আকাসে ফুইটেছে ফুল

‘আমি শুধু হিন্দু মুসলিমকে এক জায়গায় ধরে নিয়ে হ্যান্ডশেক করানোর চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি।’ নজরুলের এমন অসাম্প্রদায়িক চেতনা যেন নতুন করে সঞ্চারিত করল আকাসে ফুইটেছে ফুল নাটক। লেটোর দলকে কেন্দ্র করে আবর্তমান নাটকটি। ভারতের বর্ধমান অঞ্চলের অত্যন্ত জনপ্রিয় নাট্যদল লেটো। বাংলাদেশে লেটোগানের দল নেই। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ছেলেবেলায় লেটোগানের দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বিধায় লেটো নামটি এদেশে ব্যাপক পরিচিত। এ-নাটকে একটি লেটোদলকে কেন্দ্র করে বিংশ শতকের শুরুর দিককার ভারতীয় সমাজজীবন-রাজনীতি চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। এতে একই সঙ্গে নাটক, ইতিহাস, সংস্কৃতি অভেদরূপে দৃশ্যমান। নাটকটি নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের উৎসব উপলক্ষে, নাগরিকের পৃষ্ঠপোষকতা-প্রেরণায় মঞ্চে এনেছে নাগরিক নাট্যাঙ্গন। নাটকটি রচনা করেছেন রতন সিদ্দিকী, নির্দেশনায় হৃদি হক। এটি নাগরিক নাট্যাঙ্গনের ২৬তম প্রযোজনা। ১ ডিসেম্বর,
২০১৯-এ নাটকটির প্রথম প্রদর্শনী হয়। ২০২০ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি এ-নাটকটির তৃতীয় প্রদর্শনী বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল মঞ্চে হয়। ওই প্রদর্শনীর ওপর ভিত্তি করে লেটো-কাজী নজরুল ইসলাম প্রসঙ্গ, নাট্য-উপস্থাপন রীতি-বৈচিত্র্য, মঞ্চ-আলো-অভিনয়, নান্দনিকতা ও দর্শকের উপযোগিতা অনুসন্ধানই এ-লেখার মূল লক্ষ্য।
লেটো পশ্চিমবঙ্গের আঞ্চলিক নাট্য। অনেকে মনে করেন, নাটুয়া শব্দটির থেকে লেটো শব্দ থেকে উৎপত্তি। উনবিংশ-বিংশ শতকে পশ্চিমবঙ্গের তথা চুরুলিয়া, বীরভূম, হুগলি, নদিয়া প্রভৃতি স্থানে এ-পরিবেশনা শিল্পমাধ্যমটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। এটি অভিনয়, গীত, বাদ্য, নৃত্যের সমন্বয়ে পরিবেশিত হতো। অনেকে একে পালাও বলে থাকেন। এতে সাধারণত ঐতিহাসিক কাহিনি, ইসলামি কাহিনি, বীরত্বগাথা, পৌরাণিক কিংবা গ্রামীণ জীবনের অসংগতিমূলক নানা কাহিনি পরিবেশিত হতো। লেটো ছিল পেশাদার নাটকের দল। কৃষকদের ফসল ওঠার সময় শীতের শুরুর দিকে লেটোর আসর বসত বেশি। দর্শকদের মনোরঞ্জনই ছিল এ-পালাগানের উদ্দেশ্য। এ-কারণেই এর পরিবেশনায় রঙ্গরস বা হাস্যরস ছিল প্রধান। লেটোদলের পরিচালককে বলা হতো গোদা কবি। অল্পবয়সী ছেলেরা মেয়ে সেজে নাচত ও অভিনয় করত। তাদের বলা হতো ছুকরি। যারা রাজা, মন্ত্রী, রাজপুত্র, সেনাপতি ইত্যাদি চরিত্রে অভিনয় করত তাদের বলা হতো পাঠক। আর যারা দর্শককে হাসানোর কাজটি করত তাদের বলা হতো সংগাল।