\ ১০ \

ঘরে ফিরে অমলিনী প্রশান্ত মনে স্নান করল। পাজামা টি-শার্ট চাপাল। কফির জল বসিয়ে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে শতদলকে ফোন করল। কথা বলতে বলতে দেখতে পেল বস্ন্যাক ড্রাইভার বেঞ্জামিন ইয়াসমিনদের নিয়ে ফিরল। তারা মাত্রাতিরিক্ত উচ্চৈঃস্বরে কথা বলছে। বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। সবাই নেশার মজায় ডুবে আছে এখনো। তার মনে পড়ল ইয়াসমিনের কোনো বাড়তি পোশাক নেই।  আজো কি সে ওই এক পোশাকে রাত কাটাবে? কিংবা নগ্ন হয়ে শুয়ে পড়বে! রাত পোহালে ময়লা, দুর্গন্ধ, ঘেমো পোশাকে ফের ঢুকিয়ে নেবে শরীর! আহা রে! কী বিশ্রী ব্যাপার!

ফোনের স্বাধীনতা লাভ করে সে শতদল, রাধিকা ও তাদের মেয়ে চিন্টুর সঙ্গে কথা বলতে লাগল।

শতদল : অবশেষে তোমার ফোন এলো। আমরা খুব ভাবছিলাম। এখানে সব ভালো আছে। ঠিকঠাক আছে। আমি নিয়মিত মায়ের খবরাখবর নিচ্ছি।

মোলি : মার সঙ্গে কীভাবে কথা বলব বলো তো! পনেরো ডলার দিয়ে কলকার্ড কিনেছিলাম, বোধহয় ঠকে গেছি।

শতদল : তুমি ঠকবে না, তা কি হয় মলি? শোনো তুমি রাধিকা আর চিন্টুর সঙ্গে কথা বলো। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমাদের এখানকার রাতে ফোন কোরো। রোববার দেখে একটা সময় ঠিক করে রেখো। মাসিমার কাছে গিয়ে তোমায় কথা বলিয়ে দেবো। আর শোনো, ওখানে গিয়ে অন্নপূর্ণা হয়ে যেয়ো না। এখানে তো পাখি কুকুর বেড়াল মানুষ সব লাইন দেয় তোমার বাড়িতে। ওখানে তোমার নিজেকে দেখাশোনা করতে হবে।

কত ছোটবেলার বন্ধু শতদল! অমলিনীর পরমাত্মীয়। যেভাবে চিন্টুর যত্ন নেয়, রাধিকার দেখাশোনা করে, সেভাবেই শতদল অমলিনীরও দায়িত্ব নিতে চায়। বিশেষত, সন্দীপন বিষয়ে অমলিনীর যাবতীয় দুঃখজর্জরতার ভার অনেকটা বয়ে দেয় সে। আন্তরিকভাবে চায়, সন্দীপন মলিকে বুঝতে শুরু করুক। এই তো মানুষের জীবন, ছোট, সংক্ষিপ্ত, প্রতি পদে অনিশ্চয়তা। তারই মধ্যে কেন এত ভুল বোঝা! সে এসবের থই পায় না। সে সক্কলকে ভালোবেসে সহজভাবে বাঁচতে চায়।

হোয়াটসঅ্যাপ ভিডিওতে রাধিকা ও চিন্টুকে সারাঘর ঘুরিয়ে দেখাল অমলিনী। কিছু গল্প করল। রাধিকা তার খাবারের ব্যবস্থা জানতে চাইল। ওদের সঙ্গে কথা বলে অদ্ভুত আরাম পেল অমলিনী। আমি চুপচাপ নরম চেয়ারে বসে তার উৎসাহ  দেখছিলাম। উৎসাহিত হলে সে ভারী উজ্জ্বল। বুঝতে পারছি চিন্টু আর রাধিকাও তার কতই কাছের! নেহাতই মামুলি বাসস্থান, তবু সে সব দেখাচ্ছে, তারাও আগ্রহ নিয়ে দেখছে! তাকে যদি আমাদের সেই প্রাসাদোপম বাড়িটায় নিয়ে যেতে পারতাম, যেখানে আমার মা ছিল, আববাজান, আমার ভাইবোনেরা, কী বিশাল বাগান, নীল সমুদ্রের অপার বিস্তার ও অসামান্য সৌন্দর্য! আনন্দে পাগল হয়ে যেত আমার অমলিনী! কিন্তু সেখানে আর আমার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না। এই বায়ব-শরীরেও না। কাল রাত্রে পিতা এসেছিলেন। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন পরমপিতা পরমেশ্বর! আমার মধ্যে শক্তি সঞ্চার করলেন ঈশ্বর! তাঁরই করুণায় আমি মাটিতে মিশে যেতে যেতে, কীট থেকে কীটাণু হয়ে উঠতে উঠতেও ফের পেয়েছি মানবিক অনুভব। পেয়েছি আমার সাহিত্য রচনা। পেয়েছি প্রেম! আমি পূর্ণ হয়ে উঠছি! আমি কৃতজ্ঞ, আমি বিনত!

