অস্ট্রেলিয়ায় প্রদর্শনী, ভ্রমণ এবং দুশ্চিন্তার দিনকাল

রফিকুন নবী

বিদেশে প্রদর্শনী হোক বা অন্য কিছু, দলেবলে দূরদেশে গেলেই আমার ওপর তা নিয়ে লেখার ভার পড়ে। আমি তা মান্যি করে সবটার লঘু-গুরু বিষয়কে নিয়ে হালকা-মেজাজি লেখার চেষ্টা করি। তাতে হাস্যরসের বা মজার দিকগুলোই প্রাধান্য পায়। এবারো সেই রকমের ভাবনা ছিল। আমিও তেমনভাবেই তৈরি হচ্ছিলাম। ভেবেছিলাম অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ নিয়ে রসিয়ে লেখা যাবে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ আনন্দের হতে পারেনি। তাই লেখার উৎসাহটুকু প্রচন্ড দুশ্চিন্তার কারণে হারিয়েই গেছে। মন সায় দিচ্ছে না মোটেই। তবু সবার কথা মানতে লেখায় হাত দিতে হলো। বিশেষ করে কালি ও কলম সম্পাদকের অনুরোধ উপেক্ষা করা গেলো না।

নিরানন্দের এবং দুশ্চিন্তার কারণ বেঙ্গল গ্যালারির পরিচালক, আমাদের অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণের প্রধান আয়োজক শিল্পী সুবীর চৌধুরীর গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়া সুদূর অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে। তা এতোটাই মন খারাপের যে, ফিরে আসা অবধিও সিডনির হাসপাতালে চিকিৎসার জন্যে শয্যাশায়ী সুবীরের প্রতিনিয়ত খবরাখবর নিয়েও অস্বস্তি আর দুশ্চিন্তা বাড়ছে বই কমছে না। অর্থাৎ চিকিৎসার পুরো ব্যাপারগুলো সঠিক জানা যাচ্ছিলো না তো বটেই, আবার সিডনি থেকে কোনো কোনো অতি উৎসাহী শুভানুধ্যায়ীর অতিরঞ্জিত খবরাখবর মন খারাপ করে দিচ্ছিলো।

আসলে প্রথম থেকেই কেন যেন এই অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার ব্যাপারটি নিয়ে আমি দ্বিধায় ছিলাম। শুরু থেকেই অর্থাৎ বেশ কমাস আগে সুবীরের কাছ থেকে যখন এ-প্রদর্শনীটির কথা এবং সেজন্যে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার প্রস্তাব এসেছিল তখনই কেমন বাধো-বাধো ঠেকেছিল। একই যাত্রায় তিনটি বড় শহরে একই ছবির প্রদর্শনী,  প্রদর্শনীর জন্যে একই মাপের বড়বড় চারটি করে ছবি দেওয়া ইত্যাদি নিয়ে বেশ আপত্তি ছিল। প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী অন্য শিল্পীদেরও অনেককে এ নিয়ে গাঁইগুঁই করতে দেখেছি।

অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা হলেন – কাইয়ুম চৌধুরী, তাহেরা খানম, মনিরুল ইসলাম, আবদুস শাকুর শাহ, ফরিদা জামান, রণজিৎ দাস, রোকেয়া সুলতানা, কনক চাঁপা চাকমা, মোহাম্মদ ইকবাল। আর আমি তো ছিলামই। কাইয়ুম চৌধুরী, তাহেরা খানম এবং আবদুস শাকুর শাহ অস্ট্রেলিয়ায় যাননি। তবে সঙ্গে গিয়েছিল আনন্দপাঠের কায়সারের কন্যা ছোট্ট অদ্রি। শিল্পীদের সবার মধ্যেই প্রায় এই ছবি দেওয়া নিয়ে দ্বিধা ছিল। কিন্তু সুবীরের কারণে শেষতক এ নিয়ে আর ভাবা হয়নি। আসলে প্রদর্শনীর ব্যাপার হলে এবং তা যেমনই হোক, বেঙ্গল গ্যালারির পক্ষ থেকে ছবি চাওয়া হলে কেউ অমত করে না। কিন্তু এবার তা ঘটেছিল। আপত্তির মধ্যে অন্যতম প্রধান দিক ছিল ছবির ব্যাপারটি অনুদানের সঙ্গে যুক্ত।

অস্ট্রেলিয়া আগে কখনো যাইনি। তাই বলে কোনো সংস্থা বা সংগঠনকে সাহায্য করতে শিল্পীদের ওপর ভর বা ভরসা করতে হবে – এমনটায় সায় দেওয়া মোটেই গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। কিন্তু সুবীরের অনুরোধে ব্যাপারটিতে রাজি হতে হয়েছিল। সুবীর কেন যে সংগঠনটির জন্যে এতো বড় আয়োজনে রাজি হয়েছিল তা জানি না। তবে বহুদিন ধরে অস্ট্রেলিয়ায় প্রদর্শনী করার ইচ্ছা ব্যক্ত করতে শুনতাম।

এই ধরনের ফান্ড কালেকটিংয়ের ব্যাপারে বা বলা যায় কাউকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্যে শিল্পীদের ছবির প্রদর্শনী যে হয় না তা নয়। প্রতিবছরই কিছু প্রদর্শনী হয়ে থাকে। বিশেষ করে কোনো শিল্পী বা শিল্পকলার ছাত্রছাত্রীদের অসুস্থতায় আর্থিক সহায়তা দিতে। দুস্থ শিল্পীদের ক্ষেত্রেও শিল্পীরা দলগতভাবে এগিয়ে আসেন স্বতঃস্ফূর্তভাবেই। দেশে বড় এবং ভয়াবহ কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটলে তো সাহায্যার্থে প্রদর্শনী আয়োজনের মাধ্যমে ফান্ড তোলা কর্তব্যজ্ঞান করা হয়। কিন্তু একটা গোটা স্কুলের ভূত-ভবিষ্যৎ তৈরির জন্যে শিল্পীদের সহায়ক ভাবা সম্ভবত এই প্রথম। আসলে সুবীর কাউকে পছন্দ করলে তাকে সাহায্য-সহযোগিতা করতে কখনোই পিছপা হয় না। এবারেও তাই হয়েছে। এবং সুবীর শিল্পীদের রাজি করিয়েছে ছবি দিতে মহৎ কর্তব্য ভেবেই। আসলে তাকে কনভিন্স করতে পারলেই ব্যাপারটি সম্ভব তা জানা ছিল স্কুল কর্তৃপক্ষের। কিংবা এটা হয়তো ধারণায় ছিল।

আনন্দহীনতার এবং অনীহার অন্য যে-কারণ তা ছিল বরেণ্য শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর ভিসা না পাওয়া। বেঙ্গল গ্যালারি আয়োজিত বিদেশে প্রদর্শনী হলে তাঁর অংশগ্রহণ এবং এ উপলক্ষে সেখানে যাওয়ার ব্যাপারটি মূল আকর্ষণ বলে আমি চিরকাল দেখে এসেছি। শুধু তাই নয় – তিনি থাকলে তবেই আমি যাওয়ার ব্যাপারে সম্মতি দিই এবং আগ্রহী হই। কিন্তু এবার সে-নিয়মটিতে ব্যত্যয় ঘটলো।

তিনি যে ভিসা পাননি এ-কথা সুবীর খুলে বলেনি। আগেভাগে শুনলে যদি আমরাও না যাই তেমন ভেবেই হয়তো। ভাবনাটা অমূলক নয়। কাইয়ুম স্যার আমাদের সঙ্গে যেতে পারছেন না, একথা শুনে আমিও না যাওয়ার ইচ্ছাটি বলি। সুবীর তা শুনে তার স্বভাবসুলভ প্রতিবাদী ভূমিকা ধারণ করে আমাকে নিরস্ত করে। বলে, ‘২৬ মার্চ কাইয়ুম স্যার স্বাধীনতা পুরস্কার গ্রহণ করবেন। সেই কারণে তিনি একসঙ্গে যেতে পারছেন না। ততদিনে ভিসাও পৌঁছে যাবে। হাইকমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে।’ বলেছিলাম, ‘তবে তো ভালোই হলো। আমি থেকে যাই। স্যারের সঙ্গেই যাওয়া যাবে।’ সুবীর তাতেও মহা-আপত্তি জানিয়ে বলেছিল, মেলবোর্নের প্রদর্শনীর সব আয়োজন প্রস্ত্তত। উদ্বোধনীতে সিনিয়র কেউ না গেলে আয়োজকরা মনঃক্ষুণ্ণ হবেন। সবকিছু ব্যাহত হবে বলেও জানিয়ে রাজি করিয়েছিল। সেইসঙ্গে নিজেই আবার ঢাকা ফেরত এসে কাইয়ুম স্যার এবং ভাবিকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে, তাও জানিয়েছিল।

