার দান মূল্যবান হবে মনে করি। তুমি অন্নদাশঙ্করবাবুর সঙ্গে দেখা ক’রে এ বিষয়ে কি আলোচনা ক’রে দেখবে? আমার উল্লেখ ক’রে তাকে জানিয়ো। অবশ্য কলকাতায় তোমার প্রতিষ্ঠা বেড়ে উঠছে – হয়তো ওখানেই তুমি লেখবার, ভাববার, গড়বার সুযোগ পাচ্ছ। কিন্তু আমার মনে হয় নূতন গড়ে-ওঠার হাওয়ায় বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তোমার পক্ষে বিশেষ অনুকূল হবে।

আজ এইখানে শেষ করি। এখানে প্রত্যেক হপ্তায় আমার ইংরেজি অধ্যাপনার বহির্গত একটি বৃহৎ বক্তৃতার আয়োজন কর্তৃপক্ষ করেছেন। ‘‘Upsurge in Asia’’ নামে  একটি বক্তৃতার ধারা অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার সম্পূর্ণ ভার আমার উপর – ভারতবর্ষ এবং পূর্ব এশিয়ার প্রত্যেক দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং আধুনিক  জাগরণের সবিশেষ বৃত্তান্ত প্রকান্ড জনতার সামনে আমাকে উপস্থিত করতে হয়। ছাত্র, অধ্যাপক এবং স্থানীয় ও পার্শ্ববর্তী বহু অধিবাসী প্রত্যেক মঙ্গলবার সন্ধ্যায় দুঘণ্টার জন্যে এই Kansas বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে উপস্থিত হন – বক্তৃতার পূর্বে ছাপানো সারমর্ম, Bibliography (পুস্তক তালিকা) প্রশ্ন সংগ্রহ ইত্যাদি আধুনিক এশিয়ার বহু প্রসঙ্গ ও আধুনিক ইতিহাস এদের পক্ষে উপাদেয় মোটেই নয়, কিন্তু সেই কারণেই ব্যাখ্যার ভার নিয়েছি। পরিশ্রম ও দায়িত্ব কম নয় বুঝতেই পারো। হেমন্তের আগুনে রাঙা ঝ’রো পাতার গাঢ় সোনার আলো প্রতিফলিত – চতুর্দিকে একটি অবসান পর্বের অন্তিম সৌন্দর্য দেখা দিয়েছে। আজ প্রথম অল্প তুষার পড়ল – রঙিন পাতার উপরে সাদা স্পর্শ।

তোমার চিঠির  প্রতীক্ষায় রইলাম।

প্রীতি অভিবাদন জেনো।

তোমাদের

অমিয় চক্রবর্তী

পত্র-৩১

THE UNIVERSITY OF KANSAS

LAWRANCE, KANSAS, USA

DEPARTMENT OF ENGLISH LANGUAGE AND LITERATURE

December 8, 1957

 

 

প্রিয়বরেষু

নরেশ,

সমুদ্র পেরিয়ে চিঠিপত্রের সাঁকো-রচনার আশা দেখছি ভাঙ্বার দশা – আমার ‘‘ছড়ানো মার্কিন’’ বই ছাপানোর বিষয়ে তোমার কাছ থেকে উত্তর পাইনি। তার আগে তোমার পাঠানো চিঠি দুএকটা বোধ হয় য়ুরোপের মাঠে মারা গিয়েছিল। কিন্তু তবু ভরসা সম্পূর্ণ ছাড়ব না। পূর্ব পত্রে তোমাকে মেঘের টুক্রো কয়েকটা ছোটো কবিতা এরোপ্লেন থেকে পাঠিয়েছিলাম। এদিকে আরো কয়েকটি পূরোপূরি কবিতা জমে উঠেছে।

[য়ুরোপা] এক অংশের নাম ‘‘য়ুরোপো’’, অন্য অংশ ‘‘ভারতী’’ এবং প্রথমের দিকটা ‘‘ছড়ানো মার্কিনি’’ – সব সুদ্ধ বইয়ের নাম ‘‘ছড়ানো মার্কিনি’’ এই ভাবে কাব্য সংগ্রহ বার করতে উৎসুক হয়েছি। সিগনেট প্রেসে ছাপানো সম্ভব কিনা সবিশেষ জানিয়ো। তা না হলে অন্য কোথাও ছাপাবার পরামর্শ দিলীপবাবু এবং অন্য সুহৃদ্ দুএকজনের কাছ থেকে আমার নাম ক’রে জেনে নিয়ো। সংসারে কতদিনই বা বাঁচব – কৃতকর্মের দায়িত্ব স্বরূপে কবিতা ক-টার ব্যবস্থা ক’রে যাওয়া প্রয়োজন মনে করি। ‘‘য়ুরোপা’’ অংশের নতুন কবিতা তোমাদের ভালো লাগবে।

