অমূর্তের সম্ভাবনা

অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত

ভাবতে পারা শক্ত যে, বছর কয়েক আগেও এ-ধরনের বিতর্কের শামিল হতে হতো আমাদের। কেননা পেশাদারি রঙ্গমঞ্চের একচেটিয়া আধিপত্যের জমানা কবেই তো নিরস্ত্র হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং রবীন্দ্র-নাট্যের মঞ্চোপযোগিতা নিয়ে সংশয় উত্থাপনের দাবি ক্রমশই ক্ষীয়মাণ হয়ে এসেছিল। ফলত তার স্বয়ংসম্পূর্ণতা নিয়েই রক্তকরবীর মতো নাটক কলকাতার প্রোসিনিয়াম ঋদ্ধ ও বিনোদনময় করে তুলতে পেরেছিল, যেজন্য অবশ্যই শম্ভু মিত্রের মতন নাট্যব্যক্তিত্বের কৃতিত্বকেই নন্দিত করতে হয়। তখনো মেনে নিতেই হবে, রচয়িতার নিজস্ব নাট্যবস্ত্ত (Autoren stuck) ও পরিচালকের মনঃপূত থিয়েটার (Regietheater) বিভাজিত হয়ে যায়নি এবং বিশেষত রবীন্দ্র-নাট্যের মঞ্চায়নের ক্ষেত্রে তাঁর প্রদত্ত স্বরলিপিই ছিল মূলত শিরোধার্য। এই সূত্রে আমাদের মনে হতেই পারে, শম্ভু মিত্র কবির ব্যবহৃত ভাষার অমোঘতা বজায় রাখতে গিয়ে হাইডেগারের এষণাকেই (ভাষাই তো মানুষের অস্তিত্বের কেন্দ্রীয় আকর্ষণ) মর্যাদা দিয়েছিলেন।

কিন্তু এর মধ্যে সময়টা নির্মমভাবে বদলে গেছে। বাংলা ভাষার সারস্বত সৌন্দর্য আজ ইলেকট্রনিক ও অপরাপর মাধ্যমের দৌরাত্ম্যে পণ্যবিপণনের শিকার। এর ফলে স্বভাবতই মঞ্চে পরিবেশিত ভাষা আর কোনো চূড়ান্ত বীক্ষা মুহূর্ত নির্মাণ করে না। হাত দিয়েই সচরাচর এখন দ্বারোন্মোচন হয়, গান দিয়ে নয়। এরই অনুষঙ্গে অপরিহার্যত এসে গিয়েছে সুলভ রোমাঞ্চ তৈরি করার অনিবার্য প্রলোভন। অর্থাৎ নাটকের লক্ষ্য হয়ে উঠেছে একধরনের নাটকীয়তা, যার সংক্রাম মারাত্মক। আমি এখানে কবিত্ব আর কাব্যিকতার দ্বৈরথের মতোই নাট্য-মায়া ও প্রদর্শিত নাটকীয়তার মধ্যে বিরাজমান একটি দুস্তর ব্যবধানের দিকে সজাগ হতে চাইছি। বাংলা নাটক এই মুহূর্তে সম্ভবত দৃশ্যলোলুপ দর্শকের সৌন্দর্তিক তুষ্টি সাধনের জন্য যতটা তৎপর, শব্দবিবেকী ভ্রষ্টার আনন্দের জন্য ততটা উদ্গ্রীব নয়।

সবমিলিয়ে নাট্যকর্মীদের মধ্যে আত্মনাট্যায়নের (Self dramatilization) ঝোঁক দুর্লক্ষ নয়। চটজলদি উদাহরণ হিসেবে একটি তথ্য এখানে দাখিল করতে চাই : ফ্রাংকফুর্টের বিশ্ববইমেলায় (২০০৬) ভারতনাট্য নিয়ে বিশেষজ্ঞের প্রতিবেদন জ্ঞাপনের একটি প্রত্যাশামদির সকালে ভূভারতনন্দিত এক নাট্যকার ও অভিনেতা কাউকেই না বলেকয়ে সুদূর বার্সিলোনায় উধাও হয়ে গিলেন। পুরো ব্যাপারটা উদ্যোক্তাদের কাছে অরুন্তুদ ঠেকলেও কোনো-কোনো নাট্যামোদীর কাছে বেশ আকর্ষণীয় এবং নাটকীয় বলেই প্রতীয়মান হয়েছিল।