এই সিদ্ধান্ত শুনে শঙ্কিত হয়ে তাকে নিরস্ত করার চেষ্টা করেছিলাম। শুধু ঢাকাতেই নয়, মেলবোর্ন থেকে যেদিন আবার ঢাকার পথে রওনা দিলো, তখনো নিষেধ করা হয়েছিল। এতো লম্বা ভ্রমণের ধকল সহ্য করা কঠিন হতে পারে এবং অসুস্থ হওয়ার শঙ্কার কথাও জানিয়েছিলাম। সুবীর সে-কথাতেও কান না দিয়ে সত্যিই ঢাকা চলে এসেছিল। বলেছিল, ‘স্যার আমার তো ঘুম আছেই। ঘুমাইয়া-ঘুমাইয়া যামু আবার একইভাবে ফেরত আসুম।’ প্রায় জেদের বশবর্তী হয়েই সুবীর কাজটি করেছিল বলে আমার ধারণা।

ঢাকা এসে বিশ্রাম না নিয়েই স্যারের ভিসার জন্যে ছোটাছুটি করেছে। লাভ হয়নি। এই ভিসা না দেওয়ার ব্যাপারে কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। সব শুনে আমাদের কনিষ্ঠ শিল্পীদের কেউ কেউ অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছিল, ‘অস্ট্রেলিয়া কী এমন আহামরি দেশ যে ভিসা নিয়ে এমন কারসাজি দেখানো! অতো বিগ পাওয়ারের তো কেউ না!’ ক্ষোভের কথা হলেও ওই মুহূর্তে কথাগুলোকে মূল্যবান মনে হয়েছিল।

তবে দেশটির ভিসা সংক্রান্ত ব্যাপারটির সমাপ্তি সেখানেই টানা যায়নি। মজার ঘটনাটি ঘটলো অস্ট্রেলিয়ায় প্রদর্শনী, ঘুরে বেড়ানো এবং সর্বোপরি সুবীরের অসুস্থতা হেতু তাকে সিডনিতে হাসপাতালে রেখে ঢাকায় সবাই ফিরে আসার দিনকয়েক পর, অর্থাৎ সব কাজ ফুরিয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ করে কাইয়ুম স্যারের ভিসাটি এসে হাজির। তা পেয়ে কাইয়ুম ভাই হেসে বললেন, ‘কেউ আর বলতে পারবো না বা দোষ দিতে পারবো না যে, আদৌ ভিসা দেওয়া হয় নাই! ব্যাপারটা মশকরার মতো বইলা ধরাই উচিত।’

ওদিকে মেলবোর্নে যাঁরা প্রদর্শনীর আয়োজক এবং ভিসা সংক্রান্ত ব্যাপারে সহায়ক কাগজপত্র পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত ছিলেন, তাঁরাও ব্যাপারটিতে হতবাক। তাঁরা প্রায়শই তাঁদের সংগঠন থেকে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জগতের শিল্পী-কবি-সাহিত্যিক এবং কলাকুশলীদের আমন্ত্রণ করেন। ভিসার ব্যাপারটিও সমাধা করে থাকেন। কখনো কোনো উটকো ঘটনা ঘটতে দেখেননি। এই প্রথম তাঁরা তেমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলেন। কাইয়ুম স্যারের উপস্থিতি তাদের মনে-প্রাণে কাম্য ছিল সবাই তাঁর ভক্ত বলে। অনেকের বইয়ের প্রচ্ছদ স্যারের অাঁকা। অনেকের বাড়িতে ছবিও রয়েছে। সবাই সে-কারণে খুব আশা করেছিল। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি বলে সবার খুব মন খারাপ হয়েছিল। সব আয়োজন যেন অসম্পূর্ণ মনে হচ্ছিল স্যারের অনুপস্থিতিতে।

মনে আছে, মেলবোর্নে বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হয়েছিল। দারুণ বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান। শিরোনাম ছিল ‘আনন্দধ্বনি জাগাও গগনে’। মূল থিম ছিল ষড়ঋতু। সংগীতে ছিল ‘সুরোলোক’ সাংস্কৃতিক সংগঠন। নৃত্যে মেলবোর্নে বসবাসরত প্রবাসী শিল্পীবৃন্দ। চমৎকার আয়োজনে গান পরিবেশনে ছিলেন উৎপল ধর, মনি সাহা, দীপ্তি, পিনাকী ঘোষ, প্রিয়াংকা, আহেলী, চঞ্চল খান, শহীদ রহমান, ইন্দ্রনীল, হিমালী, নিরুপমা, নিঝুম, অরণ্য, সঙ্গীতা, সুদীপ শুভো। নৃত্যে অরণি, তিয়াশা, সাঞ্জোলি, জুবেন খান, বৃষ্টি, সানিয়া, শমিক, কথা সাহা, মেখলা, ময়ূখ, শ্রুতি, শ্রাবণ, অনিক, আহেলী বর্মণ, সোহাগ, ঐন্দ্রিলা, তানজিনসহ আরো অনেকে। যন্ত্রানুষঙ্গে রেজা আলী, মালোবি সিনহা, ডেনিস, সৌগত, রাফায়েল, গৌতম, সঞ্জয় বসু।

পুরো অনুষ্ঠান দেখে একবারও মনে হয়নি বিদেশে আছি।  নৃত্য-গীতে মুখর অনুষ্ঠানটিতে সবাই অভিভূত হয়েছি। এখানেও কাইয়ুম স্যারের অভাব বোধ হচ্ছিল। শেষে আমাকে এবং মনিরুল ইসলামকে বক্তব্য রাখতে হয়েছে।

‘আনন্দপাঠ’ স্কুলটির কর্ণধার কায়সার সুবীরের অত্যন্ত প্রিয়ভাজন। তার দুই ভাগ্নে রাজিব এবং সজিব মেলবোর্নে থাকে। বহুদিন ধরে অস্ট্রেলিয়ায় থাকে। দুজনই সংস্কৃতিমনা। তারা মেলবোর্নে বসবাসকারী প্রবাসী বাঙালিদের সাংস্কৃতিক (ABC) সংগঠনের একনিষ্ঠ সদস্য কর্মকর্তা। বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য-সংগীত নিয়ে প্রায়শই অনুষ্ঠানাদির আয়োজন করে থাকে এ-সংগঠন। আমাদের প্রদর্শনী এবং শিল্পীদের অস্ট্রেলিয়া যাওয়া, আতিথেয়তার ব্যবস্থাপনা ইত্যাদিতে রাজিব-সজিবের অগ্রণী ভূমিকার কথা শুনেছিলাম। রাজিব এই ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকায় ছিল। নিজে কবি। তার বেশ কয়েকটি কবিতার বই রয়েছে। একটি বই হাতে পেয়ে আদ্যপান্ত পড়েছি। বইটির নাম শাহবাগের কবিতা। ভালো লেখেছে। অবাক হয়েছি ভেবে যে, প্রবাসী জীবনের ব্যস্ততার মাঝে কবিতাচর্চায় নিষ্ঠা দেখে। একটি কবিতার একাংশ উদ্ধৃত করছি – ‘জয় পরাজয় তোমার হিসেব/ আমার কাছে মানুষ হতেই ভালো লাগে/ মানুষ বলেই অঙ্কগুলো শিকেয় তুলে চলছি এখন শাহবাগে।’

শিল্পীদের আতিথেয়তায় সব সময় যাঁরা নিয়োজিত ছিলেন এবং মেলবোর্নে অবস্থানকে আনন্দময় করে রেখেছিলেন তাঁদের আদর-আপ্যায়ন তুলনাহীন। নিরুপমা রহমান, ওয়াসিম আতিক কিশোর এবং তাঁর সহধর্মিণী আমাদের ছাত্রী সংগীতা, কচি ও তাঁর স্ত্রী সাদিয়া আফরিন নিঝুম, ডা. সোহেল রহমান ও মালা দম্পতি, নকীব রহমান আদর, সাইফুল ইসলাম, তাজ। মালা সংগীতশিল্পী। সিডি রয়েছে। লালনগীতিতে নিজস্ব চমৎকার ধরন রয়েছে।। কিন্তু এঁরাই শুধু নন। আরো অনেকেই তাঁদের সাহচর্য দিয়ে আমাদের মেলবোর্নের কয়েকদিনের বসবাসকে তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছিলেন। ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি যে অনেকের নাম এই লেখা লিখতে গিয়ে মনে করতে পারছি না। ব্যাপারটি যে বয়সের কারণে স্মৃতিভ্রষ্টতা তা বলা বাহুল্য।

ডা. মহিউদ্দিন আহাদ বাবর, মুশফিক রহমান এবং জনাব লোহানী – এই প্রবীণ বুদ্ধিদীপ্ত মানুষের সান্নিধ্য আমাদের মেলবোর্নে উজ্জীবিত রাখতে এতোটাই সহায়ক ভূমিকার ছিল যে, তা চিরকাল মনে থাকবে। বুঝেছিলাম যে, তাঁরাই ছিলেন তরুণ আয়োজকদের মূল অভিভাবক এবং ABC সংগঠনের প্রধান চালিকাশক্তি। আমরাও তাঁদের সান্নিধ্যে অভিভূত।