‘‘ভারতী’’ অংশের জন্যে ‘‘উদাত্ত কঠিন তোমার রাষ্ট্রপথ, উত্তর ভারতী’’ কবিতাটা দরকার – একবার পুনর্দর্শন ও সংশোধনও  আমার দিক থেকে জরুরি মনে হচ্ছে। কিন্তু কবিতার কপি জোগাড় ক’রে আমাকে পাঠাতে পারো? আমার কাছে নেই। বিমল ঘোষ মহাশয় ঐ কবিতা এবং আরো অন্য দুএকটা কবিতার সন্ধান দিতে পারবেন। তা ছাড়া ‘‘যেখানে গেলে শান্তি পাই’’ নামক কবিতা। যদি পাঠাতে পারো তাহলে অত্যন্ত আনন্দিত ও কৃতজ্ঞ হব।

‘‘আষাঢ়ে’’ এবং অন্যান্য বার্ষিকী যদি চোখে  পড়ে (অজিৎ দত্ত মহাশয়ের বার্ষিকীতেও কিছু কিছু দিয়েছিলাম) তাহলে আমার ‘‘ভারতী’’ অংশের কথা মনে রেখো। বাছাই ক’রে খুবই কম সংখ্যক কবিতা রাখতে চাই।

এইবার আমাকে যেমন ক’রে হয় এই ছোটো কাজটা সমাপন করতে হবে – তোমাদের বিশেষ সহায়তা আমার প্রয়োজন। এত দূর থেকে কীভাবে আমার ব্যাকুলতা জ্ঞাপন করব জানি না। ছাপানোর আংশিক ভারবহনের চেষ্টা করব, তা পূর্বেই লিখেছি। যদিও কন্যার বিবাহে এই অত্যন্ত খরচের দেশে অনেকখানি দায়িত্ব সানন্দে নিতে চাই। যেভাবে উৎসবকে পরিপূর্ণ ক’রে তুলতে চাই তা পারব না – কিন্তু সেই আনুষ্ঠানিক এবং সামাজিক পরিপূর্ণতা বিদেশে কোটি  অর্থের দ্বারাও সম্ভবপর নয়। দেশের  সানাই আমরা পাব কোথায়? এই বিবাহে আমরা সবাই একান্ত উৎসাহিত – ছেলেটি যেমন বুদ্ধিমান সেইরকম চরিত্রে ও সংস্কারে অত্যুজ্জ্বল। জানি তোমাদের সকল শুভকামনা ওরা দুজনে পাবে।

এই চিঠির দ্রুত উত্তরের প্রয়াসী হয়ে রইলাম।

প্রীতি নমস্কারান্তে

তোমাদের

অমিয় চক্রবর্তী

 

পত্র ৩২

THE UNIVERSITY OF KANSAS

LAWRANCE, KANSAS, USA

DEPARTMENT OF ENGLISH LANGUAGE AND LITERATURE

2nd Jan-52

 

 

প্রিয়বরেষু

তোমার চিঠিখানি পেলাম – এখন খুবই উৎসুক হয়ে তোমার পাঠানো কবিতার কপি হাওয়াই-ডাকে প্রতীক্ষা করব। কবিতা চয়ন ও কিছু সংস্কার করে দ্রুত ফেরৎ পাঠাব – ফেব্রুয়ারিতে যাতে ছাপা আরম্ভ হতে পারে। তিন ভাগ থাকবে – অতি জোর ৫০ কবিতা সব সুদ্ধ – য়ুরোপা, ছড়ানো মার্কিনি, এবং ভারতী। প্রথম অংশ ছড়ানো মার্কিনি-তাইতেই সমগ্র বইয়ের নাম।