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) কিশোর বয়সে লেটোগানের দলে যুক্ত ছিলেন। নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমদ ১৯০৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন। পিতার মৃত্যুর পর স্বাভাবিক পড়াশোনায় ছেদ পড়ে তাঁর। প্রথমে মক্তবে শিক্ষকতা, পরে মাজারের খাদেম এবং এগারো বছর বয়সে লেটোগানের দলে যোগ দেন। লেটোগানের দলে যোগ দেওয়ার পেছনে নজরুলের চাচা কাজী বজলে করীমের ভূমিকা ছিল প্রধান। কাজী বজলে করীম নিজেই ছিলেন দলের গোদা বা প্রধান। প্রথমদিকে নজরুল কাহিনি ও গান রচনা করতেন। ধীরে ধীরে নৃত্যগীতে দক্ষ হয়ে ওঠেন। পরে তিনি দলে অভিনয়ও করতেন। তবে ছুকরি হিসেবে নাচতেন কিনা তার কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। দলে তাঁর সৃজনশীল ভূমিকা এতই প্রবল ছিল যে, দল থেকে তাঁকে ওস্তাদ খেতাবে ভূষিত করা হয়। নজরুলের কারণেই তাঁর চাচার দলটি সে-সময় জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করে। নজরুল দল ছেড়ে দেওয়ার পর তাঁকে নিয়ে নানা গান রচিত হয়েছিল। লেটোভিত্তিক নজরুলের রচনাগুলোর মধ্যে অন্যতম – চাষার সঙ, শকুনি বধ, দাতা কর্ণ, রাজপুত্র, কবি কালিদাস, আকবর বাদশা প্রভৃতি পালা।
নাগরিক নাট্যাঙ্গন বাংলাদেশের গ্রুপ থিয়েটারে অতিপরিচিত একটি নাম। ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠার পর অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় নাটক উপহার দিয়েছে দলটি। শুধু নাট্যপ্রযোজনা নয়, নাট্যবিষয়ক বিভিন্ন কর্মকা-ে অংশগ্রহণ ও নানা আয়োজনের জন্য নাগরিক নাট্যাঙ্গন সুবিদিত। ধারাবাহিকভাবে নাট্যোৎসব, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম যেমন তাদের কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে, তেমনি আছে নিয়মিত প্রকাশনা। নাট্যবিষয়ক শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠা করেছে ‘নাগরিক নাট্যাঙ্গন ইনস্টিটিউট অব ড্রামা’।
মাত্র আটটি দৃশ্যের অনবদ্য লেটোকাহিনি আকাসে ফুইটেছে ফুল। নাটকটির কাহিনি সরলরৈখিক মনে হলেও অত্যন্ত জটিল বৃত্তে প্রবহমান। বঙ্গভঙ্গ কীভাবে শিল্পীজীবন কিংবা সমাজজীবনে প্রভাব ফেলেছিল তা দেখানো হয়েছে এ-নাট্যে। আবার প্রতিটি দৃশ্যে আলাদা আলাদা নাটকীয় একক তৈরি করা হয়েছে। বঙ্গভঙ্গের ফলে মুসলিম লীগের নতুন অনুশাসনে কীভাবে দলের মূল গায়েন রহিম পরিবর্তিত ধর্মান্ধে পরিণত হয়, লেটোর দলের নানা পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতির বাস্তবতাও এ-নাটকে পরিস্ফুট। আকাসে ফুইটেছে ফুল নতুন কোনো সম্ভাবনাকে ইঙ্গিত দেয়। হিন্দু-মুসলমানের পুনরায় মিলনের সম্ভাবনাকে চিহ্নিত করে।