মেলবোর্ন থেকে সরাসরি সিডনি অভিমুখে হাজার মাইল পাড়ি দিয়েছিলাম প্রদর্শনী আয়োজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত মূল সদস্যদের অন্যতম সজিবের গাড়িতে। ছবির সবকটা বাক্স বেঁধেছেঁদে গাড়িভর্তি করে শিল্পী মনিরুল ইসলাম, শিল্পী মোহাম্মদ ইকবাল এবং আমি ছিলাম যাত্রী। সুবীর উপস্থিত থাকলে এই ভ্রমণে শামিল থাকতো। কারণ দূরপাল্লার ভ্রমণে তার গাড়িতে যাওয়ার খুব আগ্রহ। দেশের বহু প্রত্যন্ত অঞ্চলে আমরা একসঙ্গে গিয়েছি এভাবে। তার উদ্দীপনায় গত কয়েক বছর ধরে আমের সময় আমার চাঁপাইনবাবগঞ্জের গ্রামের বাড়িতে যাওয়া প্রায় দস্ত্তর করে ফেলেছে। আসলে যতো না আমের প্রতি আকর্ষণ, তার চেয়ে গাড়িতে দীর্ঘ ভ্রমণ তার কাছে বেশি লোভনীয় মনে হয় বলে আমার বিশ্বাস। সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য আর বিভিন্ন অঞ্চলের নানান ধরনের পরিবেশ দেখে উচ্ছ্বসিত হতে দেখেছি। কোনো সুন্দর জায়গা দেখলেই বলে – ‘এই জায়গায় একটা ওয়ার্কশপ করলে মন্দ হয় না।’ আমাদের আমবাগানে অবস্থিত বাড়িতেও ওয়ার্কশপ করার প্ল্যান-প্রোগ্রাম নিয়ে বলতে শুনেছি। আসলে দীর্ঘ ভ্রমণে সহযাত্রী হিসেবে সুবীর অসাধারণ। আর সেই ভ্রমণ যদি তার নেতৃত্বে থাকে, তবে তো কথাই নেই – যাওয়া-আসা-থাকা সব ব্যাপারে নিখুঁত আয়োজন অবশ্যম্ভাবী। সুবীর সেই আয়োজনে সিদ্ধহস্ত। পান থেকে চুন খসার উপায় থাকে না। আর কোথাও অব্যবস্থা দেখলেই চটে যাওয়া তো প্রায়শই ঘটে থাকে। যদি সঙ্গী হিসেবে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী বা আমরা কেউ থাকি তো তড়িঘড়ি তাকে সামাল দেওয়ার দায়িত্বটা নিতে হয়। বিশেষ করে বিমানবন্দরে তার এই চটে যাওয়ার ঘটনাটি ঘটে বেশি, তা সে দেশে হোক বা বিদেশে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় আসার জন্যে ঢাকা বিমানবন্দরে এই প্রথম খুবই সংযত দেখেছি। অথচ চটে যাওয়ার যথেষ্ট ঘটনা ছিল। একটু অবাকই হয়েছিলাম সবসময় চিন্তিত দেখে। ভেবেছিলাম, কাইয়ুম স্যারের ভিসা না হওয়াতেই হয়তো মন খারাপ।

সুবীরের চটে যাওয়ার বেশ মোক্ষম একটি ঘটনা ঘটেছিল ঢাকা বিমানবন্দরে। অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার বাহন ছিল মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্স। আমাদের যাত্রার কয়েক দিন আগে এই এয়ারলাইন্সের একটি উড়োজাহাজ হঠাৎ আকাশ থেকে উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনায় পৃথিবীজুড়ে তোলপাড় চলছিল। সেই এয়ারলাইন্সে যাচ্ছি জেনে অনেকেই ঠাট্টা করে বলেছিল, ‘ওইটার টিকিট কাটা হইছে! খবর আছে তোমাদের!’

তো তেমন ‘খবর’ হওয়ার মতো বড় কিছু না ঘটলেও ঘটনা একটা ঘটেছিল। অর্থাৎ আট ঘণ্টা বিমানবন্দরে অপেক্ষার পরও উড়োজাহাজটি ঢাকায় পৌঁছাতে পারেনি। শুনেছিলাম মিয়ানমারের রেঙ্গুনে জরুরি অবতরণ করেছে। যাই হোক, শেষে অবশ্য আমাদের বনানীর একটি হোটেলে রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। আমি তো বিরক্ত হয়ে অস্ট্রেলিয়া না যাওয়ার কথা প্রায় প্রতিজ্ঞা করেই ফেলছিলাম। অথচ চটে যাওয়ার এমন সুযোগ তৈরি হলেও সুবীরকে সংযত থাকতে দেখলাম সেই প্রথম। কিছুই বললো না।

তবে পরদিন যাত্রাপথে কোনো আর বিড়ম্বনা হয়নি। বরং উড়োজাহাজের ভেতরে আপ্যায়ন দেখে মনে হয়েছিল যেন একটু বেশিই করা হচ্ছিল। ঢাকা থেকে কুয়ালালামপুর পর্যন্ত যা ছিল সেখান থেকে মেলবোর্ন পর্যন্ত তো যেন আরো ভালো। আনন্দপাঠের কায়সার বলেছিল, ভাড়ার দিকটা সাশ্রয় করতেই ওই এয়ারলাইন্স ঠিক করেছিল সুবীর।

মেলবোর্ন থেকে সিডনির হাজার মাইল পাড়িতে সুবীরের অনুপস্থিতি যাত্রাপথে অনুভূত হচ্ছিল পদে পদে। বিশেষ করে দুশ্চিন্তা হচ্ছিল অতোগুলো মূল্যবান ছবি ঠিকঠাক মতো পৌঁছাতে পারবো কিনা। সিডনিতেই বা সুবীর সব ব্যবস্থা ঠিক করে গেছে কিনা ইত্যাদি।

মেলবোর্ন থেকে রওনা দিতে প্রায় বিকেল হয়ে গিয়েছিল। কিছুদূর যেতেই সন্ধ্যা পেরিয়ে অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় দুধারের কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। কমপক্ষে ১১০ কিলোমিটারে গাড়ি চালাচ্ছিল সজিব। বেশ প্রাণবন্ত হ্যান্ডসাম আর স্মার্ট ছেলে। চমৎকার গল্প করতে পারে। মাঝে মাঝে গান গেয়ে এবং সিডিতে বাজিয়ে ভ্রমণকে উপভোগ্য করে তুলছিল। একসময় বলেছিল, স্যার একটা জিনিস খেয়াল করেছেন, একটাও প্রাইভেট গাড়ি আমাদের ওভারটেক করে যায়নি। আসলেও তাই। রাতের অন্ধকার  ফুঁড়ে শুধু মাঝে মাঝে বিশাল বিশাল ট্রাক, বেশির ভাগেরই চুরাশিটা করে টায়ার, তেমনসব মালবাহী গাড়ি ছাড়া আর কোনো গাড়ি চোখে পড়েনি।

শ’দুয়েক কিলোমিটার পরপর মোটেল। আমাদের যেহেতু তাড়াহুড়ো ছিল না, তাই এসবে থেমে চা-কফি খেয়ে কিছুটা হাঁটাহাঁটি করে নিয়ে আবার যাত্রা। এভাবে যাচ্ছিলাম। এরকম করে প্রায় অর্ধেক পথ পেরিয়ে তেলের জন্যে একটি পাম্প স্টেশনে গাড়ি থামাল সজিব।

হঠাৎ দেখলাম প্যান্টের পকেট থেকে ওয়ালেট বের করতে গিয়ে সজিব খুব চিন্তান্বিত ও নার্ভাস হয়ে গেল। বললো, ‘স্যার মানিব্যাগটা খুঁজে পাচ্ছি না। পকেটেই ছিল। ড্রাইভিং সিটের কাছে কোথাও পড়েছে কিনা তা তন্নতন্ন করে খোঁজা হলো। পাওয়া গেল না।’ একপর্যায়ে সজিব তার একটি ধারণার কথা বলল। বললো যে, পথে অন্ধকার নির্জন যে জায়গাটিতে কিছুক্ষণ বিশ্রামের জন্যে নেমেছিলাম, মনে হয় কী যেন একটা টাস করে পড়েছিল পায়ের কাছে। ওটা কি মানিব্যাগই কী না ভাবছি। কিন্তু সেটা তো প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে। সবাই বললাম গাড়ি ব্যাক করে আবার সেখানে যেতে।

তবে দুটি সমস্যা দেখা দিলো। একটা হলো ইউটার্ন নেওয়ার জায়গা পেতে বিশ কিলোমিটার সামনে যেতে হবে আর দ্বিতীয়টি হলো ঘুটঘুট্টি অন্ধকারে জায়গাটি খুঁজে বের করা যাবে না। সবাই ঠিক করলাম চেষ্টা করতে হবে। কারণ ওই ওয়ালেটে তার টাকা-পয়সা, ক্রেডিট কার্ড তো রয়েছেই, সব চাইতে ইম্পর্ট্যান্ট কাগজ রয়েছে ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং আইডি কার্ড।