এখানে, সত্যের সৌজন্যে কবুল করলে অন্যায় হবে না, সেই প্রথিতযশা শিল্পীর নাম স্বয়ং গিরীশ কারনাড, যিনি দেশে প্রত্যাবর্তনের পর ঘোষণা করেন, রবীন্দ্রনাথ নাকি নাটক লিখে উঠতেই পারেন নি। এমনতরো স্বপ্রতীতি নিয়ে তিনি ওই অপবাদ আরোপ করেছিলেন যে, রবীন্দ্র আলোকপ্রাপ্তসমূহ বিদগ্ধজন, এমন-কি অপ্রতিম নাট্যসমালোচক শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ও সেদিন কোনো প্রতিবাদ জানানোর প্রয়োজন অনুভব করেননি। খুব সম্ভব একজনই সৃজনী নাট্যকর্মী, বাদল সরকার, নান্দনিক মুদ্রায় সেই পর্বে বিরলে একা-একাই রক্তকরবীকে শ্রুতিনাট্যের আদলে আবৃত্তি করবার মতো সাহসিকতা পোষণ করেছিলেন। তাঁর একক রক্তকরবীর অডিও-অভিনয় এরই মধ্যে যন্ত্রে গৃহীত এবং সম্প্রচারিত একটি সংঘটন বলে স্বীকৃত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের আরেক শিবিরের বৈপ�বিক প্রতিভূ বাদল সরকার তাহলে রবীন্দ্রনাথের নাট্যপ্রতিভাকে সমীচীন স্বীকৃতি জানাতে পেরেছিলেন।

প্রশ্ন উঠতেই পারে, তাঁর সতীর্থদের মধ্যেও কি/ রবীন্দ্রনাথকে/ কেউ কেউ অপরিবর্তিত রেখেই অখন্ড পরিগ্রহণের কথা ভাবছিলেন, নাকি প্রয়োগের চাহিদায় তাঁকে এখানে-ওখানে ঢেলে সাজিয়ে নেওয়ার তাগিদও অনুভব করছিলেন। রবীন্দ্রনাথও কি দূরদর্শীর প্রজ্ঞায় তাঁর একাধিক নাটকের ভিন্ন ভিন্ন ভাষ্য রচনা করে যাননি, যার প্রশ্রয়ী দাক্ষিণ্যে ভবিষ্যতের নাট্যপরিচালকেরা স্বযাচিত এক-একটি মঞ্চভাষ্য তৈরি করে নিতে পারেন? এরকম একজন মেধাপুরুষ অবশ্যই আন্দ্রে ওয়াইদা, চলচ্চিত্রের জগতে বরেণ্য নাম, যিনি তাঁর একটি ছবির উপান্তে পরম্পরায় ডাকঘরের পরিণামী দৃশ্যের অন্তর্ভুক্তি ঘটিয়েছিলেন। সেই দৃশ্য বাণী ও বেদনায় অনুপম, সুধা যেখানে অমলের মৃত্যুকে চিরন্তনে অনুবাদ করে দিচ্ছে। ওয়াইদা তাঁর ভাষ্যে সেই ট্র্যাজিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে ঘাতক নাৎসিদের হাতে নিহত হওয়ার আগে অবোধ শিশুদের আসন্ন মৃত্যুর জন্য প্রস্ত্তত করে দিয়ে আমাদের জীবনবোধ ও মৃত্যুচেতনাকে যে-জায়গায় নিয়ে গিয়েছেন সেখানেই বোধহয় রবীন্দ্রনাথের জয়োৎসার!

আন্দ্রে ওয়াইদারই আরেকজন উত্তরসূরি, হেবালফরাম সেরিং, দৃপ্ত দুঃসাহসে প্রতিপন্ন করেছিলেন, এ-যুগের তত্ত্বনিরপেক্ষ নাট্যরসগ্রাহীদের উপযোগী করে তুলতে হলে রবীন্দ্রনাথের জীবনবাদ কোথাও-কোথাও অনুচ্চার রাখলে ক্ষতি নেই। তাই তো মাক্স মুলার ভবনমঞ্চের জন্য নির্মিত ডাকঘরের রূপভাষ্যে তিনি অধ্যাত্ম কবির তর্জনী আঙুল দেখিয়ে উচ্চারিত ‘চুপ করো অবিশ্বাসী, কথা কোয়ো না’ উক্তিটিকে ছেঁটে দিয়েছিলেন। প্রথম শ্রবণে আমাদের রবীন্দ্রসংস্কার আহত হলেও অন্তিম সংবেদনে তাঁর সেই বৈপ�বিকতার স্বাদ গ্রহণ করতে পেরেছিলাম তো আমরা। উপরন্তু দৃশ্যায়নের এক-একটি প্রস্বরে জাপানি নো-নাটকের ঘরানায় মুখোশ ব্যবহার করে তিনি সেদিন রবীন্দ্রনাথেরই ইপ্সিত বৃহত্তর প্রাচ্যের অভিক্ষেপ ঘটাতে পেরেছিলেন।

সেরিংয়ের অপর সার্থকতা, চূড়ান্ত মিতব্যয়িতায় অনুভাব ও গতির সুব্যবহার। অমল তো নিজেই বৃক্ষ ইব বসে আছে, তাকে ঘিরে চলাচলের অংশীদারেরাও কত সুমিত চলনে চলে, অথবা বলা যায় বলনই তাদের চলন!