কোনো সময় বিশেষ একটি দুটি কবিতার আলোচনা পত্রযোগে করা যেতে পারে, যেখানে অর্থ স্পষ্ট নয় তারই বিশেষ আলোচনা। কেননা ধ্বনি অর্থকে এগিয়ে দেয় – কিন্তু ধ্বনি দিয়ে সম্পূর্ণ ব্যঞ্জনার কাজ হয় না, কবিতার বিষয়টাও স্পষ্ট হলে তবেই ব্যক্তব্য আপনি ব্যঞ্জনা হয়ে ওঠে। অবশ্য স্পষ্ট করবার চেষ্টা অতিমাত্র হলে সে-ও ব্যর্থ হয় – সেই বিপদ বরাবর এড়াতে চেয়েছি। একটি কবিতা সম্পূর্ণ একটি পরিমন্ডল  সৃষ্টি ক’রে তবে আপনাকে ব্যক্ত ক’রে – ধ্বনি, অলঙ্কার, বিষয় সবই এই সম্পূর্ণতার প্রসাধনে যোগ দিলে তবেই তো কবিতা। কখনো বা একগুচ্ছ কবিতার মধ্যে দিয়েও একটি পরিচ্ছন্ন নিবিষ্ট কবিতা ব্যক্ত হয়ে ওঠে। যাই হোক, পরে কখনো কোনোসময়ে আরো আলোচনা করা যাবে। এ সব ব্যাপারে পথিকেরা পরস্পর পথের সংবাদ দিতে দিতে পথে চলে যায়।

সেমন্তীর বিয়ে অতি সুন্দর সম্পন্ন হল। শীঘ্রই অনুষ্ঠানলিপি ইত্যাদি  ন্যুইয়র্ক থেকে পাবে – প্রক্ষিপ্ত বা নিতান্ত সাময়িক পুরোনো কিছু কিছু অংশ বাদ দিয়ে বৈদিক মন্ত্র এবং রীতি আমরা পূর্ণ রক্ষা করেছিলাম – সুনীতি চট্টোপাধ্যায় মহাশয় ঠিক এই সময়ে এদেশে আসায় পৌরোহিত্য পদে যথার্থ জ্ঞানীকে পাওয়া গিয়েছিল।

ডাক্তার মুঙ্কার আমার বিশেষ পরিচিত জ্ঞানী বন্ধু – বহু ভাষাবিৎ। পূর্বীয় যথার্থ ধ্যান জ্ঞানের বই কিছু কিছু তাঁকে পাঠাতে চাই।

বুদ্ধদেববাবু এদেশে আসার সম্ভাবনার কথা শুনেছিলাম – কিছুদিন ঘুরে গেলে ভালো হয় : বেশিদিন এই মরণ-আয়োজন পশ্চিমে সহ্য করা কঠিন। এখন কিন্তু দূর এশিয়ার দিকে দৃষ্টি পড়েছে – সেদিকে নিরন্ত দুঃখের মধ্যেও নবজাগ্রত সৃষ্টিশীল সভ্যতা গড়ে উঠছে। মানবসভ্যতাকে বাঁচাবার পালা এখন স্বাধীন এশিয়ান্ জনশক্তির হাতে। তুমি যদি কোরিয়া (যুদ্ধান্তে) বা ইন্দো-চীন, ইন্দোনেশিয়া, ঐ অঞ্চলে যেতে পারো, বর্ণনা লিখতে পারো তাহ’লে তোমার পক্ষে পশ্চিম দেশে আসাও খুব সহজ হয়। এরা এশিয়ার নূতন সংবাদ শুনতে চায়। খবর পত্রও তাহলে পরে এই সব দেশেই পাবে – কিন্তু পূর্বে কিছু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলে পথ প্রশস্ত হবে। য়ুরোপের আর্থিক  অবস্থা সাংঘাতিক – কিছু তো অর্জন করা অসম্ভব তা শুধু নয়। বিদেশীর  পক্ষে খরচের শেষ নেই, বিশেষত continent-এ। যদিও সেখানে প্রথমটা মনে হয় খরচ কম। আমেরিকা এসে পড়লে খরচ উঠে যায়। কিন্তু আগে চাই বিশেষ দুইএকটা হাতিয়ার। এশিয়ার প্রান্ত-সংবাদ বহন ক’রে ভারতীয় কেউ  এলে তার জন্যে এরা দরজা খুলে দেবে। আমাদের পক্ষেও প্রতিবেশী এশিয়াকে জানা দরকার। ওদিকে খরচও কম। জাপানে যেতে পারলে পথে সবই দেখা যায়। জাপানে যাবার পথ দিল্লী – তারা  নানা লোক পাঠাচ্ছে।