সজিবের ভাগ্য এমনই সুপ্রসন্ন যে, চেষ্টাটি করে অকুস্থল খুঁজে বের করতেই গাড়ির হেডলাইটের উজ্জ্বল আলোয় তা ঠিকই চোখে পড়লো। পথের ধারে পড়ে আছে জিনিসটা। সে যে কী আনন্দের মুহূর্ত তা আর বলার নয়। সবাই একসঙ্গে তালি দিয়ে সজিবকে অভিনন্দিত করেছিলাম। এরপর তো আর কোনো দুশ্চিন্তা থাকলো না। তাড়াহুড়োও ছিল না। পুরো পথ মাঝে মাঝে গাড়ি থামিয়ে বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে প্রায় ভোররাতে সিডনি পৌঁছেছিলাম নির্বিঘ্নে।

কথা ছিল সজিব আমাদের সিডনিতে পৌঁছে দিয়ে মেলবোর্ন ফিরে যাবে সেদিনই। কিন্তু প্রদর্শনীর কারণে আমাদের ছোটাছুটিতে গাড়ি প্রয়োজন ভেবে তার আর ফেরা হয়নি। তার এই অক্লান্ত পরিশ্রম আর শিল্পীদের সার্বিক দেখাশোনা করার যে নিষ্ঠা তা ভোলার নয়। শুধু সিডনি নয়, মেলবোর্ন থেকে একদিন নিয়ে গেল প্রায় তিনশো কিলোমিটার দূরে একটি বাঁধ দেখাতে। উঁচু বুনোপথ। নিরিবিলি ঘন সবুজ বন। মনে হয় যেন পার্বত্য চট্টগ্রাম কিংবা সিলেটের পার্বত্য অঞ্চল দিয়ে যাচ্ছি। একই রকম একটি ঝর্ণাও রয়েছে সেখানে। দর্শনীয় স্থান হিসেবে গণ্য করা হয় স্থানটিকে। সেই ভাবেই সাজানো। তবে মন খারাপ করা ব্যাপার চোখে পড়লো। সেই প্রথম ক্যাঙ্গারু দেখলাম কিছুদূর পরপর। কিন্তু সবগুলোই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে মৃত। বেচারারা লাফিয়ে রাস্তা পার হতে গিয়ে নাকি প্রায়শই মারা পড়ে। যাওয়ার সময় ভালো লেগেছে বিশাল বিশাল আঙুরের ক্ষেত। কোনো কোনোটির পাশে রয়েছে ওয়াইনের কারখানা।

গাড়ি চালাতে চালাতে সজিব বলছিল ক্যাঙ্গারুদের কথা। ইদানীং সর্বত্র দেখা যায় না। কোনো কোনো অঞ্চলকে নিরাপদ ভেবে এবং ঘাস বা গাছ-গাছালি আছে এমনসব জায়গায় তারা থাকে। মোট কথা খাদ্য পায় এমন স্থানগুলোতেই থাকে। নগরায়ণের কারণেই বেচারাদের এই অবস্থা। ক্যাঙ্গারু থেকে কথা কখন অস্ট্রেলিয়ার আদি অধিবাসীদের দিকে মোড় নিয়েছিল বুঝতে পারিনি। জেনেছিলাম, মরুভূমি অঞ্চলে তাদের ঠেলে একাট্টা করে দেওয়া হয়েছিল ক্রমে ক্রমে। তবে তাদের মধ্য থেকে কিছু কিছু মানুষ লেখাপড়া করে বিভিন্ন কর্মকান্ডে নিয়োজিত হচ্ছে। আসলে ইউরোপিয়ানদের বসতি স্থাপনের চেষ্টা চালানোর কারণে যুগে যুগে বেচারাদের প্রায় শেষ করার দুর্বুদ্ধিতে পেয়েছিল। শেষতক আন্দোলনের মাধ্যমে একটা সমঝোতা তৈরি হয়েছে।

এঁদের অবাক করা শিল্পকলার সুনাম রয়েছে পৃথিবীজুড়ে। প্রিমিটিভ হলেও তাদের সারল্য মেশানো প্রতীকী কাজের ধরন অস্ট্রেলিয়ার শিল্পীদের তো বটেই, বিশ্বের আধুনিক শিল্পচর্চায় নিয়োজিত শিল্পীরাও আকৃষ্ট হয়ে নিজ ধরন-ধারণে ব্যবহারের চেষ্টা করে। তাদের কাজ এবং শিল্পকলার সংগ্রহ দেখেছি আসলে ক্যানবেরার ন্যাশনাল গ্যালারিতে। তাদের কাজের অসাধারণত্ব দেখে অভিভূত হয়েছি। বাংলাদেশে কমিউনিস্ট পার্টির মনজুরুল আহসান খানের ছোট ভাই কামরুল আহসান এই গ্যালারি দেখায় সঙ্গী ছিলেন। কথায় কথায় আবিষ্কারক ক্যাপ্টেন কুকের কথা উঠেছিল। বেচারাকে কোনো এক দ্বীপবাসী দলবলসহ মেরে খেয়ে ফেলেছিল বলে কথিত আছে। একজন তা শুনে মজার একটি কথা বলেছিল। বলেছিল, আমাদের দেশে লর্ড ক্লাইভকে সে আমলে তেমন করলে ইতিহাস অন্যরকম হতো।

 

দুই

ক্যানবেরায় সন্ধ্যা নামছে। ধীরে ধীরে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা নিঝুম হয়ে আসছে। লোকসমাগমও কমতির দিকে। এমনিতেই পুরো শহর যেন জনমানবহীন। পথে-ঘাটে হেঁটে-চলা কোনো মানুষ চোখে পড়ে না। আমাদের কোনো শহরে ঘোরতর হরতালের দিনও এমনটা থাকে না। মনে হচ্ছিল কারফিউ দেওয়া একটি রাজধানী শহর। শালিক, ঘুঘু আর কালো-সাদার ছিট-ছিট গায়ের কাক ছাড়া আর কোনো পাখিরও ওড়াউড়ি নেই। জীবজন্তুর চলাফেরাও  যেন নিষিদ্ধ। মানুষ যা আছে তা গাড়িতে। সাঁই-সাঁই করে সেসবে যাওয়া-আসা। আমরাও গাড়িতেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্যালারিতে ছবির বিশাল-বিশাল বাক্স খোলার ব্যবস্থা করে সবাই তিন গাড়িভর্তি হয়ে যাচ্ছিলাম হাইকমিশনারের বাসায়। চায়ের দাওয়াত। বেশ খোশমেজাজে সবাই। একটা গাড়িতে শিল্পী মনিরুল ইসলাম, আমি, ফরিদা জামান এবং সুবীর চৌধুরী। পথে হাস্যরস মিশিয়ে গালগল্প হচ্ছিল। মনির তাঁর মাদ্রিদে বসবাসের দীর্ঘ ছেচল্লিশ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে নিংড়ে কিছু-কিছু হাসির ঘটনা বলছিলেন। উনি চমৎকার করে কিশোরগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষায় রস মিশিয়ে গল্প বলতে পারেন। আমরা বুঁদ হয়ে শুনছিলাম এবং হেসে সেসব উপভোগ করছিলাম।

সবাই এই নিয়ে যখন মনোযোগী তখন দেখা গেল সামনের সিটে সুবীর চৌধুরী গভীর নিদ্রায়। বলা বাহুল্য, বসলেই ঘুমিয়ে পড়া সুবীরের স্বভাব। তার এই ঘুম নিয়ে আমাদের মধ্যে আলাপ-আলোচনাও কম হয় না। ঘুমের ব্যাপারটি আমার মতো অনেকের কাছেই বেশ অস্বাভাবিক মনে হওয়ায় প্রায়শই সুবীরকে বলতাম ডাক্তার দেখাতে। সুবীর সেসব শুনে স্বভাবসুলভ সংক্ষিপ্ত জবাবটি দিতো ‘জি – দেখামু’ এই বলে।

তবে কলকাতায় কমাস আগে এক সান্ধ্য-আসরে এ নিয়ে আলাপকালে তার একটি ঘটনা ব্যক্ত করেছিল, যা উপস্থিত সবাই মানে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, ভাবি, কালি ও কলম সম্পাদক আবুল হাসনাতসহ কলকাতার বেশ কয়েকজন শিল্পী ব্যাপারটিকে হালকাভাবে নিতে নিষেধ করেছিলেন এবং অবিলম্বে ডাক্তার দেখাতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল।

তার বলা ঘটনাটি ছিল ঘুমের মধ্যে হেঁটে বেড়ানো। শুধু তাই নয়, তার এগারোতলা ফ্ল্যাট থেকে ঘুমে ঘুমে গ্রাউন্ড ফ্লোরে চলে আসার মতো একটি ব্যাপার ঘটেছিল কিছুকাল আগে। ঘুম ভাঙার পর নিজেকে নিচতলায় আবিষ্কার করলে নিজেই আতঙ্কিত বোধ করেছিলো।