নাটকটির মনস্তত্ত্বে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে শৈল্পিক কণ্ঠস্বর প্রতিবিম্বিত হয়েছে। নাট্যকার নিজেই তাঁর স্বীকৃতিতে বলেছেন, ‘ব্যক্তিজীবনে আমার বিশ্বাস এবং আমার অন্তরঙ্গ উপলব্ধির প্রকাশ ‘লেটো কাহন’।’ এ-নাটকের অন্যতম কুশলী দিকটি হচ্ছে, বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে হিন্দুদের আন্দোলনকে যেমন তুলে ধরা হয়েছে, তেমনি বঙ্গভঙ্গের পক্ষে মুসলমানের যুক্তিও চমৎকারভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। রহিম যখন ধর্মীয় অন্ধত্বের শিকার, তখন সে বলে ওঠে –
: এহ! মানি না …! ভুইলা গেছে সব। সেই ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে মুচলমানদের, হামাদের, হটিয়ে সব ক্ষমতা লিয়ে লিয়েছিল কারা বে? ওই সাদা মুলো বিটিশগুলো। আর লাভটা হয়েছিল কার? হেঁদুগুলোর।টাকা-জমি-মাগি, সব লিয়ে গেইছে। আর হামরা, মুচলমানরা কি পেইয়েছি? পোঁদে বাঁশ।
নাটকটি শুরু হয় এদেশীয় মানুষ যে ব্রিটিশদের রাজনীতি-দাবার ঘুঁটি তার নৈর্ব্যক্তিক প্রকাশের মাধ্যমে। তারপর ধীরে ধীরে দৃশ্যের পর দৃশ্যে ফুটে উঠতে
থাকে লেটোর নানা অনুষঙ্গ, প্রতিকূলতা; সঙ্গে তৎকালীন সমাজ ও রাজনৈতিক বাস্তবতা। লেটোকর্মীদের জীবন-সংগ্রাম, দুঃখণ্ডভালোবাসা অসাধারণ পরিমিতির মধ্য দিয়ে নৃত্য-গীত-হাস্য-অভিনয়ে দৃশ্যগ্রাহ্য হয়ে ওঠে। যে-লেটোর দল সারাক্ষণ হাস্য-কৌতুক-উচ্ছ্বাসে মাতিয়ে রাখে ব্যক্তিজীবন কিংবা দর্শকঘেরা শিল্পীজীবন, চুরুলিয়া-আসানসোল নানা জায়গায় জনপ্রিয়তার তুঙ্গে যখন তারা, ঠিক এমন সময় হঠাৎ ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা করে বঙ্গভঙ্গ। থমকে দাঁড়ায় যেন সবকিছু। সৃষ্টি হয় ধর্মভিত্তিক দল মুসলিম লীগ। লেটোগানের মূল গায়েন দল ছেড়ে দিয়ে ধর্মের আশ্রয় নেয়। ধীরে ধীরে ধ্বংসের মুখে পড়ে দলটি। সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি বিকশিত হতে থাকে সর্বত্র। মানুষের আনন্দ-উচ্ছ্বাস, প্রেম-ভালোবাসাও বন্দি হয়ে পড়ে ধর্মের গ্যাঁড়াকলে। ধীরে ধীরে বাঙালি হিন্দু ও মুসলমান জড়িয়ে পড়ে পরস্পর-বিরোধিতায়। আন্দোলন, অসন্তোষের চাপে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রহিত হলেও ততদিনে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়েছে। হিন্দু পরিচয় লুকিয়ে রাখতে হয় লেটোর দলে। আবার ইসলাম ধর্মের নতুন ফতোয়ায় উপেক্ষিত হয় লেটোগান। সমাজের গোড়ায় ধরে পচন। ধর্মীয় উগ্রবাদীদের দ্বারা আক্রান্ত হতে থাকে লেটোর দল। ধীরে ধীরে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অত্যন্ত জনপ্রিয় এ-নাট্যাঙ্গিক ‘লেটো’ প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। এমন সংকটাপূর্ণ সময়ে নতুন সুর, নতুন আশাজাগানিয়া হয়ে উঠে আসেন চুরুলিয়ার দুখু মিয়া। হিন্দু-মুসলমান মিলনের নতুন সুর-ছন্দ উদ্ভাসিত হয় লেটোগানে।