‘সমাহিত কেন্দ্রে’র (still centre) এই জায়গাটা থেকে বাংলা নাট্যপরিসরে রবীন্দ্র-নাট্যের প্রযোজনা আজ কত দূরে সরে এসেছে। সার্ধশতবার্ষিকীর ডামাডোল শুরু হওয়ার ঈষৎ আগেও কিন্তু রবীন্দ্র-অক্ষপথে সঞ্চারের মাধ্যমেই যুগোপযোগী হয়ে ওঠার একটি মহতী সম্ভাবনা, রক্তকরবীর একটি নিরীক্ষামূলক প্রযোজনায়, আভাসিত হয়েছিল। রঞ্জনের মৃত্যুর প্রাক্কাল অবধি পরিচালক গৌতম হালদার রবীন্দ্রনাথের ‘প্রাণের ধর্ম সুমিতি, আর্টের ধর্মও তাই’ শীর্ষক মন্ত্রের সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গতা মূর্ত করে তুলেছেন। না, রবীন্দ্র-অনুকরণে নয়, দরকার মতো ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীতের আশ্রয় নিয়ে রবীন্দ্রস্বননকে প্রসারিত করে দেওয়ার সৎ সাহসে তাঁর সেই স্বরক্ষেপ অসাধারণ। সেই তাড়নায় আবহসংগীতের রক্তকরবীর সঙ্গে ওতপ্রোত প্রচলিত রবীন্দ্রসংগীতের সর্বস্বতাকে খারিজ করে দিয়ে ওস্তাদ আমজাদ আলি খানের সুযোগ্য পুত্র আমান আলির হাতে সরোদলহরীর মুক্তধারা ঘটিয়ে তিনি আমাদের কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন।

কিন্তু তবু তো তাঁকে অদীক্ষিত দর্শকের কথা ভাবতে হয়েছে। তারই সুবাদে রাজা তাঁর অদৃশ্য নেপথ্য থেকে একসময় বেরিয়ে আসেন, নন্দিনীর প্রেম আদায় করে নেওয়ার উদ্দেশ্যে শুরু হয়ে যায় তাঁর পেশি সঞ্চালন। সেই শারীরিকতা শুধু রবীন্দ্রবিরোধীই নয়, অসহ্য।

আসলে অনতিশরীরী অনুপস্থিতিই রবীন্দ্রনাথের রাজাদের ধর্ম। যাঁরা ন্যূনতম যৌনতার সংগত প্রত্যাশী, তাঁদের চোখে ধুলো দিয়ে রাজার রাজারা আমাদের হৃদয়ে প্রবেশাধিকার পাওয়ার অভীপ্সায় প্রাণের মেলায় মেলায় ছদ্মবেশে মনোহরণ বেশে ঘুরে বেড়ান। শুধু কি রাজারাই, রঞ্জনের মতো প্রেমিকেরাও কি একই ব্রত সম্পন্ন করার জন্য আর্ত-আকুল হয়ে ওঠেন না? শুধু কারনাডের মতো বিশ্বমাপের বিশ্বনাট্যকারই নন, পশ্চিমের অগ্রণী নাট্য-সমালোচকেরাও রবীন্দ্রসুভগ এই অঙ্গবিহীন আলিঙ্গনের স্বরূপ অনুধাবন করতে না পেরে আজ যেন কথঞ্চিৎ দিশাহারা হয়ে পড়েছেন এবং নির্ণয় করেছেন রবীন্দ্রনাথের মতোই এরকম কয়েকজন নাট্যকার শুধু সুনির্বাচিত শ্রোতৃমন্ডলীর (coterie audience) জন্যেই নির্দিষ্ট হয়ে রইলেন।

এঁদের একটি তালিকা তৈরি করতে গিয়ে এঁরা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পিঠোপিঠি নোবেলপ্রাপ্ত মেটারলিংকেরও উলে�খ করেছেন, যাঁর নাটক আজ সারা দুনিয়ায় কোনো মঞ্চেই অভিনীত হয় না। শেষ পর্যন্ত তাই এই সমালোচকেরা interpoler বা নাট্যজগতে প্রক্ষিপ্ত নাট্যকারদের সারণির প্রথম শ্রদ্ধেয় নাম হিসেবে রবীন্দ্রনাথকেই নির্বাচন করে নিয়েছেন।

তাঁদের দুরুদুরু এই সমীহা কি অপরিচিতের প্রতি একরকম প্রেম নিবেদনই নয়? তলিয়ে ভেবে দেখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ কি interpoler না deus ex machina (প্রদত্ত পরিসরের বাইরে থেকে-আসা একটি দৈবশক্তি), যিনি বহির্দেশ থেকে ঢুকে পড়ে আমাদের প্রথানুগত ধ্যানধারণার সংকীর্ণতা তছনছ করে দিয়ে চলে যান? সেটাই তো তিনি নটরাজের মতো সুসম্পন্ন করেছেন চিরকালের মতো পরিবর্তিত করে দিয়েছেন আমাদের। সেই রূপান্তরণের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম গতিপ্রকৃতি বুঝে উঠতে পারিনি বলেই কি তাঁকে তাঁর যোগ্য মঞ্চে এনে সচেতনভাবে স্থাপন করতে গিয়ে আমাদের এত দেরি হয়ে যাচ্ছে?