এই ঘটনা বলার পর অহরহ ঘুমিয়ে পড়া নিয়েও অবিলম্বে ডাক্তার দেখানোর কথাটি প্রায় প্রতিজ্ঞার মতো করেই বলেছিল সুবীর। তা পালন করেছিল কিনা সে-কথা আর শোনা হয়নি। তার ঘুম নিয়ে মাঝে-মাঝে মনে হতো হয়তো বেঙ্গল গ্যালারির কর্মকান্ড আর শিল্পী এবং শিল্পকলার স্বার্থে দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম আর ভাবনা-চিন্তা করার জন্যেই তার এই ক্ষণে ক্ষণে নিদ্রামগ্ন হওয়ার ঘটনাটি ঘটে থাকে। এ নিয়ে আলাপ-সালাপও শিল্পীমহলে কম হয় না। সবার মুখে একই কথা – ‘হাড়ভাঙা খাটুনিটা কমাও। তোমার বিশ্রাম দরকার।’ কিন্তু কম করা তো দূরের কথা, দিনকে দিন বরং আরো বাড়িয়েই চলেছে।

যাই হোক, ক্যানবেরায় গাড়িতে বসে হাইকমিশনের বাসায় যাওয়ার পথে তাকে দেখলাম নাক ডেকে গভীর ঘুমে। ঠিক একই রকম ঘুমাতে দেখেছি মেলবোর্নে প্রদর্শনী উদ্বোধনের পর। অনুষ্ঠানটি খুব বর্ণাঢ্য আর প্রাণবন্ত হয়েছিল। লোকসমাগমের আধিক্য দেখে সুবীরকে নিশ্চিন্ত হতে দেখেছি। মেলবোর্নে বসবাসরত প্রবাসী বাঙালিদের সপরিবারে উপস্থিতি তো ছিলই, সেইসঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার কলারসিকদেরও ভিড় ছিল অবাক করা। সেখানে বসবাসরত অন্যান্য দেশের লোকজনও ছিল অনেক। সবাই বেশ আনন্দিত হয়েছিলাম দেখে যে, উদ্বোধনী অনুষ্ঠান আয়োজনে দেশের শিল্পকলার শুভানুধ্যায়ী প্রবাসী বাঙালিরা দারুণ সফল একটি অনুষ্ঠান করতে পেরেছে। অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের সহযোগিতায় তাদের যেসব সংগঠন এই দুরূহ কাজটি সমাধা করেছে সেসবের নাম ABC অর্থাৎ Australia-Bangladesh Cultural Exchange Inc এবং AFBC, – যার পুরো নাম Australian Friends of Bangladesh and Culture. তবে মূল কলকাঠি ঢাকায় বসে নড়ানোটা ছিল সুবীরেরই। সেটার ফল দেখে অবাক আমরা।

অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণ দেন ডা. মহিউদ্দিন আহাদ বাবর। চমৎকার বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের শিল্পীদের অস্ট্রেলিয়ার শিল্পাঙ্গনে তাঁদের চিত্রকর্ম প্রদর্শনের প্রয়োজনীয়তা, উদ্দেশ্য এবং উপলক্ষ সম্বন্ধে সম্যক উপলব্ধিগুলো ব্যক্ত করেন। যতদূর জানি তিনি ছিলেন এই প্রদর্শনীসহ সব আয়োজনের প্রধান চালিকাশক্তি। বেশ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। চমৎকার রসিকতা করার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও ধারণ করেন। তরুণদের খুবই শ্রদ্ধাভাজন।

অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন মুশফিকুর রহমান। তিনিও বাংলাদেশের শিল্পীদের ভূয়সী প্রশংসার পাশাপাশি বাংলাদেশের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক অবস্থা, শিল্পকলার মান, শিল্পীদের দেশের সাংস্কৃতিক জগতে অবস্থান সম্পর্কে সুন্দর বক্তব্য উপস্থিত করেন। তিনিও পুরো আয়োজনে সম্পৃক্ত বিশিষ্টজন। সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অপরিহার্য বিদগ্ধ জ্যেষ্ঠ প্রজন্মের মানুষ।

মেলবোর্নের আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ গ্যালারিতে এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন ন্যাশনাল গ্যালারি অব অস্ট্রেলিয়া কাউন্সিলের চেয়ারম্যান অ্যালান জেমস মেয়ার্স। বেশ মজার মানুষ। বিষয়ের সঙ্গে মোক্ষমতা মিশিয়ে তিনি রসিকতা করার দক্ষতা রাখেন। বাংলাদেশের আদ্যোপান্ত অনেক কিছুই জানেন। সেইসঙ্গে শিল্পকলার অবস্থাটিও। প্রশংসা করলেন প্রাণ খুলে বাংলাদেশকে নিয়ে। শিল্পকলাকে নিয়ে তো বটেই। সেইসঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত বাঙালিদেরও ভূয়সী প্রশংসা করলেন তাদের রুচিশীল মননের আলোকিত মানুষ আখ্যা দিয়ে।

সুবীর চৌধুরী তার স্বভাবসুলভ সাবলীল বক্তৃতায় বাংলাদেশের আধুনিক চিত্রকলাচর্চার মান, ইউরোপ-আমেরিকাসহ দেশ-বিদেশে সেসবের অবস্থান ইত্যাদি নিয়ে বেশ দীর্ঘ একটি সুচারু বক্তব্যের মধ্য দিয়ে উপস্থিত শিল্পীদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি মেলবোর্নের প্রবাসী বাঙালিদের কথা, অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসকারী সকল বাংলাদেশিকে ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা জানালো। বক্তৃতাটি দারুণ বুদ্ধিদীপ্ত এবং প্রাঞ্জল ছিল। তার সুন্দর বক্তৃতায় আমি মুগ্ধ না হয়ে পারিনি। অন্যরাও তাই। কথা প্রসঙ্গে বলেছিলাম, ‘সুবীর তুমি তো এখন পাকা বক্তা হইয়া গেছো। কী দারুণ গুছাইয়া কথা বলো ইদানীং।’ সুবীর মুচকি হেসে সরে গিয়েছিল।

অনেকগুলো ছবি উদ্বোধনী দিনেই বিক্রি হলে সুবীর সবসময় আনন্দিত হয়। কিন্তু এই প্রথম তাকে তেমন উচ্ছ্বসিত হতে দেখলাম না। অনুষ্ঠান শেষে কেমন যেন ম্রিয়মাণ মনে হলো। এটা আমার দেখার ভুল ভেবে কাউকে কিছু বলিনি। কিন্তু একটি ব্যাপারে চিন্তিত না হয়ে পারিনি। তা হলো – অনুষ্ঠান শেষের বেশ কিছু সময় পর যখন ভিড় কিছুটা কম হতে শুরু করেছে তখনই দেখলাম – সুধীর মূল কাউন্টারের কাছেই রাখা কফির টেবিলের পাশে বসা, হাতে কফির মগ। মগটি কাত হয়ে আছে এবং কফি পড়ে যাচ্ছে। সুবীর অঘোরে ঘুমাচ্ছে। আমি কাছে গিয়ে তাকে জাগালাম। এতোই গভীর ঘুম যে, বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগলো জাগতে। আসলে আগে কখনো এমনটা হতে দেখেনি। ডাকলেই চট করে জেগে যেতো। কিন্তু এবার তেমনটা না হওয়ায় একটু দুশ্চিন্তাই হলো। ব্যাপারটি নিয়ে শিল্পী মনিরের সঙ্গে আলাপ করলাম। দিন দুয়েক পর তার ঢাকা যাওয়ার কথা। দুদিন থেকেই আবার ফেরত আসার কথা সিডনিতে, সেখানকার প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। আমরা আতঙ্কিত তার এই পুনরায় কষ্টকর ভ্রমণের ব্যাপারে। বলেছিলাম – ‘এতো ধকল সহ্য হইবো না। অসুস্থ হইয়া যাইবা। মাত্র আসা হইলো, আবার যাইবা, গিয়া ফের অতোদূর থাইকা আসা কি সহজ কথা!’ সুবীর হেসে উত্তর দিয়েছিল, ‘স্যার, আমার তো ঘুমের ব্যাপার আছেই। যাওয়া-আসায় ঘুমাইতে ঘুমাইতে যামু, আবার একইভাবে ফেরত আসুম। অসুবিধা হইবো না। তাছাড়া আগে থাইক্যা ঠিক করা আছে। সেই কারণে মাল্টিপল ভিসাও নিয়া রাখছি। আর কাইয়ুম স্যারের স্বাধীনতা পুরস্কার নেওয়ার অনুষ্ঠানটা মিস করতে চাই না। স্যারের ভিসাটা নিয়াও একটু খোঁজ লাগামু। পাইলে স্যারকেসহ একসাথে আসুম।’