মঞ্চদৃশ্যে প্রাচীন বৃক্ষকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ পটভূমি নির্মাণ করা হয়েছে। নাটকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নানা ঘটনা ও উপঘটনা বিদ্যমান। নাট্যকার নাটকের নামকরণে ভিন্নতা তৈরি করেছেন। নতুন কোনো সম্ভাবনাকে ইঙ্গিত করে আকাসে ফুইটেছে ফুল এবং ‘লেটো কাহন’ দ্বিতীয় খণ্ডকৃত শিরোনাম ব্যাখ্যায় লেটোদলের কাহিনি-গল্প কিংবা কেন্দ্রিকতাকে বুঝিয়েছেন নাট্যকার। তাঁর মূল মনোযোগ ছিল লেটোগানের দলকে কেন্দ্র করে সমকালীন রাজনীতি ও সামাজিক জীবনের ঘূর্ণাবর্ত উপস্থাপনে। এ যেন ইতিহাসকে তুলে ধরে সাম্প্রদায়িকতার মানুষী প্রবণতা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা। অসাম্প্রদায়িক চেতনার স্ফুরণ ঘটেছে সুপার অবজেক্টিভ হিসেবে।
হাস্যরসে অনবদ্য এ-লেটোকাহন। নাটকটির শুরুতেই দেখানো হয় সাদা দল ও কালো দল। কালো দল হামাগুড়ি দিয়ে একদিকে এগোয়, সাদা দল অন্যদিকে। সাদা দল বলে ‘বন্দে মাতারম’ আর কালো দল ‘নারায়ে তাকবির আল্লাহ আকবার’। দু-দল মঞ্চের মাঝখানে গিয়ে এক হয়। মানুষকে নিয়ে এ-খেলা ঔপনিবেশিক শাসকদের। এ সময় মনস্তত্ত্বে পরিস্ফুট হয় হিন্দু-মুসলমান বিভেদের পেছনে কারা দায়ী এবং দু-দলের মিলনের আকাক্সক্ষা প্রবল থাকলেও চক্রান্ত কাদের।
প্রসেনিয়াম স্টাইলে বাস্তববাদী ধারায় নাটকটি উপস্থাপিত। তবে বাঙালির চৌদিক খোলা মঞ্চের মতো মঞ্চের পেছনেই গানের দল বসা। তারা আলখেল্লার মতো পোশাক পরিহিত। নাটকে যেমন রেকর্ডেড মিউজিক ব্যবহৃত হয়েছে, তেমনি সংগীতের দলও গেয়েছে। বাংলাদেশে লেটোদল নিয়ে নাট্য-প্রযোজনা ইতোপূর্বে দেখা যায়নি। তবে প্রাচ্যনাটের সার্কাস সার্কাসের দলীয় জীবনচরিত্র বাংলাদেশের দর্শককে ভাবিয়েছিল একসময়। ঠিক তেমনি এ-নাটকটি দর্শনেও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠবে মানবমন। নাটকটিতে রূপসজ্জাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বিশেষত নজরুল চরিত্রের মেকআপ-গেটআপের বিশেষ ভূমিকাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। সমস্ত নাটকেই আলোয় নানা ব্যঞ্জনা তৈরি হয়েছে। কয়েকটি দৃশ্যের আলো পরিকল্পনা বহুমাত্রিক অর্থ তৈরি করেছে। এর মধ্যে একটি দৃশ্য হলো, শাহিদা-আমানুল্লাহ রোমান্টিকতায়, আরেকটি নদীকল্লোল-তরঙ্গ। তবে মঞ্চ সারাক্ষণই প্রায় আলোকিত ছিল। সময়কে ধারণ করা পোশাক-পরিকল্পনা অসাধারণ। গান, নৃত্য, কোরিওগ্রাফি, ব্লকিং এ-নাটকে বৈচিত্র্য তৈরি করেছে।
নাটকটিকে যেসব চরিত্র প্রতিনিধিত্ব করেছে তার মধ্যে আমানুল্লাহ অন্যতম। এ-চরিত্রে অভিনয় করেছেন হাবীব বাহার। তাঁর সংলাপ প্রক্ষেপণ ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। তবে দেহভঙ্গিমা অনেক সময়ই নায়কোচিত ছিল না। অধিক সময় ধরে একটু ঝুঁকে চলনগুলো ছিল দৃষ্টিকটু। ফলে বেশিরভাগ সময় তাঁকে বৃদ্ধের মতোই মনে হয়েছে, লেটোদলের সদস্য নয়। চরিত্রটিতে মহত্ত্ব