প্রীতি নমস্কার জেনো

তোমাদের

অমিয় চক্রবর্ত্তী

 

পত্রধৃত প্রসঙ্গ

পত্র ২৬

এই চিঠিটি অহর্নিশ পত্রিকার নরেশ গুহ সংখ্যায় মুদ্রিত। তারিখ ১৯৫১ এর স্থলে ভুলে ছাপা হয়েছে ১৯৫৭। টীকা নরেশ গুহ নিজে লিখেছেন :

পুরীর সমুদ্রতীরে অমিয়বাবুর পিতা সুন্দর একটি বাড়ি তৈরি করিয়েছিলেন। মাতাপিতা উভয়ের মৃত্যুর পরে ‘আরুণি’ নামের সেই বাড়িতে স্থায়ী ভাবে কেউ বাস করতেন না। সেখানে রক্ষিত ছিলো দেশবিদেশ থেকে অমিয় চক্রবর্তীদের সংগ্রহ করা বহু মূল্যবান গ্রন্থ এবং সৌখিন শিল্প দ্রব্যাদি। আমেরিকা যাওয়ার সময় প্রয়োজনীয় অর্থের জন্য অমিয়বাবু বাড়িটি বিক্রি ক’রে দিয়ে যান। কিন্তু তাঁর সংগ্রহ করা মহা মূল্যবান দ্রব্যাদি তখনো সেই বাড়িতেই আবদ্ধ ছিলো। অমিয় চক্রবর্তীর ইচ্ছায় বার কয়েক পুরীতে গিয়ে ‘আরুণি’ বাড়ি থেকে সেই সব গ্রন্থ ও দ্রব্যাদি কলকাতায় এনে আমি রক্ষা করার ব্যবস্থা করি। সম্পত্তির প্রধান অংশ ছিলো রবীন্দ্রনাথের দেওয়া স্বাক্ষরিত বহু বই। পুলিনবিহারী সেনের সাহায্যে প্রথম সংস্করণের বইগুলি বিশ্বভারতীতে পাঠানো হয়। এই সুকঠিন কর্ম সমাধা করার জন্য অমিয় চক্রবর্তী প্রয়োজনীয় অর্থাদি আমাকে পাঠিয়েছিলেন। চিঠি থেকে দেখা যাবে অমিয়বাবু তাঁর পিতার ডায়েরিগুলি আমাকে পুড়িয়ে ফেলতে বলেছিলেন, কিন্তু আমি তা করতে পারিনি। বরং সেগুলি সংগোপনে আমি কলকাতায় এনে নিজের কাছেই সাবধানে রক্ষা করেছিলাম। বহুকাল পরে অমিয়বাবুর কন্যা সেমন্তীর হাতে সেগুলি আমি সমর্পণ করি। অমিয়বাবুর নির্দেশ মতো তাঁর পরমাত্মীয় আই.সি.এস. যতীন্দ্র তালুকদারের গৃহে কয়েক বাক্স ভর্তি মূল্যবান দ্রব্যাদি রক্ষা করতে পাঠাই। জানি না পরে সেগুলির কী দশা হয়েছে। উই আর ইঁদুরের স্বাধীন বিচরণের ক্ষেত্র এই দেশে কোনো জিনিষই দীর্ঘদিন অক্ষতভাবে রক্ষা করা দুরূহ। ভারতবর্ষের ইতিহাস তাই এমন জরাজীর্ণ।

 

পত্র ২৭

পুলিনবাবু – পুলিনবিহারী সেন (১৯০৮-৮৪); রবীন্দ্রতথ্যভান্ডারী ও গবেষক। রবীন্দ্ররচনাবলী, চিঠিপত্র (৬, ৯ ও ১১শ খন্ড) সমেত রবীন্দ্রনাথের অগ্রন্থিত বিষয়ানুক্রমিক ২৪টি বই সম্পাদনা করেছেন। বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগের অধিকর্তা ছিলেন। বিশ্বভারতী পত্রিকার সম্পাদনায়ও যুক্ত ছিলেন। রবীন্দ্রগ্রন্থপঞ্জী (১৩৮০) তাঁর অসাধারণ গবেষণাকর্ম।

 