সুবীর সবসময়ই নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকে প্রায় জেদের মতো করেই। এবারো তাই করলো। সত্যি-সত্যিই ঢাকায় ফিরে গেল মেলবোর্ন থেকে এবং ২৭ মার্চ আবার ফিরে এলো লম্বা ভ্রমণ শেষে সিডনিতে। ২৯ মার্চ প্রদর্শনীর উদ্বোধন সিডনির কুইন্স স্ট্রিট গ্যালারিতে। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তাকে থাকতেই হবে – এমন ইচ্ছা পোষণ করেই তার তড়িঘড়ি ফিরে আসা। ওই যাওয়া-আসার ধকল থেকে পাওয়া ‘জেট-ল্যাগ’ না কাটিয়েই আবার প্রদর্শনীর কাজে নেমে পড়া চাট্টিখানি কথা নয়। তবু তার উদ্দীপনার যেন শেষ নেই। ছবির ফেটিগুলো খোলা, ছবি দেয়ালের জন্য ডিসপ্লে করা, টাঙানো, মোট কথা সবকিছুতে হাত না লাগলে যেন তার শান্তি নেই। অন্যদের ওপর ভরসা করতেই পারে না। আমি তার নিষ্ঠা প্রাণশক্তি আর চলমানতা দেখে বিস্মিত না হয়ে পারিনি। এও ঠিক যে, এতো হুলস্থূলের মধ্যে বিশ্রামের একটু সময় পেলেই ঘুমিয়ে নিচ্ছে বসে বসেই।

সিডনির প্রদর্শনীর উদ্বোধনে তাঁরই মুখ্য ভূমিকা নেওয়ার পালা। অনুষ্ঠানটি তাঁকেই পরিচালনা করতে হবে। এ-ব্যাপারে সে তো সিদ্ধহস্ত। যথারীতি তা সুন্দরভাবে সমাধাও করলো। আবারো বাংলাদেশের শিল্পকলা, শিল্পী এবং বেঙ্গল গ্যালারির কর্মকান্ড নিয়ে খুব গুছিয়ে সুন্দর একটি বক্তৃতা দিলো। প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন সাউদার্ন ক্রস ইউনিভার্সিটির চ্যান্সেলর ও অ্যাকশন এইড অস্ট্রেলিয়ার প্রেসিডেন্ট জন ডোওড।

সিডনির এই প্রদর্শনী আয়োজনকে সফল করার মূল দায়িত্বটি অস্ট্রেলিয়ানদের পক্ষ থেকে পালন করেন ডেভিড ডিটেল। বেশ মজার মানুষ মাথা-মোড়ানো এই ভদ্রলোকটি। নিজে খাঁটি অস্ট্রেলিয়ান নন। বাড়ি পূর্ব ইউরোপে, ক্রিমিয়ায়। কঠিন ক্যান্সারে ভুগছেন। জীবনের অবস্থাটি এখন-তখন, কিন্তু পাত্তাই দেন না। বাংলাদেশের শিল্পীদের কাজ প্রদর্শিত হচ্ছে এবং তিনি তাতে সম্পৃক্ত থাকতে পেরে মহাখুশি। মিশেছেনও সবার সঙ্গে হুলস্থূল করে। শহর ঘুরিয়ে দেখানোর কিছু দায়িত্ব পালন করেছেন সঙ্গে থেকে। শুনেছি নিজ থেকে কিছুটা খরচ-খরচাও করেছেন। ভদ্রলোকের উদ্দীপনা এবং ক্যান্সারকে পাত্তা না দেওয়ার ব্যাপারটি জেনে সুবীর আলাপ করতে গিয়ে বললো, ‘বেচারা ডেভিড। দারুণ সাহসী। ক্যান্সারের মতো রোগকেও পাত্তা দেয় না। আমাগো চাইতেও বুড়া ভালা আছে।’

সবচাইতে অভিভূত হয়েছি আমাদের জন্যে বাঙালি কয়েকজনের প্রায় সার্বক্ষণিক ব্যস্ততা এবং সবাইকে আপন করে নেওয়া দেখে। ভালো হোটেল ঠিক করে দেওয়া, সিডনির আনাচে-কানাচে অবস্থিত দর্শনীয় স্থানগুলোতে নিয়ে যাওয়া, দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানো থেকে শুরু করে প্রদর্শনীকে সফল করার যাবতীয় কর্মকান্ডে অকৃত্রিম শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় নিয়োজিত থাকা তুলনাহীন। বিশেষ করে বাংলা একটি টিভি চ্যানেলের কর্ণধার রহমতউল্লাহ চিরকাল সবার প্রিয় মানুষ হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। মনে পড়ছে সুবীর চৌধুরী যেদিন খুব কাকভোরে ঢাকা থেকে সিডনি বিমানবন্দরে পৌঁছাল তখন তাকে হোটেলে পৌঁছানোর ব্যাপারে যখন কাউকেই পাওয়া যাচ্ছিলো না তখন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রহমতই দুরূহ কাজটি সমাধা করেছিলেন।

রহমত বেশ হাসিখুশি সুপুরুষ। যতদূর শুনেছি একাকী জীবনে অভ্যস্ত। সংসারের বাঁধন নেই। ‘বিদেশ বাংলা’ নামে একটি টিভি পরিচালনা করেন, বিশেষ করে বাঙালিদের জন্যে। প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান পরিচালনায় সাবলীল উপস্থাপনের দায়িত্ব পালন করেছেন তাঁরই সহকর্মী বিদেশ বাংলা টিভির উপস্থাপিকা অ্যানি সাচরিন।

অনুষ্ঠানে ভিন্নতা মাখানো আবহ তৈরি হয়েছিল শিল্পী রোকেয়া সুলতানার অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী কন্যা লরা এবং জামাতা মিতুলের চমৎকার সংগীত পরিবেশনায়।

চারুকলায় দুর্বলতা রয়েছে এমন সিডনিবাসী বাংলাদেশি শিল্পমনাদের সমাগমে প্রদর্শনী দারুণ জমেছিল বলা বাহুল্য। তাঁদেরই অনেকের সহায়তা, সহযোগিতা এবং সম্পৃক্ততায় সিডনি শহরটি উপভোগ্য হয়ে উঠেছিল। এ প্রসঙ্গে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের মেজো ছেলে খায়রুল আবেদিন, ডা. ওয়াহিদুল ইসলাম, আমার ছাত্র ইকবাল রানা, আমার কনিষ্ঠ ভ্রাতা শিল্পী রেজাউন নবীর সম্বন্ধী শাহিন এবং একুশ অ্যাকাডেমির শামীম আল নোমান প্রমুখকে ভোলার নয়। ভালো লেগেছে সিডনিতে লেখাপড়া করতে আসা ভ্রাতুষ্পুত্রী মাইশা মালিহা এলাকে দেখতে পেয়ে এবং প্রদর্শনীতে সবাইকে সহায়তা করতে দেখে।

এতো ঘোরাঘুরি, হুলস্থূল-হইচইয়ে সুবীরকে ক্লান্ত মনে হলেও সবকিছুতে অংশ নিয়েছে তো বটে এবং জোর করেই আরো প্রোগ্রাম যুক্ত করেছে শহর ঘুরে বেড়ানোর। আমি নিজে ঠান্ডায়  সর্দি-কাশি-জ্বরে কাবু থাকায় কোথাও আর না গিয়ে হোটেলেই বিশ্রাম নেওয়ার কথা বলায় সুবীর মহা-আপত্তি জানায়। বলে, ‘স্যার অস্ট্রেলিয়ায় আবার কবে আসা  হয় কি না হয় তাই যতোটুকু পারা যায় দেইখা লই। চলেন স্যার যাই। ঠান্ডার ওষুধ আমার কাছে আছে। মেলবোর্নে ডা. আহাদ দিছিলেন। ওইটা খাইয়া ভালো হইছে। কাজে দিছে খুব।’

এই পর্যায়ে বলে নিই, সুবীর ঢাকা থেকেই প্রচন্ড সর্দি-কাশিতে ভুগছিল। মেলবোর্নে তা বেশ খারাপের দিকে গেলে বুকে কনজেশান হওয়ায় গলা বসে গিয়েছিল। সিডনিতে বাঙালিদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি কাজ আমাদের সবাইকে অভিভূত করেছিল, তা হলো, ‘আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস’ উদযাপন উপলক্ষে নির্মিত ’৫২-এর ভাষাসৈনিকদের স্মরণে সিডনির অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য একটি পার্কে শহীদ মিনার। প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে এখানে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর নিয়ম করা হয়েছে। প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে এখানে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সংশ্লিষ্ট আয়োজক শামীম আল নোমান একুশ অ্যাকাডেমির পক্ষে কেমন করে শহীদ মিনার বানানোর অনুমতি আদায় করা হয়েছিল সরকার এবং সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে তার বিশদ বর্ণনা দেন।

এইসব সাফল্যের কথা শুনে বুঝতে পেরেছিলাম যে, বাঙালিরা বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রবাসী বন্ধুরা সিডনিতে তথা সমগ্র অস্ট্রেলিয়াতেই বেশ সম্মানের সঙ্গে বসবাস করছেন এবং নিজ দেশকে, দেশের ভাষা এবং সংস্কৃতিকে নিয়ে গর্বিত জীবনযাপন করছেন।