পিতা বললেন, ‘যাবে?’ আমি বললাম, ‘সেই গৃহে?’

‘যেতে চাও?’

‘না।’

‘সব দাগ মুছে গেছে।’

‘তবু না।’

‘তোমার স্মৃতি আজো পূর্ণ?’

‘সম্পূর্ণ, আববাজান।’

‘বেশ।’

আমি যাব না, তবু যাব। আমি যে অমলিনীর হৃদয়ে-মনে, আঁখিতে-চিন্তায়! আমি যে ভালোবেসেছি আমার পুনরুত্থানের অ্যামেলিয়াকে!

 

কথা শেষ করে অমলিনী নিজের দুটি নতুন পাজামা ও টি-শার্ট বার করল। ইয়াসমিন তার চেয়ে অনেক বেশি স্বাস্থ্যবতী। তবু এই পোশাক তার কাজে লাগতে পারে বলে তার মনে হলো। সে ইয়াসমিনের দরজায় টোকা মারল।

ইয়াসমিন : হু ইজ ইট?

মোলি : আমি অমলিনী, তুমি কি আমার ঘরে একবার আসতে পারবে?

ইয়াসমিন : নিশ্চয়ই। একটু দাঁড়াও।

মোলি : শোনো ইয়াসমিন, এই দেখো, তোমার জন্য দুপ্রস্ত  পোশাক বার করে রেখেছি। একদম নতুন। দেখো, এখনো ট্যাগ লাগানো আছে। আমি কি তোমাকে এগুলো দিতে পারি?

ইয়াসমিন : কিঁউ না হাম হিন্দি মে বাঁতে করে মোলি?

মোলি : আমি হিন্দিতে খুব কাঁচা। হয়তো ভুলভাল বলব। ফিরভি, অগর তুমে খুশি হোগি তো মায় কৌশিস করতি হুঁ!

দুজনে হাসল কিছুক্ষণ। ইয়াসমিন পোশাকগুলো কোলে নিয়ে বলল, ‘আমি কোনোদিন ভুলব না, ইস আমেরিকামে কোই মেরি দরওয়াজে পর আয়ে অওর কঁহে, এই নাও, আমার জিনিস তোমাকে দিলাম। মোলি, সো নাইস অব ইউ। এগুলো আমি অবশ্যই নিতাম। কিন্তু একটু আগেই এখানে ফিরে দেখি আমার সুটকেস এসে গিয়েছে। তুমি যখন এলে, আমার ঘরে সুটকেস খুলে বসে ছিলাম। তুমি আমার পরমাত্মীয় মোলি!’

অমলিনীকে অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে রইল ইয়াসমিন। অমলিনী তার খোলা চুলে পিঠে আদর করতে লাগল। বাচ্চা মেয়ের মতো আদর খেল ইয়াসমিন। যখন মুখ তুলল, তার কাজল-পরা চোখে জল। পরস্পরকে চুমু খেল তারা।

‘মিসিং হোম?’

‘আই নিড দিস হাগ।’

কে ইয়াসমিন। পাকিস্তানের কোথায় থাকে। কী লেখে। কেমন লেখে। কেমন তার ব্যক্তিগত জীবন। কিছুই জানে না অমলিনী। তবু তার বুকের মধ্যে ইয়াসমিনের জন্য আবেগ ক্রিয়া করে। মেয়েটা কি একা? তারই মতো?