প্রস্ফুটিত হয়েছে। তার প্রকৃত নাম অনিমেষ ঘরামি। রানীগঞ্জের এক হিন্দু পরিবারে জন্ম। শৈশব থেকে সে লেটোগানের অনুরাগী ছিল; কিন্তু লেটোদল ছিল মুসলমানদের। সেখানে হিন্দুর কোনো স্থান ছিল না। তাই নিজের নাম পরিবর্তন করে আমানুল্লাহ সেজে দলে কাজ করত এবং শাহিদাকে মনেপ্রাণে ভালোবাসত। বঙ্গভঙ্গে হিন্দু-মুসলিম বিভেদে দল বন্ধের উপক্রমে একদিন আসল সত্যিটি নিজ মুখেই প্রকাশ করে –
: ওই হিদুর বিটাছিলাটা খুব ভয় পায়েছিল। ও ভেইবে ছিল হিদুর বিটাছিলা বলে ওকে দলে যদি কেউ না লেয়। আরে খুব ভয় পায়েছিল উস্তাদ, খুব ভয় পায়াছিলাম। হামি আমানুল্লাহ না উস্তাদ। হামি হিদুর ছিলা … অনিমেষ ঘরামি।
সবাই যেন বজ্রাহত। শাহিদার ভালোবাসা যেন শ্যাওলার মতো ভেসে যায়। শাহিদা বলে –
: তুমি আমাকে এমন করে ডোবালে কেন? এমন করে ঠকালে কেন? আমার পরিবার – আমার সমাজ – আমার ধর্ম … জানি না, জানি না এখন আমি কী করব …
রহিম চরিত্রে অভিনয় করেছেন আসিব চৌধুরী। সুস্পষ্ট সংলাপ, সাত্ত্বিক স্থিতধী এবং প্রাণবন্ত অভিনয় করেছেন। তাঁর উক্তি-প্রত্যুক্তিগুলো নাটকটিকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে। যে রহিম ছিল লেটোদলের নির্ভরশীল প্রধান গায়েন, সে মুসলিম লীগের ফতোয়ায় মুহূর্তে দল ছেড়ে দেয়। আরো অনেককে দল ছাড়াতে চেষ্টা করে। ধর্মই তার কাছে প্রধান হয়ে ওঠে। একসময় জিনা করার অপরাধ ধরে আমানুল্লাহ ও শাহিদার ভালোবাসাকেও নষ্ট করে দিতে তৎপর থাকে। দলবল নিয়ে লেটোগানের দল ভেঙে দেয়। নাটকের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মূলভাবকে প্রকাশ করতে রহিম চরিত্রই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। রহিম নিজেই একসময় আক্রমণ করে তার দীর্ঘদিনের সঙ্গী লেটোর দলে।
সাদেক চরিত্রে অভিনয় করেছেন জুয়েল জহুর। অত্যন্ত বাস্তববাদী তাঁর অভিনয়। হাসি-ঠাট্টা-অভিনয় দিয়ে সারাক্ষণ মাতিয়ে রাখেন দর্শকদের। নাটকে গল্পের অন্তর্নিহিত ভাবপ্রকাশে চরিত্রটির ভূমিকা অত্যন্ত বলিষ্ঠ।
বাঙালি বাবুসাহেব চরিত্রে অভিনয় করেছেন সুমন আহমেদ। হাঁটু পর্যন্ত ছেঁড়া লম্বা প্যান্ট পরে মাথায় হ্যাট দিয়ে ইংরেজি-বাংলা মিশ্রিত সংলাপ ও চলনে অত্যন্ত হাস্যরস তৈরি করেন তিনি। ব্রিটিশ শাসনের বাবু কালচার কে না জানে! চরিত্রটি সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সৃষ্টিরও প্রতিভূ বটে। কলকাতার থিয়েটার, যাত্রা ও লেটোর মধ্যে পার্থক্য-গুরুত্ব-অবস্থা ব্যাখ্যাত হয়ে উঠেছে এ-নাটকে।
নাটকটিতে রোমান্টিক আবহ তৈরি করেছে শাহিদা চরিত্রটি। এ-চরিত্রে অভিনয় করেছেন নির্দেশক হৃদি হক নিজেই। অত্যন্ত প্রাণবন্ত ও রোমান্টিকতায় আবিষ্ট এ-নারীর কাছে পৃথিবী মানেই প্রেম। পৃথিবী মানেই নারী-পুরুষ সম্পর্ক। কাহিনিতে –
আমানুল্লাহ : শাহিদা, মেরে জান। কখন করলে আগমন?