কবিতার মার্কিন সংখ্যা – দ্বি-ভাষিক বিশেষ সংখ্যা; ডিসেম্বর, ১৯৫০। নরেশ গুহের এই পত্র-সংগ্রহের মধ্যে ১২ই এপ্রিল ১৯৫১ তারিখের এই চিঠির সঙ্গে তিনটি কবিতা – ‘‘ওহায়ো’’, ‘‘বৈদান্তিক’’ ও ‘‘প্রত্যাবর্তনে’’র পান্ডুলিপি আছে। কবিতাত্রয়ী কবিতায় ছাপা হয় ‘মার্কিনী’ শিরোনামে চৈত্র ১৩৫৭ সংখ্যায়। পরে পারাপার কাব্যে স্থান পেয়েছে।

 

পত্র ২৮

‘‘ছড়ানো মার্কিনী’’ নামে অমিয় চক্রবর্তীর কোনো কাব্যসংকলন শেষ পর্যন্ত প্রকাশ পায়নি। তবে পারাপার কাব্যে (১৩৬০) ওই একই উপ-শিরোনামে গ্রথিত হয়েছে পঁচিশটি কবিতা।

বৈশাখী – বুদ্ধদেব বসু-সম্পাদিত কবিতাভবনের বার্ষিকী।

কবিতায় প্রকাশিত ডায়েরি – ১৩৫৪-৫৫ সনে কবিতা পত্রিকায় মুদ্রিত ষোলোটি ছোটো কবিতা। (দেখুন, প্রভাতকুমার দাম, ‘কবিতা’ পত্রিকার সূচীগত ইতিহাস, ১৯৮৯, পৃ ৮০)

 

পাঁচটা কবিতা – বাংলার দুর্ভিক্ষের সময়ে folder-এ ছাপানো (‘‘অন্নদাতা’’ ইত্যাদি) – ‘‘… এক-একটি কবিতা প্রথমে রঙিন মোটা তুলট কাগজে… ফোল্ডার আকারে ১৩৫০-এর মন্বন্তরের সময় ছাপা হয়েছিলো। বিজ্ঞপ্তি ছিলো ‘অন্নার্থীর, সাহায্যকল্পে এই কবিতা বিক্রি করা হবে।’ প্রতি ফোল্ডার চার আনা। প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন যামিনী রায় …। প্রকাশক গ্রন্থকার। প্রাপ্তিস্থান – কবিতাভবন, ২০২ রাসবিহারী এভিনিউ; কলকাতা।

‘‘সন্দ্বীপ’’ – পারাপার কাব্যের ‘‘ভারতী’’ অংশে গ্রথিত। দুটো নতুন লীরিক কবিতা – ‘‘শিল্প’’ ও ‘‘বিনিময়’’ পারাপার কাব্যভুক্ত; কবিতাসংগ্রহ ১-এ দেখুন পৃ ১৮২-১৮৩।

 

পত্র ৩০

অন্নদাশঙ্কর বাবু – উদারনীতিক ভাবুক ও সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়; ১৯৫১ থেকে দীর্ঘকাল শান্তিনিকেতনবাসী।

 

পত্র ৩১

‘‘ছড়ানো মার্কিনি’’ – ১লা জুন ১৯৫১ তারিখের পত্রের টাকা দ্র.। ‘য়ুরোপা’ ও  ‘ভারতী’ অংশের কবিতাগুলি পারাপার-এ গ্রথিত। ‘‘যেখানে গেলে শান্তি পাই’’ কবিতার হদিস পাই নি।

পত্র-৩২

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় (১৮৯০-১৯৭৭) ভাষাবিজ্ঞানী ও ভারতের জাতীয় অধ্যাপক; কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক। ১৯৫২-৬৮ সালে বিধানসভার অধ্যক্ষ। তাঁর কীর্তিস্তম্ভ : The Origin and Development of the Bengali language (১৯২৬)।

‘‘ছড়ানো মার্কিনী’’ – তাইতেই সমগ্র বইয়ের নাম – পারাপার কাব্যের প্রথম অংশের নামকরণ হয় ছড়ানো মার্কিনী।

বুদ্ধদেব বাবুর এদেশে আসার সম্ভাবনা – ১৯৫৩ সালে বুদ্ধদেব বসু প্রথম আমেরিকায় যান, পেনসিলভেনিয়া কলেজ ফর উইমেনে এক বছর শিক্ষকতা করেন।