ক্যানবেরার প্রদর্শনী পহেলা এপ্রিল। অতএব একদিন আগেই সিডনি থেকে রওনা দিতে হয়েছিল। দূরত্ব মেলবোর্নের সমান নয়। অর্ধেকের মতো। কিন্তু সাত-সকালে রওনা দিয়েও পৌঁছাতে দুপুর পার, পথ ভুল করায়। গাড়ি চালাচ্ছিল সিডনির আনোয়ার আকাশ। অনর্গল কথা বলা তার অভ্যাস। অস্ট্রেলিয়াতে তার বসবাসের শুরু থেকে অদ্যাবধি যতো কর্মকান্ড এবং সাফল্য সেসব নিয়েই তার গল্পটা। ‘বাংলা একাডেমী’ নামে একটি সংস্থা পরিচালনা করে। তার অনবরত কথার তোড়ে সুবীর তো বটেই আমিও ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। অতএব ওই সময়টুকুতে কী যে বলেছিল তা আর শোনা হয়নি।

একসময় হঠাৎ গাড়ি থামলে ঘুম ভাঙে। দেখি একটি ঈষৎ-পাহাড়ি সুন্দর এলাকায় গাড়ি থামিয়েছে। বললো, ‘আপনারা তো শিল্পী তাই সুন্দর একটি জায়গায় থামালাম। কী সুন্দর সবুজ চারদিক আর নীল আকাশ, নিশ্চয় ভালো লাগছে আপনাদের।’ আমরা হাঁ-হুঁ করলাম বটে কিন্তু সবার ভাবনায় তখন ক্যানবেরায় প্রদর্শনীর গ্যালারিতে ছবি পৌঁছানো। অতো ছবি বাক্স থেকে খোলা, সাজানো এবং ঝোলানো বেশ সময়সাপেক্ষ। গ্যালারিতে যাঁরা কাজগুলো করবেন তাঁরা সবাই নিশ্চয়ই অপেক্ষায় আছেন ভেবে সবাই উদ্বিগ্ন। তাই প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার জন্যে গাড়ি দাঁড় করানোর ব্যাপারটি খুব মনঃপূত হয়নি কারো। খুব নতুন কোনো দৃশ্যও নয়। মেলবোর্ন থেকে সিডনি যাওয়ার পথে অন্ধকার না-নামা পর্যন্ত এই একই দৃশ্য চোখে পড়েছে। তাও যদি ক্যাঙ্গারু দেখা যেতো তো মজা পেতাম। দেখলাম কয়েকটা হাড়-জিরজিরে ঘোড়া চরছে।

উদ্দেশ্যটা বোঝা গেল মিনিট দুয়েক পরেই। আমরা অবাক  হয়ে দেখলাম যে, গাড়ির পিছন-ডালা খুলে আকাশ একগাদা রংতুলি-কাগজ-পেনসিল ইত্যাদি বের করে আনলো আমাদের দিয়ে ছবি আঁকানোর জন্যে। তা দেখে তো চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। এই কান্ড দেশে কেউ আমাদের বয়সী কাউকে বলার কথা ভাবে বলে ধারণাই করতে পারি না। মনির গুনগুনিয়ে বললেন, ‘কী বুঝলেন?’

আচরণ পছন্দ হোক বা না হোক আমিসহ মনির এবং ফরিদা জামানকে একটা করে ছবি এঁকে দিতে হলো। তারপর যখন আবার রওনা দেওয়া হলো তখন দেখি সূর্য মধ্যগগনে। তো আবার ১১০ কিলোমিটার বেগে চলা এবং একনাগাড়ে কথা বলতে বলতে একসময় মেলবোর্নের পথের দিকে শ’খানেক মাইল পার হওয়ার পর তার খেয়াল হলো যে ক্যানবেরা যাওয়ার বাঁদিকে কাটার পথটি মিস করে গেছে। তাইতে বিপত্তি বাড়লো। অতোদূর থেকে আবার ইউটার্ন নিয়ে ফিরতি পথ ধরা এবং শেষতক বেশ সময় ক্ষেপণ করে তবে ক্যানবেরা পৌঁছানো গেল।

গ্যালারির মহিলা ছবি খোলা, সাজানো এবং ঝোলানোর ব্যাপারে কাউকে হাত লাগাতে দিলেন না। তা দেখে তো সবাই অবাক। একা হাতে নিয়ে নিলেন সব দায়িত্ব। এমনকি এসব ব্যাপারে খুঁতখুঁতে স্বভাবের সুবীরকেও কিছু করতে দিলেন না। তবু বিকেল পর্যন্ত গ্যালারিতে থেকে শেষে হাইকমিশনারের বাসায় যাত্রা করতে হলো শহর দেখতে দেখতে। ছড়িয়ে থাকা শহর। আকাশচুম্বী ইমারত নেই। গাছ-গাছালিতে ঢাকা বলে আবাসিক বাড়িগুলোও দেখা যায় না প্রায়।

একসময় বেশ উঁচু টিলা-টিলা মতন পাহাড়ি একটি এলাকা দিয়ে গাড়ি চলতেই হাইকমিশনার লে. জে. (অব.) মাসুদউদ্দীন চৌধুরী বললেন ক্যাঙ্গারু দেখাবেন। তার বাসার কাছেই একটা দল থাকে। সত্যিই তাই। একটা মোড় নিতেই দেখি ছয়টি ক্যাঙ্গারু একটা বাড়ির কাছে বসে আছে। আমরা প্রায় সবাই বলে উঠলাম, ‘যাক্! এবার মনে হচ্ছে আমরা অস্ট্রেলিয়ায় আছি।’

ক্যাঙ্গারু নিরীহ প্রাণী। গাড়ি দেখলেই ভীত হয়ে পড়ে। তাই হলো। আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে লাফ-ঝাঁপ দিয়ে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াল। আমরা আর দাঁড়ালাম না। কিছুদূর গিয়ে সুন্দর একটি প্রাকৃতিক পরিবেশে অবস্থিত একটি উঁচু টিলার একটি সুরম্য বাড়িতে গিয়ে থামলাম। এটিই হাইকমিশনারের বাসস্থান। বলা বাহুল্য, তাঁর বাসাতেই আমি এবং মনিরুল ইসলাম ছিলাম। তাঁর এবং ভাবির আতিথেয়তা ছিল তুলনাহীন। সেই সঙ্গে পুত্র-কন্যারাও আমাদের নানাবিধ বায়নার সুরাহা করে দিত হরেক ব্যস্ততায়ও।

তাঁদের ঢাকা ফিরে আসার সময় হয়ে গিয়েছিল। অতএব মালপত্র বাঁধাছাঁদা নিয়ে সবাই ব্যস্ত। এতদসত্ত্বেও সুবীরের অবস্থা নিয়ে, চিকিৎসা নিয়ে প্রতিমুহূর্তে ডাক্তারদের সঙ্গে যোগাযোগ করে, আবার মাঝেমধ্যেই হাসপাতালে গিয়ে দেখে আসার ব্যাপারটিও করছিলেন। আমরা তাঁকে সুবীরকে নিয়ে ভাবতে দেখে নিশ্চিন্ত বোধ করছিলাম।

আসলে অস্ট্রেলিয়ায় প্রদর্শনীগুলো অনুষ্ঠিত হওয়া, ভিসাসহ সব ধরনের ব্যবস্থাপনা এবং সহায়তার ব্যাপারগুলো দূতাবাসের সবার সম্পৃক্ততায় সুসমাধা হতে পেরেছিল। অংশগ্রহণকারী শিল্পীদের সঙ্গে ক্যানবেরা নিবাসী প্রবাসী বাংলাদেশিদের এবং অস্ট্রেলীয় শিল্পী ও শিল্পানুরাগীদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্যে ডিনারের ব্যবস্থাসহ প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে সফল করার সব দায়িত্ব সুচারুভাবে তাঁরা পালন করেছেন। মনে আছে, সবকিছু নিয়ে ফার্স্ট সেক্রেটারি সেহেলি সাবরিন সাঈদের ব্যস্ততা আর সহযোগিতার কথা। হাইকমিশনারের বাসায় পৌঁছে দুশ্চিন্তার ঘটনাটি ঘটলো।

গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে সুবীর হঠাৎ ভারসাম্য হারিয়ে টলে উঠলো। পড়তে গিয়ে গাড়ির দরজা ধরে সামালে নিল। কিন্তু ব্যাপারটা অস্বাভাবিক মনে হলো। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সুবীর বলল – ‘কেন যেন মাথাটা ঘুইরা গেলো। এমন তো আগে কখনো হয়নি।’ বললাম, ‘তোমার ভ্রমণের জেট-ল্যাগ এখনো কাটেনি। রেস্টের অভাব। ঢাকায় গিয়ে থরো চেকআপটা করাইয়া নিও।’ সুবীর সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে বললো, ‘এখন কোনো ওষুধপাতি পাওয়া যায় কি না দেখতে হইবো।’

হাইকমিশনার জানালেন, ক্যানবেরায় বাঙালি অনেক ডাক্তার রয়েছেন। তাঁদের অনেকের সঙ্গে দেখা হবে সন্ধ্যায় এখানেই। তখন আলাপ করা যাবে। তাই হলো, তরুণ ডাক্তার যাঁরা এলেন সবাই পরদিন সকালে হাসপাতালে নিয়ে যাবেন দেখাতে। এই মুহূর্তে পরম সুহৃদ ডাক্তারবৃন্দের নাম মনে আসছে না। তার জন্যে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। তবে তাঁরা ডা. শাহরিয়ারকে যোগাযোগ করে সকালে হাসপাতালে যাওয়ার ব্যাপারটা ঠিক করে নিলেন। ততক্ষণে সুবীর বেশ সুস্থ বোধ করায় আমরা নিশ্চিন্ত হলাম।