শাহিদা : আমারে বিহা করতে না তোমার লোল পড়ছে না। আমারে তুমি বিহা করবার চাও না?
আমানুল্লাহ : না না না। আমি কবি। অন্তরে তোমার ছবি। লেটোর দলে আছি। বাবা ছিল গাছি। সে কাজে বসতো না মোর মন। মক্তবে থাকিনি কোনো ক্ষণ। যেও না যেও না জান। চলে গেলে রাখবো না প্রাণ।
নাটকটিতে যেমন ইতিহাস আছে, তেমনি আছে সংস্কৃতির লড়াই। আছে ন্যাকড়ার পুতুলের মতো রাজনৈতিক পট পরিবর্তন।
দুখু চরিত্রে অভিনয় করেছেন কামরুজ্জামান রনি। কামরুজ্জামান রনি এ-নাটকের সংগীত-পরিকল্পকও বটে। প্রাণবন্ত তাঁর অভিনয়। কাজী নজরুল ইসলামের মতোই বিশ্বাসযোগ্য পোশাক, চুলের স্টাইল ও সংগীতের অনুরণন আছে। আরো বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন – ফায়জুল রথী, মোসাদ্দিক শাহীন, সাদ্দাম হোসাইন, ফারহানা নিশা, সুব্রত দাস, রাজিবুল রাজ, আরাফা ও রহমান, তানজিনা তৃষা, রিশাদ আবদুল্লাহ, সুতপা বড়–য়া, মনিকা চৌধুরী, শুভ, আমীর প্রমুখ। নাটকটির মঞ্চপরিকল্পনায় সাজু খাদেম, পোশাক পরিকল্পনায় আইরিন পারভীন লোপা এবং আলোক পরিকল্পনায় ইশরাত নিশাত।
সাধারণ বেশভূষা হলেও সংলাপগুলো উচ্চমার্গীয়, শৈল্পিক এবং অত্যন্ত স্পষ্ট। সংলাপ গঠনে লেখকের অসাধারণ দক্ষতা প্রকাশিত হয়েছে।
বর্ধমানের কথ্যরীতিতেই নাটকের সংলাপ। বাবুর সংলাপে ইংরেজি-বাংলার মিশ্রণ আছে।
সাহেব : লিসেন আমি কলকাতায় থাকি, ১২ কেলাস কম গ্র্যাজুয়েট, কমপ্লিট কইরেছি বিয়ে।
সখি : ওমা বিয়ে।
সাদেক : এটা বুইঝেছি উস্তাদ। এটা বুইঝেছি। বিহা কইরেছে। তা ভাবি সাহেবা কী করেন? কার মেয়ে? কলিকাতার মেয়ে নাকি?