সে কি একা? এক আবেগ তাকে নিয়ে গেল অন্য আবেগের কাছে। কেন তার নিজেকে একাকী মনে হয়? তার মা আছে, কয়েকজন ঘনিষ্ঠ, নির্ভরযোগ্য বন্ধু আছে, তার প্রিয় পাঠককুল আছে, তার সমাজ তাকে সম্মান ও স্বীকৃতি দেয়, হতে পারে তার অর্থনৈতিক অপ্রতুলতা আছে; কিন্তু সে কারো ওপর নির্ভর করে না। তবু কেন একা লাগে? এ কি সৃজনশীল মনের বৈশিষ্ট্য। চির-একাকিত্ব, চির-অতৃপ্তি। নাকি যাকে জীবনসঙ্গী ভেবেছিল, যে দূরে চলে গেছে, তার না-থাকাই একমাত্র কারণ। মানবজীবনের দাঁড়িপাল্লা কি এমনই অদ্ভুত? তার একদিকে মন ও শরীর ছেয়ে-যাওয়া প্রণয়াবেগ, অন্যদিকে জীবনের আর সব? নাকি সে-ই এমন। লেখাই কি তার কাছে প্রধান নয়? কিন্তু এই প্রাধান্য সর্বব্যাপী হতে পারে না। তার লেখার তৃষ্ণা সীমাহীন। তার ভালোবাসার তৃষ্ণাও মেটে না কখনো। অনির্বাণ অগ্নির মতো একটু ভালোবাসার জন্য তার হৃদয় পুড়ছে তো পুড়ছেই। আমি ভালোবাসতে চাই। ভালোবাসা পেতেও যে চাই। আমি কি আজো সন্দীপনকে ভালোবাসি? আজো কি তাকে ভেবে আবেগ উথলিত হয়? সে কি আমাকে ভালোবাসে?

সে হোয়াটসঅ্যাপ আইকনে সন্দীপনের ছবিতে আঙুল রাখল। ছবি নেই। পরিবর্তে একটা নীল মাছরাঙা। সে নিজস্ব গ্যালারিতে সন্দীপনের কিছু ছবি দেখল। লিখল – কথা বলতে ইচ্ছে করছে।

মুছে ফেলল।

আমাকে কি একটুও মনে পড়ে?

মুছে ফেলল।

একবার জানতেও চাও না, ভালো আছি কি না? মুছে ফেলল।

আশা করি ভালো আছ। আমি আইওয়ায়। ফোন কল ব্যবস্থা করিনি। হোয়াটসঅ্যাপ কোরো।

এখানেই থামল সে। ভাবল, বেশি কথা লেখা হলো কি? ঠিক আছে। সে যে কথা বলতে চায়, এই ইঙ্গিত খুব পরিষ্কার। এবার দেখা যাক।

শোবার আগে পর্যন্ত বারবার হোয়াটসঅ্যাপবার্তা দেখল সে। কিছু নেই। মাঝরাতে দেখল। সন্দীপন বার্তাটি পড়েছে। উত্তর লেখেনি। অপমানে ঘুম ছুটে গেল তার। কান জ্বালা করছে। উঠে আলো জ্বালাল। জল খেল। ফের আলো নিবিয়ে জানালায় এসে দাঁড়াল। বৃষ্টি পড়ছে। জলের ফোঁটায় লেগে আছে রাত্রির বাতির বিচ্ছুরিত আলো। জানালার কাচে থেঁতলে যাচ্ছে জলের ফোঁটার মতো। কটা সামান্য কথা, ভালো আছি, ভালো থেকো – এটুকুও লেখা কি যেত না? কিংবা আর কিছু। আমি তোমাকে চাই না! লিখো না! কিংবা আই মিস ইউ।

ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো সে। একা একা হেঁটে বেড়াতে লাগল করিডোরে। এত রাতেও দু-চারজন স্টুডেন্ট পেল সে। এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত বরাবর পায়চারি করতে লাগল। এই মুহূর্তে সে চাইছিল কেউ আসুক, কথা বলুক তার সঙ্গে। তাকে একটু বুকে জড়িয়ে ধরুক! যেমন জিনেটকে জড়িয়ে আছে ইয়েরমেন। যেমন ভেরোনিকা মুখ ডুবিয়ে আছে সের্গেইয়ের বুকে। ইয়াসমিন নিডস এ হাগ। আমালাইনি ঘুফতা নিডস এ হাগ টু!