রাতে ডিনারের দাওয়াত এজাজ মামুন হ্যাপির বাসায়। তাঁর স্ত্রী স্বপ্না যে পাকা রাঁধুনি টের পেলাম ডিনারে গিয়ে। দেশি সুস্বাদু খাবার পেয়ে তো সবাই খুব খুশি। লক্ষ করলাম সুবীরও বেশ তৃপ্তির সঙ্গে খেল এবং গল্প করলো। হ্যাপি ভদ্র, অমায়িক অথচ চটপটে, হ্যান্ডসাম আর উদ্যমী ছেলে। পুরো প্রদর্শনীর জন্যে যা কিছু করার তা তো নিষ্ঠার সঙ্গে করেছেনই, সেই সঙ্গে সুবীরকে পরদিন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারেও ছোটাছুটি করেছেন, ডাক্তারদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।

হাসপাতালে যাওয়ার পর সুবীরের অবস্থা দেখে ডাক্তাররা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। সিটিস্ক্যান থেকে যা যা চেক করা দরকার সবই করা হবে, তাতে সারাদিন লেগে যাবে বলা হলো। দেখতে দেখতে প্রদর্শনী উদ্বোধনের সময় এসে গেল। অতিথিদের আগমনে গ্যালারি বেশ সরগরম। কিন্তু সুবীর তখনো পৌঁছালো না। যখন অধির দুশ্চিন্তা নিয়ে সবাই ভাবছি কী করবো, তখন সুবীরই টেলিফোন করে জানালো যে, তার আসা হচ্ছে না অনুষ্ঠানে। আরো বেশ কিছু টেস্ট বাকি।

নির্ধারিত সময়ে প্রদর্শনী উদ্বোধন করতেই হলো। প্রধান অতিথি হাইকমিশনার লে. জে. (অব.) মাসুদ চৌধুরী থেকে শুরু করে সবাই বক্তব্য রাখতে গিয়ে সুবীরের অসুস্থতাজনিত কারণে অনুপস্থিতির কথা বললেন এবং তার আশু রোগমুক্তি কামনা করলেন।

হাইকমিশনার বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চায় যে আদিকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত যে আন্তর্জাতিক মান এবং বিশ্বে যে সেসব সমাদৃত তা নিয়ে বললেন। বক্তব্য রাখলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর এবং শিল্পী সমিতির সভাপতিও। অনুষ্ঠান ভালো হলো ঠিকই কিন্তু সবারই মন খারাপ সুবীরের জন্যে। এই প্রথম সুবীর কোনো উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারলো না।

অনুষ্ঠান শেষে যখন বেশ উদ্বিগ্ন সবাই তখন এক পর্যায়ে সুবীর হাসপাতাল থেকে আমাকে টেলিফোনে কণ্ঠ খুব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে যে-খবরটি আমাকে দিলো তা শুনে থ’ বনে গেলাম। বলল, ‘স্যার, সিটিস্ক্যানে আমার ব্রেইনে টিউমার ধরা পড়েছে। পরে কথা বলবো।’

কী উত্তর দেবো? প্রথমে তো বিশ্বাসই করিনি। ভুল রিপোর্ট বলে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলাম। দুশ্চিন্তা না করার জন্যে সাহস দেওয়ার চেষ্টা করলাম। তারপর তক্ষুনি হাসপাতালে পৌঁছলাম হাইকমিশনারের সঙ্গে।

সেখানে গিয়েও সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলাম। দেখলাম সুবীর অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে নিয়েছে পুরো ব্যাপারটাকে। বললো – ‘স্যার আমার বোধহয় আপনাদের সঙ্গে মেলবোর্ন বা ঢাকায় ফেরা হবে না। এখানে এতোবড় হাসপাতালে যখন রোগটা ধরা পড়লো – চিকিৎসাটা যতোদূর পারি এখানেই করে যাই।’ আরো বললো – ‘আমার স্যার বেশ কয়েকটা ইন্স্যুরেন্স করা আছে। টাকা-পয়সার অসুবিধা হইবো না আপাতত।’

আমি তো বিদেশ বিভুঁইয়ে তার এই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়া নিয়ে ভীষণ শঙ্কিত হয়ে পড়লাম। কী করা উচিত ভেবে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু সুবীরের মনোবল দেখে তার সিদ্ধান্তকেই মান্যি করতে হলো। হাসপাতালে কয়েকবার গিয়ে ডাক্তারদের সঙ্গেও এ নিয়ে আলাপ হলো। তাঁরাও সুবীরকে ক্যানবেরাতেই এবং ওই হাসপাতালেই অন্তত বাকি চেক-আপগুলো শেষ না করা পর্যন্ত রাখার পরামর্শ দিলেন। তবে খরচ-খরচা যে আকাশচুম্বী হতে পারে সে-কথাও জানিয়ে দিলেন।

আমরা তাৎক্ষণিক খরচের দিকটা সামাল দিতে প্রদর্শনী থেকে বিক্রয়লব্ধ আমাদের ছবির সমস্ত টাকা হাসপাতালের জন্যে রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। মেলবোর্নে ফিরে গিয়ে জানলাম ‘আনন্দপাঠ’ বিদ্যালয়ের অংশ তাঁরা এ-ব্যাপারে ছাড় দিতে সম্মত নয়। তাঁরা তাঁদেরটা নিয়েই নেবেন। ব্যাপারটা আমাদের সবাইকে ক্ষুব্ধ করেছিল। সুবীরের সহযোগিতায় যে এতোজন শিল্পীর ছবি স্কুলটির ফান্ড তৈরির ব্যাপারে পেয়েছিল, তা তো এমনিতে পাওয়া সহজ ছিল না। কারণ অংশগ্রহণকারী সব শিল্পীই দেশে প্রথিতযশা বলে তাঁদের ছবি পাওয়া সহজ নয়। যত্রতত্র ছবি দেনও না।

সুবীর বিদ্যালয়টির প্রতি কিংবা কর্ণধার কায়সারের প্রতি স্নেহের কারণে বিশেষ দুর্বলতা পোষণ করে বলেই এই প্রদর্শনীটির ব্যবস্থা করেছিল আপ্রাণ চেষ্টা করে। সবটা শুনে সুবীর মর্মাহত হয়েছিল; কিন্তু কিছু বলেনি। আমরা হতবাক হয়েছিলাম কায়সারের সিদ্ধান্ত এবং কথিত ফান্ডের টাকা নিয়ে বেঙ্গল গ্যালারি ও শিল্পীদের প্রতি অবিশ্বাস দেখে।

ঢাকায় বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের কর্ণধার আবুল খায়ের ব্যাপারটা শুনে তখনই তাঁদের টাকা দিয়ে দেওয়ার কথা জানিয়ে দেন এবং সুবীরের চিকিৎসার সমস্ত ব্যয়ভার, তা যতো টাকাই হোক, তিনি বহন করবেন বলে জানিয়ে দেন। শুধু কর্তব্যজ্ঞান থেকে নয়, সুবীরের প্রতি স্নেহ-ভালোবাসাও তাঁর এই সিদ্ধান্তের প্রধানতম কারণ। প্রতিদিন টেলিফোনে সুদূর ঢাকা থেকে সুবীরের চিকিৎসাজনিত খোঁজখবর নেন, সাহস জোগান। শুধু তাই নয়, সুবীরকে সুস্থ ফিরে পেতে যা যা করণীয় করবেন বলে জানান।

তিনি কথা রেখেছেন। প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী তিনি সম্প্রতি নিজে সিডনিতে গিয়ে অভিভাবকের দায়িত্বটি পালন করে আসেন। আমরা শিল্পীরা তাঁর এই সিডনি এবং মেলবোর্নে যাওয়া, সুবীরের ব্যাপারে বড় ডাক্তারদের যে-দ্বিধাগুলো ছিল চিকিৎসা নিয়ে, সেসবের সুরাহা করেছেন। তাঁকে সাধুবাদ জানানোর ভাষা নেই। সুবীর এখন কেমোথেরাপি নিয়ে ক্রমশ সুস্থ হয়ে উঠছে। আমরা নিশ্চিন্ত বোধ করছি জেনে যে, ব্রিসবেনে পিএইচ. ডি করতে যাওয়া সুবীরের পুত্র সর্বক্ষণ বাবার সেবায় নিয়োজিত আছে। সঙ্গে রয়েছে সুবীরের ভাগ্নি এবং ভাগ্নিজামাই। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন এবং ডাক্তারদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও দেশের শিল্পীসহ শুভানুধ্যায়ীর শুভ কামনা বৃথা যাবে না এবং সুবীর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে বলে আমি নিশ্চিত। আমি তার আরোগ্য কামনা করছি। সুবীর সুস্থ হয়ে ফিরে আসুক।