সাহেব : তুমি কি বইলছ এইকি। ইহা কোনো লেডি নায়। নায় কোনো কলিকাতার বিটিছিইলা। হা হা হা বিয়ে মানে ম্যারেজ নায়। ডিগ্রি, গ্র্যাজুয়েশন।
নির্দেশক হৃদি হক লেটোভিত্তিক থিয়েটার নির্মাণকেই বড় করে দেখেছেন। সঙ্গে ঘটনার পরিক্রমণে ইতিহাস উঠে এসেছে। নাটকীয় মুহূর্তগুলো তৈরিতে অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়েছেন তিনি। রূপক নানা আচরণের মধ্য দিয়ে তৎকালীন সমাজবাস্তবতার নানা দিক ইঙ্গিত করেছেন এবং রূপক আচরণেই অধিকাংশ হাস্য তৈরি করেছেন। ব্রিটিশ শাসনের প্রসঙ্গ এবং হিন্দু-মুসলমানের মিলনের অন্তরায় অত্যন্ত চমৎকার প্রতীকী তাৎপর্যে তুলে ধরেছেন।
নির্দেশক হৃদি হক বলেন, ‘… বহিরাগত ইংরেজরা ভাগ করতে চেয়েছিল বাংলাকে; ভাগ করতে চেয়েছিল মানুষকে। আজো এতদিন পর যখন এ-মাটিতে মানবতাবিরোধী অপরাধে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হয়, তখন দেশ এগিয়ে চলে বিপুল গতিতে আন্তর্জাতিক রাজনীতি থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক মুক্তির দিকে, তখনো কি কূপম-ূকতার অতল অন্ধকারে নিমজ্জিত ধর্মান্ধতার উন্মত্ত আস্ফালনে তৎপর অপশক্তি, একইভাবে ধর্মের নামে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টিতে ভাঙনের খেলা খেলে যায় না? … নাগরিক নাট্যাঙ্গন বিশ্বাস করে প্রযোজনার বিচিত্রতায়। তাহলে লোকনাট্যের ধাঁচে কিছু নয় কেন? সঙ্গে যুক্ত হলো গল্পের মূলভাবনার সঙ্গে দলের আদর্শ মিলেমিশে যাবার অকাট্য যুক্তি। … আবিষ্কারের উন্মাদনায় জানলাম লেটোকে, সংখী, সরদার, নায়ক, পাঠক, বেঙাচি, বুইড়া, আসামি, পেন্টার, মাস্টার, দোহার, ম্যানেচারকে। বঙ্গভঙ্গের সময়ের চুরুলিয়া থেকে ঢাকার পরিবাগ। … আকাসে ফুইটেছে ফুল লেটো কাহন নাটকে এর অন্তর্নিহিত সত্য উন্মোচনের চেষ্টা ছিল আমাদের। এর অভিঘাতে যদি দর্শক তৃপ্ত হয়, তাহলেই সার্থক সবটুকু আয়োজন।’
শিল্পবৈশিষ্ট্যে এ-নাটকে প্রধান রূপে প্রতীয়মান হয়েছে রূপক-সাংকেতিকতা। তার মধ্যে যেমন চরিত্রের রূপক আছে, তেমনি ঘটনাগত রূপকও আছে। আবার সংলাপেও নানা রূপকের আশ্রয় নিয়েছেন নাটককার ও নির্দেশক। নানাভাবে নাটকীয়তা তৈরি হয়েছে। দাদু চরিত্রটি অন্যতম। মহাত্মা গান্ধীর প্রতীকে তার পোশাক ও আচরণ। সে সারাক্ষণ ছাগল খোঁজে।
: শাহিদা, ও শাহিদা, আমি সারাপথ ছাগলটাকে দড়ি বেঁইধে টেইনে আনলাম, আর ঘরে গিয়ে দেখি ছাগল নেই। ছাগলটা গেল কোথায়?
কংগ্রেস, বঙ্গভঙ্গ, মুসলিম লীগ গঠন, ভারতীয় রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প বুননের ইতিহাস যেন অনুপম গাঁথুনিতে দৃশ্যকাব্য হয়ে উঠেছে এ-নাটকে। হাস্যরঙ্গ, নৃত্যগীত, অভিনয় ও ইতিহাস-সংস্কৃতির অপূর্ব সমন্বয় আকাসে ফুইটেছে ফুল।