আমার বায়বীয় শরীর আর পরিপূর্ণ ভালোবাসায় আমি জড়িয়ে ধরলাম তাকে। বললাম, চলো, আমি তোমায় বুকে নিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিই। সে শুনতেও পেল না। আসেত্ম আসেত্ম সে আড্ডাঘরের জানালায় দাঁড়াল। তাকিয়ে রইল নদীর দিকে। পথবাতির আলোয় চিকচিক করছে নদীজল। বৃষ্টি পড়ছে তো পড়ছেই।

 

 

২২ আগস্ট             যেখানেই যাও, যত দূরে

মঙ্গলবার               অর্ধেক পৃথিবীর পথ ঘুরে

খেতে হবে, খেতে হয়

প্রোটিনের মধ্যে থেকে কবিতার নবজন্ম হয়।

একুশ তারিখ সোমবারের মতো বাইশ তারিখ মঙ্গলবারও সারাদিন ব্যস্ত হয়ে রইল তারা। প্রাতরাশের আড্ডা জমাবারও সময় হলো না। সকাল নটায় সারা অর্ধেকসংখ্যক রাইটার নিয়ে চলে গেল ব্যাংকে। প্রথম দফার চেক পাবে তারা। ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলা হবে।

যাবার আগে সারা এলো অমলিনীর দরজায়। বলল, ‘ঠিক সাড়ে ১০টায় তোমাদের নিয়ে যাব। দ্বিতীয় দল। কী কী সঙ্গে নেবে জানো তো?’

মোলি : নিশ্চয়ই। অনুষ্ঠানসূচিতে সেসবও লেখা আছে।

সারা : থাকলে কী হবে। রাইটাররা ওসব পড়ে না। আর পড়লেও  ভুলে যায়। আমার ছত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতা বুঝলে। আমি আর আমার স্বামী ভিক্টর ইয়াপের সঙ্গে ছত্রিশ বছর ধরে যুক্ত। কত ওঠা-পড়া দেখেছি, কতবার অর্থাভাবে এই প্রোগ্রাম উঠে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। আরো কত কারণে প্রায় উঠে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। আমি  আর ভিক্টর সোজা ডিনের সঙ্গে কথা বলেছি, যেভাবেই হোক, একে রক্ষা করতে হবে। কত লেখক কবি দেখলাম। কত অভিজ্ঞতা হলো। আমি রাইটারদের তত্ত্বাবধায়ক, কিন্তু লেখার ক্ষমতা নেই। মেয়েরা বলে, শুধু স্মৃতিকথা লেখো মা। অমূল্য রচনা হবে। কে জানে! ডোনাল্ড ট্রাম্প যেভাবে শিল্পে-সাহিত্যে সরকারি অনুদান কমিয়ে দিচ্ছে, বেশিদিন লোকটা থাকলে আমাকে ঘরে বসে ওই স্মৃতিকথাই লিখতে হবে!

মোলি : লেখকদের নিয়ে তোমার স্মৃতিকথা নিশ্চয়ই এক অমূল্য রচনা হবে সারা। তোমার মেয়েরা ঠিকই বলে। তবে আমি চাই, তুমি মনের আনন্দে লেখো। দেখো ইয়াপ পঞ্চাশ বছর পূর্ণ করল। সারাবিশ্বে শুধু কাব্য-সাহিত্যের এমন বিশাল ও দীর্ঘস্থায়ী কর্মশালা আর আছে বলে আমার জানা নেই। তুমি তার প্রত্যক্ষ অংশীদার সারা। তোমার স্মৃতিও প্রশংসনীয়। তুমি লিখতে শুরু করে দাও। এই সুবর্ণজয়মত্মী বর্ষ দিয়েই শুরু করতে পারো! সবাইকে মনে আছে তোমার?

সারা : এক কথায় হ্যাঁ বলা সম্ভব নয়। কী জানো, ছবি আর নামের তালিকা দিলে আমি সঠিক ব্যক্তিকে চিহ্নিত করতে পারি। এ-কাজে বহুবার আমার ডাক পড়েছে। সবাই জানে, সারা কখনো ভুল বলবে না। ভিক্টর বলে, কী করে তুমি মনে রাখো? কোথাও গেলে সেখানকার রাস্তাও আমি ভুলি না। কিন্তু মোলি, তুমি আমাকে আজ বড়ই অনুপ্রাণিত করলে। মেয়েরা মাকে উৎসাহ দেয় – এ তো স্বাভাবিক। তুমি নিজে একজন সাহিত্যিক হয়ে আমায় লিখতে বলছ, আমি নিশ্চয়ই ভাবতে শুরু করব। হা হা হা! ভাবা যায়? আমি লিখছি!! সে যাই হোক,  এবার পালাই। এই লেখক-কবিদের সামলানো যে কী হ্যাপা! আর আমি চলি ঘড়ির কাঁটা মেনে। কে যে কী করবে! সববাইকে পইপই করে বলছি, কাগজপত্র নাও, তবুও ব্যাংকে গিয়ে দেখব এ এটা আনেনি, সে ওটা আনেনি।

মোলি : পাসপোর্ট, ভিসা, ডিএস-২০১৯, এই তো?

সারা : গুছিয়ে রাখো, এখুনি গুছিয়ে রাখো। আর তোমার ফোনটা নিয়ো। তোমাদের দ্বিতীয় দলের ব্যাংকের কাজ হয়ে গেলে ফেরার পথে তোমাকে হেল্প ডেস্কে নিয়ে যাব। এদিকে জিনেটের ল্যাপটপ কাজ করছে না। তাকেও নিয়ে যেতে হবে।

মোলি : আমার ফোন চালু হয়ে গিয়েছে সারা।

সারা : তাই নাকি! বাহ্! তুমি নিজেই করলে!

মোলি : না সারা। কাল দিলীপিতারোমের গাড়িতে ফিরছিলাম। সে এসে সারিয়ে দিয়ে গেল।

সারা : দিলীপিতারোম? মানে ড্রাইভার মুর? তুমি ঠিক লোকের সাহায্য পেয়েছ মোলি। সে এক আশ্চর্য মানুষ। তুমি যে-কোনো কাজ তাকে দাও, সে করে দেবে। ইঞ্জিনিয়ার ছিল জানো। খুব ভালো ছোটগল্প লিখত। চাকরি নিয়ে ফ্লোরিডায় চলে গেল। ওখানেই ছিল অনেক বছর। তারপর কী যে হলো, সব কাজকর্ম ছেড়ে ফিরে এলো এখানে। এখন এই ড্রাইভারি করছে। কেউ বলে ওর বউ ওকে ছেড়ে গেছে, সেই দুঃখে দিওয়ানা হয়ে গেছে। কেউ বলে কোনো গর্হিত কর্ম করেছিল, তাই কাজের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। জানি না কোনটা সত্যি! তবে সে কোনো অপকর্ম করতে পারে বিশ্বাস হয় না। আচ্ছা, আজ তোমাদের কেনাকাটা, তারপর রান্না, কেমন? তুমি তো রেঁধে খেতে চাইছিলে।

সারা চলে যাওয়ার পর কফি বানাল অমলিনী। দিলীপিতারোমের কথা ভাবতে লাগল সে। একজন সফল ইঞ্জিনিয়ার, এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়িচালক! এক একটি ঘটনা মানুষের জীবন আমূল পালটে দেয়! মুরের জীবনে কী ঘটেছিল তা কি কোনোদিন জানতে পারবে সে?

দিলীপিতারোমের জন্য অমলিনীর হৃদয়ে মায়া ভরে উঠেছে। সে জানালার কাচে গাল ঠেকিয়ে বাইরের যন্ত্রপাতি দেখতে লাগল। শক্তিশালী সুবৃহৎ ক্রেন বড় বড় বাক্স, যন্ত্রাংশ তুলে দিচ্ছে এগারোতলার ওপর। ইমু উঁচু হচ্ছে। আরো আরো উঁচু। নিরন্তর ধাতব আঘাতের শব্দে মাথা ধরে যাওয়ার কথা। এরই মধ্যে লোরেনটিনা, জিনেট, লাইলাক  চু, ইয়েরমেন প্রমুখ রাইটার এই উৎপীড়ক শব্দের জন্য অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে। লিলি হেববার প্রাতরাশ-ঘরে অমলিনীকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এই শব্দে তোমার অসুবিধে হচ্ছে না? তুমি অভিযোগ করবে না? আমরা চাইছি, ইয়াপ চলাকালীন বিশ্ববিদ্যালয় এই নির্মাণ বন্ধ রাখুক। অসহ্য শব্দ। আমরা তো এখানে শামিত্মতে থাকতে এসেছি নাকি?’

লিলি হেববার, জার্মান রাইটার, সবচেয়ে বরিষ্ঠ। রোগা, সুউচ্চ, ঝাঁকড়া চুল লিলি কথা বলে আদেশের ভঙ্গিতে।

অমলিনী সেই আদেশ পাশ কাটিয়ে বলল, ‘অভিযোগ? আমি থাকি কলকাতা শহরে। সেখানে সারাক্ষণ এত শব্দ যে এ নিয়ে অভিযোগ করা আমার নিজের কাছেই হাস্যকর! অসুবিধে তো হয়ই। কিন্তু আমার মনে হয়, এই কাজটি স্থগিত রাখতে পারলে নিশ্চয়ই রাখা হতো। অতিথিদের বিরক্ত করা ওদের উদ্দেশ্য নয়।’

‘তুমি অদ্ভুত মোলি! আমি তোমার ভালোর জন্যই বলছিলাম। এবার তোমার ব্যাপার।’

মোলি একবার লিলির কথাও ভাবল। তার ওই আদেশের ভঙ্গি কি সহজাত? নাকি জার্মান বলে জাত্যভিমান? নাকি বয়সে বড় বলে অভিভাবকত্ব দেখাচ্ছে? সে এসে লেখার টেবিলে বসল। সন্দীপনের মেসেজ আছে কি না দেখল। খাতা-পেন নিয়ে নাড়াচাড়া করল কিছুক্ষণ। ভাবতে লাগল।  তার শুভানুধ্যায়ী বন্ধু যারা, সবাই তাকে একটাই কথা বলেছে। ওখানে লিখো। এমন টানা তিনমাস সময় সহজে পাবে না। এই কথাই সে-ও বলেছে কাম্বা ঘালোন্দাকে। হয়তো কাম্বা সত্যিই লিখবে। সে কী করবে সে জানে না। বাইশ, তেইশ, চবিবশ এই তিনদিন এত কিছু করার রয়েছে যে লেখার অবকাশ পাবে না। বললেই অমনি লেখা পারে না সে। একমাত্র প্রবন্ধ-নিবন্ধ ছাড়া
যখন-তখন কোনো কিছুই লিখতে পারে না। তাকে একটানা ঘরে বন্ধ থাকতে হয়। জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হয়। এ পর্যন্ত উপন্যাস লেখার সময় কখনো কখনো সে কুড়িদিন, এক মাস, এমনকি ছ-মাস বাড়ির বাইরে যায়নি। মনোসংযোগ করতে বড়ই যুদ্ধ করতে হয় তাকে। ধ্যানস্থ না হলে সে লিখতে পারে না। তার সবচেয়ে বড় উপন্যাস লেখার সময় সে ঘরে বসে থেকে দশ কেজি দৈহিক ওজন বাড়িয়ে তুলেছিল।

সন্দীপন প্রথম প্রথম তার ধরন দেখে মজা পেত। তারপর সে বিরক্ত হতে শুরু করল। ‘আমার লেখা আছে, কোথাও যেতে পারব না।’ শুনলেই সে ক্ষেপে উঠতে লাগল।

‘লেখকরা খায় না, ঘুমোয় না, ব্যাংকে যায় না, তারা অসামাজিক এবং বায়ুভক্ষণ করে।’…

‘তুমি কিছুই পারবে না। কারণ তুমি লেখো। আর আমার হাসপাতাল, চেম্বার, মানসিক চাপ, পরিশ্রম সব ফালতু।’ …

‘ক-টাকা রোজগার করো লিখে। কেউ পড়ে আজকাল এসব। কারো গপ্পো পড়ার সময় আছে?’ …

‘সংসারটা ভালো করে করতে চাও না বলেই তোমার বাচ্চা হয় না, বুঝলে।’

‘খুব ভালো লাগে, তাই না। আমারই রোজগারে খাবে আর ফুলবে আর নেচে নেচে সাহিত্যসভা করে আসবে। ঘুম থেকে উঠে ধোপার গাধার মতো আ আ আ গান ধরো। ক-টাকা রোজগার করো তুমি? যা করো সব তো বাপের বাড়ি পাঠাও। শালার বিয়েও করেছি একটা ভিখিরির বাচ্চাকে।’ …

পেন ও খাতা সরিয়ে সে কফি কাপ হাতে জানালার বাইরে তাকিয়ে রইল।

এক পিচ্ছিল পথ বেয়ে দ্রম্নত ক্রমাবনতি হচ্ছিল সম্পর্কের। একত্র বসবাস হয়ে উঠছিল পূতিগন্ধময় আবর্জনা। তুমি যদি শ্রদ্ধা করতে না পারো, তুমি ভালোবাসবে কী করে?

আমি তাকে বলতে চাইছিলাম, ভালোবাসা দিয়ে শুরু করো, হয়তো শ্রদ্ধা এসে জুটবে। না যদি হয়, কী এসে-যায়, ভালোবাসাই তো পথ। সে-পথ নিরুপদ্রব হয় না। লক্ষ্যেও পৌঁছায় না সবসময়।

অমলিনী তার প্রতি সন্দীপনের বিষোদ্গার নিয়ে ভাবছে। যদি তাদের বাচ্চা থাকত, সব অন্যরকম হয়ে যেত? যদি সে লিখে বিশাল উপার্জন করত, সব ঠিকঠাক থাকত? সে যদি পালটা বলে, ডাক্তার হিসেবে কী এমন রোজগার তোমার, কী এমন নামডাক? তুমি ডা. শেঠি হতে পেরেছ, ডা. কোনার, ডা. রেড্ডি? তোমার চেম্বারে কি প্রতিদিন শতাধিক রোগীর পদচিহ্ন পড়ে? চিকিৎসক হিসেবে তুমি অতি নগণ্য সন্দীপন।

না। সে বলেনি কখনো। বলবে না। যে-আঘাতে সে জর্জরিত, সে-আঘাত সে ফিরিয়ে দেবে না। তার ধর্ম আলাদা। সে সন্দীপনকে ভালোবাসত, সেই ভালোবাসাকে অপমান করতে পারবে না। সে সরে এসেছে। তবু মন টানে কেন?

জানালা দিয়ে সে দেখতে পেল প্রথম দলের রাইটাররা ব্যাংক থেকে ফিরে আসছে। তারও যাওয়ার সময় হলো। শাম্বাগ হাউস তাদের প্রত্যেককে একটি ঝোলা ব্যাগ দিয়েছে। সুন্দর কাপড়ের থলে। সাদা থলের প্রান্তগুলিতে কালো পাইপিং। কালো দিয়ে লেখা International writing program lowa থলেটি তার ভারি পছন্দ হয়েছে। সে জরুরি কাগজ তার মধ্যে ভরে নিল। লবিতে নেমে দেখল রাইটাররা অনেকেই থলেটি নিয়ে বেরিয়েছে। সে লক্ষ করল জিনেট তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। চোখে চোখ পড়লে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। সে এগিয়ে গেল না। এই মুহূর্তে কোনো তাগিদ বোধ করল না সে। বাইরে রোদ্দুর ঝলমল করছিল। গত রাত্রির বৃষ্টি সামনের মাঠটি নরম করে তুলেছে। স্টুডেন্টরা মাঠময় খেলতে নেমে গেছে। তাদের খালি পা। হাঁটু পর্যন্ত কাদা। গায়ে-পিঠে কাদার ছোপ। তারা পড়ছে, উঠছে, ছুটছে। আমোদ-উল্লাসের অন্ত নেই।

তারা বেরিয়ে পড়ল। সারা সৈন্যদলের সেনাপতির মতো নেতৃত্ব দিয়ে চলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হর্ম্যের পাশ দিয়ে চলেছে তারা। রাইটারের দল। তাদেরও ব্যাংকে যেতে হয়। বাজার-হাট, রান্নাবান্না, খাদ্য-পানীয় ইত্যাদির চাহিদা আছে। তারাও বড়ই ভালোবাসার কাঙাল।  (চলবে)